সাইডিং

সাইডিং

টিফিনের সময়ে সোমনাথ বললে, ‘আমার মনে হয় যূথিকা তোর প্রেমে পড়েছে।’

যূথিকা আমাদের নতুন টাইপিস্ট। এই মাসখানেক হল চাকরি পেয়েছে। শ্যামবর্ণ কিন্তু মুখটি ভারি মিষ্টি। দেহটিও মন্দ নয়। না লম্বা, না বেঁটে। মাথায় অনেক চুল, তা না হলে অত বড়ো খোঁপা হয় কী করে। চোখে সোনালী ফ্রেমের ফিনফিনে চশমা। হাসলে গালে টোল পড়ে। সামনে দিয়ে চলে গেলে হৃদয়ে দোলা লাগে। অফিসে আরও মেয়ে আছে, তবে তাদের কেউ না কেউ দখল করে বসে আছে। যেমন সোমনাথ রেবাকে। একমাত্র যূথিকাই ফ্রি আছে। আর অপরপক্ষে আমরা দু-জনে, আমি আর বিধান। বিধানের সম্প্রতি ফ্লু হয়েছে। অফিসে আসছে না।

‘কি করে বুঝলি?’

‘টাইপ করতে করতে মাঝে মাঝেই তোর দিকে তাকিয়ে থাকে।’

আমি যেখানে বসি তার পেছনেই বিশাল একটা জানালা। সেই জানালায় হাওড়ার পোল আটকে আছে। যূথিকা হয়তো পোলটাই দেখে। মেয়েরা অত সহজে প্রেমে পড়বে বলে বিশ্বাসই হয় না। বহুত কাঠখড় পুড়িয়ে তবে প্রেম। প্রেম কী যাচিলে মেলে, আপনি উদয় হয় শুভ যোগ পেলে।

‘আমার দিকে তাকায় না, আমার পেছনের হাওড়ার পোলের দিকে তাকায়।’

‘তোর দিকেই। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই কেমন ঘাবড়ে যায়।’

‘ঠিক বলছিস?’

‘ডেড সিয়োর।’

হতেও পারে। সোমনাথ ভেটারেন প্রেমিক। প্রেম কা কাচ্চে হিন্দি ছবিতে এইরকমই যেন কী একটা বলে। মেয়ে-ছেলে এক্সপার্ট। মেয়েদের চোখে চোখ রেখে মনের গভীরে ঢুকে যেতে পারে। কথায় বলে, এই সংসার-সমুদ্রে এমন কোনো মেয়ে নেই যাকে আমার চারে ভেড়াতে না পারি। বলে বলে লটকে আনব।

সেই সোমনাথ যখন বলেছে তখন সত্যিই হয়তো যূথিকা আমার প্রেমে পড়েছে।

‘আমার এখন তাহলে কী করা উচিত!’ প্রশ্নটা করে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগল! মেয়ে যেন প্রথম গর্ভবতী হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ চাইছে।

সোমনাথ গম্ভীর মুখে বললে, ‘নট ব্যাড। মেয়েটা ভালোই। পটাতে পারলে সহজেই পটবে। তবে প্রেম আর মামলা মকর্দমা একই নেচারের জিনিস। সময় দিতে হবে। ভালো খেলোয়াড়ের মতো খেলতে হবে, খেলাতে হবে। তোকে একটু স্মার্ট হতে হবে। এই ম্যাদামারা, ভিজে বেড়াল ভাবটা সামলাতে হবে। বি এ সোডা ওয়াটার বটল। মুখ খুললেই ভাব ভাষার গ্যাঁজলা বুজবুজ করে বেরোতে থাকবে।’

‘কিন্তু ব্যাপারটা তো এখনও মুখোমুখি হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে বললেও ভুল হবে। চোখা হয়েছে চুখি হয়নি।’

‘দ্যাটস ট্রু। তোমার সেই চোখকে এবার কায়দা দেখাতে হবে। চোখে চোখ মারতে হবে।’

‘ছি ছি ছি, চোখমারা খুব গর্হিত কাজ, লোফারদের কাজ। আমাদের পাড়ায় একটা মেয়ে আছে সে চোখ মারে বলে তার নামই হয়ে গেছে চোখমারা মিনু। ও ভাই আমি পারব না। ভীষণ শক্ত কাজ। একটা চোখ খোলা রেখে আর একটা চোখ পিচিক করে বোজানো।’

‘আরে সে চোখমারা নয়। এ হল নজরো কা তীর মারে কষ কষ—এক নেহি, দো নেহি, আট নও দশ। স্ট্রেট তাকিয়ে থাকবি প্রেমের পাওয়ারফুল দৃষ্টিতে। বিবেকানন্দের চোখ, মজনুর হৃদয় এই হল প্রেমিকের অ্যানাটমি।’

আমরা দু-জনে পাশাপাশি বসে কথা বলছি। চা দিয়ে গেছে চা খাচ্ছি। ওদিকে আমাদের আলোচনার সাবজেক্ট উলটো দিকের দু-সার টেবিলের ওপারে বসে খুটুস খুটুস করে টাইপ করে চলেছে। সোমনাথের কথা শোনার পর আমি একবারও ওদিকে তাকাইনি। যূথিকার পাশে বকুল, বকুলের পাশে রমা, রমার পাশে আশা সারি সারি যুবতী, যৌবন যায় যায় এমন সব মহিলা। সকলেরই কিছু না কিছু অ্যাফেয়ারস আছে।

সোমনাথ বললে, ‘তোর ড্রেসটাও পালটাতে হবে। এই মালকোঁচা মারা ধুতি আর দাদু মার্কা শার্ট চলবে না। কেমব্রিকের পাঞ্জাবি গোটা চারেক বানা। স্টিমলন্ড্রিতে কাচাবি। তিন দিনের বেশি পরবি না।’

‘বেশ কস্টলি হয়ে যাবে না!’

‘তা একটু হবে ভাই। প্রেম আর ব্যবসায় ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট কিছু থাকবেই! বিনা পয়সায় হয় না। সে হয় মেয়েছেলেদের। মেয়েরা হল রিসিভার। আমরা দিয়ে যাব, ওরা নিয়ে যাবে।’

‘কী দেবে?’

সোমনাথ বেমক্কা প্রশ্ন শুনে রাগরাগ মুখে তাকাল।

‘তুমি শালা জান না কী দেবে? যা দেবার তাই দেবে। প্রেম পাকলে বিয়ে হবে। বিয়ে হলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবি, লাভ ম্যারেজ। লাভ ম্যারেজ একটা ছেলের ইজ্জত কত বেড়ে যায় জানিস। লাভার হল হিরো, টক অফ দি টাউন।’

আমি একটু ঘাবড়ে গেলুম। প্রেম এবং বিবাহ। প্রেম জিনিসটা মন্দ নয়; কিন্তু বিয়ে! যূথিকার সঙ্গে বিয়ে মানে অসবর্ণ বিবাহ। মেরে ফেলবে। বাড়ি থেকে লাথি মেরে দূর করে দেবে। ত্যাজ্যপুত্তুর করে দেবে। আমার কোষ্ঠিটাও আবার তেমন ভালো নয় বদনামের যোগ আছে। চরিত্র নাকি চোট খাবে।

‘আচ্ছা সোমনাথ, শুধু প্রেম হয় না ভাই, বিয়ে বড়ো ঝামেলার ব্যাপার। ওটা অ্যাভয়েড করা যায় না?’

‘যায়, তবে কিছু স্টিকি মেয়ে আছে, আঠাপাতার মতো গায়ে লেপটে যায়, ছাড়ানো যায় না।’

‘যূথিকাকে তোর কী মনে হয়!’

‘আর একটু স্টাডি করে বলব। তবে জেনে রাখ প্রেমে অনেক হোঁচট থাকে। কাটা প্রেম ম্যাচিওর করে রে। হাতে গোনা যায়। আমাদের ইনসিয়োরেন্সের মতো। প্রিমিয়াম ল্যাপস করবেই। কেস ক্যাঁচ। ভেরি ডিফিকালট সাবজেক্ট। মেয়েরা প্রথম প্রেমে ধাত পাকায়, দ্বিতীয় প্রেমে খেলা করে, তৃতীয় প্রেমে দাগা খায়। তারপর যখন দেখে যৌবন যায় যায় তখন নাছোড়বান্দা হয়ে ঝুলে পড়ে। বিয়ের ভয়ে পেছিয়ে যাসনি। সিমটম যখন দেখা গেছে তখন ব্যাপারটা নিয়ে একটু ড্রিবল কর।’

‘কী ভাবে করব, বলবি তো?’

‘তুইও কাজ করতে করতে যখন তখন তাকাবি। চোখে চোখে ঠেকলে উদোবঙ্কার মতো ভয়ে চোখ নামিয়ে নিবি না। ধরে রাখবি, আস্তে আস্তে সময় বাড়াবি। চোখে হাসবি।’

‘চোখে হাসব কী রে! লোকে তো মুখেই হাসে।’

‘আজ্ঞে না স্যার। প্রেমিকার হাসি চোখে। রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করবি।’

‘ভয় করে।’

‘কী ভয় করে? কাকে ভয় করে? ভয়ের কী আছে রে। প্রেমে আর রণে ভয় পেলে চলবে না।’

‘আমাদের পাড়ার মধুকে একটা মেয়ে একবার জুতো মেরেছিল। মধুর অপরাধ সে মেয়েটাকে দেখলেই মুচকি মুচকি হাসত।’

‘মধু ইডিয়েট।’

‘ইডিয়েট! কেন ইডিয়েট!’

‘প্রথমে চোখে চোখে সইয়ে নিয়ে তারপর হাসতে হয়। দেওয়ালে পেরেক ঠোকা। প্রথম ঠুকুর ঠুকুর, তারপর ঠকাস ঠকাস।’

‘যদি আবার ঠকে যাই!’

‘ঠকে যাই মানে?’

‘এই তো তিন-চার দিন আগে। আমি যাচ্ছি, উলটো দিক থেকে একটা মেয়ে আসছে। পাড়ারই মেয়ে। মুখ চেনা। হঠাৎ হাসল আমিও হাসলুম। আমি হাসতেই তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। খুব নার্ভাস হয়ে গেলুম। ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে তাকালুম। আমাকে দেখে হাসেনি। সে হেসেছে আমার পেছনে একটা ছেলে আসছিল, তাকে দেখে। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল মাইরি! আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে কী হয়েছিল! মেয়েটা এত নিষ্ঠুর। কুকুরের মতো। ওয়ান মাস্টার ডগ।’

সোমনাথ সিগারেট খেতে খেতে বলল, ‘ওরকম একটু-আধটু মিসফায়ার হবেই। ভালো শিকারীর বন্দুক থেকেও মাঝেমধ্যে শিকার ফসকে যায়। প্রেমের পেছনে চোখ নেই। সাকসেসের রাস্তা হল লিপ বিফোর ইউ লুক। জহরব্রতের মতো, জয় মা বলে ঝাঁপ মারো আগুনে।’

সোমনাথ মেয়ে মহলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সিগারেট টানছে। যূথিকা বকুলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। একদিন আমার সঙ্গেও হয়তো হেসে হেসে ওই ভাবে কথা বলবে! জলজ্যান্ত একটা মেয়ে। চুল, খোঁপা, আঁচল। ভাবা যায় না! ভেতরটা কীরকম গুড়ুগুড়ু করে উঠছে। প্রেমের উপন্যাসে যা পড়েছি তা এবার সত্য হবে। হবে তো?

সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে চেপে ধরে সোমনাথ উঠে দাঁড়াল। আমার মাথার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে রে বাবা? লোকে হাত দেখে, কপাল দেখে, মুখ দেখে। মাথা দেখে বলে জানা ছিল না। সোমনাথ অ্যাস্ট্রলজি করে শুনেছি। অবশ্য নিজে কখনো সামনে হাত ফেলে পরীক্ষা করে দেখিনি, অ্যাস্ট্রলজি না হোয়ারোলজি।

সোমনাথ হাতের একটা আঙুল আমার চুলে ঠেকিয়েই চাটনি চাখার মতো করে তুলে নিল। ‘ইস ছি ছি, তুই চুলে তেল মাখিস? থার্ডক্লাস। কবে যে তুই মানুষ হবি! নো তেল। চুলে তেল মেখে প্রেম হয় না। প্রেম হল ফুরফুরে ব্যাপার। চুল ফুরফুরে, মন ফুরফুরে, প্রেম ফুরফুরে।’

সোমনাথ চলে গেল। আজ আবার ময়দানে খেলা। খেলার মাঠে যাবে। ঠিক ম্যানেজ করে অফিস কাটবে। আমাদের অত সাহস নেই। সাহস না থাকলে পৃথিবীতে কিছু করা যায় না। ক্রীতদাস হয়ে ফাইল রগড়াও। একবার আড়চোখে যূথিকার দিকে তাকালুম। না আমার দিকে তাকিয়ে নেই। মাথা নীচু করে টাইপ করছে? কানের দুল নড়ছে টিনিটিনি করে। কে কার প্রেমে পড়েছে? আমি যূথিকার না যূথিকা আমার। ভেবে লাভ নেই। দেখা যাক কী হয়।

টিফিনের পর দেখা গেল। ছোট্ট লেডিস রুমাল বের করে ঠোঁটের ঘাম মুছতে মুছতে যূথিকা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মাথা ঠোকাঠুকির মতো চোখে চোখে ঠোকাঠুকি হয়ে গেল।

সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলুম। চোখ নামালেও মনঘুড়িটা যূথিকার আকাশেই লাট খেতে লাগল। কমলালেবু রঙের শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজের হাতা ওপর বাহুতে খাপ হয়ে বসে আছে। একপলকের দেখা। কি জানি, আমাকে দেখছিল, না আমার পেছনে আকাশের টঙে হাওড়ার পোলের সদ্য রঙকরা ঝলমলে মাথা? সোমনাথ বলে যায়নি কতক্ষণ অন্তর দেখা উচিত। পরের বার যখন চোখ তুলে তাকালুম যূথিকা নেই। শূন্য চেয়ার। ধ্যাত তেরিকা, গেল কোথায়? এখন তো সবে তিনটে। ছুটি হতে পাক্কা দু-ঘণ্টা বাকি। এর নাম প্রেম। গঁদের আঠার মত চেয়ারে যদি আটকেই না রইল তাহলে আর প্রেম হল কী! বড়ো অভিমান হল। সোমনাথ বলার পর থেকে আমি একবারও সিট থেকে উঠিনি। সামান্য অদর্শনে প্রেম যদি চটকে যায়? সব সময় চোখের সামনে নিজেকে হাজির রেখেছি। দুয়ারে খাড়া এক যোগী। ধুর, প্রেম ফ্রেম সব ফলস। আসলে ক্লান্ত চোখটাকে নীল আকাশে একটু খেলিয়ে নেয়। আমার দিকে তাকাবে কেন? আমি কি সিনেমার হিরো। মেয়েরা হয় হিরোর প্রেমে পড়ে, না হয় ভিলেনের। আমি তো কোনোটাই নই। মাছিমারা কেরানি।

আমার একটু সকাল সকাল অফিসে আসা অভ্যাস। বাসে-ট্রামে ভিড় কম থাকে। তা ছাড়া চড়া রোদে রং কালো হবার ভয় থাকে না। দরজা দিয়ে ঢুকতেই বুকটা ছাঁত করে উঠল। যূথিকা এসে গেছে। কেউ কোথাও নেই। বহু দূরে নৃপেনবাবু টেবিলে জোড়া হাঁটু ঠেকিয়ে উট হয়ে খবরের কাগজ পড়েছেন। একটা পিয়োন খালি এসেছে। পকেট থেকে একগাদা কাগজ বের করে একমনে সারা মাসের ঘুষের হিসাবে ব্যস্ত। আড়চোখে যূথিকাকে একবার দেখে নিলুম। বেশি দেখব না। কালকের ঘটনায় আমার ভীষণ অভিমান হয়েছে। কথা বললে বন্ধ করে দিতুম। বলি না বলে বেঁচে গেল।

যূথিকা নীচু হয়ে টেবিলের নিচের ড্রয়ারটা ধরে টানাটানি করছে। সরকারি টেবিল। মাঝে মাঝেই ড্রয়ার আটকে যায়। আমাদেরও আটকায়। লাথালাথি করলে তবে খোলে। খেলোয়াড় না হলে যেমন প্রেম হয় না, সরকারি চাকুরিও করা যায় না। সবে একমাস চাকরি হয়েছে মহিলার এখনও অনেক কিছু শিখতে বাকি।

হঠাৎ মনে হল, এই সুযোগ। নাউ অর নেভার। পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী, খুলছে না? আটকে গেছে?’

উঃ! যূথিকা ওই নীচু অবস্থাতেই ঘাড় বেঁকিয়ে খোঁপা লতপতিয়ে আমার দিকে তাকাল। কী মনোরম, কী অপূর্ব, কী অসাধারণ।

‘দেখুন না খুলছে না। চাবি ঘুরে যাচ্ছে অথচ…’

‘একেই বলে কলের গ্যাঁড়াকল।’ বা: বেশ বলেছি। স্ট্রেট বলেছি, একটুও আটকায়নি।

‘দেখি, সরুন। এসব লোয়েস্ট কোটেশানের মাল। খোলার কায়দা আছে।’

যূথিকা সোজা হল। এতক্ষণ হেঁট হয়েছিল। আহা মুখটা বেগুন হয়ে গেছে। আমি উবু হয়ে চেয়ারের পাশে বসে পড়লুম। ধুতি পরার এই সুবিধে। আমার মুন্ডুর একেবারে পাশেই যুথিকার জোড়া কল। সেন্টের কি প্রসাধনের গুমোট গন্ধ। ফ্লোরে শাড়ির ঘের ছড়িয়ে আছে। ভেবেছিলুম আমাকে বসতে দেখে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা বঁধুর মতো একটা ভাব করে সরে বসবে। না সেসব কিছুই করল না। একেবারে সহজ। যেমন ছিল তেমনিই বসে রইল জমাটি হয়ে। উঃ সোমনাথ, মার দিয়া কেল্লা। যূথিকার একটা হাত তখনও চাবির ওপর।

‘কই দেখি?’

গলাটা একটু কাঁপা কাঁপা মনে হল। হাতে হাত ঠেকল। যেন শক খেলুম। ঠিকই, মেয়েদের শরীরে বিদ্যুৎ আছে। ঠেকলেই ঝটাস করে মেরে দেয়। প্রথম প্রথম ডি সি। তারপর কনভার্টারে পড়ে এ সি। আঁকড়ে মাঁকড়ে ধরে।

চাবিটা বোঁ করে ঘুরে গেল। বা: বেশ কল তো। জয় মা, দেখো মা, খুলে দাও মা। প্রেম একবারই জীবনে আসে। বেইজ্জত করে দিও না। খুলতে পারলেই হিরো। ডানদিকে ঘোরাচ্ছি আর কায়দা করে টানছি। আমার ড্রয়ারটাও এই একই অবস্থা, ওয়ান, টু, থ্রি। কী গুরুবল! খুস করে খুলে গেছে।

‘এই নিন।’ আমার সারা মুখে বিজয়ীর হাসি। দাও শ্যামা সুন্দরী গলায় বরমাল্য পরিয়ে দাও। এত বড়ো একটা দুরূহ কাজ করে দিলাম। হরধনু ভঙ্গের মতো ব্যাপার।

‘খুলেছে?’ যূথিকা ঝুঁকে পড়ল। ডান গালটা আমার মুখের কাছে। ধন্যবাদ টন্যবাদ দেবার কোনো ইচ্ছেই নেই। কাগজ, কার্বন বের করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জাত টাইপিস্ট। কোথায় প্রেম? উঠে দাঁড়ালুম। পা ব্যথা হয়ে গেছে। আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? এতবড়ো একটা ব্যাপার ঘটে গেল, মনে রেখাপাত করল না। কী মন রে বাবা! মা কালীর মতো পাষাণী। এদিকে বকুল এসে গেছে। আমাকে যূথিকার চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। আমার কৃতিত্বটা জানিয়ে দেওয়া দরকার।

‘বুঝলেন, আটকে গিয়েছিল। ঘোরে কিন্তু খোলে না।’

বকুল হাতব্যাগ রাখতে রাখতে বললে, ‘কী আটকে ছিল?’

আমাকে উত্তর দিতে হল না, যূথিকা টাইপ মেশিনে কাগজ আর কার্বন পরাতে পরাতে বলল, ‘ড্রয়ারের চাবি।’

বকুল বললে, ‘মুখপোড়া ড্রয়ার, ভেঙে ফেলে দে না!’

আমি হেলে দুলে ধীরে সুস্থে বেশ খেলে খেলে নিজের সিটে গিয়ে বসলুম। চোখ বুজিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাববার মতো ব্যাপার। এর পর কী! সোমনাথ আসুক। বেলা বারোটার আগে আসবে না। ততক্ষণ একটু কাজের অভিনয় করা যাক। তাড়াতাড়ি একটা প্রমোশন চাই। বলা যায় না, যদি ফেঁসে যাই, বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করলে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে। তখন এ মাইনেতে সংসার চলবে না।

সোমনাথ এসে গেল। বসতে না বসতেই শুরু করে দিলুম। সিগারেট খেতে খেতে মন দিয়ে শুনল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘এইবার? হোয়াট নেক্সট।’ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোমনাথ বললে, ‘কত আছে?’

‘কী কত আছে?’

‘হার্ড ক্যাশ?’

সে আবার কী! হার্ড ক্যাশ দিয়ে কী হবে? দু-দশ টাকা পড়ে আছে। মাস শেষ হতে চলেছে!

‘গোটা পনেরো টাকা পড়ে আছে। কোনোরকমে মাসটা চলবে।’

‘ওতে হবে না রে! তোর একটা প্রেমফান্ড তৈরি করতে হবে। মিনিমাম পাঁচ-শ নিয়ে নামতে হবে।’

‘পাঁচশো! অত টাকা পাব কোথা থেকে?’

‘কে-অপারেটিভ থেকে লোন নে, আমি গ্যারান্টার দাঁড়াচ্ছি।’

‘ধার করে প্রেম!’

‘শাস্ত্রেই আছে ঋণ করে ঘি। প্রথমে পাঁচ-শো তারপর কেস বেশ জমে গেলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে! তোর পাড়ায় লাইব্রেরি আছে?’

‘হ্যাঁ আছে।’

‘মেমবার?’

‘এক সময় ছিলুম। চাঁদা বাকি পড়ায় ছেড়ে দিয়েছি, একটা বই মেরে দিয়েছি।’

‘বেশ করেছিস। আজই আবার মেমবার হয়ে যা।’

‘লাইব্রেরির মেমবার হবার সঙ্গে প্রেমের কী সম্পর্ক? লেখা পড়া করতে হবে না কী!’

‘আজ্ঞে না। অফিসের মেয়েরা বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। কালকে তুই…’

‘কালকে তুই কী করবি!’

‘তুই একটা বই হাতে, মলাটের দিকটা সামনে করে যুথিকার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবি, হেসে হেসে জিজ্ঞেস করবি—কি ড্রয়ার আটকে গেছে নাকি।’

‘তারপর?’

‘তারপর বইটা হল টোপ! কী বই দেখি? ব্যাস বইটা দিবি পড়তে। দিবি আর নিবি, নিবি আর দিবি। দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে।’

‘ভীষণ ভয় পাই রে! ছাত্র জীবনে এক পড়ুয়া মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলুম। বইয়ে পর বই দিয়েই যাই, ফেরত আর পাই না। সাহস করে চাইতেও পারি না। বই পেয়ে খুশি খুশি ভাব। মেয়েদের খুশি করে ছেলেরা কীরকম আনন্দ পায় ভাবো! বই ফেরত চাইলে যদি রেগে যায়। সেই ভয়ে মাইরি দিয়েই যাই। আমি দিতে থাকি সে নিতে থাকে। হাতে তেমনি পয়সাও নেই। জলখাবারের জন্য রোজ এক আনা বরাদ্দ। তিরিশ দিনে তিরিশ আনা। পাঁচটা রোববারে পাঁচ আনা বাদ। তার মানে পঁচিশ আনা। এদিকে যাদের যাদের কাছ থেকে বই এনে পড়তি দিয়েছি তারা বই চেয়ে না পেয়ে খেপে বোম। একদিন সবাই মিলে রাস্তায় চেপে ধরে বেধড়ক ধোলাই দিলে। তিনমাস জলখাবার বন্ধ রেখে যার যার বই কিনে ফেরত দিলুম। আর আমার কুমকুম!’

‘কুমকুমটা কে?’

‘আরে সেই বই-মারা মেয়েটা। কি জিনিস মাইরি। পরে জেনেছিলুম এই মেয়েটা আমাদের মতো একটু বোকা ছেলে ধরে ধরে সেই কই মেরে নিজের বাড়িতে একটা লাইব্রেরি তৈরি করেছিল। একটু মিষ্টি হাসি, সুর করে টেনে টেনে কথা, উয়ু: কী সুন্দর, কী সুন্দর, ব্যাস, আমরা কাত। গিলোটিনে মাথা পেতে বেহেড।’

সোমনাথ ফুস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল:

‘তোর প্রেম নেই। তোর দ্বারা প্রেম হবে না। শালা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বেনেদের মতো মেন্টালিটি। প্রেমিক আর যোগী একই মনের মানুষ একজন মেয়ে পাগল আর একজন ব্রহ্মপাগল। পাগল না হলে প্রেম হয় না। শ্যান পাগল বুঁচকি আগল হারা, তাদের জন্যে সংসার, হিসেবের খাতা, বগলের ছাতা, মুতো কাঁথা।’

‘তুই বুঝসিস না, আমার এখন একস্ট্রা খরচ করবার মতো টাকা নেই ভাই। একটা বইয়ের দাম আট টাকা, দশ টাকা, পঁচিশ টাকা। মেরে দিলেই হাতে হ্যারিকেন।’

‘তবে হাঁ করে বসে থাক। ওদিকে বিধান ভিড়ে পড়ুক।’

সোমনাথ আর কথা না বাড়িয়ে একটা পুরোনো বস্তাপচা ফাইল খুলে বসল। ওরকম ফাইল আমার টেবিলেও গোটা কতক আছে। একটা খুললেই সারাদিন হেসেখেলে চলে যাবে। বাইরের আকাশে চাঁপা ফুলের মতো রোদ খেলে যাচ্ছে। ফুরফুরে বাতাস। এমন দিনে কী মানুষের দুঃখ কষ্টের ফাইল খুলে বসে থাকা যায়। রাজ্যের আরজি। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ চিত্র দুটো বাদামী মলাটের তলায় যতদিন চাপা থাকে ততদিনই ভালো। কল্পনায় যূথিকাকে নিয়ে বোটানিকসে ঘুরে বেড়াই।

সোমনাথ চিঠি ড্র্যাফট করছে। আজ দেখছি কাজে খুব আঠা! দেশের উন্নতি না করে ছাড়বে না। ওদিকে প্রসূন গিয়ে যূথিকার টেবিল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। মুলোর মতো দাঁত বের করে খুব হাসছে। যূথিকাও হাসছে। কোনো মানে হয়। প্রসূন আবার ভালো রবীন্দ্র সংগীত করে। চাকরিতে যেমন প্রতিযোগিতা, প্রেমেও তেমনি। কোনো মেয়ের সঙ্গে একা প্রেম করার উপায় নেই। ফোড়ে, ফেউ জুটবেই। কেকের টুকরো। ডিশে রাখলেই পিল পিল পিঁপড়ে। এখুনি এক কলি গান থেকে কেল্লা দখল করে নেবে। দাঁত বড়ো বড়ো, গাল ভাঙা, চোখ বসা, এসবের কোনোটাই যূথিকার চোখে পড়বে না। গান গাইতে পারে, ব্যাস, সাতখুন মাপ। আমি নাচ দেখাব। ভাঙড়া নাচ। ধ্যুত, প্রসূনটা আচ্ছা হারামজাদা! কিছুতেই নড়তে চাইছে না।

‘সোমনাথ!’

‘বল।’

‘গান শিখবি?’

‘গান শিখে কি করব?’

‘ওই দেখ, প্রসূন ব্যাটা পাকাধানে মই দিতে গেছে।’

‘যাক না, তাতে তোর কী? ভ্যাকুয়ামে প্রেম করবি ভেবেছিস? ফেউ এর পর ফেউ আসবে। লড়ে জিততে হবে। রোপ ওয়াক। গেল গেল, এল এল। কোনো দিন ঘুড়ি উড়িয়েছিস? তুমি তো শালা জীবনে কিছুই করনি। শুধু জন্মে বসে আছে, প্রেম হল ঘুড়ির প্যাঁচ। কাটতে থাকে, কাটতে থাকে, একসময় ফাঁকা নীল আকাশ, প্রাণ খুলে ওড়া। নীলাকাশের সঙ্গে প্রেম।’

সোমনাথ আবার খসখস করে চিঠি লিখতে শুরু করল। আমি টেবিল থেকে উঠে পড়লুম। ওদের পাশ দিয়ে একবার চলে যাই। ননপ্লেয়িং ক্যাপটেন হয়ে বসে থাকলে চলবে না। যা ভেবেছি তাই। প্রেমে পড়লে সিকসথ সেনস বেড়ে যায়। প্রসূন বলছে, ‘এ মণিহার আমার নাহি সাজে’ রেকর্ডটা আমার আছে! কালই এনে দেবো। ঢং করে একটা সিকি পায়ের কাছে পড়ল। উঃ কী লাক! যূথিকার পয়সা ব্যাগ থেকে ছিটকে এসেছে। তাড়াতাড়ি তুলে দুবার ফুঁ মেরে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গেলুম।’

‘আপনার পয়সা।’

প্রসূন হাত বাড়িয়ে সিকিটা নিয়ে পকেটে ফেলে গম্ভীর মুখে বললে, ‘ধন্যবাদ। হাঁ হাঁ, আকাশ ভরা সূর্য তারাটাও আছে। কী নেই আমার কাছে।’

যা: শালা। কী বরাত। প্রসূনের পয়সা জানলে কে তুলত! পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যেতুম। প্রেম তুমি আমাকে উদ্ধার করো। বেশ জমিয়ে প্রেমে পড়ার আগেই কেন হিংসে এসে যাচ্ছে! কেন মনে হচ্ছে প্রেম বড়ো একতরফা। প্রেমে গলি কী ওয়ান ওয়ে? হৃদয়ের গাড়ি ঢোকে। ঢুকে আটকে যায়। বেরোতে গেলে ব্যাক করে বেরিয়ে আসতে হয়। আপাতত ব্যাক করে নিজের জায়গায় চলে যাই। মাথায় কিছু আসছে না। সোমনাথই ভরসা।

মুখ খোলার আগেই সোমনাথ বুঝে গেছে।

‘প্রসূন লাইন দিয়েছে। দেখেছি। তোর চেয়ে ভালো ক্যানডিডেট। শীতকালে কাশ্মীরী শাল গায়ে দেয়। পাঞ্জাবিটা দেখেছিস, চিকনের কাজ করা। ভালো গান গায়। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বেশ শক্তিশালী। বেশ কায়দা করে লড়তে হবে রে! মেয়েছেলের মন পদ্মপাতায় জল। যাক, তোর আর একটা সুযোগ করে দি। এই চিঠিটা টাইপ করতে দিয়ে আয়। বলবি ডবল স্পেসিং, দুপাশে মার্জিন। আর ফট করে জিজ্ঞেস করবি বিকেলে কী করছেন?’

‘যদি বলে কেন?’

‘কেন’টা আবার যদি খুব চিৎকার করে বলে! পাশে যারা বসে আছে তারা যদি শুনতে পায়!’

‘আ মোলো।’ সোমনাথ মেয়েলি ভাষায় গালাগাল দিয়ে উঠল। ‘রাশকেল যদি যদি করেই তোর জীবনটা যাবে। যদি-ফদি আবার কী! জীবন হল, ধর তক্তা মার পেরেক।’

‘যদি বলে কেন।’

‘আবার শালার যদি। বলবি সোমনাথ কোরবানীর টিকিট কেটেছে।’

‘একেবারেই জামপ করে অতদূর!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। একেই বলে বলিষ্ঠ অ্যাপ্রোচ। স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘা। যা যা।’ যূথিকাকে চিঠিটা টাইপ করার জন্যে দিতেই, সোমনাথের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। সোমনাথ ইশারায় হাতের ভঙ্গি মুখের হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল টাইপ। যূথিকা চোখের সামনে মেলে ধরে বললে, ‘কী সাংঘাতিক হাতের লেখা!’

আমি অমনি ফট করে বলে ফেললুম, ‘আমার হাতের লেখা খুব ভালো। মুক্তোর মতো।’ বলে ফেলতেই ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলুম। প্রেম মানুষকে জাহির করতে শেখায়। অহমটাকে খুঁচিয়ে তোলে। ভেরি ব্যাড।

যূথিকা বললো, ‘দেখেছি। শিল্পী শিল্পী চেহারা, শিল্পী শিল্পী কথা, মানানসই লেখা।’

যূথিকার কথা শুনে পা কাঁপছে। উরে ব্বাবা, প্রেমের ঘণ্টা বেজেছে ঢং করে। মুখে কথা সরছে না। কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে ফিরে এলুম।

সোমনাথ বললে, ‘কি হল? জিজ্ঞেস করেছিস? কী বললে? বিকেলে কী করছে?’

‘দাঁড়া এক গেলাস জল খাই।’

‘কেন? খিস্তি করেছে?’

জলের গেলাসটা নামিয়ে রেখে, হাত দিয়ে ঠোঁট মুছে ফিস ফিস করে বললুম, ‘মরে গেছি, ফিনিশ। বুকটা কেমন করছে।’

‘পেটে উইণ্ড হয়েছে। একটা পান খা।’

‘ভাগ শালা। বুকে হিল্লোল বইছে, হিল্লোল।’

‘কেন রে। চোখ মেরেছে!’

‘মোর দ্যান দ্যাট। তীর মেরেছে। তোর হাতের লেখার নিন্দে করে আমায় বললে, যেমন আপনার শিল্পী শিল্পী চেহারা, ঠিক সেই রকম আপনার কথাবার্তা, ঠিক সেইরকম আপনার মুক্তোর মতো হাতের লেখা।’

‘এইতেই তোর বুক ধড়ফড়। ওর গদিতে তোকে দিয়ে খাতা লেখাবে না কি! তোর গালে হাত দিলে কী করবি? দম ফেল করে মরে যাবি। শোন, কোনটা মেয়েদের কথা আর কোনটা কথার কথা, আগে বুঝতে শেখ। যা জিজ্ঞেস করে আয়।’

এবার আমার সাহস বেড়ে গেছে। বরফ যখন গলতে শুরু করেছে তখন আর ভয় কী। নদী বইবে কুলু কুলু। পাখি গাইবে গান, পিউ কাঁহা। গড়গড়িয়ে চলে গেলুম।

‘আজ বিকেলে কী করছেন?’

‘ক্লাস আছে।’

‘কীসের?’

‘স্টেনোগ্রাফির।’

‘ও।’

সোমনাথের কাছে ফিরে এলুম, ‘ওরে স্টোনোগ্রাফির ক্লাস আছে।’

‘বলে আয় ক্লাসফ্লাস যাই থাক, আজ সিনেমা।’

আবার যেতে হল, ‘ক্লাস-ফ্লাস যাই থাক, আজ সিনেমা ‘কোরবানী।’

‘কোরবানী।’ যেন লাফিয়ে উঠল। ‘কে বললে?’

‘গ্রেট সোমনাথ।’

‘ঠিক আছে।’

সোমনাথকে এসে বললুম, ‘ঠিক আছে।’

সোমনাথ বললে, ‘সিনেমার কথায় যে মেয়ে না বলবে, জানবি সে অসুস্থ। স্ত্রী-রোগে ভুগছে।’

সারাটা দুপুর পেটটা কেমন কেমন করতে লাগল। নার্ভাস ডায়েরিয়া। বেয়ারাকে দিয়ে দুটো ট্যাবলেট আনিয়ে খেয়ে নিলুম। বলা যায় না, হলে বসে প্রকৃতির বেগ এসে গেলে লজ্জার একশেষ হবে। একেই মেয়েরা গ্ল্যাডিয়েটার কিংবা বুল ফাইটার কিংবা কাউবয়দেরই ভালোবাসে। আমার আবার একটু মেয়েলি মেয়েলি ভাব। হরমোন খেয়ে পুরুষ পুরুষ হতে হবে।

দেখতে দেখতে বিকেল। সোমনাথের দু প্যাকেট সিগারেট উড়ে গেছে। অফিস প্রায় ফাঁকা। আমরা তিন জনে লিফটে করে নীচে নেমে এলুম। রাস্তায় সোমনাথ হাঁটছে আগে আগে। লিডার অফ দি টিম। পেছনে আমি। আমার এক কদম পেছনে যূথিকা। সোমনাথ আমাকে প্রেম করাতে নিয়ে যাচ্ছে। একেই বলে বন্ধুর মতো বন্ধু। বন্ধু হো তো অ্যায়সা।

বাইরের আলোয় যূথিকাকে একটু বেশি শ্যামবর্ণ মনে হচ্ছে। হলেও খারাপ লাগছে না। হাতে ফোলডিং লেডিজ ছাতাটা না থাকলেই ভালো হত। ছাতা হাতে তেমন রোমান্টিক লাগে না। যাকগে, যা করে ফেলেছে। সিনেমায় যাব বলে তো আর বাড়ি থেকে বেরোয়নি। বেরিয়েছিল অফিসে।

সোমনাথ ভস ভস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আগে আগে গটগট করে চলেছে। স্টিম ইঞ্জিন চলেছে। আমরা যেন দুটো বগি। পেছনে পেছনে চলেছি লাফাতে লাফাতে। ইঞ্জিন যে দিকে যাবে, বগিও সেই দিকে যাবে। ইঞ্জিন হেলেদুলে একটা নামজাদা রেস্তোরাঁর অন্ধকার গর্ভে গিয়ে ঢুকল। বেশ মনোরম পরিবেশ। প্রেমের সুখপাখি এমন জায়গাতেই পাখা মুড়ে বসতে পারে। ফিসফাস, খুসখাস, ঘেঁষাঘেঁষি। দুল, চুড়ি, গোঁফ, দাড়ি, ঘাড়, গলা, চিবুক সব একাকার।

সোমনাথ তো খুব গ্যাটগেটিয়ে মেয়ে বগলে ঢুকল। মেয়ে ঢুকল ছাতা বগলে। আমি ঢুকলুম কোঁচা বগলে। কিন্তু! কিন্তু আর যদিতেই আমার জীবনটা শুঁয়োপোকার মতো কুঁকড়েই রয়ে গেল। প্রজাপতি আর হল না। কত বিল হবে কে জানে। টাকা কে দেবে! আমার পকেটে পনেরো টাকা পড়ে আছে।

সোমনাথের বাঁ-পাশে যূথিকা। আমি বসেছি উলটো দিকে একা। সোমনাথ মেজর জেনারেলের মতো হাঁকল ‘ওয়েটার’। বাব্বা কী দাপট। ‘মেনু প্লিজ’। মেনুটা হাতে নিতে নিতে সোমনাথ বললে, ‘জিরাপানি।’ সেটা আবার কী রে বাবা! মেনুর ওপর আবছা চোখ বুলিয়ে পরের অর্ডার ‘রোগনজুস। নান। স্যালাড। আইসক্রিম ভ্যনিলা। মেনুটা ওয়েটারের দিকে ঠেলে দিল। হাত নিসপিস করে উঠল। একবার টেনে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করেছিল, ক-টাকার ধাক্কা। দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না। নেভি ব্লু স্যুট পরা ময়ূর ছাড়া কার্তিকের মতো ওয়েটার টুক করে তুলে নিয়ে আলোছায়াঘেরা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেল।

‘তারপর ম্যাডাম! সোমনাথ সব মেয়ের সঙ্গেই ম্যাডাম দিয়ে শুরু করে। এইটাই হল টেকনিক। বিরাট পার্সোন্যালিটি মেগালোম্যানিয়াক। ম্যাডাম বলে যূথিকাকে দেয়ালঠাসা করে বসল। ম্যাডাম টেবিলের ওপর হাত রেখে আঙুলে কিলিবিলি খেলছেন। নাকছবি, দুল, চশমা, আলো পড়ে চিক চিক করছে। স্বপ্ন স্বপ্ন।

সোমনাথ হঠাৎ ছাতাটা যূথিকার কোলে থেকে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললে, ‘ফরেন?’

‘হ্যাঁ ফরেন। আমার এক পিসতুতো দাদা আমেরিকা থেকে এনে দিয়েছে।’

সোমনাথ ছাতাটা আবার যূথিকার কোলে খচর মচর করে গুঁজে দিল। মেয়েটা সোমনাথের হাতের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠল। উঃ ভাবা যায় না। সোমনাথের কী সাহস রে বাবা। মেয়েরা বোধ হয় এইরকম হাতকেই বলে অ্যাগ্রেসিভ হ্যাণ্ড। আমি একটা ভ্যাবাচ্যাকা জরদগবের মতো উলটো দিকে বসে আছি। প্রেম ফ্রেম মাথায় উঠে গেছে। বেশ বুঝতে পারছি প্রেমের মাঠে আমি এক নাবালক।

ঢক ঢক করে তিন গেলাস জিরাপানি ওয়েটার আমাদের সামনে নামিয়ে রেখে গেল। সোমনাথ বললে ‘নে খেতে থাক অ্যাপেটাইজার।’

পৃথিবীতে কত রকমের যে খাদ্য আছে, পানীয় আছে। এই পঁচিশটা বছর ধরে শুধু ভাত ডাল আর ডাল ভাত খেতে খেতেই জীবনে অরুচি ধরে গিয়েছিল। জিরাপানিতে চুমুক মেরে পঁচিশ বছরের বোদা মুখ ছেড়ে গেল। বিশেষ একটা সময়ে মেয়েদের স্বাদ না সাধ কী একটা হয় না। মনে হল আজ আমার তাই হচ্ছে।

খাবার এসে গেল। সে এক এলাহি ব্যাপার! ব্যাঙের মতো ফুলো ফুলো নান না কি যেন ওই। মাঝখানে ঘি, কালো জিরে। রোগনজুস। স্যালাড। সোমনাথ গপাগপ খেতে শুরু করল। যূথিকাও কম যায় না। আমি মাঝে মাঝে আড় চোখে দেখছি। মনে হচ্ছে আমার সামনে বসে আছে জামাইবাবু আর দিদি। আমি যেন ছোট্ট শ্যালকটি। দু-জনে বেশ জমে গেছে। কথা চলছে, হাসি চলছে। সোমনাথ মাঝে মাঝে বাঁ-হাতে চামচে দিয়ে যূথিকার প্লেটে স্যালাড তুলে দিচ্ছে। কোলের ওপর ন্যাপকিন পেতে দিচ্ছে। সোমনাথের কান্ড দেখে আমার মুখ শুকিয়ে আসছে। হয়ে গেল আমার প্রেম। নদী এখন অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে।

আইসক্রিম এসে গেল। মাঝখানে আবার কায়দা করে পাতলা পিচবোর্ড গোঁজা। সোমনাথ বললে, ‘পিচবোর্ড নয় রে, ওটা বিস্কুট। ওকে বলে ওয়াফার।’ যূথিকা আদুরে গলায় বললে, ‘আইসক্রিম খাব না। গলা ধরে যাবে।’

সোমনাথ বললে ‘কিছু হবে না ম্যাডাম। ঠাণ্ডা ঘরে বসে আইসক্রিম খেলে গলায় ঠাণ্ডা লাগে না।’

সোমনাথের কথা যেন বেদবাক্য। যূথিকা হেসে হেসে খেলে খেলে আইসক্রিম খেতে লাগল। হাত ধোয়ার গরম জল এল বাটিতে। এক টুকরো লেবু ভাসছে। আমি ভেবেছিলুম গুরুপাক খাওয়া হল তো, তাই জিরাপানির মতো লেবুপানি এসেছে। সোমনাথ বললে ‘মূর্খ, একে বলে ফিঙ্গার বোল। লেবুটা হাতে চটকে দে। ইট কাটস দি গ্রিজ।’ পেছনের দিকে মুন্ডু ঘুরিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বেয়ারা, বিল।’

কি আদেশের সুর! এসব ছেলে পৃথিবী শাসন করতে পারে, যূথিকা তো সামান্য মহিলা। বিল এল। আমার জিভেতে তালুতে আটকে গেছে। আমাকে দিতে হলে ঘড়ি খুলে দিতে হবে। না সোমনাথই পকেট থেকে এক গোছা নোট বের করল। ঠোঁটে সিগারেট বাঁকা। নাক ছুঁয়ে ধোঁয়া উঠছে চোখের সামনে দিয়ে। নাকের কাছটা কোঁচকানো। চোখ দুটো হয়ে আছে গ্রেট গ্যাম্বলারের তাসের চাল দেবার মতো। বিল সমেত পঞ্চাশ-টাকার একটা নোট প্লেটের ওপর ফেলে দিল।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরোবার সময় যূথিকার পিঠে তবলায় তেহাই মারার মতো করে আঙুলের তিনটে চাপড় মেরে বললে, ‘চলো, চলো।’

বা: ভাই। কত কায়দাই জান? আমার প্রেমিকার পিঠে তবলা বাজানো। আমার আর কী রইল। যূথিকা যেভাবে তোমার বক্ষলগ্না, তৃতীয় চোখে দেখলে মনে হবে পারফেক্ট স্বামী-স্ত্রী।

রেস্তোরাঁর উলটো দিকেই পান সিগারেটের দোকান। বরফের চাঙড়ার ওপর হলদে হলদে পাতা পাতা শোয়ানো। বিশাল দোকান। বিশাল আয়না। বোতলের জল। জর্দার গন্ধ। ধূপ জ্বলছে। সোমনাথ বললে, ‘তিনটে মঘাই পান। একটায় কিলপাতি জর্দা। আর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।’

‘আমি পান খাই না।’

‘তাহলে দুটো নিয়ে আয়।’

বুঝলাম এটা আমার ইনভেস্টমেন্ট। সাড়ে তিন টাকা খসে গেল। যূথিকা পান চিবোচ্ছে আর ঠোঁট উলটে উলটে দেখছে কীরকম লাল হল।

সোমনাথ আমাকে ফুটপাথের একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললে, ‘শোন আমার কাছে দুটো টিকিট আছে। ব্যাপারটা তোর জন্যে প্রায় সড়গড় করে এনেছি, বাকিটা সিনেমা হলে গিয়ে করব। একটু ইজি না করে দিলে তুই সামলাতে পারবি না। আমরা চলি, কাল তোকে সব বলব। হয়ে এসেছে। যেটুকু বাকি আছে হলে হয়ে যাবে।’

সোমনাথ ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলেছে। পেছনে এবার একটা বগি। আর একটা বগি সাইডিং এ পড়ে রইল। সেই বগির ভেতরে কে একজন হইহই করে হেসে উঠল, মূর্খ মূর্খ! প্রেম বলে কিছু নেই। আছে লটকালটকি, আছে শানটিং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *