সাইকেল
তুমুল বর্ষা। চারা রুইবার সময় আসতে-না-আসতেই যেন ভাদ্রর শেষের মতো একহাঁটু জল মাঠে। গত বছর খরা গেল। এবারে অতিবর্ষণ। মানুষকে আর বাঁচতে দেবে না।
শালোপাড়া গ্রামটা ছোটোই। বেশ বেশিই ছোটো। কাছেই অবশ্য আছে হুকলিঝাড়। বিরাট ব্যাপার সেখানে। বড়ো বড়ো আড়তদার। চারদিকে শয়ে শয়ে মাইল ধানখেত আর রাইস মিল। এফ.সি.আই.-এর গোডাউন। ট্রেনের স্টেশন। ওই হুকলিঝাড়ের সঙ্গেই শালোপাড়ার নাড়ি বাঁধা। এখানে লাউটা, কুমড়োটা, মাগুরটা-শিঙিটা, সেই সবই গিয়ে জড়ো হয় শনিবারের হুকলিঝাড়ের হাটে। বর্ধমানের বড়োমানষিরা ছুটিছাটার দিন হলেই গাড়ি নে চলে আসে ফিসটি করতে, ঘুরতে-ফিরতে, মালোপাড়ার নির্জনে। এঁটেল মাটির বর্ডার দেওয়া পিচ-এর রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সন্ধের মুখে জোড়ায়-জোড়ায় বসে থাকে বড়োলোকের ব্যাটা-বিটিরা, ছিন-ছিনারি দেকে। কেউ কেউ বোতল খুলে ঢুকুঢুকু খায়।
রাত আটটা হয়ে গেল। এখনও যমুনা ঘরে এল না।
কেতো বালিশের তলাতে রাখা ঘড়িটা দেখল। তার বিয়ের সময় সেনবাবুদের খামারের ম্যানেজারবাবু এটা দেছলেন। এইচ.এম.টি. ঘড়ি একটা। কেতোর জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পত্তি। যখের ধনের মতো আগলে রাখে ও সবসময় এই ঘড়িটাকে।
যমুনা গেসল তার বাপের বাড়িতে নবীনপুরে। গেসল, পরশু! আজ বিকেল বিকেল যমুনার দাদা তাকে পৌঁছে দে গেছে। এতক্ষণে তো কাজকম্মি সেরে খাওয়াদাওয়া করে ঘরে আসা উচিত। বাইশ বছরের কেতোর ধৈর্য ধরে না। বিছানায় শুয়ে ছটফট ছটফট করে। নতুন জল-পাওয়া মাঠে ব্যাং ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাং। গাছে গাছে সবুজ তারার টায়রার মতো জোনাকির ফুল দোলে। মাটির ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে এসব দেকে-টেকে সময় কাটাবার উপায় খোঁজে কেতো। দুস শালা! তবু, সময় কি কাটে? নতুন বউকে দিয়ে এত কী কাজ করায় বাবা আর পুঁটিদি তা তারাই জানে! মোটে ছ-মাস বিয়ে হয়েছে কেতোর।
কেতোর মনে পড়ে, হাবা বলেছিল একদিন। পাঠাশালা তো আজকাল নেই। প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়ত ওরা, তখন হাবাকে একদিন মাস্টের জিজ্ঞেস করেছিল, বল তো বাবা হাবা, ‘বিহ্বলতা’ শব্দের মানেটা কী?
হাবা অনেকক্ষণ হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরই মাস্টের বলেছিল ‘যা: বাবা। এ যে দেখছি বিবিই পালিয়ে যাবে! গা গরম করতে করতে, বিবিই পালাবে।’
বিহ্বলতা-টিহ্বলতা শেখবার জন্যে হাবা-কেতোরা স্কুলে যায়নি। আমন-বোরোর সোজা হিসেব। তাই-চুং, আই. আর. এইট-এর কিলো কষা। ফলিডল, ইউরিয়া, খোল এসব কিছুর হিসেব-নিকেশ করতে পারা। পাইকার যাতে না ঠকিয়ে দেয় তাই গুন-ভাগ-যোগ-বিয়োগটা জানা। স্কুলে আসলে যাওয়া; নিজের নামটা ভালো করে সই করতে জানতে। পঞ্চায়েতে গিয়ে খবরের কাগজও পড়ে আসতে পারে। আজকাল অবশ্যি রেডিয়োর খপর শুনলেই সব জানা যায়। ঘরে ঘরে টানজিস্টার, তবু টি ভিও হোয়েছে হেথা-হোথা। কেতো তো পারেই, শ্রীবাবু কার্তিকচন্দ্র পোড়েল বলে নাম সই করতে। এমনকী হাবাও পারে। শ্রীল শ্রীযুক্ত হাবা সাপুই। হাবা তো যেখানেই পারে, সেখানেই একটা করে সই মেরে দেয়। ডিসটিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তায়, পদ্মদিঘির জলে, এমনকী সনাতন মাঝির বাড়ির উঠোন যখন পাকা করতেছিল বদ্দমানের রাজমিস্তিরিরা তখন সেই থকথকে সিমেন্টের মধ্যেও আঙুল চালিয়ে লিকে রেকেচিল শ্রীল শ্রীযুক্ত হাবা সাপুই। সিমেন্ট জমাট বেঁধে যেতেই চিত্তির! সনাতন মাঝির মাথায় হাত! উঠোনে ঢুকতেই বড়ো বড়ো করে সিমেন্টের মধ্যে লেখা শ্রীল শ্রীযুক্ত হাবা সাপুই। সনাতন মাঝি রেগে গিয়ে বলেছিল, শালা! এই ছোটোলোক ইনইডুকেটিডদের গেরামে আর লয়! জান কইলা হয়ে গেল গো!
এমন সময় ঝুনঝুন করে চুড়ির শব্দ হল। সোনার নয়। লোহা, শাঁখা আর গিলটি করা কেমিক্যাল গয়না তার বউ-এর গায়ে। যমুনার বাবা-মা নেই। দাদা-বউদি যা না-দিয়ে পারেনি তাই-ই দিয়েছে। আর কেতোর বাবা হাড় কেপ্পন। তিনিও কিছুই দেননি। খাইয়েছিলেন পঁচিশ-জনাকে। তাও অতিসাদামাটা!
কেতো উঠে বসল বিছানাতে। যমুনা একটা কালো আর হলুদ ডুরে শাড়ি পরেছে। এইটেই তার সবচেয়ে ভালোবাসার শাড়ি। আর যা আছে, সবই আটপৌরে। আজ বাপের বাড়ি গেসল বলে শায়া আর বেলাউজও পরে গেসিল। অন্যদিন শুধু গায়েই শাড়ি জড়িয়ে থাকে। ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করল। হ্যারিক্যানের আলোটা পড়েছে যমুনার কুচকুচে কালো মস্তবড়ো খোঁপাটাতে আর শাড়ির পেছনে। ছ-মাসের পুরোনো বউ, তবু শালা যেন রোজ রাতেই মনে হয় আনকোরা নতুন। যমুনার গায়ে পদ্মদিঘির শাপলার গন্ধ। তার বুকের মধ্যে যখন ওর নিজের ঠোঁট চেপে ধরে কেতো, তখন মনে হয় ডাগর ডাগর পদ্ম দুটির মধ্যে থেকে পদ্মবীজই কুড়িয়ে খাচ্ছে যেন। কত সব গন্ধ, দৃশ্য; বার বার দেকে-শুঁকেও ফুরোয় না। আলো জ্বালায়ে দেকেছে, আলো নিভায়ে দেকেছে, দিনের আলোয়, চাঁদের আলোয়, কনে-দেখা আলোয় সবরকম করে দেকেও দেকা ফুরোয়নি কেতোর। আশা মেটেনি। কে জানে! নতুন বউ পুরোনো হতে কতদিন লাগে? যমুনাকে বড়ো ভালোবাসে কেতো। যমুনা ছাড়া তার আর কেউই নেই। কেউই তাকে এত ভালোবাসেনি।
যমুনাকে কি? নাকি যমুনার শরীরটাকেই? ওই হল! অতশত ভাবে না কেতো। ভাবার সময় কুথায়?
যমুনা ঘুরে দাঁড়াল। দরজাতে পিঠ দিয়ে।
—কী? হল কেমন? বাপেরবাড়ি গিয়ে মন ভরল?
উত্তর না দিয়ে যমুনা বলল, গলা নামিয়ে; বাতিটা নিবোবে? শাড়ি জামা ছাড়তাম।
না না। ধমক দিয়ে বলল কেতো, চিতি সাপ আছে গো! কাল তুই ছিলি না যমুনে, ঘরে ঢুকেই দেখি, চিতি সাপ! চেঁদো দাদাকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নে দু-জনে মিলে তাকে মারি।
—সত্যি? ঘরের মধ্যেই চিতি! বলো কী গো?
আবিশ্বাসী গলায় ষোলো বছরের যমুনা বলল, কালো ভ্রমরের মতো দুটি উজ্জ্বল চোখ তুলে।
—না তো কী? আমি কি তোর ইয়ার্কির পাত্র?
মুখ নামিয়ে যমুনা বলল, না। তুমি আমার পতিদেব। আমার দেবতা, সর্বস্ব আমার।
—খোল শাড়ি জামা। আলো আরও তুলে ধরছি আমি। দেখব। দেখে দেখে আশা মেটে না। কী দিয়ে গড়েছে তোকে রে বিধি? আমি ভাবি।
লজ্জা পেয়ে যমুনা বলল, কেন? না আলো নামাও।
—না।
—না, না। লঞ্জী, নামাও।
—না কেন রে? কেন না?
কেতো বলল, তোকে দেখব। ভালো করে দেখব। আজ তোকে শাড়ি জামা জড়ির ফিতে বেণিতে জড়িয়েই এত ভালো দেখাচ্ছে, সব ছেড়ে ফেললে না জানি আরও কত ভালো দেখাবে। না রে!
—ধ্যাত..।
লজ্জা পেয়ে বলল যমুনা।
বলেই, যমুনা ঘরের এক কোনাতে, যেখানে দুটি ছেঁড়া শাড়ির পাড়ের চাদর-ঢাকা তোরঙ্গ পর পর সাজানো আছে, সেখানের আবছা অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে চকিতে অনাবৃত করেই বাড়িতে পরার চাঁপারঙা একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিল। উদলা গায়ে। বাদলা-রাতে গা-শিরশির করে উঠল ওর। শিরশির করে নানা কারণে।
কেতো মনে মনে বলল, বা: রে। এ যে দেখি বহুরূপী। কালো আর হলুদ শাড়িতে ছিল বসন্তবৌরি আর এখন হয়ে গেল সাঁঝবেলাকার ফিনফিনে চাঁপারঙা জলফড়িং। মস্ত ফড়িং। যা: মাইরি।
যমুনা খাটে আসতে গড়িমসি করছিল। বিনুনি থেকে রুপোলি জরির ফিতে খুলছিল। আস্তে আস্তে। ডানদিকের বেণি থেকে খোলা হয়েছে সবে, কেতো একলাফে খাট থেকে নেমে ঝড়ের মতো গিয়ে পড়ল তার ওপর। পাঁজাকোলা করে যমুনাকে তুলে নে এসে খাটের ওপর ফেলল দড়াম করে। মাটির ঘর কেঁপে উঠল যেন।
তারপর? তারপর, যা হয় তাই…
মাটির ঘর সোহাগে কাঁপতে লাগল।
বাইরে আবারও মুশলধারে বৃষ্টি নামল। এখন ওরা পাশাপাশি শুয়ে আছে। কাত হয়ে, যমুনাকে জড়িয়ে আছে কেতো, পেছন থেকে।
কেতো বলল, সাইকেল? কথা হল কি কিছু?
—উঁ?
—সাইকেলটার কথা তোর বড়োদাদা কী বলল?
—জানি না।
—তার মানে, ‘না’ বলেছে কি?
—ঠিক তাও না। ঝুলিয়ে রেখেছে। বুঝছে না আমার ভাগ্য, আমার সুখ, সব ঝুলছে সেইসঙ্গে। জোর তো নেই। সৎ দাদা।
—না তো কী? গত ছ-মাস ধরে এমনই ঘুরোচ্ছে তারা। এদিকে বাবা কিন্তু রেগে যাচ্ছে রোজ রোজ। একদিন সত্যি করে চটে উঠলেই, কম্মো শেষ।
যমুনার ডান বুকের ওপর ডান হাত কেতোর। চাষার হাত। রুক্ষ, কর্কশ, মোটা চামড়ার তেলো। কিন্তু যমুনার শরীরে তো এর আগে অন্য কেউই হাত দেয়নি। যমুনার এই-ই খুব ভালো লাগে। কেতো তাকে খুব ভালোবাসে। অন্তত তার শরীরটাকে। ওই হল! ওতেই খুব খুশি যমুনা। ছোটোবেলায় মা-বাবা মরা মেয়ে আদর কাকে বলে তাই-ই জানেনি কখনো। কোনোরকম আদরই নয়। তার কাছে শরীরের আদরও অনেক আদর। কাজকর্ম খাটাখাটুনির মধ্যে ডুবে গিয়ে কখন কেতোর সোহাগ খাবে ঘরে, সেই আশায় প্রদীপের সলতের মতো কাঁপে যমুনা।
মাঝে মাঝেই কেতো তাকে ভয় দেখায়। ‘বাবা যেদিন সত্যিকারের চটে উঠবে’ সেদিনই ‘কম্মো শেষ’ বলতে ঠিক কী যে বোঝায় কেতো, তা জানে না যমুনা। কিন্তু কেতোর বাবার মিথ্যা রাগ দেখেই, তার গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় ভয়ে। পাখির মতো ঢিপঢিপ করে তার বুক। জানে না, সত্যিকারের রাগের দিন কী হবে?
—আজ বাবা কি কিছু বলল তোমার দাদাকে? এসেছিল কোন দাদা? মেজদা? আমি তো ছিলাম না। যত্ন-আত্তি করা হল কি কিছু?
—যত্ন-আত্তির কথা ছাড়ো। গরিব বউ-এর বাড়ির লোককে কে যত্ন-আত্তি করে? তবে বাবা মেজদাকে বললেন, যা বলেন। বিয়ের দিন থেকেই যা বলছেন। কথার খেলাপ তো হয়েইছে। তোমাকে সাইকেল দেবে বলেছিল, দিতে পারেনি।
—ছাড়ো তো! আমার লাগবে না। আরে পাম্পটা বসুকই-না, তিন-চার বছরের মধ্যে ধান করে, গম করে, এমনকী আলুও করে আমি নিজেই একটা ভটভটি কিনে নেব।
—সত্যি? ভটভটি সাইকেল? হলুদ কালো ডোরা ডোরা।
বিছানাতে উঠে বসার চেষ্টা করল যমুনা, উত্তেজনায়।
কেতো তাকে কোলবালিশ করে ঊরু দিয়ে চেপে বলল, শোনোই-না।
—কী রঙের? হলুদ-কালো তো?
—যে রঙের চাইবি। কেনার আগে তোকে শুধিয়ে নেব।
—পেচনে আমি বসতে পারব? কী গো? ছিট থাকবে তো?
—নিশ্চয়ই!
—আমাকে পেচনে বসিয়ে আমাদের গেরামে যেতে পারবে?
—নিশ্চয়ই। পারব না কেন? কত জায়গায় যাব। তোকে ডি.ভি.সি.-র ক্যানাল দেখিয়ে আনব। দুগ্গাপুর। কত বড়ো শহর গো! আগে যেইতে পথে মস্তবড়ো বন পড়ত। ডাকাইতি হত সিখানে। কেঁদো বাঘ ছেল। দাদুর কাছে শুনেছি।
আচ্ছা! যমুনা ফিসফিস করে বলল, একটা কথা বলব, রাগ করবে না বলো?
—কী?
—তোমার দাদু কি ওই দুগ্গাপুরের বনে ডাকাতি কইরেই সব জমিজমা ডাল-ভাঙাই কল, ইসব কইরেছেন?
—তোকে কে বইলেচে?
—আমাদের গেরামের লোকেরা বলে। আরও বলে, তোমার বাবা নাকি এখন চাষবাস ছেইড়ে দে ওয়াগন ভাঙাদের দলে নাম নিকিয়েছে। খুব নাকি লাভ সিখানে। কাঁচা টাকা। ইসব কাজ কারবার নাকি খুবই ডিঞ্জারাস সবাই বলে, সত্যি?
এমন সময়ে হঠাৎ ওদের মাথার কাছের জানলার একেবারে পাশেই শব্দ হল একটা।
কে রে?
বলেই উঠল কেতো। খাট ছেড়ে, বউ-এর গায়ের গন্ধ ছেড়ে দরজার খিল খুলল, হাতে বর্শাটা তুলে নিয়েই। যমুনাও দৌড়ে গেছিল পেছন পেছন। তারপরই সে উদোম একথা মনে পড়াতেই খাটের বাজুতে ঝুলিয়ে রাখা শাড়িটা জড়িয়ে নিয়ে বলল কেতোকে জড়িয়ে ধরে, তুমি যিয়ো না গো।
—একটা টর্চ থাকলি।
—এটাই লাও।
বলেই, যমুনা তাড়াতাড়ি তার ঝুলি থেকে টর্চটা দিল।
দরজা খুলে চারধারে আলো ফেলে কাউকেই দেখতে পেল না কেতো। শুধু দেখল, দু-বার কেশে তার বাবা উঠোন থেকে ঘরের দিকে যাচ্ছেন খুব আস্তে আস্তে। কেতোর মনে হল, একটা মস্ত খরিশ গোখরো যেন ঢুকছে তার গর্তে গিয়ে।
দরজা খোলার শব্দ হাওয়াতে ও পিঠে আলো পড়াতে ঘুরে দাঁড়িয়ে কেতোর বাপ গণশা পোড়েল বলল, কে? ও কেতো! কী হল? এত রাতে? বউমার শরীর কি খারাপ?
—না:।
কেতো বলল। শব্দ হয়েছিল একটা।
—তুই কি শহুরে হয়ে গেলি বাপ? গ্রামের রাতে কত শব্দই তো হয়। শব্দ হলেই রাতবিরেতে ছেলেমানুষ জোয়ান বউকে একা ঘরে ফেলে কেউ এমন বেরোয় রাতে? তুই কী রে? তোর কি আক্কেল হবে না? কোন দিন ফিরে দেখবি বউই তুলে নিয়ে গেছে ডাকাতে! তোর বয়স হল দেদার, বুদ্ধি হল না এক ফোঁটা।
—না। শব্দ শুনলাম একেবারে জানলার পাশেই! তাই।
—শ্যাল-ট্যাল হবে।
—না:। শ্যাল না।
—তবে?
—তবে…
—তবে কি বাঘ?
—বাঘ!
—হ্যাঁ শ্যাল না হলে নিশ্চয়ই বাঘ। এত ভয় যখন পেয়েছিস।
কেতো কোনো জবাব দিতে পারল না। চুপ করে রইল।
ফিরে আসছিল, এমন সময়ে বাপ গণশা বলল, কাল বদ্দমান যেতে হবে। মনে আছে তো?
—হ্যাঁ।
সকালে দুটি খেয়েই বেরিয়ে যাস। এস.ডি.ও. সায়েবের জন্যে একহাঁড়ি বড়ো কই মাছ রেখে দিচি। মালোকে বলেছিলাম দে যেতে। নে যাস, যাবার সময়।
—ঠিক আচে।
বলল, কেতো।
ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করেই খাটে এল। যমুনা উঠে বসেছিল। বলল, আমার ভয় করে। খুব ভয় করে গো।
—আমারও।
কেতো বলল।
—তোমারও? কেন? বাঘ-এর জন্যে?
—না।
—শ্যালকে ভয়?
—না:।
—তবে?
—আছে।
—আমার ভয় করে গো।
—সাবধানে থেকো। কাল আমার বদ্দমানে যেতে হবে। বাবার অডডার।
পরদিন ভোরে উঠে কেতোকে ডেকে গণশা বলল, সাইকেল-এর কথা কিছু জানিস?
চমকে উঠল কেতো। বলল কেন? যমুনার দাদা কিছু বলেনি?
সে তো গত ছ-মাস ধরে যা বলার বলেই চলেছে। কথাতে তো আর চিঁড়ে ভিজবে না। যমুনের বড়োদাদা শুনেছি খুব ফেরেলবাজ নোক। গণশা পোড়েল-এর ছেলের বে কি ওই হাভাতে ঘর ছাড়া আমি দিতে পারতাম না? দ্যাখ কেতো, আমার এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্কেরম হতিচে। ইর পর, কিছু হলে আমাদিগের দোষ লাই। কোনো দোষই লাই।
তারপরই বলল, তোর সোজা আর বদ্দমান যেয়ে কাজ লাই। তুই যমুনের বাপের বাড়ি যা আগে তার চে। সিখান থেকে বদ্দমানে চইলে যাস বাসে। একটো চিঠি দে দেব। ছোটোদারোগার বাড়িতে ওলাচন্ডিপুরে রাতটা থেকে দু-জনে একই সঙ্গে ভোর ভোর চইলে আসিস। ছোটোদারোগার তো ভটভটিও আছে। হাওয়ার মতো পৌঁছে যাবি।
কেতো ব্যাপার কিছুই বুঝল না। তবে কোনো একটা ব্যাপার যে ঘটতে যাচ্ছে, তা অনুমান করতে পারল। তার মায়ের মৃত্যুর আগের দিন এমন নানা রহস্য ঘটিয়েছিল তার বাবা। এই শালা বাবাকে ভক্তি ছেরেদ্দা তো করেই না, ঘেন্না করে কেতো। পেচন্ড ঘেন্না। মাকে খুন করেছিল বাপ।
যমুনা গত সপ্তাহে একদিন বলেছিল, পুঁটিদিটা না থাকলে, এবাড়িতে থাকাই যেত না। তোমার বাবার স্বভাব-চরিত্তর যেন কীরকম।
কেতো জানে সবই। তবু মুখে অবাক হওয়ার ভান করে বলেছিল হেসে, পাগল নাকি! বউ হয়ে শ্বশুরের চরিত্তর খুঁত ধরছিস? হয়েছেটা কী? তোর সাহস তো কম নয়!
—না গো! হয়নি কিছুই। কিন্তু হতে পারে।
—কী?
—কিছু। যকন-তকন হতে পারে।
সাইকেল বাবা নিজে চড়ে না। আসলে ঝিলের পাশে যে বাগদি দিদির ঘর আছে সেইখানেই যাবে এ সাইকেল। পণের সাইকেল। ঝুমকি বাগদির বড়োছেলে চড়বে সে সাইকেলে। কানাঘুসোয় শুনেছে কেতো যে, সেই ছেলে নাকি তারই বাপের ছেলে তার নাম লালচাঁদ।
শোনে। এককান দিয়ে শুনে অন্যকান দিয়ে বার করে দেয়। এখনও স্বাবলম্বী হয়নি কেতো। বাবা যদি সত্যিকারের রেগে ওঠে, তখন কেস কেচাইন হয়ে যাবে! কী করবে? কেতো নিরুপায়। বাপের বেগার খাটা দিনমজুর। দু-টি খেতে পায়, মাথায় ছাদ আছে; এই-ই যা।
যমুনা কাতর গলায় বলল, আমাকেও নিয়ে চলো তোমার সঙ্গে।
—কী করে? বাবা যদি ‘সত্যিকারের রেগে যায়’? থাক তুই। তা ছাড়া আমি কত কত জায়গায় যাব। রাতে কোতা থাকব তারই ঠিক লাই।
যমুনার চোখে ভীষণ ভয় দেখল কেতো।
—একা ঘরে শুতে পারবি?
—ভাবছি, পুঁটিদিদিকে ডেকে নেব।
বাবা বলছিল, তোর একা হয়তো ভয় করতে পারে, রাতটা তুই বাবার ঘরেই কাটাস। মস্ত ঘর, মস্ত বিছানা। নইলে বাবাও এসে থাকতে পারে তোর ঘরে। বাবার কাছে যন্তর আছে।
—কী যন্তর?
চোখ বড়ো বড়ো করে যমুনা শুধোয়।
—যন্তর! হি:। হি:। কোমরে গোঁজা থাকে। তবে লাইসেন্স লাই। আর কেউই জানে না। আমি একদিন দেখে ফেলেছিলাম। যখনই বদ্দমান যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় বাপ আমার।
—আমি শোব না।
—কোথায়?
—তোমার বাবার ঘরে।
—তাহলে, বাবাই আসবে তোর ঘরে।
—একদম না। মানা করে দিয়ে যাও।
—কেন? সে কী?
—না, বলেছি না। তোমার বয়স হয়েছে, বুদ্ধি হয়নি।
—হুঁ। আমাকে অমন বউয়ের আঁচল ধরা মরদ পাওনি যে বউ যা বলবে, তাই-ই শুনব। আমি নিজের বুদ্ধিতে চলি। হুঁ।
কথাটা, তার বাবা গণশা পোড়েল মাকে উঠতে-বসতে শোনাত। এই বাড়িতে মেয়েরা খেজুরের রস, জিয়োনো মাগুর অথবা তালক্ষীরেরই মতো এক ধরনের খাদ্য-পানীয়-ভোগ্য ব্যাপার ছিল। ছোটোবেলা থেকেই দেকেছে। মেয়েদের কতা শুনে চলা, এবাড়িতে পুরুষত্বহীনতারই শামিল।
যমুনা কিছু না বলে, চেয়ে থাকল অনেকক্ষণ কেতোর মুখে।
বিড়বিড় করে বলল, আমার চেয়ে একটা সাইকেলের দাম বেশি হল?
কেতো বিজ্ঞের মতো বলল, সে কতা নয়! ব্যাপারটা হচ্ছে কতার খেলাপ। তোর বড়োদাদা সব জেনেশুনেই, আমার বাবা লোক খারাপ জেনেও তার সঙ্গে মিথ্যাচার কেন করতে গেল, বল তো? এতে তোর বা আমার কোনো উপগারটা হল? গণশা পোড়েল এককথার নোক। সে যদি বলে কোথাও যাবে, তাহলে সে না যেতে পারলে তার ডেডবডিও সেখানে যাবে। অন্যায় তার তো নয়। তোর বড়োদাদা এমন কতা দিয়ে আজ ছ-মাস ঘোরাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে বাবার জিদ চেপে গেছে। কালও যদি সাইকেল না আসে তো বাবা সত্যিকারের নেগে যাবে। বড়ো জিদ্দি লোক সে। আর অত্যিকারের নেগে…
—কাল কেন, কোনোদিনও সাইকেল দেবে না বড়দা।
মুখ নীচু করে যমুনা বলল।
—সে কী? কত্ত কথা আমার সঙ্গে। কোনটা নেবে বলো কেতোবাবু? হিরো, না হারকুলিস? এইমতো ব্যবহার ভদ্রমানুষের? ছি ছি।
—দাদা দেবে কেন? বোনকে যখন তোমাদের গছিয়ে দিয়েছে তখন আর খরচ কেউ করে? বউদিরা তোমাকে একদিন খাওয়াল না পর্যন্ত বিয়ের পর। তুমি কী ভাবো আমি অন্ধ? সাইকেল ওরা দেবে না। তুমি মিছিমিছি যেয়ো না। তোমাকে অপমান করলে, আমারই অপমান।
—তুই বকিস না যমুনা। সারাগাঁয়ের সকলে জানে যে, আমার বিয়েতে আমি সাইকেল পাব। বাপ আমার চন্ডীমন্ডপে, পঞ্চায়েতে, সব জায়গায় বলেছে বড়োমুখ করে। আমার মনে হয়, দশজনে দশ কথা বলছে। বাপের দিকটাও ভাব। তার ইজ্জত!
—তুমি আমাকে মেরে ফেলে দাও। আবার একটা বিয়ে করো। এবার সাইকেল আগে হাতে পেয়ে তারপর বউ আনবে ঘরে। এমন ভুল দ্বিতীয়বার কোরো না। হ্যাঁ গো! পেটে যে এসেছে, তার তো এখনও সাত মাস দেরি আছে আলো দেখতে। এইবেলা আমাকে তোমরা শেষ করে দাও বাপ-ব্যাটাতে মিলে। তোমাদের ইজ্জত কত বড়ো! ছি ছি, দাদার কথাও ভাবি। মানুষ এত ছোটোও করে নিজেকে? আমাকে বললে, আমি ফলিডল খেয়ে মরে যেতাম, বিয়ে দিতে হত না গিলটি করা গয়না আর শাঁখা দিয়ে।
কেতো ঘাবড়ে গেল যমুনাকে দেখে। এ যমুনাকে সে চেনে না।
তাড়াতাড়ি তার ভেজা চোখের নীচে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, দেখো বাবা। এখানে ওসব কিছু কোরো না। আমাদের বদনাম হবে। বাবার ইজ্জত-এর কথাটাও ভেবো। এ গেরামে আমাদের সকলে ছেরেদ্দা করে।
দুই
ওলাচন্ডীপুরে ছোটোদারোগার বাড়ির বাইরের ঘরের তক্তাপোশে শুয়েছিল রাতে কেতো। ছারপোকা ছিল খুব। ঘুম হয়নি। তার ওপর সারারাত বেড়াল কেঁদেছে। তবে, ছোটোদারোগা, রাতে খেতে দিয়েছিল ভালোই। কচি পাঁঠার ঝোল আর রূপশালি ধানের ভাত। তালক্ষীরও।
ছোটোদারোগা বলেছিল, ভোর ভোর রওয়ানা হব হে কেতো। আমার আবার ফিরতে হবে তোমার বাপকে নিয়ে। জরুরি কাজ আছে বর্ধমানে।
অন্ধকার থাকতে থাকতেই তৈরি হয়ে ছোটোদারোগার লাল মোটরবাইকের পেছনে বসে পড়েছিল কেতো। তারপর লাফাতে লাফাতে এবেড়ো খেবড়ো পথে কিছুটা এসে পিচরাস্তাতে পড়েছিল। তাদের গ্রামের কাছে এসে আবার ছ-মাইল কাঁচা রাস্তা। গোরু-বাছুর চলে। কাদা শুকিয়ে এমনই হয়ে আছে যে, হাঁটলেই গোড়ালি আর পায়ের পাতা ভেঙে যাবে বলে মনে হয়, যেকোনো সময়ই।
মনটা ভালো ছিল না কেতোর। বাপ একটা পত্র দেছিল ছোটোদারোগাকে। সেই মোতাবেকই তিনি চলেচেন। দারোগার সঙ্গে কী মামলাতে যেতে হবে তার বাপকে বদ্দমান? এসব ওর ভালো লাগে না। যমুনা বলেছিল, ই সব ডেঞ্জারাস। কানাঘুসো। যা খেত-জমি আছে তাতেই সৎভাবে চাষবাস করলে তো খাওয়া-পরা চলে যায় বাবুয়ানি করে। এইসব ঘোঁত—ঘাঁত-এর পথের বড়োলোক হতে যাওয়াই বা কেন? কেতো ভাবে, তার ডাকাত দাদুর রক্ত বোধ হয় বইছে তার বাপের শরীরে। বাগদির মেয়ে ছাড়া শুয়ে আরাম পায় না, ডাকাতি না করলে ভাত মিঠে লাগে না। এ কেমন রোগ হে!
শেষরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছিল কেতো। সবে যখন দু-চোখের পাতা বুজে এল ঠিক তখনই। দেখেছিল, যমুনা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। আর বলছে, তোমার বউ দেখতে নিয়ে যাবে তো আমায়? আমি কিন্তু বরযাত্রী যাব। যাব্বোই। ফেলে যেয়ো না যেন!
ঠিক সেই সময়ই স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ছোটোদারোগার চাকর গঙ্গা একধাক্কা দিয়ে তুলেও দিল কেতোকে।
পিচরাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তাতে এসে পড়তেই মোটরবাইক সাংঘাতিক লাফাতে লাগল। আর প্রায় তারই সঙ্গে সঙ্গে লাফাতে লাফাতে সূর্যটাও উঠল মালোডাঙার জল-ভরা মাঠ লাল করে। বানের জল এখনও নামেনি মাঠ থেকে। পশ্চিমাকাশে মেঘ করে আছে কালো করে। শালিখ আর চড়াই ডাকছে ক্রমাগত। পথের পাশে আকন্দর ঝাড়ে রোদ লেগেছে। কণ্টিকারি, কয়েতবেলের গাছ। বুড়ো ছাতিমের গোল গোল পাতাকে ছোটো ছোটো হাতের পাতার মতো দেখাচ্ছে। রোদ লেগে মনে হচ্ছে লাল লাল ফুল ধরেছে ছাতার তলায়। বাঁ-দিকে একজোড়া শামুকখোল বসে আছে মাঠে। এক-পা এক-পা গুনে গুনে ফেলছে পা। অতিসাবধানে।
আর একটু গেলেই ওদের গেরাম। মোড়ের বুড়ো বট গাছটার কাছে ডানদিকে ঘুরলেই কেতোদের বাড়িও দেখা যায়। যমুনা কী করছে কে জানে? বাবা কি তাকে রাতে পাহারা দিয়েছিল? সত্যিই? না ওই-ই গেছিল বাবার ঘরে শুতে। বাচ্চা মেয়ে তো। ভয় পায় বড়ো।
মোড়টাতে এসেই গতি কমল মোটরবাইকের। ডানদিকে মোড় নিল একটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে। এবং মোড় নিতেই, কেতোর গলার মধ্যে কীসের একটা শক্ত দলা উঠল। টাকরা শুকিয়ে গেল।
কেতো দেখল, ওদের শোবার ঘরের পেছনের আমড়া গাছটা থেকে হলুদ আর কালো ডুরে শাড়িতে ফাঁস লাগানো যমুনা ঝুলছে।
ছোটোদারোগাও দেকেচে।
দেকে মোটরসাইকেল থামিয়ে ওদিকে তাকিয়ে বলল, এ কী অঘটন হে! হায় হায়। এ কে?
—আমর বউ।
কেতোর গভীর থেকে কেউ বলে উঠল।
ছোটোদারোগা বলল, ‘তাহলে, ভগমানই আমাকে এখানে পাইটেচেন! আমি না এইলে কী বিপদেই-না পড়তে বলো তোমরা! লাশ-কাটা ঘরে কতদিন পড়ে থাকতে হত মেয়েটাকে। ভগমন যাই-ই করেন, তাই-ই মঙ্গলের জন্যে।’
কেতোর কানে এতসব কথা ঢুকছিল না। কেতো আবারও তাকাল উপরে। বর্ষার জল পাওয়াতে অনেকই সবুজ পুরুষ্ট সব পাতা ছেড়েছে আমড়াটা। নরম নরম পাতার মধ্যে নরম যমুনা দুলছে অল্প অল্প, পশ্চিমের হাওয়া লাগা ডালের দোলায়। শাড়িটা তার দু-পায়ের মধ্যে এমন আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে গেছে যে তার লজ্জাস্থান ঢেকে রয়েছে তা। তার দু-পায়ের দু-পাশে শাড়ির প্রান্ত ফুলে ফুলে উঠছে ভোরের ভেজা হাওয়ায়।
যমুনা যেন হলুদ-কালো একটা সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে চাপ চাপ নরম মেঘের ঘাসের মাঠ পেরিয়ে। দূরে, দূরের কোনো দেশে— যে দেশে মেয়েরা জিয়োনো মাগুর বা খেজুরের রস; বা তালক্ষীর নয়।