সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বাংলা গান: সেকাল থেকে একাল – মধুমিতা সরকার

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বাংলা গান: সেকাল থেকে একাল – মধুমিতা সরকার

কোনো দেশ বা জাতির মেরুদন্ড হলো তার সংস্কৃতি। সেই দেশ বা জাতির পূর্ণ পরিচয় বহন করে তার সংস্কৃতি। আর দেশ বা জাতির উন্নতির প্রণোদনা হিসেবেও তা কাজ করে। কালের প্রবাহে বহমান মানব সভ্যতায় জাতিসমূহের পরস্পরের আগমন প্রত্যাগমনের মধ্যদিয়ে ঘটে নানা বিনিময় যা কোনো জাতির বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনিময়ের ক্ষেত্রে মানুষ নিজ সংস্কৃতির স্বভাবজাত, হৃদয়গ্রাহী ও উত্তম বস্তু ধারণের মধ্যদিয়ে উন্নত হয়ে ওঠে, পূর্ণতা পায় তার সংস্কৃতি। আদান প্রদান যখন পারস্পরিক বিনিময় না থেকে কোনো এক পক্ষের প্রাধান্য বেড়ে যায় এবং অপর পক্ষে তা প্রভাব বিস্তার করে তখন আগ্রাসন আভাসিত হয় এবং সময়ের আবর্তে এর প্রভাব গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। আগ্রাসন থাকে আধিপত্যবাদ। এতে কোনো একটি দেশের একক সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতিকে প্রায় ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং নিজে সেই সংস্কৃতির স্থান নিয়ে নেয়। অর্থাৎ কর্তৃত্ব ভাবাপন্ন হয়ে কোনো সংস্কৃতি যখন অন্য সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিয়ন্ত্রণ করে বা ধ্বংস করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে তখন তা হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আগ্রাসনে বন্দী হওয়া সংস্কৃতির ভিত্তিমূল নড়ে যায়। জাতির উন্নতির বদলে ঘটে অবনতি, সংস্কৃতি হয়ে ওঠে অপসংস্কৃতি। এর ফলে সেই দেশের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ধরন পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ বর্তমাণের বাঙালির সংস্কৃতির একাংশ। বাংলা তথা বাঙালির দীর্ঘদিনের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি বিদেশী-বিজাতী সংস্কৃতির নগ্ন প্রভাবে আজ যেন লক্ষ্যচ্যুত হতে বসেছে। তার নানা প্রকাশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে লক্ষিত হয়। সবচেয়ে বেশী দৃষ্ট হয় বর্তমানের বাংলাগানের বেশ কিছু অংশ জুড়ে।

গান হলো মানব সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। আর বাংলা গানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও গুরুত্ব পায়। কারণ গান ছাড়া বাঙালি অসম্পূর্ণ। গানকে বলা যেতে পারে বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রাণ। বাঙালি-মানসের সার্থক প্রতিফলন ঘটে গানেই। সর্ব কর্মে, সর্ব পরিবেশ-পরিস্থিতি, সর্ব অনুভূতিতে গান বাঙালির সঙ্গী, প্রধান অবলম্বনও। বাংলা গানের অভিজাত যে ধারা তা খুব সহজে প্রাপ্ত হয়নি। তার জন্য চলেছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নানা গ্রহণ-বর্জনের দীর্ঘপথ পরিক্রমা এবং তা পরিণতি পায় রবীন্দ্রনাথের হাতে।

বাংলা সংগীতের ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ঔপনিবেশিক বসতি রূপে কলকাতার আবির্ভাবের সাথে বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারণের ফলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিধ শ্রেণির মানুষ জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কলকাতায় এসে বসবাস করতে শুরু করে। আর এদের সূত্রে আসে ঐতিহ্যাশ্রয়ী গ্রামীণ সংস্কৃতি যা কলকাতায় এসে নিজের রদবদল ঘটিয়ে গড়ে তোলে স্বতন্ত্র লোকসংস্কৃতি যাকে বলা যায় নাগরিক লোকসংস্কৃতি। এই নাগরিক লোকসংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ সংগীতের এমন রূপ গড়ে ওঠে যা তৎকালীন নবসৃষ্ট কলকাতার পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভিঘাত ও অর্থের প্রাচুর্যে সৃষ্ট অবনমিত রুচিকে তুলে ধরে। কবিগান, যাত্রা, পাঁচালি, আখড়াই ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা গান সে সময় প্রচলিত থাকলেও তার রূপ ও ভাষাভঙ্গি এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যা বাবু কালচারের বিকৃত রুচি ও আমোদের প্রকাশক হয়ে ধরা পড়ে। গানের বিষয়গত ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ও প্রাধান ছিল ধর্ম ও প্রেম। প্রাধান্য ছিল আদি রসের, যার ফলে তৎকালীন বাংলা গানের বাণী হয়ে ওঠে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অশিষ্ট ও সুরগত দিক থেকে হয়ে পড়ে দুর্বল। সুরগত দুর্বলতা ও বাণীগত অশিষ্ট ভাষা ও ভঙ্গির দাপটে তৎকালীন বাংলা গান এক সময় প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দু’একটি উদাহরণ— (i) “কও দেখি হে নূতন নাগর / একী নূতন ভাব রাখা / হয়ে কামিনী, জেগে পোহাই যামিনী / ছমাসে নমাসে তোমার পাই নাকো দেখা”, (ii) “তোমার কাঁচা পিরিত তাইতে জান না / পুরুষ পরশ পিরিত মাখা / ঠেকলে পরে হয় সোনা”, (iii) “দেশ ঢলালেম প্রেম করে সই / প্রাণ গেলে বাঁচি / বিচ্ছেদ বিষে, লোকের রিষে / আমি দুই জ্বালাতে জ্বলতেছি”১ ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবে সংগীত শিক্ষার সূত্রপাত যে সমস্ত গানের মধ্যদিয়ে হয় ঠাকুর বাড়ির সংগীত শিক্ষক বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে, তার উল্লেখ তিনি নিজেই করেছেন— “এক যে ছিল কুকুর চাটা শেয়াল কাঁটার বন / কেটে করলে সিংহাসন” ইত্যাদি। এই গান শিক্ষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন— “বিষ্ণু যে গানে হাতেখড়ি দিলেন এখনকার কালের কোনো নামী বা বেনামী ওস্তাদ তাকে ছুঁতে ঘৃণা করবেন”।২ নাগরিক সভ্যতার অর্থনীতির চাপে শিল্প পণ্যে পরিণত হয়।, ঘটে রুচির অবনমন— এও তো আগ্রাসনধর্মী ভাবনার ফলশ্রুতি। বাংলা গানের এই দুরূহ পরিস্থির চাপে অভিজাত ভদ্র সমাজ এ সমস্ত গান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে থাকে এবং স্বতন্ত্র অভিজাত সাংস্কৃতির রুচি আনুযায়ী গান সৃষ্টির নানা প্রয়াস, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর অভিজাত শিষ্ট সংগীত ধারা হিসেবে বাংলা গান প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। বাণীগত অশিষ্টতা ও সুরগত দুর্বলতা থেকে মুক্ত করে তিনি অভিজাত বাংলা গানের মূল ধারাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ধারায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ, নজরুল প্রমুখ একে একে নানা সংযোজন করে বাংলা গানের ধারাকে শক্তিশালী ও উন্নত করে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান। এঁরা প্রত্যেকেই দেশী-বিদেশী গানের নানা উপাদান সংযোজন করেন বাংলা গানের ধারায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংগীতের নানা প্রয়োগ করেছেন বাংলা গানের রূপ নির্মিতিতে। তিনি খেয়াল, দ্রুপদ, ভারতীয় বিভিন্ন আঞ্চলিক গান বা বিলাতি গান ভেঙ্গে বাংলা গান যেমন সৃষ্টি করেছেন, তেমনি বিভিন্ন রাগরাগিনী, লোকসংগীত, বিলাতি সংগীতের নানা প্রভাব দ্বারাও গান রচিত করেছেন। তবে তাঁর গানের ভাষায় এই প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়না, তা সুর ও বাণীর যথাযথ প্রয়োগে হয়ে উঠেছে মৌলিক সৃষ্টি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান সৃষ্টিতে পাশ্চাত্য প্রভাব অনেকটাই। তিনি পাশ্চাত্য গানের সুর কাঠামো বজায় রেখে যেমন গান রচনা করেছেন, তেমনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংগীতের মিশ্রণেও গান সৃষ্টি করেছেন। সংগীতের ভাব ও সুরগত দিকে বৈচিত্র্য আনেন, পাশ্চাত্য গানের গতিভঙ্গি বা ওজস্বিতা নিয়ে আসেন বাংলা গানে। বাংলা গানের জগতে তাঁর অভিনব সংযোজন হাসির গানে তিনি বহু ইংরেজী শব্দের ব্যবহারও করেছেন। যেমন— ‘Reformed Hindoos’ গানে লিখলেন— “যদি জানতে চাও আমরা কে / আমরা Reformed Hindoos / আমাদের চেনে না ক যে, / Surely he is an awful goose” , বা “তারেই বলে প্রেম -/ যখন থাকে না future এর চিন্তা / থাকে না ক shame – / তারেই বলে প্রেম”৩ ইত্যাদি। রজনীকান্ত সেনও তাঁর কিছু গানে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেছেন— “দেখ আমরা জজের Pleader, / যত Public Movement এ leader / আর, conscience to us is a marketable thing”, বা “দেখ আমরা হচ্ছি পাশ করা / ডাক্তার মস্ত মস্ত, / ঐ Anatomy, Physiology তে / একদম সিদ্ধহস্ত”।৪ অতুল প্রসাদ সেন বাংলা গানে সংযোজন করেন গজল ও ঠুংরীর সুর কৌশল, আঙ্গিক ও ভাব। বিশেষ করে ঠুংরী গানের সূক্ষ্ম কারুকার্য ও গীতশৈলী বা চাল সংযোজন করেন বাংলা গানে। নজরুল ইসলাম দেশীয় ও বিদেশী গানের নানা ব্যবহার করেছেন তাঁর গানে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংগীত ধারা বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত করেন। বাংলা গানের সুরে আনেন মধ্যপ্রাচ্য সুরের সূক্ষ্ম কারুকার্য ও মাদকতা, করেন উর্দু, আরবী-ফার্সী শব্দের ব্যবহার। যেমন— “আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন / দিল বহী মেরা ফঁস গয়ী”, বা “বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে” বা “মদীর আঁখির সুধায় সাকী ডুবাও আমার এ তনুমন”৫ ইত্যাদি। নজরুল বাংলাগানের জগতে গজল-এর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশী-বিদেশী নানা গানের রূপ-ভাষা-ভঙ্গি-সুর ব্যবহার করে বাংলা গানকে উৎকর্ষতা দান করেছেন। উক্ত সংগীত স্রষ্টাদের সংগীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গীতের নানা ব্যবহার তাঁদের গানকে ভারাক্রান্ত করে তোলেনি কখনোই। কারণ তাতে ছিল না কোন আগ্রাসী মনোভাব বা আগ্রাসনের ছাপ। তা ছিল গ্রহণ, আত্মীকরণ ও মৌলিক রূপদান, যা বাংলা গানের ভান্ডারকে বৈচিত্র্যে ও ঐশ্বর্যে ভরপুর করেছে।

কালের প্রবাহে বহমান মানব সভ্যতার ভাষা ধীরে ধীরে সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠতে থাকে। সাহিত্যের ভাষা, কথ্য ভাষার সাথে সাথে এর অভিঘাত দেখা যায় সংগীত জগতেও। নজরুল পরবর্তী যে বাংলা গানের পরিচয় আধুনিক বাংলা গান হিসেবে, সে গানের ভাষা পূর্ববর্তী সংগীত স্রষ্টাদের গড়ে দেওয়া সংগীতগুণ সম্পন্ন কাব্যভাষা থেকে সরে আসতে থাকে। অতি সাধারণ শব্দ-বাক্য ধীরে ধীরে বাংলা গানে স্থান করে নেয়, ঘটতে থাকে ভাষা মিশ্রণও। যেমন— “ও কেন এত সুন্দরী হলো / ওমনি করে ফিরে তাকালো / দেখেতো আমি মুগ্ধ হবোই / আমি তো মানুষ” [কথা: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর ও শিল্পী: মান্না দে]। বা ‘লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার, আঁচল টেনে ধরো না / লোকে দেখলে বলবে কি, দুষ্টুমি আর করো না” [কথা গৌরপ্রসন্ন মজুমদার, সুর রাহুল দেববর্মন, শিল্পী: আশা ভোঁশলে], বা ‘মাছে কাঁটা খোঁপার কাঁটা, কাঁটা অনেক রকম / ফুলের কাঁটার চেয়েও জ্বালায় প্রেমের কাঁটার জখম’ [কথা: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর: রাহুল দেববর্মন, শিল্পী: আশা ভোঁশলে] বা ‘আমি মিস ক্যালকাটা চাই দিতে টিপস / এখনো তো কেউ জানে না আমার স্ট্যাটিসটিকস’ [কথা: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুর: সুধীন দাশগুপ্ত, শিল্পী: আরতি মুখার্জী], বা ‘আমার নাম এ্যাণ্টনি কাজের কিছু শিখিনি / সিংগিং কিম্বা লার্নিং পেইন্টিং ডান্সিং’ [কথা: পুলক বন্ধ্যোপাধ্যায়, সুর: বীরেশ্বর সরকার, শিল্পী: কিশোর কুমার] ইত্যাদি। এই ধারার গানের ভাষা কাব্যভাষার খোলস ছেড়ে প্রাত্যহিক জীবনের রোজকার ব্যবহৃত ভাষার কাছাকাছি সরে আসলেও সুর-বাদ্য-গায়কী অসাধারণ উৎকর্ষতা প্রকাশ করে ঢেকে দেয় বাণীর দৈ্ন্য। জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসে বাংলা গান। সময় এগোয়, তার সঙ্গে বদলায় বাংলা গানের জগৎ।

সময়ের হাত ধরে বর্তমানে বাংলা গান আজ পরিবর্তনের এমন স্তরে পৌঁছিয়েছে যে, একটা বড় অংশের বাংলা গানের ভাষা-ভঙ্গি-ভাব থমকে দেয় শ্রোতৃ-সমাজকে। রুচিশীল মন নিয়ে নির্দ্বিধায় এইগান শোনা বেশ কষ্টকর। এ-গানের বাণী অংশে যেমন নির্দ্বিধায় প্রাধান্য বিস্তার করেছে ইংরেজী-হিন্দী শব্দ, উচ্চারণ, তেমনি গানের ভাব-ভঙ্গিও রুচির অধোগমনকে স্পষ্ট করে। কয়েকটি গানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে—

১.

“মনের ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট টি ভি তে

তুই কালার লাগালি

রিমোট দিয়ে প্রেমের চ্যানেল দেখালি

ঠুমকা লাগালি রূপের বিজলি গিরালি

তোকে দেখে গাইছে প্রেমের রিমিক্স কাওয়ালী”

২.

“এই হাওয়া silki silki

বলে যায় বাতে দিলকি

চলো না ভেসে যাই জোয়ারে…

মস্তি মাঙ্গে দিল মাহি রে”

৩.

“Hey you listen to me

you are my love জানো তুমি…

ও মধু ও মধু I love you”

৪.

“…আমার স্বপ্ন জুড়ে তুই

আর তোর চিন্তারা শুধুই

ঘুরে ফিরে যাচ্ছে বারে বারে

আর কোনো রাস্তা নেই আমার…

O my love, আদুরে গোলাপ”

৫.

“যতই বলো আমায় বোকাভোলা

কাল হবি তুই আমার কোকাকোলা”

৬.

“চার আনার মাল খেয়ে আট আনার দাদাগিরি / এতো মানা যাবে না

রেশনের চাল খেয়ে বিরিয়ানীর বাতেলা / সেটাও দেওয়া যাবে না।

সিগারেট খাবো রে রেখেছ বাংলা বিড়ি / আইটেম দেখলে তবু,

মিস করি না বলতে / উফ কি লাগছে” ইতাদি

গানে হিন্দী-ইংরেজী শব্দের বহুল ব্যবহার, ‘তুই’ তোকারি করে বলা, ভাব-ভঙ্গি উপস্থাপনের অধোগমনে আজ বাংলা গান ভারাক্রান্ত। তবে একটা কথা স্বীকার করতে হয়, এ সকল গানের সুর-বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অসাধারণ, দুর্দান্ত। ফলে কোমর আপনিই দুলে ওঠে এর তালে। কিন্তু বাণী একটু মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় তার করুণ পরিণতি কোন পর্যায়ে গেছে। হিন্দী গানের আদলে এসেছে ‘তুই’ করে বলা। হিন্দী ভাষার ক্ষেত্রে ‘তুই’ সম্বোধন নৈকট্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয় (‘তু শায়র হ্যায়’, ‘মা তুঝে সলাম’, ‘তেরে দরপর সনম চলে আয়’, রূপ তেরা মস্তানা’ ইত্যাদি) এই আদলেই বাংলা গানেও অতি নৈকট্য বোঝাতে ‘তুই’ ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তা যেন আরও সাবলীল ভাব নিয়ে আসছে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ গান তৈরী হচ্ছে ‘মাস’-এর জন্য ‘ক্লাস’-এর জন্য নয়। গানকে আজ পণ্য বানিয়ে এই ‘সংগীত পণ্যে’র ক্রেতা বৃদ্ধির জন্য তাতে নানা গ্রহণ-বর্জন অবলম্বিত হচ্ছে, জোর দেওয়া হচ্ছে কথ্য ভাষা বা দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহৃত ভাষার উপর। গান কেউ কান দিয়ে শোনে, কেউ হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করে। বর্তমানে কান দিয়ে গান শোনার শ্রোতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই গান আজ অনুভব জাগায় না, হৃদয়ে দোলা লাগায় না, দোলা লাগায় শরীরে। সংগীতকে আজ পণ্যে পরিণত করে ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয় করতে তাতে নানা চটক ব্যবহৃত হচ্ছে। আগ্রাসনের এটি একটি প্রধান দিকও। স্বাধীন দেশে সংস্কৃতি আজ আগ্রাসনের শিকার হয়ে পরাজিত-পরাধীন। হারাতে বসেছে তার নিজস্বতা; তার মর্যাদা, হারাচ্ছে তার মধুর বাণী-সম্পদ।

গতিশীলতা সচলতার প্রধান লক্ষণ। প্রবাহমান সময়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে সমস্ত কিছুই, ভাষাও তার একটা অঙ্গ। বর্তমানে দৈনদিন জীবনের ভাষা বদলে গেছে— কেউ এখন খুব একটা ‘নমস্কার’ বলে না, বলে ‘হাই, হ্যালো’; ‘কিন্তু’ বলে না, বলে ‘বাট’, ‘বিদায়ে’র স্থলে ‘বাই’। নির্দ্বিধায় ব্যবহৃত হয় ‘দিবানা’, ‘জো হুকুম’, ‘বাওয়াল’, ‘ইয়ার’, ‘হামেশা’, ‘মস্তি’। শুধু তাই নয় ‘গুরু’, ‘মামা’, ‘কাকা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তার নিজস্ব অর্থ নিয়ে নয়, বিশেষ প্রকার কোনো কর্মদক্ষতা বা নৈকট্য বোঝাতে [বলো গুরু, কি দিলি মামা ইত্যাদি] যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এসব সম্বোধন। এর প্রভাব খুব স্বাভাবিক ভাবেই গানেও এসে পড়েছে। গানে অন্য শব্দ ব্যবহার মাত্রই খারাপ নয়। এই গ্রহণ-বর্জন চলতেই পারে। এক্ষেত্রে কোনো আনুগত্য বা বিরোধিতা না করে উপযোগিতা দেখা প্রয়োজন, সম্মানের সঙ্গে তার স্থান ছেড়ে দিতে হয়— এ ভাবেই ভাষা সচল থাকে, বিকাশ ঘটে— একথা খুবই সত্য। কিন্তু কোনো সংকীর্ণতা নয়, দেখতে হবে শব্দ বা বাক্যের মান, তার গভীরতা। এমন গানও তো আছে যেখানে অন্য শব্দের ব্যবহার নেই, তা বাংলাতেই রচিত। কিন্তু তার অর্থ-মান রুচিকে আঘাত করে। পুরো গান মন দিয়ে শুনলে একটাই কথা মনে আসে— “এ কেমন বাংলা গান?” —এ কেমন ভাষা ব্যবহার? —এমন উদাহরণ অনেক আছে। দৈনন্দিন জীবনে অবশ্যই আমরা শুদ্ধ বাংলা বলি না। তাতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করি যা বাংলা নয়। কিন্তু তা কখনোই রুচির সীমাকে লঙ্ঘন করে না। অভিজাত বাংলা গান প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা গানের যে রূপ ও ভাষাভঙ্গি ছিল সেটাও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেরই ফলশ্রুতি। হঠাৎ প্রাপ্ত প্রচুর অর্থের বলে বলিয়ান বাঙালি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভিঘাতকে দেশীয় গ্রাম্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে রূপ দিয়েছিল নিজস্ব রুচি আনুযায়ী। প্রভাব-আগ্রাসন ছিল, কিন্তু সম্মুখে ছিল না কোনো নিদর্শন। ফলে নতুন গড়ে ওঠা এ গানের রূপ পৌঁছিয়েছিল অশিষ্টতার চরম সীমায়। সেখান থেকে বাংলা গানকে উদ্ধার করে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা দেন রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীতে নানা গুণীর স্পর্শে গান সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এঁদের গানেও পাশ্চাত্য বা অন্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। তবে তা আগ্রাসন হয়ে ওঠেনি। তা ছিল গ্রহণ-আত্মীকরণের মাধ্যমে বঙ্গীয়করণ। গানের সুর-ভাষা-ব্যাকরণের উপর বিশেষ দখল থাকায় পঞ্চপ্রধান ও অন্যান্য স্রষ্টারা নিজেদের গানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নানা উপাদান প্রয়োগ করতে পেরেছেন বা আঙ্গিকগত নানা প্রয়োগ করেছেন সফলতার সঙ্গে। এতে কোথাও আগ্রাসী মনোভাব বা আগ্রাসন বিশ্রী ভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে তা হচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন খুব সূক্ষ্ম ভাবে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে আজ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। জাতি ও দেশকে প্রভাবিত – ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশীয় সমস্ত কিছু, এমনকি ভাষা বা মাতৃভাষার প্রতিও টান না থেকে তৈরী হচ্ছে দূরত্ব। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যদিয়ে দেশের নিজস্ব ইতিহাস, মূল্যবোধ, বিশ্বাসের ধরন বদলে যাচ্ছে, আত্মপরিচয় ধীরে ধীরে সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে, ভিন্ন সংস্কৃতির অভিঘাতে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে বাংলা গান আজ কেউ মন দিয়ে শোনে না, মনেও রাখে না। এর সুর বাদ্যে সাময়িক আনন্দ লাভ করে, উত্তেজনা বোধ করে, আর বাণী শুনলে থমকে যায় রুচিশীল মন। আতঙ্কিত হয় অর্থ বুঝে বা শব্দ ব্যবহারে, বোঝা যায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বাংলা সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে বাংলা ভাষা আজ এগিয়ে চলেছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিঘাতে, যার চরম প্রকাশ বাংলা গানে আজ বর্তমান।

তথ্যসূত্র:

১. সর্বানন্দ চৌধুরী সম্পাদিত, দুর্গাদাস লাহিড়ী সংগৃহীত ও সম্পাদিত ‘বাঙালির গান’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সংস্করণ, এপ্রিল ২০০১

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, জৈষ্ঠ্য ১৪১১ বঙ্গাব্দ, পৃ.-১৭৬

৩. সুনীলময় ঘোষ সম্পা. দ্বিজেন্দ্রলাল-সঙ্গীত সমগ্র, সাহিত্যম, অক্টোবর ১৯৯৭

৪. নিশীথ সাধু ও সুনীলময় ঘোষ সম্পদিত, রজনীকান্ত সঙ্গীত সমগ্র, সাহিত্যম, জানুয়ারী ১৯৯৭

৫. কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল গীতিকা, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০২

সহায়ক গ্রন্থ:

১. পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, আনন্দ, ২০১২

২. সুধীর চক্রবর্তী, গান হতে গানে, পত্রলেখা, ২০০৮

৩. সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের সন্ধানে, অরুণা প্রকাশণী, ১৩৯৭

লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ, বাগাটি, মগরা, হুগলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *