সাইকেল সাথি – শরদিন্দু কর

সাইকেল সাথি – শরদিন্দু কর

আশ্বিন মাস। সামনে পুজো। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পুজোর তত্ত্ব পৌঁছে দিয়ে সাইকেলে গ্রামে ফিরছিল বাসুদেব ফৌজদার। মেয়ের বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার সময় ঝমঝমিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। অবশ্য সে-বৃষ্টি থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়েছিল আকাশের নীল রং। শরৎকাল এরকমই হয়—এই রোদ এই বৃষ্টি।

এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে ওদের আনন্দপুরে পৌঁছানোর রাস্তা এক জায়গায় এসে দু-ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে রাঙা মাটির পথ অন্যদিকে পাকা পিচ রাস্তা। তবে পাকা রাস্তা ধরে অনেকখানি ঘুর পথে গ্রামে পৌঁছাতে হয়। তাই পায়ে হাঁটা বা সাইকেল চালানো মানুষজন অনেক সময় কাঁচা রাস্তাটি পছন্দ করে। প্রায় তিন কিলোমিটার কাঁচা রাস্তার দু-পাশে পুরোনো কালের বিশাল সব বট-অশ্বত্থ-পাকুড়-অর্জুন গাছের পাশাপাশি শালগাছের ঘন জঙ্গল।

রাস্তা যেখানে দু-ভাগ হয়েছে সেখানে তেমাথার মোড় থেকে রাঙা মাটির পথ ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর মেঘ গুড় গুড় করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। তার সাথে কান ফাটানো চড়াৎ চড়াৎ শব্দে বজ্রপাত। একটা বড়োগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হাত থেকে যথাসাধ্য নিজেকে বাঁচাল বাসুদেব। তবে আশেপাশে বাজ পড়ার বিকট আওয়াজে ভয়ে বুক হিম হয়ে যাচ্ছিল। এভাবে অনেকটা সময় বয়ে গিয়ে দেখতে দেখতে বিকেল ফুরিয়ে এল।

এখন সাবধানে সাইকেল চালাতে হচ্ছে। কাঁচা মাটির রাস্তা গত বর্ষার সময় এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গিয়েছিল যা এখনো সারানো হয়নি। তার উপরে আজকের বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ। অনেক জায়গায় জল জমে আছে। মাঝে মাঝে বড়ো গর্ত রয়েছে যা অন্ধকারে চোখে পড়ে না। জলে ডোবা গর্তের মধ্যে যদি একবার সাইকেলসুদ্ধ পড়ে তখন কী হবে? হাত-পা ভেঙে রাস্তার মধ্যে দুর্দশার অন্ত থাকবে না। অজানা বিপদের কথা ভেবে বুক কেঁপে ওঠে বাসুদেব ফৌজদারের। পূর্বপুরুষরা একসময় রাজার ফৌজে সেনাপতি ছিল তাই উপাধি পেয়েছিল ফৌজদার। সে-সব দিন কবে শেষ হয়ে গেছে। এখন সংসার চালাতে একটা দোকান দিয়েছে। কাগজ-খাতা-পেন পেনসিল এসবের সাথে মিলিয়ে নানা রকমের কেক-বিস্কুট-চকলেটও রাখে। দোকানটা ভালোই চলে।

সাঁজের আঁধারে একা একা সাইকেল চালাতে চালাতে মনে হয় এ সময় কেউ সঙ্গী-সাথি থাকলে ভালো হত। কিন্তু শুনশান কাঁচা মাটির পথে ঝড়-বৃষ্টির সময় লোকজন কোথায় পাবে? বাসুদেব যখন এরকম ভাবনা নিয়ে অনেকখানি হতাশ হয়ে পড়েছিল তখনই মনে হল ওর পিছনে পিছনে কে যেন আসছে। জলকাদার রাস্তায় সাইকেলের চাকার ছপ ছপ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। যা শুনে বুকে তবু কিছুটা বল এল।

দু-পাশের বড়ো বড়ো গাছগুলির নীচে চাপ চাপ অন্ধকার। চোখে সব কিছু ঠাহর হয় না। এসব রাস্তায় অনেকখানি আন্দাজে সাইকেল চালাতে হয়। সেই ভাবেই বাসুদেব চলছিল হঠাৎ শুনতে পেল, ওদিকে নয়, ওদিকে নয় সামনে জলে ভরা গর্ত আছে, বাঁ-দিকে আসুন।

অজানা লোকটির কথা শুনে তাড়াতাড়ি হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে সাইকেল সামলে নিল বাসুদেব। যাক, বড়ো একটা ফাঁড়া কাটল। ততক্ষণে লোকটি ওর পাশে চলে এসেছে। বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে মানুষটিকে বলতে হয়, তুমি খুব বাঁচিয়ে দিলে ভাই না-হলে গর্তে পড়তাম। তারপর নির্জন পথে ওর সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টায় বলল, তুমি কোথায় থাকো?

উত্তর এল, জোড়া বকুলতলা।

বাহ ভালোই হল। তোমার সাথে অনেকটা পথ একসাথে যাওয়া যাবে। আমি জোড়া বকুলতলার কিছুদূর আগে আনন্দপুরে থাকি।

আমি জানি। আপনার ফৌজদার স্টোর্সে বেশ কয়েকবার গেছি।

গলার আওয়াজ শুনে আগেই মনে হয়েছিল বয়স কম এখন আকাশের তারার আভায় যতটুকু অন্ধকার দূর হয় তার মধ্যে নজর রেখে বাসুদেব বুঝতে পারল ওর পাশে চলা সাইকেল সঙ্গীটির বয়স ষোলো-সতেরোর বেশি নয়। ওর মুখে নিজের দোকানের নাম শুনে সে উৎসাহে বলল, তাই নাকি? তাহলে তুমি আমার চেনাজানা।

আলো আঁধারের মধ্যে চেহারা দেখে ছেলেটিকে চিনতে চেষ্টা করল বাসুদেব। কিন্তু মুখখানা পরিষ্কার দেখতে পেল না।

আপনার দোকানে যখন খাতা-পেন কিনতে যেতাম দেখতাম কত কেক বিস্কুট থরে থরে সাজানো আছে। তখন খুব নিতে ইচ্ছে হত কিন্তু পকেটে পয়সা থাকত না বলে কোনোদিন নিতে পারিনি।

ছেলেটি সহজ ভাবে মনের কথা শুনিয়ে দিল।

বাসুদেবের মায়া হল। তা ছাড়া সদ্য ওকে জলে ডোবা গর্তে পড়া থেকে বাঁচিয়ে যে উপকার করেছে তার বিনিময়ে ছেলেটিকে কিছু প্রতিদান দেওয়া দরকার এই চিন্তা নিয়ে বলল, এরপর তুমি যেদিন আমার দোকানে আসবে তোমাকে এক প্যাকেট ক্রিমবিস্কুট দেব। ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলল, না না তার কোনো দরকার নেই। আমার এখন ক্রিমবিস্কুট লাগে না।

বাসুদেব ভাবল ছেলেটি নিশ্চয় টাকাপয়সার কথা ভেবে সংকোচ বোধ করছে তাই দরাজ গলায় বলল, তোমাকে দাম দিতে হবে না। পুরোপুরি ফ্রিতে দেব।

ছেলেটি কোনো উত্তর দিল না।

আরও কিছুক্ষণ পাশাপাশি চলার পর বাসুদেব দেখতে পেল রাস্তার একপাশে অনেকখানি জল জমে আছে এবার সতর্ক হয়ে অন্যপাশ ধরে সে সাইকেল চালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সাথে সাথে হুঁশিয়ারি এল, ও দিকে নয় ও দিকে যাবেন না। জল এড়িয়ে ও দিকে গেলে কাঁটা গাছের মধ্যে পড়বেন। সামনে ফণীমনসার ঝোপ আপনি অনেকখানি ডানদিকে সরে আসুন।

আশ্চর্য! কথাটি তো ষোলো আনা সত্যি। ততক্ষণে ঝাউগাছের মতো চাপ বাঁধা ফণী-মনসার কাঁটাগাছগুলি ওর নজরে পড়ল। এবারেও ছেলেটির কথা শুনে বাসুদেব ডানদিকে ভালো রাস্তায় সরে এল।

এভাবে দুর্ভোগ এড়িয়ে বেশ খুশি মনে সে আবার আগের মতন উদার গলায় বলল, এবার তুমি যখন আমার দোকানে আসবে তখন তোমাকে একটা চকলেট বার দেব। ছেলেটির স্বভাব ভালো। যদি কিছু নিতে রাজি না-হয় এই চিন্তা করে বাসুদেব তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিল, না না তোমাকে এক পয়সাও দিতে হবে না তবে চকলেট তোমাকে নিতেই হবে।

ছেলেটি নীচু স্বরে বলল, আমি চকলেট নিয়ে কী করব। থাক না।

বাসুদেবের ধারণা হল গরিব ঘরের ছেলে তাই হয়তো চকলেটের দিকে অত টান নেই। কিন্তু উপকারের বদলে টাকাপয়সা দেওয়া ঠিক নয়। তবে এরপর দিন যখন ওর দোকানে আসবে বাসুদেব সিদ্ধান্ত নিল তখন ওর হাতে জোর করে একটা বড়ো চকলেট বার গুঁজে দেবে।

জলকাদা ভেঙে সাইকেল চালাতে বেশ কষ্ট হয়। সাইকেলের চাকা নরম মাটিতে এঁটে যায়। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পার হতেই বাসুদেবের কপালে ঘাম জমে। বিকেলে বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচালেও জামাকাপড় কিছুটা ভিজে গিয়েছিল। শরীরে আধভেজা জামা আর কপালে ঘাম নিয়ে এই সামান্য পথও যেন অনেক দীর্ঘ মনে হয়। সাইকেলের পেডেল ঠেলতে ঠেলতে পায়ে ব্যথা ধরে গেছে। এখন একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হয়। এই ভেবে রাস্তার পাশে বাসুদেব দাঁড়িয়ে পড়ল।

সঙ্গী ছেলেটির উদ্দেশ্যে সে বলল, এসো একটু জিরিয়ে নিই তারপর আবার চলব।

কথাশুনে ছেলেটিও থেমে গেল।

গায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগানো দরকার এই ভেবে জামাটা খুলে ফেলল বাসুদেব। একটা গাছের ডালে ওটা ঝুলিয়ে দিয়ে সাইকেলটি গুঁড়িতে ঠেসিয়ে আরাম করে দাঁড়াল। ছেলেটি রইল সামান্য দূরে। বাসুদেব চিন্তা করল ছেলেটার স্বভাব কেমন যেন লাজুক চাপা ধরনের। নিজে থেকে কোনো কথা বলে না। যা জিজ্ঞাসা করা হয় শুধু সেইটুকু উত্তর দেয়।

এসময় গাছের একটি ডাল থেকে ঝটপট শব্দে কোনো পাখি উড়ে গেল।

পাখিটির ডাক বড়ো বিচিত্র—চ্যাঁও চ্যাঁও। যে কর্কশ আওয়াজ শুনে বাসুদেবের বুক শিরশির করে উঠল। ছেলেটি বোধহয় ওর মনের কথা আন্দাজ করে নিয়েই অভয় দেয়, আতঙ্কের কিছু নেই। প্যাঁচা ডাকছে। হয়তো সাপখোপ দেখেছে। শিকারের আগে প্যাঁচা ওরকম ডাক দেয়।

তুমি এসব জানলে কী করে?

আমিতো এদিকেই থাকি, দেখেশুনে সব শিখে গেছি। তবে ভয় পাবেন না সাপখোপ যদি আশেপাশে থাকেও তবে ওই ডাকশুনে নিজেরাই আড়ালে লুকিয়ে পড়বে। অন্ধকারে প্যাঁচারা সব পরিষ্কার দেখতে পায়। ওদের নাগাল থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন। তবে আপনার কোনো চিন্তা নেই। প্যাঁচা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।

বাসুদেব অনেকখানি আশ্বস্ত হল কিন্তু এ জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেও মন চাইছিল না। ঘরে ফেরার টান। বলল, চল আমরা এখান থেকে যাই। কথার শেষে গাছের ডাল থেকে জামাটি টেনে গায়ে চড়িয়ে নিল।

সাইকেল চালাতে চালাতে অনেকটা পথ পার হল নির্বিঘ্নে। কোনো গর্ত বা কাঁটাঝোপের সামনে পড়ল না। এভাবে বেশ কিছু দূর চলার পর একসময় ছেলেটিই ওকে ডেকে উৎসাহ নিয়ে দেখাল, ওই তো আপনাদের আনন্দপুরের আলো দেখা যাচ্ছে। আর কোনো চিন্তা নাই। এবার আপনি সো-জা চলে যান। একটি বিশাল ঝুপসি তেঁতুলগাছের নীচে এসে ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আপনার সাথে আমার রাস্তা এখানেই শেষ। আপনি এগিয়ে যান।

তুমি কোথায় যাবে? প্রশ্ন করল বাসুদেব।

বাঁ-দিকে আমাদের জোড়া বকুলতলা। এই রাস্তা ধরে চলে যাব। আঙুল তুলে জঙ্গলের মধ্যে সরু পায়ে চলা পথটি দেখাল।

গরিব ছেলেটি ওকে সারাপথ যে ভাবে বিপদআপদ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে তা দেখে বাসুদেব মনে মনে দারুণ খুশি। সে চিন্তা করল আবার কবে দেখা হবে কে জানে? সবচেয়ে ভালো হয় এখনই ওর হাতে কিছু নগদ টাকাপয়সা ধরিয়ে দেওয়া। উপকারীর ঋণ বেশিদিন ফেলে রাখতে নেই।

এইসব চিন্তাভাবনা করে বুক পকেটে হাত দিল। বাসুদেব খুব একটা মানিব্যাগ ব্যবহার করে না। পকেটে পাতলা প্লাস্টিকের খামে সাধারণত টাকাপয়সা রাখে। কিন্তু এখন বুক-পকেটে হাত দিয়ে দারুণ চমকে উঠল। সর্বনাশ! টাকা ভরা খামটা পকেটে নেই। খুব কম করেও ওতে দশ-পঞ্চাশ একশো মিলিয়ে সাড়ে পাঁচশো টাকা ছিল। খামটা কোথায় গেল?

বাসুদেবের মাথায় এতক্ষণ রাস্তার খানাখন্দের দুর্ভাবনা ছিল। এখন টাকার চিন্তায় বুক হু হু করে উঠল। ওর মতো ছোটো দোকানদারের কাছে ওই টাকা অনেক কষ্টের ধন। মেয়ের বাড়ি যাচ্ছে যদি কোনো দরকার পড়ে এই ভেবে বেশি টাকা হাতে নিয়েছিল।

এখন দুখি দুখি মুখে নিজের মনে মাথা দোলাতে লাগল, হায়রে, অতগুলো টাকা চলে গেল? ছেলেটি ওর হাবভাব দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

নিরাশ স্বরে বাসুদেব জানাল আমার টাকাসুদ্ধ খামটা পকেট থেকে রাস্তায় পড়ে গেছে। ওতে অনেকগুলি টাকা ছিল।

একথা শুনে ছেলেটি ঠান্ডা গলায় বলল পথে যখন আসছিলেন নিশ্চয় টাকাগুলি সম্পর্কে আপনার হুঁশ ছিল। ভালো করে ভেবে দেখুন কতদূর পর্যন্ত আপনি টাকার কথা খেয়ালে রেখেছিলেন?

বাসুদেব বলল তুমি ঠিক বলেছ। একটু আগে যেখানে বসেছিলাম সেখান পর্যন্ত খামটা পকেটে ছিল বেশ মনে পড়ছে।

কিন্তু জামাটি গাছের ডাল থেকে নামাবার পর আপনি দেখেছিলেন সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা?

বাসুদেব অবাক, ঠিক কথাই তো। ওখান থেকে জামাটি নিয়ে গায়ে দেবার পর তার পরিষ্কার মনে পড়ছে না পকেটে টাকাটি ছিল, না ছিল না।

আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি একবার দেখে আসি। কথাগুলি বলেই ঝপ করে সাইকেলে লাফিয়ে উঠে সে আবার চলে আসা পুরোনো পথে সাত তাড়াতাড়ি রওনা হল।

সাইকেল সাথি ছেলেটি চলে যাওয়ার পর বাসুদেবের কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বনবাদাড়ে শুধু মাত্র জন্তুজানোয়ার নয় এরকম অন্ধকারে তেনারাও ঘোরাফেরা করেন এ কথা ভেবে ভয়ে ভয়ে একবার রাম নামও জপে নিল।

এরকম পরিস্থিতিতে ওর মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলি ঠিকমতো সে সাজাতে পারছে না। ছেলেটি পদে পদে ওর সাথে রয়েছে। দারুণ বাহাদুর ছেলে মানতেই হবে। কিন্তু ও যেভাবে চলে গেল তা থেকে চিন্তা হয় অন্ধকারের মাঝে যদি টাকার প্যাকেটটি কোথাও পড়ে থাকে ছেলেটি খুঁজে পাবে কী ভাবে? ওর তো প্যাঁচার মতো চোখ নয় যে অন্ধকারে সবকিছু দেখতে পাবে?

টাকাপয়সা অনেক সময় মানুষের চিন্তা ঘোলাটে করে দেয়। ওরকম ঘোলা জলে নেমে বাসুদেব চিন্তা করল, ছেলেটি ওর উপকার করেছে সত্যি। কিন্তু অতগুলি টাকা হাতে পেয়ে গরিবের ছেলে টাকার খামটি নিয়ে পালিয়ে যাবে না তো? যতই হোক মানুষের মতিগতি বোঝা দায়।

সাত-পাঁচ চিন্তা নিয়ে যখন বাসুদেব মগ্ন ছিল ঠিক তখনই শুনতে পেল ছেলেটির গলার স্বর, এই নিন আপনার টাকার প্যাকেট, ওই গাছের নীচে পড়েছিল।

বাসুদেব আনন্দে চমকে উঠল একই সাথে দারুণ লজ্জা পেল। ছিঃ ছিঃ। সে ছেলেটি সম্বন্ধে কত মন্দ কথা চিন্তা করছিল এতক্ষণ ধরে।

এবার বাড়ি যান। আমি চলি, যেন ওর কাজ শেষ এই ভাবে কথাটি বলে ছেলেটি চলে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন বাসুদেবের মনে হল এখনও ওর হাতে কিছু টাকা দেওয়া হয়নি কিন্তু ওতো চলে যাচ্ছে। ছেলেটির সম্পর্কে অন্তত কিছু খোঁজ নেওয়া দরকার। এবার তাই প্রশ্ন করল, তোমার নাম কী? প্রশ্ন শুনে সে থামল না। বাঁ-দিকের পায়ে চলা সরু ঝোপঝাড়ের রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে দূর থেকে বলল, আমার নাম ঝড়ু।

ব্যাস, এই কথা বলেই অন্ধকারেই সে যেন তাড়াতাড়ি চলে গেল নজরের বাইরে। তখনই একটা ঝড়ো বাতাসে আশেপাশের গাছগুলির ডালপালা কেঁপে উঠল। দূরে আনন্দপুরের ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে তবু বুকের ভিতর অজানা শিরশিরানি। এতক্ষণ ছেলেটি ছিল তার মনে কোনো ভয়ডর ছিল না। ভূতপ্রেতের কথা চিন্তার মধ্যেও আসেনি। কিন্তু এখন কেন এমন অস্বস্তি লাগছে? চারপাশের আবহাওয়া বড়ো ভূতুড়ে মনে হয়। তেনাদের কথা মনে এলে এরকম সুনসান পথে ভয় যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে বুকে চেপে বসে। এখন মনে হয় ছেলেটি বাকি পথটুকু সঙ্গে থাকলে ভালো হত।

শেষপর্যন্ত এক বুক উৎকণ্ঠা নিয়ে বাকি পথটুকু পার হয়ে নির্বিহ্নে গ্রামে পৌঁছে গেল বাসুদেব। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে বাসুদেব দেখতে পেল ওর স্ত্রী মায়ারানির ভাই রামকৃষ্ণ এসেছে। রামকৃষ্ণ এখানকার একটি স্কুলের শিক্ষক। চারপাশের অনেক কিছু খোঁজখবর রাখে। বেশ ভালোমানুষ। মায়ারানিও সরলা প্রকৃতির। ওরা ভাই-বোনে একজোট হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসুদেবের অপেক্ষায়।

ওকে দেখে রামকৃষ্ণ এগিয়ে এসে খুশি খুশি গলায় বলল, যাক তোমাকে অক্ষত দেখে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টি ভেজা এতটা পথ জল কাদা পার হয়ে কী করে এলে? আমরা দারুণ চিন্তায় ছিলাম।

খুব সহজ গলায় বাসুদেব বলল, একজন ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে সাইকেলে একই পথে আসছিল। সে আমাকে ঠিকঠাক পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।

কথাটি শুনে রামকৃষ্ণ অবাক। কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, তুমি ওর পরিচয় নিয়েছ ও কোথায় থাকে, কী নাম? বাসুদেব সামান্য চিন্তা করে বলল, ওর নামটি বেশ অদ্ভুত—ঝড়ু। ওরা থাকে জোড়া বকুলতলার ওদিকে। এবার রামকৃষ্ণের কপালে ভাঁজ দেখা দিল। তবে কোনো একটি বিষয়ে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ছেলেটি ঠিক কথাই বলেছে। ওর মায়ের নাম রজনি। ওরা খুব গরিব। ছেলেটি বাসুদেবপুর হাইস্কুলে পড়ত। ওর ভালো নাম স্বপন। ঝড়-জলের রাতে জন্ম হয়েছিল বলে ডাকনাম ঝড়ু।

বাসুদেব চোখবুজে কী যেন চিন্তা করে বলল, তাইতো তাইতো, মনে হচ্ছে আমি যেন ওকে চিনি।

রামকৃষ্ণ স্মরণ করিয়ে দেয়, মনে আছে বাসুদেবদা সেবার দ্বারকেশ্বরের বন্যার সময় যখন চারপাশে থইথই জল তখন কলাগাছের ভেলায় চেপে একটি ছেলে জল ও কাদা ভেঙে কতজন মানুষকে জল থেকে ডাঙায় তুলেছিল। সে হল ওই ঝড়ু। এ ছাড়া তুমি নিশ্চয় শুনেছিলে বদ্যিপাড়ার আনন্দীবুড়ি যার নিকট আত্মীয়স্বজন কেউ নেই তার যখন কলেরা হয়েছিল কেউ ওর চিকিৎসার জন্যে এগিয়ে আসেনি। তখন ডাকাবুকো স্বপন ওই আনন্দীবুড়িকে পাঁজা কোলা করে তুলে হেলথসেন্টারে পৌঁছে দিয়েছিল।

রামকৃষ্ণ এখন স্বপন সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। বলল, ছেলেটার আরও গুণ আছে। পোস্ট অফিসে টাকা তুলে বাড়ি ফেরার পথে স্কুলের রিটায়ার পণ্ডিতমশাই বাণীকণ্ঠবাবুর অনেকগুলি টাকা কোনো ভাবে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। তিনি খেয়াল করেননি। ভাগ্য ক্রমে টাকাগুলি অন্য কারও নজরে পড়েনি। ওই ছেলেটি টাকাগুলি কুড়িয়ে পেয়ে থানায় জমা দিয়েছিল। পণ্ডিতমশাই পুরোটাকা ফেরত পেয়েছিলেন।

বাসুদেব এসব শুনে উল্লসিত হয়ে বলল, বাঃ বেশ সমাজসেবী ছেলেতো, এরপর যখন আমার দোকানে আসবে তখন ও রকম পরোপকারী ছেলেকে নিশ্চয় কিছু উপহার দেব তার সাথে বড়ো একটা কেক খাওয়াব।

গলার স্বর ভারি হয়ে এল রামকৃষ্ণের, বলল, সে সুযোগ হবে না বাসুদেবদা, জঙ্গলের রাস্তায় দেখা তোমার সাইকেল সাথি স্বপন কোনোদিনই তোমার কাছে আসবে না।

কেন, আসবে না কেন? অবাক হয়ে জানতে চাইল বাসুদেব।

ইতিমধ্যে কাজের মেয়ে মানদা ওদের কাছে এসেছিল। শুধু শেষের দিকের কয়েকটি কথা শুনে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠল, কী কাণ্ড দ্যাখো, বাবু আমাদের সাইকেল ভূতের পাল্লায় পড়েছিল। ওই ভূতের কথা আমরা শুনেছি। বনের রাস্তায় থাকে।

ভূত? সে কী কথা। সাইকেল ভূত সত্যি নাকি গো? ওখানে ভূত আছে? সাধাসিধে মায়ারানির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠে আতঙ্কে। চোখ-মুখের ভাব বদলে যায়।

আঃ তুমি চিৎকার করো না ওভাবে। কী সব উলটা-পালটা বক বক করছ সেই থেকে। সাইকেল ভূত আবার কী? মানদার দিকে তাকিয়ে কড়া সুরে ধমকে উঠল বাসুদেব।

রামকৃষ্ণ কিন্তু ধীর গলায় বলল, মানদা বোধ হয় সবটাই ভুল বলছে না। এর আগে শুনেছি ওই রাস্তায় দু-একজন সময় বিশেষে ওর দেখা পেয়েছে।

মোটেই না, আমি তোমাদের কথা একফোঁটা বিশ্বাস করি না। নিজের চোখে অমন একজন জলজ্যান্ত ছেলেকে দেখলাম সেটা কি মিথ্যা? বাসুদেব মাথা ঝাঁকিয়ে প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানাল।

তুমি ছেলেটিকে ঠিকই দেখেছ। স্বপন নামের ওই ছেলেটি আজ থেকে দশমাস আগে এক ঝড়জলের রাত্রে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু জলে ডোবা চোরা গর্তে পড়ে গিয়ে মাথায় দারুণ চোট পেয়েছিল। সেই অবস্থায় কোনোভাবে সে ঘরে ফিরে এসেছিল। তবে তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল বেদম জ্বর। ওর চোট লেগেছিল মাথার ভিতরে যা বাইরে থেকে বোঝা যায়নি। এখানকার হেলথসেন্টারে ছেলেটির যথাসাধ্য চিকিৎসা হয়েছিল কিন্তু জ্বরে জ্বরে সাতদিন বেহুঁস থেকে স্বপন মারা গিয়েছিল। গরিব ঘরের ছেলে তাই এনিয়ে কোনো হইচই হয়নি। তোমরাও ওর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারোনি। জঙ্গলের রাস্তায় যেখানে তোমার সাথে শেষ দেখা ওই ঝুপসি তেঁতুলগাছের নীচেই ও সাইকেল থেকে গর্তে পড়ে গিয়েছিল।

ওমা সত্যি সত্যি ভূত! তুমি এতক্ষণ ভূতের সঙ্গে কাটিয়ে এলে? মায়ারানির সারাশরীর ভয়ে ও বিস্ময়ে থরথর করে কেঁপে উঠল।

কিন্তু অবিচল থাকে বাসুদেব। সে শান্ত স্বরে বলল ভূত! তোমাদের কথায় মেনে নিলাম সে ভূত। কিন্তু তোমাদেরও মানতে হবে সে মানুষের ভালো করে, একজন পরোপকারী ভূত। এতক্ষণ ধরে রামকৃষ্ণের বৃত্তান্ত মন দিয়ে শুনে সে জোর গলায় ভূতের পক্ষে সওয়াল করল।

স্বামীর মুখের ভাষায় পুরোপুরি বল ভরসা পেল মায়ারানি। মনও বদলে গেল তাড়াতাড়ি। তারপর বাসুদেবের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ঠিক বলেছ তুমি ওতো উপকারী ভূত। এবার চোখেমুখে স্বস্তি ফুটিয়ে নিজের মতো করে বলল, এতদিন ধরে একটা কথা অনেক বার শুনেছি খারাপ লোককে দোষী ঠাউরে ঠাট্টা করে বলা হয় স্বভাব যায় না মলে। এখন দেখেশুনে বুঝতে পারছি কথাটি মন্দ ভালো সব দিক থেকেই কত খাঁটি। যে ভালো মানুষ সে মরণের পরও ভালোই থাকে তার স্বভাব কোনো দিনই বদলায় না।

কথাগুলি বলতে বলতে স্বপন নামের অজানা ছেলেটি যে অন্ধকারে জলে ডোবা খানাখন্দের রাস্তায় ওর স্বামীকে বিপদ থেকে আগলে আগলে রক্ষা করে সুস্থভাবে ঘরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে সেই চোখে না-দেখা ছেলেটির জন্যে ওর বুক গভীর আবেগে উথলে উঠল। সরল মনের মায়ারানি ভাবল, আহা! কী সোনার টুকরো ছেলে!

ভাবনার উচ্ছ্বাসে বরাবরের অভ্যাস মতো বুক থেকে বেরিয়ে আসছিল একজন মায়ের মুখের ভাষা, ভালো থেকো, বেঁচেবর্তে থেকো বাবা।

কিন্তু চকিতে সে হুঁশ ফিরে পেল। বুকের কথাগুলি মুখে এলেও ঠোঁটের মধ্যে আটকে রইল।

তবে চোখের জল আটকাল না। মায়ারানির গালের উপর গড়িয়ে পড়ল জলের ধারা।

যা দেখে কাজের মেয়ে মানদা দারুণ অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে নিজের মনেই বিড় বিড় শুরু করল, ওমা এমন কাণ্ড জেবনে দ্যাখিনি। ভূতের জন্যে চোখের জল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *