সাকার রূপ করো সাধনা
নীলাচল পাহাড়, কামাখ্যা
তিন দিন হয়ে এল ডাকিনী মা ছিন্নমস্তায় এসে উঠেছেন। চোখ বোজা। ধ্যানস্থ। ভক্ত এসে মা, মা মাতৃমন্ত্র উচ্চারণ করে উপুড় হয়ে পড়লে ভূমিতে তিনি খানিক প্রকৃতিস্থ হয়ে ওঠেন। সদ্য ঘুম—ভাঙা চোখে কেবল ভক্তের উদ্দেশে বলে বসেন, ত্রাহি ত্রাহি মাং শরণাগতম্। তার পরই আবার চোখ বুজে নেন ডাকিনী মা। ধ্যানস্থ। ভক্তদের ফিসফাস ফেলে কোন সুদূরে যেন পাড়ি দেন! শত কোলাহলেও আর যে খোলে না ডাকিনী মায়ের চোখের পাতা।
মন্দিরের ভেতর কুণ্ডের জল টলটল করতে থাকে। যে জলে ছিন্নমস্তার প্রদীপের আলো লেগে চিদানন্দজির ফোলা হাতের টসটসে উপুড় পাতা এসে পড়ে আর সেই মুহূর্তেই ভক্তের ডাকে ফের ডাকিনী মায়ের খানিক প্রকৃতিস্থ হয়ে আসা চোখের পাতাজোড়া খুলে যায়। চোখ পড়ে গিয়ে একেবারেই সামনে থাকা ছিন্নমস্তা কুণ্ডেরই জলে পড়া চিদানন্দ স্বামীর ইয়া বড় ফুলে যাওয়া বিসদৃশ হাতেরই পাতায়।
সেই হাতেই তো তিনি আরতি সেরেছেন মায়ের। এখন মন্ত্র উচ্চারণ করছেন গুপ্তদুর্গা ছিন্নমস্তার, মা! মা! অনঙ্গকুসুমা! মা অনঙ্গমদনা, মা অনঙ্গমেখলা!
অসমের কামাখ্যায় নীলাচল পাহাড়ের ওপর রয়েছে দশমহাবিদ্যারূপ দেবীদের এক একটি মন্দির। আর আছে পঞ্চশিবের মন্দির। ডাকিনী মা কামাখ্যা এসে নীলাচল পাহাড়ে কামেশ্বর শিব মন্দিরের দক্ষিণে অবস্থিত গুপ্তদুর্গা ছিন্নমস্তার মন্দিরেই বরাবর অবস্থান করেন। মায়ের ভৈরব আবার থাকেন ভুবনেশ্বরীতে।
ভুবনেশ্বরী নীলাচল পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায়। এখান থেকে কুয়াশার বুকে ডুবে থাকা কার্তিকের ব্রহ্মপুত্র বেশ দেখা যায়। এখানকার শোভা খুব মনোরম। এন্ডির চাদরে গা—মাথা ঢেকেঢুকেই আমি আর চিদানন্দজি মায়ের ভৈরবের সঙ্গে দেখা করেই ভুবনেশ্বরী থেকে ছিন্নমস্তায় নেমে আসি সকাল সকাল। তখনই চিদানন্দজি ওঁর হাতের কষ্টের কথা বলছিলেন আমায়। বলছিলেন, কার্তিক থেকেই হিম ঢোকে পরিবেশে আর বাতের প্রকোপ বাড়ে আমার শরীরে।
ছিন্নমস্তায় আজ বিশেষ ভোগ হবে ঘিলাপিঠায়। চালগুঁড়ি আর নারকেল কুরির সঙ্গে আখি গুড় মিশিয়ে একটা একটা করে কাঠের আগুনে ভাজতে হয় ঘিলাপিঠা। ডাকিনী মা আদেশ দিলেন চিদানন্দজিকে পিঠা তৈয়ারির। স্বামীজির হাত ফুলে ঢোল। কীভাবে চাল পিষে, নারকেল ভেঙে—কুরিয়ে তিনি বানাবেন ভোগের পিঠা! সেসবই ভাবছিলাম আমরা।
ধুতি—কামিজ পরা যুবক ভক্ত মাকে প্রণাম করছে। মাথায় ঘন চুল, তীক্ষ্ন নাক, গায়ের রংখানাও তো বেশ ফর্সা। কে ও! মুগার মেখলা ও গায়ে মার্কিন কাপড়ের ঘটি হাতা ব্লাউজ পরা, মাথায় কাঁটায় আটকানো বেশ বড় খোঁপার প্রায় সমবয়সি মেয়েটি বোধহয় ওর বউই হবে। দেখছি ওরা ডাকিনী মাকে প্রণাম করছে। পেছনে লম্বা পাকা চুলের বৃদ্ধটিকে দেখেই বুঝলাম এবার, কামাখ্যাপীঠের প্রখ্যাত পান্ডা সুরেনমোহন শর্মাজির এরা হল ছেলে ও ছেলের বউ। শর্মাজির বাবা আর ডাকিনী মা কামাখ্যার সিদ্ধ জটাধারীর আশ্রিত। ছিন্নমস্তা তাই মায়েরই গুরুগৃহ। মায়ের ভৈরব চূড়ামণি ঠাকুরের গুরুদেব ছিলেন বাংলার মানুষ। ডাকিনী মায়ের মুখেই তো শুনেছি তিনিই তাঁকে মুর্শিদাবাদ থেকে কামরূপ এনেছিলেন আধার ভালো বলে। ডাকিনী মা কিছুদিন ছিলেন তখন হনুমান দুয়ার। চূড়ামণি ঠাকুরের গুরুদেবের বেশ বড়সড় চেহারা। তিনি কেবল একখানি ছোট লালশালুতে গুপ্তাঙ্গ ঢেকে রাখতেন। পিঠের ওপর পড়ে থাকত খালি তামাবরণ কালনাগেরই মতো দীর্ঘ এক জটা।
ওরা সব চলে গেলে ছিন্নমস্তা নির্জন হল একসময়। ডাকিনী মা চিদানন্দজিকে এবার ওঁর পাশে এসে বসতে বললেন। বলেই তিনি খানিক ধ্যানমগ্না হয়ে রইলেন। সম্মুখে ওঁর একখানি জলপাত্র। মা বলেন, ও হল গিয়ে অভিমন্ত্রিত জল। এই জল ব্যথা—বেদনা, জ্বর—জ্বালা—সর্বপ্রকার রোগেই তো ব্যবহার করেন দেখেছি, মাতাজি। বলেছিলাম, এই জল প্রয়োগে ব্যথারোগের আদতে কোনও উপকার হয় কি না। ডাকিনী মা—গুরু আমাকে তখন বলেছিলেন, তোর তো অবিশ্বাসীর চোখ। কাজ হবে না। বলেছিলাম, হবে কী করে মা? এই জলচিকিৎসায় বিশ্বাস ছাড়া আর কোনও তো সারবস্তু নেই। ডাকিনী মা তখন হেসেছিলেন। এরপরই মুর্শিদাবাদ থাকাকালীন আমার নিতম্বে ফোঁড়ার উপদ্রব শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার দেখানো হল। ওষুধেও বসছে না ফোঁড়া। কাটাছেঁড়ার পথে যেতে বললেন এবার ডাক্তার। মা বললেন, তুই আমার কাছে দু—দণ্ড বস। আমি গিয়ে বসলুম ওই পাতা আসনটিতে। তিনি বললেন, মনকে এবার একটা বিন্দুতে স্থাপন কর। মনে কর বিন্দুটি সূর্যের তাপের মতোই উজ্জ্বল ও প্রচণ্ড শক্তিশালী।
মুদ্রা, ধ্যান, জপতপ—এসবের অভ্যাস আমার তো ছিলই। মনকে তাই আমার বিন্দু থেকে প্রকাশিত জ্যোতির ভেতর বসিয়ে নিতে কোনও অসুবিধাই হল না। বুঝলাম এবার জ্যোতির ছটায় আমার মনের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে পড়ছে। আমি ক্রমশ আমিত্বহীন প্রকৃতির গুণে গুণান্বিত হয়ে চলেছি। ডাকিনী মা ধীরে ধীরে বলছেন আমায়, মনে কর পৃথিবীর সবখানে গন্ধপুষ্প ফল মূল শিকড়—বাকড় নিয়ে যে বায়ু বইছে সেই বায়ুই তোর ব্যথায় সঞ্চালিত হচ্ছে, তাকে তুই এবার শরীর থেকে বের করে দে দিকিনি। মনে মনে ভাব, শরীরখানা থেকে আমার ব্যাধির দূষিত হাওয়া এবার বের হয়ে যাচ্ছে। আর সেই গন্ধপুষ্পের হাওয়াটিকে এবার সেখানে ঢুকায়ে দে। এক—দুই—তিন—চার গুনে গুনে তুই শ্বাস নে দিকিনি।
আমি ডাকিনী মায়ের কথা ধরে আসনে বসে বসে এবার তেমন ধারাই করতে থাকলাম। বুঝলাম এতে, সুগন্ধি পুষ্টিবর্ধক বায়ু আমার শরীরে মনে মস্তিষ্কে উদরে—সর্বাঙ্গে এবার ছড়িয়ে গিয়েছে। আমার আর শরীরখানাই তো নেই। আমি প্রকৃতির শক্তি দ্বারা এবার যে নিয়ন্ত্রিত। যেহেতু অনেকদিন ধরে আমি ধ্যান, ধারণা, আসন, প্রাণায়ামে দেহ মনকে নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাসে অভ্যস্ত রয়েছি, সেহেতু আমার ব্যথার জায়গা থেকে মনখানাকে সরিয়ে ফেলতেই ব্যথাযন্ত্রণাটা কমার দিকে যাচ্ছে এখন ক্রমশ।
মা এবার আমার ব্যথায় ওঁর সারা জীবনের যোগালব্ধ ইচ্ছাশক্তিটিকেই প্রয়োগ করে দিলেন বুঝলাম। তিনি মনে মনে একান্তচিত্তে আমার ব্যথার জায়গাটি থেকে চিন্তাশক্তির উত্থান পর্বখানিকেই যেন নিষ্ক্রিয় করে দিলেন। কয়েকদিনের ভেতর এভাবে মায়ের সামনে আসনে বসার ফলে তিনি আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঁর বাহ্যিক চৈতন্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে একান্তচিত্তে আমারই ব্যথার জায়গাটিতে মানসিক শক্তির প্রবল প্রয়োগ ঘটিয়ে শেষমেশ ফোঁড়াটিকেই অপসরণ করে ফেললেন। আমার আর কাটাছেঁড়ার দিকে যেতেই তো হল না।
আজও দেখছি ছিন্নমস্তায় মা চিদানন্দজিকে পাশে বসিয়ে ধ্যানে বসে গিয়েছেন। সামনে ওঁর সেই অভিমন্ত্রিত জল। যোগৌষধি। তিনি সেই জলের ওপর নিজের ডান হাতের তালু দিয়ে পাত্রখানাকে ঢেকে দিলেন দেখলাম। ডাকিনী মা একে ‘অমৃতকরণ’ বলেন। তিনি এবার চিদানন্দ স্বামীর ব্যথার কথা চিন্তা করে ওঁর সাধনার্জিত যোগশক্তি দিয়ে জলকে অভিমন্ত্রিত করে নিলেন বুঝলাম। পাত্রটিকে তিনি মুখের কাছে এনে নিরাময় মন্ত্র দিয়ে কুণ্ডলিনীকে তুলে সুষুম্না নাড়িকে চৈতন্যরূপিণী হতে দিয়ে বায়ুকে অভিমন্ত্রিত করে সেই যোগৌষধিতে ফুঁ দিয়ে জলপাত্র থেকে সবটা জলই চিদানন্দজির হাতে ঢেলে দিলেন।
বিকেলবেলা জলশক্তি অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে দিল। স্বামীজি দেখলাম এক হাতে ঘিলাপিঠা ভাজছেন। ছিন্নমস্তায় তখন সন্ধ্যা লেগেছে। ঢোল, করতাল, উলুধ্বনির উচ্ছ্বাস। লালকাপড় পরা সেবাইতরা সব যাতায়াত করছে কালী, তারা, কামাখ্যা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলার মন্দিরে মন্দিরে। কেউ কেউ যাচ্ছেন কামেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, কোটিলিঙ্গ, অঘোর ও আম্রতকেশ্বর শিবের মন্দিরে। নীলাচল পাহাড়ে তখন ধমধম ঢোলের আওয়াজ। দেবীর স্তবস্তুতি। নাম—কীর্তন। তারই মাঝে দেখি, ছিন্নমস্তায় ভোগ লাগাচ্ছেন চিদানন্দ স্বামী। আমি সামনে গিয়ে দেখলাম, হাতখানি ওঁর খুবই স্বাভাবিক। একটুকুও ফুলো নেই। চিদানন্দ স্বামী বললেন, ব্যথা কমে গিয়েছে। ফুলোও গায়েব।
ঢোল বাজছে। একটানা গান চলছে। ডাকিনী মা গাইছেন—
জয়কালী জয়তারা
ছিন্নমস্তা বগলা
ভুবনেশ্বরী ভৈরবী
ধূমাবতী কমলা
দেবী করে ক্রীড়া হরি
দেবী করে ক্রীড়া
লকলক করে জিভ
হে হরের প্রিয়া।
ওঁ দীর্ঘজীবনাং কামনার্থে
ডাকিনী মায়ের কাছে প্রায় প্রায়ই তো আমি দেখি, মানুষজন এসে জানিয়ে যান সব নানাবিধ সাংসারিক অভিযোগ ও কামনারই কথা। মা মন দিয়ে শোনেন। কতদূর কী করেন বা ওঁর ক্রিয়াতে মানুষজনদের কী উপকার মেলে, সেসব নিয়ে আমার আগাগোড়াই তো কোনওরকম কোনও আগ্রহ ছিল না। তথাপি যাঁরা আসেন ওঁর ডেরায়, তাঁদের কয়েকজনকে তো বলতে শুনেছি, মায়ের ক্রিয়ার গুণাগুণ আছে। ভালো আছি অনেক। আমার সমস্ত বাধা—বিপত্তি কেটে আসছে দেখছি আস্তে—ধীরে।
আমি যখন মায়ের কাছে থাকতাম। তিনি আমার শরীরে ও মনে পঞ্চতত্ত্বের উদয় করার কথাটি বলতেন। যেহেতু যোগক্রিয়া নিয়ে আমার অসীম আগ্রহ, শিক্ষানবীশ যোগীর মতো আমি ওঁর পাশটিতেই চুপ মেরে বসে থাকতাম। আমার কাজটি ছিল ডাকিনী মাকে খুঁচিয়ে তোলা। ওঁর অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধির ক্রিয়াতত্ত্বগুলি সব বের করে নেওয়া।
শক্তিধর যোগিনী তিনি। আমার উদ্দেশ্য ভালোই বুঝতে পারতেন ডাকিনী মা। বুঝতেন তিনি, অতি গুহ্য সাধনক্রিয়ার সেই নিয়মানুবর্তিতা, ক্ষুধা—তৃষ্ণা—ঘুমকে জয় করে ইন্দ্রিয়গুলিকে বশে আনার যে কৃচ্ছ্রসাধন, তারই সুখপাঠ্য বয়ানখানি ধরতেও আমি তৎপর। আমি ওঁর সাধারণ ভক্তকুলদের মতো মানসা নিয়ে কখনো আসি না ডেরায়। এসব জেনেও তিনি আমাকে যোগদীক্ষার কথাগুলো বলতেন। বলতেন, মনকে সন্তুষ্ট করে রাখো এখন খালি। দেখো মনের আনন্দ কখনোই যেন হারিয়ে না ফ্যালো। মনের ভূমি দিয়েই তোমার জমিটি পোক্ত হবে। সেই জমিতে ক্রিয়ার বীজটি তো তুমি লাগিয়ে রেখেছ মা—গুরুর সহায়তায়। সেই বীজকে এখন অঙ্কুরিত করাবার দায়িত্ব আমার। আমি ভালো মালিনী। বিশ্বাস রাখো, বাবা।
সেই বিশ্বাসে ভর করেই তখন তো ঘন ঘন আমি ডাকিনী মায়ের কাছেই যেতাম। ওঁর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতাম আর মনকে একখানে এনে নিজেরই বিনাশ ঘটানোর চেষ্টাটা করতাম খুব। পারতাম তো না কিছুই। ডাকিনী মা বলতেন, আত্মলয় না ঘটালে চক্র যে জাগবে না শরীরে। বলতাম, সহজ পদ্ধতি কিছু বলুন না, আমায়। এভাবে যে হচ্ছেও না কিছু।
ডাকিনী মা হাসলেন। ওঁর মূর্তিখানি তো বিশাল। দীর্ঘ বাহুদ্বয়, বুকের ছাতিও মহিলা হিসেবে বেশ বেমানান, কুচকুচে কালো ঘন ভ্রূ, তার নীচে অতি নরম ও করুণা মাখানো চোখদুটি আবার এখানে যে বড় বেমানান। সেই চোখ নিয়ে দৃষ্টি প্রথমে তিনি স্থির করে নিলেন এবার আমার মুখে। তারপর বললেন, দ্বার ঠিক কর আগে। ঢোকবার জায়গা। এই বলেই তিনি আমার কপালটা ওঁর বলশালী লম্বা আঙুলে ঠেকিয়ে বললেন, এই এখানে, দুই ভ্রূর সন্ধিস্থলে। এখানেই প্রথমে তোকে চক্রের গুণে গুণান্বিত হয়ে বিভোর দশাপ্রাপ্তির অভিনয়টা খালি করে যেতে হবে।
বললাম, অভিনয়!
বললেন, হ্যাঁ রে। সাধনক্রিয়ায় অভিনয়টাই খুব জরুরি। সমস্ত ইন্দ্রিয়, মন, প্রাণের সঙ্গে যুক্ত সকল কিছুর অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দুটা হল গিয়ে ভ্রূর ভাঁজানিতে। ওখানেই রয়েছে প্রজ্ঞাবিন্দুটি। মাথার মধ্যেকার সেই ব্রহ্মরন্ধ্রখানার সঙ্গে প্রথমে তোকে যুঝতে হবে ওই অভিনয় দিয়ে। আসনে বসে অভিনয় করতে হবে এক জ্যোতির্ময় পুরুষের সঙ্গে তোর একাত্মতার। অভিনয় করতে করতেই অভিব্যক্তিতে ভাব ফুটে উঠবে। ভাব ফুটলেই তো রূপ খুলবে। শিব—কালী—দুর্গা। রূপের খেলাটা আবার যখন সাঙ্গ হবে একদিন, তখন তোর আত্মলীন দশাপ্রাপ্তি ঘটবে। সেটাই হল গিয়ে বুঝলি সাধন সমাধি। রোজ অভ্যাস কর দিকি এই সহজযোগ—ই। একদিন হবেই।
এই হওয়া না—হওয়া নিয়েই আমার অভ্যাসযোগ আর আরও ঘনঘনই ডাকিনী মায়ের কাছে গিয়ে বসা।
বসতে বসতেই একদিন দেখলাম একজন নিমোনিয়ার রোগী মায়ের কাছেতে এলেন, অন্যান্য নানা রোগের রোগীদের মতোই। মা তাঁকে বললেন, বাড়িতে কী ধুতরা গাছ আছে? লোকটি মাথা নাড়লেন। গ্রামের গরিব বয়স্ক। দেখবারই তেমন কেউ বোধহয় নেই। পোশাক এলোমেলো, মলিন। সুগোল মাথাখানা একেবারে পাকা চুলে ভরা।
ডাকিনী মা বললেন, ধুতরা পাতা তুলে রোদে ভালো করে শুকিয়ে ফেলেন। বুড়ো পাতা হলে ভালো। এবার সেই শুকনাপাতা পুড়ায়ে তার ধূঁয়া টানেন বাড়ি গিয়া দুইবেলা।
আমার তো সন্দিগ্ধ মন খালি। অধ্যাত্ম মার্গের গুহ্য যোগদশাগুলো জানব বলেই মায়ের কাছে ঘুরঘুর করি। মা ধরতে পারলেন আমার অবিশ্বাস। বৃদ্ধকে নিরাময়ের ওষুধখানা বাতলে আমারই দিকে তাই ফিরে তাকিয়ে বললেন, এ হল জগদম্বার বিধান।
তিনি আমাকে প্রায় প্রায়ই তখন মুদ্রা আসনে বসতে বলতেন। বলতেন, শ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত কর না তুই খালি। অত ঘনঘন শ্বাস ফেলবি না। যে কোনও কাজের ভেতরই দূরে দূরে শ্বাস ফেলাটা আগে রপ্ত কর দিকি।
আমি শ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করাটা শিখতে লাগলাম। বাঁ পায়ের গোড়ালিটা আমার গুহ্যদেশে ঢুকিয়ে ফেলে ডান পাখানা মেলে দিয়ে দু—হাত দিয়ে স্পর্শ করার প্রাণায়াম ভঙ্গিটি খুব করে আয়ত্তে আনতে থাকলাম। একেবারেই ডাকিনী মায়ের কথামতো কাজ। এতে করে আমার কুণ্ডলিনী থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ি তিনখানিই আলাদা হয়ে পড়ল এবার। দেখলাম আসনে বসে ভেতরের শক্তি ঠিক ওপর দিকে উঠছে। তারপরই আমি শ্বাসে জোর দিতে থাকলাম। শুরু হয়ে গেল আমার সেই ভ্রূ যুগলের মধ্যে ভেতরের চোখদুটি দিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তির তেজদীপ্ত জ্যোতিখানাকেই দেখবার অভিনয়।
মা শুনে বললেন, ঠিক দুয়ারে পৌঁছে গেছিস এবার। দরজা নাড়া। যত নাড়াবি শরীরের দুয়ার তত নড়বে তোর লিঙ্গমূলের কড়া। নাভির স্বাধিষ্ঠান এবার তোর দরজাখানা খুলে দেবে। আস্তে আস্তে দেহবাড়ির মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, ললনার সুসজ্জিত ঘরগুলাও সব খুলে যাবে। তুই এখন রোজ ভালো করে মূল দুয়ারের কড়াখানা নাড়া দিকিনি। শব্দ হোক খালি।
আমি তো লেগে পড়লাম মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। দরজা যত খুলছি মনের, দেখছি জানলাগুলো সব বন্ধ হচ্ছে। আত্মঘাতী জানলা সব ইন্দ্রিয়ের। মা বলেন, স্থির হতে দেয় না এরা। বলে শুধু বাইরের জিনিসগুলা দ্যাখো। এই দ্যাখা থেকে চোখ ফিরা না দিকি।
আমার চোখে তখন কুণ্ডলিনীর ধ্যান লেগে থাকে রোজ। আমি অভ্যাস করি। মনের রিপুগুলো আটকে দিয়ে ভ্রূযুগলে চোখ রাখতে।
এরই মধ্যে মায়ের ডেরায় আসল এক আমারই বয়সি যুবক। যার হৃদরোগের উপদ্রব শুরু হয়েছে সবে তখন। মা বললেন, শোন, যখন হাঁটবি তখন ডান পাখানাকে আগে ফেলে হাঁটবি। তিন পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটার সময় শ্বাস ফেলবি। এইভাবে এগোলে ক্লান্তি আসবেই না। আবার শ্বাস যখন নিবি, তখন একইভাবে গতি ধরে শ্বাস নিবি। মাঝে মাঝে ধীর হবি। তিনকে পাঁচ করে নিয়ে শ্বাস ফেলবি আবার পাঁচে গিয়েই শ্বাসখানা নিবি। এতে করে শরীরে তোর শক্তি আসবে। হার্টের মৃদু প্রকোপগুলা সব মিইয়ে যাবে। শরীরের উত্তেজনা কমে আসবে। শ্বাসের ওঠানামাটা নিয়ম দিয়ে সারলে শরীরে রোগেরও উৎপাত কম হবে তোর। এই বলেই মা আমার দিকে তাকালেন। আমি দেখলাম বৃদ্ধ সেই নিমোনিয়ার রোগীটি ফুরফুরে মেজাজে ডাকিনী মায়ের ডেরার রাস্তাটি পার হয়ে ওঁর দিকেই এগোচ্ছেন!
মুর্শিদাবাদে ঠান্ডা পড়ে খুব। গরমের সময়ও ডাকিনী মায়ের ডেরার টিনের চালখানি তেতে ওঠে মাঝ দুপুরে। আমি তো থাকতে পারি না। মা—গুরু তখন গুরুবাড়িতে ওঁর কৃচ্ছ্রসাধনার গল্পখানা জোড়েন, আমার প্রতিকূল বোধ চলে যায়।
মা—গুরু বলেন, তখন গুরুদেব আমাদের শীতলী প্রাণায়াম শেখাচ্ছেন। প্রচণ্ড গরমে শরীরের চন্দ্ররূপী নাড়ি পিঙ্গলাকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই তাতটা কমে আসে। বৃন্দাবনে থাকাকালীন তাই গরমই মনে হত না আমাদের। বাসন্তী নবরাত্রিতে বৃন্দাবন থাকতাম তো আমরা। এই সময় শ্রীবৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কাত্যায়নী মায়ের বিশেষ পুজো চলত। ভৈরব হোমে বসতেন।
বললাম, শীতলী প্রাণায়ামে তবে শরীরী বোধগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব?
ডাকিনী মা বললেন, শরীর আর মনখানাকে যদি এক মালায় গেঁথে তুলে ধ্যান—জপ সারতে পারিস তবে দেখবি জাগতিক বোধগুলো সব তোরও কমে আসছে।
আমিও মুর্শিদাবাদের তীব্র গ্রীষ্মে চন্দ্রনাড়িকে আয়ত্তে আনতে পারলাম ডাকিনী মায়েরই সহায়তায়। শীতে দেখলাম, ইড়ারূপী সূর্য নাড়িটিকে আয়ত্তে আনতে পারছি বলে শীতবস্ত্রের ব্যবহার কিছুটা কম লাগছে। আমি কী আর মায়ের মতো পারি! প্রচণ্ড শীতেও মায়ের গায়ে কোনও গরম পোশাকই তো দেখি ওঠে না।
ডাকিনী মা বলেন, সাধকদের আনন্দসাগর থাকে একটা। মুদ্রা ও প্রাণায়ামের অভ্যাসখানা করে নিতে পারলে কুণ্ডলিনী শক্তি ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না হতে আগলা হয়ে পড়ে স্বাধিষ্ঠান থেকে মণিপুরে গিয়ে শরীরটারই বিলয় করে দেয়। তখন আর শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার অনুভূতিই আসে না।
মায়ের কাছে থাকাকালীন তিনি আমাকে উলটিক্রিয়া শিখিয়েছিলেন। ভোর ভোর উঠে পড়তাম তখন আমি। প্রাতঃকৃত্যে যাওয়ার আগে ডাকিনী মায়ের নির্দেশে তখন ঢকঢক করে উঠেই এক বোতল জল খেতে হত। তারপর গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করে সেই জলটাকে বের করে ফেলতে হত। এভাবে সপ্তাহখানেক করার পর জল দেখলাম এরপর আপনে হতেই বেরিয়ে আসছে। প্রথমে ঘোলা জল বের হত। তারপর কদিন ফেনা জল। শেষদিকে একেবারেই পরিষ্কার জল। মা—গুরু দেখে বললেন, এবার শরীর থেকে তোর অ্যাসিড, অগ্নিমন্দা এসব কমে আসছে। পেটে চাপ দিচ্ছে না খারাপ বায়ু। ফলে উলটির পরিষ্কার আসছে। এভাবে করতে থাক তুই রোজ। এতে তোর পেটের রোগ দেখবি এক সময় ধরে আসছে।
দেখলাম আমি এরপর আমার অ্যাসিডিটির প্রকোপটা অনেকটাই কমে আসছে। খাবারও হজম হচ্ছে দ্রুত। ডাকিনী মা আমাকে মুখ বন্ধ করে দুই নাকে খালি শ্বাস নেওয়াটা এবার রপ্ত করতে বললেন। মুখ দিয়ে শেষে জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে দিতে বললেন।
বললাম, এতে কী হবে?
বললেন, তোর ফুসফুসের ক্ষমতাখানা বাড়বে। রোজ অভ্যাস করিস। বুকে সর্দিকাশি জমে থাকবে না। অনেক খাটলেও পরিশ্রম মনে হবে না তোর।
ডাকিনী মাকে বললাম, এই যে সবাই এসে অভাবের কথা বলছে, প্রার্থনা করে যাচ্ছে—ক্রিয়ায় এগুলো দূর করা কি সম্ভব?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। ডেরায় প্রদীপের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে মায়ের মুখ। সুকোমল আসনখানাতে বসে তিনি এখানেই নিরবচ্ছিন্ন জপ সারবেন। আমাদের সব চলে যেতে হবে এবার। ডেরা ডুবে যাবে রাতের অভ্যাসে। ডাকিনী মায়েরই সাধনায়। যাওয়ার আগে বললেন, ক্রিয়ায় কর্তাকে দিয়েই কর্মখানা করানো হয় রে। কর্ম হল সাধনার শক্তি। সেই শক্তি দিয়ে ওঙ্কার স্বরূপ পরমেশ্বরের কাছে যদি প্রার্থনা করা যায় যার প্রার্থনা, অভাব তার হয়ে, তবে অভাব, কষ্ট দূরীভূত করাটা সম্ভব। তবে ক্রিয়াবান ব্যক্তিকে আগে সেই নিষ্কাম স্তরে পৌঁছতে হবে। নিজের ভেতর কামনা নিয়ে অপরের অভাব দূর করা যায় কি কখনো?
আমি নিরুত্তর।
ডাকিনী মা বললেন, রোগ মুক্তির জন্য মহামৃত্যুঞ্জয় কবজ করা হয়। এর জন্য ধ্যানে মগ্ন হয়ে কয়েক লক্ষ বার জপতে হয়। শুধু জপলেই কী আর মৃত্যু ঠেকানো যাবে? নিষ্কাম, নির্লোভী ক্রিয়াবান কবজ না করলে ও কবজে কোনও কাজই হবে না, বুঝলি। যন্ত্রের ওপর মনস্থির করে মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়। সক্কলের কল্যাণের জন্যই জানবি ক্রিয়াবান মন্ত্র জপ করে। মানুষের কল্যাণের জন্য রোজ জপবি বুঝলি তুই টান্তং মন্ত্র।
বললাম, কী এর কাজ?
ডাকিনী মা বললেন, কাজের দরকার কী? জপে শ্বাসে স্থিরতা আসে। রোজ জপবি তুই নিজের নাম গোত্রখানা বলে, ওঁ দীর্ঘজীবনাং কামনার্থে।
ব্যোম ব্যোম ব্যোম
ডাকিনী মায়ের আরাধ্য এক বরফরঙা শিব। তিনি যখন যেখানে যান ঝোলায় ভরে লিঙ্গখানা ঠিক বহন করেন। নতুন আস্তানায় শিবলিঙ্গের অভিষেক সেরে তিনি সাধন কুঠিয়ার উদ্বোধন সারেন।
রাজরাপ্পায় সেবার আমরা দিন সাত ছিলাম। মায়ের কুঠিয়াটি ছিল রামগড়ের জঙ্গলে। কুঠিয়া থেকে ভৈরবের দেখা মেলে। শীতের নদের স্বচ্ছতোয়া তিরতিরে জল। লোকমুখে তিনি ভৈরবী নদী। ডাকিনী মা বলেন, দামোদরের সাথে ওঁর নিত্যরমণ। এ রমণে এঁরা জ্যান্তে মরা হয়ে শুয়ে। মরা সোঁতায় তাই সাধন কুঠিয়া থাকলে জায়গার স্বত্বগুণখানাও বলবৎ থাকে। এতে সাধনের আধার মানসে অনায়াসে নেমে আসে। মানস থেকেই তো সাধনা শরীরখানায় গড়ায়।
দামোদরের ওপারে বোকারো। নদ—নদীর সংগমস্থলের দিকে নিবিষ্ট তাকালে রাজধানী রাঁচির ক্রমশ বিস্তৃত ঝলক দেখা যায়। ঝাড়খণ্ডের টিলা উঁকি মারে আবার রামগড়ের জঙ্গল থেকে। ডাকিনী মা অরণ্যেই সেঁধিয়ে থাকেন।
মায়ের ভৈরবের ঝোলাটিতে আছে আবার রঙের রহস্য। শিবলিঙ্গের অভিষেকের পর তিনি ঝোলা থেকে বের করেন কুচকুচে কালো, নীল আর হলদে শিলাখণ্ড। জিজ্ঞেস করি আমি, এঁরা সব কারা?
ভৈরব শিলামূর্তি অভিষেকের জন্য কম্বল ও চর্মের আসনজোড়া পাততে থাকেন। ডাকিনী মা বলেন, গুরুদেব অস্থি আসনে বসে ক্রিয়া করতেন।
বললাম, সাধনায় আসনের গুরুত্ব কী মা?
ডাকিনী মা বললেন, দেবীর পূজায় কম্বল, চর্ম ও পাথরের আসনই উত্তম। গুরুদেবের আসনখানা ছিল হাতির মাথার। অস্থি আসনে হাতি ছাড়া অন্য কোনও আসনও চলবে না, বুঝলি। সাধকের তো আর রত্নখচিত আসনের দরকার পড়ে না। শাস্ত্রে আছে কাঠ, চর্ম, বস্ত্র ও তুলার আসনই হল গিয়ে উত্তম সিংহাসন—ন যথেষ্টা সনো ভূয়াৎ পূজাকর্ম্মনি সাধকঃ। কাষ্ঠাদিকাসনং কুর্যাৎ সিতমেব সদা বুধঃ।।
ডাকিনী মা যখন আসনের প্রশস্তি গাইছেন, ভৈরব তখন শিলামূর্তি স্থাপনায় ব্যস্ত ওই অস্থায়ী সাধন কুঠিয়ায়। স্থাপনা দিতে দিতেই বললেন তিনি, এঁরা সব তামসঘোর জানবি।
বললাম, কীরকম?
বললেন, সাধনায় রঙের রহস্যটা জানবি তুই মস্ত এক ব্যাপার।
বললাম, রং না দেবীদেবতার রূপারূপ?
ভৈরব বললেন, দেবদেবীরা তো সব হল গিয়ে অপরূপ শরীরের যুবকযুবতী, কেউ কেউ আবার কিশোরকিশোরী। অধ্যাত্মবাদে হামাগুড়ি দেওয়া গোপাল ঠাকুরও তো নমস্য।
এসবের মানেটানে কিছু আছে কি? নাকি সবই মনগড়া একটা ব্যাপার? আমার জিজ্ঞেসার পর আসনে বসা ভস্মমাখা লাল চোখের ভৈরবের দেখলাম কথা আছড়ে পড়তে থাকল।
তিনি বলতে থাকলেন, দেবদেবীরা সব সাধকদের রসলীলার আনন্দ রে। দেবদেবীদের ভেতরে সাধক নিজেরাই নিজেদের উপভোগ করে। তাই তো দেবদেবীদের নিয়ে গান, কীর্তন, উৎসব। এমন সাধনা সাধকদের খুব উপরের স্তরের ব্যাপার সব।
জিজ্ঞাসা করলাম, সাধনার ভেতরের স্তরখানা তবে কী, ভৈরব?
ডাকিনী মা তখন কালো শিলাখণ্ডটির অভিষেক করছিলেন। অভিষেক ঘটের জন্য মাটির বেদি। বেদিতেই তামার একখানি থালার ওপর তিনি অভিষেক কলস বসিয়ে দিলেন এবার। বেদিতে লাল, সাদা, সবুজ, কালো, হলুদ—এই পঞ্চবর্ণের গুঁড়ি। অভিষেক ঘটে ভৈরব এবার একটুখানি গোলা সিঁদুর নিয়ে দক্ষিণাকালীর বীজমন্ত্রখানা লিখে ফেললেন। এর আগে সর্বপ্রথমে ডাকিনী মা বসিয়ে নিলেন গণেশ ঘট। বসাতে বসাতে বললেন, এসব সবই হল গিয়ে ভৈরব ঠাকুরের বলা ওই রঙের রহস্যকণা, বুঝলি।
বললাম, ঠিক ধরতে পারলাম না গো, মা।
ডাকিনী মায়ের গলায় নির্মাল্যের মালা। গায়ের রং ময়লা হলেও ওঁর শরীর থেকে দেখি সবসময়ই এক রহস্যময় জ্যোতি বের হয়। আমি মায়ের আলোতে ধুয়ে উঠতে উঠতে বুঝি আমার শরীরেও যেন ছিটিয়ে গেছে মায়ের সেই জ্যোতির উদ্ভাসিত রূপ। এ কী করে সম্ভব!
মা বললেন, ফুল দে শিলাবিগ্রহে।
আমার দেওয়া ফুল এবার ঘুরে গিয়ে পড়ল ডাকিনী মায়ের পায়ে। শরীর কাঁপছে। ভৈরব এসে কিছুটা নাড়িয়ে দেওয়ার পর ডাকিনী মা এবার বললেন, কালীমূর্তির রূপ বর্ণনা কর দিকি।
আমি বললাম, কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডমালা গলাতে, চুল ছাড়া, লাল রঙের জিভ। চোখদুটিও রক্তজবার। শাস্ত্রে এমনই বর্ণনা।
মা এবার মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, দ্যাখ তোর বর্ণনা এবার ওই রঙের রহস্যে গিয়ে ঠেকেছে।
ভৈরব বললেন, কালো শিলাখণ্ডটি রক্ষা মায়ের। নীলবর্ণ শিলা শ্যামা মায়ের আর হলদে শিলাখানা মা বগলার। এই হল গিয়ে আরাধ্যা রঙের রহস্য রে। রং দিয়ে রূপে যেতে হয়। রূপ ভেঙে এরপর অরূপখানায় আসা। ও খুব সহজ জিনিস নয় রে, বাবা। ঘটে শক্তিসঞ্চার করতে হয়। ঘট তখন হয় ব্রহ্মকলস। সেই কলসে সাধনশক্তি সঞ্চারিত করে ক্রিয়াদীক্ষা হয় আমাদের পরম্পরায়। ব্রহ্মকলসকে দীক্ষার সময় ভাবতে হবে গুরুর সাধকদের, এটা হল সিদ্ধিদাতা, দেবতা—স্বরূপ। এই ভাবনাতেও রঙের রহস্যশক্তি লেগে। তন্ত্র তো কেবল কালীপুজো নয়, বাপ।
তন্ত্র তবে কী? জিজ্ঞেস করলাম এবার।
ভৈরব বললেন, তন্ত্রে বাইরের জগৎখানা ফেলে ভেতরখানায় ঢুকতে হয়। বাইরের জগতে ভোগ লেগে আছে। ভেতরবাড়িতে গেলে যোগ আসবে। দীক্ষাটা হল পাত্রান্তর, বুঝলি?
বললাম, কীরকম?
বললেন, দীক্ষা শরীরখানাকে বদলে দেয়। পাকা শক্ত গুরু ছাড়া শরীরের বদল হয় না। শরীর বদলের জন্যই পূর্ণাভিষেক দীক্ষা। সবার আগে ক্রমদীক্ষা।
সেটা কী আবার!
ডাকিনী মা এবার বললেন, আদৌকালী ততস্তারা সুন্দরী তদনন্তরম। আগে কালী, পরে তারা, তারপরে ত্রিপুরসুন্দরীর সাধনা। এই ক্রমদীক্ষায় ব্রহ্মজ্ঞান আসে। ব্রহ্মসাধনায় প্রথমে কালী সাধনা করতে হয়। কালীর পর তারা সাধনা। শেষে তারারূপ নীল সরস্বতী। ওই সেই, ভৈরব ঠাকুরের রঙের রহস্য সাধনা।
ভৈরব তখন দীক্ষাদানের প্রস্তুতিতে লেগে গেছেন। আচমনাদি সেরেটেরে জগন্মাতার চরণচিন্তা করছেন। দীক্ষাপ্রার্থীর প্রথমে হবে শাক্তাভিষেক। তারপর পূর্ণাভিষেক। গত দু—দিন ধরে দীক্ষাভিলাষী দু—জন নিরামিষ খাচ্ছেন। হবিষান্ন খাচ্ছেন। পঞ্চদেবতা, নবগ্রহের পুজো আগেই হয়ে গেছে। চলছে ভূতশুদ্ধি। জ্যোতির্মন্ত্র ওঁ হ্রৌ ১০৮ বার জপ। জপমন্ত্রে কুঠিয়া উদ্বেলিত। দীক্ষাভিলাষীদের পরনে শান্তিপুরি ধুতি। আদুল গা। তাঁরা গণেশপুজো করছেন। গণেশ পুজোর পর অষ্টশক্তির আহ্বান। বিঘ্নরাজের পুজো যথাশক্তি করছেন ওঁরা আশ্চর্য নিবিষ্টতায়—গণেশায় নমঃ, ওঁ গণনায়কায় নমঃ, গণনাথায়, গণক্রীড়ায়, একদন্তায়, লম্বোদরায়, গজাননায়, মহোদরায়, বিকটায়, ধূম্রাভয় ও বিঘ্ননাশায় দেবতায়…
ডাকিনী মা এবার দীক্ষার্থীদের জন্য শিবভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিলেন। বললেন, মন্ত্রযোগ সাধনে খুলবে গুপ্ত দেহভাণ্ডার। আমার হাতেও নির্মাল্য। আমি মায়ের পায়ে দেওয়া পর ডাকিনী মা বললেন, দ্যাখো বাবা, জগজ্জননী মহামায়ার চরণছায়া পেতে এতদূর ছুটে এসেছ, তুমি। এবার ছুটতে হবে তোমায়, শরীরখানার মধ্যে। তোমার শরীরে রয়েছে এক অলৌকিক ত্রিশূল। তন্ত্রমার্গে এ হল কুঞ্জি। চাবির গোছা। আজ তোমার মন্ত্রদীক্ষায় সেই কুঞ্জি তোমার হাতে এখন। তুমি শরীরখানা খোলো। শরীরে তোমার শিবমহিমার তিনখানা খোঁচা—সত্ত্ব, রজঃ ও তমের খোঁচা। আদতে ওই তো ত্রিশূল। শূলপাণি ভগবান। শরীরখানা ছিন্নভিন্ন করতে হবে সাধনায়। মহাপ্রলয় ওখানেই।
ভৈরব এবার আমাদের হাতে নরকপাল দিলেন। বললেন, এতে করে এখন থেকে মহামায়ার প্রসাদ পাবে। ক্রিয়াভিষেকও করবে।
আমরা মানুষের মাথায় সেই শুকনো খুলিতে সেদিন শাক্তাভিষেক, অধিবাস পুজো, ভূতশুদ্ধি, গণেশ পুজো, অন্যান্য দেবতাদের পুজো, অভিষেক ঘট স্থাপনা, গণেশ ঘটের প্রবর্তনার পর পূর্ণাভিষেকে গেলাম। ডাকিনী মা আমাদের দিলেন কুঞ্জি ত্রিশূল। এভাবেই মহাপূর্ণদীক্ষা অভিষেক হল।
নরকপালে প্রসাদ পেয়ে আমরা খুলি ধুয়ে ফেললাম ভৈরবীর জলে। দামোদরে তখন জোয়ার। ভৈরবী ফুঁসছে যেন আমারই ভিতরে। ও কী মন্ত্রক্রিয়ার গুণ! আমি ধরতে পারছি না। আকস্মিক বিদ্যুতের মতো আমার চারপাশে যেন রঙের রহস্য। অথচ রামগড়ের জঙ্গলে তখন থিকথিকে অন্ধকার। কুঠিয়ার প্রদীপ জ্বেলেছেন ডাকিনী মা। মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষধারী ভৈরব বলছেন, ব্যোম ব্যোম ব্যোম ব্যোম ব্যোম, শিবশম্ভু শিবশম্ভু।
গুপ্তরঙ্গিণী
ডাকিনী মায়ের সঙ্গে সেবার গিয়েছিলাম আমরা কলজেখাকির কবরে। কবরে বসে মা খানিক সম্বিদায় টান দিলেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রসারে চার রঙের চার ধরনের সম্বিদার উল্লেখ পেয়েছিলাম পড়তে গিয়ে। আগমবাগীশ বলেছেন মাতৃপূজা ও সাধন শুরুর আগে মনকে ফুরফুরে করে নিতে সম্বিদা গাঁজায় সাধককে টান দিতে। ভৈরব বললেন আমায়, ভালো সম্বিদা নারীবৃক্ষে জন্মায়। গাছের মাথায় জট পরে। পুরুষ গাছের সম্বিদায় নেশা তো ধরে না রে। ডাকিনী মা বললেন, সম্বিদার ধোঁয়ার ভেতর মোহিনী বাস করে। বললাম, মোহিনী কী মা?
মা বললেন, মোহিনী পথ ভোলানোর নারী রে। কুলসাধনায় দুইজন নারীর হাত হতে সাধককে প্রথমে পরিত্রাণ পেতে হয়। তবেই সাধনার মুখখানা খোলে। প্রকৃতির চক্রান্ত হল গিয়ে মোহিনী। ওর মায়ায় যদি ঠকে যাও তাহলে সব গেল তোমার। সম্বিদারও তো এক চক্রান্ত আছে রে।
বললাম, কীরকম সেটা, শুনি!
ডাকিনী মা এবার মৃদু হাসলেন। কলজেখাকির কবরে তখন চেরাগ জ্বেলেছেন ফকির আলি। ভৈরব ওঁর পাশে বসে বললেন এবার, এ চক্রান্ত বেটা, আশমানি খেয়ালের।
ডাকিনী মা আমাকে বললেন, সাধনার প্রথম সোপানটা হল গিয়ে কল্পনাবৃত্তিখানিকে সতেজ করে তোলা।
জিজ্ঞাসা করলাম আমি, সেটা কীরূপে সম্ভব, মা?
মা বললেন, শরীরখানা আদতে তো জড়বস্তু রে, বাপ। ওর মধ্যে যখন চেতন আসে সেই চেতনখানাকে আকাশের মতন খানিক ছড়ায়ে দিতে হবে তোকে।
বললাম, চেতনে তো মা ইন্দ্রিয়বোধও লেগে। ও কী আর দেহখানাকে চট করে আকাশের কল্পনা আনতে দেবে গো, আমায়?
ভৈরব বললেন, আত্মসুখী ব্যভিচারী হলে চলবে কেন, বাপ? কাম—কামনাটা জানবি তুই, দেহের স্বভাব। তোর স্বভাব নয়। ওই স্বভাবে যদি চেতন রূপখানাকে তুই দেখতে শুরু করিস তো দেখবি, তোর ওই কাঁচা চেতনে প্রেম ধরেছে। ও প্রেমে তরঙ্গ বইছে… আনন্দ… পরমানন্দ। গুরু আমাদের একাহারী সাধন করতেন দেখেছি। মা—গুরু আটা, ছাতু, ভিজানি ছোলা, সবজি—টবজি দিয়ে একখানা মোটা মতন পরোটা ভাজি দিতেন, সারা দিনমানে ওই পরোটাখানাই তিনি ছিঁড়েছুড়ে মাঝেমধ্যে মুখে দিতেন। ওর থেকেই আবার প্রসাদ পেতাম আমরা। বোঝ তবে আমার একাহারী গুরুর আহার।
আর কিছু খেতেন না, গুরুজি? জিজ্ঞেস করলাম আমি?
খেতেন তো। ওই খাওয়ার মধ্যেই তো আশমানি খেয়াল গেলে, বাপ।
বললাম, তার মানে সম্বিদা গাঁজার সেবা নিতেন, গুরুজি।
ডাকিনী মা বললেন, সাত পাকের দেহ। সেই দেহের ভিতরবাড়িতে শিব ঘুমায়ে গেছেন।
বললাম, শিব কী মা?
মা—গুরু জর্দা ভরা মুখ নিয়ে হাসলেন। বললেন, তোর পাকে পরিপাক দেবে তো ওই ভিতরবাড়ির শিব।
জিজ্ঞেস করলাম, সে পাক আবার কীরকম?
ভৈরব বললেন, রস রক্ত মাংস মেদ অস্থি মজ্জা ও শুক্রবস্তুর পাক মারা ওই শরীর। ওর ভিতরে চেতনখানা রয়েছে, বাপ তোমার তমোগুণে আচ্ছন্ন হয়ে। ওই হল গিয়ে জড়ত্ব। ওকেই অগ্নিময় করতে হবে কুণ্ডলিনী দিয়ে। অগ্নি ছড়ায়ে দেবে তাপ। সেই তাপে তোর শরীরখানা জড়ত্ব ভেঙেভুঙে তখন আকাশের মতন ছড়ায়ে পড়বে। ওই হল গিয়ে সাধকের আশমানি খেয়াল।
বললাম, উপনিষদেও এই আকাশ ভাবনার কথা আছে। বলা হচ্ছে সেখানে, শরীরখানাকে নিশ্চল করে আকাশের মতন ছড়িয়ে দিতে।
ডাকিনী মা বললেন, ও ভাবনা কী এমনি আসে রে। ও যে বড় কঠিন ব্যাপার। জড় শরীরে আশমানি খেয়াল আনা অত সোজা নাকি রে! ভৈরব তো বলে দিলেন।
কলজেখাকির কবরে তখন গাঁজা চলছে। গাঁজা কেটে, বীজ বেছে, রক্তচন্দন দিয়ে, গোলাপজল মিশিয়ে আমি তখন কলকে এগিয়ে দিয়েছি ভৈরবের দিকে। মালবাহী ট্রাক থামিয়ে কবরে এসেছেন সব ফকির আলির মুরিদরা। পরিশ্রমের পর একটু প্রসাদি সেবা পাবেন তাঁরা। কেউ এসেছেন বোতল ভরা দুধ, মিষ্টি এনেছেন কেউ, কারও হাতে ফলের ঝোলা। সবই তাঁরা কলজেখাকির কবরে আজ গুরুপ্রণামী দেবেন।
কবরে আমরা তখন বসে। ফকির আলি আজমীড় থেকে ফিরে খাজা বাবার রক্তগোলাপ এসেছেন মাকে দেবেন বলে। এনেছেন প্রসাদি সুরমা। ডাকিনী মায়ের চোখে সুরমা পরিয়ে দিলেন ফকির। ভৈরবের গা থেকে আতর গন্ধমাখা গাঁজার সুবাস বের হচ্ছে। ভৈরব বলছেন আমায়, ফুঁক দে ফুঁক, খা না ক্যানে তুই?
হাতে আমার প্রসাদি কলজে। ধরে আছি আমি। না খেয়েই গন্ধে আমার নেশা উঠেছে যেন। ডাকিনী মা বললেন, গাঁজা সাধুর খাদ্য। তোর ডুবন্ত মনখানা ভাসায়ে নিতে পারে ওই সম্বিদা। মন ভাসলে কল্পনাগুলা কলজেখাকি হয়ে উঠবে তোর। ভৈরবের বলা সেই আশমানি খেয়াল জাগবে মনে।
নেশা ধরেছে যেন আমার। ভৈরব হাতে দিয়েছেন এবার দুধের প্রসাদি বোতল। ফকির আলি কলজেখাকির কবরে চড়ানো মিষ্টিও ভরে দিলেন আমার মুখে। সব মিলিয়ে আমার তখন তো ওই আশমানি দশা। সেই দশাতেই আগমবাগীশ মশায়ের কথাটা ভাবছি আমি। চৈতন্যদেবের সময় পার হয়ে গেছে নবদ্বীপে। তন্ত্রের কুলসাধনা নিয়ে রমরমা নবদ্বীপ। আগমবাগীশ পুজো সারছেন মায়ের। ঘটপুজোর আগে মনকে আনন্দে রাখতে সম্বিদার সেবা নিচ্ছেন তিনি। তন্ত্রপুথিগুলোকে এক জায়গায় এনে তিনি সন্ধ্যাপূজার আগে সম্বিদার সেবা নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন সাধককে।
ডাকিনী মা বললেন, কামাখ্যা থেকে একবার গেলাম মায়াং।
আমি বললাম, সে তো মণিপুরের কাছে। শুনেছি মায়াং তান্ত্রিক গুরুমায়েরা সব পুরুষদের ভেড়া বানিয়ে ফেলতে পারেন। মায়াং তন্ত্রে এসব লেখাঝোকা আছে।
আমার কথা শুনে এক ভুবন কাঁপানো হাসি দিলেন এবার ডাকিনী মা। বেশ জানি এই হাসিতে মায়ের অর্জিত শক্তি এবার বেরিয়ে আসবে। গলার আওয়াজই পালটে যাবে, মায়ের।
হোমে বসবেন মা। কলজেখাকির কবরে একজন এলেন তখন মায়ের আটনে। মা তখন ডাকিনী আধারে বিরাজিতা। মায়ের পাশে আমি আশমানি দশায় গঙ্গার মাটি দিয়ে একখানা শিবলিঙ্গ বানাচ্ছি। ভৈরব এবার আমার বানানো লিঙ্গশিবে ঝোলা থেকে বের করা খানিক চিতাভস্ম লেপে দিলেন। ডাকিনী মায়ের হাতে গুরুদেবের দেওয়া ব্রহ্মদণ্ডী। সেই দণ্ডীর মাথায় টোকা খেলে আমার আধকপালি মাথার যন্ত্রণা কমে। ডাকিনী মা সেই ব্রহ্মদণ্ডী দিয়ে এবার শিবলিঙ্গে আঘাত করে দু—ভাগ করে দিলেন লিঙ্গ। মা কথা বলছেন পুরুষালি গলায়।
যে লোকটি মায়ের গলাতে কথা বলছেন তিনিই নাকি উচাটন বৃত্তিধারী! এই লোকটিই জ্বালাতন করছেন ওনাকে; এজন্য মায়ের কাছে উচাটন বৃত্তির ক্রিয়া করাতে এসেছেন।
লোকটি এখন আমার পাশে। তিনিই বলছেন আমায় মা যে গলাতে কথা বলছেন এবার সেই গলাখাকিই তার ভেতর উচাটন বৃত্তি দিয়েছে।
বুঝলাম মা উলটি উচাটন বৃত্তি দিয়ে এবার ভক্তলোকটির সমস্যার সমাধান করে দিতে চাইছেন।
ফকির আলির ভক্তরা মায়ের এ আচরণে চমকে গেছেন। মা কীভাবে এত পুরুষালি গলায় কথা বলছেন, আবার সেই গলাটি যার সে লোকটি মায়ের ভক্তকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। এসব শুনে ওঁরা সব আমাকে বলছেন, আচ্ছা মা কী মারণ, উচাটন এসব জানেন বলে মনে হয়? আপনি তো মায়ের সঙ্গে অনেককাল আছেন বলে জানি। আমাদের মুর্শেদ বলেছেন, আপনি মায়ের শিষ্য ও সহায়ক।
বললাম, মা চক্রদশায় সিদ্ধা ডাকিনী। দেহের ভিতর বিদেহভাব আনাটা অত্যন্ত সহজ কাজ জানবেন। বেহাল মনকে সতেজ করা আর কী।
আমি যখন এসব বলছি তখন মা দেখছি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছেন। কলজেখাকিতে তখন সম্বিদার রসসাধনা চলছে। মা বলছেন, সম্বিদার ধোঁয়ায় থাকে মোহিনী।
বললাম, কে তিনি?
মায়ের গলায় এক মধুরা আওয়াজ। তিনি এখন ডাকিনী দশা থেকে নেমে এসে সাধারণ হয়ে উঠেছেন। তাঁর হাতে সম্বিদার প্রসাদি কলকে। খানিক প্রসাদ নিয়ে তিনি বললেন, মোহিনীরা সব গুপ্তরঙ্গিণী। ওরা শরীর খেতে পারে। রক্ত টেনে বের করে নিতে পারে শরীর থেকে। আমাদের মা—গুরু ছিলেন মোহিনী। তিনি নিজের শরীর কেটে রক্ত খেতেন। মা বলতেন আমায়, তেনার গুরুমার গুরু তাঁর সম্মুখপানে নরবলি দিয়েছেন। বলির আগে তিনি রক্ত টেনে খেয়ে নিতে পারতেন। ভেতরকার কলিজার রক্ত খেতে পারতেন বলে তেনার নাম ছিল কলজেখাকি। এ হল তাঁর থান। এই থানে আমাদের গুরুদিদা মোহিনীসিদ্ধা হয়েছিলেন। কলজেখাকিতে সেই সিদ্ধাই বাতাস আছে। বাতাস ধরতে তাই তো এখানে মাঝেসাজে আসা।
বললাম, বাতাস কী ধরা যায়, মা?
ডাকিনী মা বললেন, দেহটাই তো বাতাস ভরা রে। দেহে থাকে স্বরূপ আর বিরূপ। দেহবোধ যত তোর সূক্ষ্ম হবে, তত বাতাসে ওই মোহিনী জাগবে।
মোহিনী কী? আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।
মোহিনী হল স্বরূপখানার চিদানন্দ সত্তা। ওই সত্তা আনতে তন্ত্রসাধক সম্বিদা সেবন করেন। তন্ত্র স্থূল থেকে সূক্ষ্মে যাওয়ার পথ। তাই সম্বিদার ধুম দিয়ে কলজেটা আগে খেতে হবে তোকে। সেই কলজেতে যখন সচ্চিদানন্দ সত্তাটার দাগ ধরবে তোর, তখন সম্বিদার ওপর চালাকি আর কাজে আসবে না। তখন শ্বাস—প্রশ্বাসে তোর সূক্ষ্ম সম্বিদার মাতন। কখনো বিরাম নাই। তালে তালে সেই সম্বিদার সম্মোহনটা ধরতে পারাটাই তো সাধনা, বাপ। ভিজে কাঠে আগুন ধরালে প্রথমে দেখবি খুব করে গ্যাঁজলা বেরোয়। সম্বিদা তাই শরীরের কাঁচা দশাতে পড়লে ওইরকম ভিজানি কাঠের ঘোর তোলে শরীর। সেই ঘোরে কাঁচা দুধ খেতে হয়। ফলের রস। তুই যে বার বার মোহিনী কী, মোহিনী কী করছিস, তা ওই কাঁচানি ধোঁয়ার কথা। ধোঁয়া বন্ধ হোক। জিজ্ঞেসা কমে যাক মন থেকে,তখন দেখবি শূন্য মনে মোহিনী ভর করেছেন।
আমি তখন উচাটনের শিব ও সাদা সরষে এক করে মায়ের কথামতো শালু কাপড়ে বেঁধে ফেলছি। এই দ্রব্য উচাটন ভোগ করা মায়ের ভক্তটি নিয়ে যাবেন। শনিবার মাঝরাত্তিরে উচাটন দেওয়া সব্বোনাশার দুয়ারে ফেলে উলটি উচাটন দেবেন।
ডাকিনী মা বললেন, উচাটন হল কলজেখাকি মোহিনী। সে জেগে আছে ওই সম্বিদার মায়ায়।
বাসুদেবায় স্বাহা
শেষ চৈত্রের এলোমেলো হাওয়া উঠছে এখন মামা—ভাগ্নে পাহাড়ের গায়ে। কাছেই অঘোরীবাবার সমাধি। সমাধির তত্ত্বাবধায়ক গোপাল সাধু। তিনিই সমাধি ঝাড়পোঁছ করেন। ধূপদীপ জ্বালেন। তারপরই পাকুড়তলা ভেঙে চলে যান পিশাচ তান্ত্রিকের ডেরায়। অমাবস্যার নিশুত রাতে আমরা সেদিন চলেছি তখন বক্কোমুনির শ্মশানে। সেখানে বসে মরা মানুষের মুড়ো চিবোন পিশাচসিদ্ধ বাবা। নস্যি নেন। বাবার মড়ার মাথা চাবানো দেখি আর ভাবি, আমাদের মাছের মাথা চাবানোর সঙ্গে এর তো কোনও তফাত নেই! ঘেন্নাপিত্তিহীন নির্বিকার সিদ্ধ। ডাকিনী মা আমাকে বলেছিলেন, ও হল জন্মসিদ্ধ। শ্মশানের ইজারা ওর হাতে।
বললাম, কীরকম!
ডাকিনী মা বললেন, বাবা মড়ার মাথা চিবোয় আর পাকুড়গাছের মগডাল থেকে পেঁচো ভূতেরা হাড় ছুঁড়ে মারে।
আমি বলি, ভূত বলে আদতে কিছু নেই। ঠিক তখনই পাকুড় ডাল থেকে একটা হাড় এসে মাথার ওপর টোকা খেয়ে আমার পায়ের ধারে পড়ে। শ্মশানে থাকতে থাকতে আমার কোনও ভয়ডর নেই। আমি তো চমকাই না।
পিশাচসিদ্ধ বললেন, এ হল বক্কোমুনির পাকুড়তলা। সিদ্ধপীঠ। শরীরী কসরতে তুয়ার স্বয়ম্ভুকে জাগা না ক্যানে, তু? উঁয়ার ডানা ঝাপট্যে দে না ক্যানে, তু? তু শালা মনিষ্যি। রাতির বেলাই শ্মশানে আসিস ক্যানে? তুর কী ভূতের সাথে আড়ি আছেক? তুকে মা শিখায় লাই স্বয়ম্ভুর ভূত; দেখায় লাই শরীরী কসরতে কুণ্ডলিনীটোর ভূত? কুণ্ডলিনীর একান্নটি তরঙ্গঘেরা শক্তিপীঠ। উঁ তো আসল ভূত রে।
আমি দেখলাম এক বিঘৎ চওড়া আর ফুট—চারেক লম্বা বিনুনি করা জটাধারী এক মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, জ্যয় তারা। বাজারে যা দিকি প্যামানন্দো। আজ মাছপোড়া ভোগ হবে মায়ের। আমার গুরুবোন এ্যায়েছে তাঁর দলবল লিয়ে।
বুঝলাম, এই মাতাজি আমাদের ডাকিনী মায়েরই গুরুর মন্ত্রদীক্ষিতা আর পিশাচসিদ্ধ বাবার সাধনসঙ্গিনী।
মাতাজি বললেন আমায়, কালীকে খেবার দিব, ভূতকে দিব না? শিয়াল—ভূত—যুগিনীকে বাদ দিয়ে কি পূজা—হোম হয় মায়ের? তুর জন্যি মন্ত্র ছাঁটবক লাকি। ভূত—শিয়াল—পেত্নী ছাড়া কালীকে কুথাও দেখিস, বাপ? চ না ক্যানে তু, অঘোরী বাবার মন্দিরে। দলে দলে ওরা তুর হাত থিকা খাবার নিয়ে খাবেক।
বক্কোমুনির শ্মশানে আমার আবার চোখ খুলে গেল। আমি দেখলাম মা কালীকে চারধারে সব শেয়ালেরা ঘিরে রেখেছে। ডাকিনী মা আমাকে বলেছিলেন, শ্মশান হল অস্থিকঙ্কাল ছড়ানো এক ভয়ংকর জায়গা। সেইখানে তো শেয়ালরা ঘুরে বেড়াবেই। জায়গাটা আসলে আমাদের শরীরের মধ্যেকার সেই ভয়ংকর স্থান।
জিজ্ঞেসা করলাম, কোন জায়গার কথা বলছেন, মা?
মা বললেন, শিবা বা শেয়ালরা হল সব মানুষের শিবপ্রকৃতি।
বললাম, মানে?
মানুষের মঙ্গলস্বভাবখানা হল গিয়ে মহাভূতে শামিল। আর হাড়—কঙ্কালের রংগুলা সাদা বলে ওগুলা তো সব সত্ত্বগুণেরই প্রতীকখানা, বাবা। যখন মহাপ্রলয় আসতেছ্যে, তখন এই মহাভূতগুলা ও মরা শরীরখানার সত্ত্বগুণগুলা তো সব ছড়ায়ে ছিটায়ে পড়ে। সেই ছড়ানো দশার স্থিতিখানাই তো শিবা—শিবপ্রকৃতি। সাধকের ওই দশা চাই। সেজন্যিই তো শিবাভোগ দিতে হয়। শরীরের ভূতগুলাকে শান্ত করতে হয়।
আমি দেখছি পিশাচসিদ্ধের সাধনসঙ্গিনী মাতাজির হাতে এবার শিবাভোগের সেই পাত্তর। আমার পায়ের ধারেও ঘোরাফেরা করছে শেয়ালেরা। হাতে আমার মাছপোড়া। আমার হাত থেকে তা তুলে খেয়ে নিচ্ছে শিবা।
মাতাজি বলছেন আমায়, তু খা না ক্যানে প্রসাদ? তুলে ল্যে উঁয়ার মুখ থেক্যে।
মাতাজি শেয়ালের মুখ থেকে মাছপোড়া টেনে খানিক মুখে দিলেন নিজে আর বাকিটা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন এবার। আমি তো না করতে পারলাম না। জীবনে এই প্রথম আমি কোনও জানোয়ারের মুখের এঁটো খেলাম। আমার শরীরে কেমন এক ঘিনঘিনে দশা এসে গেল।
এরপর মামা—ভাগ্নে পাহাড়ের শিবশিলার পূজারির কাছে গিয়ে খানিক বসলাম আমি। তিনি অবাক করে বললেন, এ চত্বরে শেয়ালের কোনও গর্তই নাই। আসবে কোথা থেকে শুনি?
আমি বললাম, মাতাজি ভোগ দিলেন। শেয়ালরা সব ভোগ নিতে এল। আমি তো স্বচক্ষে দেখলাম পূজারিনি।
তিনি বললেন, মায়ের ভোগে শেয়াল আসে রে। ও যে আমিও দেখেছি। অথচ তল্লাটে কোনও শেয়ালের বাসা লাই। ও মা সিদ্ধাই। জাদুটোনা জানে।
শুনশান এখন মামা—ভাগ্নে পাহাড়ের আশপাশ। কাছেই অঘোরী বাবার জটা সমাধি। লোকে বলে আনন্দকানন। আমি তখন পথ হাঁটছি ডাকিনী মায়ের সঙ্গে। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা। পাহাড়ের মাথায় প্রশস্ত উপত্যকার মতো একটা জায়গা। ওদিকেই যাচ্ছি আমরা। মৃদু মোমবাতির এক আলো দেখতে পাচ্ছি এখন। তারই দিকে এগোতে এগোতে কথা চলছে আমাদের। মাকে বললাম, তন্ত্রে শিবাভোগ দেওয়া হয় কেন?
পাথর বেয়ে আমরা তখন ওপরে উঠছি। আমাদের সঙ্গে প্রেমানন্দজিও তো আছেন। ওর আদুল গায়ে পৈতে দুলানো। পিশাচসিদ্ধ ও মাতাজির সঙ্গে তিনি বছর দশেক হল আছেন। তিনি বলেছেন আমায়, প্রতিদিন নিশুত রাতে শ্মশানে একশো আটবার করে বলতে হবে ভূত—তাড়ানিয়া মন্তরটা। বললাম, কেন গো এ চত্বরে ভূত থাকে নাকি?
প্রেমানন্দজি বললেন, পাকুড়তলায় খেড়িয়ে থাকে ভূত। ভূতেরা বাদুড় হয়ে ঝুলে মুখ নীচা করে। ভূতেদের স্যাঙ্গাৎ আছে।
বললাম, কারা তারা?
কালপ্যাঁচা গো, কালপ্যাঁচা।
কী মন্তর পড়ো?
নাকে নস্যি ধরে প্রেমানন্দজি এবার বললেন, লুড়ি পাত্থর হাতে লিয়ে পাকুড়তলায় খেড়িয়ে বলি, ভূত আমার আসল পুত, পেত্নি আমার নকল ঝি—আয় খাবি আয় মরার ঘিলুর, গলে যাওয়া ভারি সুন্দর ঘি। ইসস্ মাইরি, মিছ্যা বলিনি। আয় না ক্যানে গাছের থিক্যা—সন্দ করিস্নি।
বললাম, এই হল তবে ভূত—তাড়ানোর মন্ত্র!
এই মন্তরে সাড়া আসে গো বাবু।
ভূতগুলো কথা কয় বুঝি?
হ গো বাবু, হ।
ছড়া কাটে বুঝি?
প্রেমানন্দজি তালে তালে মাথা হেলিয়ে বলতে থাকেন, লোটন ঘোষের মা, তার গুটা তিনেক ছা। সি বুড়িটো মর্যে যেচেক, শাদ্দ হবেক লা। লাশটা উয়ার পুড়া ক্যানে, গিলু টুকান্ খা। নিবা চিতার কাঠগুলান, ধরাই লিগে যা। তার গুটা তিনেক ছা—ফ্যেলায় যেছেক্ লাশটো উয়ার, চিতা জ্বালবেক্ না।
গ্রামবাংলার এই ভূত—তাড়ানিয়া মন্তর শুনে ডাকিনী মা এবার হেসে ওঠেন।
প্রেমানন্দজি এর পরও সরল বিশ্বাসে আমাকে বলেন, কলকাতায় ভূত লাই বুঝি? কলকাতায় মন্দিরে মা লাই বুঝি? কালী মা বাবার বুকে পা—টো দিছে। পা—টো লিয়া বুকের উপ্প্যর, সি বাবা—শিব ঘুমায় যেছেক। ইঁ তে ভূত গো বাবু। ভূত মানে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কলন গো। পিশাচ সাধু বলে, জ্যয় জ্যয় ভোলানাথ বলে হাঁকাড় মার প্যামো…
ডাকিনী মা এবার কথার খেই ধরেন। আমরা মৃদু মোমবাতির কাছাকাছি চলে এসছি। মা বললেন, পশুরূপাং শিবাং দেবীং যো নার্চয়তি নির্জনে। পশুরূপিণী শিবাদেবীকে নির্জন জায়গায় অর্চনা করতে হয় সাধককে। শিবাভোগ না হলে শিবা সাধকের জপ, পূজার সুকৃতিগুলো নিয়ে শাপ দিয়ে নির্জনে রোদন করতে থাকেন। শিবাদেবীকে প্রসন্ন না করলে সাধকের সাধনকর্মের পুণ্যফল সব নষ্ট হয়ে বসে।
আমি ভাবছি তাই মাতাজি কালী কালী বলে তখন আহ্বান আরম্ভ করলেই শিবারূপধারিণী মা সেখানে উপস্থিত হলেন। না হলে শেয়াল না থাকা জায়গায় শেয়াল আগেই বা কী করে! শিবশিলার পূজারি তো তাই বলেছিলেন আমায়। চত্বরে কোনও শেয়াল নেই। শেয়াল সব এখানকার সাঁওতালরা সাবার করে দিয়েছে।
আমরা এসে পৌঁছেছি এবার উপত্যকার ছোট এক মন্দিরে। আলোয় দেখছি এক নওল সাধিকা। সম্পূর্ণ উঙ্গল হয়ে তিনি বসে আছেন। সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন ওঁর ভৈরব। সাধিকার ঠোঁটে চলকে উঠছে হাসি। চুলগুলো খোলা, পিঠ ছাড়িয়ে কোমরে নেমে পড়েছে। সাধক তাঁকে ডাকছেন, মহামায়া বলে। বুঝলাম বিপরীত বিহার চলছে। পিশাচসিদ্ধ বলছেন, ও ক্রীং ক্রীং, হুং হুং, হ্রীং হ্রীং ওঁ… মাতাজি বলছেন, ‘ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায় বাসুদেবায় স্বাহা…
আমার আর দেখতে ইচ্ছে করল না। আমি সরে এলাম। এসেও দেখছি আওয়াজের নিস্তার নেই কোনও। শুনতে পাচ্ছি সাধক বলছেন, এস মা আমার সত্তার গভীরে। এস মহামায়া, শ্যামা আর রাধা হয়ে। এস কালী হয়ে…
বুকের ভেতর কেমন এক ধরফরানি আমার তখন। কেমন যেন এক অপরাধবোধ কাজ করছে। এ কোথায় এলাম আমি। কী দেখলাম। দেখা ঠিক হল কী! মনে আমার নানা ভাবনার উৎপাত। ডাকিনী মাও তো নেই যে আমাকে শুশ্রূষা দেবেন।
এমন সময় পাহাড় ঘিরে গান উঠল। সে গান যেন বলতে লাগল আমায়, এখনও অনেক দেখা বাকি। পথ চলা বাকি। দেখাই তো নিরসন করতে পারে হাজার জিজ্ঞাসার।
আমি দেখছি মত্ত মাতন। অন্ধকার প্রকৃতির রূপ। তারই ভেতর সুরঢালা একরূপ। মাতাজি গাইছেন। মন্দির—গুহার চাতালে বসে তিনি। তাঁকে আমি দেখতে পাচ্ছি না :
ঝিঞ্জা ফুলের বুকের ভিত্যর,
নোলা লাগাই মধ্যু খেছে ফড়িং রে—
মেয়্যার বুকে মধ্যু খেলে,
দুষটা ক্যানে হবেক রে—উ সমাজ, দুষ্টা ক্যানে…
পুরুষ—ম্যেয়ার হরষ মিটায়,
এক জনেকে আরেক তাতায়,
মেয়্যা লাফায় পুরুষ লাফায়—
কে ধরে কার দোষ রে,
সমাজ খালি চিল্লে মরে—নজ্জা নজ্জা করে রে!