সাক্ষাৎকার – জুলাই, ২০০৮ (দৈনিক সমকাল)

১৮ জুলাই ২০০৮ সালে সুইডেনে হুমায়ুন আহমেদ  দৈনিক সমকালের সাংবাদিক সাব্বির রহমান খান কে একটা সাক্ষাৎকার দেন। 

সাব্বির খানঃ আপনাকে স্যার বলছি, ঠিক আছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ২২ বছর মাস্টারী করেছি, স্যার বলবে নাতো কি বলবে। ২ বছর আমেরিকায়, আর বাকী সময় বাংলাদেশে। সারা বাংলাদেশে সবাই-ই আমাকে  স্যার ডাকে। এখন বলো, আমার কোন ইন্টারভিউ তো না?

 

সাব্বির খানঃ আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। কিছু কথা জানার আগ্রহ নিয়েই আমার আসা।

হুমায়ুন আহমেদঃ আমিতো ইন্টারভিউ দেশেও দেইনা, তাই বাইরে এসে যদি ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করি, তাহলে দেশের সাংবাদিকদের জন্য সেটা হবে অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা খুব ভালো ভাবে জানে যে, আমি ইন্টারভিউ দেইনা। এই হলো প্রব্লেম।

 

সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনার ছবির শুটিং সম্বন্ধে একটু জানতে এসেছি। সুইডেনকে শুটিংয়ের জন্য কেন বেছে নিলেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি সুইডেনে যে ব্যাপারে এসেছি, তার মেইন ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলি। আমরা বাংলাদেশে ছবি বানাই ৩৫ মিমি ক্যামেরায়। ওই ছবিগুলোতে প্রয়োজন হয় ফিল্মের। ফিল্মে ছবিগুলো এক্সপোজড হয়। যেহেতু পৃথিবী বহুদুর এগিয়ে গিয়েছে, এখন শুরু হয়েছে ফটোগ্রাফি ডিজিট্যালি নেয়া। যদি ডিজিটেলি ফটোগ্রাফি করা হয়, তাহলে অনেক কিছু করা যায়। ফিল্মে ফটোগ্রাফিতে বেশি কিছু করা যায়না। ডিজিটেল ফটোগ্রাফিতে একটাই সমস্যা হয়, তাহলো Depth of field এর সমস্যা। ধরুন আমরা যদি ৩৫ মি.মি.-এ দুজনকে ধরি, তাহলে দুজনের পিছনে যা থাকবে, তা থাকবে খুবই ক্লিয়ার এবং এটা খুবই ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ডিজিটেলি এটা করতে পারে না। তবে নতুন একটা টেকনোলজি এসেছে। সেটা হচ্ছে কি, একটা হাই ডেফিনিশন ভিডিও ক্যামেরা ব্যাবহার করে, তার সাথে একটা এডাপ্টার লাগায়। তার পরে যে সমস্ত লেন্সগুলো আছে, সেগুলো বসায়। এই প্রক্রিয়ায় যে রেজাল্ট হয়, তা ৩৫ মিমি ক্যামেরার খুব কাছাকাছি। হলিউডে যে সব ছবি করা হয়, তারা তাতে এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে, যা দুএকটা উদাহার আমি দেখেছি। তাতে কোন রকম পার্থক্য আমি পেলাম না ৩৫ মি.মি. ক্যামেরার ফিল্মের সাথে। কিন্তু বোম্বেতে কিছু ছবি তারা করেছে, তাতে বোঝা যায় যে, ওগুলো ভিডিওতে করা। হলিউডের ছবিগুলোতে তা বোঝা যায়না। যেহেতু নতুন জিনিসের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ আছে বলে আমরা ঠিক করলাম যে আমরা চেষ্টা করবো এই টেকনোলজি ব্যাবহার করে। প্রথম কারন হচ্ছে নূতন একটা টেকনোলজির কাছে যাওয়া, আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, এটা এতো এক্সপেন্সিভ না। আর তৃতীয় কারন হচ্ছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা যে চেঞ্জগুলো করতে পারবো, ৩৫ মি.মি. তা সম্ভব না। এই তিনটি কারনে উৎসাহীত হলাম। তারপরে মাসুদ আখন্দ (সহকারী পরিচালক) এই এডাপ্টারটা যোগার করেছে এবং লেন্সগুলো তাতে সেট করা যাচ্ছে, তাই ঠিক করলাম যে ছবির প্রথম পর্বটা সুইডেনে করবো এবং দ্বিতীয় পর্বটা বাংলাদেশে করবো। যেহেতু এই টেকনিকে আমি অভ্যস্ত না, তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম।

 

সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি শুটিং করতে গিয়ে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ নানাবিধ সমস্যা আছে এখানে। প্রথমতঃ লোকবলের সমস্যা, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, এখানে প্রতিটা জিনিসই খুব এক্সপেন্সিভ। যেমন আমি যে একটা ক্রেন ভাড়া করবো, যেটা উপর থেকে নীচে যাবে বা নীচ থেকে উপরে যাবে, সেটা ভাড়া করতে পারছিনা। তাতে আমাদের বাজেটে কুলোবে না। কিন্তু দেখা যাক কি হয়। কাজতো শুরু করলাম। আগামি শীতে আবার যখন আসবো, তখন এখনকার শুটিংয়ে যে ত্রুটিগুলো ধরা পড়বে, সেগুলোর আবার নতুন করে শট নেবো। যেহেতু আমাদের ছবিতে গ্রীস্মের এবং শীতের দুটি পর্ব আছে, সেহেতু আমাদের এখানে দুবারই আসতে হবে। গ্রীস্মেরটা এখন হয়ে গেলো, শীতেরটা পরে হবে। আমার পরিকল্পনা ছিল স্কটল্যান্ডে এই ছবিটা করতে। কিন্তু এখানে যেহেতু মাসুদ আছে, সে ফিল্ম লাইনে পড়াশুনা করেছে। তার মেধা এবং অভিজ্ঞতাকে ব্যাবহার করা যাবে এবং তার কম্পিউটারের জ্ঞ্যান ভালো, সেটাকে পুরোপুরিভাবে ব্যাবহার করা যাবে। সর্বোপরি, এখানকার ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে কাজ করবে। এই সব বিষয় বিবেচনা করে ভাবলাম যে, এই জায়গাটা ঠিক আছে। এইভাবেই আমরা ছবিটা তৈরিতে অগ্রসর হয়েছি। পূর্বে দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করেছি। এবার ইউরোপে একজন ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করছি। দেশের অংশটা দেশীয় ক্যামেরাম্যান নিয়ে করবো।

 

সাব্বির খানঃ দেশীয় এবং ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানের মধ্যে পার্থক্য কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই দুই ক্যামেরাম্যানের মধ্যে প্রথমতঃ শিক্ষাগত পার্থক্য। ইউরোপীয়ানরা ক্যামেরা বিষয়ক সমস্ত থিওরী জানে। আর আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা হচ্ছে গুরুর কাছ থেকে শেখা, অর্থাৎ গুরুমুখী বিদ্যায় শিক্ষিত। তারা গুরুর কাছ থেকে আস্তে আস্তে সবকিছু শিখে নেয়। আমাদের ক্যামেরাম্যানদেরকে ছোট করার কোনই কারন নাই। এদের অভিজ্ঞতা খুব বেশি। এরা ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছে। আমি নিজে দেখেছি, এরা ক্যামেরার আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারে যে, ক্যামেরাটা রান করছে, না স্লো হয়ে যাচ্ছে। এটা শুধুই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারনে সম্ভব।

 

সাব্বির খানঃ কেন দেশী এবং বিদেশী দুই ধরনেরই ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ করবেন? তাতে অসুবিধা হবেনা?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের দেশটা হচ্ছে খুব স্লো, এশিয়ার সব দেশই বলা যায় স্লো এবং এই স্লো ব্যাপারটা ছবিতেও চলে আসে। একটা উদাহারন না দিলে বোঝা যাবে না, ধর তুমি একটা কাগজে কিছু একটা লিখছো। ক্যামেরাটা তোমার মুখের উপরে ধরা। সেখান থেকে ক্যামেরাটা কাগজের উপর নামবে। আমাদের দেশের ক্যামেরাম্যানরা খুব স্লোলী ক্যামেরাটা মুখ থেকে কাগজের উপর নামাবে, অথবা মুখ থেকে কাট করে দ্বিতীয় শটে কাগজটা দেখাবে। ইউরোপীয়ান ক্যামেরাম্যানরা ধাম করে নীচে নামাবে। এরা খুব দ্রুত। আমাদের দেশে সে স্পিডটা নাই। আমরা জাতীগতভাবে স্লো, দেশটা স্লো, কথাবার্তায় স্লো। আমরা সবকিছুতেই খুব স্লো। আমি চাই, ফিল্মের ইউরোপীয়ান পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে ইউরোপীয়ান স্টাইলে, খুব ফাস্ট। আর বাংলাদেশী পর্ব যেটা হবে, সেটা হবে আমাদের দেশীয় স্টাইলে, খুব স্লো। তাতে স্পস্ট একটা পার্থক্য তৈরি হবে।

 

সাব্বির খানঃ ছবিটার নাম কি হবে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার “নক্ষত্রের রাত” নামের উপন্যাস অবলম্বনে হবে এই ছবিটা। উপন্যাসের নামে অবশ্য ছবির নাম হবে না। ছবির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে প্রথমিকভাবে “ চোখে আমার তৃষ্ণা ” নামটি ঠিক করেছি ছবির জন্য। এটা রবীন্দ্র নাথের গানের একটা লাইন। তবে নামটা বদলানো হতে পারে।

 

সাব্বির খানঃসুইডিশ কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকছেন কি এই ছবিতে?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যা থাকছে। অনেকেই অভিনয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

 

সাব্বির খানঃ সুইডিশদের সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ভালোই লাগছে। তবে ওরা খুব রোবোটিক । ওরা হুকুমের বাইরে এক পা-ও নড়বেনা। ওদের যা বলে দেয়া হচ্ছে, ওরা ঠিক ততটুকুই করছে। তার বাইরে না। ওদের বলেছি মাঝে মাঝে একটু ইম্প্রোভাইস করতে, কিন্তু তারা তা করছে না। শুধু আমি যতটুকু বলছি, ততটুকুই করছে। তবে তারচেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে লাইটিংয়ের ব্যাপারে। ডিজিটেলেতো লাইটের খুব একটা বেশি প্রয়োজন পড়ে না, আর আমি প্রচুর লাইট নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। তাতে আমার বেশ একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবে দেখা যাক, কাজতো এগিয়ে চলছে!

 

সাব্বির খানঃ এই ছবিটা তৈরিতে খরচ কেমন হবে বলে মনে করছেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার সব ছবিতে সাধারনত এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়। আমার মনে হয়, এটাতেও তাই হবে। ইউরোপে টাকার এই অংকটা খুবই কম হলেও, আমাদের দেশে অনেক বেশি।

 

সাব্বির খানঃ সুইডেনে আপনি এখন শুটিং করছেন এবং আগেও এসেছেন। সুইডেন এবং বাংলাদেশের মধ্যে আপনি কোন ব্যাপারগুলোর মিল বা অমিল খুঁজে পান?

হুমায়ুন আহমেদঃ মিল তেমন কিছু নাই। বাংলাদেশের মানুষরা খুব সুখী মানুষ। ধরুন, বন্যায় ঘর ডুবে গেছে, ঘরের চালের উপর আশ্রয় নিয়েছে মানুষ, ঠিক তখন সেখান দিয়ে দেশী বা বিদেশী কোন টিভি টিম যাচ্ছে, তখন তারা কি করবে? হাসবে অথবা হাত নাড়বে। এই ঘটনা সুইডেনে কখনোই সম্ভব না। এটা শুধুই আমাদের দেশে সম্ভব। আবার পেটে ভাত নাই, নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। নৌকায় চড়েও দেখবেন একটা গান ধরছে। এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। সুইডিশরা তা পারবেনা।

 

সাব্বির খানঃ আপনি বলতে চান যে বাংলাদেশের মানুষ আসলেই খুব সুখী?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। কিছুদিন আগে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষদের দেশের একটা তালিকা বের করেছিল। সেখানে বাংলাদেশ ছিলো পাচ নাম্বারে। দুর্নীতির তালিকায় এক নাম্বারে থাকলেও সুখীর তালিকায় কিন্তু পাঁচ নাম্বারে।

 

সাব্বির খানঃ আপনিতো মুলতঃ একজন লেখক। কিন্তু আপনি একই সাথে নাট্যকার ও চলচিত্র পরিচালক। আপনি নিজেকে কি হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি আসলেই একজন লেখক। আমি নিজেকে বলি ফিকশন রাইটার। কখনোই আমি নিজেকে ফিল্মমেকার বলিনা। ছবি দেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। আমি কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখি, কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম বানাতে পারছেনা। এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো, অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি নাই। এই আফসোস থেকেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা ছবি বানালাম “আগুনের পরশমনি”। এই ছবি করতে সমস্ত খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। আসলে ছবির লাইনটা হচ্ছে একটা নেশার মতো। সিগারেটের যেমন নেশা, গাঁজার যেমন নেশা, সিনেমা বানানোর নেশা তারচেয়েও বেশি।

 

সাব্বির খানঃ আপনি থামবেন কোথায়? লেখালেখিতে, সিনেমায় না অন্য কিছুতে? নাকি সবকিছু একসাথে নিয়ে চলবেন, কোথাও থামবেন না? শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি লিখে যাবো। অন্য কিছুর কি হবে জানিনা, তবে লেখালেখি থামবেনা। আর আমরাতো ভবিষ্যতের ব্যাপারে খুব একটা ভাবিনা। তাই জানিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। আমরা হচ্ছি, “প্রডাক্ট অব দ্য প্রেজেন্ট”! প্রেজেন্ট নিয়েই আমাদের সমস্যা বেশি।

 

সাব্বির খানঃ আপনি কিছুক্ষন আগে বলেছেন যে, আমরা খুব স্লো-জাতী। এটা যদি আমাদের জন্য একটা নেতিবাচক দিক হয়, তাহলে আমাদের ঠিক হওয়ার জন্য কি করা উচিত?

হুমায়ুন আহমেদঃ এটাকে ঠিক করার কিছু নাই। এটা যেমন সেরকমই থাকবে। এর মাঝখান থেকে নতুন নতুন ছেলেপেলে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। তারা খুবই স্মার্ট, খুবই আধুনীক। বাংলাদেশকে পরিবর্তন করার দায়িত্ব এদের। এরা করবে।

 

সাব্বির খানঃ আপনিতো বাংলাদেশ প্রচন্ড জনপ্রিয়। আপনার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষে কিছু একটা করা যায়না?

হুমায়ুন আহমেদঃ একজন লেখক কিন্তু সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করতে পারেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান তিনি দেবেন না বা এটা তার দায়িত্ব না।

 

সাব্বির খানঃ এটা কার দায়িত্ব?

হুমায়ুন আহমেদঃ এ দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদের। সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব। একজন লেখক রাজনীতিবিদ না, বা সমাজ সংস্কারক না। এটা তার দায়িত্বও না।

 

সাব্বির খানঃইঙ্গিত থাকবে কিন্তু প্রস্তাবনা থাকবেনা, এটা কি ঠিক?

হুমায়ুন আহমেদঃ ইঙ্গিতের ভিতরেইতো প্রস্তাবনা থাকে। কিন্তু সেগুলোকে গুরুত্ত্বের সংগে বিবেচনা করার কিছু নাই।

 

সাব্বির খানঃ আমাদের রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনগুলো কি এই ইঙ্গিত বা প্রস্তাবনাগুলো যাচাই করে থাকেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ না না না। এই সমস্ত ইঙ্গিত বা প্রস্তাবকে গুরুত্ত্বের সংগে নেয়ার কিছু নাই। আমাদের মুসলমানদের কথাই যদি ধরি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট পবিত্র গ্রন্থ কোরান যদি আমাদের চেঞ্জ করতে না পারে, একজন ঔপোন্যাসিক কি একটা উপন্যাস লিখে তাদের চেঞ্জ করতে পারবেন? সেটা কিভাবে সম্ভব?

 

সাব্বির খানঃ লেখক হুমায়ুন আহমেদের সমাজের প্রতি অঙ্গিকার বা দায়বদ্ধতা কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ লেখক হিসেবে আমার অঙ্গিকার একটাই, যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের জন্ম, সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা সবাইকে জানিয়ে রাখা। কারন আমি যখন একজন যুবক, তখন সেই যুবকের দৃষ্টি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধটি দেখেছি।

 

সাব্বির খানঃ আপনিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। আপনার দৃষ্টিতে একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদী এবং বর্তমানের মৌলাবাদ ও মৌলবাদীর মধ্যে তফাৎ কোথায়?

হুমায়ুন আহমেদঃ একাত্তরের মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ছিল একটা বিদেশী শক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যে মৌলবাদ ও মোলবাদীরা কোন বিদেশী শক্তির অংশ না। এটাই পার্থক্য। তবে আমাদের এতো মৌলবাদ-মৌলবাদী বলে চিৎকার করে লাভ নেই কিছু, কারন বিশ্বের সব দেশেই এখন এসব আছে। ইন্ডিয়াতে আছে বিজেপি, আমেরিকাতে আছে ক্লু ক্লাক্স ক্লান, সারা পৃথিবীতেই আছে মৌলবাদী।

 

সাব্বির খানঃ বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা কি সমস্যা না? বিএনপি-জামাত সরকারের সময়ে বাংলা ভাই, শায়খুল, ৬৩টা জেলায় এক সাথে বোমাবাজী এসব কি সমস্যার আওতায় পড়ে না?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি মনে করি না। বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা এতো বড়ো কোন সমস্যা এখনো হয়নি। জনগন যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদিদের নির্বাচন করে, গনতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী।

 

সাব্বির খানঃ এই দুর্মূল্যের বাজারে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালীরা এখন কেমন আছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ সবাই খুবই ভালো আছে। বিশ্বের সব জায়গায়ই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। এখনো বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের যে কোন জায়গার চেয়ে কম।

 

সাব্বির খানঃবাংলাদেশের বর্তমান সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি তাদের খুব ভালো দৃষ্টিতে দেখি। তারা খুব ভালো কাজ করছে।

 

সাব্বির খানঃ একটা স্বাধীন দেশে এতদিন জরুরী অবস্থা জারী করে রাখা কি উচিত?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এতদিন দেশটাকে যে অবস্থা করে রেখেছিল, আগামী আরো দুবছরও যদি জরুরী অবস্থা জারী থাকে, আমি তার বিরূদ্ধে একটি কথাও বলবো না। কারোর পক্ষে কখনোই কি সম্ভব ছিল তারেক জিয়া, কোকো এদেরকে জেলে ঢোকানো? এর পরে যদি আওয়ামী লীগ সরকারও আসতো, পারতো কি এদের ধরে ধরে জেলে ঢোকাতে? কখনোই পারতো না। কারন একাজ করতে গেলে সবার থলেরই বিড়াল বেরিয়ে পড়তো। প্রত্যেকেইতো যার যার থলেতে একটা করে বিড়াল নিয়ে ঘুরছে।

আমাদের যে জেনারেল মইন ঊ আহমেদ, খুব নরম মনের মানুষ, কিন্তু খুব শক্ত। যেই ইন্ডিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করলো, আমাদের জেনারেল ভারতে গেলেন, সেখানে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসলেন, সম্মান দিলেন। এই কাজটা কি আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারতো না? আমাদের জাতী হিসাবে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবেনা? এতোগুলো ভারতীয় সৈন্য আমাদের জন্য আত্নত্যাগ করলো, আমরা কি পারতাম না তাদের স্মরনে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে? আমরা করিনি কিন্তু! একটা অন্য দেশের সন্তানরা আমাদের দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, এটা আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল।

 

সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে জামাতের মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। আপনি কি বলেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি কোন রাজনীতি বন্ধ করার পক্ষপাতি না। “সারভাইভ্যাল ফর দ্য ফিটেস্ট”। যে ফিটেস্ট, সে সারভাইভ করবে। যে আন-ফিট সে সারভাইভ করবে না। রাজনীতি বন্ধ করে কিন্তু একটা জিনিস বন্ধ করতে পারবে না।

 

সাব্বির খানঃ বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ বিতাড়নের উপায় কি বলে আপনি মনে করেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ বাঙ্গালীদের শিক্ষিত হতে হবে। এখানে মাদ্রাসা শিক্ষা নয়, আমি সাধারন বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলছি। যদি সাধারন শিক্ষায় বাংলাদেশীরা শিক্ষিত হয়, তাহলে বাংলার মাটিতে মৌলবাদীদের চিহ্ন থাকবে না। অশিক্ষিতকেই একজন মৌলবাদীর পক্ষে ভুল বোঝানো সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষার জন্যতো আমার ঘরই যথেষ্ঠ। মাদ্রাসায় গিয়ে পড়তে হবে কেন। আমাদের যদি যেতে হয়, তাহলে সাধারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেয়েই আমাদের শিক্ষা গ্রহন করতে হবে।

 

সাব্বির খানঃআপনার কি মনে হয় ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই হবে।

 

সাব্বির খানঃ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কথিত মাইনাস-টুর যে ফর্মূলা, এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারের আগে দেশের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে দেশের সাধারন মানুষই বলতো দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে দেশ পরিচালনার কথা। এটা এই সরকারের কোন কথা নয়। এটা বাংলাদেশের মানুষেরই কথা। আমাদের দেশে অসংখ্য জোকস (কৌতুক) আছে এই দুই নেত্রীকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে। আর আমরা হচ্ছি কি… আমরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যখনই এই সরকারের এক বছর পূর্তি হল এবং তারা কিছুটা এস্টাবলিশ হলো, তখনই আমরা এন্টি- এস্টাবলিশমেন্টের ধাঁচে কথা বলা শুরু করলাম। অথচ এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কি ছিল? নাথিং!

 

সাব্বির খানঃ বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ?

হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যথা সম্ভব সংবিধান মেনে চলছেন বলে আমার বিশ্বাস।

 

সাব্বির খানঃ  বর্তমানে দুই নেত্রীর একজন জেলে, আর অন্যজন চিকিৎসার জন্য বাইরে। এব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ুন আহমেদঃ তারা যদি দোষী হয়, তাহলে তাদের সাজা হওয়া উচিত। আর যদি দোষী না হয়, তাহলে তাদের বিচারের মাধ্যমে জেল থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

 

সাব্বির খানঃ  বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারকে দেখা গেছে মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে। কেন তারা মৌলবাদের সংগে আঁতাত করে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আঁতাতটা হয় মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দেখেছেন না, আওয়ামী লীগ কিভাবে খেলাফত আন্দোলনের সাথে পাঁচ দফার চুক্তি করেছিল। কেন করেছিল? মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে। বিএনপিতো মৌলবাদীদের সাথে আঁতাত করবেই। কারন তারা সেই ধরনেরই রাজনীতি করে। কিন্তু যেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নেতৃ্ত্ব দিয়েছে, জনগন কি অন্তত তাদের কাছ থেকে এই রাজনীতি আশা করে?

 

সাব্বির খানঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এই সরকার কেন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

হুমায়ুন আহমেদঃ এই সরকারই প্রথম যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কথা বলেছে। এর আগে আর কোন সরকার এই ব্যাপারে কথা বলেনি। এমন কি আওয়ামী লীগ সরকারও না। তবে আমার ধারনা, বর্তমান সরকার বিদায়ের আগে এব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদায় নেবে।

 

সাব্বির খানঃ আপনার কি চান যে এই সরকার নিজ উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্র্যাইবুনাল গঠন করুক?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই চাই। কারন এটা সরকারেরই দায়িত্ব এদের বিচার করা। এরকম অন্যান্য দেশেও হয়েছে এবং হচ্ছে।

 

সাব্বির খানঃ  আপনি এখন সুইডেনে। বাংলাদেশের তসলিমা নাসরিনের সাথে কি আপনার যোগাযোগ হয়েছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ না হয়নি।

 

সাব্বির খানঃ  কিছুদিন আগে আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে পশ্চিম বঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমাকে একজন বিতর্কিত লেখিকা বলেছেন। আপনি কি এই ব্যাপারে একমত?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমার মনে হয় উঁনি একজন বিতর্কিত লেখিকা। কারন ওঁনার লেখা দিয়ে উনি নিজেই নিজেকে বিতর্কিত করেছেন। তবে তসলিমা নাসরিন যে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আছেন, সেজন্য আমি খারাপ বোধ করি। কারন একজন লেখক তার মাতৃভূমিতে বসবাসের অধিকার রাখে। তসলিমাকে দেশে ফিরতে দেয়া উচিত।

 

সাব্বির খানঃ  আপনি কি কোন রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি অনুগত?

হুমায়ুন আহমেদঃ যে কোন লেখকে জন্য রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতবাদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা ক্ষতিকর। কারন তার লেখা কোন সাহিত্য হবেনা, সেটা হবে একটা মূখপত্র। আনুগত্য স্বীকার করার মত কোন সমস্যার মধ্যে আমি পড়িনি। কারন যে সব দর্শনের কথা বলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগইতো আমার নিজের। আর আমি লেখালেখি করি প্রথমত আমার নিজের আনন্দের জন্য। সে আনন্দের ভাগ যদি পাঠকরা পায়, তাহলেতো গুড এনাফ। লেখক হিসেবে মতবাদ প্রচার করার দায়-দায়িত্ব আমার না।

 

সাব্বির খানঃ  বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।

 

সাব্বির খানঃ তাহলে ডঃ হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ কারন যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিৎ যে, যে-কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয়না।

 

সাব্বির খানঃ  ঠিক একই কারনে কি তাসলিমা নাসরিন দেশ থেকে বিতাড়িত?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, হয়তোবা।

 

সাব্বির খানঃ  শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশ-দ্রোহীর মামলার মাথায় নিয়ে মৃত্যু বরন করেছেন। ওঁনার অপরাধ কি ছিলো? আপনি কেমন বোধ করেন এব্যাপারে?

হুমায়ুন আহমেদঃ ওনাকে তো কেউ খুন করেনি। উনিতো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওঁনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহীর কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা করা হয়নি। তাছাড়া সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, সমস্তটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। মৌলবাদীরাতো কতবার আমাকে মুরতাদ বলেছে, তাতে কি আমি মাথা ঘামিয়েছি কখনো? কখনোই না।

 

সাব্বির খানঃ  আপনি কি সমাধীকারে বিশ্বাস এবং নিজের জীবনে চর্চা করেন?

হুমায়ুন আহমেদঃ অবশ্যই। এটা বাংলাদেশে সবাই করে। বিশেষ করে আজকালকার অফিস আদালতের দিকে তাকালে প্রচুর মেয়েদের দেখা যায়, যা পূর্বে ছিলনা। আমি নিজেওতো আমার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ না করে কিছু করিনা। তার মতামতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব আমি দেই।

 

সাব্বির খানঃ আপনার নিজের ব্যাপারে কি শুনতে আপনার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমার ব্যাপারেতো আমি খারাপ কিছু শুনিনা। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি বলে যে, আপনার এই বইটা খুব একটা সুবিধার হয় নাই, তাহলে খারাপ লাগে। পরচর্চাও খারাপ লাগে। আমি নিজেই তার শিকার হয়েছিলাম যখন একটা ফ্যামিলি ছেড়ে দিয়ে, নতুন একটা ফ্যামিলি শুরু করলাম, তখন এরকম হয়েছিল।

 

সাব্বির খানঃ  আপনি কেমন আছেন স্যার?

হুমায়ুন আহমেদঃ আমি ভালো, আমি খুব ভালো আছি।

সাব্বির খানঃ  আপনি কি সুখী? আপনার সংসার কেমন চলছে?

হুমায়ুন আহমেদঃ হ্যাঁ, আমি ১০০% সুখী। আমার সংসার ভালো চলছে। আমার সংসার ভালো না চললে কি আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে আসতাম! আমার বড় ছেলেটিও আমার সাথে এসেছে।

সাব্বির খানঃ স্যার, আপনি অনেক সময় দিয়েছেন আমাকে আজ। আমার এবং দৈনিক সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এবং আপনার সুখী-সমৃদ্ধ জীবন কামনা করি। ভালো থাকবেন।

হুমায়ুন আহমেদঃ তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে আমার পাঠকদের জানাই অনেক ধন্যবাদ।

[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *