সাগর এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা
এক
‘গুরুদেব, চিনি দিই?
দাও। যদিও আমার আবার চিনি খাওয়া মানা। জ্যোতি আর দ্বিজেন দুজনেই বারণ করেছে। কিন্তু কফিতে একটু চিনি না হলে চলে না বাপু। জ্যোতি, দ্বিজেনদের চেনো তো?’
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, ‘অপরাধ নেবেন না গুরুদেব, ঠিক চিনতে পারলাম না।’
কবিগুরু হেসে বললেন, ‘জ্যোতিপ্রকাশ আর দ্বিজেন্দ্রনাথ বহুদিন ধরে আমার চিকিৎসা করেছে। গুণী মানুষ। আমার ওষুধ পথ্য সবই ওদের হাতে ছিল। তবে কিনা বিধি নিষেধ বড্ড বেশি। এটা হবে না, ওটা হবে না শুনতে শুনতে আমার কাহিল অবস্থা। বুঝলে সাগর, জীবনের এটাই হল সমস্যা। সে যত দীর্ঘ হয়, অনেক স্বাদ আহ্লাদ ছোটো হতে হয়। শখ করে যে নবীন ময়রার দুটো রসগোল্লা খাব সে উপায়ও নেই।’
আমি বললাম, ‘গুরুদেব, একটা বিস্কুট খাবেন?’
কবিগুরু তার ঘন ভুরুদুটো কোঁচকালেন। বললেন, ‘বিস্কুট? কী বিস্কুট দেবে? আচ্ছা, দাও। তোমাদের ওই কুকিজ্ না কী যেন আছে, তাই দাও একখানা। আমাদের আমলে এসব জিনিসের বালাই ছিল না। ইংল্যান্ডে গিয়ে কেক বিস্কুট পেয়েছি বটে, তবে এত রকমারি আইটেম তখনও বেরোয়নি। বুঝলে সাগর, সেই সময় কুইন্স বেকারি নামে বিখ্যাত এক কোম্পানি ছিল। তারা মহারানির কাছে বিস্কুট পাঠাত। টিনের কৌটোতে ছোটো ছোটো গোল বিস্কুট। কৌটো দেখতে ছিল চমৎকার। গায়ে ফেয়ারি টেলসের ছবি। রাজকুমার রাজকন্যাকে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছোটাচ্ছে। হাসিমুখের রাজকন্যার হাতে কুইন্স বেকারির কৌটো। যেন সোনাদানার বদলে বিস্কুটের কৌটো নিয়ে আসতে পেরে সে অতি খুশি। সুন্দর না?’
আমি মুগ্ধ হলাম। রাজকন্যার জন্য মুগ্ধ নয়, কবিগুরু আমাকে গল্প বলছেন বলে মুগ্ধ! বিড়বিড় করে বললাম, ‘খুবই সুন্দর।’
কবিগুরু বললেন, ‘মহারানি আমাকেও দিলেন এক কৌটো পাঠিয়ে। সকালে চায়ে ডুবিয়ে খেতে হবে। আমি তো এদিকে সকালে নিমপাতার রস খাই। একদিন হল কী, খেয়াল না করে মহারানির বিস্কুট দিলাম নিমপাতার রসে ডুবিয়ে। হা হা হা…মুখে তুলে তো হা হা..এক হাতে লন্ডন টাইমস্, অন্যহাতে নিমপাতা রসে ভেজানো বিস্কুট…হা হা হা…।’
গুরুদেব আওয়াজ করে হেসে উঠলেন। কাউন্টারের ফুটফুটে মেয়েটি ফিরে তাকাল। সেও হাসল। যেন নিমপাতার রসে বিস্কুট খাবার অভিজ্ঞতা তারও রয়েছে। এই ধরনের হাসি হল ‘সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা’র মতো, সর্ব ঘটে কাঁঠালিহাসি’। সব ঘটে যেমন কাঁঠালি কলা চাপানো যায়, এই হাসিও তেমন। সব ইস্যুতে ব্যবহার করা যায়। কর্পোরেট ট্রেনিং। শুনেছি, যারা সেলসে কাজ করে তাদের নাকি একমাস ধরে এই কাঁঠালি হাসি’ ট্রেনিং হয়। তারপর পরীক্ষা হয়। ফেল করলে আউট। যাই হোক, মেয়েটি কাঁঠালি হেসে আবার কফি মেশিনে মন দিল। ভাবটা এমন যেন আমি ওপাড়ার দাড়িঅলা, জোব্বা পরা নন্দখুড়োকে নিয়ে কফিশপে কফি খেতে এসেছি। একবার মুখ তুলে হেসেছে, তাই যথেষ্ট।
