সাক্ষাৎকার-৮
কিছুধ্বনি : আপনি কেন কবিতা লেখেন?
রুদ্র : কাব্যভাষার মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে পারি বিধায় কবিতা লিখি।
কিছুধ্বনি : একজন কবি কিভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?
রুদ্র : মানুষের মুক্তির আকাংখা উচ্চারন কোরে কবি তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
কিছুধ্বনি : ‘সকলেই প্রায় একই ভঙ্গিতে কবিতা লিখছেন’—এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
রুদ্র : ‘সকলেই প্রায় একই ভঙ্গিতে কবিতা লিখছেন’— এই বাক্যটিকে আমি একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই— প্রায় সকলেই একই ভঙ্গিতে কবিতা লিখে থাকেন। ব্যতিক্রম কন্ঠস্বর, নোতুন উচ্চারন, অভাবিত উজ্জ্বল প্রকাশ সব যুগে, সব সময়েই অতি অল্প। সংখ্যায় তারা একেবারেই সামান্য। কিছুধ্বনি : কাব্যভাষা এবং ম্যানারিজম বলতে আপনি কী বোঝেন?
রুদ্র : ‘কাব্যভাষা’ বলতে কবির নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, উপমা উৎপ্রেক্ষা নির্বাচন, চিত্রকল্প যোজনা ইত্যাদির সামগ্রিক ধারনাটাই বুঝি। ‘ম্যানারিজম’ বলতে আমি কিছুই বুঝি না।
কিছুধ্বনি : ‘কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস’— এই মন্তব্যের পক্ষে অথবা বিপক্ষে আপনার মতামত ব্যাখ্যা করুন।
রুদ্র : ‘কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস’ নয়। কবিতা নির্মানের ক্ষেত্রে ‘টেকনিক’ এই শব্দটি অত্যন্ত অশ্লীল মনে হলো। কাব্য-বিষয়ে এই শব্দটি আগে কখনো শুনি নি। জানি না ঠিক কী অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমার ধারনা কবিতার ইতিহাস কবিতারই ইতিহাস।
কিছুধ্বনি : কবিতার ভাষা, আঙ্গিক এবং ভাব— এই তিনটি ক্ষেত্রে আপনি নতুন কী নিরীক্ষার কথা ভাবছেন, ব্যাখ্যা করুন।
রুদ্র : কবিতার ভাষা, আঙ্গিক ও ভাব— এই তিনটি ক্ষেত্রে নিরীক্ষামূলক চেষ্টা আমার এ-যাবত প্রকাশিত ছয়টি এবং অপ্রকাশিত একটি কবিতাগ্রন্থে গ্রন্থিত হয়ে আছে। দু’এক কথায় বিষয়টি নিয়ে বলা মুশকিল। ঠিক এই মুহূর্তে আমার মাথায় কবিতা বিষয়ক কোনো নিরীক্ষার চিন্তা নেই। নোতুন কিছু এলে পরবর্তী কবিতা-কর্মে তার প্রকাশ দ্যাখা যাবে।
কিছুধ্বনি : আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজের পরিবর্তন আনতে সক্ষম? দেশি-বিদেশি অন্তত পাঁচজন কবির নাম করুন যাদের কবিতা সমাজ-পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছিলো।
রুদ্র : সমাজ-পরিবর্তন আসলে অত্যন্ত ক্রুড একটি ব্যাপার এবং প্রচন্ড বস্তুগত। কবিতার হাত দিয়ে সে কাজটি ঘটানো সম্ভব নয়। কবিতা সমাজ-পরিবর্তনের প্রেরনা হতে পারে। পারে বিপ্লবের আকাংখা বহন কোরে নিয়ে যেতে। আর পারে শৃংখল এবং অন্ধকারের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনা সৃষ্টি করতে। সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে এমন সব দেশের কবিতা সংকলন ঘাটলেই পাঁচজন নয়, আরো অসংখ্য কবির নাম জানা যেতে পারে যাঁদের কবিতা সমাজ-পরিবর্তনের প্রেরনা হয়েছে। এই মুহূর্তে এই কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
কিছুধ্বনি : অন্তত তিনজন জীবিত কবির নাম করুন যাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে না। ভালো না-লাগার পেছনে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন।
রুদ্র : ‘অন্তত তিনজন’ কেন? অনেককেই তো আমার ভালো লাগে না এবং ভিন্ন ভিন্ন কারনে। এখন কোন মানদন্ডে তিনজনের নাম বলবো? প্রশ্নটি ঘাটাঘাটি কোরে কোনো ক্রাইটেরিয়ারই হদিস পেলাম না।
কিছুধ্বনি : দুজন তরুণ কবির নাম করুন যাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে এবং ভালো লাগার পেছনে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন।
রুদ্র : একজন ফরহাদ মজহার। তাঁর কবিতা আমার ভালো লাগার কারন তাঁর তীক্ষ্ণ নাগরিক ভাষা, সমকালীন জীবনের সংকট উন্মোচন, সংগ্রামরত মানুষের পক্ষে মানবিক উচ্চারন, ভাবালুতা বর্জিত সূক্ষতা, সচেতন আলোকসম্পাত এবং অন্তর্লোকের জটিল উপস্থাপনা — এইসব। দ্বিতীয় জনের নাম করতে হলে নিজের নাম বলতে হয়। কাজেই একজনই থাকুক।
কিছুধ্বনি : আপনার নিজের কবিতা সম্পর্কে আপনার কী ধারনা?
রুদ্র : এক যুগ গেল গায়ে হলুদের দিন,
আর এক যুগ বাকি আয়োজনে যাবে।
কখন আমার শুভদৃষ্টির ক্ষন?
বাসর আমার হবে কতো যুগ পরে??
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আওয়ার আহমদ
কিছুধ্বনি, ঢাকা, অক্টোবর ১৯৯১ (রুদ্র-র মৃত্যুর পর প্রকাশিত)