সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও শেরশাবাদিয়া ভাষা – আকবর হোসেন
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হল কোন সংস্কৃতিকে জোর করে নিয়ন্ত্রন, বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে ধ্বংস করে দেওয়া। অন্য ভাষার সংস্কৃতির প্রভাবে যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল, পিছিয়ে পড়া ভাষার অপমৃত্যু ঘটে, তখন আমরা তাকে এক ভাষার প্রতি অন্য ভাষার আগ্রাসন বলি। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বলতেও দ্বিধা নেই। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একদিনে আসেনি। পুঁজিবাদী সমাজের ধ্যন-ধারণা থেকে এর জন্ম হয়। সামন্তবাদী সমাজ থেকে মানুষ যখন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ করে তখন তারা চিন্তা করে, পুঁজির বিকাশ হবে না যদি তাদের সংস্কৃতিকে সবাই অনুসরণ না করে। ফলে তাদের কৌশলে ভিন্নভাষী মানুষ নিজের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে অন্য সংস্কৃতির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয় এবং সেই সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভাষার এই আগ্রাসন কোন বিছিন্ন ঘটনা নয়। সভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জাতি ও ভাষা, দুর্বলজাতি ও তার ভাষাকে গ্রাস করতে চেয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই প্রয়াস সফলও হয়েছে। একটি বিজয়ী জাতি বিজিত জাতির ভাষাকে বিলুপ্ত করে তার নিজের ভাষাকে সেই জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। নানা প্রলোভন, অর্থনৈতিক, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দুর্বল জাতি বিজয়ী জাতির ভাষাকে সাদরে বরণও করে নিয়েছে। এই ভাবে পৃথিবীতে অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে। অনেক ভাষা আজ হারানোর মুখে। আসলে একটি ভাষার প্রায় বিলোপ মানে একটি সংস্কৃতি বিলোপ, একটি জাতিসত্তার অপমৃত্যু। আর এই রকম একটি ভাষা মুসলিম সম্প্রদায়ের শেরশাবাদিয়া ভাষা।
শেরশাবাদিয়া ভাষায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রসঙ্গ আলোচনার করার আগে এই জাতির জীবন, সংস্কৃতি, উত্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণার প্রয়োজন। এই শেরশাবাদিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী মূলত আফগান দেশীয় পাঠান মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক জটিল আবর্তে কোন এক সময় দলবদ্ধ ভাবে অখন্ড পাঞ্জাবে তারা চলে আসে এবং এখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ষোল শতকের তিন-চারের দশকের সময়কালে অর্থাৎ শের খাঁর গৌড় আক্রমনকালে তারা তাঁর সৈন্য হিসাবে গৌড় অঞ্চলে পদার্পণ করে। শের শাহ রাজ্যকে শাসনকার্য ও রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কয়েকটি পরগনায় ভাগ করেন। এ রকমই একটি পরগনা হল ‘শেরশাহাবাদ’-যার ভিতরে ছিল বাংলার রাজধানী গৌড় শহর ও পরবর্তীতে টাঁড়া শহর। এর আয়তন ১,০৬,৫৬৮ একর, এর অধীনে ১৫টি এস্টেট রয়েছে। মূল অংশটি গঙ্গা ও মহানন্দার মধ্যবর্তী এলাকায় গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ নগরকে ঘিরে অবস্থিত। আর এই শেরশাহাবাদ পরগনার অধিবাসীরা শেরশাবাদী বা শেরশাবাদিয়া নামে পরিচিত। এই জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশেষকেও শেরশাবাদী বা শেরশাবাদিয়া ভাষা বলে। ঐসব যুগে শাসকদের ভাষা ফারসী থাকলেও এই পরগনার সাধারণ জনগন এমন এক কথ্য ভাষায় কথা বলত, যার মধ্যে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য রয়েছে— যা শেরশাবাদিয়া ভাষা নামে পরিচিত। মালদার অন্যতম লোকসংস্কৃতি গম্ভীরা এই ভাষায় গাওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে সেই ভাষার ঐতিহ্য, ধারাবাহিকতা, কৃষ্টি-কালচার, সাহিত্যচর্চা হারিয়ে যেতে বসেছে।
আধুনিকতার সূত্রপাতে যেমন আমাদের মনন চিন্তার গভীরতা বেড়েছে তেমনি ইউরোপীয় ধারাই লালিত হয়ে তাদের সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি অনুকরণের চেষ্টা করেছি। দেশের মানুষ বেশি বেশি করে বিদেশী সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চায়- আর এটাকেই তারা সভ্যতা ও আধুনিকতা বলে মনে করে। ফলে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, রীতিনীতির কথা ভূলে যায়। শেরশাবাদিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে তার ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমান প্রজন্ম শেরশাবাদিয়া ভাষা থেকে প্রায় বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিছিন্ন পড়েছে সেটা ভূল, তাদেরকে সেই পথে চালনা করা হচ্ছে। মুসলমান সমাজ এমনিতেই শিক্ষা সংস্কৃতি দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল, তার ওপর ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা সার্বিক শিক্ষার পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। উনিশ শতকের যে নবজাগরণ, সেই নবজাগরণের আলো এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। তবে সেই ভাবে গ্রামীন মানুষকে খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি। পরবর্তীতে শিক্ষার আলো যখন সমাজের সবক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তখন শেরশাবাদিয়ার সেই সমস্ত মানুষরাও বুঝতে পারে শিক্ষার গুরত্ব। এতদিন পর্যন্ত এই জাতি নিজস্ব সাংস্কৃতিক, ভাষাকে আঁকড়ে থাকলেও সেই ঐতিহ্য বর্তমানে অনেকটাই হারিয়ে গেছে। বাইরের মানুষের কাছে এই জনগোষ্ঠীর চাল-চলন, কথাবার্তা খুবই পরিচিত। যেন ভাষায় তাদের পরিয় বহন করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলার হার কমে যাচ্ছে। এর মূলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনকে অস্বীকার করা যায় না। যেহেতু ভাষাটি একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেহেতু শিক্ষা-সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রয়োজনে অন্য ভাষার প্রভাব পড়েছে বা বাধ্য হয়ে সেই ভাষাগুলির দারস্থ হতে হয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারি কাজকর্মও এই ভাষায় করা হয় না। শেরশাবাদিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ভাষা সীমাবদ্ধ রূপ নিয়েছে। তাই শিক্ষা-দীক্ষা, জীবন-জীবিকা, ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য ভাষার উপর নির্ভর করতে হয়। যেহেতু শেরশাবাদিয়া অধ্যুষিত এলাকা বাংলার মধ্যে অবস্থিত, সেহেতু বাংলা ভাষার প্রভাব সবচেয়ে লক্ষনীয়। তবে বর্তমানে ইংরেজি ভাষার আগ্রসনও ব্যাপক ও জোরদার হতে শুরু করেছে।
শেরশাবাদিয়া ভাষা বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসলেও গ্রামীন সাধারণ মানুষের মধ্যে তা কিছুটা বেঁচে আছে। আর এই বিপন্নতা তখনই দেখা গেছে যখন এই ভাষার কথা বলার লোক কমে এসেছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রলোভনে সেই ভাষা-ভাষিরা অন্য ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেছে, পরবর্তী প্রজন্মকে মাতৃভাষা হিসাবে সেই ভাষা শেখানো হয় না, সরকারি কাজে, পঠন-পাঠনে সেই ভাষাকে গুরত্ব দেওয়া হয় না, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা করা হয় না। শুধু তাই নয় এই জনগোষ্ঠীর যে পরিবারে শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে বা যারা শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিকতার অহংকারে, নিজেকে সবার কাছে জাহির করার বাসনায় তারা এই ভাষাকে ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণা করতে শুরু করে।আঁকড়ে ধরতে চায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষাকে। পরবর্তী প্রজন্মকেও তারা এই শেরশাবাদিয়া ভাষার ধারের কাছে যেতে দেয় না। তাদের কাছে সেই ভাষা অজানাই থেকে যায়। এমনকি এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই হোক আর বাইরে, এই ভাষায় কথা বললে তারদিকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তাকানো হয় এবং তাকে অশিক্ষিত, অপদার্থ, মুর্খের আখ্যায় ভূষিত করতে মন ছটপট করতে থাকে। অনেক সময় তার বহিঃপ্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষিত হলে তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়— সমালোচনায় তার জীবন-সংস্কৃতিকে খান খান করা হয়। শিক্ষিত হলেও বংশের কোন খারাপ বিশেষণে তার শিক্ষাকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়- শুধু শেরশাবাদিয়া ভাষা ব্যবহারের জন্য। তুচ্ছার্থ অর্থে অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং স্বগোষ্ঠীর একদল শিক্ষিত মানুষরা এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের ‘শেরশা’ বাদ দিয়ে শুধু ‘বাদিয়া’ বলে ব্যঙ্গ করে। ফলে শেরশাবাদিয়া ভাষার প্রতি বিরূপতা তৈরী হয়। এক সময় এই ভাষা তারা প্রায় ভূলে গিয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষাকে আঁকড়ে ধরে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সর্বাত্মক আগ্রাসনেই আজ শেরশাবাদিয়া ভাষা বিপন্নতার পথে। এর প্রভাব এতটাই সর্বগ্রাসী ও মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মানুষের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, পোশাক, জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতার জায়গায় শেরশাবাদিয়া ভাষাকে সরিয়ে কোথাও বাংলা, আবার কোথাও ইংরেজি ভাষা জায়গা করে নিয়েছে।
মানুষের চিন্তা-চেতনা, আদর্শকে নিয়ন্ত্রন করার জন্যই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হয়। যে কোন আগ্রাসনই হোক তার প্রভাব কখনোই ভালো নয়। আর যদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয়, তবে তা হয় আরও ভয়াবহ। কারণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বার বার প্রয়োগ করতে হয় না। একবার কোন সমাজ, জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে পারলে তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। যেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হয়তো থাকে না। শেরশাবাদিয়া সম্প্রদায়ের সামগ্রিক জীবন প্রণালীকে বাংলা ও ইংরেজির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ভীষণভাবে গ্রাস করেছে। পরিবর্তন করেছে সামগ্রিক জীবনের কথ্যভাষার রূপকে। সেই পরিবর্তনময় ভাষার বিবর্তনকে বোঝাতে কিছু উদাহারণের আশ্রয় নেব। যেমন খালি করা অর্থে বোঝাতে এই সম্প্রদায় ‘আজোড়’ শব্দ ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমানে ‘খালি’ শব্দের প্রাধান্য দেখা যায়, তেমনি উড়োশ অর্থে ছারপোকা, ওসরা-বারান্দা, ওসার-চওড়া, ওচ্ছা-বেটে,খাটো, কান্ধা-ধার, কবিতর-পায়রা, খাট্টা-টক, গিধনী-শকুন, গতোর-শরীর, গা, পহাত-সকাল, ইটে-ওটে-এখানে-ওখানে, উঝোট-হোঁচট, উদাম-খোলা, সানিহ্যা-প্রবেশ, উকাশ-অবকাশ, লহু-রক্ত, এ্যাকোড়া-একরোখা, জেদি, ক্যাইটঠ্যা- ঘন, শক্ত, কৃপণ, খৈলহা-অলস, খাসলত-স্বভাব, চরিত্র, গুমান-অহংকার, গুদড়ি-ছেঁড়া কাপড়, ঘিন্যাহী-ঘৃণ্য, চোপা-মুখ, গিথ্যান-বাড়ির প্রধান কর্ত্রী, ঘাটা-রাস্তা, জাঞ্জোরা-ভূট্টা, জিরি-মিহি, তোগদির-ভাগ্য, দদ-ব্যথা, দড়া-রশ্মি, পুসতা-বারান্দা, ফকফৈক্যা-ধবধবে, ভোগা-মিথ্যা ইত্যাদি শত শত শেরশাবাদিয়া শব্দের জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলা ভাষার শব্দগুলি। কয়েকটি শব্দ তুলে ধরেছি মাত্র। আরও অনেক শব্দ বাংলার ভাষার আগ্রাসনের মুখে মুখ থুবড়ে পড়েছে, উচ্চারিত হয়েছে বাংলা ভাষা। এক প্রজন্ম যখন অন্য ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু শব্দের পরিবর্তন করেছে, পরবর্তী প্রজন্ম তো সেই পরিবর্তন শব্দের স্পর্শে আসেনি, বরং শিশু ও কৈশোর বয়সে যা শিখেছিল, তা থেকে রেহাই পেতে চেয়েছে। যেহেতু বর্তমানে শিক্ষার আলো প্রায় শেরশাবাদিয়া পরিবারে প্রবেশ করেছে সেহেতু বাইরের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে। ফলে নিজের ভাষাকে গ্রাস করে নিয়েছে অন্য ভাষা- যার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মাতৃভাষার প্রতি মমতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে ইংরেজি ভাষাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ইংরেজি ভাষার জন্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আরও সহজ হয়েছে। মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। এই ভাষার আগ্রাসন কেবল উন্নয়নশীল দেশের জন্য নয়, অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও জনগোষ্ঠীর ভাষা আজ ইংরেজির দাপটে বিলুপ্ত হতে চলেছে। সব ভাষাকে আত্মস্থ করে চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ ইংরেজি ভাষা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে অনেক ভাষা যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি বিলুপ্তির পথেও অনেক ভাষা। যুগ যুগ ধরে দুর্বল ভাষার ওপর সমৃদ্ধ ভাষার আক্রমন, সন্ত্রাস অব্যাহত থেকেছে। শেরশাবাদিয়া ভাষাও সেই আগ্রাসন থেকে রেহাই পাইনি। উপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা ইংরেজি ভাষাকে আপন বলে গ্রহন করে নিয়েছি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কখনোই সম্ভব নয়। বর্তমান সমাজে তার বিস্তার আরও বেশি। তাই ছোট বয়স থেকে অভিভাবকেরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে শুরু করে। ফলে তার পক্ষে মাতৃভাষার আপন স্বাদ গ্রহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। অভিভাবকরাও ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি ভাষায় কথা বলাকে এক অহংকার হিসাবে গ্রহন করে। সর্বত্র তা জাহির করতেও পিছপা হয় না। আবার শিক্ষা, চাকরি, সুযোগ-সুবিধার চমকপ্রদ ফাঁদে পড়ে নিজদের অতি আধুনিক বলে মনে করে। এটাও শেরশাবাদিয়া ভাষার প্রতি ইংরেজি ভাষার সাম্রাজ্যবাদ। আমরা সারাদিনে অনেক ইংরেজি ভাষার আশ্রয় নিয়ে চলাফেরা করি। যেমন- ব্রাশ, কলগেট, চেয়ার, টেবিল, মোবাইল, চার্জার, ব্যাটারি, টি-টেবিল, বেঞ্চ, সিলিন্ডার, গ্যাস, ওভেন, শার্ট, প্যান্ট- শত শত শব্দ ব্যবহার করি। ইংরেজি ভাষার প্রচুর শব্দকে নিজের বলে গ্রহন করে নিয়েছি। এতটাই শব্দগুলির সঙ্গে আত্মস্থ হয়ে গেছি যে, সেই ভাষাগুলি ছাড়া আমরা অচল। এমনকি বাংলা ভাষার মানুষরাও। অনেক নিজস্ব ভাষাও হারিয়ে গেছে ইংরেজি ভাষার প্রভাবে। যেমন ‘উরাল’ বলতে গরু মহিষের গাড়ির পেছনের দিকে ভারী ওজনকে বোঝাত, ধুরি বলতে গাড়ির দুই চাকার মধ্যবর্তী সংযোকারী মোটা দন্ডকে বোঝাত কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গাগুলি দখল করে নিয়েছে ইংরেজি শব্দ নামাঙ্কিত যন্ত্র, ট্র্যাক্টর। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে পাম্পিং মেশিন, থ্রেসারসহ আরও অনেক শব্দের প্রবেশ ঘটে। এই সমাজের আগের মানুষরা মাসের নাম নিজের ভাষায় বলত- অগ্রহায়ণকে আঘুন, চৈত্রকে চৈত, শ্রাবনকে শাওন, ভাদ্রকে ভাদু, পৌষকে পুষ। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজি মাস তারিখের বাইরে যেতে পারে না। ফলে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন এই জাতির সত্তাকে কতটা আঘাত হেনেছে, তা সহজেই অনুমেয়।
তাই বলা যায়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যেকোন জাতি বা গোষ্ঠীর সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিশাল ক্ষতিকর। আমাদের ভাবা দরকার এমন পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে। এর উত্তরও আমাদের কাছে, বিদেশী সংস্কৃতি প্রীতি আমাদের এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এমনকি দেশের মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা না থাকায় পরভাষা নির্ভর হয়ে থাকতে হয়। ফলে তারা অন্য ভাষা সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। এই শেরশাবাদিয়া ভাষা বিপন্ন হয়েছে দুই দিক থেকে- এক, অন্য একটি ভাষাকে সাদরে গ্রহন করে, দুই নিজ ভাষীদের অবহেলা ও উপেক্ষা। অন্য ভাষার যে সম্পদ ও শক্তি আমাদের আকৃষ্ট করছে, সেগুলি অর্জন করা জরুরী। শুধু ভালোবাসা দিয়ে একটি ভাষাকে বাঁচানো যায় না, সব দিক দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলতে হয়- যেটা শেরশাবাদিয়া ভাষার ক্ষেত্রে হয়নি। ফলে ভাষার উপযুক্ত কাঠামো তৈরীর পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে মাতৃভাষায় পাঠ, মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ, সরকারি কাজকর্ম, সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় মাতৃভাষাকে প্রধান্য দিতে হবে। তার জন্য দেশীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সংকীর্ণতা নয়, বিভিন্ন সমৃদ্ধ ভাষার সংযোগ ও আদান প্রদানের মাধ্যমে নিজ ভাষাকে শক্তিশালী, স্বাবলম্বী ও সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।
সহায়ক গ্রন্থ:
১। আব্বাস আলী খান, বাংলা মুসলমানদের ইতিহাস, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, অষ্টম প্রকাশ, জুন ২০১৪।
২। জাহিরুল ইসলাম, বাংলায় মুসলমানের ইতিহাস, পূর্বা, কলকাতা-১৪, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০১৫।
৩। আবদুল সামাদ, শেরশাবাদিয়াদের কথালেখ্য, বাদিয়াবার্তা প্রকাশনা, মালদা, তৃতীয় সংস্করণ, আগস্ট ২০০৩।
৪। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৮।
৫। ড. রামেশ্বর শ, সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা, পুস্তক বিপনি, কলকাতা-৯, তৃতীয় সংস্করণ, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪০৩।
লেখক পরিচিতি: গবেষক, রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়, সহকারী শিক্ষক, ভগবানপুর হাই মাদ্রাসা (H.S), সামসী, মালদা।