আজ থেকে বছর চল্লিশ-পঞ্চাশ আগে হলে কফিশপ এখন ভিড়ে ভেঙে পড়ত। পুলিশ ডাকতে হত। লাঠি চালাতে হত। খবরের কাগজের সাংবাদিকরা আসত। চিত্রসাংবাদিকরা আসত। পুলিশ লাঠি চালানোর প্রতিবাদে পথ অবরোধ হত। পরদিন খবরের কাগজে ছবিসহ প্রতিবেদন বের হত। যার হেডিং হতে পারত
‘কফিশপে রবীন্দ্রনাথ, ভাঙচুর, পুলিশের লাঠি, আহত ৩০।’
এখন এসবের ভয় নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এখন বহু মানুষই চেনে না। কম বয়েসের ছেলেমেয়েরা তো বটেই, যাদের বয়স বেশি, তারাও চেহারা ভুলে যেতে বসেছে। এখন তাঁর ছবি, মূর্তি সবই বিমূর্ত। সহজ বাংলায় যাকে বলা যায়, দুর্বোধ্য। মাস ছয়েক আগে এক কাণ্ড হয়েছিল।
একটা কাজের বরাত পেয়েছিলাম। অড জব। সহজ বাংলায় যাকে বলা যায়, উদ্ভট কাজ। আমি বেকার। যে যেমন কাজ দেয় নিই। পাকা চাকরি না হলেই হল। পাকা চাকরিও যা খাঁচায় বন্দি থাকাও তাই। আমি ওতে নেই। এদিক ওদিক করে যেটুকু রোজগার করি তাতেই খুশি। তাছাড়া ‘অড জব’ ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। যাই হোক, এক রবিবার সকালে আমার এক চেনা অধ্যাপক ডেকে পাঠালেন।
‘সাগর, আমার একটা কাজ করে দেবে? কিছু টাকা-পয়সা পাবে।’
সেই সময়ে আমার টাকা পয়সার খুবই টানাটানি চলছিল। ঘরের ভাড়া তিনমাস বাকি, যে হোটেলে ভাত-ডাল খাই সেখানেও ধার। টিউশনের বেতন পাইনি।
আমি বললাম, ‘কী কাজ স্যার?’
অধ্যাপক বললেন, ‘আমি একটা গবেষণা করছি, তার জন্য কিছু ডেটা লাগবে।’
আমি বললাম, ‘কীসের ডেটা? লাইব্রেরি যেতে হবে?’
অধ্যাপকমশাই বললেন, ‘না, তোমাকে ফিল্ডওয়ার্ক করতে হবে সাগর। যাকে বলে, মাঠেঘাটে ঘুরে পরিসংখ্যান সংগ্রহ।’
আমি উৎসাহিত হয়ে বলি, ‘বাঃ, স্যার আপনার গবেষণার বিষয় কী?’
অধ্যাপকমশাই কপালের ওপর গোল চশমা তুলে বললেন, ‘আমার গবেষণার বিষয় হল, বাংলা সাহিত্যে পকেটমারের প্রাসঙ্গিকতা।’
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, ‘বাংলা সাহিত্যে পকেটমার! স্যার বিষয়টা বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে, খুবই কঠিন।’
অধ্যাপকমশাই বললেন, ‘কঠিন কিছু বোঝা তো তোমার কম্ম নয় সাগর তোমার কম্ম হল আমার গবেষণার জন্য ডেটা সংগ্রহ করা। পথে ঘুরে ঘুরে তুমি পকেটমারবার সম্ভাব্য এলাকা খুঁজে বের করবে। স্পট বলতে পার।’
আমি আরও উৎসাহ নিয়ে বলি, ‘স্যার, আমার এক পকেটমারের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে। অতি ভালো ছেলে। তাকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে পারি। সেই ছেলের স্যার বাংলা সাহিত্যেও বিশেষ আগ্রহ। জীবনানন্দ দাশ তার অতি প্রিয় একজন কবি। বাংলার মুখ কবিতাটা অনেকটা মুখস্থ বলতে পারে। একবার বছর খানেকের জন্য জেলে ছিল, সহবন্দিদের আবৃত্তি শিখিয়েছিল। ওকে সঙ্গে নিই স্যার?’
একজন পকেটমারের বাংলা সাহিত্যে আগ্রহ আছে ব্যাপারটা অধ্যাপকমশাই একেবারেই মেনে নিতে পারলেন না। মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘নো। কাউকে সঙ্গে নেবে না। একজন পকেটমার তোমাকে সেই সব স্পট দেখাবে, যেখানে সে এতদিন কাজ করেছে। ভিড় বাস ট্রাম, লোকাল ট্রেন। আর তুমি বের করবে, নতুন নতুন স্পট। যেখানে পকেটমারবার ঘটনা কেউ ভাবতেও পারে না। যেমন ধর তুমি…তুমি কোন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, টিচার্সরুম বা সেমিনার হলকে একটা সম্ভাব্য স্পট হিসেবে বাছলে…অথবা ধর, চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ড, যেখানে পকেটমারবার ঘটনা ঘটতেই পারে না, অথচ তুমি ভাবলে হতে পারে…অথবা ধর, তুমি মনে করলে, রাগ সঙ্গীতের কোনও আসর, যেখানে শুধুই বিশিষ্ট শ্রোতারা আসেন। সেখানেই হয়তো হঠাৎ হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। কী ব্যাপার না পণ্ডিত রমাকান্ত চট্টোপাধ্যায় সবে বাগেশ্রী ধরেছেন আর তখনই তার পকেট থেকে…। সবটাই তোমার উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভর করবে সাগর।’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, ‘স্যার কাজ খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে পেমেন্ট কেমন যদি বলেন কাজে উৎসাহ পাই।’
অধ্যাপকমশাই বললেন, ‘সম্ভাব্য স্পট যদি আমার পছন্দ হয় আর তোমার ডিটেলিং যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে স্পট পিছু তোমাকে টাকা দেওয়া যাবে। টাকা নিয়ে চিন্তা করও না সাগর, গবেষণার জন্য নানা ধরনের গ্রান্টের ব্যবস্থা রয়েছে।’
আমি হাত কচলে গদগদ গলায় বললাম, ‘অপরাধ নেবেন না, আমি কি স্যার পিকপকেট গ্রান্ট থেকে টাকা পাব?’
অধ্যাপকমশাই বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘কোথা থেকে তুমি টাকা পাবে তোমার ভাববার দরকার নেই।’
আমি বললাম, ‘তা তো ঠিকই। টাকা তো টাকাই। কোথা থেকে পেলাম সেটা বড় কথা নয়। স্যার, এই সব সম্ভাব্য স্পট আপনি গবেষণায় কীভাবে কাজে লাগাবেন?’
অধ্যাপকমশাই উদাসীন ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি বলতে চাইব, বাংলা সাহিত্য নানবিধ বিষয়কে তার অঙ্গনে ঠাঁই দিয়েছে, কিন্তু পকেটমারবার মতো গভীর সম্ভবনাকে…যাক, এখনই সবটা বলব না। বিষয় লিক হয়ে যেতে পারে। সাগর, তুমি তোমার মতো কাজে নেমে পড়।’
সেই কাজেই আমি একদিন এক আর্ট এগজিবিশনে ঢুকে পড়েছিলাম। আর্ট গ্যালারিতে পকেটমারবার ঘটনা কখনও ঘটেছে বলে শোনা যায় না। এই জায়গা হল শিল্প বোধ, শিল্প চেতনা, শিল্প উন্মেষের পবিত্র জায়গা। এখানে পকেটমার নিজেই লজ্জা পাবে। এই গ্যালারিতেই দেখি পাটের ব্যাগ কাঁধে, লম্বা বেণীর তরুণী লেফট রাইট মোডে ছবি দেখছে। আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম।
‘ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
তরুণী আমার দিকে বিরক্তি ভরে তাকাল।
‘বলুন।’
আমি বললাম, ‘এটা কীসের ছবি?’
তরুণী আরও বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কীসের নয়, কার। এটা রবীন্দ্রনাথের ছবি।’
আমি চোখ বড় করে বললাম, ‘রবীন্দ্রনাথ! মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? টেগোর?’
তরুণী বলল, ‘আর কোনও রবীন্দ্রনাথকে আপনি চেনেন?’
আমি হতভম্ব হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘শুধু একটা রেখায় অতবড় মানুষটাকে ধরে ফেলছে!’
তরুণী তার টানা চোখ তুলে আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আমি একজন অদ্ভুত প্রাণী। তারপর বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে, ওটাও বেশি হয়েছে। আর্টিস্ট এখানে মিস্টেক করেছে। ওই দাগটা না থেকে যদি শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডটুকু থাকত, তাহলেই রবীন্দ্রনাথকে চেনা যেত।’
আমি তো শুনে আরও ব্যোমকে গেলাম। এই সুন্দরী বলে কী! কিছু ছাড়াই রবীন্দ্রনাথকে চেনা যেত! আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তরুণী অতি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাকে অবজ্ঞা করে পরের ছবির দিকে এগিয়ে গেলেন। বয়েসে আমার থেকে ছোট বা সমানে সমানে হলেও মনে মনে মেয়েটিকে শ্রদ্ধা জানালাম। আহা! কী শিল্পবোধ! ছবি দেখবার কী লেফট রাইট কায়দা! আমি সরে গেলাম। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম, ছবির আর্ট গ্যালারি পকেটমারদের জন্য কতটা সুবিধেজনক?
পরে এই তরুণীটির সঙ্গে আমার আলাপ এবং কিছুদিনের জন্য প্রেমও হয়। সে অন্য গল্প। রবীন্দ্রনাথকে কতটা দুর্বোধ্য করা যায়, সেই প্রসঙ্গেই এই গল্পের কথা বললাম। শুধু একটুকুখানি বলে রাখি, সেদিন যখন আর্ট গ্যালারি থেকে বেরোচ্ছি, হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তনাদে চমকে উঠি। ফিরে তাকিয়ে দেখি সেই লেফট রাইট তরুণী। তার পাটের লম্বা ব্যাগ থেকে নাকি কোন পকেটমার মানিব্যাগটি হাতিয়ে নিয়েছে। ছবি দেখায় এতটাই মন দিয়েছিল যে পকেটমারকে ধরতে পারেনি। আমি চমকে উঠলাম। আর্ট এগজিবিশনে পকেটমার!
কবিগুরুর ছবি ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে ছবি মাঝেমধ্যে দেখা যায় বটে, তবে সে সবই ঠাট্টা ইয়ার্কির। হয় তিনি কাঁধে ঝোলা নিয়ে পালাচ্ছেন, নয় তিনি কাউকে আঙুল তুলে ধমকাচ্ছেন। এতে সত্যিকারের মুখ চেনা যায় না। এই কারণেই আমি এখন নিশ্চিন্ত।
আমি গুরুদেব বসে আছি সল্টলেকের এক সিসিডিতে। কাচে ঘেরা ঝকঝকে সিসিডি। একেবারে কোনার দিকে বসেছি সোফায়। গুরুদেব দরজার দিকে উলটো মুখ করে বসে আছেন বলে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কাল রাতে গুরুদেব আমাকে টেলিফোন করেন মনফোনে। ‘মনফোন’ বস্তুটি কী তা এখন অনেকেই জেনে গেছে। তারপরেও একবার বলি। মনফোন এমন একটা টেলিফোন যা শুধু মনের ভিতরেই থাকে। এই ফোন থেকে যখন খুশি, যাকে খুশি টেলিফোন করা যায়। তবে কে ফোন করবে আর সেই ফোন কে ধরবে সেটা নির্ভর করছে ওই দুটো মানুষের ওপর। তাদের ইচ্ছে হলে তবেই মনফোনে কথা সম্ভব। ও আর একটা কথা, মনফোন মুক্ত। সে জীবিত, মৃতের তফাৎ করে না।
কবিগুরু ফোন করলেন বেশি রাতে।
‘সাগর, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
আমি ভাঙা তক্তাপোষে ধড়ফড় করে উঠে বসে বললাম, ‘গুরুদেব, আপনি ঘুমে জাগরণে সবসময়েই আছেন।’
কবিগুরু বললেন, ‘কলকাতায় এসেছি। কাল একবার দেখা করো। একটা সমস্যায় পড়েছি বাপু।’
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘কখন, কোথায় যাব গুরুদেব? জোড়াসাঁকো? ময়দান? যদি বলেন, গঙ্গার ধারে কোথাও গিয়ে বসতে পারি।’
কবিগুরু বললেন, ‘নানা, ওসব অনেক হয়েছে। নতুন কোনো জায়গা বলো যেখানে আমি আগে কখনও যাইনি, দেখিওনি।’
গুরুদেবকে নিয়ে কফিশপে এসেছি। কফিশপ একবারে ফাঁকা। কফি নিয়ে বসেছি দুজনে।
কবিগুরু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সাগর, এবার আমার সমস্যাটা শোনো। দুটো কবিতা পাঠিয়েছিলাম তোমাদের এখানকার এক পত্রিকায়। পত্রিকার সম্পাদক আমাকে খবর পাঠালে, আপনাকে একবার আসতে হবে। সেই খবর পেয়েই আমি এসেছি।’
আমি অবাক হলাম। কবিগুরু পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছেন! এ আবার হয় নাকি! উনি কী কবিতা পাঠাবেন? এতদিন তো সবাই কবিতা নেবার জন্য তার কাছেই ছুটে গেছে, বসে থেকেছে পায়ের কাছে।
‘আপনি কবিতা পাঠিয়েছেন! নিশ্চয় ওরা চেয়েছিল।’
কবিগুরু বললেন, ‘না ওরা চায়নি। আমিই নিজে থেকে পাঠিয়েছি। হঠাৎ মনে হল, অনেকদিন হয়ে গেল, নিজে থেকে কাউকে লেখা পাঠায়নি। পত্রিকার ঠিকানা দেখে দিলাম পোস্ট করে।’
আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, ‘বলেন কী! আপনি কোথাও কবিতা পাঠিয়েছেন মানে তো বিরাট হইচইয়ের ব্যাপার। কবিতার কথা বাদ দিন, যে খামে পাঠিয়েছেন সেটাও তো মিউজিয়ামে যাবে। যেসব পোস্টাপিস থেকে আপনার খাম চালাচলি হয়েছে সেগুলো হবে ট্যুরিস্ট স্পট। যে পিওনভাই আপনার খাম ডেলিভারি করেছেন, তার জীবনী প্রকাশ করা হবে। পত্রিকার নাম কী? আমি এখনই সেখানে ছুটব।’
কবিগুরু চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘আরে থাম দেখি, আমায় আগে বলতে দাও। সেদিন দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর পত্রপত্রিকা উলটেপালটে দেখছিলাম। তখনই একটির হাতে নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়ি। পত্রিকার নাম আমারই নামে তাও একেবারে পদবিশুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনটা আগে কখনও দেখিনি। আমার কবিতার নামে অনেক পত্রপত্রিকা হয় বটে, যেমন ধর সোনার তরী, খেয়া, পুনশ্চ, তা বলে একেবারে আমার নামে! ব্রাকেট দিয়ে লেখা ‘একটি মাসিক সহিত্যপত্রিকা’। উলটে পালটে দেখলাম। অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ আছে কিন্তু আমার লেখা কোনও কবিতা খুঁজে পেলাম না। নিজের নামের পত্রিকায় নিজেরই কবিতা থাকবে না ভেবে একটু মন খারাপ হল। ঠিকানা দেখে দুটো কবিতা দিলাম পাঠিয়ে।’
এই পর্যন্ত বলে কবিগুরু থামলেন। কুকিজে কামড় দিলেন, কফিতে চুমুক দিলেন। ন্যাপকিন দিয়ে গোঁফ মুছলেন। ফের বলতে শুরু করলেন।
‘কবিতা দুটো আমি নিজের হাতে বেছেছি। একটু বড় হয়েছে। ভাবলাম, আমার নামে যখন পত্রিকা, একটু বড় কবিতাই না হয় দিই। নইলে কিপটে না ভেবে বসে। তাছাড়া, ওরা তো কিপটেমি করেনি। পত্রিকার নাম যদি শুধু রবি দিয়ে ছেড়ে দিত, একটা কথা ছিল, তা তো করেনি। এমনকী রবীন্দ্রনাথ বলেও থামেনি। একেবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়ে ছেড়ছে। আমিই বা ছোটো কবিতা লিখেছি বঞ্চনা করি কেন? ঠিক করেছি কিনা সাগর?’
আমি গদগদ হয়ে বললাম, ‘অবশ্যই ঠিক করেছেন। আপনার মতো বড় ভগবানের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব। ভগবান বললাম বলে রাগ করবেন স্যার। আপনাকে মানুষ বলে ছোট করতে পারব না। আপনি কোনও ধর্মের ভগবান নয়, আপনি মনুষ্যত্বের ভগবান।’
গুরুদেব আমাকে হাত দেখিয়ে চুপ করতে বলল।
‘তারপর কী হল শোনো সাগর। খুবই ঝামেলার একটা কাণ্ড হয়েছে।’
আমি অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কাণ্ড গুরুদেব!’
গুরুদেব এরপর আমাকে যা বললেন তা শুনে আমার হাতের কফি মগ থেকে চলকে পড়ল কফি। আমি খেলাম রাম বিষম। গুরুদেব আমার মাথা থাবড়ে দিলেন, জল খাওয়ালেন, পিঠে চাপড় দিলেন। চোখের জল, নাকের জল সামলে বললাম, ‘এ অসম্ভব!’
কবিগুরু বললেন, ‘অসম্ভব হলে কী আর এখানে ছুটে আসি? না তোমাকে ডেকে পাঠাই সাগর?
সত্যিই তাই। কাণ্ড ভয়ংকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকা থেকে কবিগুরুকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠি এইরকম,
‘মহাশয়, আপনার দুইখানি কবিতা ডাকযোগে আমাদের হাতে এসেছে। কিন্তু কবিতাগুলিতে কিছু গোলমাল রয়েছে। ছন্দে যেমন গোলমাল রয়েছে, গোলমাল রয়েছে অর্থে। কয়েকটি লাইন অতিরিক্ত। ভাবের সঙ্গে কোনও কোনও বাক্যের অসঙ্গতি আমরা লক্ষ করেছি। ফলে কাব্য সুষমায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। আমরা নিশ্চিত, আপনি এই কবিতা ফেসবুকে দেননি। তাই পাঠকদের মতামতও জানতে পারেননি। নইলে এই গোলমালের কথা আগেই জানতে পারতেন। আপনার মতো কবির জন্য ফেসবুকের কমেন্টস খুবই জরুরি। নিজের ভুল সংশোধন করা যায়। নিদেন পক্ষে কোনও কবিতা পাঠের আসরে কবিতা দুটি শুনিয়ে ঝালাই করে নেওয়া উচিত ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবিতা পাঠের আসরে হাততালি শুনলে বোঝা যায়, কবিতা উতরেছে কিনা। যদি দেখেন হাতাতালির মধ্যে তেমন জোর নেই, তাহলে বুঝতে হয়ে, কবিতাতেও জোর নেই। তবে হাততালি জোরে হলেও সতর্ক থাকবেন। অনেক সময় অন্য নিজের কবিতায় জোরে হাততালি পাওয়ার আশায় এই ধরনের মিথ্যে হাততালি দেয়। এই ধরনের হাততালিকে বলে, ‘আমাকেও দিতে হবে’ হাততালি। যাক, আপনি, সত্বর এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নিজের ভুল সংশোধন করে যান।
ইতি
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ পত্রিকার সম্পাদক।
পুঃ এরপর থেকে, লেখা পাঠাবেন মেইলে বা হোয়াটস্অ্যাপে।’
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। কবিগুরু বললেন, ‘আমি কী করব সাগর? আমার কবিতা নিয়ে এমন কথা তো কেউ কখনও বলেনি।’
আমি বললাম, ‘গুরুদেব, আপনি কি রেগে গেছেন?’
কবিগুরু বললেন, ‘না রাগিনি, ঘাবড়ে গিয়েছি।’
আমি নিজেকে শক্ত করলাম। বললাম, ‘আপনি আমাকে ওদের ঠিকানা দিন। এখনই যাব। আপনিও যাবেন। আমি দেখতে চাই, কার এত সাহস হয়েছে যে আপনার কবিতার ছন্দ, অর্থের ভুল ধরে! সে কে! হয় উন্মাদ, নয় ডাকাত।’
আমি আর কবিগুরু ট্যাক্সি করে পত্রিকার অফিসের সামনে গিয়ে হাজির হয়েছি। গলিঘুঁজির মধ্যে অফিস। ট্যাক্সি থামবার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার পাঠানো কবিতাদুটির নাম কী গুরুদেব?’
উনি নাম বললেন। দুঃসময় আর দেবতার গ্রাস।
এবার বিষমের বদলে আমার হেঁচকি শুরু হল। রবি ঠাকুরের দুঃসময় আর দেবতার গ্রাসে গোলমাল পেয়েছে! হেঁচকি না উঠে উপায় আছে? এবার ট্যাক্সিচালকদাদা আমাকে মাথায় জল ঢেলে হেঁচকি থামালেন। অবাঙালি এই ট্যাক্সিচালকদাদা উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনতে পেরেছেন। কী করে তিনি এই সময়ে আবার ফিরে এসেছেন তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না মোটে। বরং ভাবটা এমন, কবি মাঝেমাঝেই তার ট্যাক্সিতে যাতায়াত করেন। রাসবিহারি মোড় থেকে গাড়ি ধরেন। শুধু একবার বললেন, ‘আপকা তালগাছ বহুৎ বড়িয়া কাব্য হ্যায়।
আমি গলা নামিয়ে কবিগুরুকে বললাম, ‘আপনি এখন ট্যাক্সিতে বসে থাকুন। আগে আমি কথা বলে আসি। তারপর আপনাকে অ্যাপিয়ার করব। পিলে চমকে দেব। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নামে পত্রিকা বের করে ছাড়ব।’
কবিগুরু মহা উৎসাহে ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কাব্যচর্চা শুরু করলেন।
‘ভাই বীরপুরুষ আপকো ক্যায়সা লাগা?’
‘ও তো ঠিকই হ্যায়, লেকিন…’
আমি হনহন করে হেঁটে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ পত্রিকা অফিসে ঢুকে গেলাম। আজ একটা এপার ওপারের দিন। দুঃসময় আর দেবতার গ্রাস কবিতা নিয়ে ফাজলামি আজ বের করে ছাড়ব। ওরা হাড়ে হাড়ে টের পাবে দুঃসময় কাকে বলে এবং তারপর দেবতার গ্রাসে কী ভাবে পড়তে হয়।
দুই
আমি ফিরে এসেছি মাথা নিচু করে। এসে ট্যাক্সিতে উঠে বসেছি।
কবিগুরু বললেন, ‘কী হল?’
আমি বললাম, ‘ট্যাক্সিচালকদাদা, আপ গাড়ি স্টার্ট কর দিজিয়ে।’
কবিগুরু আবার বললেন, ‘কী হল?’
আমি শুকনো মুখ করে বললাম, ‘ওরা বলল, আপনাকে চিনতে পারেনি।’
কবিগুরু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মানে! কী বলছ সাগর! আমাকে চিনতে পারেনি?’
আমি বললাম, ‘ভেবেছে, ওদের পত্রিকার নামের মতোই বানানো কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম নিয়েছে।’
কবিগুরু বললেন, ‘আর আমার দুটো কবিতা? সেগুলোও কি বানানো?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘হ্যাঁ, ওরা তাই ভেবেছিল। বলল, কী করব দাদা, আজকাল ভেজাল রবীন্দ্রনাথের চারপাশ ভরে গেছে। আমি মেনে নিয়ে বললাম, ঠিকই।’
কবিগুরু ধপাস্ করে ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে বললেন, ‘সিধা হাওড়া স্টেশন। হাম শান্তিনিকেতন জায়েঙ্গে।’
আমি বললাম, ‘আমিও যাব।’