সাক্ষাৎকার-৩
১. ‘ফুল আছে কিন্তু ফল নেই’— সত্তর দশকের এ নিন্দিত প্রবাদ সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি?
রুদ্র : ‘ফুল আছে কিন্তু ফল নেই’ বোলে ‘সত্তর দশকে’র যে ‘নিন্দিত প্রবাদে’র কথা আপনি উল্লেখ করেছেন, তার সাথে আমার কোনো পরিচয় নেই। এমনিতেই এই সাহিত্যের দশক-টশকে আমার কোনো শ্রদ্ধা বা আস্থা নেই। শিল্পের কাজ আমার কাছে ম্যারাথন দৌড়ের মতো মনে হয়। যা হোক, ‘ফুল আছে কিন্তু ফল নেই’ এই কথাটিকে আমি আরো একটু অন্যভাবে বলতে চাই এবং সত্তুর দশকের জায়গায় তিরিশোত্তর কথাটি বলতে চাই। ফুল কিংবা ফল— এর আগে আমাকে দেখতে হবে আদৌ কোনো গাছ আছে কিনা। আধুনিক কবিদের (শুধু কবি নয় সব ধরনের শিল্পী, রাজনীতিক, শিক্ষক অর্থাৎ পুরো উপরি কাঠামোই) অধিকাংশই তো পরগাছা— মৌলিক বৃক্ষই নয়। পশ্চিমি রুচি ও ধারনা-গাছে এই পরগাছা স্বর্নলতা বেড়ে উঠতে চেয়েছে। এবং এতোদিন ধ’রে বেড়েছেও।
২. সত্তর দশক সম্বন্ধে কিছু বলুন।
রুদ্র : সত্তুরের দশ বছর আমাদের জীবন-ইতিহাসে এক ভয়ংকর উত্থান পতনের সময়। এই অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের তাবৎ এলাকায় ঘটে গেছে দারুন এক ওলোট পালোট। স্বপ্ন, নৈরাশ্য, হত্যা, হিংসা, অপরিনত রাজনীতিক উত্থান, সামরিক শাসন, বিশ্বাসহীনতা এবং এই সমুদয় ভাঙচুরের পাশাপাশি একটি স্বপ্নবান সংগ্রামী জীবন চেতনা ধীরে ধীরে, তিল তিল কোরে বেড়ে উঠেছে।
বিভিন্ন বয়সের কিছু তরুন আমরা চাইছি মৌলিক বৃক্ষ জন্মাক। আমরা মাটিতে বীজ বুনছি। হোক সে ঘাস তবু কিছু মৌলিক বৃক্ষ জন্ম নিক। স্বর্নলতার চাষ বন্ধ হোক।
৩. কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা কার কাছ থেকে পেলেন?
রুদ্র : কবিতা লেখার প্রেরনা আমি বোধহয় আমার নিসর্গের কাছ থেকে পেয়েছি। (বোধহয় শব্দটি আমি সচেতনভাবে রাখছি। কারন নিজেকে এখনো খুব পস্ট কোরে চেনা হয়নি। নিশ্চিত কথা বলি কি কোরে?)
জোয়ার ভাটার স্রোতবান নদী, দূর দিগন্ত অব্দি মেলে যাওয়া ধানক্ষেত, চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুরে দূর থেকে আসা রাখালের বাঁশির সুর, বিশাল আকাশ, ফাল্গুনের পূর্ণিমার নিচে সুন্দরবন, খালের কিনারে বাঁধা জেলে নৌকো, নৌকোর গলুয়ে বড়শির সুতলি হাতে ধ্যানমগ্ন বোসে থাকা একাকি নির্জন জেলে, ভয়ানক শব্দহীনতার মধ্যে টুপ কোরে জলে ঝ’রে পড়া একটি কেওড়া ফলের শব্দ— এইসব, এইসব— আমার কৈশোরের গায়ে নুন আর কাদার গন্ধ, ছাতিম ফুলের গন্ধ, নাড়া আর তুষের গন্ধ।
৪. ‘মানুষের মানচিত্র’ কি আধুনিক গদ্য কবিতা?
রুদ্র : তিরিশের বিভ্রান্ত কবিরা যে সব কারনে একটি কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলতে চেয়েছেন, এবং এখনো আমাদের অনেক অগ্রজ সাহিত্যিক যে গুনাবলীর জন্যে একটি কবিতাকে আধুনিক কবিতা বোলে থাকেন, ‘মানুষের মানচিত্রে’ আমি প্রানপনে সেইসব লক্ষন ও গুনাবলীকে অবহেলা করতে চেষ্টা করেছি। বর্জন করতে চেষ্টা করেছি। একে শেষমেশ কী নামে ডাকা হবে তা স্থির করবে সাহিত্যের অধ্যাপকেরা—ওঁরা ওই একটি কাজই ভালো করতে জানেন।
৫. ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ সম্বন্ধে কিছু বলুন।
রুদ্র : ‘ফিরে যাই স্বর্নগ্রাম’কে আমি প্রায় পাঁচ বছর পিছনে ফেলে এসেছি। ওকে নিয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। সুযোগ পেলে বরং আমি আমার আগামীর স্বপ্নের কথা কিছু বলবো।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : বিপ্লব মাহমুদ
দেশ বাংলা, ১৯৮৬