সাঁতু

পীতু 

ভগবানের সম্বন্ধে আপনাদের কোনও রকম স্পষ্ট ধারণা আছে?—বোধহয়, নাই। না-থাকিবারই কথা; কেন-না, সম্ভবত আপনারা সকলে সেই পন্থাই ধরিয়াছেন, যাহা অবলম্বন করিয়া আমায় হার মানিতে হইয়াছে। ওসব আগম নিগম বেদপুরাণে কোনও ফল হয় না। অরণ্যে ঘুরিয়া বেড়ানো, শুধু সংশয়ের ঘন অন্ধকার—যেটা একটু পথ বলিয়া মনে হয়, দেখা যায়, সেটা আরও নিবিড়তর অরণ্যে লইয়া আসিয়াছে মাত্র। 

তাই বলিতেছিলাম, বেশ একটা বিশদ ধারণা না থাকিবারই কথা। আমারও ছিল না; তবে সম্প্রতি লাভ করিয়াছি এবং আপনাদের মতো যাঁহারা অজ্ঞ, তাঁহাদের কাছে প্রকাশ না-করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। জানেনই তো—থাকিতে পারা যায় না, জিনিসটা এই রকমই। 

অতএব আমি যাহা জানিয়াছি শুনুন—ভগবান আকাশের চেয়েও বড়, ইচ্ছা করিলে হাতির চেয়েও বেশি খাইতে পারেন, আর প্রয়োজন হইলে রেলগাড়ির চেয়ে জোরে দৌড়াইতে পারেন। 

এ ঈশতত্ত্ব অপৌরুষেয় কি না বলিতে পারিলাম না। আমার পাওয়া আমার ভাইঝি ছবির কাছে। তত্ত্বটি অপূর্ণ হইতে পারে, কেন-না, ভগবানের ষড়ৈশ্বর্যের মধ্যে তিনটি মাত্র পাওয়া যাইতেছে; কিন্তু এই তিনটিতেই ধারণা এত স্পষ্ট করিয়া দিতেছে যে, অপর তিনটির জন্য মাথা ঘামাইবার দরকারই হয় না। নয় কি? 

আমার দীক্ষা ছবির কাছে। ছবির গুরু পীতু। ধানবাদের পীতু—আপনারা নিশ্চয় জানিতে পারেন। জানেন না?—আপনারা যে অবাক করিলেন। অবশ্য আমিও জানিতাম না। কিন্তু ছবির কাছে যে-রকম পরিচয় পাওয়া যাইতেছে, এবং তাহাতে ধানবাদের দিকের পৃথিবীটা সে একাই যে রকম ভরাট করিয়া আছে বলিয়া মনে হইতেছে, তাহাতে তাহার সম্বন্ধে লোকে অজ্ঞ থাকিতে পারে—বিশ্বাসই করিতে পারা যায় না; আমি নিজেও কী করিয়া ছিলাম, আশ্চর্য হইতেছি। 

যতটা আন্দাজ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে মনে হয় পীতুর বয়স চার হইতে সাতের মধ্যে। আমাকে ছবির বয়সের তুলনায় আন্দাজটা করিতে হইতেছে। ছবির নিজের যাইতেছে পাঁচ বৎসর। নূতন কোনও সঙ্গীর নিকট পরিচয় দেওয়ার সময় বলে, আমার নাম ছবি—ছ, বয়ে হস্বই, ছবি—অর্থাৎ প্রথম ভাগ ধরিয়াছে। অনেকটা, যেমন সঙ্গতি থাকিলে আপনারা নাম লিখিয়া ‘এম. এ. ডি-লিট’অথবা ‘বিদ্যাবিনোদ’ প্রভৃতি জুড়িয়া দেন আর কি! 

পীতুর বয়স চার হইতে সাতের মধ্যে ধরার কারণ এই যে, এই ছবির চেয়ে ছোট কী বড় ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

যখন পীতু-কথিত কোনও তথ্যে সংশয় প্রকাশ করি, ছবি তাহাকে যতটা সম্ভব বাড়াইয়া তোলে। ধরুন, যেন বৃষ্টির কথা উঠিল। আপনারা যে মনে করেন বাষ্পে শৈত্যস্পর্শ হইয়া বৃষ্টি সংঘটিত হয়, আসলে তাহা নহে। ওটা কতকগুলি হাতির কীর্তি; তাহারা ভগবানের আকাশের মতো-বড় পুকুর থেকে কলসি কলসি জল আনিয়া স্বর্গের রাস্তায় ছিটায়, তাহাতেই বর্ষা হয়। স্বর্গের পথ যে পিচ্ছিল— একথা আপনারাও স্বীকার করিবেন। জল পড়িবার পূর্বে হাতিরা নিজেরা যে পড়িয়া যায় না, তাহার কারণ তাহাদের পাখা আছে। যদি বলি, হাতির তো পাখা হয় না ছবি? ছবি উত্তর দেয়, পীতু বলেছে, সগের হাতিদের হয়, তুমি পীতুর চেয়ে বেশি জানো? পীতু আমার চেয়ে বড় মশাই, অনেক জানে। 

এক এক সময় আবার পীতু ছোটও হইয়া যায়। 

আমি বলি, পড়াশুনো কিছু করছ না ছবি, খালি রোদে রোদে দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছ, এবার যখন ধানবাদে যাবে, দেখবে, পীতু আকাশের মতো পড়ে ফেলেছে, তোমাদের সঙ্গে কথাও কইবে না। 

ছবি তাচ্ছিল্যের সহিত বলে, ইস্, পীতুর সাধ্যি! পীতু তো আমার চেয়ে ছোট।

নিজে সোজা হইয়া দাঁড়ায়, বলে, আমি তো এত্তো বড়। তাহার পর ডান হাতটা নামাইয়া বুকের কাছাকাছি আনিয়া মাথাটা নিচু করিয়া বলে, আর পীতু তো এত্তোটুকু। যখন ঈর্ষা প্রবলতর হয়, হাতটা আরও নামাইয়া একেবারে হাঁটুর কাছে লইয়া আসিতেও বাধে না। পীতুর বিদ্যার্জনের দিক দিয়া সে যে অন্য হিসাবেও নিশ্চিত্ত, তাহাও এক এক সময় জানাইয়া দেয়; বলে, ওর মা বলে,–তোর কিচ্ছু বিদ্যে হবে না পীতু…মার কথা মিথ্যে হয় না মশাই, পীতু নিজে বলেছে। 

মোট কথা, পীতুর ছোট হওয়া কী বড় হওয়া একেবারেই ছবির তৎকালীন মেজাজের উপর নির্ভর করে। তবে ছোটই হোক আর বড়ই হোক, বয়সটা চার থেকে সাত পর্যন্ত যাহাই হোক, পীতু যে অসামান্য তাহাতে তার সন্দেহ নাই। 

প্রথমত, পীতুর সব বিষয়ে নিজস্ব একটি মত আছে এবং সাধ্যমতো সে সেটা দেশ-বিদেশে ছড়াইতে কসুর করে নাই। কোথায় ধানবাদ আর কোথায় সুদূর বিহারে আমাদের এই নগণ্য নগরী—এখানে ইতিমধ্যে তাহার থিয়োরিগুলি আসিয়া পড়িয়াছে এবং বেশ চারাইয়া গিয়াছে। যে-কোনও পাড়ার যে-কোনও শিশুমণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়াইলেই পীতুর নাম এবং এক-আধটা অভিমত কানে আসিবে। 

বৃষ্টির কথা বলা হইয়াছে। আরও আছে। যেমন এঞ্জিনের মধ্যে যে-রাক্ষসটা বসিয়া থাকিয়া অত হাঁকডাক করিতে করিতে গাড়ি টানিয়া লইয়া যায়, তাহারই একটি ছোট মেয়ে গ্রামোফোনের মধ্যে বসিয়া মিষ্ট মিষ্ট গান করে। মেয়েটি পলাতক—দুর্দান্ত নিষ্ঠুর পিতার ভয়ে রেল-জগৎ ছাড়িয়া সে মানব-পরিবারে আসিয়া লুকাইয়া আছে। ধানবাদ কিংবা যে কোনও স্টেশনে গেলেই দেখা যাইবে, কতকগুলি ছোট—বড় নানা আকারের এঞ্জিন অবিশ্রান্তভাবে গর্জন করিতে করিতে এদিক-ওদিক ছুটিয়া বেড়াইতেছে। তাহাদের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, এই মেয়েটিকে খুঁজিয়া বেড়ানো! তাই, কাছে অনেক লোক না-জুটিলে মেয়েটি কোনও শব্দই করে না, গান গাওয়া তো দূরের কথা, আহা, রাক্ষস-বাপের লক্ষ্মী মেয়ে বেচারি! পীতু ওকে উদ্ধার করিয়া নিজের কাছে রাখিতে পারিত, কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে এঞ্জিনের দল বড় বড় আলোয় চোখ মেলিয়া খোঁজাখুঁজি করে, অনেক দূরের পাহাড়ের মাথা থেকে গাছের ডগায় ডগায়, বাড়ির জানালায় জানালায় তাহাদের দৃষ্টি আসিয়া পড়ে! বড় হইয়া পীতু একটা ব্যবস্থা করিবে। ইতিমধ্যে ঝাল মাংস খাইয়া গায়ে খুব জোর করিয়া লইতেছে। ছবি চোখ বড় বড় করিয়া বলে, খুব ঝালমাংস খেয়ে পীতু একটুও উস্-আস্ করে না, পার তুমি মেজকা? 

কুকুর বিড়াল ছাগল ভেড়া সকলেই কথা কয়, এ তো দেখিতেই পাওয়া যাইতেছে; -মনে করেন বুঝি মাছেরা কথা কহিতে পারে না?—পারে। কয় না পেটে জল ঢুকিয়া যাইবার ভয়ে। পুকুরে ডুবিয়া একবার কথা কহিবার চেষ্টা করিয়া দেখুন না—পীতুর কথা সত্য কি না। পুকুরে যদি জল না থাকিত তো মাছেরা খুব কথা কহিত। অবশ্য যে-সব পুকুরে মাছও নাই, জলও নাই, সে-সব মাছ আর সে-সব পুকুরের কথা হইতেছে না। 

গোটাকতক নমুনা দেওয়া গেল, মোটের উপর সব জিনিস সম্বন্ধেই পীতুর এই রকম নিজের একটি স্বাধীন মতামত আছে। আপনাদের সঙ্গে মেলে না বলিয়াই যে সেগুলো অবহেলার যোগ্য, এমন মনে করি না। একটি সৃষ্টি—আপনারা দেখেন এক রকম চোখে, পীতু এবং পীতু-পন্থীরা দেখে অন্য রকম চোখে। কী ঠিক দেখে, কী করিয়া বলিব? এই যে মায়াবাদীরা বলে, আপনারাই ভুল দেখিতেছেন। পীতুও এক ধরনের মায়াবাদী। 

আমার দৃষ্টিতে আসুক সেই মায়া যাহা পীতুর চক্ষে বুলানো আছে। আপনারা বলিবেন, ছবির শিষ্য বলিয়াই আমার এ ধরনের অভিরুচি; ছবি দিন ওদের কল্পলোকের কাহিনি শুনাইয়া, দৃশ্য জগতের নিত্য-নূতন ব্যাখ্যা দিয়া আমাকে, আপনাদের চক্ষে যাহা সত্য, তাহা হইতে স্খলিত করিতেছে। সম্ভব। 

কিন্তু এই সত্যচ্যুতিতে আমার কোনও দুঃখ নাই। এ আমার পরম বিলাস; তাই প্রতিদিনের আপনাদের এই গতানুগতিক জীবনে যখন ক্লান্ত হইয়া পড়ি, বার-বার—পড়া একই কাহিনির মতো জীবন যখন ঠেকে নিতান্ত বিস্বাদ, অনুচ্চাবচ সমতোলের মতো বৈচিত্র্যহীন, ছবিকে কাছে ডাকিয়া লই, ধানবাদের পীতুর কথা পাড়ি। দেখিতে দেখিতে নীল পাহাড়ের স্তবকে স্তবকে, অসমতোল ভূমির তরঙ্গলীলায়, শিশু-শালের বনে, আর শরৎকালের স্বচ্ছ জলে ভরা সাহেববাঁধের দীঘিতে ধানবাদ জাগিয়া উঠে। ও-সবের মধ্যে যদি থাকেই কিছুর কঠোরতা তো এই তিন শত মাইলের দূরত্বে তাহা যায় গলিয়া মিলাইয়া। অনির্দেশ-সঞ্চরমান দুইটি শিশু পাহাড়ে-ঘেরা এবং পাহাড়কেও অতিক্রম করা সমস্ত জায়গাটিকে করিয়া তোলে একটি স্বপ্নপুরী। 

ছবি প্রশ্ন করিয়া শুরু করে, ভারী তো জানো—ভগবানের বাড়ি কোথায় বলো তো মেজকাকা? 

সরল প্রশ্ন। উত্তর দিই, স্বর্গে। 

উত্তরটা নিশ্চয় নির্ভুল, কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে ছবি যাহা চায় তাহা নয়। মনের ভাবটা ঠিক করিয়া প্রকাশ করিবার জন্য ছবি একটু ভাবে, তাহার পর বলে, সে তো ভগবানের কলকাতার বাড়ি,—দেশের বাড়ি কোথায়? . 

প্রশ্নটা তার ততটা সরল থাকে না, আমি উত্তর খুঁজিতেছি, ছবি বলে, পীতুদের বাড়ির জানালা থেকে ধানবাদে যে পাহাড়টা দেখা যায় না…অনেক দূরে, দেখেছ তুমি? 

পীতুদের বাড়ি সম্বন্ধে কোনও ধারণা নাই, তাহার জানালা দিয়া কোনও পাহাড় দেখা যায় কী করিয়া বলিব? বলি, না, দেখিনি তো! 

ছবি গম্ভীর হইয়া বলে, কিচ্ছু দেখনি তুমি, ধানবাদে গিয়ে তবে কী করতে? পীতুদের জানালা দিয়ে আকাশে-র মতো মস্ত একটা পাহাড় দেখা যায়। ভগবানের বাড়ি তার পেছনে, মশায়।…হ্যাঁ!—হাসছ তুমি, ভারী তো জানো; ভগবানের বাড়ি ঠিক তার পেছনে। সেখান থেকে রোজ সক্কালবেলা—কোথাও যখন কেউ ওঠে না—ভগবান সুয্যি ঠাকুরকে পাঠিয়ে দেন। আহা, অত ভোরে উঠতে কষ্ট হয় না মেজকাকা সুয্যিঠাকুরের? কী করবেন বলো? ভগবানের গায়ে হাতি-র মতো জোর, ভয় করে তো? দাদাকে বাবা ভোরবেলায় যখন পড়তে তুলে দেন, দেখনি?—সেই রকম চোখ রগড়াতে রগড়াতে ওঠেন সুয্যিঠাকুর। রাঙা হয়ে যায় চোখ 

ছবি হাতটা সঞ্চারিত করিয়া বলে, তখন কোথাও কেউ ওঠে না, খালি পীতু ওঠে। পীতুর মাও ঘুমিয়ে থাকে। পীতুর মা খুব সুন্দর মেজকাকা, জানো? যখন সুয্যিঠাকুর ওঠেন, পীতুর মার মুখ রাঙা হয়ে যায়; দুগ্‌গা ঠাকুরের যেমন ঝকঝকে মুখ নয়?—সেই রকম। এমন চমৎকার দেখায় মেজকাকা! পীতু বলেছে আমায় একদিন দেখাবে। পীতু অনেকক্ষণ ধরে দেখে। চাঁদের মতো মুখ পীতুর মার। এক—এক দিন জেগে উঠে জিগ্যেস করে, কী দেখছিস যে পীতু অমন করে? মেজকাকা চাঁদ কে বলো তো? 

বলি, সুয্যিঠাকুরের ছোট ভাই। 

ছবি এমন হাততালি দিয়া হাসিয়া ওঠে যে, সত্যই নিজের মূঢ়তার জন্য অপ্রতিভ হইয়া পড়িতে হয়। ও বলে, কিছু জানো না মেজকাকা তুমি, শুধু দোরের মতো উঁচু হয়েছ,—চাঁদ সুয্যিঠাকুর মশাই, রাত্তিরে চাঁদের মতন দেখায়—পীতু বলেছে। 

আমি ওকে এক রকম হারাইবার জন্যই বলি, চাঁদ যে সুয্যিঠাকুর বলছ, তবে অত চক্‌চক করে না কেন? 

দুর্বল প্রতিপক্ষকে হারাইবার উপযোগী অবজ্ঞার সহিত ছবি বলে, রাত্তিরে যে রোদ্দুর থাকে না মশাই, কী করে করবে চক্চক?…উনি পীতুর চেয়ে বেশি জানেন।… এবারে ধানবাদে গিয়ে পীতুকে বলব তোমার বুদ্ধির কথা, হেসে গড়িয়ে যাবেখন। 

হঠাৎ হাঁ-টি ছোট এবং গোল করিয়া লইয়া চোখ দুইটা বড় করিয়া ছবি প্রশ্ন করে, মেজকাকা, তুমি ভগবানকে দেখেছ? 

বলি, না, তাঁকে কি দেখা যায় ছবি? 

নাঃ, দেখা যায় না! তবে পীতু কী করে দেখলে মশাই? 

পীতু দেখেছিল নাকি? 

ছবি খুব টানিয়া জোরের সঙ্গে বলে, হ্যাঁ—! পীতুর পাঠশালের গুরুমশাই মরে গিছল কিনা, তার শ্রাদ্ধতে পীতুকে দই দিতে বলেছিল। আহা, কোথায় পাবে দই পীতু, মেজকাকা? গরিব মানুষ, গেরো-দেওয়া কাপড় পরে, চালের পিটুলিকে দুধ গুলে ওর মা ওকে খাওয়ায়; কোথায় দই পাবে মেজকাকা? পীতুর মা বললে, তোর মধুসূদনদাদাকে ডাকিস, তিনি দেবেন দই। যেদিন শ্রাদ্ধ না মেজকাকা?—পীতু ওদের বাড়ির ওদিকটায়, একলা পলাশবনের ধারে গিয়ে—”কোথায় মধুসূদনদাদা, কোথায় মধুসূদনদাদা, এস, দই দিয়ে যাও’ বলে কাঁদতে লাগল। আহা, কাঁদবে না মেজকাকা? দই না নিয়ে গেলে ওকে মারবে যে। কেঁদে কেঁদে ওর চোখের জলে একটা নদী বয়ে, পলাশবনের মধ্যে দিয়ে ছোট পাহাড়ের পাশ দিয়ে ভগবানের বাড়ির দিকে— যেদিকে সুয্যি ওঠে—কত দূর চলে গেল। অমনি একজন থুড়থুড়ে বুড়ো লাঠি ধরে ঠুকঠুক্ করতে করতে, হাতে করে এক ভাঁড় দই নিয়ে এসে বললে, এই নাও, দই, এর জন্যে কি এত কাঁদে?—এ বুড়ো কে বলো তো মেজকা? 

বুঝিতেই পারিতেছেন গল্পটি একটি প্রাচীন উপাখ্যান। কল্পনাপ্রবণ পীতু ওটিকে নিজের জীবনে আত্মসাৎ করিয়াছে,–গেরো দেওয়া কাপড় আর চালের পিটুলির দুধ-সমেত সমস্ত গল্পটি তাহার তরুণ মনে বড় লাগিয়াছে। অবশ্য, আবশ্যক-মতো একটু পরিবর্তন করিয়া লইয়াছে। মূল উপাখ্যানে বোধহয় গুরুমহাশয়ের মায়ের শ্রাদ্ধ ছিল, নিজের গল্পে পীতু খোদ গুরুমহাশয়েরই অন্ত্যেষ্টি ঘটাইয়াছে। এটা পীতুর মরজি বলুন, সাধই বলুন বা সুবিধাই বলুন। 

আমি প্রশ্ন করি, বুড়ো—ভগবান বুঝি? 

ছবি সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া বলে, ঠিক বলেছে রে! তুমি বুঝতে পার মেজকাকা, খুব বোকা নয় তো! 

আমি বলি, কিন্তু এই তুমি বলো—ভগবান আকাশের মতো বড়, আর রেলগাড়ির চেয়েও দৌড়ুতে পারেন? 

সে তো যখন রাক্ষসের সঙ্গে কুস্তি করেন মশাই। দই আনবার সময় অত জোর নিয়ে কি হবে? যদি দই না আনলে ওরা পীতুকে মারত তো দেখতে ভগবানের জোর!—খপ্ করিয়া আমার হাতের কড়ে আঙুলটা ধরিয়া বলিল, ভগবানের এই আঙুল দিয়ে তাদের সব্বার গায়ে একটা পাহাড় ঠেলে দিতেন। হুঁ, চালাকি নয় মশাই! 

ভীত হইয়া বলি, ভাগ্যিস তা হলে দই এনে দিয়েছিল বুড়ো, নইলে — 

ছবি তাড়াতাড়ি উঠিয়া আমার মুখ চাপিয়া ধরে, শঙ্কিত কণ্ঠে নিম্নস্বরে কহে, জিব কামড়াও মেজকাকা, শিগগির, ভগবানকে বুড়ো বললে! এক্ষুনি এ-রকম শাপ দেবেন— 

চাপা ঠোঁটে বলি, হাতটা সরাও, বের করি জিবটা কামড়াবার জন্যে। বড্ড রাগ করেন বুঝি বুড়ো বললে? 

হ্যাঁ! পীতু কক্ষনোও বুড়ো বলে না। তাই কত ভালোবাসেন। বাড়ি গেলে কত আদর করেন, কত্তো খাবার দেন… 

বলি, খেতে দেন? তা হলে তো একবার গেলে হত ছবু! পীতু জানে পথটা? 

ওমা, জানে না?—বলিয়া ছবি গুছাইয়া বসে। রাফেলের আঁকা শিশু-পরীর মতো করতলে চিবুক রাখিয়া, আমার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া গল্প আরম্ভ করিয়া দেয়! চোখ কোন এক অজানা লোকের আলোক ঝলমল করিতে থাকে।… 

পীতু জানে বইকি, ছবিও জানে। পীতুতে ছবিতে মিলিয়া কতবার গিয়াছে। পীতু একবার একলা গিয়াছিল। ওর মার কাছে সেদিন ধ্রুবের গল্প শুনিয়াছিল না?— সেই দিন, রাত্রিবেলা। সেদিন সকালবেলা ঠিক যেখান দিয়া সূর্য ওঠে, রাত্রে ঠিক সেইখানে দিয়া সূর্যটা চাঁদ হইয়া বাহির হইল। শোবার সময় পীতুর মার মুখে অন্ধকার ছিল, গল্প বলিতে বলিতে খোলা জানালা দিয়া আলো ফুটিয়া উঠিল। কপালে কাচপোকার টিপ আকাশের মতো নীল হইয়া উঠিল। চাঁদের চেয়েও পীতুর মার মুখ সুন্দর, মশাই! চাঁদের কপালে মায়ের মতো রাঙা পাড় আর সিঁদুর নাই, পান খাইয়া চাঁদের ঠোঁট মায়ের মতো রাঙা হয় না।…পীতু মাকে বড় ভালোবাসে—ভগবানের চেয়েও। গল্প শুনিতে শুনিতে সেদিন পীতু কাঁদিয়াছিল। আহা ধ্রুবের মায়ের মতন পীতুর মায়ের যদি মোটে একখানি কাপড় হয়, আর ওর বাবা যদি ঝড়ে বৃষ্টিতে বনে বনে ঘুরিয়া হঠাৎ রাত্রে আসিয়া পড়ে! তাহা হইলে তোমাকে তাই থেকে আধখানা ছিঁড়িয়া দিতে হইবে! তাই গল্প শুনিতে শুনিতে পীতু খুব কাঁদিয়াছিল। ওর মাকে জানিতে দেয় নাই—আস্তে আস্তে চোখের জল গড়াইয়া বালিশ ভিজিয়া গিয়াছিল। পীতু খুব সেয়ানা ছেলে মশাই। পীতুর বাবা বকিলে ওর মা যেমন চুপ করিয়া কাঁদিতে পারে না?—পীতুও সেই রকম ভাবে কাঁদিতে পারে।…ছবি বলিল, খু-ব আস্তে আস্তে, খালি ভগবান সে-রকম কান্না শুনতে পারেন। মেজকা, পার তুমি কাঁদতে সে-রকম করে? 

পীতু গল্প শুনিতে শুনিতে এবং কাঁদিতে কাঁদিতে ঠিক করিল, মা ঘুমাইলে সে ধ্রুবের মতো ঘুমন্ত মায়ের পাশ হইতে আস্তে আস্তে উঠিয়া ভগবানের কাছে চলিয়া যাইবে এবং গিয়া বলিবে—মায়ের যেন কখনও মোটে একখানি কাপড় না হয়, আর বনে বনে ঘুরিয়া যদি রাত্রে হঠাৎ আসিয়া পড়ে, ভগবান যেন দুয়ারের পাশটিতে চুপি চুপি খাবার রাখিয়া যান। কাহারও কাছে চাহিতে গেলে মার বড্ড লজ্জা করে, চোখে জল আসে; সে-সময় মাকে দেখিলে বড় কষ্ট হয়। ভগবান তো পীতুর মাকে জানেন না, পীতু গিয়া সব বলিবে। 

সেদিন রাত্রে মা যখন গল্প বলিতে বলিতে ঘুমাইয়া পড়িল, ভগবান আসিয়া পীতুর চোখে তাঁহার ঘুমের মতো ঠান্ডা আর নরম হাত বুলাইয়া দিলেন। তাহার পর পীতু উঠিল। ধ্রুবের মায়ের মতো পীতুর মা পীতুকে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল, সেই গেরোটা জাঁতি দিয়া কাটিল, তাহার পর ভগবানের বাড়ির দিকে চলিল। তাহার আগের দিন মধুসূদনদাদাকে ডাকিয়া ডাকিয়া চোখের জলে যে নদী হইয়া গিয়াছিল—না? পীতু তাহার ধারে দাঁড়াইয়া খুব কাঁদিয়া কাঁদিয়া মধুসূদনদাদাকে আবার ডাকিতে লাগিল। তাহার চোখের জলের নদী বাড়িতে বাড়িতে বাড়িতে আকাশের মতো বড় হইয়া গেল এবং একটা সোনার নৌকো আসিয়া ধারে দাঁড়াইল। ছবি মামার বাড়িতে যে নৌকো চড়িয়া গিয়াছিল, তাহার চেয়ে অনে-ক ভালো নৌকো, অনে-ক বড় নদী, অনে-ক বেশি হাওয়া; নৌকোর সোনার পাল হাওয়ায় ফুলিয়া গিয়াছে। 

যাইতে যাইতে কত দূর চলিয়া গেল পীতু। আমার সঙ্গে কিংবা একলা চুরি করিয়া যতদূর বেড়াইতে যায়, তাহার চেয়ে আরও অনেক দূর। অত আলো ছিল তো? ভগবানের বাড়ির যত কাছে যাইতে লাগিল, আলো ততই আরও বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। ধানবাদ ইস্টিশানের চেয়ে ঢের বেশি আলো। পীতুর এক-একবার ভয় করিতেছিল। পীতুর একটুও ভয় করে না, মশাই! ঝাল মাংস খাইয়া ওর গায়ে খুব জোর হইয়াছে। ওর মা যদি কাছে থাকে, আর রাক্ষস যদি দুঃখিনী সীতার মতন ওর মাকে ধরিতে আসে তো এ-ক চাপড়ে রাক্ষসকে মারিয়া ফেলিতে পারে। কিন্তু ওর মা তো কাছে ছিল না, তাই পীতুর ভয় করিতেছিল না…পীতুর একটুও ভয় করে না…মায়ের জন্য শুধু মন কেমন করিতেছিল। তখন ভগবান ওর নৌকো দুলাইয়া দুলাইয়া ওকে ঘুম পাড়াইয়া দিলেন। যখন ঘুম ভাঙিল না?—পীতু দেখিল পাহাড়ের ওদিকে, ভগবানের আরও আলোর দেশে পীতু পৌঁছিয়া গিয়াছে। কত বড় দেশ! কত বড় সোনার বাড়ি! আকাশে-র মতো উঁচু। ঝরিয়ার রাজার বাড়িতে যেমন ঝাড়লালঠেম টাঙানো আছে না?—ছবি দেখে নাই, কিন্তু পীতু একবার পূজার সময় দেখিয়াছিল—তাহার চেয়েও অনেক ভালো ভালো অনেক লালঠেম টাঙানো…

পীতুর অভিজ্ঞতায় গরবিনী ছবি আমায় পরীক্ষার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করিল, কীসের আলো বলো তো মেজকাকা? 

বোধহয় আমা হেন অনভিজ্ঞের পক্ষে উত্তরটা নিতান্তই অসম্ভব ভাবিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বলিল, তারার ঝাড়-লালঠেম….হ্যাঁ মশাই, তুমি তো ভারী জানো! পীতুর মা বলেছে ভগবানের বাড়িতে খালি তারার ঝাড়-লালঠেম টাঙানো আছে!—তারার লালঠেম না হলে পীতুর নৌকায় অত আলো করেছিল কী করে?—বলো না এবার মশাই! 

এমন অকাট্য প্রমাণের সামনে আমি আর কিছু বলিতে পারিলাম না।

ছবির বর্ণনা চলিল— 

ভগবান জানিতেন পীতু আসিবে। তাহা না হইলে নৌকা কে পাঠাইয়া দিয়াছিল? নৌকো ঘাটে লাগিলে ভগবান নামিয়া আসিয়া পীতুকে কোলে করিয়া লইলেন। চুমা খাইলেন। কী সুন্দর যে দেখাইতেছিল ভগবানকে!…ভগবান যখন ভালোবাসেন তখন আর প্রকাণ্ড থাকেন না, তাঁহাকে দেখিলে ভয় হয় না। তখন তিনি খুব সুন্দর হইয়া যান। তখন, মা পূজার সময় যে-মাল্য পরান, ভগবানের গলায় সেই মালা দুলিতে থাকে। মায়ের দেওয়া মালাসুদ্ধ তাঁকে খুব আপনার লোক বলিয়া মনে হয়। একটুও ভয় করে না। পীতুর কিন্তু লজ্জা করিতেছিল। বিকালের গাড়িতে পীতুর বাবা এক—একদিন আসিয়া পীতুকে কোলে লইয়া যখন চুমা খায় তখন যেমন লজ্জা করে, সেই রকম লজ্জা। 

পীতু তো বড় হইয়াছে? ওদের ছোটখুকির মতো তো ছোট নয়,—লজ্জা করিবে না? 

ছবি আবার প্রশ্ন করিল, ভগবান পীতুকে কেন কোলে করে নিলেন বলো তো মেজকাকা? 

বলিলাম, ভালোবাসতেন বলে। 

নির্বুদ্ধির ক্রমাগত ভুল উত্তরে লোকে যেমন জ্বালাতন হইয়া যায়, সেইভাবে ছবি ঈষৎ ঝংকার করিয়া উঠিল, আরে কাদা লেগে যাবে না বুঝি পীতুর পায়ে? কিছু যদি জানো তুমি! 

আমি প্রতি প্রশ্ন করিলাম, আর ভগবানের পায়ে কাদা লেগে গেল না? তিনি বুঝি বুট জুতো পরে ছিলেন? 

ছবির হিউমারের দৃষ্টিটা বেশ প্রখর, হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার পর আবার গম্ভীর হইয়া, বিচক্ষণের মতো মাথা দোলাইয়া একটু ব্যঙ্গহাস্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, ভগবানের পায়ে বুঝি কাদা লাগে? কি বুদ্ধি তোমার মেজকাকা! 

বলিলাম, লাগে না বুঝি? 

ছবি মাথা নাড়িয়া বলিল, না, না,—একটুও না। 

একটু চিন্তা করিল, তাহার পর বলিল, ভগবানের পায়ে কাদাও লাগে না, হাতে কালি লাগে না, সাবান মাখলে চোখ জ্বালা করে না, বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দি করে না, ওরা সব যে ভগবানের চাকর, মশাই; পীতুর মা বলেছে! আর জানো মেজকা? 

প্রশ্ন করিলাম, কী? 

ওল খেলে ভগবানের মুখ কুট্‌কুট্ করে না, একটুও তেঁতুল খেতে হয় না।

ভগবানের এই গূঢ় শক্তির আবিষ্ক্রিয়াটা নিশ্চয় ছবির নিজের, কেন-না, আজ সকালেই ওল খাইয়া তাহার নিজের নির্যাতন গিয়াছে। আশ্চর্য হইয়া বলিলাম, তাই নাকি? খুব সুবিধে তো ভগবানের। আচ্ছা, তারপর ভগবান কী করলেন বল। 

ভগবানের বাড়িতে অনেক চাকরানি আছে। বুঝি মনে করিয়াছেন, তাহারা আমাদের বাড়ির ‘বিদেশিয়া-কে-মা’-এর মতো লম্বা, কালো এবং ময়লা কাপড় পরা? না, তাহারা সব খুব সুন্দর; পীতুর মায়ের মুখে চাঁদের আলো পড়িলে যেমন সুন্দর দেখায়, সেই রকম। তাহাদের সাদা পায়রার মতো বড় বড় ডানা আছে; পীতুদের ঘরে টাঙানো মেমসাহেবদের ছবিতে যেমন আছে না, সেই রকম। এক-এক দিন সকালবেলা পাহাড়ের ওদিকে ভগবানের বাড়ির উপর যখন ছোট ছোট রাঙা রাঙা মেঘ করে, এরা মেঘের সিঁড়ি দিয়া, আলোর রাস্তা ধরিয়া, গান করিতে করিতে আকাশে উড়িয়া যায়। পীতু ভোরবেলা উঠিয়া যখন জানালা দিয়া মেঘের দিকে চাহিয়া থাকে, ঘুমন্ত মায়ের আর খুকির মুখে, আর ডানাওয়ালা মেমসাহেবদের ছবিতে আলো আসিয়া পড়ে, তখন অনেকবার ইহাদের দেখিয়াছে। পীতুর মা বলেন, এদের পরি বলা হয়, পীতুদের খুকি মায়ের কোলে আসিবার আগে পরি ছিল।… পরিরা নরম ডানার মধ্যে করিয়া পীতুকে লইয়া গেল…বেশ লাগে, মনে হয় ঠিক যেন ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইতেছে আর মা আঁচলে করিয়া পীতুকে ঘিরিয়া আছে। পীতুর মাও নিশ্চয় আগে পরি ছিল, পীতুকে এমনি করিয়া ডানায় ঢাকিতে, এখন যেমন রাঙা পাড়ের আঁচলে করিয়া ঢাকে। 

তাহার পর সোনার জলের ঝরনায় নাওয়া। পীতুর মা যে বলে সেখানকার জলে স্নান করিলে সমস্ত পাপ ধুইয়া গিয়া আলোর শরীর হয়, তাহা একটুও মিথ্যা নয়। দেখিতে দেখিতে পীতুও পরিদের মতো হইয়া গেল। মেমদের ছবিতে ডানা বসানো খোকা সব হাতজোড় করিয়া আছে না?—সেই রকম। তখন কিন্তু তাহার মায়ের জন্য বড় মন কেমন করিয়া উঠিল,—মা যদি চিনিতে না পারে! যদি মনে করে, পীতু আসলে সত্যই তাহাদের ঘরের মেমসাহেবদের ছবির সাদা পাখাওয়ালা ছোট ছেলে; মিছামিছি পীতু হইয়া নামিয়া আসিয়াছে। তাহা হইলে কী হইবে? 

না, পীতুর এসব ভালো লাগে না; ছেঁড়া কাপড় পরা ধ্রুবের মতো সে মায়ের কাছেই থাকিবে। ভগবানের চেয়ে মা অনেক ভালো। আর পীতু না থাকিলে ভগবান তো বাঁচিয়া থাকেন, মা কিন্তু কোন মতেই বাঁচিবে না যে! 

ভগবান সবার মনের কথা বুঝিতে পারেন, মশাই। পীতুকে কোলে লইয়া চুমা খাইয়া তাহার মনের ভয় সরাইয়া দিলেন। পীতু মার কথা ভুলিয়া গেল। কত খাবার দিলেন। গোবিন্ হালুয়াইয়ের দোকানের চেয়ে আরও অনেক মিষ্টি খাবার। তাহার পর আরও কত কী দিলেন;—পীতুর বাবা, পূজার সময় টাকা ছিল না বলিয়া যে বড় জাপানি ডলটা কিনিয়া দিতে পারেন নাই, সেইটা; নেমন্তন্নর দিন ওদের বাড়ির অজু যেমন জরি-বসানো জামা পরিয়াছিল, সেই রকম জামা; ইস্টিশানের সাহেবদের বাগানের পোষা হাঁস;—পীতুর মনের কথা নিজে নিজেই জানিয়া সমস্ত দিলেন পীতুকে। আরও কত কী দিলেন, কত জায়গায় লইয়া গেলেন—কত রাঙা রাস্তার ওপর দিয়া—লতার ফুলে ঢাকা কত বাড়ির কাছ দিয়া—কত পাহাড়ের গা বাহিয়া, সাঁওতালরা যেমন করিয়া যায়—কত রাঙা হলুদে বেগুনে মেঘে পা ফেলিয়া সাতরঙা রামধনুর নিচ দিয়া কত জায়গায় লইয়া গেলেন। ভগবানের গায়ের আলোয় পরিদের গায়ের রং কত সুন্দর হইয়া উঠিল… 

বর্ণনায় হারিয়া ছবি বলিল, সে তুমি বুঝবে না মেজকাকা, কখনও দেখনি কিনা। পীতুর মা বলে, বড়রা সে পায় না দেখতে। পীতুদের বাড়ির জানলা দিয়ে যে পাহাড় দেখা যায় তার ওধারে আছে সব। সেখানে যখন পাহাড়ের মাথায় রামধনু ওঠে, কী মেঘের মধ্যে মধ্যে চাঁদের রুপোর নৌকো ঢেউ ভেঙে ভেঙে চলে, সে সময় পীতু দেখতে পায় ভগবানকে, পরিদের—কত বাজনাবাদ্যি করে আগে-পিছে ভগবানের লোকেরা যাচ্ছে। পীতু সব দেখে; আমায়ও কতবার দেখিয়েছে মশাই, ওর মাকেও দেখিয়েছে। কিন্তু পীতুর মা দেখতে পায় না; পীতুর মা বলে—কেউ বড়রা দেখতে পায় না; ভগবান বড়দের ওপর রাগ করেন। 

ওই সব রাস্তা দিয়া ভগবানের স্বর্গের বাড়িতে যাওয়া যায়। যাইতে যাইতে পীতুরা কত দূর গেল,—মেঘের রাজ্য অতিক্রম করিয়া, রামধনুর ফটক পার হইয়া, কত উঁচুতে—রাত্রে যেখানে তারার জানালা খুলিয়া দিয়া আকাশের ওদিক থেকে দেববধূরা দলে দলে পৃথিবীর দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকে—সেইখানে। সে জায়গাটায় একটু ভয়-ভয় করে, কেন-না, সেটা রাত্রির অন্ধকারের দেশ। এদিককার আলো কমিয়া কমিয়া সেইখানটায় শেষ হইয়াছে, আর উপর থেকে স্বর্গের আলোও পৌঁছোয় নাই। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় পৃথিবীর হাজার হাজার দুষ্টু ছেলে যখন খেলাধুলা শেষ করিয়া আসিয়া মায়েদের, দিদিদের ঘাড়ে পিঠে চড়িয়া দুরন্তপনা করে, সেই দেশ থেকে তখন অন্ধকার আস্তে আস্তে ভগবানের দেশের উপরও কালো ডানার ছায়া ফেলিয়া নামিয়া আসে। সেখানে পৌঁছিয়া পীতুর মায়ের জন্য বড্ড মন কেমন করিয়া উঠিল। চোখ নামাইয়া পীতু দেখিতে পাইল, নিচে অনেক—অনেক—অনে ক দূরে, তাহাদের ধানবাদের ছোট্ট ঘরটিতে পীতুর মা খুকিকে সঙ্গে লইয়া ঘুমাইয়া আছে; ঘুমাইয়া থাকিলে মায়ের মুখে যে-হাসিটি লাগিয়া থাকে সেই হাসিটি এখান থেকে দেখা যায়। মায়ের শাড়ির রাঙা পাড়, মায়ের পায়ের রাঙা আলতার উপর দিয়া, গায়ের উপর দিয়া মায়ের চুড়ি-পরা হাতের সঙ্গে খুকিকে জড়াইয়া, বুকের উপর দিয়া, কালো চুলের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে; ভোরের মেঘে যেমন সোনার পাড় বসানো থাকে না?—ঠিক সেই রকম। ঘরের এদিকটায় চাঁদের আলো, কিন্তু ও—পাশটায়—পীতু যেখানটায় নাই, সেইখানটায় চাঁদের আলো নাই। পীতু সমস্ত রাত মায়ের হাতটি বুকে লইয়া শোয়, যেখানে তাহার বুক ছিল হাতটি এখনও সেইখানে পড়িয়া আছে। পীতুর মা না-জানিয়া মনে করিতেছে তাহার হাত এখনও পীতুর গায়েই আছে, মনে করিতেছে ওটা বালিশ নয়, পীতুর নরম বুক। তাই তাহার মুখে হাসি। পীতুকে বড্ড ভালোবাসিত কিনা,—ভগবানের চেয়েও 

পীতুর ভয়ানক মন কেমন করিয়া উঠিল। অন্ধকারের দেশ পার হইয়া আবার যদি ফিরিয়া আসিতে না পারে। যদি ভগবানের স্বর্গের বাড়ি এত সুন্দর হয় যে, মায়ের কথা এক্কেবারেই মনে না পড়ে!—কলকাতায় একবার রতনদিদির বাড়িতে গিয়া যেমন এক্কেবারে মনে পড়ে নাই!…মায়ের ঘুমন্ত মুখে এখনও হাসি দেখা যাইতেছে, মা মনে করিতেছে পীতুর বুকে হাতটি রহিয়াছে, তাই। ঘুম ভাঙিলেই মা যখন দেখিবে পীতু নাই, যখন বুঝিবে পীতু তাহার অত করিয়া বাঁধা আঁচলের গেরো কাটিয়া, তাহার চোখের জলের নদী দিয়া ভগবানের পাহাড়-ঘেরা বাড়ি পার হইয়া অন্ধকারের দেশ পার হইয়া ভগবানের স্বর্গের বাড়ি চলিয়া গিয়াছে—তখন! 

ভয়ানক মন কেমন করিয়া উঠিল পীতুর। ভগবান তো মনের কথা টের পান? টের পাইয়া আগেকার মতো ভুলাইয়া দেওয়ার অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু পীতু আর কিছুতেই ভুলিল না,—পীতুর বাবা একবার বাড়ি হইতে যাইবার সময় পীতুকে যেমন কোনও মতেই ভুলাইতে পারে নাই, সেই রকম। পরিরা কত বুঝাইল, আদর করিল, বলিল, অন্ধকারের ওপারে গিয়া তাহাকে ঝরিয়ার রাজার মতো বাড়ি দিবে, গাড়ি দিবে, অজুর চেয়েও ভালো ভালো জামা দিবে, পীতুর কিন্তু সব জিনিসের চেয়ে মাকে ভালো লাগিতেছিল। তখন ভগবান আরও চেষ্টা করিলেন, আরও লোভ দেখাইলেন। বলিলেন—ধ্রুবকে যেমন ধ্রুবলোক করিয়া দিয়াছিলেন—আকাশের অনেক দূরে এখনও দেখা যায়—পীতুকেও সেই রকম আকাশের চেয়েও আরও উঁচুতেও ধ্রুবলোক করিয়া দিবেন। আরও কত কথা সব… 

পীতুর একবার মনে হইল, যাই; মার যদি কষ্ট হয়?—খুকুকে কোলে লইয়া ভুলিবে। ভগবান এমন করিলেন যে, পীতু একটুখানি ভুলিয়া গেল মাকে, এ— টুখানি,—ঘুমাইবার সময় একটুখানি যেমন ভুলিয়া যায় না লোকে?—সেই রকম। ঠিক সেই সময় হঠাৎ সে রাস্তার পাতলা অন্ধকার ভেদ করিয়া দেখিতে পাইল— অনেক নিচে, ধানবাদের ঘরটিতে তাহার মা পাশ ফিরিতেই কাটা আঁচলটা কাপড়ের মধ্যে থেকে বাহির হইয়া পীতু যেখানটায় শুইয়া ছিল সেইখানটায় লুটাইয়া পড়িল। জাঁতি দিয়া কাটার দরুন পাড় হইতে সুতা বাহির হইয়া যেন রক্তের মতো দেখাইতেছে। …মা যদি এখনই উঠিয়া পড়ে!…মুখের হাসি এখনও মুখে লাগিয়া আছে। 

পীতু ভগবানের বুকে ছটফট করিয়া উঠিল। না, সে যাইবে; তাহার চাই না কিছু …চাই না ধ্রুবলোক। সে মায়ের কাছে ফিরিয়া যাইবে। ভগবান বড় দুষ্টু, ভগবানের চেয়ে মা ঢের ভালো। মা তো রোজ ভগবানকে পূজা করেন, সন্ধ্যার সময় তুলসী—তলায় প্রদীপ দেন, সকালবেলায় স্নান করিয়া মাটির ভগবান গড়িয়া ফুলচন্দন চড়ান। মায়ের দেওয়া মালা তো এখনও ভগবানের গলায়; তবুও কেন পীতুকে মায়ের কাছে যাইতে দিতেছেন না? পীতু যাইবেই যাইবে। ভগবান যদি না ছাড়েন, ধ্রুব যেমন আগুনের মধ্য থেকে, বাঘেদের মধ্য থেকে ভগবানের তপস্যা করিয়াছিল, পীতুও ধ্রুবলোকে গিয়া মার জন্য সেই রকম তপস্যা করিয়া আবার সেখান থেকে মায়ের কাছে নামিয়া আসিবে। না, পীতুকে ভগবান জানেন না,—পীতু মাকে বড্ড ভালোবাসে—ভগবানের চেয়েও—পরিদের চেয়েও—স্বর্গের চেয়েও—ধ্রুবলোকের চেয়েও… 

বলিলাম, ভগবান চটে গেলেন না ছবি? 

ছবি একটি স্বপ্নের মধ্যে ছিল যেন, মুখে একটি শান্ত করুণা ফুটিয়া উঠিয়াছে। একটু ভাবুকতার সঙ্গে, একটু ক্ষমার সঙ্গে, একটু আর একটা কী অনির্বচনীয়তার সঙ্গে স্মিত হাস্যের সহিত ধীরে কণ্ঠে বলিল, না মেজকাকা, ভগবান যে বড্ড ভালো। পীতুকেও যেমন ভালোবাসেন, ওর মাকেও সেই রকম ভালোবাসেন কিনা! আর ওপরে গেলেন না। আর অন্ধকারও রইল না। পীতুকে কত চুমু খেলেন, কত আদর করে কত সব কথা বললেন, পরিরাও কত চুমু খেলে, কত গালে হাত বুলিয়ে বললে, তোমার মায়ের কাছেই এবার থেকে তোমার জন্যে ভগবান থাকবেন পীতু; সেইখানেই তোমার জন্যে ধ্রুবলোকে গড়ে দেবেন।…তারপর আবার কত আলোর মধ্যে দিয়ে, কত বাজনা-বাদ্যির মধ্যে দিয়ে চাঁদের নৌকো করে নদী বেয়ে পীতুকে নামিয়ে নিয়ে এলেন।…হ্যাঁ মশাই, নিয়ে এলেন নামিয়ে, না হলে পীতু যখন উঠল, কী করে দেখলে ঠিক যেমন করে মায়ের হাত বুকে নিয়ে শুয়ে ছিল, সেই রকম করেই রয়েছে?…আর মেজকাকা, কী আশ্চর্য জানো? 

প্রশ্ন করলাম, কী? 

আঁচল কেটে পীতু চলে গিয়েছিল না?—উঠে দেখলে একটুও কাটা নেই। ভগবান যদি আসেননি তো কে জুড়ে দিয়ে গেল মেজকাকা? তুমি পার? আর পীতু দেখলেও যে নিজে। যখন চোখ খুললে না?—দেখলে, ভগবানের পাহাড়ের বাড়ির ওপরে নতুন সুয্যির আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে—কত গান হচ্ছে—মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে, আর রাঙা মেঘ দিয়ে গড়া সোনার সিঁড়ি বেয়ে ভগবান, তার পরিরা আর সোনার পোশাক পরে বাজনা বাজিয়ে যারা সঙ্গে এসেছিল—সব ফিরে যাচ্ছে…হ্যাঁ, দেখলে পীতু মেজকাকা; তখন আর একটু মনও কেমন করেছিল—মনে হচ্ছিল, ভগবান এত ভালো, এত লক্ষ্মী; কিন্তু পরিরা যে বললে পীতুর মায়ের কাছে থাকবেন সর্বদা— যদি ভুলে গিয়ে না-থাকেন কোনও দিন!… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *