সাগরের ভুতুড়ে কাণ্ড
সাগরে ঘটে নানা ধরনের ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তি। ভুতুড়ে জাহাজ, প্রেত, দৈব ভবিষ্যদ্বাণী, নাবিকের অতৃপ্ত আত্মা এমন আরও কত কী!
ভয়ানক ভবিষ্যদ্বাণী
এখন যে ঘটনাটি বর্ণনা করব আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবই মনে হতে পারে আপনার কাছে। কিন্তু এর প্রত্যেকটি অংশই খুব ভালভাবে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই স্বীকার করে নিতে হবে সত্য কখনও কল্পনাকেও হার মানায়।
একসময় ‘আস্ক’-এর ক্যাপ্টেন ছিলেন রিচার্ড ব্রাউন। ১৮৬০-এর দশকের এক ভ্রমণের ঘটনা। কেবিনে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ব্রাউন। এখন পর্যন্ত এবারের যাত্রায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। ক্যাপ্টেনের অধীনে বিশ্বস্ত কিছু ক্রু কাজ করছে। এমনিতে বেশ সাদাসিধে মানুষ ব্রাউন। সাগর, ক্রু আর নিজের জাহাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারলেই খুশি।
একমুহূর্ত পরেই তাঁর ফুট তিনেক সামনে এক নারীমূর্তিকে দেখতে পেলেন। যদিও নারীটির শরীর ভেদ করে সাগরটাও দেখা যাচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে, চোখ কচলে আবার তাকালেন ব্রাউন। তখনই শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। বুঝতে পারলেন আর যা-ই হোক, এ রক্তমাংসের কোন মানুষ নয়।
ছায়ামূর্তির আরও কাছাকাছি হলেন উঠে দাঁড়িয়ে। পরে বলেছিলেন কীভাবে যেন অতিপ্রাকৃত এই শক্তির বশে চলে এসেছিলেন।
‘এখনই জাহাজটা ঘুরিয়ে ফেলো,’ দুর্বল কণ্ঠে বলল সে, ‘বাড়ির দিকে ফিরে চলো। এই জাহাজটা অশুভ। যদি ফিরিয়ে না নাও তোমার সব ক্রুকেই হারাবে, যাবে নিজের জীবনটাও।’
সতর্কসঙ্কেত দিয়ে একমুহূর্ত দেরি না করে অদৃশ্য হলো অশরীরী I
কয়েক মিনিটের জন্য যেন নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেললেন ক্যাপ্টেন ব্রাউন। একের পর এক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে মনে। আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? ওই জিনিসটাকে থোড়াই কেয়ার না করে কোর্স ধরেই চলতে থাকব? নাকি ভুতুড়ে ওই সতর্কবাণী মাথা পেতে নিয়ে জাহাজ ঘোরাব?
শেষ পর্যন্ত মালিকদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রাউন। ক্রুরা অবাক হলেও বুঝতে পারল নিরাপত্তার ব্যাপারে আশঙ্কা তৈরি হওয়ায়ই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্যাপ্টেন। আদেশ মেনে জাহাজের কাজ করতে লাগল তারা। ক্রুরা এটাও জানে মাল নির্দিষ্ট বন্দরে না পৌঁছে দিয়ে ফিরে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শেষ করছেন ক্যাপ্টেন।
ওয়ালসের কার্ডিফ বন্দরে যখন ভিড়ল জাহাজ যা প্রতিক্রিয়া হওয়ার তাই হলো। ব্রাউনকে বহিষ্কার করা হলো, সেই সঙ্গে তাঁর জাহাজ চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। কয়েক বছর বাদে ভেঙে পড়া ও বিধ্বস্ত অবস্থায় মৃত্যু হয় ব্রাউনের।
এদিকে আস্ক কিন্তু ঠিকই মালিকের নির্দেশনায় যাত্রা চালিয়ে গেল। দ্রুত যোগ্য একজন ক্যাপ্টেন নিয়োগ পেলেন। নতুন সব ক্রু নিয়ে চলল জাহাজটি পুরানো গন্তব্যের উদ্দেশে, যেটা ওই ভুতুড়ে ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে বানচাল হয়। কয়েক হপ্তা বাদে জাহাজের মালিকরা একটা খবর পেলেন। আটলান্টিক মহাসাগরে দেখা গেছে আস্ককে, যেখান থেকে ব্রাউন জাহাজ ঘুরিয়েছেন তার কাছেই। আগুনে গোটা জাহাজটাই পুড়ে ছারখার। ক্রুরা সবাই এখনও জাহাজেই আছে, তবে কেউ বেঁচে নেই।
প্রেতাত্মার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিকই ছিল। জাহাজের মালিক, নতুন ক্রু এবং ব্রাউনের দুর্ভাগ্য-দেরি হয়ে যাওয়ার আগে কেউই বিষয়টি বুঝতে পারেনি।
নাবিকের সমাধি
কখনও কখনও অতিপ্রাকৃত কোন সংবাদও ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়। এবারের ঘটনাটি ছাপা হয় ১৯২১ সালের ১২ মে রচেস্টার ডেমোক্রেট অ্যাণ্ড ক্রনিকল পত্রিকায়।
ওই সময় লেক ওন্টারিওর তীরবর্তী এলাকাগুলো ছিল অনেকটাই লোকবসতিহীন। হঠাৎ হঠাৎ আদিবাসীদের একটা-দুটো ছোটখাট বসতি বা বাড়িঘর চোখে পড়ত। ইয়োরোপীয়দের পদধূলি কমই পড়ত সেখানে। তবে সন্দেহ নেই ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না।
আবার প্রকৃতির রুদ্ররূপের কারণে ১৮০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত এখানে বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। ১৮৫৭ সালের এক ঝড়ের সময় জলে ডুবে মৃত্যু হয় এক নবিকের। নিউ ইয়র্কের সোডাস বে-র পয়েন্ট চার্লসের তীরে সমাহিত করা হয় তাকে। এদিকে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে চমৎকার সব বিলাসবহুল কটেজ তৈরি হতে থাকে এলাকাটিতে। এরকম কিছু কটেজের মালিক মিলে একটা সংগঠন দাঁড় করান। গ্রীষ্মকালীন এই আবাসস্থলগুলোর আশপাশের এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেখভালের জন্য একজন কেয়ারটেকারও নিয়োগ করেন তাঁরা। ১৯১৭ সালের দিকে এখানকার কেয়ারটেকার ছিল জর্জ কারসন নামের এক ব্যক্তি।
এই এলাকার সঙ্গে বেশ ভালমতই পরিচিত ছিল কারসন। তার জানা ছিল, সোডাস উপসাগরে যখন শক্তিশালী উত্তর-পুব বায়ু বয়ে যায় তখন কটেজগুলোর কাছে গোর দেয়া ওই নাবিকের কান্না শুনতে পাওয়া যায় বলে দাবি করে এখানকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা। এসব বিষয়ে কারসনের চিরকালের অবিশ্বাস। বাতাসের শব্দই এর জন্য দায়ী এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তার মনে। লোকেদের কল্পনাই একে অন্য দিকে নিয়ে গেছে।
একপর্যায়ে মারফি পরিবারের সদস্যরাও কারসনকে জানায় প্রচণ্ড এক উত্তর-পুর ঝড়ের সময় একটা ভূত তাদের দেখা দেয়। এমনিতে মারফিদের পছন্দ করে এবং বিশ্বাসও – করে কারসন। কিন্তু ওই গ্রীষ্মের রাতে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয় বলে দাবি করেছে তা হেসেই উড়িয়ে দেয় সে। পরিবারের সদস্যরা জানায় ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে ছিল সবাই। এসময় কটেজের দেয়ালের বাইরে থেকে নক করার শব্দ শুনতে পায়। মি. মারফি প্রতিটি জানালা পরীক্ষা করেও এ ধরনের কোন শব্দের কারণ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। কাউকে দেখেনওনি।
শব্দটা হতেই থাকলে ছেলে-মেয়েদের চুপচাপ থাকার নির্দেশ দেন ভদ্রলোক। প্রথমে ভাবলেন কোন প্রতিবেশী ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দশ মিনিট ধরে অনবরত আওয়াজটা হতেই থাকলে বিষয়টা কী তদন্ত করে দেখবেন স্থির করেন। ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন মারফি এবং তাঁর সন্তানেরা। অর্ধেক গেল বামে। বাকি অর্ধেক ডানে। একপর্যায়ে আবার সামনের দরজায় একত্রিত হলো সবাই। অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়নি, যেমন খুঁজে বের করা যায়নি শব্দের কারণ।
ছোট বাচ্চাদুটি ভেতরে চলে গেল। এদিকে মারফি বড় ছেলেটাকে নিয়ে ঘরের চারপাশে তল্লাশি চালিয়ে যেতে লাগলেন। যদি এই ঠক ঠক আওয়াজের ব্যাপারে কোন সূত্র মেলে। শোঁ শোঁ শব্দে ঝড়ো বাতাস বইছে। এরই মধ্যে ধৈর্য নিয়ে খুঁজছে দু’জনেই। হঠাৎই চোখে পড়ল বেশ কিছুটা নিচে লেকের পাড়ে তুমুল বাতাসের মধ্যে বসে আছে ভৌতিক একটি আকৃতি। বাপ-বেটার ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনে কাঠামোটা উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে পুরানো সেই নাম না জানা নাবিকের সমাধিটার সামনে হাজির হলো। হাতদুটো ওপরে তুলল, তারপর অদৃশ্য হলো।
রাতে পরিবারের একজনেরও ভাল ঘুম হলো না। তবে একেবারে সকাল সকাল উঠে পড়ল সবাই। দুপুরের মধ্যে পাথর দিয়ে একটা স্মৃতিফলক তৈরি করে সমাধিতে স্থাপন করল। আশা করল এর ফলে হয়তোবা পরের বার উত্তর-পুব ঝড় বইলেও পরিবারটিকে আর বিরক্ত করবে না প্রেতাত্মাটা।
ওই গ্রীষ্মেই মারফিদের জমিতে টহল দেয়ার সময় অসাবধানতাবশত পা লাগিয়ে এত যত্নে গড়া পাথরের ফলকটা উপড়ে ফেলল জর্জ কারসন। অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে পাথরের টুকরোগুলো কটেজের পেছনের ময়লার স্তূপে ফেলে দিল।
ওই দিন সন্ধ্যায় রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে চাঁদের আলোয় টহল দিচ্ছিল কারসন। মারফিদের বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌছল হঠাৎ একটা নড়াচড়া মনোযোগ আকর্ষণ করল। আরও ভালভাবে তাকাল। খুব বেশি দূরে নয়, যেখানে পাথরের ফলকটা উপড়ে ফেলেছে সেখানে অদ্ভুত এক দৃশ্য অপেক্ষা করছে তার জন্য। পুরানো ধাঁচের নাবিক– পোশাক পরিহিত এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তবে আর যা-ই হোক, মানুষ নয়। কারণ ওটার শরীর ভেদ করে ওপাশের জলের রেখা দেখতে পাচ্ছে কারসন।
এভাবে প্রেতাত্মাটার মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার পর আর কোন অবিশ্বাস রইল না কারসনের। পত্রিকার একজন রিপোর্টারকে সে বলে, মারফিদের বেঞ্চ আর সমাধিটার মাঝখানে প্রেতাত্মাটাকে দেখার পর ভয়ে নড়তে ভুলে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তার চোখের সামনেই কাঠামোটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
একমুহূর্ত দেরি না করে নিজের কেবিনে ফিরে যায় জর্জ কারসন। সে বুঝতে পারে পরের দিন সকালে তার প্রথম কাজ হলো একজন লোক ডেকে ওই পাথরের ফলকটা আবার আগের জায়গায় ঠিকমত স্থাপন করা।
আর সামান্য এই শ্রদ্ধা জানানোটাই প্রেতাত্মাটার জন্য যথেষ্ট ছিল। কারণ এরপর আর ওই ছায়ামূর্তিকে রাত- বিরেতে হাজির হয়ে চমকে দিতে দেখা যায়নি লোকজনকে। অন্তত পত্রিকাটির রিপোর্টে তা-ই বলা হয়েছিল। অবশ্য এরপরে সেখানে আর কোন ভৌতিক ঘটনা ঘটেও থাকতে পারে। কারণ ওই রিপোর্টের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় একশো বছর।
প্রেতাত্মার সাহায্য
কখনও কখনও ছোট্ট কোন নৌকায় চেপে একাকী দুঃসাহসী সাগরযাত্রায় বেরিয়ে পড়ার খবর কানে আসে আমাদের। আমেরিকার ফ্লোরিডার বব ফ্লাওয়ার এমনই একজন। ১৯৭৮ সালের গ্রীষ্মে তার আঠারো ফুটি নৌকাটা নিয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো ফ্লাওয়ার। মিসকিটার নামের নৌকাটিতে চেপে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে বদ্ধপরিকর সে। এবারের অভিযানটা সফল হলে মিসকিটারকে নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরোনোর পরিকল্পনা।
যেদিন সাগরে নামাল নৌকাটিকে, সব কিছু ছিল চমৎকার। আকাশটা পরিষ্কার, সূর্য দারুণ আলো ঝরাচ্ছে। আটলান্টিক মহাসাগর এতটাই শান্ত যে ফ্লাওয়ারের মনে কোন শঙ্কাই রইল না। রাতের বেলা হঠাৎই পরিবেশ পাল্টে গেল। বাতাস ও ঢেউ তার ছোট্ট নৌকাটিকে নিয়ে রীতিমত খেলতে শুরু করল। নৌ বিদ্যা সম্পর্কে জানা সব ধরনের জ্ঞান প্রয়োগ করেও ঝড়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না ফ্লাওয়ার। কোন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটা ছাড়া আর রক্ষা নেই বুঝতে পারল।
একটার পর একটা দিন পেরোতে লাগল। ঝড় থামার কোন লক্ষণ নেই। ফ্লাওয়ারের রীতিমত কাহিল অবস্থা। ঝড় এতটাই প্রবল যে বড় জাহাজগুলোও মিসকিটারকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে পারল না।
পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছে ফ্লাওয়ার। কেবলমাত্র বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করছে না এখন। বাঙ্কের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শরীরটা বাঁধল, যেন সাগরে পড়ে না যায়।
একপর্যায়ে জ্ঞান হারাল। টানা ৯০ ঘণ্টা পর জেগেছিল। কতক্ষণ পর বলতে পারবে না হঠাৎ কেবিনে একটা কণ্ঠ শুনতে পেল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারল না। চোখ খুলতেই কেবিনে তিনজন মানুষকে দেখতে পেল। দেখে অভিজাত কোন প্রমোতদরীর যাত্রী বলে মনে হলো।
ফ্লাওয়ার ভাবল প্রবল খিদে, ভয়, পিপাসা আর ক্লান্তিতে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তার। চোখ বন্ধ করে দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। এরই মধ্যে ওই তিনজন লোকের কথা শুনতে পাচ্ছে।
‘আমাদের কি একটা পাল টানানো উচিত?’ একজন জানতে চাইল। তারপর নানা ধরনের যুক্তি দেখাতে লাগল তিনজন। তবে এর সব কিছুই কীভাবে বব ফ্লাওয়ারকে সাহায্য করা যায় তা নিয়ে। তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত, ফ্লাওয়ার নিজের জীবন বাঁচাতে পারবে না। এই অপমানটা গায়ে না মাখার সিদ্ধান্ত নিল বাঙ্কে শায়িত তরুণ। সে বারবার নিজেকে বোঝাতে লাগল গোটা বিষয়টাই তার কল্পনা।
তবে যতই সময় গড়াল এই অবিশ্বাসী মনোভাব বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ল। কারণ ওই লোকগুলো তাকে তুলে নানা ধরনের পরামর্শ দিতে লাগল জাহাজ নিয়ে। তাদের কথার কোন আগামাথা পাচ্ছে না সে। একপর্যায়ে ভাবতে আরম্ভ করল, ঝড়, না এই লোকগুলো তার প্রধান শত্রু?
এই অদ্ভুত লোকগুলোর কথামতই নৌকাটা পরিচালিত করল ফ্লাওয়ার। তারপর বিধ্বস্ত অবস্থায় শুয়ে পড়ল কেবিনে আবার। একটু পর লোকগুলোর একজন এসে তাকে মিসকিটারের ডেকে যাওয়ার নির্দেশ দিল।
‘তোমার ফ্লেয়ার গানগুলো জ্বালো। কাছেই একটা জাহাজ আছে। ওটাই তোমাকে বাঁচাবে।’
কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ফ্লেয়ার গান ছুঁড়ে মারল আকাশে। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ডেকের ওপর। একটু পরেই একটা মালবাহী জাহাজকে দেখা গেল দৃষ্টিসীমায়।
কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও কোনমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে কেবিনে ঢুকল। ওই তিন আগন্তুক অদৃশ্য হয়েছে। একটু পরই ফ্লেয়ার গানের আলো দেখে হাজির হওয়া জাহাজটা মিসকিটার এবং এর মালিককে উদ্ধার করে বন্দরে নিয়ে গেল।
কয়েক মাস পর যখন তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয় তখন বিষয়টা নিয়ে আবার সন্দেহের দোলাচলে ভুগতে থাকে সে। যদিও কথা থেকে যায়। সে কীভাবে বুঝল তখনই ফ্লেয়ার গান ছুঁড়তে হবে?
সব কিছু মিলিয়ে অতিপ্রাকৃত রহস্যের ইঙ্গিতই পাই আমরা। অন্য ভুবনের তিনজন মানুষ তাকে সাহায্য করেছে নাকি ওই পরিস্থিতিতে তার মনের মধ্যে এমন একটা ক্ষমতা তৈরি হয় যাতে সে বুঝতে পারে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে, সে রহস্যের সমাধান হয়নি আর
ভুতুড়ে জাহাজ
নিস্তব্ধতা, স্থিরতা ও অন্ধকার এই তিনটা অ্যানি এম. রেইড নামের জাহাজটির ক্রুদের সেদিন আঁকড়ে ধরেছিল। ক্যাপ্টেন ডার্কি নোঙর ফেলতে ও পাল গোটাতে বললেন। চারপাশের পরিবেশে একটা অস্বাভাবিক কিছু টের পাচ্ছিল নাবিকরা। কেউ কথা বলছে না। উত্তমাশা অন্তরীপ পেরোনোটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এটা তাদের জানাই ছিল। এই জায়গাটা তারা দ্রুত পেরিয়ে যেতে পারলেই শান্তি পেত। এর বদলে এখন এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে অপেক্ষা করাটা নিশ্চয়ই প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে নাবিকদের মনে।
অস্বাভাবিক নীরবতা, গাঢ় অন্ধকার এবং ভুতুড়ে এই স্থিরতার সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন ডার্কির মনে হলো চারপাশে একটা পরিবর্তন অনুভব করতে এবং দেখতে পাচ্ছেন। ‘আমার মন কি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ডার্কি সাগর সম্পর্কে খুব অভিজ্ঞ এক মানুষ। নিজেকে শান্ত করলেন। জাহাজ এবং এর নাবিকদের নিরাপত্তা নির্ভর করছে তাঁর ওপর। স্পাইগ্লাসটা চোখে দিয়ে চারপাশের অন্ধকারের রাজ্যে কিছু ঠাহর করা যায় কিনা বোঝার চেষ্টা করছেন।
ওখানে ওটা কী? চমকে উঠলেন। ফুট পঞ্চাশেক দূরে সাগরের পানিতে একটা আলোড়ন দেখা যাচ্ছে।
কয়েক সেকেণ্ড পরেই চারপাশে একটা শীতল ঘূর্ণি বাতাসের উপস্থিতি টের পেলেন। এদিকে সাগরের ওই অংশটার পরিস্থিতিও যেন আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। ধূসর একটা কুয়াশা তৈরি হয়েছে সেখানে। আশ্চর্য একটা বিষয় নজরে পড়ল তাঁর টেলিস্কোপ, গ্লাসটায় চোখ লাগাতেই। কুয়াশা স্বচ্ছ হয়ে গিয়ে ওপাশে আরেকটি জাহাজের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে। ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে।
ক্যাপ্টেন উন্মত্তের মত চিৎকার করে নাবিকদের একের পর এক নির্দেশ দিতে লাগলেন। নাবিকরা ত্বরিত সাড়া দিল। ডেকের সতর্কতামূলক নীল বাতি জ্বেলে দেয়া হলো। ছোট্ট জাহাজটা এখন এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে, খালিচোখেও দেখা যাচ্ছে। ওখানকার কেউই মনে হয় এখনও অ্যানি এম. রেইডকে দেখতে পায়নি। ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন বা নাবিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলে কপালে খারাপি আছে বুঝতে বাকি রইল না ডার্কির।
এগিয়ে আসা ছোট্ট কার্গো জাহাজের নাবিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রেইডের লোকেরা ডেকের ওপর লাফাতে লাগল, পতাকা নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। কিন্তু ওটা সেই আগের মতই এগিয়ে আসছে।
‘পাল তোলো। একটা দমকা বাতাস আসছে। এটার সাহায্য নিয়ে জাহাজটা পৌছার আগেই হয়তো দূরে সরে পড়তে পারব।’ হুকুম দিলেন ক্যাপ্টেন ডার্কি।
দ্রুতই বাতাসটা এল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে হিমশীতল ওই বাতাসটার ঝাপটা লাগল জাহাজে। এদিকে কার্গো জাহাজটা গায়ের ওপর উঠে এসেছে। সংঘর্ষ অনিবার্য। রেইডের প্রত্যেকটি নাবিক বুঝে গেল তাদের কেপ অভ গুড হোপের সৌভাগ্যের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটতে যাওয়া প্রচণ্ড সংঘর্ষের জন্য নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলেন ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা।
ঘন একটা কুয়াশার চাদরে নিজেকে মুড়ে অ্যানি এম. রেইডের পোর্ট বো-র গায়ে প্রায় লেগে এল জাহাজটি। তিন মাস্তুলের জাহাজের সব ক্রু অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের আঘাত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে থাকা জাহাজটির দিকে। ওটা যতই কাছে আসছে বাতাস আরও শীতল হচ্ছে। ডার্কির কিছু ক্রু চেঁচিয়ে উঠল যখন আপাত জনমানবহীন, জরাজীর্ণ জাহাজটি তাদের মাঝখানে কেটে চলে গেল। যেন বা এখানে অ্যানি এম. রেইড কিংবা এর নাবিকদের কোন অস্তিত্বই নেই।
পুরানো এই মালবাহী জাহাজটা আসলে আর কিছু নয়, এক ভুতুড়ে জাহাজ, নিশ্চিতভাবেই অন্য কোন সময়চক্র থেকে এখানে হাজির হয়েছিল। ওই ভুতুড়ে জাহাজ যখন সাগরে সত্যিকার অর্থেই চলত তখন হয়তো অ্যানি এম. রেইড তৈরিই হয়নি।
ভয়াবহ ওই জাহাজটি শরীরের হাড়মজ্জা কাঁপিয়ে দিয়ে তাদের ভেদ করে চলে যাওয়ার পর সময় নষ্ট করল না রেইডের নাবিকরা। আবার যাত্রার প্রস্তুতি নিল। কেপ অভ গুড হোপের এখানটায় যেভাবে বাতাস বওয়া স্বাভাবিক আবার সেভাবে বইতে থাকল। এদিকে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং নাবিকরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে রেকর্ড টাইমে পৌঁছে গেল, বন্দরে।
ক্যাপ্টেন ডার্কি পরে বলেন, ‘ওটার ডেক কিংবা ব্রিজে জীবিত কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। নজরদারির জন্য লুকআউটেও ছিল না কেউ। আমরা সংঘর্ষ এড়াবার জন্য সব কিছুই করেছিলাম। খুব দ্রুতই পালগুলোও টাঙিয়ে ফেলেছিলাম।’
ক্যাপ্টেন যদি আরও বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হতেন তবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো মোটেই কঠিন হত না তাঁর জন্য। ১৯১১ সালে ঘটনাটি ঘটে, হ্যালোইনের সময়।
বাবা ও মেয়ে
সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের সীমানায় পড়লেও ভৌগোলিক দিক থেকে জর্জিয়ার সাভানার কাছে হিলটন হেড দ্বীপের অবস্থান। জায়গাটি বৈরী আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত। জানান দেয়া ছাড়াই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে সাগরের দিক থেকে।
একসময় হিলটন হেড আইল্যাণ্ডের বাতিঘরের রক্ষক ছিলেন এক স্ত্রী হারানো লোক। ষোলো বছরের মেয়েটা বাবার সঙ্গেই থাকত। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন ভদ্রলোক। বাতিঘরের কোন অসঙ্গতিই চোখ এড়াত না। বাতিগুলোতে তেল দেয়া হত ঠিকভাবে, বাতির চারপাশের কাঁচ ঝকঝকে- তকতকে করে রাখতেন। এই দেখভালের জন্য কর্তাব্যক্তিদের খুব পছন্দের পাত্র ছিলেন এই লাইট হাউস কিপার।
সাপার শেষে প্রতি সন্ধ্যায় ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বাতিসহ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা ভালভাবে পরীক্ষা করে আসতেন। আবহাওয়া ভাল থাক কি খারাপ তাঁর এই প্রাত্যহিক রুটিনে কোন নড়চড় হত না। কাজেই এক ঝড়ের রাতে যখন টহল দেয়ার জন্য বেরোলেন কিপার তাঁর মেয়ে বিষয়টা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হলো না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে বাতিঘরের চূড়ায় পৌঁছে গেলেন সিঁড়ি ধরে। ঝড়টা হারিকেনে রূপ নিয়েছে। বাতিগুলোর কাচের আচ্ছাদনের ওপর আছড়ে পড়ছে ঝড়ো বাতাস এবং বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। অভিজ্ঞ একজন বাতিঘররক্ষক হওয়ার পরও এ ধরনের ঝড় জীবনে দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। মনে হচ্ছে শয়তান স্বয়ং যেন চড়ে বসেছে সাগর এবং বাতাসের ওপর।
ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এখানেই অপেক্ষা করে বাতি জ্বেলে রাখার চেষ্টা করবেন? নাকি সিঁড়ি বেয়ে নেমে মেয়ের কাছে যাবেন? মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। ঠিক করলেন দুটোই করবেন। আপাতত পোস্ট ছেড়ে গিয়ে মেয়েটার অবস্থা একবার দেখে আসবেন।
এদিকে কোয়ার্টারে মেয়েটাও বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। তুলনামূলক নিরাপদ জায়গাটিতে অপেক্ষা করবে? নাকি বাবার খোঁজে যাবে? একপর্যায়ে সিদ্ধান্তে পৌছল এখানে বিশ্রাম নেয়ার আগে তাকে নিশ্চিত হতে হবে বাবা ভাল আছেন। মা মারা যাবার পর তিনিই তো তাকে আদর-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন। অতএব আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার মত মোটামুটি ধরনের পোশাক পরে বেরিয়ে এল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে বাবাকে খুঁজে পেল। বাতিঘরের সিঁড়ির সবচেয়ে নিচের ধাপের কাছেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোরী মেয়েটা। কী করবে সে? বাবাকে কীভাবে সাহায্য করবে? এদিকে বাতিটা জ্বেলে রাখাও খুব জরুরি, ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজগুলোকে পথ দেখাতে। বিপদ ঘটে যাওয়ার আগেই কি সাহায্য পৌঁছবে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেয়েটার মনের শেষ প্রশ্নের উত্তর ছিল না। পরিস্থিতি শান্ত হতে মোটামুটি এক হপ্তা লাগল। কেবল তখনই অনুসন্ধানী দল পাঠানো হলো বাতিঘরের রক্ষক এবং তাঁর মেয়ের অবস্থা জানতে। কংক্রিটের সিঁড়ির শেষ ধাপে পড়ে হার্ট অ্যাটাকের শিকার বাতিঘররক্ষক মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। পরে মারা যায় তাঁর আদরের ধন একমাত্র মেয়েটিও। বাবার মৃতদেহের পাশেই পাওয়া যায় মেয়েটার নিস্পন্দ দেহ। কীভাবে সে মারা গেল এটা এক রহস্যই রয়ে যায়। বাবা-মেয়েকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত এমন লোকদের ধারণা বাবার মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না পেরেই মারা গিয়েছে মেয়ে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, বাবার আত্মাটা শান্তিতেই তার শেষ গন্তব্যে চলে যায়। কিন্তু মেয়েটার আত্মা বছরের পর বছর ধরে এলাকাটাতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। যখন তার মৃতদেহ উদ্ধার করে লোকেরা তখন যে পোশাক পরনে ছিল, পরে ওই পোশাকেই দেখা যায় মেয়েটার আত্মাকে। একটা ঝড় এগিয়ে এলে তবেই দেখা দেয় কিশোরীর প্রেতাত্মা। টাওয়ারের দিকে এগিয়ে আসা লোকেদের দিকে দৌড়ে যায় তার স্বচ্ছ কাঠামোটা। হাত নেড়ে কাছাকাছি আসতে নিষেধ করে। তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়।
এক রাতের ঘটনা। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস এবং বৃষ্টি হচ্ছে। এসময় বাতিঘরের ধারের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকা এক দম্পতি এক কিশোরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাস্তার পাশে। তাকে গাড়িতে তুলে নেয় ওই দম্পতি। গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ে মেয়েটা। স্বামী যখন গাড়ি চালাচ্ছে তখন মহিলাটি পেছন ফেরে মেয়েটাকে কোথায় নামিয়ে দেবে জানতে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। অথচ কেবলই বৃষ্টিভেজা ওই মেয়েটাকে গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে জায়গা দিয়েছে তারা। এতটাই ধাক্কা খায় ওই দম্পতি তখনই রাস্তার পাশে দাঁড় করানো হয় গাড়ি। পেছনের আসনে উঠে পড়ে ভদ্রলোক মেয়েটার খোঁজে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পেছনের সিটের একটা অংশ ভেজা।
হতভাগা মেয়েটা ওই রাতের ঘটনায় এতটাই আঘাত পায় যে তার আত্মা শান্তি পায়নি। তবে তার এই অস্থিরতা অন্যদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে আসছে মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর থেকে।
জাহাজে অশরীরী
সাগরে বিচরণ করা নাবিকেরা নানা ধরনের বিষয়কে অশুভ বা মন্দভাগ্যের সঙ্কেত হিসাবে দেখে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বিষয়টি হলো, কোন জাহাজে যদি প্রেত বা ভূত দেখা যায় ওই জাহাজটির আর ভাল কোন কিছুই ঘটবে না। যখন কোন একটা জাহাজের গায়ে ভুতুড়ে তকমা লাগে তখন কোন নাবিকরাই এতে কাজ করতে চায় না। এমনকী কখনও কখনও এ ধরনের জাহাজকে বেশ নতুন এবং আরও বহু বছর সাগরে চলাচলের উপযোগী থাকার পরও ধ্বংস করে দিতে হয়েছে মালিককে।
এবার আমরা যে জাহাজটির কাহিনী শোনাতে যাচ্ছি তার নাম পনাটিক। ওটার হোম পোর্ট ছিল ইংল্যাণ্ডের লিভারপুল। ১৮৬৩-র আগ পর্যন্ত এখান থেকে দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত বন্দরগুলোয় নিয়মিতই যাওয়া-আসা করত। বেশ কয়েক বছর এই সাগরযাত্রাগুলো চলে নির্বিঘ্নে। তো একবার ফিরতি যাত্রার সময় ক্যাপ্টেন আবিষ্কার করেন তাঁর জাহাজে লোক সঙ্কট আছে। লিভারপুলের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে কয়েকজন লোক নিয়োগ দেয়া জরুরি। পেরুর ক্যালাওয়ের ডকগুলোতে ঘুরে তিনজন লোক পেয়ে গেলেন যাদের পছন্দ হয়েছে তাঁর, আবার তারাও কিছু আয়- রোজগারের সুযোগ হাতছাড়া করল না। ক্যাপ্টেন নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলেন, ‘যাক, বাবা, এবার আর যাত্রা করতে কোন সমস্যা হবে না। ভ্রমণটাও মনে হয় ভালই হবে।’
কিন্তু পরের দিন আর রাতগুলো প্রমাণ করল ক্যাপ্টেনের অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। এক পরিষ্কার, চন্দ্রালোকিত রাতে ঘটনার শুরু। বেশিরভাগ নাবিক ঘুমিয়ে আছে। কেবল পনাটিকের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দু’জন ক্রু জাহাজকে ঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বে আছে। তাদের একজন উইলিয়াম, ডেকে রুটিন টহল দিচ্ছে। এসময় হুইলে থাকা এডমণ্ড রক্ত জল করা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে টহল বাদ দিয়ে উইলিয়াম যত দ্রুত সম্ভব তার সঙ্গী যেখানে আছে সেদিকে ছুটল। ঘটনাটা কী জিজ্ঞেস করার আগেই এডমণ্ড চিৎকার করতে লাগল, ‘একটা লোক, জাহাজে একটা লোক!’
সে চোখ বড় বড় করে যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না উইলিয়ামের। একবার ভাবল সে কি তবে কোন মস্করা করল?
‘একটা লোককে তো তুমি দেখতেই পার। জাহাজে একজন নয় অনেকেই আছে। এমনকী নতুন লোকও তোলা হয়েছে। এদের সবাইকে তুমি ভালমত চেন, এডমণ্ড।’ এই বলে হেসে উঠল। ভাবল তার সঙ্গী যদি মজা করে থাকে তবে তারও একটু ঠাট্টা করতে দোষ কোথায়!
‘উইল, আমি যাকে দেখেছি সে আমাদের কোন ক্রু নয়। ভয়াবহ এক জিনিস ওটা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ডেকের এক গজ ওপরে, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখগুলোও স্বাভাবিক ছিল না। মনে হচ্ছিল অশুভ, ভয়ঙ্কর একটা কিছু ছিল ওগুলোতে।’ কাঁপতে কাঁপতে বর্ণনা দিল এডমণ্ড।
এডমণ্ডের বর্ণনা আর কাঁপা কণ্ঠস্বর শুনে উইলিয়াম বুঝতে পারল মোটেই ঠাট্টা করছে না তার সঙ্গী। একটা অতৃপ্ত আত্মা জাহাজে হাজির হয়েছে এটা বুঝে নিতে কষ্ট হলো না তার। অভিজ্ঞ দুই নাবিকের জানা আছে লক্ষণটা মোটেই শুভ নয়। মুখহীন, জ্বলতে থাকা দুই চোখের হুড পরা এক কাঠামো ওটা, যেটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত বহন করছে। নিশ্চিতভাবেই মৃত কোন মানুষের আত্মা। দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে!
তাদের চিৎকার ও উচ্চস্বরে আলাপ জাহাজের বেশিরভাগ ক্রুকে জাগিয়ে দিল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে এই ভুতুড়ে অবয়ব দেখা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা জাহাজে।
হৈ চৈ, চিৎকার ধীরে ধীরে একটু কমে আসতে শুরু করেছে, এসময় জাহাজের সবচেয়ে কমবয়স্ক নাবিকটি পিঠে একটা স্পর্শ টের পেল। ধীরে ধীরে মাথা ঘোরাল সে। যদি ভাবত তার কোন সিনিয়র সহকর্মী আশ্বস্ত করার জন্য হাত দিয়েছে পিঠে তাহলে হতাশ হতে হত তাকে। কারণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হুড পরা লম্বা এক ছায়ামূর্তি। চিৎকার করার চেষ্টা করল তরুণ, আতঙ্কে শব্দ বেরোল না গলা থেকে। ভয়ার্ত চোখে নিঃশব্দে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কালো আলখেল্লা গায়ে চাপানো ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে দূরে সরে পড়তে লাগল। ওটার কমলা জ্বলজ্বলে চোখজোড়া এখন কেবল নজরে পড়ছে তরুণের। তার আতঙ্ক যখনই চরম শিখরে পৌঁছল সাগরের শীতল বাতাসে অদৃশ্য হলো ছায়ামূর্তি।
তবে পরের দুই দিন ও রাতে ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটল না। জাহাজও লিভারপুল বন্দরে ভিড়ল। কোন ক্রুরই মানসিক অবস্থা ভাল নেই। তবে ভয়াবহ ওই অশরীরী চেহারা দেখানোর পরও যে তারা বেঁচে ফিরতে পেরেছে এজন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তারা।
একমুহূর্ত দেরি না করে জাহাজ ত্যাগ করল ক্রুরা। এদের একজনও আর ফিরল না জাহাজটিতে। এদিকে আশপাশের প্রত্যেকটা নাবিক তাদের মাধ্যমে রাতারাতি জেনে গেল পনাটিকের ডেকে অশরীরীর হানা দেয়ার ঘটনা। বহু অর্থের লোভ দেখিয়েও জাহাজের ক্যাপ্টেন আর একজন ক্রুকেও পেলেন না তাঁর জাহাজে কাজ করার জন্য।
কয়েক মাস ডকে পড়ে রইল জাহাজটি। তারপর মালিক আশা ছেড়ে দিয়ে বেশ নতুন অবস্থাতেই ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিলেন জাহাজটিকে। ওটার কাঠ, তক্তা ও বিভিন্ন ভাঙা টুকরো কিনে নিল পুরানো জিনিস কেনাবেচা করে এমন দোকানগুলো। সৌভাগ্যক্রমে অন্য কোন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এগুলো কেনেনি। কারণ অশুভ কোন জাহাজের পরিত্যক্ত বস্তুর সঙ্গেও আত্মার নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমানোর ঘটনা শোনা যায়।
কালো আলখেল্লা পরা হুড মাথার ওই অশরীরীর ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির এখানেই শেষ এটা অবশ্য বলতে পারব না আমরা। হয়তো অন্য কোন জাহাজ কিংবা কয়েকটা জাহাজে হানা দিয়ে যাচ্ছে ওটা।