ভলিউম ০০২ – সাগরসৈকত – রকিব হাসান – তিন গোয়েন্দা – কিশোর থ্রিলার
এক
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৮৭
চিঠিটা অদ্ভুত। হাতে নিয়ে চিন্তিত চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কিশোর পাশা, তৃতীয়বার পড়ল:
তিন গোয়েন্দা,
স্কুল তো ছুটি, চলে এসো না তিনজনেই আমাদের বাড়িতে। চমৎকার জায়গা, বুঝেছ, খুবই সুন্দর। সাগর, পাহাড়, পাখি, কি যে দারুণ, না দেখলে বুঝবে না! হ্যাঁ, আরেকটা কথা, রহস্যের পূজারি তোমরা, কথা দিচ্ছি-এখানে এলে কোন না কোন রহস্য পেয়ে যাবেই যাবে। তোমাদের সঙ্গে আমারও ছুটিটা কাটবে ভাল। এসো, পছন্দ না হলে পরের দিনই চলে যেয়ো আবার, খরচ-খরচা সব আমার।
আসবে তো? তোমাদের অপেক্ষায় রইলাম।
-জর্জ গোবেল।
হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। কিশোরের ডেস্কের। উল্টোদিকে বসেছে মুসা আর রবিন।
খামটা উল্টেপাল্টে দেখছে রবিন। খামের এক কোণে প্রেরকের ঠিকানা রয়েছে: জর্জ গোবেল, গোবেল ভিলা, গোবেল বিচ।
ঠিকানাটাও অদ্ভুত! বিড়বিড় করল রবিন।
জায়গাটা কোথায়? মুসার প্রশ্ন।
ড্রয়ার খুলে একটা ম্যাপ বের করে বিছাল কিশোর। তিনজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর। একটা জায়গায় আঙুল রাখল রবিন। এই যে, এই তো…লস অ্যাঞ্জেলেসেই। যা মনে হচ্ছে…শহরের বাইরে, গ্রামট্রাম থাকবে হয়তো আশপাশে। সাগরের তীরে, এই যে। নাহ, জায়গাটা সুন্দরই হবে।
কিন্তু এই জর্জ গোবেলটা কে? কিশোরের দিকে তাকাল মুসা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমাদের পরিচিত না!
কী জানি! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কয়েকবার গোয়েন্দাপ্রধান, চিন্তিত। কিন্তু চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, আমাদের নাড়িনক্ষত্র সব তার জানা।
দূর! ঠোঁট ওল্টাল মুসা। আমার মনে হয়, কারও শয়তানী। শুঁটকি টেরিও হতে পারে। আমাদের বোকা বানানোর জন্যে করেছে। গেলেই ব্যাটার হাসির খোরাক হব হয়তো।
তা-ও হতে পারে! রবিন বলল।
চিঠিটার দিকে আরেকবার তাকাল কিশোর পাশা, নীরবে কিছুক্ষণ ভাবল। মুখ তুলল হঠাৎ। এই ছুটিতে তোমাদের কোথাও যাওয়ার কথা আছে?
মা আয়ারল্যাণ্ডে যাবে, রবিন বলল। অনেক দিন আমার নানা নানীকে দেখে না, এবার নাকি দেখতে যাবে। বাবা সঙ্গে যেতেও পারে, না-ও যেতে পারে। আমাকে যেতে বলেছিল, আমি মানা করে দিয়েছি। যা শীত এখন, কে যায় মরতে! সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকা কাথামুড়ি হয়ে, বরফের জ্বালায় বাইরে বেরোনোর জো নেই। তার চেয়ে আমাদের রকি বিচই অনেক ভাল। আমি যাচ্ছি না।
আমার আম্মা-আব্বা যাবে নিউ ইয়র্কে, মুসা বলল। মার বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমি যাব..যদি না…
যদি না? কিশোর ভুরু কেঁচিকাল।
যদি না গোবেল বিচে যাওয়া হয়। নিউ ইয়র্কের লোকের ভিড়ের চেয়ে সাগর অনেক ভাল। তা ছাড়া বলছে, পাহাড়, পাখি…
আরে, আরে! তুমি আবার কবি হলে কবে থেকে! টিপ্পনী কাটল রবিন। ফুলের কথা কিন্তু বলেনি।
কড়া একটা জবাব দেয়ার জন্যে ঘুরে চাইল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলল কিশোর, রাখো, রাখো, ঝগড়া বাধিয়ো না, জরুরি আলাপ এটা। হ্যাঁ, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তোমরা দুজন কোথাও যাচ্ছ না। আমিও না। তা হলে গোবেল বিচে যেতে বাধা কোথায়?
যাবে ঠিক করে ফেলেছ? মুসার কণ্ঠে বিস্ময়। যদি শুঁটকির কাজ হয়? ও ব্যাটা রকি বিচে আসেনি এবার ছুটিতে, ওখানে গিয়ে বসে আছে। কিনা, কে জানে?
গেলে গেল। ওর চিঠি পেয়ে আমরা গেছি, কী করে জানছে? আমরা কি বলতে যাচ্ছি? তোমার এয়ারগানটা সঙ্গে নেবে, রবিন আর আমি ছিপ নেব। চুটিয়ে পাখি শিকার করব, খরগোশ মারব, মাছ ধরব।
থাকব কোথায়? রবিনের জিজ্ঞাসা।
গোবেল ভিলায়। আর ওরকম কোন ভিলা না থাকলে শহরে এসে তাঁবু-টাবু কিনে নিয়ে যেতে পারব। অসুবিধে কী?
না, কোন অসুবিধে নেই। আরও খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে একমত হয়ে গেল তিন কিশোর, গোবেল বিচেই যাবে। আসছে বুধবার, মাঝখানে শুধু একটা দিন বাকি।
.
মাত্র একটা দিনই যেন আর ফুরোতে চায় না। অবশেষে বুধবার এল। ভোরে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিল রবিন আর মুসা, নাশতা সেরেই পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে চলে এল। কিশোরও তৈরি হয়ে ওদের অপেক্ষা করছে, দুই বন্ধু আসতেই ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, তিনজনের কাঁধেই ব্যাগ। মুসার হাতে এয়ারগান, রবিন আর কিশোরের হাতে ছিপ।
ছুটির সময়। বাস স্টেশনে বেশ ভিড়। স্কুল ছুটি, বড়দের চেয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ভিড়ই বেশি। কোলাহল, কলরব, উত্তেজনা, সবাই আনন্দমুখর। কোথাও না কোথাও ছুটি কাটাতে যাচ্ছে সবাই।
প্রথম বাসটায় জায়গা পেল না তিন গোয়েন্দা, পরের বাসের টিকিট কাটতে হলো।
বাস ছাড়ল। রাস্তায় গাড়ির ভিড়।
শহর ছাড়িয়ে এল এক সময় বাস। ধীরে ধীরে কমছে যানবাহনের ভিড়। পথের দুপাশে বাড়িঘর আর তেমন নেই এখন, পাহাড় আর টিলাটব্ধরও কমে আসছে। খোলা প্রান্তর।
তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। জানালার কাছে বসেছে কিশোর, তার দুপাশে অন্য দুই গোয়েন্দা। হু হু বাতাসে চুল উড়ছে ওদের। মনে দারুণ সুখ। আর থাকতে না পেরে এক সময় গান গেয়ে উঠল মুসা। তার সঙ্গে যোগ দিল রবিন, দেখতে দেখতে গান শুরু হয়ে গেল সারা বাস জুড়ে। হাতে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে কয়েকটা ছেলে। বাসের কণ্ডাকটরও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। তালে তালে আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছে ড্রাইভার। নাহ, ছুটি বটে!
গান থামল এক সময়।
কিশোর, মুসা বলল, খাচ্ছি কখন? পেট জ্বলছে খিদেয়।
এখনি? জানালার দিক থেকে মুখ ফেরাল কিশোর। মাত্র তো এগারোটা। আরও ঘণ্টা দেড়েক যাক।
খাইছে, এতক্ষণ! আঁতকে উঠল মুসা। টিকব না! সেই ভোরে কখন কী খেয়েছি ভুলেই গেছি!
হেসে ফেলল কিশোর। ব্যাগ খুলে বড় তিনটে চকলেট বের করে একটা করে তুলে দিল রবিন, আর মুসার হাতে। নিজেরটারও মোড়ক ছাড়িয়ে কামড় বসাল। আবার চোখ ফেরাল বাইরে। দুপাশে তৃণভূমি, তার ওপারে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল। পথের ধারে বড় বড় গাছ, স্যাৎ স্যাৎ করে সরে যাচ্ছে।
বারোটা নাগাদ একটা স্টেশনে থামল বাস। এখানে গাড়ি বদল করতে হবে, বাস থেকে নামল তিন গোয়েন্দা।
পাহাড়ের ধার ঘেঁষে এখানে চলে গেছে পথ। নিচে ছড়ানো উপত্যকা রোদে ঝলমল করছে। গরু-ভেড়া চরছে। খেয়ে নিয়ে তারপর বাসে উঠবে ঠিক করল তিন গোয়েন্দা। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ওরা, একটা বড় গাছ দেখেছে, তার ছায়ায় বসে খাবে।
পেছনে আচমকা ম-অঁ-অ্যাঁ! শুনে ইয়াল্লা! বলে চেঁচিয়ে এক লাফ মারল মুসা। ফিরে চেয়ে দেখল, বাদামী রঙের একটা গরু বড় বড় অবাক চোখ মেলে তাকে দেখছে। হো হো করে হেসে উঠল কিশোর আর রবিন।
সঙ্গে আনা স্যাণ্ডউইচ দিয়ে খাওয়া সারল ওরা।
কটার সময় পৌঁছুব? আঙুল চাটছে মুসা। খাওয়াটা জুতসই হলো না। শিগগিরই খিদে লেগে যাবে।
এই, সাতটা-আটটা তো বাজবেই, কিশোর জবাব দিল। হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে। আরেকটা লম্বা যাত্রা।
আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? প্রস্তাব দিল রবিন। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিলেই তো পারি? ভিড়ও হবে না, যেতেও পারব তাড়াতাড়ি।
হুঁ, কথাটা মন্দ না, এক কনুইয়ে ভর রেখে কাত হয়ে শরীরটাকে সামান্য তলল কিশোর। তাই করব। মুসা, দেখো না একটা ট্যাক্সি।
আবার যাত্রা শুরু হলো। চোখের পলকে যেন এগিয়ে আসছে মাইল। পোস্টগুলো, পেছনে পড়ে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে একটা বড় পাহাড়ে উঠতে শুরু করল গাড়ি, পথটা পাহাড় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন চূড়ায় পৌঁছে গেল গাড়ি, সাগর চোখে পড়ল। বিকেলের সোনালী আলোয় সূরের সাগরটাকে দেখাচ্ছে মস্ত এক আয়নার মত।
ওই যে! এসে পড়েছি! হাত তুলল কিশোর।
দারুণ! চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে রবিন।
ইস, এখুনি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে! মুসা বলল।
আর বড় জোর মিনিট বিশেক লাগবে, কিশোর বলল। খুব তাড়াতাড়িই এসেছি। বাসে এলে অর্ধেক পথ আসতাম এতক্ষণে।
সৈকতের ধার দিয়ে ছুটছে ট্যাক্সি।
খুবই সুন্দর! কিশোর বলল। কী ঘন নীল!
আর দ্বীপগুলো দেখেছ? রবিন অভিভূত। যেন ছবি! নাহ, এসে ভুল করিনি, কিশোর!
গোবেল ভিলাটা এখন খুঁজে পেলেই হয়! মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।
কিন্তু পাওয়া গেল গোবেল ভিলা, সহজেই। একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই হাত তুলে দেখিয়ে দিল। ছোট একটা পাহাড়ের মাথায় বিশাল এক বাড়ি, সাগরের দিকে মুখ করা। শ্বেতপাথরে তৈরি, নিশ্চয় অনেক পুরানো আমলের। সামনে ছড়ানো বাগান, ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, গোলাপই বেশি।
বাড়ির সিংহ-দরজার মস্ত খুঁটিও শ্বেতপাথরে তৈরি, ধনুকের মত বাকানো গেটের কপালে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে: গোবেল ভিলা। ধবধবে সাদা পাথরে যেন ফুটে রয়েছে কালো অক্ষরগুলো।
ব্যস, পৌঁছে গেলাম! চেপে রাখা শ্বাসটা শব্দ করে ছাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান।
দুই
খোয়া বিছানো পথ ধরে গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল ট্যাক্সি, শব্দ শুনেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে দাঁড়ালেন গাড়ির পাশে। মেরি চাচীর বয়েসী, বেশ সুন্দরী, হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। মহিলাকে ভাল লাগল ছেলেদের।
এসে পড়েছ! হেসে বললেন মহিলা। তোমাদের অপেক্ষায়ই ছিলাম। তাড়াতাড়িই এসেছ।
ট্যাক্সিতে এসেছি, তাই, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল কিশোর। দরজা খুলে নামল। রবিন আর মুসাও নামল। গালে চুমু খেয়ে ছেলেদেরকে স্বাগত জানালেন মহিলা। ট্যাক্সি। বিদায় করে দেয়া হলো। পথ দেখিয়ে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এলেন ড্রইংরুমে। বিরাট হলরুম, আসবাবপত্র সব পুরানো আমলের, কিন্তু খুব। সুন্দর।
চারপাশে তাকিয়ে কিশোর বলল, কই, জর্জকে দেখছি না?
ওর কথা আর বোলো না, হাসলেন মহিলা। ও কি বাড়ি থাকে? তোমরা আসবে, আমাকে বলে সেই সকালে বেরিয়েছে, আর দেখা নেই। হয়তো মাছ ধরছে জেলে ছেলেদের সঙ্গে, কিংবা পাহাড়ে উঠে পাখির ডিম পাড়ছে। বড় বেশি দুষ্ট হয়েছে, কথাবার্তা এক্কেবারে শোনে না…
এক পাশে দরজা খুলে গেল। লম্বা একজন লোক ঘরে ঢুকলেন, ফেকাসে চামড়া রোদের মুখ দেখে বলে মনে হলো না, বাদামী মস্ত গোঁফ, চওড়া কপাল বিরক্তিতে কোঁচকানো, চোখ দুটো চেহারার সঙ্গে বেমানান-বড় বড়, তাতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ।
এই, শোনো, ভদ্রলোককে ডাকলেন মহিলা। ওরা রকি বিচ থেকে এসেছে, জর্জের বন্ধু। ছেলেদেরকে বললেন, ও জর্জের বাবা।
উঠে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল কিশোর। আমি কিশোর পাশা:..ও মুসা আমান। আর ও হলো রবিন মিলফোর্ড।
হুঁ, তোমরা বসো, বিরক্তিতে আরও কুঁচকে গেল জর্জের বাবার চেহারা। হট্টগোল একদম পছন্দ করি না আমি, বুঝেছ? চুপচাপ, থাকবে। বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ওর কথায় কিছু মনে কোরো না, তাড়াতাড়ি বললেন মহিলা। ও এরকমই। তবে মনটা খুব ভাল। সারাদিন কী সব গবেষণা নিয়ে থাকে, এখন একটা বই লিখছে, বিজ্ঞানের কী একটা জটিল বিষয়ের ওপর। তাই অমন খিটখিটে মেজাজ।
না না, ঠিক আছে, আমরা কিছু মনে করিনি, মহিলার অপ্রতিভ। ভাব দেখে বলে উঠল রবিন। বিজ্ঞানীরা ওরকমই হয়, দুনিয়ার আর কোন খোঁজখবর থাকে না তো।
কথা পরে হবে, বললেন মহিলা। অনেক দূর থেকে এসেছ, সারাদিন কী খেয়েছ না খেয়েছ, কে জানে। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এসো। ওই যে, ওদিকে বাথরুম। আমি খাবার বাড়ছি।
খাওয়া সারা হলো, তবু জর্জের দেখা নেই।
ছেলেদেরকে থাকার ঘর দেখিয়ে দিলেন জর্জের মা। পাশাপাশি দুটো ঘর, একেক ঘরে দুটো করে বিছানা। লাল টালির ছাত, অনেক উঁচুতে। এক পাশের বড় বড় জানালা দিয়ে তৃণভূমি আর তার ওপারের জলাভূমি চোখে পড়ে। অন্য পাশের একটা জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়। বাতাসে জানালার কাঁচের শার্শিতে মাথা ঠুকছে রক্তগোলাপ। এত ফুল, খুবই ভাল লাগছে রবিনের।
জর্জ এখনও আসছে না! রবিন বলল।
ওর আসার ঠিকঠিকানা নেই, ঠোঁট বাঁকালেন মহিলা। হয়তো জেলেদের বাড়িতেই খেয়ে রাতদুপুরে আসবে। ওর বাপ জানলে তো দেবে পিট্টি, পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়বে। অনেক বুঝিয়েছি, রাগ করেছি, শাসন করেছি, শোনে না। ছেড়ে দিয়েছি এখন, যা খুশি করুক গে! বড় হলে যদি ভাল হয় তো হবে!
বড় করে হাই তুলল মুসা। শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর আর রবিন, এরপর কী হবে বুঝতে পারছে। ওদের আশঙ্কাই ঠিক হলো। হা হা করে উঠলেন মহিলা, এই যে, ঘুম পেয়েছে! সারাদিন গাড়িতে, কম পরিশ্রম? শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো! কিশোর আর মুসাকে বললেন, তোমরা দুজন। এঘরে শোও। রবিন, তুমি ওঘরে চলে যাও..হ্যাঁ, রাতে কোন কিছুর দরকার হলে ডেকো আমাকে। একটুও লজ্জা কোরো না। আমি যাই।
গাধা কোথাকার! জর্জের মা চলে যেতেই মুসার দিকে চেয়ে ধমকে উঠল কিশোর। আর খানিকক্ষণ চেপে রাখতে পারলে না? ভেবেছি, খাওয়ার পর সৈকতে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসব। দিলে সব মাটি করে! কী করে মানা করি মহিলার মুখের ওপর? ভাববে বেয়াদব।
আমি…আমি বুঝিইনি! বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল মুসা। মহিলার রান্না খুব ভাল, বেশি খেয়ে ফেলেছি..তাই…
…তাই, আর কী? নাক ডাকিয়ে ঘুমাও এখন!
কিন্তু জর্জের ব্যাপারটা কী, বলো তো? রবিন কথার মোড় ঘোরাল। আমাদেরকে এভাবে দাওয়াত করে এনে…
আসবে সময় হলে, মুসা বলল। শুঁটকির ফাঁকিতে পড়িনি, এতেই আমি খুশি! ভেবে অবাক হচ্ছি, ছেলেটা কে!
এত দেরিতে হচ্ছ? রবিন পাল্টা প্রশ্ন করল। আমি তো চিঠি। পাওয়ার পর থেকেই ভাবছি, সে কে। কী করে আমাদের নাম জানল?
রহস্যজনক! গম্ভীর মুখে বলল কিশোর। নিশ্চয় আমাদের পরিচিত কেউ, কোন একটা মতলব আছে তার, হয়তো আমাদের সাহায্য দরকার।
হাঁ করে তাকিয়ে রইল রবিন আর মুসা, বুঝতে পারছে না।
এখন শুয়ে পড়ো, কাপড় ছাড়তে শুরু করল কিশোর। পরে জানা যাবে কী ব্যাপার। জর্জ আগে আসুক তো।
রাতে জর্জ কখন এল, কাপড় ছাড়ল, শুল, কিছুই টের পেল না। রবিন। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে, সূর্য উঠেছে তখন।
চোখ মেলতেই লাল টালির ছাত চোখে পড়ল রবিনের। প্রথমে বুঝতেই পারল না কোথায় আছে। মাথা কাত করে জানালার দিকে তাকাল, ভোরের বাতাসে দুলছে গোলাপের ডাল, আলতো বাড়ি মারছে। শার্শিতে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল তার, কোথায় রয়েছে। মুখ ফিরিয়ে আরেক পাশে তাকাতেই দেখল, অন্য বিছানাটাও এখন আর খালি নয়। কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে একটা ছেলে, গলা পর্যন্ত চাদর টানা।
নড়েচড়ে উঠল ছেলেটা, চোখ মেলল, রবিনের দিকে তাকাল।
জর্জ? রবিন বল।
বিছানায় উঠে বসল ছেলেটা, আস্তে করে মাথা নোয়াল। মুসার চেয়েও ছোট করে ছাটা কালো চুল, মোটা নাক, রোদে-পোড়া চেহারা। কিন্তু চোখ দুটো বড় বড়, ধূসর, বাপের চোখের মতই তাতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ। চেহারাটা কেমন যেন পরিচিত মনে হলো রবিনের, আগে কোথাও দেখেছে, কিন্তু কোথায়, মনে করতে পারল না।
একটাও কথা না বলে উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকল জর্জ। ভীষণ পেচ্ছাপ চেপেছে রবিনের, অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল সে, কিন্তু জর্জের বেরোনোর নাম নেই। শেষে আর থাকতে না পেরে, পাশের ঘরে চলে এল। এখানেও বাথরুম খালি নেই, মুসা ঢুকেছে। কিশোরের বাথরুমের কাজ শেষ, চুল আঁচড়াচ্ছে।
আর পারছে না রবিন। জানালা দিয়েই কল ছেড়ে দেবে কিনা ভাবছে, এই সময় দরজা খুলল মুসা।
বারান্দায় বেরোতেই ডিম আর মাংসভাজার গন্ধ নাকে এল। আগে আগে চলেছে জর্জ, তিন গোয়েন্দার কারও সঙ্গেই কথা বলছে না, ফিরেও তাকাচ্ছে না। দাওয়াত করে এনে এ কেমন ব্যবহার?
ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েছেন মিসেস গোবেল। কয়েকটা এঁটো প্লেট সরাচ্ছেন, বোধহয় খেয়ে উঠে গেছেন জর্জের বাবা।
জর্জের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন মহিলা। আরে, জর্জ, এ কী চেহারা করেছিস! চুলের এ অবস্থা করেছিস কেন? নাকে কী হয়েছে? বোলতা-টোলতা কামড়েছে?
না, সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে চেয়ারে বসে গেল জর্জ। এক টুকরো পাউরুটি তুলে নিয়ে তাতে মাখন লাগাতে শুরু করল। কারও দিকেই তাকাচ্ছে না।
স্থির চোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মিসেস গোবেল। শেষে মুখ বাঁকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোর যা ইচ্ছে, করগে, আর কিছু বলব না! তোমরা বসো, বাবা, নিজের হাতে নিয়ে খাও। এটো। কাপপ্লেট তুলে নিয়ে সিঙ্কে ভেজাতে চলে গেলেন তিনি।
নাশতা শেষ হলো। মুখ তুলল জর্জ। এই প্রথম কথা বলল ছেলেদের সঙ্গে, আমি মাছ ধরতে যাব। তোমরা? মেয়েলী কণ্ঠস্বর। চেনা চেনা।
আমরাও যাব, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা। তুমি না গেলেও যেতাম। ছিপ নিয়ে এসেছি আমরা। কাটা কাটা জবাব। এ হাসল জর্জ। কেমন যেন পরিচিত হাসিটা, সামনের দুটো দাঁত সামান্য উঁচু না হলে খুব মিষ্টি দেখাত। খুব রেগে গেছ, না? চলো, উঠে। পড়ি। বাবা এসে দেখে ফেললে হয়তো অন্য কাজে লাগিয়ে দেবে। কিংবা ঘরে আটকে দেবে।
মিসেস গোবেলকে বলে জর্জের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। রবিনের হাতে ছিপ, মুসার হাতে এয়ারগান,, কিশোরের কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা।
সৈকতের ধার ধরে এগিয়ে চলল ওরা। দিগন্তের ওপরে অনেকখানি উঠে পড়েছে সূর্য, সাগরের সোনালি পানি নীল হতে আরম্ভ করেছে, ঝলমল করছে কাঁচা রোদে।
হাঁটতে হাঁটতেই হাত তুলে একটা দ্বীপ দেখাল জর্জ। কেমন যেন অদ্ভুত, পাথুরে দ্বীপ। এক পাশ থেকে একটা সরু প্রণালী বেরিয়ে মিশেছে। সাগরের সঙ্গে। দ্বীপের মাঝে একটা উঁচু টিলার ওপরে ভাঙা কিছু দালানকোঠা, অনেক পুরানো কোন দুর্গের ভগ্নাবশেষ বোধহয়। সুন্দর জায়গা, না?
হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর আর রবিন।
ওটার নাম গোবেল দ্বীপ, কিশোরের দিকে ফিরল জর্জ, তার তামাটে চোখে নীল সাগরের প্রতিফলন। খুবই সুন্দর জায়গা। একদিন। তোমাদেরকে নিয়ে যাব ওখানে। কবে, এখনি বলতে পারছি না।
কোথায় শুনেছে ওই মেয়েলী কণ্ঠস্বর? ওই চোখ কোথায় দেখেছে? মনের অলিগলিতে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে রবিন, কিন্তু জবাব মিলছে না।
গোবেল দ্বীপ! বিড়বিড় করল কিশোর। কাদের ওটা? তোমাদের?
আমার, হাসল জর্জ। মানে, আমারই হবে একদিন। ওই দ্বীপ, দুর্গ।
তিন
ক্ষণিকের জন্যে থ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
ওই দ্বীপ! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা। আস্ত একটা দ্বীপ তোমার!
বললাম না, একদিন হবে, হাসছে জর্জ। বিশ্বাস না হলে মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। দ্বীপটা এখন মায়ের, তার মানে, আমারই তো?
হুঁ! হলেই বা কী? আপনমনেই বলল মুসা। কালো কালো সব পাথর। নারকেল বীথি নেই, বনবাদাড় নেই। আসলে, প্রবালদ্বীপ হলো সবচেয়ে সুন্দর।
ওটাও সুন্দর, জোর গলায় বলল জর্জ। গেলেই বুঝবে। অসংখ্য খরগোশ আছে, আর কমোরেন্ট। সী-গালের তো ঝাক পড়ে একেক সময়। এয়ারগান দিয়ে আর কটা মারবে? দুৰ্গটাও এককালে খুব সুন্দর ছিল। এখন ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে, তা-ও সুন্দর।
যত যা-ই বলো, আমার কাছে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। সাফ জবাব দিল। মুসা।
ভূত আছে ভাবছ নাকি? তোমাদের সেই টেরর ক্যাসলের ভূত?
তুমি কী করে জানলে? ঝট করে ফিরল রবিন।
জানি জানি, রহস্যময় হাসি হাসল জর্জ। আরও অনেক কিছুই। জানি। তোমাদের নাড়িনক্ষত্র সব জানা আছে আমার।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দ্বীপটা সুন্দর। আরেকটা ব্যাপার, ভূত নেই, তবে গুপ্তধন থাকতে পারে।
মানে? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
চলো, কোথাও গিয়ে বসি, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে জর্জ। লম্বা কাহিনী। ওই যে, ওই পাথরগুলোর ওপর গিয়ে বসি, চলো।
কোন্খান থেকে শুরু করি? একটা পাথরে বসতে বসতে বলল। জর্জ। হ্যাঁ, অনেক আগে এখানকার প্রায় সমস্ত জায়গা ছিল আমার মায়ের পূর্বপুরুষদের। যতই দিন গেল, ধীরে ধীরে গরীব হয়ে পড়ল। তারা, সমস্ত জায়গাজমি বেচে বেচে খেল। কিন্তু ওই ছোট্ট দ্বীপটা বেচেনি, কিংবা হয়তো কেনার লোক পায়নি, তাই বেচতে পারেনি। কে কিনবে? ওই ভাঙা দুর্গ দিয়ে কার কী হবে?
ভালই হয়েছে। চমৎকার ওই দ্বীপটার এখন মালিক হব আমি।…দ্বীপটা ছাড়াও আরও কিছু মাকে দিয়ে যেতে পেরেছে আমার নানা, বাড়িটা, গোবেল ভিলা। ভেঙেচুরে গিয়েছিল, বাবা অনেক খরচাপাতি করে সারিয়ে নিয়েছেন। দুৰ্গটা বাবার কোন কাজে লাগছে না, নইলে সারিয়ে নিত।
জর্জকে ঘিরে বসেছে তিন গোয়েন্দা। আগ্রহ নিয়ে শুনছে তার কথা।
হুঁ, দ্বীপটা সুন্দরই! কিশোর বলল। মালিক হতে পারলে, আমিও তোমার মতই খুশি হতাম।
হ্যাঁ, এখানকার অনেক ছেলেমেয়েই সেকথা বলে, দ্বীপটা তাদের ঈর্ষার বস্তু। কতবার কতজন সাধাসাধি করেছে আমাকে, ওখানে নিয়ে যেতে। যাইনি। রেগে গিয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে, বড় লোক বলে আমি নাকি অহঙ্কারে বাঁচি না। হিহ!
দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে আছে চারজনেই। ভাটার টানে পানি নেমে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে দ্বীপটা।
ওরা নিজে নিজে চলে গেলেই তো পারে? বলল কিশোর।
এত সহজ না, মাথা নাড়ল জর্জ। নৌকা ছাড়া যাওয়ার পথ নেই। পথ চেনা না থাকলে নৌকা নিয়ে গেলেও বিপদে পড়তে হবে। প্রণালীটার জায়গায় জায়গায় ভীষণ গভীর, কিন্তু বেশির ভাগ জায়গাই অগভীর, চোখা সব পাথর বেরিয়ে আছে কোথাও পানির ওপরে, কোথাও পানির নিচে। নৌকার তলায় ঘষা লাগলেই সর্বনাশ। চিরে, কেটে ফালাফালা হয়ে যাবে। তারপর সাতরে তীরে ওঠা! অসম্ভব! কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। ডুবে যাওয়া জাহাজের মাস্তুলে বাড়ি লেগে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
ডুবে যাওয়া জাহাজ! চকচক করছে কিশোরের চোখ। আছে নাকি ওখানে!
এক কালে অসংখ্য ছিল, জর্জ বলল। এখন সাফ করে ফেলা হয়েছে, করেছে গুপ্তধন শিকারীরা। তবে ছোটখাট একটা-দুটো যে এখনও নেই তা নয়। আর বড় একটা আছে, দ্বীপের ওপাশে। গভীর পানিতে। সাগর শান্ত থাকলে নৌকো থেকে নিচে তাকালে ওটার ভাঙা মাস্তুল চোখে পড়ে, তার নিচে অন্ধকার, আর কিছু দেখা যায় না। মিটিমিটি হাসছে সে। ওই ভাঙা জাহাজটাও আমার।
হাঁ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। বলে কী জর্জ!
জোরে মাথা ঝাঁকাল জর্জ। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। জাহাজটা ছিল আমার নানার-নানার-বাবার। সোনা নিয়ে আসছিল ওটা, সোনার বার। গোবেল দ্বীপের কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
তাই? বারগুলোর কী হলো? চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের।
কেউ জানে না, মাথা নাড়ল জর্জ। হয়তো চুরি হয়ে গেছে। কোনভাবে। গুপ্তধন শিকারীরা আঁতিপাতি করে খুঁজেছে জাহাজটা, সোনার একটা টুকরোও পায়নি।
মেরেছে! তুড়ি বাজাল মুসা। কতখানি গভীর? ডুব দেয়া যায়? দেখতে ইচ্ছে করছে!
ডুবুরীর পোশাক হলে তো যায়ই, জর্জ বলল। তবে ওপর থেকে দেখতে চাইলে আজই যেতে পারি। বিকেলে। পুরো ভাটা থাকবে তখন, পানি নেমে যাবে অনেক, তা ছাড়া সাগরও শান্ত আজ।
দারুণ হবে! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল রবিন। দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
কিশোর চুপ করে রয়েছে, আস্তে আস্তে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, তার মানে গভীর ভাবনা চলেছে তার মাথায়।
তো, জর্জ, মুসা বলল, মাছ ধরার কী হবে? বাড়িতে না বলে এলে, মাছ ধরতে যাচ্ছ?
আগে রাফিয়ানকে ডেকে নিয়ে আসি, জর্জ উঠে দাঁড়াল।
রাফিয়ান? কপাল কুঁচকে গেছে মুসার।
কথাটা গোপন রাখবে তো? বাড়িতে কেউ যেন না জানে।
জানবে না, কথা দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা।
রাফিয়ান আমার সবচে বড় বন্ধু, জর্জ বলল। কিন্তু মা আর বাবা একদম দেখতে পারে না ওকে, কাজেই লুকিয়ে রাখতে হয়। যাই, নিয়ে আসি।
পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে চলে গেল জর্জ। অবাক হয়ে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। তিনজনেই একমত, সাংঘাতিক রহস্যময় কিশোর জর্জ গোবেল।
ওই রাফিয়ানটা আবার কে? মুসা বলে উঠল।
হবে হয়তো কোন জেলের ছেলে-টেলে, রবিন সন্দেহ করল। জর্জের মা-বাবা তাই দেখতে পারে না।
নরম বালিতে গা ছড়িয়ে পাথরে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করে রইল ছেলেরা। খানিক পরেই বড় একটা টিলার ওপাশে জর্জের গলা শোনা গেল। আরে; আয়, রাফি; জলদি আয়, ওরা বসে আছে!
টিলার মাথায় দেখা গেল জর্জ আর তার বন্ধুকে। পিঠ সোজা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দার। ও, এই তা হলে রাফিয়ান। জেলের ছেলে নয়, মস্ত এক কুকুর, বাদামী রঙের মাংগরল। অস্বাভাবিক লম্বা লেজ, চওড়া মুখে ছড়িয়ে রয়েছে যেন বিস্তৃত হাসি। আনন্দে জর্জের চারপাশ ঘিরে লাফাতে লাফাতে আসছে। ঢাল বেয়ে ছুটে নামছে জর্জ।
এই হলো রাফিয়ান, কাছে এসে পরিচয় করিয়ে দিল জর্জ, হাঁপাচ্ছে। খুব সুন্দর, না? একেবারে নিখুঁত।
ভুল বলেছে জর্জ। মোটেই নিখুঁত নয় রাফিয়ান, বরং খুঁতই বেশি। পিঠ সামান্য কুঁজো, শরীরের তুলনায় অনেক বড় মাথা-মাংগর কুকুরের সাধারণত এমন হয় না, কানের ডগা গোল হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে। চোখা, বড় বড়; লেজটা এত লম্বা, মোটা রোমশ না হলে চিতাবাঘের লেজ বলেই মনে হত। সবকিছু মিলিয়ে মাংগরলের ভয়ঙ্করত্ব নেই চেহারায়, আছে একটা হাস্যকর ভাব; তবে আদর করতে ইচ্ছে করে, এটা ঠিক। প্রথম দর্শনেই তিন গোয়েন্দাকে ভালবেসে ফেলেছে কুকুরটা, তার উন্মাদ নাচ আর অনর্গল গাল-হাত চেটে দেয়া থেকেই বোঝা যায়।
লক্ষ্মী ছেলে! আদর করে রাফিয়ানের নাক চাপড়ে দিল রবিন।
মুসার নাক-মুখ চেটে দিল রাফিয়ান।
আরে, আরে, এই, করছিস কী, কুত্তার বাচ্চা কুত্তা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। অপবিত্র করে দিচ্ছিস! আমার মা দেখলে এখন সাতবার সোনারূপা ধোয়া পানি দিয়ে গোসল করাত! কুত্তা নাকি নাপাক জীব!
কিন্তু নাপাক জীবটা এই কটু কথায় কিছুই মনে করল না, বরং আদর করে পেছন থেকে মুসার কাঁধে দুই পা তুলে দিয়ে হ্যাঁহ্ হ্যাঁহ করে হাসল।
জোরে হেসে উঠল রবিন আর জর্জ।
ইস, ওরকম একটা কুকুর যদি থাকত আমার! কিশোর আফসোস করল। এই, রাফিয়ান, এদিকে আয়।
এক লাফে কিশোরের প্রায় কোলে এসে পড়ল রাফিয়ান।
আন্তরিক হাসি ফুটল জর্জের মুখে, জ্বলজ্বল করে উঠল তামাটে চোখের তারা। হাত-পা ছড়িয়ে ধপ করে কিশোরের পাশে বালিতে বসে পড়ল। বাহ, আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ইচ্ছে নাকি? কটাক্ষ করল সে। রাফিয়ানকে ভীষণ ভালবাসি আমি। জানো, মাত্র এক বছর বয়েস ওটার, অথচ কত বড় হয়ে গেছে! জলার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, গত বছর। চেহারা ভাল না বলেই বোধহয় ফেলে দিয়ে এসেছিল ওকে ওর মালিক। বাড়ি নিয়ে এলাম। প্রথমে মা কিছু মনে করেনি। কিন্তু যতই বড় হতে লাগল, দুষ্টুমি বেড়ে গেল রাফিয়ানের, শেষে মা আর সইতে পারল না…
কী দুষ্টুমি করত? রবিন জানতে চাইল।
যা পেত তা-ই চিবাত। ড্রইংরুমের নতুন কার্পেটের কোনা চিবিয়ে দিয়েছে নষ্ট করে, মার একটা নতুন হ্যাট কামড়ে অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। বাবার স্যাণ্ডেল আর কাগজ চিবাতে গিয়েই পড়ল বিপদে। ধরে আচ্ছামত ধোলাই লাগাল বাবা। তারপর থেকেই বাবাকে দেখতে পারে না। ঘেউ ঘেউ করে কামড়াতে যায়। এই কাণ্ড করলে কি আর বাড়িতে রাখা যায় ওকে? শেষে দিল একদিন বাড়ি থেকে বের করে। বাবা হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, এরপর আর ওকে বাড়িতে নিয়ে গেলে আমাকে সুদ্ধ বের করে দেবে।
হ্যাঁ, তোমার বাবাকে দেখলেই ভয় করে, মুসা মাথা দোলাল। সারাক্ষণই যেন রেগে আছে!
সাগরের দিকে চোখ ফেরাল জর্জ। বাবা ওরকমই! রাফিয়ানকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার পর কত কেঁদেছি, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি, না খেয়ে থেকেছি, কেয়ারই করল না বাবা। সাফ জবাব, কুকুর বাড়িতে ঢোকানো যাবে না। আমার দুঃখে রাফিয়ানও কেঁদেছে।
আরে, দূর! যতসব গল্প। কুকুর আবার কাঁদে নাকি? মুসা ফস করে ।বলে বসল।
দপ করে জ্বলে উঠল জর্জের চোখ। তুমি ওসবের কী বুঝবে, মুসা আমান? ঘোড়া দেখলে ভয় পাও, কুকুর পছন্দ করো না..।
ঘোড়া দেখলে ভয় পাই, তুমি জানলে কী করে? অবাক হয়ে গেছে মুসা।
না, ইয়ে, মানে, যে লোক কুকুর পছন্দ করে না, ঘোড়াকে তো ভয়। সে পাবেই, বলে তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেল জর্জ। ও, হ্যাঁ, চলো, সাঁতার কাটতে যাই। নাকি মাছ ধরবে?
কুকুরটাকে এখন কোথায় রাখো, জর্জ? কিশোর জানতে চাইল।
ফগ-এর কাছে। ওর বাবা জেলে। গরীব, নিজেরাই খেতে পায় না, কুকুরকে খাওয়াবে কোথা থেকে? রাফিয়ানের খরচ আমিই দিই। মাঝে মাঝে ফগকেও কিছু হাতখরচ দিই; রাফিয়ানকে যত্ন করে, সেজন্যে।
টুংটাং টুংটাং ঘণ্টা বেজে উঠল। রাস্তা দিয়ে আইসক্রিমওয়ালা। যাচ্ছে।
আইসক্রিম! এক লাফে উঠে দাঁড়াল মুসা। এই, মিয়া, দাঁড়াও দাঁড়াও! মোটা সাইজের গোটা চারেক চকলেট-আইসক্রিম কিনে নিয়ে এল সে। রবিন আর কিশোরকে দিল একটা করে। জর্জের দিকে বাড়িয়ে ধরতেই ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিল সে।
না, তোমার আইসক্রিম আমি খাব না! ঝঙ্কার দিয়ে উঠল জর্জ। তুমি আমার রাফিয়ানকে গালমন্দ করেছ!
গালমন্দ আবার করলাম কখন! …আচ্ছা, ঠিক আছে, আর করব না। এই, রাফিয়ান, তুইও নে, নিজেরটা বাড়িয়ে ধরল মুসা।
কখন কী গালমন্দ করেছে মুসা, তাতে থোড়াই কেয়ার রাফিয়ানের, গপ করে আইসক্রিমটা কামড়ে ধরে খেতে শুরু করে দিল সে।
নরম হলো জর্জ। আর কক্ষনো বকবে না তো ওকে?
না, বব না। নাও।
আইসক্রিম নিল জর্জ। নিজের জন্যে আরেকটা কিনে নিয়ে এল। মুসা।
নীরবে বসে আইসক্রিম খেল ওরা কিছুক্ষণ।
একসময় জর্জ বলল, সত্যি, তোমরা আসাতে যা খুশি হয়েছি না! চলো, একটা নৌকা নিয়ে আজ বিকেলেই যাই। আমার জাহাজটা দেখবে। কি বলো?
নিশ্চয়ই! প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা।
হুফ! বলে উঠল রাফিয়ান, জোরে জোরে নাড়ছে লম্বা লেজ, তার। মানে সে-ও যেতে রাজি।
চার
ফুড়ৎ করে উড়ে চলে গেল যেন সকালটা। গোটাকয়েক রঙিন মাছ ধরেছে আর ছেড়েছে রবিন। একের পর এক গুলি করে গেছে মুসা, কিন্তু একটা পাখিকেও লাগাতে পারেনি; তার গুলি কোনখান দিয়ে গেছে, টেরই পায়নি পাখি; রেগেমেগে শেষে ঢিল মেরে দুএকটা পাখিকে উড়িয়ে দিয়েছে, জর্জ আর রবিনের টিটকারি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, তবে রাফিয়ান খুব ভাল ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে। পাখি, দেখলেই আলতো হউ করে মুসার কাপড় কামড়ে ধরে টেনে ফিরিয়ে পাখিটা দেখিয়ে দিয়েছে। রীতিমত ভাব হয়ে গেছে এখন দুজনের।
দুপুর হয়ে আসছে। গরম বাড়ছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ছেলেদেরকে নীল সাগর। এয়ারগান ফেলে কাপড় খুলে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসা। তার সঙ্গে সঙ্গেই নামল রাফিয়ান। রবিন আর কিশোরও নামল। কিন্তু আশ্চর্য! জর্জ নামল না। কিছুতেই নামানো গেল না তাকে। সাঁতার কাটার মুড নেই নাকি তার আজ?
দুপুর নাগাদ ছুঁচোর নাচন আরম্ভ হলো ছেলেদের পেটে। বাড়ির পথ ধরল ওরা।
ভেড়ার মাংসের বড়া, আপেলের হালুয়া, ঘরে বানানো দই আর পনির দিয়ে চমৎকার খাওয়া হলো। সব শেষে এল গাজরের মোরব্বা! মুসার হাসি দেখে কে? মিসেস গোবেল বুঝে গেছেন, কে ভোজনরসিক, তাই সেদিকেই তার আনাগোনা বেশি।
বিকেলে কোথায় যাচ্ছ তোমরা? মহিলা সত্যিই ভাল। অল্প সময়েই একেবারে আপন করে নিয়েছেন ছেলে তিনটেকে।
আমাদেরকে তার জাহাজটা দেখাতে নিয়ে যাবে জর্জ, রবিন বলল।
চোখ বড় বড় হলো মিসেস গোবেলের। জাহাজ দেখাতে নিয়ে যাবে জর্জ! বলো কী? এ যে পশ্চিমে সূর্য উঠল রে! কত ছেলেমেয়ে ওকে সাধাসাধি করে করে হয়রান, শেষে আমাকে এসে ধরেছে, আর বলেও কিছু করাতে পারিনি! নিয়ে যায়নি। অথচ…
চুপচাপ খাচ্ছিল জর্জ, বাধা দিয়ে বলে উঠল, ওরা আমার বন্ধু, তাই নিয়ে যাব। আমার ইচ্ছে না হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও নিয়ে যাব না।
হুঁ, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বয়েই গেছে তোর কাছে আসতে!…যাক, তোর যে অন্তত তিনজন বন্ধু জুটেছে, এতেই আমি খুশি। তোর এই গোয়ার্তুমির জন্যে কেউ পছন্দ করে তোকে? তোর বাপ পর্যন্ত দেখতে পারে না।
না না, খালা, হাত তুলল মুসা, আমরা খুব পছন্দ করি ওকে। তা ছাড়া ওর রা…আঁউউ! পায়ে জর্জের প্রচণ্ড লাথি খেয়ে থেমে গেল সে।
কী, কী হলো! ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মিসেস গোবেল।
না, কিছু না-পিঁপড়ে কামড়েছে!
অবাক হয়ে এক মুহূর্ত মুসার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি, তারপর একটা প্লেট টেনে নিয়ে তাতে খাবার তুলতে শুরু করলেন। জর্জের বাবা টেবিলে খেতে আসেননি-স্বস্তিই বোধ করছে ছেলেরা। তার ঘরে তাকে খাবার দিয়ে আসা হবে।
.
খাওয়ার পর আর একটা মিনিটও দেরি করল না ছেলেরা। প্রায় ছুটে চলে এল সৈকতে। কুকুরটাকে আনতে গিয়েছিল যখন, খুব সম্ভব তখনই বলে রেখেছিল জর্জ, নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে ফগ। ওদেরই বয়েসী আরেক। কিশোর রোদে-পোড়া বাদামী মুখের চামড়া, কোকড়ানো বড় বড় চুল। সৈকতে বালির ওপর ডিঙির অর্ধেকটা টেনে তুলে তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে। তার পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে রাফিয়ান, কুকুরটার গায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলাচ্ছে ফগ।
ছেলেদের সাড়া পেয়েই চোখ মেলল রাফিয়ান, তড়াক করে উঠেই লম্বা লেজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এল। ফগ ফিরে তাকাল।
এসেছেন, উঠে দাঁড়িয়েছে ফগ। আসুন, নৌকা তৈরি। …এরাই আপনার বন্ধু? হাত বাড়িয়ে দিল সে।
একে একে হাত মেলাল তিন গোয়েন্দা।
নৌকায় উঠল চার কিশোর, রাফিয়ানও উঠল। ধাক্কা দিয়ে ডিঙিটাকে পানিতে নামিয়ে দিল ফগ, আরেক ঠেলা দিয়ে ছেড়ে দিল। দাঁড় তুলে নিয়েছে জর্জ, পানিতে ফেলল ঝপাং করে।
সুন্দর বিকেল। নীল সাগর, ছোট ছোট ঢেউ। তিরতির করে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে ডিঙি, চারপাশ থেকে এটাকে ঘিরে রেখেছে। ঢেউয়ের সাদা ফেনা। এক পাশ থেকে এসে ছলাত করে বাড়ি মারছে ঢেউ, পানি ছিটকে উঠছে; মাথায় পানি পড়ার ভয়ে চট করে মাথা নুইয়ে ফেলছে রাফিয়ান, বার বার। হউউ করে ধমক লাগাচ্ছে ঢেউকে।
এই, দুই, বকা দিল জর্জ, চুপ করে বস।
আহা, করুক না একটু দুষ্টুমি, খাতির করতে চাইছে মুসা। কুকুরের বাচ্চা বটে, কিন্তু খুব ভাল মানুষ।
তা ঠিকই বলেছ, কুকুর যে কী করে মানুষ হলো, বোধহয় জর্জের মনেও জাগল না প্রশ্নটা। ঢেউকে ধমকাচ্ছে বটে, কিন্তু ভয় একটুও পায় না। ও খুব ভাল সাঁতারু।
হুফ! প্রশংসা বুঝতে পারল যেন রাফিয়ান; প্রথমে মুসার কান, তারপর জর্জের নাক চেটে দিল খুশি হয়ে।
বাহ, বুঝতে পারে তো? হাসিমুখে বলল মুসা।
তা তো পারেই, মাথা ঝোকাল জর্জ। ও সব কথা বুঝতে পারে।
এই যে, এসে গেছি, দ্বীপটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। যা ভেবেছি তার চেয়ে অনেক বড়!
আরও কাছে এসে গেল দ্বীপ। চারপাশে চোখা পাথরের। ছড়াছড়ি-দ্বীপের ধারে, পানিতে। জায়গা জানা না থাকলে কোন নৌকা কিংবা জাহাজ নোঙর করতে পারবে না, যেতেই পারবে না কাছে। দ্বীপের ঠিক মাঝখান থেকে গজিয়েছে একটা পাহাড়, তার মাথায় দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। শ্বেতপাথরে তৈরি হয়েছিল, দাঁড়িয়ে রয়েছে আধখানা ধনুকের মত ভাঙা খিলান, মোটা স্তম্ভ, কিছু কিছু দেয়াল। এক কালের শির উঁচু করে থাকা চমৎকার দুর্গে এখন দাঁড়কাকের বাসা, উঁচু থাম আর খিলানের মাথায় সার দিয়ে বসে আছে অগুনতি সী-গাল।
গা শিরশির করে দেখলে! কিশোর বলল। এত পুরানো ভাঙা দুর্গ আর দেখিনি। ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার। রাত কাটাতে কেমন লাগবে। ওখানে!
হাত থেমে গেল জর্জের, ঝট করে চোখ ফিরিয়ে তাকাল। এক্কেবারে মনের কথাটা বলেছ! কখনও কাটিয়ে দেখিনি, একা একা সাহসই পাইনি। এবার দেখব। চারজন একসঙ্গে থাকলে আর…কি বলো? দারুণ হবে না?
হবে, রবিন বলল। কিন্তু তোমার মা কি রাজি হবে?
জানি না, মাথা নাড়ল জর্জ। তবে হয়েও যেতে পারে চেপে ধরলে।
আজ দ্বীপে নামছি তো? কিশোর জানতে চাইল।
সময় হবে না, জর্জ বলল। দ্বীপ ঘুরে গিয়ে জাহাজ দেখে আবার সাঁঝের আগে বাড়ি ফেরা, তাতেই দেরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, চলো, আগে জাহাজটাই দেখি। দেখি, অনেক বেয়েছ, হাত বাড়াল কিশোর, এবার আমাকে দাও।
ওসব আমার অভ্যাস আছে, দাঁড় পানি থেকে তুলে ফেলল জর্জ। তবু নাও। বসে থাকতে পারলে কাজ করে কে? হাসল সে। হুশিয়ার! পাথরে লাগিয়ে দিয়ো না!
জায়গা বদল করল কিশোর আর জর্জ।
দাড় পানিতে ফেলল কিশোর। দুলে উঠল ডিঙি, নাক ঘুরে গেল শাই। করে। কিন্তু সামলে নিল সে। জর্জের মত অত ভাল বাইতে পারে না। ডিঙির নাক এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে সামান্য, তাতে অসুবিধে নেই, সোজা পথে চললেই হলো।
দ্বীপের অন্য পাশে চলে এল ওরা, খোলা সাগরের দিকে। দুর্গের এদিকটা একেবারে ভেঙে পড়েছে, স্তূপ হয়ে আছে সাদা পাথর।
খোলা তো, বাতাসের ঝাঁপটা খুব বেশি এদিকে, বুঝিয়ে বলল জর্জ। তাই ওই অবস্থা। জানো, এদিকে একটা ছোট্ট জেটি আছে, গোপন জেটি। দ্বীপের ভেতরে ঢুকে যাওয়া একটা খাড়িতে। এখন শুধু আমি জানি কোথায় আছে।
খানিক পরে কিশোরের হাত থেকে আবার দাঁড় নিয়ে নিল জর্জ, জায়গাটা খারাপ, আর কারও হাতে নৌকার দায়িত্ব দিতে সাহস পাচ্ছে না সে। দ্বীপের ধার ধরে আরও কিছু দূর চলে হঠাৎ ডিঙির নাক ঘোরাল, বেয়ে নিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে। একটা জায়গায় এসে দাঁড় বাওয়া থামিয়ে ফিরে তাকাল দ্বীপের দিকে।
জাহাজটা কোথায় কী করে বুঝবে? কিশোর ভুরু কোঁচকাল।
ওই যে, গাঁয়ের গির্জার চূড়াটা দেখছ? হাত তুলে দেখাল জর্জ। আর ওই পাহাড়ের মাথা? দুটোকে দুটো বিন্দু ধরো। এইবার দ্বীপের ওই যে বড় বড় দুটো টাওয়ার, ওগুলোর মাঝখান দিয়ে তাকাও। টাওয়ারের মাথা দুটোকে দুটো বিন্দু ধরো। চারটে বিন্দু এক লাইনে হয়েছে?
না, মাথা নাড়ল কিশোর আস্তে করে, হয়নি এখনও। টাওয়ারের মাথা দুটো একটু উঁচু মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, আস্তে আস্তে ডিঙিটাকে সরিয়ে নিয়ে চলল জর্জ।
খোলা সাগরের তুলনায় পানি এখানে বেশ শান্ত। কালচে-নীল একটা আয়না যেন বিছিয়ে রয়েছে। নৌকার ধার দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে মুসা আর ববিন, জাহাজটা দেখা যায় কিনা খুঁজছে।
আরেকটু বায়ে সরাতে হবে, জর্জ বলল।
হুফ! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাফিয়ান। জোরে জোরে লেজ নাড়ছে।
হয়েছে! কিশোরও চেঁচিয়ে উঠল। এক লাইনে এসে গেছে চারটে বিন্দু! থামো! কিন্তু সে বলার আগেই দাঁড় বাওয়া থামিয়ে দিয়েছে জর্জ।
নৌকার কিনারা দিয়ে নিচে উঁকি দিল চার কিশোর, রাফিয়ানও গলা বাড়িয়ে দিল। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না, তারপর ধীরে ধীরে আবছামত দেখা গেল একটা বিশাল কালো অবয়ব, ওটাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটা খুটি-ভাঙা মাস্তুল!
একটু কাত হয়ে রয়েছে না? দেখতে দেখতে বলল কিশোর। জর্জ, নামা যায় না?
কেন যাবে না? জর্জ হাসল। নামতে চাইলে নামো। ভয় লাগবে না তো?
আরে, দূর, কী যে বলো! আগেও নেমেছি, পুরানো জাহাজের খোল পানির তলায় নেমে দেখার অভ্যাস আছে। তবে ডুবুরির পোশাক পরে। ওসব ছাড়া নামতে পারব?
পারবে, যদি দম বেশিক্ষণ রাখতে পারো।
আমি পারব, জ্যাকেট খুলতে শুরু করেছে মুসা। সাঁতারে ওস্তাদ
শুধু জাঙ্গিয়া পরে আস্তে করে নেমে পড়ল মুসা। ডিগবাজি খেয়ে ঘুরিয়ে ফেলল শরীরটাকে পানির তলায়, মাথা নিচু করে দ্রুত নেমে চলল হাত-পা চালিয়ে।
তুমি যাবে? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর।
মাথা নাড়ল রবিন। তোমরাই যাও, আমার সর্দি সর্দি ভাব।
কঙ্কাল দ্বীপে সর্দি হয়েছিল আমার, এখানে হলো তোমার, হাহ্! কাপড় খোলা হয়ে গেছে, নেমে পড়ল কিশোর।
মাথা নিচু করে সাঁতরে নিচে নামার সময় কীভাবে চোখ খোলা রাখতে হয়, জানা আছে কিশোরের, ডাইভিঙে দক্ষ ওস্তাদের কাছে ট্রেনিং নিয়েছে। চলার পথে আশপাশে তাকিয়ে দেখছে সে। বড় বেশি নীরব আর কেমন যেন বিষণ্ণ লাগছে এখানে। ওপর থেকে পানি নীল মনে হয়, কিন্তু এখানে কালচে, আশপাশে কালো কালো ছায়া-বিকেল বলেই, গা
ছমছম করে। নিচে জাহাজের অবয়ব আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাত হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে এক অজানা ভয়ঙ্কর দানব, সাড়া পেলেই জেগে উঠবে।
মুসার মত এতক্ষণ দম রাখতে পারল না কিশোর, আবার ওপরে ভেসে উঠতে পেরে খুশিই হলো। হাউস করে জোরে শ্বাস ফেলে নৌকায় উঠে এল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দারুণ! …ভেতরে ঢুকে ভালমত খুঁজে দেখতে পারলে ভাল হত। কে জানে, সোনার বাক্সগুলো…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নৌকার পাশে ভেসে উঠল মুসা। সেদিকে চেয়ে জর্জ বলল, নেই। এক তিল জায়গা খোঁজা বাকি রাখেনি ডাইভাররা। কিছু পায়নি। পশ্চিম দিগন্তে তাকাল সে, বেলা আন্দাজ করল। আর দেরি করা যাবে না। চলো, নইলে চায়ের দেরি হয়ে যাবে।
তাড়াহুড়ো করেও দেরি হয়েই গেল, বেশি না, মিনিট দশেক। চা নিয়ে অপেক্ষা করছেন মিসেস গোবেল।
চা খেয়ে আবার একটু হাটাহাটি করতে বেরোল ছেলেরা, জলার ধারে চলে এল। তাদের পায়ের কাছে নাচানাচি করছে রাফিয়ান, উল্লাসে।
সন্ধ্যা নামছে। বাড়ি ফিরছে জলার সব পাখিরা। এখানে-ওখানে শুধু দুএকটা সাদা বক ধ্যানমগ্ন হয়ে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে রয়েছে, শেষ লোকমা খাবারের আশায়।
বাড়ি ফিরল ছেলেরা। রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেল।
গুড নাইট, জর্জ, ঘুমজড়ানো গলায় বলল রবিন। চমৎকার একটা দিন কাটল, তোমারই জন্যে, ধন্যবাদ।
কাল আরও সুন্দর কাটবে, জর্জের কণ্ঠেও ঘুম। কাল আমার দ্বীপে নামব তোমাদের নিয়ে, দুর্গ দেখাব…দুর্গ…
জর্জের শেষ কথাটা রবিনের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না, ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
পাঁচ
সবার আগে রবিনের ঘুম ভাঙল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, উজ্জ্বল রোদ, চমৎকার আবহাওয়া। জর্জকে ডেকে তুলল সে। হাই তুলতে তুলতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল জর্জ। উমম! আজ না গেলেই ভাল!
কেন! কেন! আঁতকে উঠল রবিন।
ঝড় আসবে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে জর্জ, চিন্তিত।
কিন্তু আবহাওয়া তো পরিষ্কার! জর্জের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। সূর্যের সামনে ছায়া নেই, এক রত্তি মেঘ নেই আকাশে।
বাতাসের গতি উল্টোপাল্টা, টের পাচ্ছ না? আর ওই দেখো, দ্বীপের কাছে যে ঢেউ ভাঙছে, মাথাগুলো সাদা। অশুভ সঙ্কেত।
যাবে না তা হলে? হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। রাফিয়ানের কথা ভেবেছ? আমাদের সঙ্গ না পেলে আজ কী রকম দুঃখ পাবে ও?
হেসে ফেলল জর্জ। ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাব, যাব। কেঁদে ফেলো না।
কী যে বলো! রবিনও হাসল, লজ্জা পেয়েছে। আচ্ছা, ঝড়টা কতখানি খারাপ… বলেই জর্জের চেহারা দেখে থেমে গেল; আবার না মানা করে বসে যেতে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি বলল, আর খারাপ হলে হলো। ঝড়ের ভয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি দেখি, কিশোর আর মুসা উঠেছে কিনা।
ভরপেট নাস্তা করল চারজনে। ছেলেরা দ্বীপে যাবে শুনে পোটলা করে খাবার বেঁধে দিলেন জর্জের মা, অনেক খাবার। বলে দিলেন, গায়ের বাজার থেকে কিছু লেমোনেডের বোতল কিনে সঙ্গে নিতে। যেখানে সেখানে যেন পানি না খায়, বার বার হুশিয়ার করে দিলেন। সৈকতের পথ ধরে হেঁটে চলল ওরা। সবাই খুশি। ঝড়ের কথা কিশোর আর মুসাও শুনেছে, কিন্তু খুব একটা আমল দিচ্ছে না। ঝড়ের।
আগে দ্বীপে পৌঁছে যেতে পারলে আর কোন ভয় নেই।
ফগদের বাড়িতে পৌঁছল ওরা। বাড়ির পেছনে শেকলে বাঁধা রয়েছে রাফিয়ান, ওদেরকে দেখেই হউ-হউ করে উঠল। চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এল ফগ।
মর্নিং, মাস্টার জর্জ, বলল সে। তার কণ্ঠস্বর অবাক করল রবিনকে, কেন যেন মনে হলো, মাস্টার বলতে বাধছে ফগের। রাফিয়ানের বাধন খুলে দিল সে।
খুশিতে পাগল হয়ে গেল যেন রাফিয়ান। ছেলেদেরকে ঘিরে নাচছে, আর ঘেউ ঘেউ করছে।
গুড মর্নিং, রাফি, হেসে বলল কিশোর। আরে, অমন পাগল হয়ে গেলি কেন? আয়, এদিকে আয়।
লাফিয়ে এসে কিশোরের পায়ের কাছে পড়ল রাফিয়ান। তার গায়ে দুপা তুলে দিয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, কান চেটে দিল, কিশোরের। পরক্ষণেই লাফিয়ে গিয়ে পড়ল জর্জের গায়ে।
সৈকত ধরে এগোল ওরা আবার। অনেকখানি শান্ত হয়ে এসেছে। রাফিয়ান, পিছে পিছে চলেছে, সুযোগ পেলেই চেটে দিচ্ছে জর্জের হাত।
এক জায়গায় কয়েকটা বড় বড় পাথর নেমে গেছে পানিতে, ওখানে নৌকা বাধা। একে একে উঠে পড়ল অভিযাত্রীরা, নৌকা ঠেলে পানিতে নামিয়ে দিল-ফগ। দাঁড় তুলে নিল জর্জ।
তীরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাল ফগ। চেঁচিয়ে বলল, বেশি দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি চলে যান। ঝড় আসবে।
জানি, চেঁচিয়ে জবাব দিল জর্জ। ভেবো না, ঝড়ের আগেই দ্বীপে উঠে যাব। আসতে দেরি আছে এখনও।
দাঁড় বেয়ে চলল জর্জ। রাফিয়ানের আনন্দের সীমা নেই। ছোট্ট নৌকাটা ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে, সেই সঙ্গে নাচছে কুকুরটা। লাফ দিয়ে একবার নৌকার এ-মাথায় চলে আসছে, আরেকবার ও-মাথায়। দুলে উঠছে নৌকা। তাতে আরও মজা পাচ্ছে সে, গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে।
এক দৃষ্টিতে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, কাছিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দ্বীপটার দিকে চেয়ে চেয়ে আগের দিনের মতই উত্তেজনা বোধ করছে।
জর্জ, এক সময় বলল কিশোর, উঠব কোন দিক দিয়ে? খালি তো দেখছি পাথর আর পাথর, নৌকা ভেড়ানোর জায়গা কোথায়?
আছে, আছে, রহস্যময় হাসি হাসল জর্জ। কাল বলেছিলাম না, ছোট্ট একটা জেটি আছে? লুকানো। দ্বীপের পুব ধারে।
দক্ষ হাতে চোখা পাথরের ফাঁক দিয়ে ডিঙিটাকে চালিয়ে নিয়ে চলল। জর্জ, পাকা মাঝি সে কোন সন্দেহ নেই। সামনে চোখা পাথরের দেয়াল, তার পরে কী আছে দেখা যায় না। একটা ফাঁক দিয়ে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। জর্জ, দেয়ালের অন্য পাশে চলে এল। জেটিটা দেখতে পেল সবাই। প্রাকৃতিক জেটি। সাদা বালিতে ঢাকা ছোট্ট একটুকরো সমতল জায়গা, প্রায় চারপাশ থেকেই ঘিরে রেখেছে উঁচু পাথরের দেয়াল। বাইরে থেকে জায়গাটা দেখা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
সরু প্রণালী ধরে এগিয়ে চলেছে ডিঙি, জেটির দিকে। শান্ত পানি কাঁচের মত পরিষ্কার। রঙিন ছোট ছোট মাছগুলোকে মনে হচ্ছে রঙিন স্ফটিকে তৈরি। মুগ্ধ হয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দা।
ইস, কী সুন্দর! জ্বলজ্বল করছে কিশোরের চোখ। তুমি। ভাগ্যবতী।
ঝট করে চোখ তুলে তাকাল জর্জ। মুসা ঠিক খেয়াল করল না ব্যাপারটা, কিন্তু রবিন অবাক হলো। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ঘঁাচ করে বালিতে ঠেকল নৌকার তলা, ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ডিঙি।
হলদে সাদা মসৃণ বালিতে লাফিয়ে নামল ওরা।
সত্যিই তা হলে দ্বীপে পৌঁছলাম! খুশিতে ওখানেই এক গড়ান দিল রবিন। তার সঙ্গে যোগ দিল রাফিয়ান। হেসে উঠল অন্যেরা।
টেনে নৌকাটাকে ডাঙায় তুলতে শুরু করল জর্জ। তার সঙ্গে হাত মেলাল মুসা। আর বেশি ওপরে তুলে কী হবে? জোয়ার কি এত ওপরে আসে? ১ঝড় আসবে ভুলে গেছ? পানি এখন শান্ত, ঝড়ের সময় দেখবে কী রকম ফুঁসে ওঠে। নৌকাটাকে টেনে নামিয়ে বাড়ি মেরে গুড়ো করে দিক, তাই চাও?
না, চায় না মুসা, পারলে এখন পাহাড়ের মাথায় তুলে রাখে। নৌকাটাকে।
চলো, চলো, ঘুরেফিরে দেখি, তর সইছে না রবিনের। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে সে। এসো, এসো।
ছোট্ট একটা পাহাড়, আসলে টিলা বলাই উচিত। ওটা পেরিয়ে মোটামুটি একটা সমতল জায়গায় চলে এল ওরা। এত সুন্দর জায়গা খুব কমই দেখেছে তিন গোয়েন্দা। আশপাশে খরগোশের ছড়াছড়ি। ওর কাছাকাছি এলেই একটু সরে যাচ্ছে, ভয় পেয়ে গর্তে ঢোকার কোন লক্ষণই নেই জানোয়ারগুলোর মাঝে।
এক্কেবারে পোষা! অবাক হয়ে বলল কিশোর।
এখানে কেউ আসে না তো, তাই। আমিও ভয় দেখাই না ওদের। কুকুরটার দিকে চেয়ে হঠাৎ ধমকে উঠল জর্জ, এই, রাফি, রাফি, এলি এদিকে! ধরে থাপ্পড় লাগাব কিন্তু।
একটা খরগোশকে তাড়া করেছিল রাফিয়ান, মাঝপথেই যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেল, ফিরে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল জর্জের দিকে। এই একটা ব্যাপার বুঝতে পারে না সে, আর কোন কিছুতেই মানা করে না, শুধু খরগোশ তাড়া করলে এত রেগে যায় কেন তার মনিব? বিষণ্ণ ভঙ্গিতে ফিরে এল রাফিয়ান, ছেলেদের পাশে পাশে সুবোধ বালকের মত হেঁটে চলল, খরগোশগুলোর দিকে নজর, রসগোল্লার থালার দিকে যে চোখে তাকায় পেটুক ছেলে, চোখে সেই দৃষ্টি।
মনে হচ্ছে হাত থেকেই খাবার নিয়ে খাবে? খরগোশ দেখিয়ে বলল। কিশোর।
মাথা নাড়ল জর্জ। না, চেষ্টা করেছি, আসে না। ওটুকু ভয় রয়েই গেছে। …আরে, ওই বাচ্চাটা দেখেছ! কী সুন্দর, না?
হুফ! স্বীকার করল রাফিয়ান, মনিবের আঙুল তোলা দেখে ভাবল ছাড়পত্র পেয়ে গেছে, কিন্তু লাফ দিয়ে বাচ্চাটার দিকে এগোতে গিয়েই থেমে গেল। আবার ধমকে উঠেছে মনিব, এই, শয়তান, কান ছিঁড়ে দেব কিন্তু!
দুপায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে আবার ফিরে এল রাফিয়ান।
এসে গেছি! হঠাৎ বলে উঠল কিশোর।
হ্যাঁ, ওই যে সিংহ-দরজা, হাত তুলে দেখাল জর্জ। ওখান দিয়েই দুর্গে ঢুকতে হবে।
বিশাল দরজা ছিল এক কালে, মস্ত বড় দুই থাম, ওপরে ধনুকের মত বাঁকানো খিলানের অর্ধেকটা বিশিষ্ট রয়েছে এখন, ঝুলে আছে বেকায়দা ভঙ্গিতে, ওটাও খসে পড়তে পারে যে-কোন সময়। ওপাশ থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাথরের ভাঙা সিঁড়ি, দুর্গের ঠিক গোড়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
দুর্গ ঘিরে উঁচু দেয়াল ছিল এক সময়, বলল জর্জ। এখন জায়গায় জায়গায় পড়ে গেছে। টাওয়ার ছিল দুটো, দেখতেই পাচ্ছ, একটা পড়ে গেছে।
দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা। আরেকটা টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে এখনও, তাতে কাকের বাসা। যেখানেই ফোকর পেয়েছে, বাসা বেধেছে। খড়কুটো ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখা যায় না এখন টাওয়ারের।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা। টাওয়ারের কাছাকাছি আসতেই ভড়কে গেল একজোড়া কাক, একেবারে কাছেই ওদের বাসা, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। কা-কা চিৎকার করে মাথার ওপরে চক্কর দিতে লাগল পাখি দুটো। এই বেয়াদবিতে ভয়ানক রেগে গেল রাফিয়ান, হাউহাউ করে চেঁচিয়ে উঠল সে, লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করল কাক দুটোকে, বৃথা চেষ্টা।
ওই যে, দুর্গের কেন্দ্র, হাত তুলে দেখিয়ে বলল জর্জ। ভাঙা একটা দরজার ওপাশে পাথরের ছড়ানো চত্বর, জায়গায় জায়গায় ফাটল সেখানে ঘাস আর শেওলার রাজত্ব। দেখে মনে হয়, এক সময় ওখানে মানুষ থাকত। …ওই যে, একটা ঘর এখনও আছে। চলো, ওপাশে যাই।
দরজাটা পেরোল ওরা, ঘরটায় এসে ঢুকল। আবছা অন্ধকার। পাথরের দেয়াল, পাথরের তাক, পাথরের ছাত; এক কোণে মস্ত এক ফায়ারপ্লেস, তা-ও পাথরের। দেয়ালের অনেক ওপরে বড় বড় দুটো ফোকর, এক কালে জানালা ছিল, ওখান দিয়ে মান আলো আসছে, রহস্যময় এক আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে ঘরের ভেতরে। গা ছমছম করা পরিবেশ।
যা মনে হচ্ছে, এই একটা ঘরই আস্ত আছে, ঘুরেফিরে দেখছে। কিশোর। আরেকটা দরজার কাছে গিয়ে অন্যপাশে উঁকি দিল। হুম, আরও আছে, কিন্তু আস্ত নেই কোনটাই। দেয়াল নেই, নয়তো ছাত নেই। ফিরে তাকাল সে জর্জের দিকে। ওপরতলা বলে কিছু আছে?
নিশ্চয়, কিশোরের কথার ধরনে মৃদু আহত হলো যেন জর্জ। তবে ওখানে আর ওঠা যায় না। ওই যে, দেখো, সিঁড়ি। সব আলগা। কাক টাওয়ারের ওপরেও কয়েকটা তলা আছে…ও, বুঝতে পারছ না, কাকেরা যে টাওয়ারটাতে বাস করে ওটার নাম রেখেছি কাক-টাওয়ার। কিন্তু ওখানেও উঠতে পারবে না, সিঁড়ি সব ভাঙা। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম। পড়ে গিয়েছিলাম। আরেকটু হলেই গিয়েছিল ঘাড়টা মটকে! তারপর আর সাহস করিনি।
পাতালঘর-টর আছে কিছু? আচমকা প্রশ্ন করল মুসা। আতঙ্কের দুর্গের সেই ডানজনের কথা মনে পড়ে গেছে তার।
জানি না, মাথা নাড়ল জ। তবে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। চারদিকে এত ঘাস-লতা-পাতা গজিয়েছে, থাকলেও এখন আর সিঁড়ির মুখ দেত্যই, একে ঝোঁপ; পুরনের গুল
সত্যিই, একেবারে জংলা হয়ে গেছে জায়গাটা। এখানে-ওখানে ঘন হয়ে জন্মেছে বইচির ঝোঁপ; পাথরের ফাঁকে, কোনায়, যেখানেই জায়গা পেয়েছে, ঠেলে বেরিয়েছে এক ধরনের গুল্ম; মাথায় হলদে রঙের ছোট ছোট ফুল। সবুজ ঘাসের কার্পেট যেখানে-সেখানে, মাঝে মাঝেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলচে-লাল সরু দণ্ডের মত উদ্ভিদ, মাথায় ছোট্ট একটা ক্রসের মত, একেকটা ক্রসের চার মাথায় আবার খুদে খুদে চারটে নীল ফুল।
না রে, ভাই, এত সুন্দর জায়গা কমই দেখেছি! আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছে অভিভূত রবিন।
দিনের বেলা সুন্দর লাগছে বটে, খাপছাড়া কণ্ঠে বলে উঠল মুসা, কিন্তু রাতে? ভূত-টুত থাকে না তো?
তোমার কথাই এমন! রেগে গেল জর্জ। খালি বাজে কথা!
বাজে কথা বললাম? তোমাদের মত কল্পনার জগতে থাকি না আমি সারাক্ষণ, আমি হলাম বাস্তববাদী…
মাথার ওপর কর্কশ চিৎকার শুনে চমকে থেমে গেল মুসা। আকাশের দিকে তাকাল।
টাওয়ারের মাথায় অনেকটা হাঁটুভাঙা-দ-এর মত হয়ে বসে ছিল। এক ঝাক বড় পাখি, চকচকে কালো পালক, কী জানি কেন একসঙ্গে উড়াল দিয়েছে, চেঁচাচ্ছে সমানে। ভয় পেয়েছে নাকি কোন কারণে?
করমোরেন্ট, বলল জর্জ। খিদে পেলেই সাগরে নামে, মাছ ধরে খায়, তারপর হজম করার জন্যে এসে বসে টাওয়ারের মাথায়।
ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে? কিশোর বলল।
জর্জ জবাব দেয়ার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ভেসে এল চাপা গুডগুড। ঘাড় কাত করে বলল জর্জ, যা বলেছিলাম, ওই দেখো ঝড় আসছে। সেজন্যেই ভয় পেয়েছে পাখিগুলো। কিন্তু, একটু তাড়াতাড়িই এসে যাচ্ছে না! শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে গেল সে।
ছয়
অবাক হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। দুর্গের ভিতরটা দেখায় এতই, মনোযোগী ছিল, আর কোনদিকে নজরই রাখেনি, আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে তাই তাজ্জব হয়ে গেছে।
আরেকবার মেঘ ডাকল। মনে হলো, আকাশের কোন এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে ভীষণ কণ্ঠে গর্জে উঠেছে হাজারখানেক বাঘ। জবাবে রাফিয়ানও গর্জে উঠল, মেঘের তুলনায় হাস্যকর মনে হলো তার চিৎকার।
এত তাড়াতাড়িই এসে গেল! জর্জ চিন্তিত। সময়মত আর বাড়ি ফিরতে পারব না। আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ।
ঠিকই বলেছে সে। ওরা রওনা দেয়ার সময় আকাশের রঙ ছিল গাঢ় নীল, এখন কালচে-ধূসর। আকাশের অনেক নিচে যেন ঝুলে রয়েছে ভারি মেঘ। ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের দল তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে দিকে দিকে, যেন তাড়া খেয়ে। মাথা কুটে একনাগাড়ে বিলাপ করে চলেছে বাতাস। ভয় পেতে শুরু করেছে রবিন।
টুপ করে বড় একটা ফোঁটা পড়ল কিশোরের কানে। বৃষ্টি আসছে! চলো, কোথাও ঢুকে পড়ি। ভিজে যাব।
আরিব্বাপ রে, ঢেউ দেখেছ! হাত তুলে বলল জর্জ। বড় রকমের ঝড় আসছে!
আকাশ চিরে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, ক্ষণিকের জন্যে নীল আলোয়
আলোকিত করে দিয়ে গেল চারদিক।
কী সাগর বদলে কী হয়ে গেছে! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ের সমান একেকটা ঢেউ ভীমবেগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথুরে তীরে, কানফাটা গর্জন তুলে ভাঙছে; বালির সৈকত, পাথুরে টিলা সব ভিজিয়ে একাকার করে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার।
নৌকাটা আরও ওপরে তুলে রাখতে হবে, জর্জ বলল হঠাৎ।
মুসা আর রবিনকে দুর্গের ঘরে চলে যেতে বলে দ্বীপের অন্য ধারে ছুটে চলে এল কিশোর আর জর্জ, নৌকাটা যেখানে রেখেছে সেখানে। এসে ভালই করেছে, ইতিমধ্যেই নৌকার কাছে চলে এসেছে পানি, ঢেউ আরেকটু বড় হলেই ভাসিয়ে নিয়ে যেত। টেনেহিঁচড়ে নৌকাটাকে টিলার ওপরে তুলে নিয়ে এল ওরা, শক্ত করে শেকড় গেড়েছে এমন একটা ঝোঁপ দেখে তার গোড়ায় পেঁচিয়ে বাধল নৌকার দড়ি।
বৃষ্টি বেড়েছে, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে দুজনে।
ওরা নিশ্চয় ঘরে চলে গেছে এতক্ষণে, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, চলে গেছে। ভয় পাচ্ছে দুজনেই! বাইরে অন্ধকার, ঘরে আরও বেশি, তার ওপর ঠাণ্ডা। ভেজা কাপড়-চোপড় নিয়ে কিশোর আর জর্জের অবস্থা কাহিল।
আগুন জ্বালানো দরকার, কাঁপতে কাঁপতে বলল কিশোর। শুকনো কাঠকুটো কোথায় পাই?
তবে প্রশ্নের জবাবেই যেন কা-কা করে চেঁচিয়ে ঘরে এসে ঢুকল কয়েকটা কাক, মানুষের সাড়া পেয়ে দ্বিগুণ জোরে কা-কা করে উঠে বেরিয়ে গেল আবার।
এই তো পেয়েছি, কাঠকুটো! আনন্দে চিৎকার করে উঠল কিশোর। কাকের বাসা। দুতিনটে আনতে পারলেই কাজ চলে যাবে।
বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে বেরোল সে। ভিজতে ভিজতে চলে এল টাওয়ারের কাছে। হ্যাঁচকা টানে সবচেয়ে নিচের বাসাটা খুলে বের করে দুহাতে জাপটে ধরে নিয়ে ছুটে চলে এল আবার ঘরে।
বাহ, চমৎকার! খুশি খুশি গলা জর্জের। ম্যাচ আর কাগজ দরকার, আছে কারও কাছে?
ম্যাচ আমার কাছেই আছে, ফায়ারপ্লেসে কুটোগুলো ছড়িয়ে রাখতে রাখতে বলল কিশোর। কিন্তু কাগজ…
আছে, আছে, বলে উঠল মুসা। স্যাণ্ডউইচের মোড়ক।
হেসে উঠল সবাই, কিন্তু কথাটা ঠিকই বলেছে মুসা। স্যাণ্ডউইচের মোড়ক খুলে নেয়া হলো, ঘি লেগে আছে, আগুন ধরাতে বরং সুবিধে হলো। কুটোগুলো গোল করে সাজিয়ে তার মাঝখানে কয়েকটা কাগজের টুকরো রাখল কিশোর, ওপরে আরও কিছু পাতলা কুটো ছড়িয়ে, একটা কাগজে আগুন ধরিয়ে তার ওপর ফেলল। প্রথমে ধোয়া উঠল কিছুক্ষণ, তারপর জ্বলে উঠল আগুন, সুন্দরভাবে।
পটপট করে কুটোর শুকনো গাঁট ফাটছে আগুনে, অন্ধকার ঘর লালচে আলোয় আলোকিত, দেয়ালে ছায়া নাচছে, কেমন যেন রহস্যময় করে তুলেছে ঘরের পরিবেশ। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কালো আকাশ, টাওয়ারের মাথায় যেন নেমে এসেছে ভারি মেঘ-ঠেকে আছে, নড়তে-চড়তে পারছে না। সাদা ছেঁড়া মেঘকে ঘোড়দৌড় করাচ্ছে বাতাস, ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে উত্তরে। সাগর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গর্জন কানে আসছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বাতাসের তীক্ষ্ণ বাঁশি।
সাগরের পারে বাস, অথচ সাগরকে এমনভাবে গর্জাতে শুনিনি কখনও! রবিন বলল। ঝড় অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন অবস্থা.. থেমে গেল সে।
এ আর এমন কী? জর্জ বলল। এর চেয়েও ভীষণ ঝড় হয় এদিকে। শীতকালে সবচেয়ে বেশি।
চেঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছে ওদের, নইলে একে অন্যের কথা শুনতে পাচ্ছে না।
অযথা বসে থেকে আর কী লাভ! মুসা প্রস্তাব রাখল। এসো, বোঝা কমাই। শেষ করে ফেলি স্যাণ্ডউইচগুলো।
অন্যেরা হাসল বটে, কিন্তু রাজি হলো।
ঝড়ের মধ্যে আগুনের ধারে বসে এভাবে খাওয়া! রবিন বলল। এর, আগে কতবছর আগে কে খেয়েছিল এখানে, কীভাবে খেয়েছিল, দেখতে ইচ্ছে করছে!
এই, মিয়া, চুপ করো, আর বোলো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল মুসা, যেন ভূত দেখতে পাবে। আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে! সত্যি। সত্যি যদি ওনারা থেকে থাকেন!
তার শিহরণ সংক্রমিত হলো অন্যদের মাঝেও।
চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল ওরা। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে লেমোনেড় দিয়ে। ভালমতই ধরেছে আগুন, উত্তাপ ছড়াচ্ছে, গরম হয়ে উঠেছে ঘর। আগুনের ধার ঘেঁষে বসল জর্জ আর কিশোর, ভেজা জামাকাপড় শুকিয়ে নিতে চায়।
আরে, বাবা, এত কষ্ট করছ কেন? মাংস চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। কাপড় খুলে চিপে নাও না। এখানে সবাই আমরা ছেলে, লজ্জার কী আছে?
ঠিক বলেছ, শার্ট খুলতে আরম্ভ করল কিশোর।
কিন্তু জর্জ দ্বিধা করছে। শার্ট খুলল না সে, মুখ ফিরিয়ে নিল আরেক দিকে, আগুনের আরও ধার ঘেঁষে বসল। সেদিকে চেয়ে হাসল কিশোর। জিনা, আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না নিজেকে। তা ছাড়া তোমার উইগও সরে গেছে, আসল চুল বেরিয়ে পড়েছে। আগুনের আলোয় বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু তুমি ঘরের বাইরে বেরোলেই দেখে ফেলবে ওরা।
হাঁ হয়ে গেছে মুসা আর রবিন। খাওয়া থামিয়ে বোকার মত চেয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। ধীরে ধীরে চোখ ফেরাল ওরা জর্জের দিকে! ও…ও জিনা? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন।
কেন, এখনও সন্দেহ আছে? মিটিমিটি হাসছে কিশোর।
কিন্তু ওই নাক…দাঁত… মুসার গলায় খাওয়া আটকে যাওয়ার। অবস্থা।
হাত বাড়িয়ে জিনার নাক চেপে ধরল আচমকা কিশোর, দুআঙুলে টিপে ধরে টেনে খুলে নিয়ে এল আলগা রবারের নাকটা। জিনা, সামনের দাঁত দুটো খুলে ফেললো।
কারও দিকে না চেয়ে আস্তে করে ওপরের পাটির সামনের দুটো আসল দাঁতের ওপর থেকে প্লাস্টিকের দাঁত খুলে আনল জিনা। হঠাৎ মুখ তুলে হাসল সে, ঝকঝকে দাঁত, সুন্দর মিষ্টি হাসি। যাই বলো, কিছুদিনের জন্যে তো বোকা বানাতে পেরেছি।
উঁহু, আমাকে পারোনি, মাথা নাড়ল কিশোর। শার্টটা চিপে পানি ঝরিয়ে আবার গায়ে চড়াল। আমি দেখেই চিনেছি। …ওভাবে কষ্ট করার দরকার নেই, আমরা ঘুরে বসছি। শার্ট খুলে চিপে নাও। উইগ খুলে চুল মুছে নাও।
শার্ট খুলে চিপে নিল জিনা। আবার পরে নিয়ে বলল, এবার ফিরতে পারো।
হুঁ, সেজন্যেই চেনা চেনা মনে হয়েছে। রবিন বলল। হাসি চেনা, শুধু দাঁতের জন্যে…তবে গলার স্বর…
আমারও সন্দেহ হয়েছে, মুসা বলল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে সব সময়, সবই করে, অথচ পানিতে নামার বেলা চুল ভিজে যাওয়ার ভয়ে নামোনি, না?
মাথা ঝোকাল জিনা।
জিনা, কিশোর বলল, গোবেল তোমার মায়ের কুলের নাম, না?
হ্যাঁ।
আবার খাওয়ায় মন দিল ওরা।
আগুন নিভু নিভু হয়ে আসছে।
আরও কুটো দরকার, জিনা বলল। ঝড় থামতে দেরি আছে। দেখি, যাই, নিয়ে আসি… বাজ পড়ার ভয়ানক শব্দে চমকে থেমে গেল।
এই ঝড় রাফিয়ানেরও পছন্দ হচ্ছে না। জিনার গা ঘেঁষে বসেছে, কান খাড়া, ব্ৰাজ পড়ার শব্দ হলেই গো গো করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাড়গোড় বা দুএক টুকরো রুটি তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে, টুকিয়ে টুকিয়ে খাচ্ছে সে ওগুলো।
চারটে করে বিস্কুট পড়ল একেকজনের ভাগে। জিনা বলল। আমার চারটে রাফিকে দিয়ে দাও। ওর খাওয়ার বিস্কুট আনিনি, আমারগুলোই খাক। বেচারার নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে।
আরে, দূর, তোমার সুরগুলো দেবে কেন? মুসা বাধা দিল। সবার। ভাগ থেকেই একটা করে দিই, চারটে হয়ে যাবে ওর।
তোমরা সবাই খুব ভাল, জিনা আন্তরিক গলায় বলল। সেজন্যেই এই ছুটিতে তোমাদের কথাই প্রথম মনে এল। দিলাম চিঠি লিখে। ভালই কাটছে, না?
হুফ! সবার আগে জবাব দিল রাফিয়ান। চারটে আস্ত বিস্কুট পেয়ে। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে, কুকুরে-হাসি। চার কামড়ে চারটে বিস্কুট সাবাড় করে দিল সে, তারপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে চিত হয়ে শুয়ে চার পা তুলে দিল ওপর দিকে। হেসে জিনা তার পেটে আঙুল বুলিয়ে দিল।
খাওয়া শেষ, আগুনও একেবারে কমে গেছে। মুসা আরও গোটা দুয়েক বাসা ভেঙে নিয়ে আসার জন্যে উঠল। কাধ চেপে তাকে বসিয়ে দিল কিশোর। আমি ভিজেছি, ভিজি আরেকবার। তুমি বসো। তা ছাড়া বাইরের অবস্থাও দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। মুসা কিংবা জিনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
টাওয়ারের কাছে এসে দাঁড়াল। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। থেকে থেকেই বাজ পড়ছে, আকাশটাকে চিরে ফালা ফালা করে দিচ্ছে যেন বিদ্যুতের নীল শিখা। ঝড়কে ভয় করে না কিশোর পাশা, কিন্তু এই ঝড়টা অস্বস্তি জাগাচ্ছে তার মনে, কেন জানি! ভয়ঙ্কর অবস্থা আকাশ আর সাগরের। বজ্রের গর্জন মিলিয়ে যাওয়ার পর পরই কানে আসছে সাগরের হুঙ্কার। দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে, কিন্তু অনুমান করতে পারছে সে, ঢেউয়ের বড় বড় একেকটা পর্বত ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের গায়ে, প্রচণ্ড শব্দে ভাঙছে, তার ছিটে উঠে আসছে এই এত ওপরে, টাওয়ারের গোড়াতেও। বৃষ্টি না থাকলে ওই ছাটের জন্যেও ভিজে যেত কিশোর। সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার! বিস্মিত গলায় আপনমনেই বিড়বিড় করলসে।
কী ভেবে ঘুরল কিশোর। ভেজা পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দিয়ে চলে এল দেয়ালটার কাছে, যেটা এককালে পুরো দুর্গকে ঘিরে রেখেছিল, এখন জায়গায় জায়গায় ভাঙা। তেমনি একটা ভাঙা জায়গার কাছে এসে দাঁড়াল সে। সাগরের দিকে চেয়ে বোবা হয়ে গেল! এ কী দৃশ্য!
ঢেউ তো না, যেন ধূসর-সবুজ পর্বত একেকটা। ছুটে এসে গিলে। ফেলতে চাইছে ছোট্ট দ্বীপটাকে, চূড়ায় সাদা ফেনা, আকাশের বিদ্যুতের সঙ্গে চমকাচ্ছে। এত জোরে বাড়ি মারছে দ্বীপটাকে, কিশোরের ভয় হলো, ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে না দেয়! পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে বাজ পড়ার শব্দে, না ঢেউয়ের গুমরানিতে ঠিক বুঝতে পারল না।
পুরো তিরিশ সেকেণ্ড নির্বাক চেয়ে রইল কিশোর খোলা সাগরের দিকে। ধীরে ধীরে ভয় কেটে গেল; বুঝতে পারছে, এই সাগরে এর চেয়ে বড় ঢেউ আর উঠবে না, গোবেল দ্বীপকেও ভেঙে নিয়ে যেতে পারবে না। পাশ ফিরে চেয়েই স্থির হয়ে গেল সে। ঢেউয়ের খাঁজে একটা নিয়মিত সময়ে বার বার বেরিয়ে আসছে ডুবো-টিলার চোখা চূড়া, তারই ফাঁকে কালো বড় একটা অবয়ব, ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে মনে হচ্ছে। ঢেউয়ের দোলায় দুলছে; একবার, এপাশে কাত হচ্ছে, একবার ওপাশে; তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ভাসছে। কী ওটা!
জাহাজ হতে পারে না! নিজেকে বোঝাল কিশোর বিড়বিড় করে। দ্রুত হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ডের গতি, চোখের সমস্ত ক্ষমতা নিংড়ে নিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভালমত, কিন্তু বৃষ্টি আর ঢেউয়ের ছটের জন্যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না কিছুতেই। অথচ জাহাজের মতই লাগছে! নাকি জাহাজই! দ্বীপে ভেড়ার চেষ্টা করছে! তা হলে মরেছে ওটা, কেউ বাঁচাতে পারবে না!
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কিশোর। কালো বস্তুটা আরেকবার ভাসল, তারপর ডুবে গেল আবার। হঠাৎ তার মনে পড়ল আগুনের কথা, নিভে গেল না তো? ফিরল সে।
আর আধ মিনিট দেরি করলেই নিভে যেত আগুন। ফিরে আসায় কোনমতে বাঁচানো গেল।
অদ্ভুত একটা জিনিস দেখে এসেছি, বলল কিশোর। জাহাজের মতই লাগল!
হাঁ করে তাকিয়ে রইল অন্য তিনজন।
জাহাজের ভূত! ঝড়ের মাঝে বেরোয়! গলা কেঁপে উঠল মুসার।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জিনা। চলো তো, দেখি! আগুনে আরও কয়েকটা কুটো ফেলে কিশোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরোল সে। রবিন আর মুসা চলল ওদের পেছনে।
বাতাসের গতি কমছে, কিন্তু বৃষ্টি বেড়েছে, ঝড় সরে যাচ্ছে বোধহয়। বাজ পড়ছে এখনও, তবে অনেক দূরে, সরে যাচ্ছে আরও, বিদ্যুতের ঝলকও কমছে। ভাঙা দেয়ালটার কাছে সঙ্গীদেরকে নিয়ে এল কিশোর।
ধূসর-সবুজ ঢেউ দেখল ওরা, ঢেউয়ের মাথায় ফেনা দেখল, দ্বীপ ঘিরে পানির তা-থৈ নাচ দেখল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছে মুসা আর রবিন, কিশোরের বাহু খামচে ধরে রেখেছে জিনা।
ওই যে ওদিকে, হাত তুলল কিশোর। চোখা পাথরের মাঝে। দেখেছ?
প্রথমে কিছু দেখল না, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা, হ্যাঁ হ্যাঁ, জাহাজ! জাহাজই! বড়…অনেক বড়, সেইলিং বোট কিংবা জেলেদের বোট নয়।
ওই যে বললাম, ভুতুড়ে! ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।
তার কথায় কান দিল না কেউ, অবাক হয়ে চেয়ে আছে জাহাজটার দিকে। পুরোপুরি ভেসে উঠেছে এখন, কালো বিশাল দেহ, দুলছে ঢেউয়ে। ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কিনারে নিয়ে আসছে ঢেউ, খুব ধীরে ধীরে।
মরবে! কিশোর বলল। যা চোখা পাথর! তলায় খোঁচা লাগলেই খতম!
তার কথা শেষও হলো না, কাঠ ভাঙার তীক্ষ্ণ মড়মড় শব্দ উঠল, দুলে উঠে এক পাশে অনেকখানি কাত হয়ে গেল জাহাজ। দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিমের ভয়াল ডুবোটিলার চূড়ায় বাড়ি লেগেছে। কাত হয়েই রইল জাহাজটা, তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল মস্ত একটা ঢেউ। ঢেউ সরে যাওয়ার পরও একই জায়গায় একইভাবে থেকে গেল জাহাজটা।
গেছে আটকে! কিশোর বলল। আর নড়তে পারবে না। ঝড় থামলেই পানি নেমে যাবে, ওখানে ওভাবেই আটকে থাকবে জাহাজটা।
বৃষ্টি ধরে এসেছে, তবে একেবারে থামেনি। এরই মাঝে মেঘের ফাঁকে রোদ দেখা দিল, চকিতের জন্যে। বোঝা গেল, শিগগিরই সূর্য বেরিয়ে আসবে।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এ আবার কী? এখনই ঝড়, এখনই রোদ!
গরমকালে এদিকের ঝড় এমনই, জিনা বলল। এই আছে, এই নেই।
মেঘ পাতলা হয়ে এল, ঝড়ো বাতাস মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় এল ফুফুরে হাওয়া। মেঘের ফাঁকে হেসে উঠল সূর্য, উষ্ণ কোমল রোদ যেন স্বাগত জানাল ওদের। ঢেউ কমে গেছে, পানি নেমে গেছে অনেক, টিলার মাথায় আটকা পড়া জাহাজটা এখন স্পষ্ট।
অদ্ভুত! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অদ্ভুত দেখাচ্ছে! জাহাজের এমন চেহারা…
বুঝেছি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা। তার ধূসর চোখে আলো। উত্তেজনায় কথা আটকে যাচ্ছে।
কী! জিনার কাধ খামচে ধরল কিশোর।
কিশোর…ওটা, ওটা আমার জাহাজ! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল জি না। আমার ডুবোজাহাজ! ঝড়-ঝড় সাগরের তলা থেকে তুলে দিয়েছে! আমার জাহাজ!
পলকে বুঝে গেল অন্যেরা, জাহাজটার এই চেহারা কেন। আধুনিক জাহাজ নয়, পুরানো কাঠের জাহাজ, পাল নেই, মাস্তুল ভাঙা। জাহাজ নয়, জাহাজের ধ্বংসাবশেষ!
ভালই হলো, জিনার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে আনল কিশোর। ভালমত খুঁজে দেখতে পারব এবার। হয়তো কে জানে, হয়তো সোনার বারগুলো পেয়েও যেতে পারি! কি বলো, জিনা?
সাত
এরপর মিনিটখানেক নির্বাক হয়ে জাহাজটার দিকে চেয়ে রইল ওরা। কালো পুরানো ভেজা ধ্বংসাবশেষের ভিতরে অসংখ্য সোনার বার! –ভাবতেই কেমন জানি লাগছে!
জিনার হাত ধরল কিশোর। কি বলো, জিনা?
তবুও জবাব দিল না জিনা, বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে জাহাজটার দিকে। হঠাৎ করেই ফিরল কিশোরের দিকে। জাহাজটা তখন কার ছিল জানি না, হয়তো কোন রানী বা রাজার, কিন্তু এখন আমার! সাগরের তলায় ডুবে ছিল, ভেসে উঠেছে। কিশোর, ওটার ক্যাপ্টেন ছিল আমাদের নানার-নানার-বাবা। জিনিসটা তো এখন আমারই সম্পত্তি, নাকি? কেউ ছিনিয়ে নিতে আসবে না তো আবার?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না কিশোর। মুসা বলল, তা আসতেও পারে! তবে আমরা ওটার কথা কাউকে না বললেই হলো।
বোকার মত কথা বোলো না! জাহাজের মালিকানা হারানোর ভয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে জিনার। জেলেরা আসে, কারও না কারও চোখে পড়ে যাবেই। এত বড় একটা জাহাজ দেখতে না দেখতে রটে যাবে খবর!
তা হলে কেউ দেখার আগেই চলো ভেতরে খুঁজে দেখি, মুসা প্রস্তাব দিল। ঢেউ আরেকটু কমলেই যাব।
ঢেউ তেমন কমতে অনেক দেরি, জিনা বলল। নৌকা নিয়ে যেতে হবে। এখন যা আছে ঢেউ, তার অর্ধেক থাকলেও আছড়ে গুঁড়ো করে দেবে ডিঙি। আজ সম্ভব না।
কাল সকালে? জিনার দিকে তাকাল কিশোর। অন্য কেউ এদিকে আসার আগেই যদি চলে আসি আমরা? ভেতরে কিছু না কিছু পেয়ে যেতে
পাবে না, মাথা নাড়ল জিনা। বললাম না, ডুবুরিরা কিছু বাকি রাখেনি…
যত যেভাবেই দেখুক, বাধা দিয়ে বলল কিশোর, পানির তলায় অত খুঁটিয়ে দেখা যায় না। ওপরে অনেক ভাল করে দেখতে পারব। তা হলে কাল সকালেই, কি বলো?
হ্যাঁ, তা আসা যায়, জাহাজটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না যেন জিনা। স্বপ্নের মত লাগছে! আমি.. আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এতকাল পর ওটা উঠে এল পানির তলা থেকে!
মেঘ কাটেনি পুরোপুরি, তার ভিতর দিয়েই সূর্য উঠেছে, রোদ বেশ কড়া। ভেজা কাপড় থেকে হালকা বাষ্প উঠতে শুরু করেছে, এমনকী রাফিয়ানের ভেজা রোম থেকেও বাষ্প উঠছে রোদের আছে। সে-ও তাকিয়ে আছে জাহাজের দিকে, থেকে থেকে চাপা স্বরে গোঁ গোঁ করছে।
কী রে জাহাজ দেখে অমন করছিস কেন? কুকুরটার মাথায় হাত রাখল জিনা। ওটা শত্রু না, লাগতে আসবে না তোর সঙ্গে।
হয়তো তিমি-টিমি ভেবেছে, হেসে বলল রবিন। জিনা, কাল সকালে কেন? আজই যাওয়া যায় না?
নাহ! আমারও খুবই ইচ্ছে করছে, কিন্তু সম্ভব না। দেখছ, জাহাজটা এখনও পুরোপুরি বসেনি পাথরের ফাঁকে? বড় ঢেউ এলেই দুলে উঠছে। পাথরে বাড়ি খেতে পারে নৌকা, আর যদি কোন অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যাইও জাহাজে উঠতে পারব না কিছুতেই। খুবই বিপজ্জনক। খামোকা, ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে কাল সকালেই আসব।
আরও খানিকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে জাহাজটা দেখল ওরা। তারপর ঘুরল। নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। ওদেরকে দেখেই টাওয়ার থেকে নেমে এল কাকের ঝাঁক, বাসা ভাঙা হয়েছে দেখেছে, মাথার ওপর উড়ে কা-কা করতে লাগল। গর্ত থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে। খরগোশেরা। কাকের কা-কায় কান না দিয়ে খরগোশের গর্ত এড়িয়ে, ঝোঁপঝাড় ভেঙে, টিলা ডিঙিয়ে আবার নেমে এল ওরা প্রাকৃতিক জেটিতে। মুসা একাই নামিয়ে আনল ডিঙিটা।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ভাল, জিনা বলল। ঢেউ এখনও বেশি। আকাশের দিকে তাকাল সে। হুমম! আবার বৃষ্টি আসবে। জোয়ারের আগে এসে গেলে মরেছি; তা হলে আজ আর বাড়ি ফিরতে পারব না।
ভাগ্য ভাল, জোয়ারের আগে এল না বৃষ্টি। ঢেউয়ের প্রতিকূলে পালা করে দাঁড় বেয়ে চলতে বেশ কষ্টই হচ্ছে ওদের।
খোলা সাগরে বেরিয়ে এল নৌকা। জাহাজটা দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে, উল্টো দিকে রয়েছে, পাহাড়ের ওপাশে।
নাহ, দেখবে না কেউ, দাঁড় বাইতে বাইতে বলল কিশোর। জিনার দিকে ফিরল। রাতে মাছ ধরতে যায় জেলেরা?
যায়। তবে আজ যাবে না। আকাশ আবার খারাপ হচ্ছে।
এই, দাঁড়টা আমাকে দাও তো, কিশোরের দিকে হাত বাড়াল মুসা। তোমার হাতে থাকলে সারাক্ষণ ওদিকেই চেয়ে থাকবে, বাড়ি ফেরা আর হবে না। এদিকে খিদেয় আমার পেট জ্বলছে।
হুফ! সঙ্গে সঙ্গে একমত হলো রাফিয়ান। মুসার হাটু ঘেষে এসে লেজ নাড়তে লাগল।
যাক, এতদিনে মনের মত দোস্ত পেয়েছ একটা, হেসে টিপ্পনী কাটল রবিন।
তীরে নেমে টেনে ডাঙার অনেক ওপরে নৌকাটা তুলে রাখল ওরা। জিনা বলল, তোমরা দাঁড়াও, আমি রাফিকে দিয়ে আসছি এক দৌড়ে!
বাড়ি ফিরতে দেরিই হয়ে গেল। খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। মিসেস পারকার, দুশ্চিন্তা শুরু করেননি এখনও।
কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল ওরা। খাবারের বহর দেখে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার। প্রথমেই কেকটা টেনে নিল সে। বড়সড় ডিশের প্রায় কানা ছুঁই ছুঁই করছে কেকের প্রান্ত। গাঢ় চকলেট রঙ, ঘি চুপচুপ করছে, চূড়ায় বড় বড় কিসমিস আর বাদাম গা ডুবিয়ে আটকে আছে, ভিতরে মোরব্বার কুচি আর কী কী আছে, অনুমান করতে কষ্ট হলো না তার। ছুরি দিয়ে বড় এক টুকরো কেটে নিয়ে কামড় বসাল। আরি, কী স্বাদ! কেক তৈরিতে মেরি চাচীকেও ছাড়িয়ে গেছেন জিনার মা।
দিনটা কেমন কাটল? হেসে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস পারকার।
খুব ভাল, খুব ভাল, মুখে কেক ভর্তি, কথা স্পষ্ট হচ্ছে না মুসার। দারুণ একখান ঝড় বইল। ধাক্কা দিয়ে সাগরের তল থেকে জা…
একসঙ্গে লাথি চালাল কিশোর আর রবিন। নাগালের মধ্যে থাকলে। জিনাও লাথি মারত। আঁউক! করে উঠল মুসা, চোখে পানি এসে গেল।
কী হলো? অবাক হলেন মিসেস পারকার। গলায় আটকেছে? এত তাড়াতাড়ি কীসের, আস্তে খাও না। নাও, পানি খেয়ে নাও। গেলাস ঠেলে দিলেন মুসার দিকে। হ্যাঁ, তারপর কী হলো?
জিনার কড়া দৃষ্টি থেকে চোখ সরাল মুসা। ও, হ্যাঁ, সাগরের তল থেকে, জানেন, কী যে বড় বড় ঢেউ…
ঢেউ সাগরের তল থেকে ওঠে নাকি? বোকা ছেলে, হাসলেন। মিসেস পারকার। জর্জের দ্বীপ দেখেছ?
নিশ্চয়। এত সুন্দর না! তবে ঝড়ের জন্যে কিছু দেখতে পারলাম না। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, আমার মতই রাহাউক! আবার লাথি খেয়েছে পায়ে।
জিনার মা যাতে কিছু বুঝতে না পারেন সেজন্যে তাড়াতাড়ি বলল। কিশোর, খরগোশগুলো তো একেবারে পোষা।
হ্যাঁ, আর করমোরেন্টও দেখলাম, রবিন যোগ করল। অনেক অনেক করমোরেন্ট।
আর জানো, মা, জিনা বলল, কাক এত বেশি হয়েছে না। সারাক্ষণ খালি কা-কাকা-কা, একেবারে কান ঝালাপালা…
তোরাও দেখি কাকের মতই কা-কা শুরু করে দিলি! ভুরু কোচকালেন মিসেস পারকার। নে, জলদি খেয়ে নে। তারপর চুপচাপ যার যার ঘরে চলে যা। উনি ব্যস্ত, জরুরি কাজ করছেন। চেঁচামেচি শুনলে রাগ করবেন। যাই, খাবারটা দিয়ে আসি। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই বললেন, আরে, আকাশ আবার খারাপ! জোর বৃষ্টি আসবে।
প্লেটে খাবার নিয়ে স্বামীর কাজের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
গাবা কোথাকার! চাপা গলায় ধমক দিল কিশোর। দিয়েছিলে তো ফাস করে! মুখ সামলাতে পারো না?
হয়েছে, হয়েছে, আবার বকাবকি করছ কেন? মুসার মুখ গোমড়া, কিন্তু খাবার চিবানোয় বিরতি নেই।লাথি তো যা মারার মেরেছ, চামড়া ছড়ে গেছে পায়ের। এক কামড়ে একটা সামুসার আধখানারও বেশি মুখে পুরল সে।
হো হো করে হেসে ফেলল অন্য তিনজন। মুসার মুখ ভরা, হাসতে পারছে না, কিন্তু চোখ উজ্জ্বল।
খাওয়া শেষ করে ওপরে চলে এল ওরা। জিনা বলল, এবার তো ঘরে বন্দি। দাঁড়াও, লুডু নিয়ে আসছি।
খেলা শুরু হলো। কিশোর আর জিনা জুটি হয়েছে। প্রতিপক্ষ রবিন আর মুসা। খেলা চলছে, এক সময় প্রশ্ন করল কিশোর, আচ্ছা, জিনা, তোমাকে জর্জ বলে ডাকেন কেন তোমার মা-বাবা?
ছেলের খুব শখ ওদের, গুটি চালতে চালতে বলল জিনা। আমার একটা ভাই হয়ে মারা গেছে, তার নাম ছিল জর্জ। তার পরে আমি হয়েছি, তাই আমাকে দিয়েই পুত্রসন্তানের আশা পূরণ করে তারা, শেষ কয়েকটা শব্দ বিশেষ এক ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল সে। আরে, আরে, একী! চেঁচিয়ে উঠল সে। আমার গুটি খেয়ে ফেলেছ? চুরি করেছ তুমি, স্রেফ চুরি!
না, চুরি করিনি! মুসাও চেঁচাল। ছক্কা উঠেছে আমার, ঠিকই খেয়েছি!
না, চুরি করেছ!
না, করিনি!
বেধে গেল ঝগড়া। টান দিয়ে লুডু ছিঁড়ে ফেলল জিনা। তাকে থামাতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেলে দিল রবিন। এক ঝটকায়। খুলে গেল দরজা, জিনার বাবা, রাগে লাল চোখমুখ। ধমকে উঠলেন, এই, হচ্ছে কী!
মুহূর্তে চুপ হয়ে গেল সবাই।
খালি শয়তানি, না? চুপচাপ গল্প করো। আবার যদি গোলমাল শুনি, কাল ঘরে আটকে রাখব, বেরোতেই দেব না, হ্যাঁ। যত্তসব!, গজগজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি।
সরি, মুসা, লজ্জিত হয়েছে জিনা।
মুসা কিছু বলতে পারল না, শুধু লজ্জিত হাসি হাসল।
বাইরে অঝোর বৃষ্টি। আকাশ কালো। সন্ধ্যা নামতে দেরি আছে, অথচ বৃষ্টির জন্যে এখনই বেশ অন্ধকার। সাগরের দিকে তাকাল কিশোর, দিগন্ত চোখে পড়ছে না, আড়াল করে দিয়েছে বৃষ্টির চাদর। আনমনেই হাত বাড়িয়ে জানালার কাছের গাছ থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটতে শুরু করল ভেজা পাপড়িগুলো।
খেলা বা গল্প কিছুই আর জমল না। আর কিছু করারও নেই এখন। সকাল সকালই শুতে গেল ওরা। মুসা আর রবিন শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু কিশোর আর জিনার চোখে ঘুম নেই। দুজনের মনে একই ভাবনা। বৃষ্টি থামবে তো সকালের আগে? জাহাজে উঠতে পারবে? আচ্ছা, সত্যিই কি পাবে ওরা সোনার বারগুলো? সেরাতে স্বপ্ন দেখল কিশোর, জলদস্যুদের সর্দার হয়েছে সে, পালতোলা কাঠের জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে খোলা সাগরে, দিগ্বিজয়ে। জিনা দেখল দুঃস্বপ্ন, ভোরের দিকে
আট
কিশোওর! কিশোওর! বাঁচাও! বাঁচাও! আমার দম আটকে আসছে…
জিনার চিল্কারে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল রবিন। পাশের। বিছানায় ছটফট করছে জিনা। উঠে গিয়ে ঠেলা দিল, এই, জিনা, কী হয়েছে। ওঠো। দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
চোখ মেলল জিনা। আমি পাতালঘরে বন্দি-সোনার বার…ওহ, মুখে হাসি ফুটল সহসা। স্বপ্ন দেখছিলাম! উঠে বসল সে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল ওরা, কখন বৃষ্টি থেমে গেছে। দিগন্তে পানির তলা থেকে যেন পিছলে বেরিয়ে আসছে বিশাল সূর্যটা, সাগরের পানি তো নয়, টলটলে তরল সোনা, আকাশে সাদা মেঘ রক্তাক্ত, তাতে সোনালি ছোপ। গোলাপবনে টুইই টুইই করে ডাকছে কী একটা নাম-না-জানা ছোট্ট পাখি। অপূর্ব সুন্দর এক সকাল!
কিশোরও উঠেছে। মুসাকে ঠেলা দিল, এই, এই, মুসা ওঠো। সকাল হয়েছে।
চোখ মেলল মুসা, কিশোরের দিকে চেয়ে হাসল। কেমন এক ধরনের সুখের অনুভূতি, তাদের মনে। আবহাওয়া পরিষ্কার, অভিযানে বেরোবে খানিক পরেই। বিছানা ঝাড়ল মুসা। রবিন আর জিনাকে ডাকতে চলল কিশোর, কিন্তু বারান্দায় বেরিয়েই দেখল, ওরা দুজন তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসছে।
কিশোরকে দেখেই ঠোঁটে আঙুল রাখল জিনা, জোরে কথা বোলো না! মা-বাবা নিশ্চয় এখনও ওঠেনি। দেখা হলেই হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, তার চেয়ে, চলো, না জানিয়েই বেরিয়ে পড়ি। ফিরে এসে খাব।
পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল ওরা বাড়ি থেকে।
রোদ বাড়ছে, সূর্যটা এখনও দিগন্তেই রয়েছে, পানির সামান্য ওপরে। আকাশ এত পরিষ্কার, মনে হয় যেন এই মাত্র ধুয়ে এনে ছড়ানো হয়েছে। উজ্জল নীল আকাশের পুবে সাদা মেঘের গায়ে গোলাপী রঙ লেগেছে, সাগর যেন একটা চকচকে আয়না। আবহাওয়া দেখে মনেই হয় না, গতকাল কী ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে!
সৈকতে তিন গোয়েন্দাকে দাঁড়াতে বলে ফগের বাড়ি চলে গেল। জিনা। খানিক পরেই নৌকা বেয়ে নিয়ে ফিরে এল।
দ্বীপে রওনা হলো ওরা। দাঁড় বাইতে পরিশ্রম লাগছই না প্রায়, সাগর একেবারে শান্ত। দ্বীপের ধার দিয়ে ঘুরে অন্যপাশে নৌকা নিয়ে এল জিনা।
চোখা পাথরে কাত হয়ে আটকে রয়েছে জাহাজটা, পাথরের মতই অনড়। হালকা ঢেউয়ের তলা দিয়ে পানি আসছে-যাচ্ছে, কিন্তু জাহাজকে নড়াতে পারছে না, তার মানে ভালমতই আটকেছে। পানির তলায়ই ভাঙা ছিল অবশিষ্ট একটি মাত্র মাস্তুল, গতকালকের ঝড়ে সেটা ভেঙে আরও খাটো হয়েছে।
ইসস, কী অবস্থা হয়েছে! আফসোস করল জিনা। আরও ভেঙেছে! এটুকু যে রয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! যা একেকখান বাড়ি খাচ্ছিল!
কিন্তু ওটার কাছে যাবে কী করে? মুসা বলল। জাহাজের চারপাশে চোখা পাথরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
দেখোই না, কী করে যাই, জিনা হাসল। তার কথা বিশ্বাস করল। তিনজনেই। গোবেল দ্বীপ আর তার চারপাশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা হাতের উল্টোপিঠের মতই পরিচিত জিনার কাছে। দাঁড় বাওয়ার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, কতখানি আত্মবিশ্বাস রয়েছে ওর।
কাছে চলে এল ডিঙি। বিশাল জাহাজ, দূর থেকে দেখে বোঝা যায়নি এত বড়, পানির তলায় ডুব দিয়ে তো নয়ই। জাহাজের শরীর কামড়ে ধরে রেখেছে নানারকমের ছোট-বড় শামুক। এখানে-ওখানে ঝুলে রয়েছে শেওলা, বাদামী-সবুজ, আধশুকনো। ভেজা ভেজা কেমন একটা আশটে গন্ধ ছড়াচ্ছে। জাহাজের খোলে ইয়া বড় বড় কালো ফোকর, পাথরের খোঁচায় হয়েছে। অনেক পুরানো একটা লাশ যেন, দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।
যে কটা পাথরে জাহাজ আটকে রয়েছে, তার একটার গা ঘেঁষে নৌকা রাখল জিনা। জোয়ার আসছে, ঢেউ ছলাতছল বাড়ি খাচ্ছে পাথরের গায়ে, পানির ছিটে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের জামা।
নৌকা বাধি কোথায়! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে জিনা।
জাহাজের সঙ্গেই, কিশোর বলল। দড়িটা কোথায়? পাটাতনের নিচ থেকে খুঁজে দড়ি বের করে নিল সে। এক মাথা নৌকার গলুইয়ের আঙটার সঙ্গে বেঁধে আরেক মাথায় একটা ফাস তৈরি করল। জাহাজের ডেকের ভাঙা রেলিঙের একটা খুটি সই করে ছুঁড়ে দিল ফাসটা, আটকাল না। তিন বারের বার কাজ হয়ে গেল। টেনে ফাসটা খুঁটিতে এটে নিল। সে। দুটো কাজ হলো এতে। নৌকাও বাধা হলো, জাহাজে ওঠারও ব্যবস্থা হলো।
দড়ি বেয়ে বানরের মত সবার আগে ডেকে উঠে গেল জিনা। কিশোর আর মুসা উঠল তার পর। সবার শেষে রবিন। রেলিঙের কাছাকাছি এসে হাঁপ ধরে গেল তার, ওপর থেকে হাত ধরে টেনে তুলে। নিল তাকে মুসা।
এই সেই ডেক, না? বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ডেকে চোখ বোলাচ্ছে জিনা। এখানেই ঘুরে বেড়াত এক সময় জ্যান্ত মানুষ, আমার নানার-নানার বাবা! বড় একটা গর্তের দিকে আঙুল তুলল সে। ওই যে, সিঁড়ি বোধহয় ওখানেই।
গর্তটার কাছে এসে ঘিরে দাঁড়াল ওরা। সিঁড়িই। মরচে ধরা লোহার একটা মই জায়গামতই আটকে আছে এখনও।
ভার সইবে তো? দেখতে দেখতে বলল জিনা। ইস, কী অন্ধকার!
প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে আনতে সাধারণত ভুল করে না কিশোর। পাশা, কোমরের বেল্ট থেকে টর্চ খুলে হাতে নিয়ে মই বেয়ে নামতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল অন্য তিনজন সাবধানে, যদি ভেঙে পড়ে! না, ভাঙল না মই, নিরাপদেই নামল ওরা।
বিরাট খোল, বেজায় অন্ধকার, টর্চের আলোয় রহস্যময় দেখাচ্ছে। ভারি ওক কাঠে তৈরি নিচু ছাত, রবিনেরই মাথা নুইয়ে রাখতে হচ্ছে, মুসার তো আরও অসুবিধে। এখানে কেবিন ছিল নাকি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেয়াল-টেয়াল কিছু নেই এখন, ভেঙেচুরে সব একাকার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাঠ। নানারকম জিনিস ছিল, সব কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে, শামুক আর শেওলার রাজত্ব। তীব্র আশটে গন্ধ, শামুক আর শেওলা পচতে শুরু করলে গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠবে, বোঝাই যাচ্ছে।
হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, ভীষণ পিচ্ছিল। দড়াম করে এক আছাড় খেল মুসা, এরপর পা বাড়াতেই ভয় হলো তার। এক মাথায় পাটাতনে বড় আরেকটা গর্ত দেখা গেল। আগে এখানে কেবিন ছিল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেবিনের মেঝেতেই গর্তটা।
ওর নিচেই বোধহয় সোনার বাক্সগুলো রাখা হয়েছিল, গর্তে আলো ফেলে বলল কিশোর। হয়তো ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। নোনা পানি আছে এখন, আর জ্যান্ত মাছ। ইচ্ছে করলে নামা যায় ওখানে, কিন্তু লাভ কী? উপুড় হয়ে শুয়ে গর্তের ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে, আলো ফেলে দেখল। না, বাক্স চোখে পড়ছে না। বড় একটা ভাঙা পিপে ভাসছে পানিতে, ভিতরে কিছু নেই।
কিশোরের পাশে শুয়ে ভিতরে উঁকি দিল জিনা। হু, পানির পিপে। মদেরও হতে পারে। কিংবা মাংস, কিংবা বিস্কুট, কিন্তু সোনা নয়। আরে, পানির তলায় ওসব কী? ও, বাঙ্ক। সাধারণ নাবিকরা থাকত ওখানে।
কোণের দিকে এক জায়গায় অনেকগুলো হুক দেখা গেল দেয়ালে, তাতে শেওলা ঝুলে রয়েছে। রান্নাঘর ছিল। বাবুর্চির কড়াই আর কাপ, প্যান ঝুলিয়ে রাখা হতো ওগুলোতে।
পুরো জাহাজটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে লাগল ওরা। ক্ষীণ একটা আশা রয়েছে মনে, যদি বাক্সগুলো মিলে যায়! কিন্তু পাওয়া গেল না, একটা বাক্সও না, বার রাখার বাক্স তো দূরের কথা, কোনরকমের কোন বাক্সই দেখতে পেল না।
এক পাশে একটা দেয়ালের কিছু তক্তা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, দরজাটা কোথায় ছিল বোঝা যায়। বড় একটা কেবিনে এসে ঢুকল ওরা। অন্য তিন পাশের দেয়াল মোটামুটি ঠিকই রয়েছে। এক কোণে একটা বড় বাঙ্ক, তাতে নারকেলের সমান বড় এক কাকড়া শুয়ে আছে। সাড়া পেয়ে লম্বা একটা দাঁড়া বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে, খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে সিদ্ধান্ত নিল, শুয়ে থাকবে আগের মতই। আরেক কোণে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা গোল টেবিল, দুটো পায়া নেই। কাঠের বুকশেলফ আছে, তাতে বই নেই, তার জায়গায় রয়েছে রাশি রাশি শামুক আর ঝিনুক, কুৎসিতভাবে ঝুলে রয়েছে শেওলা। দেয়ালেও শামুক আর শেওলার ছড়াছড়ি।
ক্যাপ্টেনের কেবিন, বিড়বিড় করল কিশোর। কোনায় ওটা কী?
এগিয়ে গিয়ে তুলে নিল রবিন। কাপ। আধখানা পিরিচও পড়ে আছে। জাহাজটা যখন ডুবেছিল, চা বা কফি খাচ্ছিলেন বোধহয় ক্যাপ্টেন!
এমনিতেই অস্বস্তি বোধ করছে ওরা, এই প্রাপ্তি মন আরও খারাপ করে দিল। বাতাসে আঁশটে গন্ধ স্থির হয়ে আছে যেন, পায়ের তলায় কাঠের মেঝে ভেজা, পিচ্ছিল। জিনা ভাবছে, পানির তলায়ই ভাল ছিল, কেন ভাসতে গেল জাহাজটা? গলিত লাশ কবরে মাটি চাপা থাকাই ভাল!
চলো, যাই, গলা কাঁপছে জিনার। আমার ভাল্লাগছে না! গা গুলাচ্ছে!
যাওয়ার জন্যে ঘুরল অন্য তিনজন, শেষবারের মত আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেবিনটা দেখে নিচ্ছে কিশোর। রওনা হতে যাবে, ঠিক এই সময় চোখে পড়ল জিনিসটা। আলো ওটার ওপর স্থির রেখে সঙ্গীদেরকে ডাকল, দাঁড়াও! এক মিনিট!
ঘুরে তাকাল অন্যরাও। ছোট একটা দেয়াল-আলমারির দরজা! তালার ফুটোটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিশোরের।
নিশ্চয় কিছু আছে ওর ভেতরে! উত্তেজিত শোনাল তার কণ্ঠ, হাতের টর্চের আলো কাঁপছে অল্প অল্প। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। দরজার ধারে আঙুল বাধিয়ে টান দিল। খুলল না। তালা আটকানো।
গালে আঙুল রেখে এক মুহূর্ত ভাবল কিশোর। টর্চটা মুসার হাতে দিয়ে কোমর থেকে খুলে নিল তার প্রিয় আট ফলার ছোট ছুরিটা।
একেকটা ফলা একেকটা অতি দরকারী যন্ত্র। তালা খোলার চেষ্টা করল। সে, পারল না। মরচে পড়ে আটকে গেছে। তালার পাশে খোঁচা দিয়ে দেখল, ভিজে নরম হয়ে গেছে, সামান্য খোঁচাতেই কাঠের চলটা উঠে যায়, পচে গেছে একেবারে। শেষে তালার চারপাশের কাঠ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেটে ফেলল সে। ক্রু-ড্রাইভারটা তালার গর্তে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই কুট করে লক-পিন ভেঙে খুলে চলে এল তালা।
দুই তাকের ছোট্ট আলমারি, ভিতরে কয়েকটা জিনিস। একটা কাঠের বাক্স, পানিতে পচে ফুলে রয়েছে। গোটা তিনেক বই, ফুলে তিন গুণ হয়ে রয়েছে। একটা মদের গেলাস, ভেঙে তিন টুকরো, আরও কয়েকটা জিনিস রয়েছে-কী ছিল চেনার উপায় নেই।
নাহ, কিছু নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। তবে বাক্সটা… তুলে নিল সে ওটা। ভেতরে নিশ্চয় কিছু আছে। খুলে দেখতে হবে।
বাক্সের ডালায় দুটো ইংরেজি অক্ষর খোদাই করা: আর জি।
রিচার্ড গোবেল! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। আমার নানার-নানার-বাবা! এটা ওঁর বাক্স! নিশ্চয় মূল্যবান দলিলপত্র রয়েছে ভেতরে! খোলো, খোলা!
চেষ্টা করল কিশোর, কিন্তু তালা খুলতে পারল না। এখানে হবে না। হাতুড়ি দরকার।
চলো, বাড়ি নিয়ে যাই! চলো, চলো! তর সইছে না জিনার।
ডেকে বেরিয়ে এল ওরা। খানিক দূরে খোলা সাগরে জেলে-নৌকার ভিড়, এদিকেই তাকিয়ে আছে জেলেরা, উত্তেজিত ভাবভঙ্গি, জাহাজটা দেখে ফেলেছে।
দড়ি বেয়ে নৌকায় নামল চার অভিযাত্রী। আঙটা থেকে দড়ি খুলে দিল কিশোর, পানিতে ঝুলে রইল দড়ির মাথা, খুঁটি থেকে ফাস খোলা সম্ভব না নৌকায় বসে, দড়িটা ফেলে রেখেই যেতে হচ্ছে।
জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে একটা জেলে-নৌকা। মুখের কাছে হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলল গলুইয়ের কাছে দাঁড়ানো একটা লোক, এইই, শুনছ? কীসের আওয়াজ?।
পুরানো ভাঙা জাহাজ! চেঁচিয়ে জবাব দিল জিনা। ঝড়ে ভেসে এসেছে!
আর কিছু বোলো না, হুঁশিয়ার করে দিল কিশোর। চুপ! কিছু বলল না জিনা। লোকটার দিকে পেছন করে বসে দাঁড় তুলে নিল।
বাড়ি ফিরে দেখল, টেবিলে নাস্তা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মায়ের বকা খাবে ভেবেছিল জিনা, কিন্তু কিছু বললেন না মিসেস গোবেল। কোথায় গিয়েছিল ওরা জানতে চাইলেন শুধু। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিল, জিনা বলতেই চুপ করে গেলেন।
চিকেন সুপ, ডিম ভাজা আর টোস্ট যেন নাকেমুখে গুঁজে দিয়ে শেষ করল ওরা। বাক্সটা লুকিয়ে রেখে এসেছে একটা গোলাপ ঝাড়ের তলায়। খেয়ে গিয়ে কোন এক ফাঁকে বের করে নিয়ে আসবে, উঠে যাবে ওপরতলার চিলেকোঠায়, ওখানে নিয়ে গিয়েই ভাঙবে, আলোচনা করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে।
নয়
তিন গোয়েন্দাকে চিলেকোঠায় পৌঁছে দিয়ে নিচে নেমে গেল জিনা। বাবা কাজের ঘরে, এটো ডিশপ্লেট সরাচ্ছেন মা, খানিক পরেই রান্নাঘরে চলে। গেলেন। এই ফাঁকে বাক্সটা বের করে নিয়ে এক ছুটে ওপরে চলে এল সে।
আরেকবার তালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর, পারল না, মুখ তুলে বলল, জিনা, একটা হাতুড়ি আর ছেনি হবে?
সবই আছে, বাবার যন্ত্রপাতির বাক্সে, জিনা বলল। দাঁড়াও, দেখি আনতে পারি কিনা।
কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এল সে, হাতে হাতুড়ি আর ছেনি। চুরি করে এনেছি। বাবা খুব ব্যস্ত, খেয়াল করেনি। পেছন দিয়ে ঢুকে টুক করে খুলে নিয়ে এসেছি, হাসল সে।
বাক্সটা মেঝেতে রেখে ডালার ওপরে ছেনি বসিয়ে হাতুড়ি দিয়ে কষে এক ঘা লাগাল কিশোর। চলটা উঠে গেল কাঠের, কিন্তু তলায়, মানে বাক্সের ভিতরের দিক শক্ত টিনের পাত দিয়ে মোড়ানো, তাতে বেধে ফিরে এল ছেনির মাথা। আবার ডালার আরেকখানে আক্রমণ চালাল সে, কাঠের চলটা উঠে গেল আরেক জায়গার। ছেনি দিয়ে ডালার অর্ধেকেরও বেশি তুলে ফেলা গেল, কিন্তু ভিতরের লাইনিং কাটেনি। ছেনি বসিয়ে জোরে বাড়ি দিয়ে দিয়ে লাইনিং কাটতে শুরু করল কিশোর, বিকট ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে। তিন ধার কাটা হয়ে গেল, এখন টিনের পাত টেনে ওপরের দিকে বাঁকিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কী আছে না আছে বের করে আনা যাবে। কিন্তু আনা আর হলো না। এক ঝটকায় খুলে গেল। চিলেকোঠার দরজা। জিনার বাবা! রাগে মুখচোখ লাল!
কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন তিনি, এই, কী হচ্ছে! হচ্ছে কী! সারা বাড়ি মাথায় তুলেছ! আওয়াজের চোটে ঘরে থাকতে পারছি না! বাক্সটার ওপর চোখ পড়ল তার। ওটা কী?
তাড়াতাড়ি বাক্সটা তুলে নিল মুসা।
কী ওটা? চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার পারকার। কথা বলছ না কেন?
একটা বা-বাক্স… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি! কীসের বাক্স? দেখি? হাত বাড়ালেন। তিনি।
পিছিয়ে গেল মুসা। না, কিছু না, এমনি…
কী এমনি! দেখি! গর্জে উঠলেন মিস্টার পারকার। এগিয়ে এসে মুসার হাত থেকে বাক্স কেড়ে নিয়ে বললেন, কী সব আজেবাজে জিনিস এনে খালি ঝামেলা! শয়তানীর চোটে কাজ করা যায় না! যত্তোসব! কোথায় পেয়েছ এটা?
জা-জাহাজে…
জাহাজে! কোন্ জাহাজে?
ওই যে…মানে, যেটা ভেসে উঠেছে…
মাথায় দোষ-টোষ নেই তো! কোথায় ভেসে উঠেছে জাহাজ?
এবার রেগে গেল মুসা। দোষ থাকবে কেন? কাল ঝড় হয়েছে, দেখেননি? দ্বীপের কাছে ভেসে উঠেছে একটা ভাঙা জাহাজ, আপনাদের দ্বীপের কাছে। আপনার নানা-শ্বশুর নাকি কোন এক শ্বশুরের দ্বীপ ছিল, সেটার কাছেই তাঁর জাহাজ ডুবেছিল, ভেসে উঠেছে! রাগের ঠেলায় এক নিঃশ্বাসে সব কথা ফাস করে দিল সে।
প্রমাদ গণল সবাই।
অবাক হয়ে বাক্সটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মিস্টার পারকারই। বিড়বিড় করলেন, হু, মূল্যবান কিছু থাকতে পারে ভেতরে! ওই জাহাজে উঠতে কে বলেছে তোমাদেরকে? নাক গলানো হয়ে গেল না?
নাক গলানো কোথায়, বাবা? বন্ধুদের অপমান সইতে না পেরে রেগে উঠল জিনা। ওটা আমার দ্বীপ, আমার জাহাজ, আমি নিয়ে গেছি ওদেরকে। হাত বাড়াল, দাও, আমার বাক্স আমাকে দাও। সোনার বার টার থাকতে পারে ওতে।
সোনার বার! ভুরু কুঁচকে গেছে বিজ্ঞানীর। একেবারেই বুন্ধু! আরে, বোকা, এই বাক্সে বার থাকে কী করে! দেখছিস না, ছোট? জাহাজটায় সোনার বার ছিল, গপ্পোটা আমিও শুনেছি। হয়তো ছিল, কিন্তু এখন নেই। অনেক আগেই কেউ না কেউ কোথাও সরিয়ে ফেলেছে, জাহাজে নেই।
থাকলে থাকুক, না থাকলে নেই, চোখে পানি এসে গেছে জিনার, মরিয়া হয়ে বলল, আমার বাক্স দিয়ে দাও। ওটা তুমি নিচ্ছ কেন? কেন জানি তার এখন মনে হচ্ছে, ভেতরে সোনাদানা না থাকুক, মূল্যবান। দলিলপত্র নিশ্চয় রয়েছে, যাতে গুপ্তধনের নকশা আঁকা আছে।
কিন্তু বাক্সটা দিলেন না মিস্টার পারকার, হাতে নিয়ে নেমে চলে গেলেন।
আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি! লজ্জিত কণ্ঠে বলল মুসা। সব ফাঁস করে দিয়েছি!
যা হবার হয়েছে, মুসার কাঁধে হাত রাখল কিশোর। দুঃখ করে লাভ নেই।
বাক্সটা আবার পাই কী করে, ভাবছি! রবিন বলল।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল কিশোর। পাই কী করে? জিনার দিকে তাকাল সে। কীভাবে?
বাবার ঘরের ওপর চোখ রাখতে হবে, ভেবে বলল জিনা। বেরোলেই চুরি করব। আর কোন উপায় দেখছি না।
ঠিকই, আর কোন উপায় নেই। কাজেই মিস্টার পারকারের কাজের ঘরের কাছে ঘুরঘুর করতে থাকল ওরা। সারাক্ষণই কেউ না কেউ চোখ রাখল দরজার দিকে।
কী কারণে বাইরে এলেন জিনার মা, ছেলেদেরকে বাগানে একই জায়গায় ঘুরঘুর করতে দেখে অবাক হলেন। আরে, অবাক কাণ্ড! তোরা সব এখানে? মুখ শুকনো কেন এমন? ঝগড়াঝাটি করেছিস নাকি?
না, খালা, তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা, ঝগড়া করব কেন? এই এমনি…
হুঁ! ঠোঁট ওল্টালেন তিনি। কী জানি, বাপু! তোদের মতিগতি কিছু বুঝি না। নিজের কাজে চলে গেলেন তিনি।
কী ব্যাপার, জিনা? রবিন আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। তোমার বাবা কি ঘর থেকে বেরোবেন না? এভাবে ঘরে বসে থাকা এটা কোন কাজের কাজ হলো?
কাজের কাজ করে নাকি বিজ্ঞানীরা? সাফ বলে দিল জিনা। সব অকাজ! এই জন্যেই তো মেজাজ এমন তিরিক্ষি হয়ে থাকে ওদের! ঘরের কোথায় একটা ইটের কণা পড়ল, তার শব্দেই চমকে ওঠে বাবা! বাবার জালায় টু শব্দ করার জো আছে? হোস্টেলই আমার ভাল!
কিশোর তাদের কথায় যোগ দিল না। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল। কাজ করছেন। আর কোন কথা না বলে একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে বই খুলে বসল।
ঘর থেকে একটিবারের জন্যে বেরোলেন না মিস্টার পারকার। দুপুর হয়ে এল। খাওয়ার জন্যে ডাকতে এলেন জিনার মা।
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিয়ে খেয়ে আসতে হলো ছেলেমেয়েদের। ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বই খুলে বসল কিশোর। গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অন্য তিনজন।
বিকেল হয়ে এল। হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলল কিশোর। তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। জিনার গায়ে ঠেলা দিল, সে চোখ মেলতেই বলল, জিনা, কীসের শব্দ? তোমার বাবার ঘর থেকে আসছে!
কান পেতে শুনল জিনা। আর কীসের? বাবা নাক ডাকাচ্ছে।
এ-ই সুযোগ! বই রেখে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। দেখি চেষ্টা করে!
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল কিশোর, বড় একটা আর্ম চেয়ারে আধশোয়া হয়ে নাক ডাকাচ্ছেন জিনার বাবা, মুখ খোলা, চোখ বন্ধ, ঘুমে অচেতন। মাথা বেকায়দাভাবে কাত হয়ে রয়েছে এক পাশে, ফলে, যতবারই শ্বাস টানছেন, বিকট শব্দ হচ্ছে।
নাহ, ঘুমিয়েছে! ভাবল কিশোর, বাক্সটার দিকে তাকাল, মিস্টার পারকারের ওপাশে টেবিলে রয়েছে। নিই ঝুঁকিটা! ধরা পড়লে চড়থাপ্পড়ও দিয়ে বসতে পারে, কিন্তু আর কোন উপায় নেই!
পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর। আর্ম চেয়ারের কাছে এসে থামল এক মুহূর্ত, মিস্টার পারকারের মুখের দিকে তাকাল, তারপর ঘুরে চলে এল টেবিলের কাছে। বাক্সটা তুলে নিল কাঁপা কাঁপা হাতে, দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর, গলা শুকিয়ে কাঠ-ঘন ঘন ঢোক গিলতে হচ্ছে, তাড়াহুড়োয় বাক্সের ওপরে রাখা আলগা একটা কাঠের টুকরো পড়ে গেল মেঝেতে। ছোট্ট খুটুস শব্দ, কিন্তু কিশোরের মনে হলো বোম ফাটল। চোখের পলকে এসে লুকিয়ে পড়ল আর্ম চেয়ারের পেছনে।
কী হলো! বিড়বিড় করলেন মিস্টার পারকার, নাক ডাকানোয় ব্যাঘাত ঘটল, কয়েক মুহূর্তের জন্যে, তারপরই আবার শুরু হলো নিয়মিত, খোঁওঁওঁওঁ-খেত!
আর দেরি করল না কিশোর, বাক্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল নিঃশব্দে। বাইরে বেরিয়েই দে ছুট। সঙ্গীদের মুখের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বলল, সোজা সৈকতে! ছুটতে শুরু করল সে, দুহাতে ধরে রেখেছে বাক্স।
বিকেলে, সৈকত একেবারে নির্জন নয়, কিন্তু দেখেও দেখল না যেন ছেলেরা। একটা পাথরের ধারে এসে ধপ করে বালিতে বসে পড়ল। কিশোর। হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
সবাই এসে বসে পড়ল কিশোরকে ঘিরে।
বাক্সটা যেমন নিয়ে গিয়েছিলেন মিস্টার পারকার, তেমনিই রয়েছে, খোলার চেষ্টাও করেননি। কোমর থেকে ছুরি খুলে তিন দিক কাটা টিনের একপ্রান্তে ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে ওপর দিকে তুলে ফেলল কিশোর। সবাই ঝুঁকে এসেছে, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে, খেয়ালই করছে না যেন ওরা; বাক্সের ভিতর কি আছে, কার আগে কে দেখবে, সেই চেষ্টা।
টিনটা বাকা করে ফেলল কিশোর। না, ভিতরে সোনাদানা কিছু নেই। আছে কালো কাপড়ে মোড়ানো বইয়ের মত কিছু একটা। একটু যেন হতাশই হলো ওরা।
আরে, একেবারে শুকনো! ভিতরে তাকিয়ে আছে কিশোর। পুরানো আমলের কাজ, কী নিখুঁত
এত শত বছর পানির তলায় পড়ে ছিল, অথচ এক ফোঁটা পানি ঢোকেনি, খটখটে শুকনো! হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বের করে আনল সে। কাপড় খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ডায়েরি! হু, তোমার নানার-নানার-বাবার হাতের লেখা, পড়া তো যাচ্ছে না।
এত গুঁড়ি গুঁড়ি, লেখা তো না, পিঁপড়ের সারি!
একটা পাতা দুআঙুলে ধরে পরখ করে দেখল জিনা। তুলট কাগজের মত কাগজ, বয়েসের ভারে হলদে হয়ে এসেছে। ডায়েরিটা নাড়াচাড়া করছে কিশোর, হঠাৎ ভিতর থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ল বালিতে। প্রায় ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিল সে। মানচিত্র! নকশা! কাগজটা ডায়েরির পাতার চেয়েও হলুদ। তাড়াহুড়ো করতে গেলে যদি ভাজে ভাজে ছিঁড়ে খুলে চলে আসে, এই ভয়ে সতর্ক হয়ে আস্তে আস্তে খুলে বিছাল ওটা বালিতে।
হুঁ, ম্যাপই মনে হচ্ছে! আপনমনে বলল সে মাথা দুলিয়ে, কিন্তু আজব ম্যাপ! ঠিক বোঝা যাচ্ছে না!
জিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাপটার দিকে, রক্ত সরে যাচ্ছে তার মুখ থেকে। ঝট করে মুখ তুলল, চোখে জ্বলজ্বলে আলো। কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছে, কিন্তু বলতে পারছে না। তার ভাবভঙ্গিতে অবাক হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।
কী? অবশেষে জিজ্ঞেস করল কিশোর। বোবা হয়ে গেছ? কী ব্যাপার?
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকি দিল জিনা, ঝাঁকুনি খেয়েই যেন গলার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা প্রতিবন্ধক ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল কথার স্রোত, কিশোর, জানো ওটা কি! জানো! জানো! ওটা ম্যাপ, একটা ম্যাপ! দুর্গের ম্যাপ, গোবেল দুর্গের, যখন ওটা আস্ত ছিল, ধসে পড়েনি! এই যে, এই যে দেখো, এক জায়গায় আঙুল রাখল। ডানজন! পাতালঘর! আর এই যে, ডানজনের কোনায় কী জানি লেখা!
লেখার ওপরে রাখা জিনার কাঁপা কাঁপা আঙুল সরিয়ে দিল কিশোর। সবারই চোখ এখন লেখাটার ওপর। পুরানো ধাচের পেচানো হরফে রয়েছে একটিমাত্র অদ্ভুত শব্দ: ইনগটস।
ইন-গটস! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ইয়াল্লা! এটা আবার কী জীব! কোন দৈত্য-টৈত্য, নাকি ভূতের সর্দার!
হেসে ফেলল রবিন, কিশোরও।
এই জন্যেই বলি, বই-টই একটু পড়ো, বলল রবিন। দুনিয়ার কিছুই তো জানো না।
হেই, মিয়া, মুখ সামলে কথা বলবে! রেগে উঠল মুসা। জানি না। মানে? কয় ধরনের খেলা আছে, খেলার সরঞ্জাম আছে, জানো তুমি? জানো, এবার রেসলিঙে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কে হয়েছে? কয় রকমের খাবার আছে দুনিয়ায়, জানো? জানো, ঠিকমত রাঁধতে জানলে শুয়োপোকার গন্ধও জিভে পানি ঝরিয়ে ছাড়ে…।
হুঁউক! ওয়াক থুহ! গলা চেপে ধরল জিনা, বমি ঠেকাচ্ছে। রাক্ষস কোথাকার!
বিমল হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুসার কুচকুচে কালো মুখে। তো, যা বলছিলাম, রবিন, সবাই সব কিছু জানে না। তুমি যা জানো, সব আমি জানি না, আবার আমি যা জানি, সব তুমি জানো না…
আরে, দূর, লেকচার রাখো! বিরক্ত হয়ে হাত তুলল কিশোর। ইনগটস মানে হলো ধাতুর বার। তবে এখানে সোনার কথাই বোঝানো হয়েছে, আমি শিওর।
খাইছে! আঁ, সোনা! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার। জাহাজ থেকে যেগুলো গায়েব! দুৰ্গটার তলায় না তো? ডানজনে..
মাথা ঝোকাল জিনা। মনে হচ্ছে তাই! ইস, যদি খুঁজে বের করতে পারতাম! বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন ফিসফিস করল, ইস, যদি পারতাম!
পাই আর না পাই, খুঁজব। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সামিল হবে কাজটা, তবু চেষ্টা না করে ছাড়ব না। কিন্তু ভাঙা দুর্গ, ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল…যাক গে! আগে থেকে ভেবে লাভ নেই, উপায় একটা নিশ্চয় বেরোবে।
চিন্তিত চোখে বাক্সটার দিকে তাকাল কিশোর। এটা কী করব? নিজেকে প্রশ্ন করছে সে। আবার রেখে দিয়ে আসব? জেগে উঠে না। দেখলে নিশ্চয় খুঁজবেন, তার চেয়ে রেখেই দিয়ে আসি!
ম্যাপটা রেখে দিই আমরা। শুধু ডায়েরিটা বাক্সে ভরে রেখে দিয়ে এলেই তো হয়? মুসার প্রস্তাব।
তার চেয়ে আরেক কাজ করি বরং, রবিন বলল, সবই রেখে আসব। ম্যাপের একটা কপি করে রেখে দেব নিজেদের কাছে।
হ্যাঁ, কথাটা মন্দ না, কিশোর বলল। তবে ম্যাপ না ফিরিয়ে দিলেও তো চলে, উনি তো আর দেখেননি ভেতরে কী আছে না আছে। …আচ্ছা, থাক, রেখেই আসব; তার আগে, চলো, কপিটা করে নিই।
বাগানে ফিরে এল ওরা। চট করে গিয়ে নিজের ঘর থেকে বল পয়েন্ট আর কাগজ নিয়ে এল জিনা। দেখে দেখে ম্যাপটর নিখুঁত একটা নকল এঁকে ফেলল কিশোর। তারপর ডায়েরির ভিতরে আবার আসলটা ভরে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দিল বাক্সে, হাত দিয়ে চেপে নামিয়ে দিল বাকানো টিন, যতটা সম্ভব সমান করে দিল আগের মত, যাতে বোঝা না যায় খোলা হয়েছিল। নকলটা সাবধানে ভাজ করে নিজের পকেটে রেখে দিয়ে বাক্স হাতে উঠে দাঁড়াল। রেখে আসি।
আবার এসে জানালায় উঁকি দিল কিশোর, আরেকটু হলেই জিনার বাবার চোখে চোখ পড়ে যেত, সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুইয়ে ফেলল সে। কিন্তু ব্যাপার কী? এখনও হৈ-চৈ শুরু করেননি কেন? বাক্সটা নেই, খেয়ালই করেননি?
করেননি বোঝা গেল চায়ের টেবিলে। ছেলেদের দিকে তাকালেনই না, চুপচাপ খাচ্ছেন। সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে গিয়ে বাক্সটা আবার জায়গা মত রেখে এল কিশোর, সঙ্গীদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ছেলেরা।
টেলিফোন বাজল হঠাৎ। উঠে গিয়ে ধরলেন মিসেস পারকার। ওখানে দাঁড়িয়েই ডেকে বললেন, জন, তোমার।
কে? চিবাতে চিবাতে বললেন জিনার বাবা।
খবরের কাগজের লোক। দেখা করতে চায়। জরুরি কথা আছে বলল।
এখন হবে না, হাত নাড়লেন মিস্টার পারকার। বলে দাও, ছটার। সময় আসতে।
আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল ছেলেরা। যা আপনভোলা মানুষ মিস্টার পারকার, বাক্সটা আর ভিতরের জিনিসপত্র দেখিয়ে দেবেন না তো রিপোর্টারদের? দুর্গের পাতাল ঘরে সোনার বার লুকানো রয়েছে, কোনমতে গুজবটা একবার রটে গেলে, সর্বনাশ!
ইস, গাধামি হয়ে গেছে! ভাবল কিশোর। ম্যাপটা বাক্সে রাখা মোটেই উচিত হয়নি!
দশ
পরদিন সকালে স্থানীয় সমস্ত কাগজে প্রকাশিত হলো খবরটা: কী করে ঝড়ের ধাক্কায় সাগরের তল থেকে উঠে পাথরে আটকে গেছে শত শত বছরের পুরানো জাহাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সব কথাই মিস্টার পারকারের পেট থেকে বের করে নিয়েছে ধড়িবাজ সাংবাদিক, নিখোঁজ সোনার বারের গল্পও জেনে গেছে, তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে চলে গেছে গোবেল দ্বীপে, কীভাবে জানি পথ খুঁজে নিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে কয়েকটা ছবিও তুলে এনেছে ভাঙা দুগটার, আর জাহাজের ছবি তো আছেই, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আকর্ষণীয় সব ছবি তুলে দিয়েছে কাগজে ছেপে।
রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল জিনা। দুপদাপ করে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। মা-আ! এসব কী! ওটা আমার দ্বীপ! তুমি কথা দিয়েছিলে, দাওনি!
তোর নয় একথা তো বলিনি! ভুরু কোঁচকালেন মা। ওরা দ্বীপে গিয়ে ছবি তুলেছে তো কী হয়েছে? নষ্ট তো আর করে ফেলেনি।
কিন্তু গেল কেন? কার কাছে অনুমতি নিয়ে? আরও রেগে উঠল জিনা! ওগুলো আমার! দ্বীপ, দুর্গ, জাহাজ…আমাকে না বলে ওরা যায় কী করে?
খামোকা রাগ করছিস, মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মা। তোর বাবা অনুমতি না দিলেই বা কী হত? সাগরের মালিক তো আর আমরা না, বোট নিয়ে গিয়ে জাহাজের ছবি তুলতই ওরা। দুর্গের ছবিও। মানা করলেও ঠেকানো যেত না।
এরপর দর্শকদের ঠেকানোর চেষ্টা করল জিনা, পারল না, কেয়ারই করল না কেউ তার কথা, রাগে-দুঃখে চোখে পানি এসে গেল তার। পুরানো একটা জাহাজ পানিতে ভেসে উঠে যে এমন শোরগোল তুলবে, এতটা শোরগোল, কল্পনাও করতে পারেনি ছেলেরা, তাজ্জব হয়ে লোকের কাণ্ড দেখল ওরা। অনেক দূর থেকেও খবর শুনে জাহাজ দেখতে এল লোকে, দ্বীপ আর দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখল। এত দিন চেষ্টা করেনি তাই, এখন দরকারের সময় ছোট্ট লুকানো বন্দরটা ঠিকই খুঁজে বের করে। ফেলল জেলেরা। মাছ ধরা বাদ দিয়ে ট্যুরিস্ট আনা-নেয়া করতে লাগল। নৌকায় করে, যার যা খুশি ভাড়া হাঁকছে, কামিয়ে নিচ্ছে দুপয়সা।
গুমরে মরছে জিনা, তাকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল কিশোর। শোনো, জিনা, বারগুলোর কথা এখনও জানে না কেউ। উত্তেজনা কমে এলেই দ্বীপে গিয়ে ওগুলো খুঁজে বের করব।
আমাদের আগেই যদি অন্য কেউ পেয়ে যায়? চোখ মুছতে মুছতে বলল জিনা, কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
কী করে? বাক্সের ভেতরের নকশা এখনও কারও চোখে পড়েনি। দাঁড়াও না, আরেক সুযোগে আবার চুরি করে নিয়ে আসব নকশাটা, আর ফেরত দেব না।
কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না কিশোর। ইতিমধ্যেই অঘটন ঘটিয়ে ফেললেন মিস্টার পারকার। পরের দিন ডাইনিং রুমে খাচ্ছিল ছেলেরা, হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঘোষণা করলেন, এক পাগলা অ্যান্টিক সংগ্রহকারীকে উপহার দিয়ে দিয়েছেন বাক্সটা। না, ভিতরে কী আছে না। আছে খুলেও দেখেননি তিনি।
আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল ছেলেরা। সর্বনাশ হয়ে গেছে! যদি ওই লোকটা নকশার মানে বুঝতে পারে? হয় সে গোপনে বারগুলো খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করবে, কিংবা বোকা হলে লোকের কাছে বলবে। পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় খবর হয়ে বেরোবে কথাটা, ব্যস, তারপর আর কী!
মেজাজ খুব ভাল এই মুহূর্তে জিনার বাবার, আশ্চর্য একটা ব্যাপার! কেন ভাল, কে জানে! লোকটা তোয়াজ করে ফুলিয়ে-টুলিয়ে দিয়ে গেছে। হয়তো। তবে এই মেজাজ কতক্ষণ থাকবে, ঠিক নেই; যে-কোন মুহূর্তে মেঘের আড়ালে চলে যেতে পারে রোদ, আচমকা ঝড় উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। একবার ভাবল কিশোর, তাকে সব কথা খুলে বলে, কিন্তু ভেবে চিন্তে শেষে না বলারই সিদ্ধান্ত নিল। হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন, সেক্ষেত্রে না বলাই ভাল, অযথা হাসির খোরাক হয়ে কী লাভ?
নিজেদের মাঝে আলোচনা করল ছেলেরা। ঘোরালো হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। জিনার মাকে বারগুলোর কথা বলবে কিনা, ভাবল ওরা, তারপর সে চিন্তাও বাতিল করে দিল। তিনিও বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না।
ওসব বলাবলির দরকার নেই, অবশেষে বলল কিশোর। যা বলছি শোনো। খালাকে গিয়ে ধরব আমরা, গোবেল দ্বীপে পিকনিকে যেতে চাই। দুটো রাত থাকবও ওখানে। যে করেই হোক তাকে রাজি করাতে হবে। এতে সময় পাব আমরা। আগামী দুদিনের আগে কেউ গুপ্তধন খুঁজতে আসবে না আশা করছি, তৈরি হওয়ার একটা ব্যাপার আছে তো।
কিশোরের প্রস্তাব মেনে নিল সবাই। পরের দিনই সকালে রওনা দেবে, ঠিক করল ওরা। আবহাওয়া এখন পরিষ্কার, সঙ্গে করে প্রচুর খাবার নিয়ে যাবে, অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। জিনার মাকে গিয়ে ধরল। ওরা। তখন মিস্টার পারকারও রয়েছেন ওখানে। মেজাজ ভালই।
খালা, কিশোর বলল, একটা কথা বলব। রাখবেন?
কী রে? অবাক হলেন মিসেস পারকার। এমনভাবে বলছ, যেন রাজ্য আর রাজকন্যা চেয়ে বসবে?
না, খালা, হাসিমুখে বলল কিশোর, ওসব চাইতে আসিনি। আমরা গোবেল দ্বীপে যেতে চাই।
যেতে চাইলে যাবে, এটা আর এমন কী হলো?
দুএক রাত কাটাতে চাই ওখানে।
রাত কাটাবি?
কেন, কী হবে, খালা? আকাশ পরিষ্কার, চেনা জায়গা, তেমন ভয়ের কিছু নেই তো। আর অবস্থা খারাপ দেখলে তো চলেই আসতে পারব, কয় মিনিট আর লাগে যেতে-আসতে।
হুঁ, তা বটে। জন, তুমি কী বলো? স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস পারকার।
যেতে চাইলে যাক, বললেন মিস্টার পারকার। নইলে আর যাওয়ার সুযোগ পাবে না। পাবে, ইয়ে, মানে, আমি বলছি কী, যেতে পারবে, তবে এখনকার মত নির্জন আর থাকবে না তখন। পিকনিক চলবে না ওখানে। লোকটা খানিক আগে আবার ফোন করেছিল। দ্বীপটা কিনতে চায়, ভাঙা দুর্গ সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে একটা হোটেল করবে নাকি, ভাল আইডিয়া, না?
হাঁ হয়ে গেছে চার ছেলেমেয়ে, নাকেমুখে কষে থাবড়া মেরেছে যেন তাদেরকে কেউ। দ্বীপ বিক্রি! গোপন ব্যাপারটা ফাস হয়ে গেছে? জেনে ফেলেছে লোকটা? বুঝে গেছে, কোথায় লুকানো রয়েছে বারগুলো?
দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন জিনার, চোখে আগুন। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, মা-আ! তোমরা আমার দ্বীপ বেচতে পারো না! ওটা আমার দ্বীপ, আমার দুর্গ…তোমাদের কোন অধিকার নেই!
কুটি করলেন মিস্টার পারকার। বোকার মত কথা বলছ, জরজিনা! শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর, মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে না তো বিজ্ঞানীর! ওটা এখনও তোমার হয়নি, তোমার মায়েরই রয়েছে। তোমার মায়ের থাকা মানেই আমার থাকা।
বাবা, টাকা কম আছে তোমার? কেঁদে ফেলল আবার জিনা। যা আছে তারই হিসেব রাখো না! ওই দ্বীপটা বেচলে আর কতই বা আসবে? কী করবে তুমি ওই টাকা দিয়ে? বলো, কী করবে?
ইয়ে..ইয়ে…হ্যাঁ, মানে…ও, হ্যাঁ, তোমার জন্যেই বিক্রি করছি। টাকাটা তোমার নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব। যখন খুশি টাকা তুলে তোমার যা খুশি কিনতে পারবে। কত ভাল ভাল জিনিস।
ভাল জিনিস আমি চাই না! আবার চেঁচিয়ে উঠল জিনা। মা! দোহাই তোমাদের, ওটা বিক্রি করো না! তুমি, তুমি কথা দিয়েছিলে, ওটা আমাকে দেবে। দাওনি?
দি-দিয়েছিলাম! দ্বিধায় পড়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু… স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি, মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে মিস্টার পারকারের মুখে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে, মা। তোর বাবা নিশ্চয় কথা দিয়ে ফেলেছেন, তাই…।
হ্যাঁ হ্যাঁ, কথা দিয়ে ফেলেছি, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মিস্টার দরকার।
আমাকে একবার বলারও দরকার মনে করলে না, বাবা? আমি, তোমার সন্তান নই, বললো, জবাব দাও, নই? আমাকে ছেলেমানুষ ভাবো, কিন্তু আমারও তো একটা মন আছে…
সাংঘাতিক দ্বিধায় পড়ে গেছেন মিস্টার পারকার; ওদিকে ক্রেতাকে কথা দিয়ে ফেলেছেন, এদিকে মেয়ের এই অভিমান, কী করবেন? কিছুই ঠিক করতে না পেরে আচমকা রেগে উঠলেন তিনি, চেঁচিয়ে উঠলেন, তোর খারাপ চেয়েছি নাকি আমি? বললাম, সব টাকা দিয়ে দেব, যা খুশি কর গে…
তোমার টাকা তুমিই রাখো গে, যাও! মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল জিনা। একটা পয়সাও আমি ছোঁব না! ছোঁব না! এক ছুটে বেরিয়ে চলে গেল সে, দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল, বোঝা গেল আওয়াজ শুনেই।
হতভম্ব হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার। তিন গোয়েন্দাকে বললেন, ওকে গিয়ে বোঝাও তোমরা। তোমাদের বন্ধু, হয়তো শুনবে। আসলে, এখন আর কিছু করতে পারছি না, আমার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন! কথা দিয়ে ফেলেছি লোকটাকে!
দলিল কবে হচ্ছে, খালু? শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল কিশোর।
এ হপ্তার ভেতরেই। কালই চলে যাও, গিয়ে পিকনিক করে এসো। পরে নতুন মালিক আর দ্বীপে উঠতে দেবে কিনা দেবে, কে জানে!
কার কাছে বিক্রি করছেন? বাক্সটা যাকে দিয়েছেন?
হ্যাঁ, লজ্জিতই মনে হচ্ছে তাকে। প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আর ব্যাটা একটা চিনেৰ্জোক, এমনভাবে ধরল, বোঝাল, হ্যাঁ বলে ফেললাম! …যা হওয়ার হয়ে গেছে, জরজিকে গিয়ে বলো, ওরকম, না না, ওটার চেয়ে ভাল আরেকটা দ্বীপ ওকে কিনে দেব! যা চায়, তাই দেব, যাও বলো গে!
কথা দিচ্ছেন? রহস্যময় হাসি ফুটেছে কিশোরের মুখে।
হ্যাঁ, দিচ্ছি!
বেশ, আমিও কথা দিচ্ছি, জিনাকে শান্ত করব। মুসা আর রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। বাইরে বেরিয়েই বলল, কিছু বুঝলে, লোকটা দ্বীপ কেন কিনতে চাইছে?
ম্যাপের মানে বুঝে ফেলেছে, আরকী? রবিন বলল।
হোটেল না কচু! মুসা বলল। শয়তানটা আসল কথা জেনে ফেলেছে, পটিয়ে-পাটিয়ে এখন দ্বীপ বিক্রিতে রাজি করিয়ে ফেলেছে জিনার বাবাকে। হারামখোর!
বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে জিনা। তার কাছে গিয়ে বসল কিশোর। কোমল গলায় ডাকল, জিনা!
জবাব দিল না জিনা, মুখ তুলল না।
জিনা, শোনো, কিশোর বলল আবার, এত নিরাশ হয়ো না, যা হয়েছে ভালই হয়েছে!
ভাল হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। আমার এত সাধের দ্বীপ ওরা কেড়ে নিচ্ছে, আর তুমি বলছ ভাল হয়েছে?
ভালই তো হয়েছে, হাসল কিশোর। কাল যাচ্ছি আমরা গোবেল দ্বীপে। থাকব। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করব সোনার বারগুলো। লোকটা আসার আগেই কাজ সেরে ফেলব আমরা।
মুখ ফেরাল জিনা। কিন্তু আমার দ্বীপ…।
ওটার জন্যে দুঃখ কোরো না। তোমার বাবা বলেছেন, তোমাকে আরও ভাল দেখে আরেকটা দ্বীপ কিনে দেবেন। যা চাও, তাই দেবেন। আমি হলে এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়তাম না।
কী সুযোগ? উঠে বসল জিনা, বুঝতে পারছে না।
চাওয়ার, মিটিমিটি হাসছে কিশোর। তার ভাবভঙ্গিতে মুসা আর রবিনও অবাক হয়ে গেছে।
কী চাইব? দ্বীপ ছাড়া আর কী চাইব!
আর কিছু নেই?
না।
সত্যিই নেই? ভাল করে ভেবে দেখো…
মেঘের কোলে রোদ উঠল, হাসি ফুটল জিনার মুখে। আস্তে মাথা দোলাল, হ্যাঁ, আছে!
এগারো
পরদিন সকাল সকালই রওনা দেবে, ঠিক করল ওরা। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে লিস্ট করতে বসল, কী কী সঙ্গে নেয়া দরকার।
খাবার লাগবে, প্রথমেই বলল মুসা। বেশি করেই নেব, যাতে টান না পড়ে।
পানি নিতে হবে, জিনা বলল। খাবার পানি নেই দ্বীপে। কুয়া একটা আছে শুনেছি, তাতে মিষ্টি পানি থাকার কথা, কিন্তু আমি খুঁজে পাইনি।
খাবার, লিখতে লিখতে বলল কিশোর। পনি। আর? তিনজনের দিকেই তাকাল সে। বিড়বিড় করল, খোন্তা, লিখে ফেলল সেটা।
কী হবে? মুসা অবাক।
মাটি খুঁড়ে ডানজনে নামার দরকার পড়তে পারে, কিশোর বলল। আর কী?
দড়ি লেখো, রবিন বলল।
আর টর্চ, জিনা মনে করিয়ে দিল। ভয়ানক অন্ধকার পাতালে।
আতঙ্কের দুর্গের ডানজনের কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল মুসা। মনে পড়ল, কীভাবে হাত-পা বেধে পাতালঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল ওদেরকে। ওরকম একটা ঘরে আরেকবার আটকা পড়তে চায় না সে কিছুতেই।
কম্বল, রবিন বলল। রাতে ঠাণ্ডা পড়বে, যা বাতাস লাগে দুর্গের ঘরটায়!
লিখে নিল কিশোর।
মগ লেখো, মুসা বলল। চা আর পানি খেতে লাগবে। আর কিছু যন্ত্রপাতি, এই…প্লায়ার্স, ক্রু-ড্রাইভার, এসব। কাজে লেগে যেতে পারে।
আধ ঘণ্টা পর লম্বা এক ফর্দ হয়ে গেল; যা যা মনে পড়েছে চারজনের, সব লিখে নেয়া হয়েছে। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা অনেক কেটে গেছে জিনার
একা থাকলে, এত সহজে পারত না, তিন গোয়েন্দা সঙ্গ দেয়াতেই নিজেকে সামলাতে পেরেছে এত তাড়াতাড়ি। আর একা থাকব না, ভাবল জিনা। একা একা কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব না। একটা মাথার চেয়ে কয়েক মাথা একসঙ্গে খাটালে অনেক জটিল ব্যাপারও সহজ করে নেয়া যায়। আচ্ছা, এই ছেলে তিনটে এত শান্ত থাকে কী করে? কোন কারণেই হুট করে উত্তেজিত হয়ে যায় না। আমি হই কেন? কেন শান্ত রাখতে পারি না নিজেকে? আমার বদমেজাজের জন্যেই বাবা দেখতে পারে না আমাকে, বুঝতে পারছি এখন। মা-টা অতিরিক্ত ভাল, তাই আমার সব অত্যাচার সহ্য করে। নাহ, আর খারাপ থাকব না, ভাল হয়ে যাব। তিন গোয়েন্দা দারুণ শিক্ষা দিয়েছে আমাকে! বিশেষ করে ওই কিশোর পাশা…
জিনার দিকে নজর পড়তেই লক্ষ করল কিশোর, তামাটে চোখ দুটো তার মুখের ওপর স্থির। হাসল সে। কী ব্যাপার?
লজ্জা পেল জিনা, মুখ লাল হয়ে গেল। না, কিছু না! …ভাবছি, তোমরা কত ভাল, কত সহজ! দুদিনেই আমার বাবা-মাকে আপন করে নিয়েছ, ওদের সন্তান হয়েও এত বছরে আমি যা পারিনি! ইস, যদি তোমাদের মত হতে পারতাম!
দোষটা তোমার না, জিনা, কিশোর বলল। ধনী বাপের একমাত্র মেয়েরা সাধারণত ওরকমই হয়। এর অনেক কারণ।
তোমরাও তো তোমাদের বাপের একমাত্র ছেলে…
তা বটে, তবে ওরা ধনী নয়, অন্তত তোমার বাবার তুলনায় তো নয়ই। তা ছাড়া, আমার বাবা-মা ছোটবেলায়ই মারা গেছে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে, আদর দিয়ে দিয়ে মাথা খাওয়ার কেউ নেই। চাচা কম আদর করে না, মেরি চাচীও জান দিয়ে দেয় আমার জন্যে, নিজের মা থাকলেও এর বেশি করতে পারত না; তবে চাচীর সবচেয়ে বড় গুণ, শাসনটা ঠিকই আছে। বখে যেতে দেয়নি আমাকে। মুসার মা-ও যথেষ্ট কড়া। আর আমাদের রবিন মিয়া এমনিতেই ভাল,
দূর, কী যে বলো! বাবাকে তো রাগতে দেখোনি! ভালর ভাল, কিন্তু শাসনের সময়…।
হুঁ! নরম গলায় বলল জিনা। দেখো, আর কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না আমি! উঠল সে। চলো, খানিক বেড়িয়ে আসি। রাফিকে দেখে আসি।
ফগ আর রাফির সঙ্গে সারাটা দিন কাটাল ওরা। দ্বীপে গিয়ে কীভাবে কী করবে, তার নানারকম প্ল্যান করল। ওদের কথা যেন বুঝতে পারে। রাফিয়ান, এমনি ভঙ্গিতে মুখ গম্ভীর করে পাশে বসে থাকে আলোচনার সময়, মাঝে মাঝে সমঝদারের মত লেজ নাড়ে, বড় বড় বাদামী চোখ দুটোতে ফুটে ওঠে কেমন একটা ভাব! জ্বলজ্বল করে। বুদ্ধিমান মানুষের চোখের তারায় যেমন আলো দেখা যায়, তেমনি এক ধরনের আলো ফোটে!
পরদিন সকালে জিনিসপত্র নিয়ে নৌকা-ঘাটে চলে এল ওরা। নৌকা তৈরি রেখেছে ফগ। সবাই উঠে পড়ল। রাফিয়ানও উঠল। মালপত্র তুলে পাটাতনের একধারে রেখে দিল ফগ, তারপর ঠেলে নামিয়ে দিল নৌকাটা পানিতে। দাঁড় তুলে নিল জিনা।
সব কিছুই আনা হয়েছে, না? প্যাকেটগুলোর দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা।
ম্যাপ! ম্যাপটা এনেছ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
এনেছি, পকেটে হাত ঢোকাল কিশোর, বের করে আনল ভাজ করা কাগজটা দুআঙুলে ধরে। এই যে…
হঠাৎ এক ঝটকায় তার হাত থেকে কাগজটা উড়িয়ে নিয়ে পানিতে ফেলল জোরাল বাতাস। ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে লাগল, ওটা। শঙ্কিত হয়ে প্রায় একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল চারজনে। তাদের মহামূল্যবান নকশা!
ঝপাং করে গলুইয়ের আরেক পাশে দাঁড় ফেলে নৌকা ঘোরাতে শুরু করল জিনা। কিন্তু তার আগেই লাফিয়ে উঠল রাফিয়ান, কোন রকম দ্বিধা না করে ঝাঁপ দিল পানিতে। অত্যন্ত ভাল সাঁতারু সে। শক্তিশালী মাংসপেশীতে কাঁপন তুলে সাতরে গিয়ে কাগজটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল।
এ মুসা আর কিশোর মিলে রাফিয়ানকে টেনে তুলল নৌকায়। দাঁতে চেপে ধরেছে কাগজটা রাফিয়ান, কিন্তু এত আলতো করে, সামান্যতম দাগও পড়েনি দাঁতের! উদ্বিগ্ন হয়ে ভাজ খুলল কিশোর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, বাঁচা গেছে! পানিতে ভিজেছে বটে, কিন্তু লেখার কোন ক্ষতি হয়নি। বল পয়েন্ট কলমের কালি, নষ্ট হয়নি। পাটাতনে কাগজটা। বিছিয়ে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রাখল, যাতে আবার বাতাস উড়িয়ে নিতে না পারে। একবারেই শিক্ষা হয়ে গেছে।
বড় বাঁচা বেঁচেছি! বলল কিশোর।
অন্যেরাও স্বীকার করল কথাটা।
নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে আবার জিনা। দ্বীপের দিকে চলেছে।
বার বার গা ঝাড়া দিয়ে রোম থেকে পানি ঝরিয়ে নিয়েছে রাফিয়ান, রোদে পিঠ শুকাচ্ছে। পুরস্কার হিসেবে বড় একটা বিস্কুট পেয়েছে, কুটুর কুটুর করে কামড়াচ্ছে, চিবাচ্ছে আয়েশ করে। চোখা ডুবো পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে দক্ষ হাতে নৌকা বেয়ে চলেছে জিনা। মনে মনে তার প্রশংসা না করে পারছে না কিশোর, ঘোড়ায় চড়তে যেমন ওস্তাদ মেয়েটা, নৌকা বাওয়ায়ও তেমনি।
নিরাপদেই সরু প্রণালীতে ঢুকল নৌকা, ছোট্ট বন্দরে এসে ঘঁাচ করে থামল। লাফিয়ে বালিতে নামল অভিযাত্রীরা। টেনে নৌকাটা ডাঙার অনেক ওপরে তুলে রাখল, জোয়ারের পানি আর নাগাল পাবে না। মালপত্র নামাতে শুরু করল।
দুর্গের ঘরটায় নিয়ে যাব সব, কিশোর বলল। ওখানেই নিরাপদ। ঝড়বৃষ্টিতে নষ্ট হবে না; তবে, অন্য কেউ এসে পড়লে কী ঘটবে জানি না।
দুএক দিনের মধ্যে আসবে না মনে হয়, জিনা গাল চুলকাল। বাবা বলল, দলিলপত্র তৈরি করে রেজিস্ট্রি করাতে করাতে হপ্তাখানেক লেগে যাবে। হয়তো তার আগে আসবেই না ব্যাটা। এই
তার মানে, পাহারার দরকার নেই, প্রণালী দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ওপর চোখ রাখার প্রয়োজন আছে কিনা ভাবছে কিশোর। চলো, যাই। মুসা, তুমি পানির ড্রাম নাও। খাবারের বোঝা আমি নিচ্ছি, খোন্তাগুলো নিক জিনা। রবিন, অন্য পোটলা-পাটলিগুলো তুমি নাও।
খাবার আর পানি প্রচুর পরিমাণে আনা হয়েছে; রুটি, মাখন, বিস্কুট, জ্যাম, টিনজাত ফল, শুকনো আঙুর, চায়ের সরঞ্জাম আর কয়েক বোতল লেমোনেড। সবচেয়ে ভারি দুটো বোঝা নিয়েছে কিশোর আর মুসা, টিলা বেয়ে উঠতে কষ্টই হচ্ছে ওদের, পা টলোমলো করছে, পিছলে পড়ে গেলে দোষ দেয়া যাবে না।
দুর্গের ছোট ঘরটাতে এনে মালপত্র তুলল ওরা। আবার ফিরে চলল কম্বল আর চাদরের বাণ্ডিল আনতে। আনা হয়ে গেল। মালপত্র গুছিয়ে রেখে ঘরের বাইরের চত্বরে এসে বসল ওরা।
এইবার আসল কাজ, ম্যাপটা মাটিতে বিছাল কিশোর। ডানজনে ঢোকার পর খুঁজে বের করতে হবে। জিনা, দেখো তো, কিছু বোঝে কিনা?
চারজনেই ঝুঁকে এল ম্যাপের ওপর। শুকিয়ে গেছে কাগজ, লেখা ঠিকই রয়েছে। নকশা দেখেই বোঝা যায়, পুরানো দিনে যখন আস্ত ছিল। দুৰ্গটা, দেখার মত বিল্ডিং ছিল!
এই যে দেখো, ডানজনের ওপর আঙুল রাখল কিশোর। মস্ত বড় পাতালঘর, আর এই এখানে…এখানে চিহ্ন বোধহয় সিঁড়ির নিশানা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা, আমারও তাই মনে হয়। তার মানে, ডানজনে নামার দুটো পথ। একটা সিঁড়ি নেমেছে ওই ছোট ঘরটারই কোনখান থেকে…আরেকটা…আরেকটা টাওয়ারের নিচ থেকে, ওই যে ওই টাওয়ারটা, হাত তুলে কাক-টাওয়ার দেখাল সে। এটা কী, কিশোর?
একটা গোল চিহ্নের ওপর আঙুল রেখেছে জিনা, গোল একটা পাইপের মুখ যেন, পাইপটা ওপর থেকে শুরু হয়ে ডানজনের মেঝে ভেদ করে আরও নিচে নেমে গেছে।
কী জানি! নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। ও, হ্যাঁ, বুঝেছি, কুয়ার কথা বলেছিলে না? এটাই সেটা। খুব গভীর। ওটাতে নামতে কেমন লাগবে ভেবে দেখো!।
কেমন আর লাগবে! বিড়বিড় করল মুসা। আমার রোম খাড়া হয়ে। গেছে এখুনি! কুয়া দিয়ে পাতালে নামা…আরিব্বাপ রে বাপ, আমি, বাবা, নেই ওতে!
মুসার বলার ধরনে হেসে ফেলল অন্যেরা, রাফিয়ানও কুকুরে-হাসি হাসল, বলল, হুফ! যেন বোঝাল, এত ভয় কীসের? আমি আছি না সঙ্গে?
এখন তা হলে কী করব? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রবিন। সিঁড়ি খুঁজব? এই ঘরে থেকে থাকলে, এটা দিয়ে নামাই ভাল। যতদূর জানি, ওসব সিঁড়ির মুখ বড় চ্যাপ্টা পাথর দিয়ে ঢাকা থাকে। খুঁজব?
হ্যাঁ, ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল কিশোর।
শেওলা আর আগাছায় ঢেকে রয়েছে পাথুরে মেঝে, সিঁড়ির মুখ কোথায় বোঝার উপায় নেই।
পরিষ্কার করতে হবে, এগিয়ে গিয়ে একটা খোন্তা তুলে নিল কিশোর। তোমরাও নাও। কাজ শুরু করে দিই।
চারটে খোন্তা আনা হয়েছে। কাজে লেগে গেল ওরা। চেছে সাফ করে ফেলতে লাগল মেঝের আগাছা।
চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত ছেলেদের কাজ দেখল রাফিয়ান, ও আর বসে। থাকে কী করে? খোন্তা ধরতে পারবে না, তাতেই বা কী? চার পায়ে
পাঁচটা করে ক্ষুরধার নখ রয়েছে, বিশটা যন্ত্র নিয়ে সে-ও লেগে গেল। কাজে। আঁচড়ে-খামচে কাজ করতে গিয়ে অকাজই করল বেশি। ধুলো মাটি আর আগাছার টুকরোর ঝড় উঠল। তার সবচেয়ে কাছে রয়েছে। কিশোর, তার গায়েই ময়লা পড়ছে বেশি।
এহহে, রাফি, থাম, থাম। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল কিশোর। বালু দিয়ে চুলের সর্বনাশ করে দিচ্ছিস আমার!
বারো
দেখতে দেখতে সাফ হয়ে গেল মেঝে। চারকোনা বড় বড় পাথর জোড়া দিয়ে তৈরি মেঝে, একটার সঙ্গে আরেকটার সামান্যতম তফাৎ নেই। কোনটা আলগা বোঝাই যাচ্ছে না। টর্চের আলো ফেলে সাবধানে প্রতিটি পাথর পরীক্ষা করে দেখল কিশোর, কিন্তু পাওয়া গেল না ফাঁক।
লোহার রিং কিংবা হাতল-টাতল কিছু তো থাকার কথা, রবিন বলল। এসো তো, আরেকবার দেখি।
একবার নয়, আরও কয়েকবার দেখল ওরা। প্রতিটি ফাঁকে খোন্তার মাথা ঢুকিয়ে জোরে চাড় দিয়েও দেখল কিশোর আর মুসা, আলগা পাথর পাওয়া গেল না। ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা একনাগাড়ে পরিশ্রম করল ওরা, লাভ হলো না। খিদেয় চো চো করছে পেট।
খেতে বসল ওরা। খেতে খেতেই আলোচনা চলল।
আর কীভাবে দেখব? কিশোর বলল। মনে হচ্ছে এঘরে নেই। দেখি, খেয়ে উঠে আরেকবার দেখব ম্যাপটা। অন্য কোন ইঙ্গিত আছে কিনা, কে জানে!
আরেকবার খুঁটিয়ে দেখা হলো ম্যাপ, নতুন কিছু বোঝা গেল না। নকশাটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর, চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। দেখো, ম্যাপে আঙুল রাখল সে হঠাৎ, এই চিহ্নটা, এটাকে সিঁড়ি ভাবছি আমরা, তা না-ও তো হতে পারে? আর এই যে, কুয়ার মুখ, এটা এই চিহ্নের খুব কাছাকাছি। মানে কী? সিঁড়ির মুখ তো খুঁজে পেলাম না, চলো, কুয়ার মুখ খুঁজি। ওটা পেলে হয়তো সিঁড়ির মুখ খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।
হয়তো, জিনা বলল। কুয়াটা আশপাশেই কোথাও…এই যে চত্বর, এরই কোথাও রয়েছে, ম্যাপের একটা জায়গায় আঙুল রেখে বলল সে।
বাইরে উজ্জ্বল রোদে বেরিয়ে এল ওরা। দুর্গের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে আশপাশে তাকিয়ে কুয়ার মুখ খুঁজল। শেওলা, ঘাস আর ঝোঁপঝাড়ের জন্যে চত্বরের পাথরই দেখা যায় না ভালমত, কুয়ার মুখ দেখবে কী? জায়গায় জায়গায় পাথর ফেটে ভেঙে বেঁকাতেড়া হয়ে গেছে, এককালে সমতল, মসৃণ ছিল, এখন হয়েছে তার উল্টো।
বড় একটা খরগোশ যেন ফুসমন্তরের বলে উদয় হলো চতুরে, কোথা থেকে উঠল ওটা, বোঝা গেল না। লাফিয়ে গিয়ে খানিক দূরের একটা, গর্তে সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল। আরেকটা খরগোশ বেরোল, এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদেরকে দেখল, তারপর ওটাও গিয়ে ঢুকল। আগের গর্তটায়।
খানিক পরে আরেকটা খরগোশ বেরোল, বাচ্চা। বড় বড় কান, ছোট্ট লেজ, মনে হয় যেন গোড়া থেকে কাটতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে, আটকে রয়েছে খানিকটা। খোশমেজাজে তিড়িং-বিড়িং করে এলোপাতাড়ি কয়েক লাফে ছেলেদের কাছাকাছি চলে এল ওটা, বসে পড়ে কৌতূহলী চোখে। তাকাল, সামনের দুই পা দিয়ে কান ঘষছে, যেন ময়লা ধুয়ে ফেলছে।
খরগোশের বাচ্চার এই চালিয়াতি আর সইতে পারল না রাফিয়ান, হুউক! করে ধমক লাগিয়েই তাড়া করল। কল্পনাই করেনি, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁড় ওই অত্তোটুকুন বাচ্চা, চোখের পলকে লাফ দিয়ে তিন হাত ওপরে উঠে পড়ল ওটা, শূন্যেই ঘুরল, নিঃশব্দে নেমে এল আবার মাটিতে-আগের জায়গা থেকে অন্তত পাঁচ হাত দূরে, তারপর ছুটল। কান প্রায় লেপটে গেছে ঘাড়ের সঙ্গে, ছোট্ট লেজটা নাচছে ছোটার। তালে তালে, রাফিয়ানকে কলা দেখাল সে অবলীলায়। একটা ঝোঁপের ধারে গিয়ে ফিরে তাকাল পলকের জন্যে, মুখই ভেঙচাল বোধহয়, পরক্ষণে ঢুকে পড়ল ঝোপে।
রাফিয়ান কি আর ছাড়ে? ঝোঁপঝাড় ভেঙে হুড়মুড় করে পিছু নিল। সে-ও। ঝোঁপের ভেতরেই বোধহয় খরগোশের বাসা, গর্তের মুখ ছোট হয়তো, তাই খুঁড়তে শুরু করল কুকুরটা, ছিটকে আসা ধুলোমাটির ঝড় তা-ই প্রমাণ করছে। উত্তেজিত চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে তার, গলা ফাটিয়ে ডাকছে জিনা, চলে আসতে বলছে, কানেই তুলছে না রাফিয়ান। পাগলের মত গর্তের চারপাশের মাটি খুঁড়ে মুখ বড় করছে, নিশ্চয়ই তার ভাষায় বাপ-মা তুলে গাল দিচ্ছে বজ্জাত বাচ্চাকে। বোধহয় বলছে, যাবে কোথায়! আসছি আমি! শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব!
রাফি! শুনছিস! এই, রাফি! চেঁচাল আবার জিনা। কতবার না বলেছি, খরগোশ তাড়া করবি না এখানে! শুনছিস! এই, পাজি!
রোখ চেপে গেছে রাফিয়ানের, মনিবের ডাকের তোয়াক্কাই করছে না। সে তার কাজে ব্যস্ত। কয়েকটা চড়থাপ্পড় লাগিয়ে, কান ধরে টেনে আনার জন্যে চলল জিনা। সে ঝোঁপটার কাছে এসে দাঁড়াতেই আচমকা থেমে গেল আঁচড়ের শব্দ, রাফিয়ানের ভয় মেশানো আর্তি শোনা গেল একবার, তারপরেই চুপচাপ। দুহাতে কাটাঝোঁপ সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিল জিনা।
রাফিয়ান গায়েব! ঘটনাটা কী! চমকে গেল জিনা। খরগোশের গর্ত দেখা যাচ্ছে, কালো ছড়ানো মুখ যেন বিশাল অজগরের হায়ের মত হয়ে রয়েছে। খুঁড়ে খুঁড়ে বড় করে ফেলেছে রাফিয়ান।
কিশোর! উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচিয়ে ডাকল জিনা। রাফিয়ান নেই! খরগোশের গর্তে পড়ে গেছে!
ঝোঁপের ধারে জিনার পাশে বসে কিশোরও উঁকি দিল ভিতরে। রবিন আর মুসাও এসে হাঁটু গেড়ে বসল গা ঘেঁষে।
গর্তে পড়ল! বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। এত্তোবড় একটা কুকুর খরগোশের গর্তে পড়ে কী করে!
যেভাবেই হোক, পড়েছে! কেঁদে ফেলবে যেন জিনা। খুঁড়ে বের করা দরকার ওকে! জলদি না করলে দম আটকে মরে যাবে!
বেশ বড় ঝোঁপ, কাঁটা-ডাল, ভেতরে ঢোকা মুশকিল। তবে ভরসা, সঙ্গে যন্ত্রপাতি রয়েছে। ছুটে গিয়ে কুড়াল নিয়ে এল কিশোর। কুপিয়ে কাটতে লাগল কাঁটা-ঝোঁপ। সে আর মুসা মিলে অল্পক্ষণেই ঝোঁপের অনেকখানি উড়িয়ে দিল। হাতের কনুই পর্যন্ত ছড়ে-কেটে গেছে, রক্ত বেরিয়ে এসেছে চামড়া কেটে, খেয়ালই করছে না।
গর্তটার পারে বসে ভেতরে ঝুঁকে তাকাল কিশোর। অন্ধকার। টর্চের আলো ফেলল। চেঁচিয়ে উঠল বিস্ময়ে। এই জন্যেই তো বলি, এতবড় একটা বাঘাকুকুর খরগোশের গর্তে ঢোকে কী করে! জিনা, এটাই কুয়া! কুয়ার পারে খরগোশের বাসার মুখ, খুঁড়ে খুঁড়ে দুটো এক করে ফেলেছে রাফিয়ান। খরগোশের গর্তে পড়েনি, পড়েছে কুয়ার ভেতরে।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জিনা। বিলাপ শুরু করল, ও, রাফি, রাফি রে, তুই কোথায়! …তোকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না রে, রাফি…
জিনার কাণ্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, মুসা আর রবিন। কিশোর মৃদু ধমক লাগাল, আরে, কী করছ, পাগলের মত! দাঁড়াও না দেখি আগে, তোলার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে রাফিয়ান!
হিউউউ করে নাকি গলায় কেঁদে উঠল রাফিয়ান, সে যে বেঁচে আছে সেটা বোঝানোর জন্যেই, অনেক দূর থেকে ভেসে এল শব্দটা, কুয়ার নিচেই আছে।
মুসার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল কিশোর। যাও তো, এক দৌড়ে গিয়ে খোন্তা নিয়ে এসো। কুয়ার মুখ আরও বড় করতে হবে। তারপর দড়ি বেঁধে নেমে যাব।
সহজেই পরিষ্কার করা গেল গর্তের মুখ। ঝোঁপঝাড়ের শেকড় গর্তের দেয়াল ভেদ করে ঠেলে বেরিয়ে আছে; তার ওপর পাতা, আলগা মাটি জমে ঢেকে গিয়েছিল মুখটা। ওগুলো সরাতেই দেখা গেল বড় একটা পাথর, প্রায় ঢেকে দিয়েছে কুয়ার মুখ, এক ধারে সামান্য ফাঁক, ওই ফাঁক দিয়েই ভেতরে পড়েছে রাফিয়নি।
সবাই মিলে প্রচুর কায়দা-কসরৎ করে পাথরটা সরাল কুয়ার মুখ থেকে। তলায় কাঠের আরেকটা ঢাকনা। বোঝা গেল, টাওয়ার ধসে পড়ার সময় কোনভাবে গড়িয়ে এসে পাথরটা পড়েছিল মুখে, কিন্তু নিচের ঢাকনাটা মাপমত তৈরি করে বসানো হয়েছে, পানিতে যাতে কোন কিছু না পড়তে পারে সেজন্যে। ভিজে পচে গেছে কাঠ; এত নরম, রাফিয়ানের ভারও সইতে পারেনি, গোলমত একটা ফোকর হয়ে আছে।
নিচে উঁকি দিল কিশোর, তল দেখা যায় না। অন্ধকার। পাথর ফেলল, কিন্তু ছলাত করে উঠল না, কোনরকম আওয়াজই শোনা গেল না। তা হলে কি পানি নেই? নাকি পানি এত গভীরে, পাথর পড়ার আওয়াজ মাঝপথেই মিলিয়ে গেছে?
সাংঘাতিক গভীর মনে হচ্ছে! বিড়বিড় করে বলল কিশোর। কিন্তু রাফিয়ান…কোথায় ও?
টর্চের আলো ফেলল ভেতরে। অনেক কাল আগে মস্ত আরেকটা পাথরের চাঙর পড়েছিল ভেতরে, কুয়ার এক জায়গায় দেয়ালের ঘের সরু, ওখানে আটকে আছে। ওখানেই বসে আছে বেচারা রাফিয়ান; জিভ বের করে বড় বড় চোখ মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওপর দিকে। যেন বুঝতেই পারছে না, কী করতে কী ঘটে গেছে, কী হয়েছে ওর।
কুয়ার দেয়ালে আটকানাে রয়েছে লােহার মই। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেমে পড়ল মুসা, লােহার মই বেয়ে নেমে চলল নিচে-ভাবেইনি বােধহয়, পুরানাে মই যে-কোন মুহূর্তে খসে আসতে পারে দেয়াল থেকে। মই বেয়ে তরতর করে নেমে চলেছে সে। নিরাপদেই কুকুরটার কাছে পৌছল, অনেক চেষ্টায় কাঁধে তুলে নিল ভারি রাফিয়ানকে, ধীরে ধীরে উঠে আসতে শুরু করল।
ওপরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা, মুসা কাছাকাছি আসতেই তার কাধ থেকে কুকুরটাকে তুলে আনল ওরা, তারপর হাত ধরে মুসাকে উঠতে সাহায্য করল। ধপ করে বসে পড়ে হাঁপাতে শুরু করল মুসা।
মুসা, আন্তরিক প্রশংসা করল কিশাের, তুমি যে আমার বন্ধু, এজন্যে গর্বে আধ হাত ফুলে যাচ্ছে আমার বুক।
জিনা কিছু বলতে পারল না, কৃতজ্ঞ জল-টলােমলাে চোখে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে।
‘সেকেণ্ড, একটা কাজের কাজই করেছ!’ রবিন বলল। তুমি দুর্দান্ত সাহসী! মই যে-কোন সময় খসে যেতে পারত, তারপর কী ঘটত সেটা জেনেও…’
খাইছে রে! ও, আল্লা!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। সেকথা তাে ভাবিইনি!’ চোখে আতঙ্ক ফুটেছে তার। একেবারে শুয়ে পড়ল। বাবা গাে, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি!’
হাে হাে করে হেসে উঠল সবাই। রাফিয়ানও তার কুকুরে-হাসি হেসে গাল, চেটে দিল মুসার।
খেঁকিয়ে উঠল মুসা, ‘দুত্তেরি, কুত্তার বাচ্চা! এখন এসেছে সােহাগ করতে! দিয়েছিলি তাে আরেকটু হলে! …যা, যা এখান থেকে! ভাগ!’
মুসার এই হঠাৎ পরিবর্তনে ভড়কে গেল রাফিয়ান, এক লাফে পিছিয়ে এসে বােকা বােকা চোখে চেয়ে রইল। বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন, খানিক আগে বাঁচিয়েছে তাকে ওই মারমুখাে ছেলেটা।
আবার হেসে উঠল সবাই।
জিনা ডাকল, ‘রাফিয়ান, এদিকে আয়! দুষ্ট ছেলে, আর খরগােশ তাড়া করবি?’ একটা ডাল ভাঙতে শুরু করল সে।
কী ঘটবে বুঝে গেল রাফিয়ান, দুই লাফে এসে জিনার একেবারে পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ল। ডাল আর ভাঙা হলাে না, হাত তুলল জিনা, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওঠ, এইবার মাপ করে দিলাম। এরপর…’ হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে।
আবার ডানজনের প্রবেশপথ খোঁজায় মন দিল ওরা। ঝােপ কেটে সাফ করে খোন্তা দিয়ে খুঁচিয়ে চল ওগুলোর গোড়ায়। মাঝেমধ্যে ঠনন করে পাথরে বাড়ি লাগছে খোন্তা, খুড়ে বের করে আনছে ওটা। সাবধানে রয়েছে, রাফিয়ানের মত আলগা মাটির আস্তর ধসে না আবার গর্তে পড়ে। উত্তেজনায় ঘামছে দরদর করে।
হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলল রবিন। নিতান্তই ভাগ্য বলতে হবে। পরিশ্রান্ত হয়ে খানিক জিরিয়ে নেয়ার জন্যে শুয়ে পড়েছিল সে, শুয়ে শুয়েই মাটি খামচাচ্ছিল। বালির তলায় ঠাণ্ডা কিছু আঙুলে ঠেকল তার। কৌতূহল হলো, উঠে বসে বালি সরাতেই দেখা গেল, লোহার একটা মোটা রিং!
এই এদিকে এসো তোমরা! ডাকল সে। দেখে যাও!
রিংটা কীসে আটকানো, বালি পরিষ্কার করতেই তা বোঝা গেল। চারকোনা একটা পাথরের চাঙড়। নিশ্চয় প্রবেশপথের মুখে ঢাকা দেয়া রয়েছে।
নতুন উদ্যমে এটাকে সরানোর কাজে লেগে গেল ছেলেরা। বহু টানাটানি করল, কিন্তু এক চুল নড়ল না ভারি পাথর। মুসার প্রচণ্ড শক্তিও বিফল হলো। ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোর পাশার, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়েছে। হবে, হবে, দৃড়াও! আচমকা ধ্যান ভাঙল তার। দড়ি কয়েক পাক করে পেঁচিয়ে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল রিঙে, শক্ত করে বাঁধল।
এসো, সবাই ধরো।
দড়ি ধরল সবাই।
মারো টান! হেঁইও! …জোর সে মারো! হেঁইও!
সম্মিলিত শক্তির কাছে হার মানল পাথর। ছিপাত করে বিচিত্র শব্দ তুলে মাটির আকর্ষণ থেকে মুক্ত হলো ওটা। এর পরের কাজ সোজা। টেনে প্রবেশমুখ থেকে ঢাকনা সরিয়ে ফেলল ওরা।
একই সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে এসে গর্তটার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল সবাই, নিচে উঁকি দিল। ধাপে ধাপে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে।
যাক, পাওয়া গেল! বলল কিশোর। চলো এবার, নামি।
পিচ্ছিল সিঁড়ি, সবার আগে বুঝল সেটা রাফিয়ান। লাফিয়ে নামতে গিয়েই পা পিছলাল, হড়াৎ করে নেমে চলে গেল কয়েক ধাপ, ওলটপালট খেয়ে শেষে থামল এক জায়গায়, উঠল কোনমতে। কুঁই কুঁই করছে। ভয়ে। আর নামতে সাহস পাচ্ছে না।
সাবধান হয়ে গেল অন্যেরা। ধীরে ধীরে নেমে চলল। দুরুদুরু করছে বুক। ডানজন তো পাওয়া গেল, সোনার বারগুলো পাওয়া যাবে তো! কতগুলো আছে? ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো মেঝেতে?
বাঁক নিল সিঁড়ি। অন্ধকার বাতাসে ভেজা কেমন একটা ভাপসা গন্ধ। শ্বাস নিতে সুবিধে হয়।
ইঁহ! দম আটকে আসে! জিনা নাক দিয়ে খোতখোত করল।
তাও তো ভালই এখানে বাতাস, কিশোর বলল, আরও নিচে কেমন, কে জানে! কুয়া কিংবা পাতালের বদ্ধ ঘরগুলোতে নানারকম বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে। ফুসফুসে ঢুকলে মরণ!
নীরবে নেমে চলল ওরা। যখন ভাবতে শুরু করেছে, এই সিঁড়ির আর শেষ নেই, ঠিক তখনই শেষ হলো সিঁড়ি। চারপাশে আলো ফেলে দেখল কিশোর। রোমাঞ্চকর দৃশ্য! জায়গায় জায়গায় পাথর পড়ে রয়েছে। একটা গুহা; প্রাকৃতিক, না মানুষের খোঁড়া, বোঝা গেল না। রহস্যময় অন্ধকার সবখানেই।
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফাঁপা এক ধরনের আওয়াজ উঠল বদ্ধ জায়গায়, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল : লা-লা লা-লা-লা…! জ্যান্ত একটা শব্দের সাপ যেন বিচিত্র শব্দ তুলে পাক খাচ্ছে ওদেরকে ঘিরে, দেখা যায় না, অনুভব করা যায় যেন, হাত বাড়ালেই বুঝি ধরা যাবে! গায়ে গা ঘেষে এল ছেলেরা।
আশ্চর্য! ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় বলল জিনা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল, খুব আস্তে, ফিসফিস করে পাক খেতে শুরু করল যেন এবার শব্দের সাপরের হাত খামজঙ্গে পরিচয় নেন
কিশোরের হাত খামচে ধরল জিনা। কাঁপছে। রক্ত জমেছে মুখে। এই ধরনের প্রতিধ্বনির সঙ্গে পরিচয় নেই তার, কিন্তু তিন গোয়েন্দার অভিজ্ঞতা আছে। টেরর ক্যাসলের প্রতিধ্বনি এর চেয়েও ভয়াবহ ছিল!
বারগুলো কোথায়? নিচু গলায় বলল মুসা, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনি উঠল: কোথায়! কোথায়! কোথায়!
হেসে উঠল কিশোর, তার হাসিকে লুফে নিয়ে শত-সহস্ৰভাগ করে বিচিত্র শব্দে যেন আবার তার দিকে ছুঁড়ে দিল রহস্যময় গুহা। চুপ হয়ে গেল সে। আস্তে বলল, এসো, আর কোথাও চলে যাই! এ-জায়গাটা ভাল না!
ভাল না! ভাল না! ভাল না!–প্রতিধ্বনি হলো।
সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এল ওরা। দেয়ালে বড় ফোকর, বোধহয় দরজা। একটা ফোকর দিয়ে ঢুকে অন্য পাশে চলে এল ওরা, আরেকটা ঘরে, এটাকেও গুহা বলা যেতে পারে। এগুলো কী কাজে ব্যবহার হত? নিশ্চয় কয়েদী আটকে রাখার জন্যে, অনুমান করল কিশোর। বিড়বিড় করল, কিন্তু বারগুলো কোথায়? পকেট থেকে ম্যাপ বের করে মাটিতে বিছিয়ে তাতে টর্চের আলো ফেলল। বারগুলো কোথায় আছে, স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে বটে ম্যাপে, কিন্তু এই পাতালের ঘরে কোনটা যে-কোন্ দিক, বোঝার উপায় নেই। ইস, একটা কম্পাস নিয়ে আসা উচিত ছিল, আফসোস করল গোয়েন্দাপ্রধান।
মনে হয়… চোখ তুলল কিশোর হঠাৎ, এ-ঘরের আশপাশেই কোথাও রয়েছে! ওই যে, আরেকটা দরজা, হয়তো তার ওপারেই…আমি শিওর, ওখানেই আছে!
তেরো
একসঙ্গে চারটে টর্চ ঘুরে গেল দরজার দিকে। ভারি কাঠের পাল্লা লাগানো, বড় বড় পেরেক গেঁথে আটকে দেয়া হয়েছে, যাতে সহজে না খোলা যায়। হাসি ফুটল মুসার মুখে, ছোট্ট একটা কাশির মত শব্দ করেই ছুটে গেল দরজার কাছে। ঠেলা দিয়ে, থাবা মেরে, ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করল।
কিন্তু বেশ ভাল করেই আটকানো হয়েছে দরজা। নড়লও না। চাবির ফোকর এত বড়, আঙুল ঢুকে যায়, চাবি নিশ্চয় আঙুলের মতই মোটা ছিল। কয়েক মুহূর্ত বোবা হয়ে দরজা আর তালার ফোকরের দিকে চেয়ে রইল ছেলেরা। এখন কী করবে? কী করে খুলবে ওই দরজা?
কুড়াল! নীরবতা ভাঙল কিশোর। কুড়াল আনতে হবে! কুপিয়ে ভেঙে ফেলব তালা!
ঠিক বলেছ! সায় দিল মুসা। চলো, গিয়ে নিয়ে আসি! তর সইছে না আর তার।
কিন্তু ফিরতে গিয়ে বুঝল ওরা, পথ হারিয়ে ফেলেছে। বিশাল ঘর, গোল দেয়াল, তাতে বড় বড় অসংখ্য ফোকর, সবগুলোই দেখতে প্রায় এক রকম; কোনটা দিয়ে ঢুকেছিল, বলতে পারবে না। অনুমানে একটা ফোকরে ঢুকে পড়ল। বেরিয়ে এল একটা ঘরে। সিঁড়িঘর নয় এটা। বড় বড় কাঠের পিপে ভেঙে-চুরে পড়ে আছে, কাঠপচা গন্ধ। নানা ধরনের খালি মদের বোতল স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ঘরের কোণে। আর কয়েকটা টুকিটাকি ভাঙা জিনিস পড়ে রয়েছে এদিক-ওদিক।
বিচ্ছিরি! নাক কোঁচকাল কিশোর।
আবার আগের বড় ঘরটায় ফিরে এল ওরা। আরেকটা ফোকর দিয়ে। ঢুকল। কিন্তু সিঁড়িঘর পাওয়া গেল না, তার বদলে আরেকটা গোল ঘর। নানারকম বাতিল জিনিস, আর পচা ভাপসা গন্ধ।
একের পর এক ফোকর দিয়ে ঢুকল ওরা, বেরোল, কিন্তু প্রতিবারেই নতুন আরেকটা ঘরে ঢুকছে। সিঁড়িঘর পাওয়া যাচ্ছে না।
বাকি জীবন আটকে থাকতে হবে নাকি এখানে! বিড়বিড় করল মুসা।
জিনা আর রবিন চুপ, তাদের ভয় সংক্রমিত হয়েছে যেন কুকুরটার মাঝেও, সে-ও চুপ।
এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? সাহস দিল কিশোর। কোন না কোনভাবে বেরিয়ে যাবই। আ-আরে, ওটা কী!
সবাই তাকাল। ইটের তৈরি মস্ত এক চিমনির মত, ছাত থেকে নেমে এসে ঢুকে গেছে মেঝেতে।
আলো ফেলে দেখতে দেখতে বলে উঠল জিনা, আমি জানি কী ওটা! কুয়া! ওপর থেকে নেমে এসে মেঝে ভেদ করে চলে গেছে। পাতালে!
ঠিকই বলেছে সে। এগিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে দেখল সবাই। কুয়ার দেয়ালে এক জায়গায় একটা জানালামত, একবারে একজনের বেশি মাথা। ঢোকাতে পারল না তাতে। হাত ঢুকিয়ে ওপর-নিচে আলো ফেলে দেখল। কিশোর, একেবারে নিচে কী আছে দেখা গেল না। পাথর ফেলে দেখল, কোন আওয়াজ নেই। বড় বেশি গভীর! অনেক ওপরে আবছা আলো, ছোট্ট একটা ফাঁক দিয়ে আসছে। কুয়ার যেখানে চ্যাপ্টা পাথরটা আটকে আছে; ওই যে, যেটাতে রাফিয়ান পড়েছিল; তারই ফাঁক দিয়ে আসছে। আলো, বুঝতে অসুবিধে হলো না।
হ্যাঁ, মাথা বের করে এনে বলল কিশোর, কুয়াই। সুবিধে হয়েছে। কুয়াটার কাছাকাছিই কোথাও আছে সিঁড়িঘর।
এ-ঘরটায় ফোকর বেশি নেই। একটা করে ফোকরে ঢুকে ওপাশ দেখে ফিরে আসতে লাগল কিশোর। তিন নম্বরটায় ঢুকে খানিকটা দেরি করল, ফিরে এল হাসিমুখে। পেয়েছি, এসো।
অন্ধকার পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওরা ওপরে, বাইরে, খোলা রোদে। মাথায়, কাঁধে সূর্যের আলো যেন অমৃতের পরশ বোলাল; ঠাণ্ডা বিশুদ্ধ বাতাস ঘন ঘন ফুসফুসে টেনে নিল ওরা, অকারণেই খিলখিল করে হাসল জিনা, তার হাসি সংক্রমিত হলো রবিন আর মুসার মাঝেও।
ঘড়ি দেখল কিশোর। আরিব্বাপ! সাড়ে ছটা বেজে গেছে। তাই। তো বলি, পেটে মোচড় দিচ্ছে কেন। চলো চলো, খেয়ে নিই। কী, সেকেণ্ড, আজ খিদে কোথায় গেল?
আরে, মিয়া, ক্ষুধা আর টুধা! মরেই তো যাব ভেবেছিলাম! মুক্তির আনন্দে খাওয়ার কথা ভুলে গেছে মুসা আমান!
আগুন জ্বেলে চায়ের জন্যে কেটলিতে পানি চাপিয়ে খোলা চত্বরেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। গায়ে লাগছে কুসুম গরম রোদ, আহ্, কী আরাম!
চা, বিস্কুট আর কেক দিয়ে বিকেলের নাশতা সারা হলো, সেই সঙ্গে কিছু রুটি আর পনিরও খেল। সাংঘাতিক পরিশ্রম গেছে। কিছুটা ভারি খাওয়ার দরকার ছিল। রাফিয়ানেরও খাওয়া ভালই হলো। জিনার গা ঘেষে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ, কান লেপটে রয়েছে মাথার সঙ্গে। সোজা হয়ে মাটিতে বিছিয়ে আছে লম্বা লেজটা। অদ্ভুত প্রতিধ্বনি, তারপর পাতালে পথ হারিয়ে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে-ও। একবার। মাত্র গর্জে উঠেছিল প্রতিধ্বনিকে ভয় দেখানোর জন্যে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেন শখানেক কুকুর একসঙ্গে গর্জে উঠেছিল; তারপর সেই যে চুপ করেছে রাফিয়ান, একটা গোঙানিও বেরোয়নি ওর গলা দিয়ে, যতক্ষণ পাতালে ছিল।
আটটা পর্যন্ত শুয়ে রইল ওরা। সূর্য ডুবছে। গরম রোদ আর নেই, ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে।
উঠে বসল, কিশোর।
কী হলো? জিজ্ঞেস করল জিনা। আবার ঢুকছি নাকি আজ?
নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। আজ আর না। কাহিল লাগছে। চলো, ঘরে গিয়ে শুই।
ঘরে এসে বিছানা পাতল ওরা। রাতের খাওয়ার ঝামেলায় আর গেল না। সটান শুয়ে পড়ল যার যার বিছানায়। শোয়ামাত্রই ঘুম।
ভোরে রাফিয়ানের ঘেউ ঘেউ ডাকে ঘুম ভাঙল ছেলেদের। দরজার কাছে একটা খরগোশ ছিল, ওটাকে দেখেই ধমকে উঠেছে কুকুরটা। তাড়া করতে গেল, ডেকে তাকে ফেরাল জিনা।
ঘুম ভাঙতেই প্রথমে পাতালের বড় কাঠের দরজাটার কথা মনে। পড়ল কিশোরের। কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে ভাঙতে হবে ওটা। কী আছে অন্য পাশে, দেখা দরকার।
পেট ভরে খেয়ে নিল ওরা। সারাদিন আর খেতে পারবে কিনা, খাওয়ার সময় আর সুযোগ পাবে কিনা, জানে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। সোনার বারগুলো থেকে থাকলে, ওগুলো খুঁজে বের করবেই।
কুড়াল তুলে নিল কিশোর। আগে আগে চলল। তার পিছনে অন্যরা। সবার পিছনে রয়েছে রাফিয়ান। কোথায় যাচ্ছে, বুঝতে পারছে; সেজন্যেই মনমরা। আবার গিয়ে পাতালের অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঢোকার কোন ইচ্ছেই নেই তার। ভাবছে বোধহয়: কেন, বাপু; এই রোদ, এই আলো, এই খরগোশ তাড়া করার দুরন্ত মজা ছেড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি একটা অন্ধকার গুহায় ঢোকা! তা-ও আবার যে-সে গুহা নয়, কথা বললেই ধমকে ওঠে শতকণ্ঠ! কিন্তু জিনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করার সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তার।
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আবার সিঁড়িঘরে নেমে এল ওরা। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় সেই ফোকরটা খুঁজে পেল, যেটা দিয়ে কাঠের দরজাওয়ালা ঘরটায় ঢোকা যায়।
আবার পথ হারাব আজ! জিনার কণ্ঠে অস্বস্তি। কী যে অন্ধকার! সব কটা ফোকর আর ঘর যেন এক রকম! কোটা থেকে কোটা আলাদা, বোঝার জো নেই।
কম্পাস আনলেই অনেক সহজ হয়ে যেত! বলল কিশোর। কিন্তু আনিনি যখন, ভেবে আর কী হবে? সাবধান থাকতে হবে, এই আর কী।
কম্পাস আনেনি বটে, কিন্তু আজ চক নিয়ে এসেছে কিশোর। যে পথেই যাচ্ছে, পাশের দেয়ালে খানিক পর পরই বড় করে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন একে একে এগোচ্ছে। কুয়াঘরটা খুঁজে পেয়েছে, ফোকরের পাশের দেয়ালে কয়েকটা আশ্চর্যবোধক এঁকে দিয়েছে। এবার আর পথ হারানোর ভয় নেই, ফিরে এসে এই ঘরটায় ঢুকতে পারলেই আর ভয় নেই, কারণ এর কাছাকাছিই রয়েছে সিঁড়িঘর, পাওয়া যাবেই।
কাঠের দরজা আর তাতে মারা পেরেকগুলো ভালমত পরীক্ষা করল। কিশোর। পুরানো আমলের রড, চ্যাপ্টা মাথাওয়ালা পেরেক, তাতে লাল মিহি মরচে। আঙুল দিয়ে চুলে লাল হয়ে যায় আঙুলের মাথা।
তালার পাশে দরজায় কোপ বসিয়ে দিল সে। ঘ্যাচাৎ! আশা করেছিল ভেঙে যাবে, ভাঙল না। আবার কোপ মারল কিশোর। লোহার, পাতে বাড়ি খেয়ে পিছলে কাত হয়ে গেল কুড়ালের ফল, চড়াৎ করে কাঠের চিলতে উঠে গিয়ে সোজা গাথল মুসার গালে।
ও, বাবা গো, গেছি, গেছি! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। টান দিয়ে খসিয়ে ফেলল কাঠের চিলতে, ক্ষত থেকে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে এল।
টর্চের আলোয় ক্ষতটা ভাল করে দেখল কিশোর, বলল, খুব লাগছে, না? সরি। যাও, ওপরে গিয়ে ভাল করে ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে নাও। রবিন, তুমিও যাও, ওকে সাহায্য করো।
আমিও যাই, উদ্বিগ্ন হয়ে বলল জিনা।
না, তোমার আসার দরকার নেই, কাটা জায়গা চেপে ধরে রেখেছে। মুসা। তুমি এখানেই থাকো, কিশোরকে সাহায্য করতে পারবে।
জিনা, কুড়াল বাড়িয়ে ধরে বলল কিশোর, কোপাও। দেখো, কিছু করতে পারো কিনা দরজার। আমি মুসাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
রাফিয়ানের দায়িত্বে জিনাকে রেখে সিঁড়িঘরের দিকে এগোল। তিনজনে।
কাঠের দরজাটাকে আক্রমণ করল জিনা, সব দোষ যেন ওটার, তাই শাস্তি দিচ্ছে। একটু পরেই ফিরে এল কিশোর। ইতিমধ্যে তালার চারপাশে মোটামুটি দাগ কেটে ফেলেছে জিনা।
কিশোর কুড়ালটা নিয়ে নিল জিনার হাত থেকে, কোপাতে শুরু করল। বেশিক্ষণ আর টিকল না কাঠ, খটাং করে তালাটা খুলে কাত হয়ে ঝুলে রইল এক পাশে। ধাক্কা দিতেই কড়মড় প্রতিবাদ তুলে যেন ঘুম ভাঙল দরজার মরচে ধরা কজার। টর্চ হাতে ঢুকে পড়ল দুজনে।
মাঝারি আকারের একটা গুহা, পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। পুরানো পিপে আর বাক্সের বদলে এখানে অন্য জিনিস রয়েছে। একধারের দেয়াল ঘেঁষে স্কুপ হয়ে রয়েছে হলদে রঙের ছোট ছোট ইটের মত কিছু।
একটা ইট তুলে নিল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, সোনা! খাঁটি সোনার বার! জিনা, অনেক টাকার সোনা এখানে!
চোদ্দ
জিনার মুখে কথা জোগাল না। চোখ বড় বড় করে সোনার স্তূপের দিকে চেয়ে আছে, বিশ্বাসই করতে পারছে না। বুকের ভিতরে হৃৎপিণ্ডটা অস্থির লাফালাফি জুড়েছে। কিশোরেরও প্রায় একই অবস্থা।
রাফিয়ানের উত্তেজিত চিল্কারে চমক ভাঙল ওদের। প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করছে।
এই, রাফি, চুপ, চুপ! ধমক দিল জিনা, কিন্তু কুকুরটার দিকে চেয়ে নিজেই চুপ হয়ে গেল। এমন করছে কেন! কি ব্যাপার, মুসা আর রবিন আসছে?
ফিরেও তাকাল না রাফিয়ান, চিৎকারও থামল না।
দরজার কাছে এসে ডেকে জিজ্ঞেস করল জিনা, মুসাআ! রবিইন! তোমরা? জলদি এসো! সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি!
জবাব নেই।
রাফিয়ানের চিৎকার এখন চাপা গর্জনে রূপ নিয়েছে। ভীষণ চোখে তাকিয়ে আছে দরজার ওপাশের অন্ধকারের দিকে। কী রে, রাফি! …নাহ, মুসা আর রবিনকে দেখে ওরকম করার কথা না! এই, রাফি… কথা আটকে গেল তার।
অন্ধকার থেকে ভেসে এসেছে একজন মানুষের ভারি কণ্ঠস্বর, গুমগুম করে উঠল যেন বদ্ধ জায়গায়। বিচিত্র প্রতিধ্বনি তুলল পাথরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে।
কে? কে ওখানে?
ভয়ে কিশোরের হাত খামচে ধরল জিনা। গুঙিয়েই চলেছে রাফিয়ান, ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।
টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে জিনা, ফিসফিস করে বলল, চুপ! চুপ, রাফি!
কিন্তু রাফি চুপ করল না।
দরজার ওপাশের ঘরের একটা সুড়ঙ্গ-মুখে জোরাল টর্চের আলো দেখা গেল। দরজা থেকে সরে যাওয়ার সময় পেল না কিশোর আর জিনা, আলো এসে পড়ল হঠাৎ ওদের ওপর, রাফির গোঙানিই এজন্যে দায়ী।
আরে, আরে! বলে উঠল ভারি কণ্ঠ। দেখেছ কারা? দুটো ছেলেমেয়ে! আমার দুর্গের ডানজনে তোমরা কী করছ?
আপনার দুর্গ! মানে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
আমার দুর্গ মানে আমার দুর্গ, এটা না বোঝার কী হলো? আরও খুলে বলছি, এটা আমি কিনছিঃ কাগজপত্র তৈরি হতে যা দেরি।
লোকটার পাশে এসে দাঁড়াল আরেকজন। চুপচাপ এক মুহূর্ত দেখল জিনা আর কিশোরকে। জিজ্ঞেস করল, বারগুলো খুঁজে পেয়েছ বলে চেঁচাচ্ছিলে, কীসের বার? কী খুঁজে পেয়েছ?
বোলো না, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কিন্তু চাপা রাখা গেল না কথাটা, ফাস করে দিল প্রতিধ্বনি। অনেক গুণ জোরাল হয়ে বার বার ঘুরেফিরে বলল: বোলো না! বোলো না!! বোলো না!!!
বলবে না? বলতে বলতে এগিয়ে এল ভারি কণ্ঠ।
দাঁত খিঁচিয়ে ধমক লাগাল রাফিয়ান, কিন্তু তাকে কেয়ারই করল না। লোকটা। সোজা এগিয়ে আসতে লাগল। দরজার কাছে এসে ভিতরে। আলো ফেলেই শিস দিয়ে উঠল বিস্ময়ে। জেরি! দেখো এসে! ডাকল সঙ্গীকে। ঠিকই বলেছিলে, সোনা আছে এখানে! পড়ে আছে, তুলে নিয়ে গেলেই হলো! এমন সুন্দর দৃশ্য জিন্দেগীতে দেখিনি!
ওগুলো সব আমার! রেগে উঠল জিনা। এই দ্বীপ আর দুর্গ আমার মায়ের; এখানে যা আছে, সব আমাদেরই। ওই সোনার বার নিয়ে এসে জমা করেছিল আমার নানার-নানার-বাবা, তারপরেই তার জাহাজ ডুবে গেছে। এই সোনা তোমাদের নয়, ছিল না কোনকালে, হবেও না। এখনি গিয়ে বাবা-মাকে সব খুলে বলব, দ্বীপ আর বিক্রি করবে না, তোমরাও কিনতে পারবে না। খুব তো চালাকি করেছ! বাবাকে ভাল মানুষ পেয়ে ফাঁকি দিয়ে ম্যাপটা নিয়ে গেছ, দ্বীপ কেনার ফন্দি এঁটেছ!
নীরবে জিনার গরম বক্তৃতা শুনল লোকটা, খুক করে হাসল। আমাদেরকে রুখতে পারবে বলে মনে হয় না! দুটো শিশু তোমরা, এত শক্তি আছে? এখন তো আরও ভাল হলো, দ্বীপ কেনার টাকাটাও বাচল। বারগুলো নিয়ে গিয়ে নৌকায় তুলব, তারপর জাহাজে করে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাব। এই পচা দ্বীপ আর দুর্গ দিয়ে কী কচুটা করব? হাসল আবার সে।
পারবে না! এগিয়ে এসে দরজা আটকে দাঁড়াল জিনা। এখুনি বাড়ি গিয়ে বাবাকে সব খুলে বলছি…
মাই ডিয়ার বালিকা, বাড়ি আর যেতে পারছ না, বলল দ্বিতীয় লোকটা, জিনাম কাঁধে হাত রাখতে গেল, ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল জি-ী। জোর করেই তার কাধ ধরে ঠেলে ভিতরে নিয়ে গেল লোকটা। তোমার ওই কুত্তাটাকে সরাও! নইলে গুলি করে মারব!
অবাক হয়ে দেখল জিনা, লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে চকচকে বড়সড় একটা রিভলভার, রাফিয়ানের দিকে তাক করছে। থাবা দিয়ে তার হাত অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল জিনা, রাফিয়ানের গলার চামড়ার কলার ধরে টেনে সরিয়ে আনল। এই, রাফি, চুপ! চুপ কর বলছি! কিছু হয়নি!
হয়নি বললেই হলো? রাফিয়ান কি এত বোকা? ঠিকই বুঝেছে সে, ঘাপলা একটা হয়েছে। চুপ তো করলই না, গোঙানি আরও বাড়িয়ে দিল। ভয়ানক হয়ে উঠেছে চেহারা। জিনা ছেড়ে দিলেই গিয়ে এখন লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
গুড, বলল লোকটা। এভাবেই আটকে রাখো, ছাড়লেই মরবে। ওটা। তোমাদের ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমাদের। কিন্তু একটু এদিক ওদিক করলেই..যা বলি, শোনো, মোটরবোটে করে এসেছি আমরা, কাজেই বারগুলো এখুনি নিয়ে যেতে পারছি না। একটা জাহাজ আনতে যাচ্ছি, ততক্ষণ তোমরা আটকে থাকবে এখানে।
তোমাদের আরও দুজন সঙ্গী আছে, বুঝতে পেরেছি। চেঁচিয়ে দুজনের নাম ধরে ডাকছিলে, বলল অন্য লোকটা। কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওদেরও আটকে থাকতে হবে এখানে। ভয় নেই, খাবার আর পানি রেখে যাব, না খেয়ে মরবে না। এক কাজ করো তো, পকেট থেকে কাগজ কলম বের করল সে। ছোট্ট একটা নোট লিখে দাও। লেখো, সোনার বারগুলো পেয়েছ। ওপরে যারা আছে তারা যেন শিগগির চলে আসে। চিঠি নিয়ে যাবে কুত্তাটা। খবরদার, কোনরকম চালাকির চেষ্টা করবে না।
করব না। মহাখাপ্পা হয়ে উঠেছে জিনা, সেটা ঢেকে রাখতে পারছে না। চালাকিও করব না, কিছু লিখবও না। কী ভেবেছ? আমাদেরকে বন্দি করে রাখবে? আবার বারগুলো নিয়ে যাবে? সেটি হতে দিচ্ছি না কিছুতেই।
ভাল চাও তো লেখো, গর্জে উঠল রিভলভারধারী। নইলে প্রথমে গুলি করব কুত্তাটাকে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল জিনা। শীত শীত করে উঠল গা, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যেন রক্তস্রোত। না, না, গুলি কোরো না! ফিসফিস করে বলল সে।
বেশ, তা হলে লিখে ফেলো, কাগজ-কলম বাড়িয়ে ধরল লোকটা।
আমি পারব না! ফুঁপিয়ে উঠল জিনা, মুখ ঢাকল দুহাতে।
বেশ, তা হলে মরুক তোমাব কুত্তামিয়া, রিভলভারের মুখ ঘোরাতে শুরু করল সে। শীতল কণ্ঠস্বর।
রাফিয়ানের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল জিনা, জড়িয়ে ধরে আড়াল করে রাখতে চাইল। না না, মেরো না, লিখছি! দাও, লিখে দিচ্ছি! কাঁপা হাতে কাগজ আর কলম নিয়ে লোকটার দিকে তাকাল সে, কী লিখব?
লেখো, আদেশ দিল ভারি কণ্ঠ, রবিন, মুসা, সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা। জলদি এসো। ব্যস, এই তো, আর কী?
নির্দেশমত লিখল জিনা। নাম সই করতে গিয়ে ভাবল এক মুহূর্ত, তারপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখল: জরজিনা গোবেল। এই ইঙ্গিতটা যদি বুঝতে পারে দুজনে, তা হলে উপায় একটা হলেও হতে পারে, আর কিছুই করার নেই।
লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে একটানা গোঁ গোঁ করে চলেছে রাফিয়ান, জিনা মানা করছে বলেই, নাহলে কখন আক্রমণ করে বসত! চিঠিটা ভাজ করে তার কলারে আটকে দিল জিনা, আরেকবার লোক দুটোর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছুটল।
জিনাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না রাফিয়ানের, কিন্তু মনিবের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু একটা রয়েছে, যাওয়াটাই উচিত বলে ধরে নিয়েছে সে। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে বেরিয়ে এল। বাতাসে নাক। তুলে গন্ধ শুকল, রবিন আর মুসার গন্ধ খুঁজছে। কোথায় ওরা?
মাটিতে গন্ধ পাওয়া গেল, যেখান থেকে হেঁটে গেছে মুসা আর। রবিন। গন্ধ শুঁকে শুঁকে অনুসরণ করে চলল রাফিয়ান। ছোট পাহাড়টার ধারে ওদের দেখতে পেল সে। ছুটে এসে দাঁড়াল কাছে। মুসা চিত হয়ে শুয়ে আছে, তার গালের ক্ষতটা লাল, তবে রক্ত পড়া থেমে গেছে।
রবিন পিছন করে বসে আছে, মুসাই আগে দেখতে পেল রাফিয়ানকে। আরে, রাফি! তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল সে। তুই একা। পাতালে অন্ধকারে ভাল্লাগছে না বলে চলে এসেছিস?
মুসা, রাফিয়ানের কলারের দিকে চোখ রবিনের, ওটা কী? কাগজ মুচড়ে লাগিয়ে দিয়েছে! …নিশ্চয় নোট-ফোট কিছু! জরুরি কোন খবর…
হাত বাড়িয়ে কাগজটা খুলে আনল সে, ভাজ খুলে পড়ল মুসাকে শুনিয়ে, সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা! জলদি এসো! …জরজিনা গোবেল! …জর-জিনা!
পেয়েছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। চলো চলো, দেখি! বসে আছ কেন?
কিন্তু রবিন উঠল না। চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে, চিন্তিত।
কী ব্যাপার? আবার জিজ্ঞেস করল মুসা।
তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে না? শুধু জিনা লিখলেই তো পারত, কিংবা জিনা পারকার! জরজিনা গোবেল লিখতে গেল কেন? ব্যাপারটা কেমন জানি লাগছে আমার! কোন ধরনের ইঙ্গিত? হুশিয়ারি?
দূর, কী বোকার মত কথা বলছ? হুশিয়ার করতে যাবে কেন এভাবে চিঠি লিখে?
মুসা, প্রণালীটা দেখে আসি। আমার সন্দেহ হচ্ছে। তুমি থাকো এখানে, আসছি এখনি।
কিন্তু একা একা বসে থাকার ইচ্ছে নেই মুসার, রবিনের পেছনে চলল। বলতে বলতে গেল, অযথাই সন্দেহ করছে রবিন, অহেতুক সময় নষ্ট করছে। কিন্তু কিশোরের কাছে শিক্ষা পেয়েছে রবিন, সন্দেহ হলেই সেটা যাচাই করে দেখে সন্দেহমুক্ত হয়ে নেবে।
প্রণালীর মুখে মোটরবোটটা দেখতে পেল ওরা। ওরা ছাড়াও অন্য কেউ উঠেছে দ্বীপে, বুঝতে অসুবিধে হলো না। মুসার দিকে তাকাল রবিন, ফিসফিস করে বলল, দেখলে তো! জিনা আমাদেরকে হুশিয়ারই করেছে! আমার মনে হয় ওই লোকটা, যে দ্বীপ কিনছে, বাক্সটা চেয়ে নিয়ে গেছে জিনার বাবার কাছ থেকে নিশ্চয় ব্যাটা গিয়ে ঢুকেছে। ডানজনে, জিনা আর কিশোরকে আটকেছে। আমরা গেলে আমাদেরকেও আটকাবে। তারপর সোনা নিয়ে সরে পড়বে। আমাদের সবাইকে মেরে রেখে গেলেও অবাক হব না। …তো, এখন কী করা?
পনেরো
হঠাৎ সচল হয়ে উঠল মুসা, রবিনের হাত ধরে তাকে টেনে আনল, এত প্রকাশ্য জায়গায় থাকা ঠিক না এখন। শত্রুরা দেখে ফেলতে পারে। প্রায় ছুটে চলে এল পাথরের ছোট ঘরটায়, যেটায় ঠাই নিয়েছে ওরা। এক কোণে বসে হাপাতে লাগল।
যে-ই এসেছে, ফিসফিস করল রবিন, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, কিশোর আর জিনাকে আটকে ফেলেছে! কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না! এখন ডানজনে যাওয়া উচিত না, বুঝতে পারছি, কিন্তু ওদেরকে উদ্ধারের কী উপায়? ..আরে, আরে, রাফিয়ান কোথায়!
ওরা যখন উত্তেজিত হয়ে ছোটাছুটি করছিল, তখনই এক সময় ফিরে গেছে রাফিয়ান, খেয়াল করেনি দুজনে। জিনাকে অন্ধকারে শত্রুর হাতে ফেলে এসেছে, রাফিয়ান এখানে স্বস্তি পায় কী করে? তাই ফিরে গেছে। কুকুরটা চলে যাওয়াতে অস্বস্তি আরও বাড়ল রবিন আর মুসার।
কী করবে বুঝতে পারছে না দুজনে, ভাবছে। রবিন বলল, নৌকা নিয়ে চলে যেতে পারি আমরা, সাহায্য নিয়ে আসতে পারি।
আমিও ভেবেছি কথাটা, বিষণ্ণ কণ্ঠ গোয়েন্দা-সহকারীর, কিন্তু যাই কী করে? যা পথ, নৌকা বেয়ে নিয়ে যাওয়া আমার কম্ম নয়। পাথরে খোঁচা লাগিয়ে মরব।
মানুষের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল দুজনেই। ভাবেইনি, রাফিয়ান চলে গেছে; শত্রুরা দেখবে তার কলারে চিঠিটা নেই, তবুও আসছে না কেন ছেলে দুটো, দেখতে আসবেই। তা-ই এসেছে।
গলা শুনেই রবিনের হাত ধরে এক টানে তুলে টেনে নিয়ে দৌড় দিল মুসা। চত্বরে বেরিয়ে থমকে গেল ক্ষণিকের জন্যে, কোথায় যাবে? পরক্ষণেই দৌড় দিল কুয়ার দিকে। লুকানোর ওটাই একমাত্র জায়গা।
কুয়ার পাড়ে এসে রবিনকে ঠেলে দিল মুসা। জলদি করো, মই বেয়ে নেমে যাও! কুইক!
দ্বিধা করছে রবিন, আবার তাড়া দিল তাকে মুসা।
লোকগুলোর হাতে পড়লেও বাঁচবে কিনা জানা নেই, কুয়ায় নামলে। আশা অন্তত আছে। আর দেরি করল না রবিন, মই বেয়ে নেমে গেল। তার পিছনেই নামল মুসা।
তুমি পাথরটায় বসো, মুসা বলল। তোমার ভার সইতে পারবে, কিন্তু আমাকেসহ পারবে না। আমি মই ধরেই ঝুলে থাকছি।
ওপরে দুজন মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রবিন আর মুসার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে, কুয়ার একেবারে কাছেই।
মুসা, রবিন, ডাকল একটা ভারি কণ্ঠ, কোথায় তোমরা? তোমাদের বন্ধুরা ডাকছে। দারুণ খবর আছে। মুসাআআ! রবিইইন!
বাহ্, কী মধুর ডাক! চাপা গলায় বলল মুসা। তা, বাবা, তোমরা। এসেছ কেন? জিনা কিংবা কিশোরই তো আসতে পারত
চুপ! শুনতে পাবে! সাবধান করল রবিন।
আরও কয়েকবার ডাকল লোক দুটো, রেগে যাচ্ছে, ওদের কণ্ঠস্বরেই বোঝা যায়। গেল কোথায়! …নৌকাটাও তো রয়েছে আগের জায়গায়ই। কোথাও লুকিয়ে পড়েছে! …কিন্তু সারা দিন তো ওদের জন্যে বসে থাকা। যায় না।
চলো, কিছু খাবার আর পানি দিয়ে আসি ছেলেমেয়ে দুটোকে, বলল অন্য লোকটা। পাথরের ঘরটায় অনেক আছে, বোধহয় ছেলেরাই নিয়ে এসেছে। অর্ধেক দিয়ে আসব, অর্ধেক থাকবে। যে দুটো লুকিয়েছে, ওদের জন্যে। কি বলো?
যদি পালায়?
নৌকাটা নিয়ে যাব, পালাতে পারবে না।
তা হলে ঠিক আছে। চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পারি। এসে বারগুলো নিয়ে যাওয়া দরকার। কখন আবার কী বিপত্তি ঘটে যায়, কে জানে!
ওটা কী? .কোনটা? ও, ওটা…কুয়া। ধড়াস করে এক লাফ মারল। রবিনের হৃৎপিণ্ড, কিন্তু পরের কথাটায়ই আবার স্বস্তি ফিরল। কেন, ওই কুয়ায় লুকিয়ে আছে ভেবেছ নাকি? অসম্ভব! যা গম্ভীর হয় এসব কুয়া:..চলো, চলো, যাই।
চলে গেল লোক দুটো। আরও খানিকক্ষণ ওদের কথাবার্তা শোনা গেল দূর থেকে, বোধহয় খাবার নিচ্ছে, কিশোর আর জিনাকে দিয়ে। আসার জন্যে। তারপর একেবারে নীরব হয়ে গেল।
এরপরও অনেকক্ষণ বেরোনোর সাহস পেল না দুই গোয়েন্দা। মই ধরে ঝুলে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা হয়ে গেল মুসার, শেষে আর না পেরে বলল, এবার বোধহয় গেছে! চলো, উঠি। আমি আর ধরে থাকতে পারছি না!
চলো।
কুয়ার মুখে মাথা বের করে উঁকি দিল মুসা, চারপাশে দেখল। নির্জন। উঠে এল সে। তার পিছনে রবিন। মোটরবোটের ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। দুর্গের এক ধারে চলে এল দুজনে, দেখল বোটটা চলে। যাচ্ছে। তাতে দুজন লোক। কিন্তু নৌকাটা নিল না কেন ওরা? বলল তো নিয়ে যাবে! আগের জায়গায়ই বাধা রয়েছে ফগের নৌকা! নিতে পারল না, নাকি কোন কারণে মত বদলাল ব্যাটারা!
গেছে! রবিন বলল। এবার?
গেছে, কিন্তু আবার আসবে, কিশোরের অনুকরণে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল মুসা-বোধহয় ধারণা হয়েছে, এভাবে চিমটি কাটলে ব্রেনটা ঠিকমত কাজ করে। নৌকাটা নিয়ে যায়নি যখন, পালাতে পারব আমরা। চলো, জিনা আর কিশোরকে মুক্ত করি।
ছুটে এল ওরা সিঁড়িমুখের কাছে। থমকে দাঁড়াল। পাথর ফেলে মুখ রুদ্ধ করে দিয়ে গেছে ব্যাটারা! প্রথমে মস্ত এক পাথরের চাই ফেলেছে, তার ওপর রেখেছে বড় বড় পাথর-নিচ থেকে ঠেলে খুলে যাতে কোনমতেই বেরোতে না পারে কিশোর আর জিনা।
এগুলো সরানো অসম্ভব! হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল মুসা। আমিও পারব না! অন্য কোন পথে ঢুকতে হবে। কিন্তু কোথায় পথ?
দাঁড়াও দাঁড়াও, হাত তুলল রবিন। টাওয়ারের কাছে আরেকটা মুখ আছে, নকশায় দেখেছি! চলো, দেখি, খুঁজে বের করা যায় কিনা!
ডান পাশের টাওয়ারের কাছে চলে এল দুজনে। টাওয়ার বলতে এখন আর কিছু নেই, খালি পাথর ভাঙা স্তূপ। একটু চেষ্টা করেই অসম্ভব। চেষ্টা বাদ দিল ওরা, এর মাঝে সিঁড়িমুখ খুঁজে পাওয়ার কোন আশা নেই, সময়ও নেই হাতে।
হায় হায়! কী করি এখন! মাথায় হাত দিল মুসা। কী করে বের করি ওদের! রবিন, তোমার মাথায় কিছু আসছে না?
কিচ্ছু না!
একটা পাথরের ওপর ধপ করে বসে গালে হাত রাখল রবিন। ভীষণ উদ্বিগ্ন। লাল, মুখ আরও লাল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ উজ্জ্বল হলো তার চেহারা। মুসা, পেয়েছি! হাতে তুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। এক কাজ করতে পারি না? কুয়া দিয়ে নেমে যেতে পারি না? কুয়াটা সিঁড়িঘরের কাছাকাছিই আরেকটা ঘরের ভেতর দিয়ে গেছে। ফোকরও রয়েছে কুয়ার দেয়ালে। ওখান দিয়ে ঘরে বেরোতে পারি আমরা! পারি না? শুধু পাথরটাই একটা বাধা, ওটা কোনভাবে পেরিয়ে যেতে পারলেই হলো!
ভেবে দেখল মুসা। তক্ষুণি কোন মন্তব্য না করে রবিনকে নিয়ে চলে। এল কুয়ার পাড়ে। ভেতরে উঁকি দিয়ে ভাবল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, ঠিক বলেছ। পাথরের ফাঁক দিয়ে গলে নেমে যেতে পারব চেষ্টা করলে।
তা হলে আর দেরি কী? চেষ্টা শুরু করে দিই!
এখন মইটা ততদূর পর্যন্ত থাকলে হয়, তার আগেই যদি শেষ হয়ে যায় তো আর হলো না! রবিনের দিকে তাকাল মুসা। আমি চেষ্টা করে দেখি। তুমি থাকো এখানে। দুজনের ভার অনেক বেশি। মই ছিঁড়ে খসে পড়ে মরার ইচ্ছে নেই। রবিনকে বাধা দেয়ার সময় না দিয়ে মই ধরে, নামতে শুরু করল সে।
সাবধান, মুসা, খুব সাবধান! চেঁচিয়ে হুশিয়ার করল রবিন ওপর থেকে। আরে, শোনো, শোনো, দড়ি নিয়ে যাও! কাজে লাগতে পারে।
ঠিক, ঠিক বলেছ! থেমে গেল মুসা, উঠতে শুরু করল আবার। দৌড় দাও। নিয়ে এসো।
দড়ি নিয়ে এল রবিন।
আমার জন্যে ভেব না, হাসল মুসা। এসব ঝোলাঝুলি আমার অভ্যেস আছে, খুব ভাল করেই জানো। আর যেভাবেই হোক, হাত পিছলে পড়ে মরব না।
সাদা হয়ে গেছে রবিনের মুখ। উত্তেজনা আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। দাঁড়াতে পারছে না, শেষে বসেই পড়ল একটা পাথরের ওপর।
রবিন, শুনতে পাচ্ছ? কুয়ার ভেতর থেকে ডাক শোনা গেল মুসার। আমি ঠিক আছি।
হ্যাঁ, মুসা, জবাব দিল রবিন। সাবধানে থেকো, ভাই, খুব। সাবধান! তাড়াহুড়ো কোরো না! মই কি আরও নিচে আছে?
তাই তো মনে হয়, অনেক নিচ থেকে এল মুসার জবাব। না না, আর নেই, শেষ! ভেঙে খসে গেছে, না এখানেই শেষ, বোঝা যাচ্ছে না। চিন্তা নেই, আমি দড়ি বাঁধছি।
নীরবতা, দড়ি বাধছে বোধহয় মুসা।
হ্যাঁ, তাই করছে গোয়েন্দা-সহকারী। দড়ির এক মাথা শক্ত করে পেঁচিয়ে বাধল মইয়ের একটা ডাণ্ডার সঙ্গে। তারপর ঝুলে পড়ল দড়ি ধরে। চেঁচিয়ে বলল, রবিন, দড়ি বেয়ে নামছি! ঠিকই আছি, ভেব না।
রবিন কিছু একটা বলল, কিন্তু বোঝা গেল না এত নিচ থেকে। নেমে চলল মুসা। নিয়মিত ব্যায়াম করে সে, কাজেই কাজটা সহজই তার জন্যে। অন্তত এখন পর্যন্ত, পরে কী হবে জানা নেই। যা হয় হোক গে, পরের ভাবনা পরে, আগে ফোকরটা খুঁজে বের করা দরকার।
অন্ধকারে কতক্ষণ নামল মুসা, বলতে পারবে না। একটা সময় মনে হলো, আর নামার দরকার নেই, ফোকরের কাছে পৌচেছে। এক হাতে দড়ি ধরে ঝুলে থেকে আরেক হাতে টর্চ নিয়ে জ্বালল। আলো ফেলে দেখল কুয়ার দেয়ালে। তার অনুমান ঠিকই। ঠিক মাথার ওপরে রয়েছে। ফোকর, ছাড়িয়ে নেমে এসেছে। টর্চটা জ্বলন্ত অবস্থায়ই দাতে কামড়ে ধরে আবার উঠতে শুরু করল সে। ফোকরের কাছে পৌঁছে ধারে পা বাধিয়ে দিল। দোল দিয়ে শরীরটাকে নিয়ে এল কুয়ার দেয়ালের কাছে। দক্ষ দড়াবাজিকরের মত শরীর বাঁকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকিয়ে ফেলল ফোকরের ভেতরে। আর বেশি কষ্ট করতে হলো না, নেমে পড়ল ঘরের মেঝেতে। দড়ির মাথাটা মেঝেতে ফেলে তার ওপর একটা পাথর চাপা দিয়ে দিল, যাতে দড়িটা কোনভাবে ফোকর গলে বেরিয়ে ঝুলে না পড়ে কুয়ার ভিতরে।
একটা সুড়ঙ্গ-মুখের পাশের দেয়ালে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে ভিতরে আলো ফেলল মুসা। হ্যাঁ, আছে, সুড়ঙ্গের দেয়ালেও রয়েছে চিহ্ন। ঢুকে পড়ল সে। সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল। চেঁচিয়ে ডাকল জিনা আর কিশোরের নাম ধরে।
জবাব নেই।
খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা সুড়ঙ্গ-মুখের পাশের দেয়ালে চক দিয়ে আঁকা চিহ্ন চোখে পড়ল! ঢুকে পড়ল মুসা, পেরিয়ে এল এই সুড়ঙ্গটাও। আরেকটা ঘরে ঢুকল। ওপাশের দেয়ালে বিশাল এক দরজা, দেখামাত্র চিনল সে। এটাই কুপিয়েছিল কিশোর, এই দরজার কাঠের চিলতে লেগেই গাল কেটেছে মুসার। দরজা বন্ধ, নিচে আর ওপরে বড় বড় ছিটকিনি, তুলে দেয়া হয়েছে।
দরজার কাছে এসে কিশোরের নাম ধরে ডাকল মুসা।
পরক্ষণেই শোনা গেল জবাব, রাফিয়ানের চাপা উত্তেজিত চিৎকার। তার পর-পরই কিশোরের কথা শোনা গেল। দরজার ওপাশেই রয়েছে ওরা।
ষোলো
ছিটকিনি খুলে দিল মুসা। পাল্লা খুলতেই এক লাফে বেরিয়ে এল রাফিয়ান, তার কাঁধে দুপা তুলে দিয়ে গাল চেটে দিল।
উহ! আরিহ্! আরে, ব্যথা পাচ্ছি! …আমার গাল কাটা! আর্তনাদ করে উঠল মুসা।
বেরিয়ে এল কিশোর আর জিনা।
হাসল মুসা, টর্চের আলোয় ঝিক করে উঠল তার ঝকঝকে সাদা দাঁত। তারপর, জিনা বেগম, মুক্তি পেয়ে কেমন লাগছে?
দারুণ! জবাবটা দিল কিশোর।
পাগল হয়ে উঠেছে রাফিয়ান, মুসাকে ঘিরে নাচছে, আর ঘেউ ঘেউ করছে! প্রতিধ্বনি কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।
আরে, এই, রাফি, থাম তো, বাপু! ধমক দিল জিনা। তুই একাই বেরিয়েছিস, নাকি আমরাও? থাম, থাম!
ঢুকলে কী করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অল্পকথায় সব বলল মুসা।
কুয়ার ভেতর দিয়ে…দড়ি বেয়ে নেমেছ! বিশ্বাস করতে পারছে ্না জিনা। তুমি মুসা আমান…ঘোড়াকে ভয় পাও…অথচ…
বিপদে পড়লে ভয়ডর ওর কোথায় চলে যায়! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তখন ওর মত দুঃসাহসী হয়ে উঠতে খুব কম লোককেই দেখেছি! মুসার দিকে ফিরল। আসল কথা বলো। ব্যাটারা কোথায়?
জানাল মুসা।
পালানো দরকার! ব্যস্ত হয়ে উঠল কিশোর। রিভলভার আছে। ব্যাটাদের কাছে। আবার এসে পড়ার আগেই ভাগব। কোন পথে বেরোব?
এসো, ডাকল মুসা। আগে আগে রওনা হলো।
কুয়াঘরে চলে এল ওরা। দড়ি দেখিয়ে বলল মুসা, ওটা ধরেই। বেরোতে হবে আবার।
আমি পারব না, বাবা! দুহাত তুলল জিনা। তাছাড়া রাফিয়ান…
পারতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। এছাড়া আর কোন পথ নেই। যাও, দেরি কোরো না। রাফিয়ান আপাতত এখানেই থাক, পরে সুযোগ করে এসে নিয়ে যাব।
আরেকবার দ্বিধা করল জিনা, তারপর এগিয়ে গিয়ে দড়ি ধরে মাথা ঢুকিয়ে দিল ফোকরে। তাকে বেরোতে সাহায্য করল কিশোর আর মুসা।
একসঙ্গে তিনজনে দড়ি ধরে ঝুললে ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় আছে, তাই একজন একজন করেই চলল। জিনা মই ধরে সেকথা চেঁচিয়ে জানাতেই মুসাকে ঠেলে দিল কিশোর।
রাফিয়ানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে সব শেষে বেরোল সে। নিরাপদেই বেরিয়ে এল বাইরে, খোলা আকাশের নিচে।
আনন্দে ধেই ধেই করে নাচছে রবিন, চোখে পানি। মুসা আর কিশোরকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে ফেলল। কোন কিছু না ভেবেই
এগিয়ে গেল জিনার দিকে, লাফ দিয়ে সরে গেল জিনা। হা হা করে হেসে। উঠল মুসা। থামলে কেন, রবিন?
লাল হয়ে গেল রবিনের গাল, জিনাও লাল, দুজনেই লজ্জা পেয়েছে।
চলো, জলদি যাই, হাসিমুখে তাড়া দিল কিশোর। ব্যাটারা এসে পড়তে পারে, যে-কোন সময়ে!
প্রায় ছুটে পাহাড় ডিঙাল ওরা, ছোট্ট বন্দরে নামল। নৌকার কাছে। এসেই থমকে গেল; বুঝল, কেন নৌকা ফেলে গেছে শত্রুরা। দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা পোহায়নি, তার চেয়ে আরও অনেক সহজ কাজটা করেছে, দাঁড় দুটো নিয়ে গেছে।
এবারে কী করি! চিন্তিত হয়ে পড়ল কিশোর।
মুক্তির আনন্দ, উবে গেল, মুখ কালো হয়ে গেল সবারই।
জাহাজ আনতে গেছে, জিনা বলল। খুব তাড়াতাড়ি করবে ওরা। দাঁড় ছাড়া প্রণালী থেকেই বেরোতে পারব না, জেলেদের যে ডাকব সে উপায়ও নেই। এখান ক হাজার চেঁচামেচি করলেও ওদের কানে যাবে না, অনেক দূরে রয়েছে। তার মানে, লোকগুলোকে ঠেকাতে পারছি না আমরা!
চুপ! হাত তুলল কিশোর। ধীরে ধীরে বসে পড়ল একটা পাথরে। একটা আইডিয়া আসছে আমার মাথায়, চুপচাপ ভাবতে দাও! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেল তার।
নীরব হয়ে গেল সবাই। উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে, কী আইডিয়া আসছে তার মাথায়?
মনে হয় কাজ হবে, হঠাৎ ঘোর ভাঙল যেন কিশোরের। শোনো, ওদের ফেরার অপেক্ষায় থাকব আমরা। এসে কী করবে ওরা? সিঁড়িমুখের পাথর সরিয়ে নিচে নামবে। দরজাওয়ালা ঘরটায় যাবে; ভাববে, আমরা ওখানেই রয়েছি, সেজন্যেই যাবে। এখন কথা হলো, তার আগেই যদি কেউ একজন লুকিয়ে থাকি আশপাশে, যেই ঢুকল ব্যাটারা অমনি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিই? তারপর ওদের মোটরবোট নিয়ে চলে যেতে পারব খুব সহজে। কী মনে হয়?
আইডিয়াটা চমৎকার মনে হলো মুসার কাছে, কিন্তু জিনা আর রবিনের দ্বিধা রয়েছে।
আমাদের কাউকে আবার নিচে নামতে হবে, জিনা বলল। দরজাটা বন্ধ করে তার কাছেপিঠে লুকিয়ে থাকা গেলই না হয়। কিন্তু দুজন লোক যে একই সঙ্গে ভেতরে ঢুকবে, তার নিশ্চয়তা কী? আর যদি ঢোকেও, আমাদেরকে না দেখলে হুশিয়ার হয়ে যাবে ওরা। তখন ওদেরকে ভেতরে রেখে দরজা আটকানো খুব কঠিন হবে, চিতার ক্ষিপ্রতা দরকার। পারা যাবে কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে! যদি না পারি, তখন কী ঘটবে? আরও বিপদে পড়ব না? ওরা তখন উঠে এসে সব্বাইকে খুঁজে বের করবে।
তা ঠিক, চিবুক চুলকাল কিশোর। ধরা যাক, মুসা নিচে গেল, দরজা সময়মত আটকাতে পারল না, লোকগুলো উঠে এল আমাদেরকে খুঁজতে…আরেক কাজ করলেই তো পারি। লোকগুলো পাথর সরিয়ে নেমে গেলেই ওপর থেকে সিভিমুখ আটকে দেব আমরা পাথর দিয়ে। মুসা তাদের আটকাতে না পারলেও আমরা পারব।
তা হলে মুসারই বা যাওয়ার দরকার কী? রবিন প্রশ্ন করল।
তা হলে দরজাটা আবার আটকে আসবে কে? দরজা খোলা দেখলেই ছুটে ওপরে চলে আসবে ওরা, আমরা পাথর রাখারও সময় পাব না। তা ছাড়া, এখনই শিওর হয়ে যাচ্ছি কেন, মুসা ওদেরকে ঘরে বন্দি করতে পারবে না? আর সিঁড়িমুখ আটকানোর কথা বললাম, সেটা তত নিরাপদ নয়। নিচ থেকে ঠেলে দুজন শক্তিশালী শোক পাথর সরিয়ে ফেলতেও পারে। তারচেয়ে ঝুঁকিটা নেয়াই ভাল নয়?
হয়তো! জিনা বলল। কিন্তু মুসা বেরোবে কী করে?
হাসল কিশোর। যে পথে ঢুকে বের করে এনেছে আমাদের। আমিই যেতাম, কিন্তু কাজটা আমার চেয়ে মুসা অনেক ভাল পারবে। যার কাজ তাকেই সাজে, সে-ই যাক। কি, মুসা, আপত্তি আছে?
আপত্তি? হাসল মুসা। কুয়াটা এখন ডালভাত হয়ে গেছে আমার কাছে। তিনবার নেমেছি আর উঠেছি। আরেকবারে কিছু হবে বলে মনে হয় না। একটু থেমে বলল, আমিই নামব তুমি ওপরে থাকো। আমি আটকা পড়লে অন্যদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তোমাকে দরকার। তা ছাড়া ওপরে আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে; সেসব তুমিই সামাল দিতে পারবে, আমি পারব না। বেকায়দায় পড়লে ভেউ ভেউ করে কান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারব না আমি…
বাহ, বাহ, আমাদের মুসা আমান আজকাল বিনয়ের অবতার হয়ে গেছেন! হেসে টিপ্পনী কাটল রবিন।
সবাই হাসল।
আর খানিক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো, মুসাই নামবে।
ঘর থেকে খাবার এনে পাহাড়ের মাথায় বসে খেল ওরা। চোখ সাগরের দিকে।
ঘণ্টা দুয়েক পর একটা বড় মাছধরা জাহাজ দেখা গেল, দ্বীপের দিকেই আসছে। প্রণালীর মুখের কাছ থেকে দূরে থেমে গেল।
আসছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। মুসা, জলদি, গিয়ে ঢোকো!
ছুটে চলে গেল মুসা।
অন্যদের দিকে ফিরল কিশোর। জোয়ার আসতে দেরি আছে। নিচে, ওই যে ওই পাথরগুলোর আড়ালে লুকানো যাবে এখন।
লুকিয়ে পড়ল সবাই। কানে আসছে বোটের ইঞ্জিনের ভারি ঝকঝক ঝকঝক! বন্দরে নোঙর করল বোট, লোকের কথা শোনা গেল, দুজন নয়, বেশি। পাহাড় বেয়ে ওদের উঠে যাওয়ার শব্দও কানে এল।
আস্তে করে মাথা উঁচু করে উঁকি দিল কিশোর। লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় চত্বরে উঠে গেছে। চাপা গলায় সঙ্গীদেরকে ডাকল, এই, বেরিয়ে এসো!
পাহাড়ের ওপরে কতগুলো পাথরের স্কুপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ওরা। এখান থেকে চত্বরের অনেকখানি চোখে পড়ে, সিঁড়িমুখটাও।
কাউকে দেখা গেল না। সিঁড়িমুখের পাথর ইতস্তত ছড়ানো।
ঢুকে পড়েছে! এসো! পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল কিশোর। পেছনে অন্যরা।
প্রায় নিঃশব্দে সিঁড়িমুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। মস্ত একটা চ্যাপ্টা পাথর পড়ে আছে, ওটা দিয়েই মুখ ঢাকা হয়েছিল। সরানো হয়েছে। ওটাকে আবার সিঁড়িমুখে ফেলতে হবে।
ঠেলতে শুরু করল ওরা। বেজায় ভারি পাথর। তিনটে ছেলেমেয়ের জন্যে বেশিই। গলদঘর্ম হয়ে উঠল, জিভ বেরিয়ে পড়ল, হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে পাথর সরাতে গিয়ে। কিন্তু নড়তে চাইছে না জগদ্দল পাথর, গ্যাট হয়ে বসে আছে।
বোঝা গেল, ওটা সরানোর সাধ্য ওদের নেই। শেষে আরেকটু ছোট তিনটে পাথর দিয়ে কোনমতে মুখটা বন্ধ করে এসে কুয়ার পারে বসে হাঁপাতে লাগল। কী জানি করছে মুসা নিচে, আল্লাহ মালুম! কিশোর বিড়বিড় করল।
অনেক কিছুই করেছে মুসা, এখন লুকিয়ে বসে আছে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গে। আরেকটা সুড়ঙ্গে কথা বলার আওয়াজ শুনল সে, কান পেতে রইল। একটু পরেই সুড়ঙ্গের মুখে আলো দেখা গেল। কথা বলতে। বলতে বেরিয়ে এল তিনজন লোক।
তিনজন! সর্বনাশ হয়েছে! পরিকল্পনা আর কাজে লাগানো যাচ্ছে না!–শঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা।
ওই যে, ওই দরজাটাই, হাত তুলে দেখিয়ে বলল ভারি কণ্ঠ। ওতেই রয়েছে সোনার বারগুলো। ছেলেমেয়ে দুটো, আর কুত্তাটাও।
হ্যাঁ, তাই ভাবতে থাকো, ইবলিসের বাচ্চারা! মনে মনে হাসল মুসা। আছে তোমাদের জন্যে বসে, বসে বসে আঙুল চুষছে, দেখো
ছিটকিনি খুলল লোকটা। পাল্লা ঠেলে খুলে ঢুকে পড়ল। তার পিছনে ঢুকল আরেকজন। তৃতীয় লোকটা বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল ভিতর থেকে, জেরি, ওরা নেই!
লাফ দিয়ে উঠল বাইরে দাঁড়ানো লোকটা, ছুটে ঢুকে পড়ল।
বিদ্যুৎ খেলল মুসার শরীরে, চোখের পলকে ছুটে এসে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। ঠেলেঠুলে লাগিয়ে দিল নিচের ছিটকিনি।
কিন্তু দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচল হয়ে উঠল ভিতরের লোকগুলোও। সব শেষে ঢুকেছে যে লোকটা, জেরি, কাধ দিয়ে জোরে ধাক্কা মারল দরজায়। মুসা সবে তখন নিচের ছিটকিনিটা লাগিয়েছে। থরথর করে কেঁপে উঠল দরজা। সে ওপরের ছিটকিনিটা লাগানোর আর সময় পেল না, তার আগেই এক যোগে এসে তিনজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল পাল্লায়; সইতে পারল না পুরানো ছিটকিনি; আংটা ছিঁড়ে ছুটে খুলে গেল ওটা। খুলে গেল দরজা।
ছুট দিল মুসা। ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। পেছনে তাড়া করে এল লোকগুলো।
কুয়াঘরে চলে এল মুসা। সুড়ঙ্গের ভিতরে লোকগুলোর হৈ-চৈ শোনা যাচ্ছে। মুহূর্ত দ্বিধা না করে ফোকরে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল কুয়ায়। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে, ওই অবস্থায়ই দড়ি বেয়ে উঠে চলল। আশা করছে, ফোকরটা লোকগুলোর চোখে পড়লেও কিছু বুঝতে পারবে না। কারণ ওরা জানে না কুয়াটার অস্তিত্ব।
আটকে থাকা পাথরটার কাছে এসে হাত থেকে মই প্রায় ছুটেই যাচ্ছিল মুসার। ধড়াস করে বোয়াল মাছের মত এক লাফ মারল হৃৎপিণ্ড। ঘামে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে হাত। অবশ হয়ে আসছে শরীর, পরিশ্রমে, উত্তেজনায়।
অবশেষে নিরাপদেই বেরিয়ে এল মুসা। উদ্বিগ্ন বন্ধুদেরকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, হয়নি! পারলাম না!
যা বোঝার বুঝে নিল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি, দৌড় দাও। নৌকার দিকে! আর কোন উপায় নেই!
রাফিয়ান! জিনার গলা কাঁপছে। ও তো নিচে রয়ে গেছে!
ওর জন্যে ভাবনা নেই, মুসা অভয় দিল। ও নিরাপদেই থাকবে। লুকিয়ে রেখে এসেছি। এসো, যাই!
তোমরা যাও, আমি আসছি, বলেই পাথরের ঘরটা, যেতে মালপত্র রাখা আছে, সেদিকে দৌড় দিল কিশোর।
কোথায় গেল! জিনা অবাক।
নিশ্চয় কোন কাজ আছে! চলো, চলো! তাড়া দিল রবিন, দৌড় দিল নৌকার দিকে।
লাফিয়ে নৌকায় উঠল জিনা আর রবিন। মোটরবোটের পাটাতনে দাঁড় দুটো আবিষ্কার করল মুসা। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়েছি! দাঁড় পেয়েছি!
কিশোর এসে পড়েছে, হাতে কুড়াল।
ওটা দিয়ে কী হবে? জানতে চাইল জিনা।
জবাব দিল না কিশোর। লাফিয়ে উঠে পড়ল মোটরবোটে। ধাই করে কুড়াল বসিয়ে দিল তেলের ট্যাঙ্কে। একের পর এক কোপ মেরে চলল সে, যেন পাগল হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে একেবারে অকেজো করে দিল ইঞ্জিন, আর কয়েক কোপে বোটের তলা খসিয়ে দিয়ে লাফিয়ে নামল তীরে। ছুটে এসে লাফিয়ে উঠল নৌকায়। জলদি নৌকা ছাড়ো, জিনা!
প্রণালীর মাঝামাঝি চলে এসেছে নৌকা, এই সময় পাহাড়ের মাথায় লোক তিনজনকে দেখা গেল। ঢাল বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল। ওরা, বোটের কাছে এসে থমকে গেল। মুঠো পাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল জেরি, বিচ্ছুর গোষ্ঠী। দাঁড়াও, আগে ধরে নিই, তারপর দেখাব মজা!
জিনার তামাটে চোখে আলোর ঝিলিক। কী করে দেখাবে? আগে আমাদের কাছে আসতে হবে তো?
তীরে দাঁড়িয়ে নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসতে থাকল লোকগুলো, মুঠো পাকিয়ে দেখাচ্ছে আর গাল দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কী-ই এসে যায় গোয়েন্দাদের!
জিনা অবশ্য আনন্দে পুরোপুরি সামিল হতে পারছে না। রাফিয়ানের জন্যে ভাবছে।
মুসা বলল, আরে, বাবা, এত ভাবছ কেন? নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, এই মুসা আমানের ওপর আরেকটু ভরসা রাখো না। আমি বলছি, আমাদের রাফিয়ান নিরাপদেই আছে। ভরপেট খেয়ে নিশ্চয় এখন সে সুখস্বপ্ন দেখছে!
সতেরো
খোলা সাগরে বেরিয়ে এল নৌকা। এখান থেকে ছোট বন্দরটা দেখা যায় না, লোক তিনজনকেও চোখে পড়ছে না। মাছধরা জাহাজের রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে এক খালাসী। ছেলেদেরকে দেখে ডাকল, এইই, তোমরা দ্বীপ থেকে এসেছ?
জবাব দিয়ো না, নিচু গলায় বলল কিশোর।
সবাই চুপ করে রইল।
এই, ছেলেরা, আবার ডাকল লোকটা, তোমরা দ্বীপ থেকে এসেছ? গোবেল দ্বীপ?
এবারেও সবাই চুপ। তাকালও না মুখ তুলে।
এই, জবাব দিচ্ছ না কেন? ধমকে উঠল লোকটা।
তবুও কথা বলল না ছেলেরা, যেন কানেই যাচ্ছে না লোকটার কথা।
লোকটা শিওর হয়ে গেল, ছেলেগুলো দ্বীপ থেকেই এসেছে। ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল, নিশ্চয় সন্দেহ করেছে, সব কিছু ঠিকঠাকমত ঘটেনি দ্বীপে, কোন গণ্ডগোল হয়েছে। তাড়াতাড়ি ডেক থেকে নিচে নেমে গেল সে।
যদি আমাদেরকে ধরতে আসে? মুসার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
আসবে না, কিশোর বলল। নৌকা নামিয়ে প্রথমে দ্বীপে দেখতে যাবে কী হয়েছে। আমি হলে তাই করতাম। তারপর হয়তো আমাদের ধরার চেষ্টা করবে।
করলেও আর পেরেছে! মুখ বাঁকাল জিনা। ততক্ষণে আমরা পগার পার।
কিন্তু সোনাগুলো তো নিয়ে যেতে পারবে, রবিন বলল।
তা-ও পারবে না, মাথা নাড়ল কিশোর। নৌকা নিয়ে লোকটা দ্বীপে যাবে, বন্দরটা খুঁজে বের করবে, সঙ্গীদের কথা শুনবে, সোনাগুলো বের করে এনে নৌকায় তুলবে, অনেক সময়ের ব্যাপার। এত সময় নেই ওদের হাতে। জানে, যে-কোন মুহূর্তে পুলিশের বোট নিয়ে হাজির হয়ে যেতে পারি আমরা।
.
জিনার মা-বাবাকে পরিস্থিতি বোঝাতে বিশেষ সময় লাগল না। থানায় ফোন করলেন মিস্টার পারকার। পুলিশের পেট্রল বোটে করে ছেলেদের সঙ্গে তিনিও চললেন দ্বীপে।
প্রণালীর কাছে মাছধরা জাহাজটা নেই, দিগন্তের কোথাও দেখা গেল না ওটা। লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
বোট থেকে ডিঙি নামিয়ে প্রণালী দিয়ে ছোট বন্দরে চলে এল ওরা। তেমনিভাবে পড়ে রয়েছে মোটরবোটটা, অর্ধেকের বেশি পানির তলায়।
তবে, সোনার বার সব নেই, বেশ কিছু গায়েব। একেবারে খালি হাতে যায়নি ডাকাতেরা। যা পেরেছে নিয়ে গেছে। এখনও যা রয়েছে, অনেক, কয়েক কোটি টাকার তো হবেই।
কিন্তু এসবের প্রতি নজর নেই জিনার, মুসাকে নিয়ে আগে রাফিয়ানকে উদ্ধার করতে চলল সে।
একটা ছোট ঘরে এসে ঢুকল মুসা। এক ধারে দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে। বড় একটা পাথর, সেটাকে ঠেকা দিয়ে জায়গামত রাখার জন্যে আরও পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলোর ওপর দেয়ালে চক দিয়ে একটা কুকুরের মুখ আঁকা। সেদিকে দেখিয়ে হাসল মুসা। চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।
প্রথমে কিছু বুঝল না জিনা, তারপর হেসে ফেলল। নাহ, যতটা ভেবেছিলাম, তত বোকা তুমি নও, মুসা।
দুজনে মিলে পাথর সরিয়ে দেয়ালের খোড়ল থেকে রাফিয়ানকে বের করল। নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তই হলো রাফিয়ান। কিশোর আর জিনাকে যে খাবারগুলো দিয়ে গিয়েছিল তোক দুটো, ওগুলো সব খেয়ে পেট ভারি হয়ে গেছে তার, আরাম করে শুয়ে খুব একচোট ঘুমিয়ে নিয়েছে। চুপচাপ থাকতে অনুরোধ করেছিল তাকে মুসা, বোধহয় অনুরোধ রেখেছে, টু শব্দটি করেনি রাফিয়ান, নইলে ডাকাতদের হাতে পড়ত, প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে হয়তো মেরেই রেখে যেত ওরা।
.
সিঁড়িমুখের কাছে অপেক্ষা করছেন মিস্টার পারকার। নিচে ডাকাতদেরকে খোঁজাখুঁজি করছে পুলিশ; জানে, পাবে না, তবুও করছে, রুটিন চেক।
বাবা, জিনা বলল, কিশোরকে কথা দিয়েছিলে তুমি, আমি যা চাই। দেবে। দাওনি?
কাছেই দাঁড়ানো কিশোরের দিকে চট করে তাকিয়ে নিলেন একবার মিস্টার পারকার, রবিনের মুখের দিকেও তাকালেন, দ্বিধা করলেন,
অবশেষে মুখ খুললেন, হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। কী চাই, দ্বীপটা তো?
না, মাথা নাড়ল জিনা।
সোনার বারগুলো?
তা-ও না।
তা-ও না! তা হলে? ভুরু কুঁচকে গেছে ভদ্রলোকের।
আগে বলো, দেবে কিনা? আঙুল নাড়ল জিনা।
বলে যখন ফেলেছি, দেব। কী আর করা? অস্বস্তি বোধ করছেন।
সিঁড়িমুখে ঝুঁকে বসে ডাকল জিনা, রাফি, এই, রাফি! উঠে আয়।
রাফিয়ানের ভোতা মুখটা দেখে চমকে উঠলেন মিস্টার পারকার। কোনমতে হাসি চাপল তিন গোয়েন্দা।
যা, বাবাকে সালাম কর, রাফিয়ানকে আদেশ দিল জিনা।
আরে, না, না, দরকার নেই, লাগবে না! লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। মিস্টার পারকার।
কিন্তু রাফিয়ান কি আর সুযোগ ছাড়ে? তার একেবারে পায়ের কাছে এসে পড়ল, দুই পা তুলে দিল হাঁটুতে, জড়িয়ে তো আর ধরতে পারে না, হাত নেই যে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বোকা হয়ে গেছেন মিস্টার পারকার, ঝুঁকে কুকুরটার মাথায় হাত রেখে কোনমতে বললেন, বেঁচে থাকো, বাবা! গর্জে উঠলেন পরক্ষণেই, কিন্তু খবরদার! আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নষ্ট করলে চাবকে পাছার চামড়া তুলে ফেলব!
আর সামলাতে পারল না মুসা, হো হো করে হেসে উঠল। তাতে যোগ দিল কিশোর আর রবিন। জিনার মুখে হাসি, চোখে পানি।
হাসিটা সংক্রমিত হলো মিস্টার পারকারের মুখেও।
আরে, এ কী কাণ্ড! পেছন থেকে শোনা গেল, ভরাট কণ্ঠ, বেরিয়ে এসেছেন শেরিফ লিউবার্তো জিঙ্কোনাইশান, আধা রেড ইনডিয়ান আধা
স্প্যানিশ রক্ত শরীরে। আমাদের জনাথন পারকার ছেলেমেয়েদের সামনে হাসছে! স্বপ্ন দেখছি না তো! আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছে তোমাকে তোমার মেয়ে…
চোখ কটমট করে বন্ধুর দিকে তাকালেন মিস্টার পারকার। মুখ থমথমে, কালো মেঘের আড়ালে-ঢাকা পড়েছে যেন মিষ্টি রোদ, কই, হাসলাম আবার কখন?