সাক্ষাৎকার – মার্চ, ২০০৭ – দৈনিক সমকাল

২০০৭ সালের ৩ মার্চে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় নূহাশ হুমায়ুন, গুলতেকিন ও হূমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও অনুলিখন করেছিলেন আরিফুর রহমান।

মা গুলতেকিনের সঙ্গে নূহাশ হূমায়ূন

চশমা পরা হ্যাংলা ফরসা ছেলেটাই নূহাশ, নূহাশ হূমায়ূন। পড়ে সানবিম স্কুলে নবম শ্রেণীতে। ওর বয়স এখন ১৫ বছর। অবসরে ছবি আঁকে, অ্যানিমেশন করে, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, ছবি তোলে, গল্প লেখে, গান লেখে। এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে নূহাশের প্রথম বই ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’। ,বইটি সে ইংরেজিতে আনুবাদ করেছে যা বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ওর বাবা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন। নূহাশ এবং তার বন্ধুরা বেশকিছু ত্রিমাত্রিক ছবিও নির্মাণ করেছে। সে খেলাধুলা করতে খুব একটা পছন্দ করে না। তার পড়তেও ভাল লাগে না। তবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে ও খুব পছন্দ করে। নূহাশ ছবি আঁকছে দু’তিন বছর হলো। সে মূলত পেন্সিল স্কেচ করে। ওর ছবির বিষয় মানব শরীর।

আমার বইঃ ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটা লেখা হয়েছিল ১৯৮১ অথবা ’৮২ সালে। কিন্তু পড়ে মনে হয় অনেক আধুনিক। আমি যখন বইটা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলাম, তখন আমার প্রধান ভয়টা ছিল, বাংলাটা পড়ে যেমন চোখে পানি চলে আসে, ইংরেজিটা পড়েও কি চোখে পানি আসবে! তাই কয়েক পৃষ্ঠা লিখেই আমি বাবার কাছে লেখাগুলো নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় প্রতিদিন। বাবা দেখে তার মতামত জানাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে বাবা এক সময় বললেন, ‘এখন তো আমি আর তোমার প্রুফ রিডার না। আমি পড়ে তো আর ভুল ধরতে পারছি না। আমি গল্পের ভেতর পুরো ঢুকে গেছি।’ এটা শুনে আমার খুব ভাল লাগল। মনে হলো, আমি সফল হয়েছি ।

আমার আছেঃ আমার অনেক ধরণের সংগ্রহ আছে। আমার সংগ্রহে আছে অনেক বড় বড় রোদ চশমা, যা কেউ পরে না। আছে মজার কিছু মুখোশ । এর কিছু বাবা দিয়েছেন, কিছু আমি কিনেছি। একটি কঙ্কাল আছে, আমার খুব প্রিয়। আমরা বন্ধুরা মিউজিক নিয়ে এক সঙ্গে অনেক কাজ করি। আমাদের সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য আমরা কিছু গান লিখেছি। আমি সব ধরনের গানই শুনি। তবে প্রোগ্রেসিভ রক বেশি শুনি। মাঝে মাঝে পপ অথবা হেভি মেটালও শুনি। বাংলা গান তেমন শোনা হয় না। নতুন একটা সিনেমা করছি ‘কোকিল’। আর বাবার লেখা বই গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা একটা বই আমার এত ভাল লাগবে, আমি কখনো ভাবিনি। অন্যগুলোর মধ্যে ময়ুরাক্ষী আমার অনেক মজা লেগেছে। মিসির আলীর বইগুলো ভাল লাগে। কারণ এগুলো পড়লে বোঝা যায়, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লেখা। মন খারাপ থাকলে হিমু পড়তে ভাল লাগে।

প্রিয় বাবা-মাঃ বাবার সঙ্গে আমার পছন্দের মিলটা খুব বেশি। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় আমার। বাবার কথা বলার ঢঙ আমার খুব ভালো লাগে। খুব চমৎকার করে কথা বলতে পারেন তিনি। আর মায়ের সঙ্গে হচ্ছে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। মায়ের সঙ্গে আমি সবসময় থেকে এসেছি। একজনের সঙ্গে সারাজীবন থাকলে যে রকম একটা টান হয়ে যায় ওরকম। আর বাবার মধ্যে অনেক জিনিস আছে, যেটা ভাল লাগার মতো, যা স্বাভাবিকভাবেই ভাল লাগে। আমি যদি বাবাকে নাও চিনতাম তাহলেও আমি হয়ত তাকে এত ভালোবাসতাম। বাবার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, কথা বলার আগে তিনি চিন্তা করে কথা বলেন, চিন্তা না করে একটা শব্দও বলেন না। তার বইয়ের রুচি, তার সিনেমার রুচি সব আমার খুব ভালো লাগে। আমার সঙ্গে খুব মেলে। কখনো লিখলে বাবাকে নিয়েই লিখব। আমার বাবা খুবই চালাক। তিনি খুব জটিল ভাষায় নিজের মতো করে কথা বলতে পারেন; তার কথা শুনে মনে হবে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ! আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় এটা তার সবচেয়ে ভালো দিক। মাঝে মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে খারাপ দিক।

মা’র চোখেঃ ইকুয়েশন ফিহা বইটি আমি এখনো পড়িনি। আমার মনে হয়, নূহাশ এবং আমার সম্পর্কটা ওর সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কের তুলনায় অনেক বেশি কাছের। আমি কখনো কাউকে তুই বলি না কিন্তু নূহাশকে আমি তুই বলি। ও বিখ্যাত না হলে কিছু যায়-আসে না বরং বিখ্যাত না হলেই আমি খুশি হবো। কারণ বিখ্যাত হওয়ার পর আমাদের পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেছে। আমি চাই ও তার বড় চাচার মতো, ইকবাল ভাইয়ের (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) মতো হোক। আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নূহাশ এবং শিলা। নোভা, শিলা, বিপাশা যখন ছোট ছিল তখন তারা একটা সুখী পরিবার দেখেছে। ওই রকম পারিবারিক আনন্দস্মৃতি নূহাশের নেই। ওরা তিন বোন দেখেছে ওদের বাবা কি করেছে, যার জন্য ওরা বাবার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না। কিন্তু নূহাশ নিজ চোখে দেখেনি। ওর সবই আমাদের কাছ থেকে শোনা। তাই ওর ওপর প্রভাবটা পড়ে না। এ কারণে বাবার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা আছে।

বাবার চোখেঃ নূহাশ একদিন এসে একটা মেয়ের ছবি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এই মেয়েটিকে আমার খুবই পছন্দ হয়, এই যে তার ছবি। আমার জায়গায় আমার বাবা হলে তো একটা ধাক্কার মতো খেতেন। আমি ধাক্কা খেলাম না বরং আগ্রহ নিয়ে ছবিটি দেখলাম। দেখে বললাম, ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে দেখতে তো খারাপ না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নূহাশের খুব বই পড়ার নেশা। আমি বিদেশ থেকে প্রচুর বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং ইংরেজি সাহিত্যের ইংরেজিতে লেখা বই কিনি। বইগুলো এনেই প্রথমে ভাগাভাগি করি। অর্ধেক আমার কাছে থাকে আর অর্ধেক নূহাশের কাছে। আমি যেহেতু খুব ব্যস্ত থাকি তাই নূহাশেরগুলো আগেই পড়া শেষ হয়ে যায়। এরপর সে আমারগুলোও নিয়ে যায়। নূহাশের অনুবাদ করা ‘ইকুয়েশন অব ফিহা’ বইটি আমি পড়েছি। ও বেশ ভালই অনুবাদ করেছে। বইটির কিছু অংশ অনুবাদ করার পর প্রকাশক তার ইংরেজি অনুবাদ কেমন হচ্ছে জানতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক শফি আহমেদের কাছে মান যাচাইয়ের জন্য পাঠায়। তিনি তার ইংরেজি ভাষায় দখল দেখে বিস্মিত হন। আমি আশা করি নূহাশ ভবিষ্যতে অনুবাদ অব্যাহত রাখবে।

[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *