সাক্ষাৎকার-৫

সাক্ষাৎকার-৫

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ

সময়ের সাহসী সৈনিক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। চুয়াত্তোরে পরিকল্পনা নিয়েই নামেন কাব্য জগতে। দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসেন সামনের দিকে। সঙ্গী পেতে অসুবিধে হয়নি। বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান করে নিতে মোটেই কষ্ট হয়নি তাঁর। উনাশিতে প্রথম কাব্য ‘উপদ্রুত উপকূল’-এর প্রকাশ। তারপর ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ ‘মানুষের মানচিত্র’ গল্প’ ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’। সেই যে তাঁর যাত্রা শুরু, এর মধ্যে পিছনের দিকে ফিরে তাকাননি তিনি। এবার বেরুলো—’মৌলিক মুখোশ’।

কবি রুদ্র নিজের চোখে নিজের কবিতা, কবিতার প্রেক্ষাপট, উপাদান, কবি ও কবিতার দায় এতদ্‌সম্পর্কীয় বিষয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, মানুষের উৎপত্তি তার দৈহিক ও সামাজিক তথা মানুষের আচরনের ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা ও গবেষনা যিনি করেন তিনি নৃবিজ্ঞানী বা নৃতাত্ত্বিক। তাঁর মতে একজন নৃতাত্ত্বিক বা দার্শনিকের কাব্য ভাষাই কবিতা। তার কবিতার ধারা মানবেতিহাসের ধারা। মানব সভ্যতার যাত্রা থেকে শুরু করে বিকাশের আজকের স্তর পর্যন্ত যে চলমানতা তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রুদ্র তাঁর কাব্য ধারা নির্মাণ করতে প্রয়াসী। তাঁর কথায়, “আমার বয়স যেন সভ্যতার সমান’। বৃহত্তম মানুষের জীবন যাপনই তার কবিতার অবলম্বন। রাজনীতি, হত্যা, আশাভঙ্গ নিয়ে কবিতা লেখেন। তিনি বলেন কথার ফুলঝুরিকে কখনো কবিতা মনে হয়নি, জীবনের প্রবমানতাকে আপন বুকের মাঝে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যায় যে গান সেই তো কবিতা। কবিতা জীবনের জন্য। তাইতো মানুষের স্বপ্নের ওপর, চিন্তার ওপর আঘাত এলেই কবিতার মাধ্যমে কবি জানায় তার প্রতিবাদ। এটা মানুষের পক্ষে তার বস্তুবাদী নির্দেশিকাচেতনাগত দিক থেকে যা উজ্জীবনের সেরা হাতিয়ার। কবি রুদ্র তাঁর ‘গল্প’ কাব্যের আলোকে বলেন, অস্ত্র মজুদ রেখে বিশ্বের দুই পরাশক্তির শক্তি আলোচনা হাস্যকর ব্যাপার। তিনি বলেন, রাজনীতি, সংস্কৃতি সব জায়গায়েই ফ্যাসিস্ট থাকতে পারে। আলোচনার টেবিলে বসে হাত চাপড়ানোও এক ধরনের ফ্যাসিজম। তিরাশি সালে ছাত্রদেরকে নাড়া দিয়েছিল, আজ দেয় না। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রুদ্র বলেন, গণতন্ত্রের চর্চা হয় না গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শোষণ মুক্তির পথে যারা নিরলস সংগ্রাম করছেন তাদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব গড়ে উঠতে হবে। তিনি বলেন মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। সর্ষের মধ্যে যে ভূত লুকায়িত তাকেই তাড়াতে হবে প্রথম।

গ্নস্তনস্ত’ সম্পর্কে তিনি বলেন মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বাড়ছে বলেই তাদের আরো খোলামেলা, আরও মুক্ত বায়ু সেবনের কথা বড় হয়ে উঠেছে। আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল শ্লোগান এগুলো আমাদের লেখার পেছনে অনুপ্রেরণা যোগায়। আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকায় আজ সাহিত্যের সৃষ্টি হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে কবিতার। ডি ক্লার্ক তেত্রিশটি বর্ণবাদী সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন, ম্যান্ডেলাকেও দিয়েছেন নিঃশর্ত মুক্তি। তা হলে সংগ্রাম ও আন্দোলনের স্বাভাবিক ভাটার কারণে কবিতারও ভাটা পড়বে কিনা এর উত্তরে তিনি বলেন, আমরা দুঃখ নিয়ে, ব্যথা নিয়ে, আশাভঙ্গ নিয়ে কবিতা লিখি। অবশ্যই তা হয়ে উঠতে পারে সময়ের সৃষ্টি। তবে ফুল কিম্বা প্রজাপতি নিয়ে, আমরা কি কবিতা লিখব না?

—পাল্টা প্রশ্ন রাখেন তিনি।

নিমাই সরকার
প্রত্যয়, ঢাকা, মার্চ-এপ্রিল ১৯৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *