সাঁঝের বেলা

সাঁঝের বেলা

শুষনী শাক তুলতে গিয়ে খেতে সাপ দেখেছিল মেজোবউ। ‘সাপ সাপ’ বলে ধেয়ে আসছিল, বেড়ায় আঁচল আটকে ধড়াস করে পড়ল। পেটে ছ—মাসের বাচ্চা। তাই নিজের ব্যথা ভুলে পেট চেপে কোন সর্বনাশের কথা ভেবে কেঁদে উঠল চেঁচিয়ে।

রোদভরা উঠানে শান্ত সকালে নরম শরীর বলের মতো গুটিয়ে বসে আছে সাদা কালো কয়েকটা বেড়াল। টিপকলের ধারে বসে বাসন মাজছিল ঝি সুধা। তাকে ঘিরে ওপর—নীচে ‘খা খা’ করে ডাকছে কাক। বড়ো পাজি কাক এখানে, লাফিয়ে এসে খোঁপায় ঠোক্কর দেয় সুধার। আশ থেকে পাশ থেকে এঁটো—কাঁটা নির্ভয়ে খেয়ে যায়। কখনো বা সাবানের টুকরো, চামচ, ঠাকুরের ক্ষুদে প্রসাদের থালা—গেলাস মুখে করে নিয়ে যায়। এ—বাড়ি ও—বাড়ি ফেলে দিয়ে আসে। বাসন মাজতে বসে সুধার তাই বড়ো জ্বালাতন। বসে বসে সে কাকের গুষ্টির উদ্ধার করছিল, কেলেভূত, নোংরাখেকো, গুখেকো গুলিন, মর মর! ভগবানের ছিষ্টি বটে বাবা, যেমন ছিরি তেমনি স্বভাব! রোসো, কাল থেকে এঁটো—কাঁটায় ইঁদুর মারা বিষ না মিশিয়ে দিই তো— তা কাকেরা শোনে না। কাটা—ঘুড়ির মতো নেমে আসে। সুধার মুখের দিকে চেয়ে ‘খা’ বলে ডাকে, লাফিয়ে সরে যায়, আবার চেয়ে ডাকে ‘খা’।

বাঙ্গালীয়া দুধ দিতে এসেছে। নোংরা ধুতি, গায়ে একটা নতুন সাদা ফতুয়া, কাঁধে নোংরা গামছা। অদ্ভুত দেখায় তাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গোঁফ চুমরাচ্ছিল। দুধের ডেকচি এখনও মাজা হয়নি। ঝামেলা। একবার ডেকে বলছিল, এই সুধারানি, বর্ত্তন ভৈল? কেতো সময় লাগে তুমার— হাঁ? শুনে সুধা ঝামড়ে উঠেছিল, থাম তো তুই খোট্টা খালভরা কোথাকার! আমি মরছি বটে নিজের জ্বালায়। বাঙ্গালীয়া একটু হেসে খৈনির থুক ফেলে বলে, কৌয়া তো খুব দিক করে তুমাকে? একঠো বন্দু মূলাও না।

বড়োবউ চায়ের কেটলি আঁচল চেপে নামিয়ে কৌটা খুলে দেখে চা পাতা নেই। কুমুকে ফের পড়া থেকে তুলে দোকানে পাঠাতে হবে, একটু আগে একবার দোকানে গিয়ে পাউরুটি আর ছোটো খোকার রসগোল্লা এনে দিয়েছে। মেজাজটা বিগড়ে গেল বড়োবউয়ের। জানালা দিয়ে ধমক দিল সে, ও সুধা, কেবল বকবক করলে কি হাত চলে? বাঙ্গালীয়া কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ওর তো আর বাড়ির গাহেক আছে না কি?

এই যে বড়োবউয়ের মেজাজ বিগড়ালে এর জের সারাদিন চলবে। একে—তাকে ওকে সারাদিন বকতেই থাকবে যতক্ষণ না আবার তার বর বিষ্ণুচরণের মেজাজ বিগড়োয়। বিষ্ণুচরণ ধৈর্য হারালে বড়োবউকে পেটায়। মেজো হরিচরণ আবার তেমন নয়। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ বউকে দেখে। উঠানে হয়তো কাপড় মেলে মেজোবউ কলধারে একটু গেঞ্জি কাচতে যায়, কী চুল শুকোয় তখন হরিচরণ জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে কী কপাটের আড়ালে লুকিয়ে বউকে দেখে। কখনো কখনো আবার কোকিলস্বরে আড়াল থেকে বলে, কু—উ! সেই শুনে আবার বড়োবউয়ের বুক জ্বলে! বলে, এমন মাগীমার্কা ব্যাটাছেলে দেখিনি বাপু জন্মে। হরিচরণ আবার সেটা টের পায়, ডেকে বলে, বউদি গো, বউ আমার খাবে—দাবে বসে থাকবে শুধু তুলবে—পাড়বে বিছানা।

যতীন এখন বুড়ো হয়েছে। হোমিয়োপ্যাথির ফোঁটা ফেলতে হাত কেঁপে যায়। এক ফোঁটার জায়গায় দু ফোঁটা তিন ফোঁটা পড়ে গিয়ে ওষুধ নষ্ট। লোকে বলে, যতীন ডাক্তারের হাতের জোর নষ্ট হয়ে গেছে ছোটোছেলেটা মরার পর থেকে; ছোটোছেলে ব্রহ্মচরণ অবশ্য বাপের সুপুত্র ছিল না। দা—কুড়ুল দিয়ে বাপ—ভাইদের কাটতে উঠত প্রায়ই বাড়ির মধ্যে। মুখে আনতে নেই এমন মুখখারাপ করে গাল দিত! এ হল মেজাজের বাড়ি। সকলেই মেজাজওয়ালা মানুষ। ব্রহ্মচরণ আবার তার মধ্যেই ছিল নুনের ছিটে। সে মরায় এ বাড়ির লোক বেঁচেছে। মরল কীভাবে কে জানে! নিরুদ্দেশ বলে রা উঠেছিল, তারপর একদিন ঝিলে তার শরীর ভেসে উঠল। সারা গায়ে ছোরার গর্ত! কোনো কিনারা হয়নি, কিনারা করার আগ্রহও নেই কারও। কেবল বুড়ো যতীন ডাক্তার আজকাল ঝাপসা দেখে, হাত কাঁপে, রাতে ঘুমোতে পারে না, উঠে উঠে বাইরে যায়, বিড়ি টানে, কাশে।

অভ্যাসমতো যতীন ডাক্তার তার বাইরের ঘরে ওষুধের বাক্স নিয়ে বসেছে। রুগিপত্র বড়ো একটা হয় না। দু—চারজন গল্পবাজ বুড়ো এসে বসে আড্ডা দিতে। আর আসে দীন—দরিদ্র দশ পয়সা দু—আনার বাকির খদ্দের কয়েকজন। সকালে একবাটি বার্লি গিলে যতীন ডাক্তার ডিসপেন্সারিতে বসে আছে। সামনে প্রায় ত্রিশ বছরের পুরোনো টেবিল তার উপর ত্রিশ বছরের পুরোনো ব্লটিং পেপার পাতা চিঠিগেঁথে রাখার স্ট্যান্ড, পিচবোর্ডের বাক্স, পুরিয়ার কাগজ রাখার কৌটো, আঠার শিশি, ওষুধের খুদে চামচ— এইসব রাখা। মাছি বসছে উড়ে উড়ে। যতীন—ডাক্তার ঘোলাটে চোখে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চেয়ে বসে ছিল। ঘরের সামনেই একটা সুরকির রাস্তা, রাস্তার ধারে একটা বাবলা গাছ। বালীর এ অঞ্চলে বাবলা গাছ বড়ো একটা দেখা যায় না। তবু কী করে বালী—দুর্গাপুরে একটা বাবলা গাছ হয়েছে। হলদেটে ছোটো ছোটো তুলির মতো ফুল ফোটে। বাবলার কচি পাতা চিবিয়ে বা রস খেলে পেটের ভারি উপকার, বাবলা গাছের ওপাশে আবার বাড়ির এক সার, আর ওপাশে রেলের লাইন। বর্ধমান কর্ড টিপ টিপ করে মাটি কাঁপছে, দূরে মালগাড়ির হাক্লান্ত ঘড়ঘড়ে শব্দ উঠেছে। পৃথিবীতে আর কিছু দেখার বড়ো একটা নেই। ফাঁকা ঘরে মাছি উড়ে উড়ে বসছে, নাকের ডগায়, ভুরুতে জ্বালাতন করে খাচ্ছে একটা মাছি। যতবার উড়িয়ে দেয় ততবার এসে ঠিক ওইখানটায় বসে। মাছির বড়ো জিদ। আজ সকালে কেউ আসেনি। বড়ো ফাঁকা একা লাগছে। কমললতা ওই রাস্তাটা দিয়েই ফিরবে একটু বাদে। ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই আজকাল জিজ্ঞেস করে যায়— কেমন আছো ডাক্তারবাবু।

যতীন ডাক্তার আজকাল আর উত্তর দিতে পারে না। কমললতার মুখের দিকে চেয়ে চোখে জল এসে যায়। বউ মরেছিল সেই কবে, তার মুখখানা মনেও পড়ে না আর। তিনটে নাবালক ছেলে নিয়ে কী যে বিপদে পড়েছিল তখন। সে সময়ে রুগির ভিড় থাকত হামেহাল। বড়োবাজারের শেঠেদের দোকান থেকে ওষুধ এনে তা থেকে আবার ওষুধ তৈরি করা। এরারুটের গুঁড়ো বানানো, পুরিয়া করা— অনেক কাজ! ছেলেগুলি ধুলোয় পড়ে কাঁদত। সে সময়ে কমললতা যৌবনের গরবিনি। ঝিগিরি করত বটে, কিন্তু হাঁটাচলার ভারি একটা মোহ সৃষ্টি করে যেত। যতীন ডাক্তারের বাড়ি ঠিক শেয়ালে নে যাবে। যতীন ডাক্তারের তখন শেষ যৌবন। কমললতার দুটো হাত ধরে ফেলে বলল, আমার ছেলেগুলি তুই নিয়ে যা কমল। তাতে অবশ্য কমল রাজি হয়নি। তবে একটা বন্দোবস্ত করে ফেলল সে। নিজের একটা অপছন্দের বর ছিল বটে কমললতার, সে উদো মানুষটা ইটখোলার কুলিগিরি, জুট মিলের চাকরি এসব করে—টরে অবশেষে সাধু হয়ে গিয়েছিল। লোকে বলে, কমললতার কাম দমন করার মতো পৌরুষ ছিল না বলেই সে নাকি লম্বা দিয়েছিল। তবে আসত মাঝে—মাঝে। বাইরে থেকে ‘ওঁ তৎসৎ’, ‘ওঁ তৎসৎ’ বলে চেঁচিয়ে জানান দিত। দরকারমতো এক—আধ রাত কাটিয়ে যেত বউয়ের সঙ্গে। আর তখন কমললতা বরকে যা—নয়—তাই বলে গুষ্টি উদ্ধার করে দিত। ত্রিশূল ভাঙত, দাড়ি ছিঁড়ত, কমণ্ডলু আছড়ে টোল ধরিয়ে দিত। কিন্তু তবু লোকটা সাধুগিরি থেকে মাঝে—মাঝে কী এক নেশায় মাস—দু—মাস বাদে এসে হাজির হত ঠিকই। সেই অপছন্দের লোকটাকে যেমন পাত্তা দিত না সে, তেমন আর কোনো পুরুষকেও দিত না। কিন্তু যতীন ডাক্তার তাকে কাবু করে ফেলে। তিনটি ফুলের মতো ছেলে ধুলোয় গড়ায়। কবে এসে হুলো বিড়াল গলার নলি কেটে রেখে যায়, দেখবে কে? ডাক্তারের বিয়ে করারও ফুরসত নেই আর একটা। আর দেবেই বা কে? কমললতা তাই একদিন ঠিকে থেকে স্থায়ী ঝি হয়ে গেল এ বাড়ির। প্রথম প্রথম আলাদা ঘরে ছেলেদের নিয়ে শুত সে। তারপর ব্যবস্থা পালটাল। ডাক্তারের সঙ্গে বিছানাটা এক হয়ে গেল একদা। লোকে কু বলত। কিন্তু বলা কথায় কী আসে যায়। কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই কমললতা হয়ে গেল ডাক্তারের বউ! অবশ্য বউয়ের মতো থাকত না। ঝিগিরিই করত বরাবর! ছেলেরা নাম ধরে ডাকত, তুই—তোকারি করত।

বিশ—পঁচিশ বছর কেটে গেছে। এই সংসারের সঙ্গে জান লড়িয়ে দিয়েছিল সে। ছেলে মানুষ করা, সংসার সামলানো, ডাক্তারির সাহায্য। সব। ঝিয়ের মতো থাকত, কিন্তু তার কথাতেই চলত সংসার। ডাক্তার সোনাদানা, শাড়ি কাপড় দিয়েছে ঢেলে, কখনো কুকথা বলেনি, আদর করেছে খুব। শরীর উসকালে রাতে জেগে বসে থেকেছে। সাধু অবশ্য এ সংসারেও হানা দিয়েছিল। সে কী চোটপাট হম্বিতম্বি, পুলিশের ভয় দেখানো! কিছু চেলা—চামুণ্ডা নিয়ে এসে হামলারও চেষ্টা করেছিল। ডাক্তার ভয় খেয়ে গিয়েছিল। কমললতা ভয় খায়নি। শুধু একবার দু—চোখ মেলে খর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে ছিল সাধুর দিকে। তাতেই সাধুর বুক চুপসে যায়। আসত বটে তার পরেও, তবে ভিক্ষে বা সিধে নিয়ে যেত, আর কিছু চাইত না।

কমললতা ভেবেছিল, এরকমই দিন যাবে। একটা জীবন আর ক—দিনের। মানুষ তো টুকুস করে মরে যায়। কিন্তু দিন যায়নি। ছেলেরা বড়ো হয়ে বুঝতে শিখে আপত্তি শুরু করে। এরকম সম্পর্ক নিয়ে বাপের থাকা চলবে না। সম্মান থাকে না। ঝঞ্ঝাটের শুরু তখন থেকেই। সেটা চরমে ওঠে বড়োছেলের বিয়ের পর। বড়োবউ বিয়ের পর এ বাড়িতে ঢুকেই যেন সাপ দেখল। এক বছর ঘুরতে—না—ঘুরতেই বলতে থাকে, আমার বাবা বলেছে, এখানে রাখবে না। এ হচ্ছে নিশ্চরিত্র জায়গা, নরক। স্বামীর ঘর করার সুখের চাইতে বাড়িতে থাকার দুঃখেও সোয়াস্তি আছে। হরিচরণ আর বিষ্ণুচরণও খেপে গেল হঠাৎ। এক ব্রহ্মচরণ মা বলে ডাকত তাকে, সে বুক দিয়ে ঠেকাত। কিন্তু হাউড়ে ছেলে, বাইরে দাঙ্গাবাজি করে বেড়ায়, ঘরে থাকে কতক্ষণ? ডাক্তারও বুড়ো বয়সে ছেলেদের সঙ্গে এঁটে ওঠে না। তবু ব্রহ্মচরণ বেঁচে থাকা অব্দি ছিল কমললতা! তারপর বেরিয়ে যেতে হল। ইটখোলার দিকে আবার ঘর নিয়েছে সে। বুড়োবয়সে সে এখন পাঁচবাড়ি ঠিকে ঝির কাজ করে খায়। একটি ছোট্ট বোনপোকে এনে রেখেছে, সেই দেখাশোনা করে।

মায়া তো যায় না। রোজ তাই বাইরে থেকে একবার কী দুবার খোঁজ নিয়ে যায় সে ডাক্তারের।

সারাদিন ওইটুকুরই অপেক্ষায় থাকে ডাক্তার। এই একা—ফাঁকা বিশ্বসংসারে ওই কমললতা ছাড়া আর কেউ বন্ধু নেই।

মাছিটা উড়ে উড়ে এসে ভ্রুতে বসছে। সুড়সুড়ি পায়ে নাক বেয়ে নেমে আসে। উড়িয়ে দেয় ডাক্তার। আবার টপ করে এসে নাকের ডগায় বসে। নড়েচড়ে হাঁটে। সকালবেলাটা কেমন আঁধার আঁধার মতো লাগে। নিঃশব্দ ঘরে শ্বাস পড়ে শ্বাস ওঠে। ভগবান।

হরিচরণ মাড়োয়ারি ফার্মে কাজ করে। সকালে যেতে হয়। দেরি হয়ে গিয়েছিল। এই সময়টায় মেজোবউ নারায়ণী কখনো কাছে যদি থাকে। ঠিক পালিয়ে বেড়াবে। নিজেকে দুর্লভ করার ওই হচ্ছে তার কলাকৌশল। পুরুষমানুষকে জ্বালাতন করে না খেলে আর ছেলেমেয়ের কাছা হয় না? দু—বার তিনবার ‘ক—উ ক—উ’ ডাক ডাকল সে। সেই ডাকে দুটো কাজ হয়। বউকে জানান দেওয়া হয়, আবার বড়োবউকে জ্বালানোও হয়। ডালশুখো আর কাঁচা পেঁয়াজ—লঙ্কা দিয়ে ফ্যানসা ভাত খেয়ে টকচা ঢেকুর তুলে হরিচরণ বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। মুখখানা না দেখে বেরোই কী করে। দিনটাই খারাপ হয়ে যাবে। কুমু আর রাখু দাদার দুই ছেলেমেয়ে হল্লাচিল্লা করছে পাশের ঘরে। বিরক্তি। মেজাজ খারাপ থাকে শব্দ সহ্য হয় না। ‘অ্যা—ই’ বলে একটা ধমক দিল এঘর থেকে, লেখাপড়া ফেলে হচ্ছেটা কী? শব্দটা বন্ধ হলে আবার একটা ‘কু—উ’ ডাক ছাড়ে সে।

বড়োবউ বোধ হয় শুনতে পায়। খেঁকিয়ে ওঠে সুধাকে— তোমার আক্কেল দেখে মরে যাই। ইস্টিলের বাসন কেউ ছাই দিয়ে মাজে? দ্যাখো তো দাগ ধরে গেল কেমন?

হরিচরণ একটু হাসে। বড়োবউয়ের মেজাজ ভালো নেই। ডালশুখোটা আজ মেখেছিল নারায়ণী। একটু হিঙের গুঁড়ো দিয়ে তেলে উলটেপালটে বাসি ডালটার দিব্যি তার করেছিল। বড়োবউ খাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন ডালশুখো খাচ্ছো গো, মেজদা?

বেশ।

তার আর কথা কী। কথাতেই বলে— বউ রেঁধেছে মুলো, খেতে লাগে তুলো তুলো।

আসলে নারায়ণী নিজের হাতে বরের ডালশুখো করেছে বলে রাগ। হিন্দ মোটরের মেকানিক বিষ্ণুচরণ যখন সাঁঝের ঘোরে এসে আজ পেটাবে তখন কেঁদে—কেটে রাগ পড়বে।

কিন্তু বউটা যে কোথায় গেল?

মেজোবউ শাকের খেতে সাপ দেখেছিল। শুষনী শাক অযত্নে হয়ে আছে। এ সময়টায় জিভের স্বাদের কোনো ঠিক থাকে না। ফোটা ভাতের গন্ধে বমি আসে, আবার চামড়া পোড়া গন্ধ ফেলে বুক ভরে দম নিতে ইচ্ছে করে। এই শীত আসি—আসি শরৎকালটা বড্ড ভালো! আকাশ কেমন নীলাম্বরী হয়ে আছে। গাছপালার রং ধোয়ামোছা ঝকঝকে! রোদ এখন ওম লাগে।

শীত রোদে নিশ্চিন্তে দক্ষিণের বাগানে সুষনি শাক তুলছিল মেজোবউ। লোকটা এখন বেরোবে। ফুঁসছে। তবু এখন কাছে যাবে না সে। অত বউমুখো, মেনিমুখো কেন যে লোকটা! বড্ড লজ্জা করে নারায়ণীর। বিয়ের পর যেমন—তেমন ছিল, কিন্তু পেটে বাচ্চা আসার পর এখন চক্ষুলজ্জা বলে বস্তু নেই। দিনরাত পারলে হামলায়।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঘাসজমি, আগাছার মধ্যে শুষনী পাতা ডাঁটা টুকুস টুকুস করে ছিঁড়ছিল। মাঝে—মাঝে চোখ তুলে দেখছিল চারিধারে। অনেকখানি দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আকাশ যেন নীল। গাছ যেমন সবুজ। দুটো—চারটে ঘুড়ি উড়ছে আকাশে, ওই উঁচুতে চিল। ছাতারে উড়ে যায় একটা। কালচে কুবো পাখি কালকাসুন্দের ডালে হাঁটছে। ‘বুক বুক বুক বুক’ করে একটা মন খারাপ—করা ডাক ডাকছিল একটু আগেই।

একটা টসটসে ডগা, ছিঁড়তে হাত বাড়িয়েই মেজোবউ ঘাসের মধ্যে চকরাবকরা দেখতে পায় প্রথমটায় যেন গা নড়ে না, পা চলে না। সারা গাঁয়ে শিরশিরানি। রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। লকলকে শরীরটা এঁকেবেঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লম্বা ঘাসে হারিয়ে আবার জেগে উঠছে।

সাপ! সাপ! বলে চেঁচিয়ে বাগানের ফটক পার হতে গিয়ে আঁচল আটকে পড়ে গেল মেজোবউ! পড়ে কিছু টের পায় না। কোনো ব্যথা না, জ্বালা না। কেবল বুকটা হাহাকারে ভরে দিয়ে যায় এক আতঙ্ক। ছ—মাসের বাচ্চা যে পেটে! কী হবে ভগবান!

কেঁদে উঠে মেজোবউ।

বড়োবউ স্তম্ভিত হয়ে যায়। নড়ে না। দাঁড়িয়ে আবার থরথর করে বসে পড়তে থাকে ভীতু, বউ—সর্বস্ব হরিচরণ, কলকাতায় একটা বাসন আছড়ে ছুটে আসে সুধা। আর আসে কমু রাখু!

বাঙ্গালীয়া দুধ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। বালতিটা রেখে এসে প্রথম ধরে নারায়ণীকে। বলে ক্যা হুয়া? সাপ কাটা হ্যায় কিয়া!

বাঙ্গালীয়ার বেশি বুদ্ধি নেই। সে মেজোবউকে ছুঁয়েই বুঝতে পারে, রূপের আগুনে তার হাত পুড়ে গেল বুঝি। কী ফর্সা, কী নরম, কী সুন্দর! এরকমই হয় বটে বাবুদের বাড়ির মেয়েরা। নাকি বাঙালি বলেই নরম। নরম শনিচারী কিছু কম নয়। কিন্তু এ তো তুলো। তার ওপর নাক মুখ চোখ আর রঙের কী বাহার।

মেজোবউ তার হাত ছাড়িয়ে নিল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে তবু বাঙ্গালীয়া। ঘাসজমিতে যেন পুজোর ফুল কে একরাশ ঢেলে দিয়ে গেছে! বউটিকে কতবার দেখেছে সে। ছোঁয়নি ছোঁয়ার পর সে যেন সব আলাদা রকম দেখে। হাতটা মেখে আছে নরম স্পর্শ।

হরিচরণ আসে। বড়োবউ এসে ধরে তোলে নারায়ণীকে। সুধা এসে মাজাটা ওর মধ্যেই একটু ডলে দেয়। বলে, ভালো করো, ভালো করো, ভালো করো ভগবান।

আশপাশ বাড়ি থেকে দু—চারজন এসে জুটে যায়।

সাপের দাঁতের দাগ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যায় না।

ডাক্তার রাস্তার দিকে চেয়েছিল অপলক। মাছিটা বড়ো জ্বালাচ্ছে। ভোরবেলাটা কেন আঁধার আঁধার লাগছে আজ? ডাক্তার একটা চিৎকার শুনতে পায়, ‘সাপ সাপ’! চেয়ারে শরীরটা বাঁ ধার থেকে ডান ধারে মুচড়ে বসে ডাক্তার। পা—দুটো তুলে হাঁটু জড়ো করে বুকের কাছে। বাতাসে একটু শীতভাব। সময়টা ভালো না। কে চেঁচাল ‘ডাক্তার ডাক্তার’ বলে? না, ডাক্তার বলে নয়, ‘সাপ সাপ’ বলে। মেয়েছেলের গলা। কমল নয় তো!

মাথাটা ভালো লাগে না ডাক্তারের।

পেছনে জোর পায়ে শব্দ উঠে যেন। ডাক্তার ভয় খায় নাতি রাখুকে। মিষ্টি ওষুধের লোভে প্রায়ই এসে চুরি করে শিশিকে শিশি ফাঁক করে দেয়। অ্যাকোসিসের মাদার টিংচার একবার শিশিসুদ্ধ খেতে গিয়েছিল।

ডাক্তার পিছু ফিরে দেখে বেড়ালটা। হুশ হুশ করে শব্দ করে। বেড়ালটা সবজে চোখ মেলে তার দিকে চায়। ক্ষীণ একটা শব্দ করে। কমল এদের পালত—পুষত। দুটো কমলের সঙ্গে গেছে। আর দুটো রয়ে গেছে। কেউ পালে না, পোষে না, আদর করে না। এরা এমনি থাকে।

বাবা! একটা বুকফাটা চিৎকার করে কে ঘরে ঢোকে।

ডাক্তার চমকে ওঠে। মাথার মধ্যে একটা আলো যেন ঝলসে উঠেই নিভে যায়। মাছিটা ঠিক বসে আছে ভ্রুর মাঝখানে। নড়ছে হাঁটছে।

বাবা, শিগগির আসুন।

ডাক্তার বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরায়, কে?

আমি হরি।

ও! চেঁচিয়ো না।

চেঁচাব না কী। আপনার বউমার কী হয়েছে দেখে যান।

তোমরা দাখো গে।

হরিচরণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে। তারপর এই চরিত্রহীন অপদার্থ নাম ডোবানো বুড়োটার প্রতি তীব্র হিংস্র একটা আক্রোশ বোধ করে সে। দু—হাতে যতীনের কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় সে।

কী বলছেন?

ওঃ! যতীন নাড়া খেয়ে ভারি ভয় পেয়ে যায়। মাথার মধ্যে লাল আলো নিভে একটা সাদা আলো জ্বলে। আবার সাদাটাও নিভে যায়।

শিগগির আসুন।

কোথায়?

আপনার বউমাকে সাপে কামড়েছে।

ভেতরে একটা হুলস্থুলের শব্দ হচ্ছে! সেই শব্দ থেকেই বড়োবউ গলা তুলে বলে, সাপে কামড়াল কোথায়! কামড়ায়নি! পড়ে গেছে বাপু।

হরিচরণ বাবাকে একটা খোঁচা দেয়, পড়ে গেছে। বাচ্চাটা নষ্ট হতে পারে।

আসুন।

পড়ে গেছে! যতীন বড়ো বড়ো চোখ করে চারদিকে চায়। শালার মাছিটা। ঠিক বসে আছে এখন নাকের ডগায়। ছাড়ছে না। যতীন বলে, কী করব!

একটু দেখুন।

ডাক্তার ডাকো।

ডাকতে পাঠিয়েছি। সে তো দু—মাইল দূর থেকে আসতে যেতে তিন ঘণ্টা। তার মধ্যে কিছু যদি হয়ে যায়।

ডাক্তার ভাবে ওষুধের নাম কিছুই মনে পড়ছে না। অনেক ভেবে বলে, থুজা টু হানড্রেড।

কী বলছেন?

উহুঁ। ডানদিকে ব্যথা তো? লাইকোপোডিয়াম দেওয়াই ঠিক হবে।

ডানদিকে না কোনদিকে কে জানে। আপনি আসুন।

ছেলের দিকে ভীত চোখে চেয়ে থাকে ডাক্তার। বলে, আমি কিছু জানি না বাপু, আমার কিছু মনে পড়ছে না।

তার হাত ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে হরিচরণ বলে, তা বলে একবার চোখে এসে দেখবেন না। আপনারই তো ছেলের বউ।

বিড়বিড় করে ডাক্তার বলে, ছেলে না ইয়ে। তোমরা আমার কেউ না। বলতে বলতেও ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে যায়। হ্যাঁচকা টানে বুকের বাঁদিকে একটা খিঁচ ব্যথা ওঠে। মাথাটা দুটো টাল খায়। আলোটা দপ করে জ্বলে ফুস করে নিভে যায়।

ভিতরের ঘরে লোকজন জুটেছে মন্দ নয়। মেজোবউ শুয়ে আছে খাটে। কোঁকাচ্ছে। শ্বাসকষ্টের কোঁকানি, চোখের তারা স্থির। মুখে গাঁজলার মতো কষ গড়াচ্ছে।

বিড়বিড় করে যতীন ডাক্তার বলে, নাক্স ভমিকা টু হানড্রেড! শিগগির।

হরিচরণ ছুটে যাচ্ছিল ডিসপেনসারিতে ওষুধ আনতে।

ডাক্তার মাথা নেড়ে বলে, না ভুল।

তবে?

সালফার থার্টি।

কীসব বলছেন?

ভুলে যাই যে বাবা।

হরিচরণ কী করবে ভেবে পায় না। হাঁ করে চেয়ে থাকে অপদার্থ বাপের দিকে। যতীন ডাক্তার বিড়বিড় করে বলে, পুত্র আর মূত্র একই পথ দিয়ে আসে। বুঝলে? পুত্র যদি পুত্রের কাজ না করে তো মূত্র। না কী?

কথাটা অবশ্য হরিচরণের কানে যায় না। কিন্তু সে লক্ষ করে এই দুঃসময়েও তার বাবা বিড়বিড় করে বকছে। এরকম কখনো করত না তো বুড়ো! পেগলে গেল নাকি!

বাঙ্গালীয়া বাঁহাতের খৈনির গুঁড়োর ওপর ডান হাতে একটা আনন্দিত চাপড় মারে। কনুইয়ের ভাঁজ থেকে দুধের খালি বালতি ঝুলছে, মনে অনেক আশ্চর্য আলো এসে পড়েছে আজ। ভারি অন্যমনস্ক সে। একটা দেশওয়ালি গান গুনগুন করে গায় সে। হাতে একটা নরম স্পর্শ লেগে আছে এখনও।

কমললতার সঙ্গে দেখা।

ক্যায়া হো কমলাদিদি।

ও বাড়িতে কী হয়েছে রে বাঙ্গালু?

সাপু কাটা নেহি। গিরে পড়ল।

কে?

বহুজি। যান না, দেখিয়ে আসেন।

বিপদে বারণ নেই। কমললতা তাই এদিক—ওদিক একটু দেখে নেয়। ভয় করে। পঁচিশ বছর কাটিয়েও ভয়। তবু সে ঢুকে পড়ে।

কী হয়েছে?

বলে সে সোজা ঘরে ঢুকে যায়। কেউ কিছু বলে না, বারণ করে না। সাহস পেয়ে কমললতা বিছানার কাছে উপুড় হয়ে দেখে নারায়ণীকে। মুখটা তুলে বলে, বড়োবউমা একটু গরম জল করো, আর মালসায় একটু আগুন। এ কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।

কেউ কিছু বুদ্ধি খুঁজে পাচ্ছিল না। কমললতার কথায় যেন বিশ্বাস খুঁজে পায় সবাই। বড়োবউ ধেয়ে রান্নাঘরে। চোখের জল মুছে, উনুন থেকে হাঁড়ি নামিয়ে জল চাপায়।

কমললতা সাহস পেয়ে মেজোবউয়ের মাথা কোলে নিয়ে বসে হাওয়া করে।

বহুকাল বাদে নিজের হারানো জায়গাটা যেন পেয়ে গেছে কমললতা।

হরিচরণকে ডেকে বলে, তোর বাপের ঘর থেকে অ্যালকোহল দশ ফোঁটা একটু গরম দুধে দিয়ে নিয়ে আয়।

হরিচরণ কমললতার দিকে একপলক চায়। চোখে কী ফোটে কে জানে।

তারপর বাপের ঘরের দিকে চায়!

যতীন ডাক্তার খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে চেয়েছিল। মেজোবউয়ের দিকে নয়।

মেজোবউ বা পৃথিবী আর কিছুর কোনো অস্তিত্ব তো নেই। সে চেয়েছিল কমললতার দিকে। কাম কবে মরে গেছে, যৌবনের প্রেম বলতে কিছু নেই এখন। কিন্তু বুক জুড়ে আছে সহবাস। সে বিড়বিড় করে ডাকে, কমল, কমল, কমল বড়ো একা ফাঁকা জগৎ। থাকো। এখানেই কেন থাকো না! থাকো।

কমললতা যতীনের দিকে চায়। বুড়োটার চোখ ঘোলাটে লাগে যে? বিড়বিড় করে কী বকছে। আহা, ওরা কী আর যত্ন করে?

সন্ধের দিকেই ঠিক হয়ে যায় মেজোবউ। ডাক্তার দেখে গেছে। বলছে, গাইনির ডাক্তার দেখাতে। তবে ভয় নেই। বিকেলের দিকে মেজোবউ ওঠা—হাঁটাও করল খানিক। চুল বাঁধল, হাসল। হরিচরণ গেছে কলকাতা থেকে বউয়ের জন্য বলকারী ওষুধ আনতে।

সারাদিন কমললতা আজ এ বাড়িতে রয়ে গেল। মেজোবউয়ের কাছেই রইল বেশিক্ষণ। যতীন ডাক্তার ডিসপেনসারিতেই আগাগোড়া বসে আছে আজ। ভাত খেতে বসে অর্ধেক খেয়ে উঠে গেল দুপুরে। শরীরটা খারাপ না কি!

কমললতার বুকের মধ্যে কেমন করে। তিন—চার দিন আগে খবর এসেছে, সাধু মানুষটা মরেছে কুলটির হাসপাতালে। একটু কেঁদেছিল কমল। কান্নাটা মেয়েদের রোগ, নইলে সে মানুষের জন্য কান্নাই কী, দুঃখই কী! কমললতা ভালোবাসা যা পেয়েছে তা এই যতীন ডাক্তারের কাছে। কাছে যাবে সে উপায় নেই। কে কী বলে। বাড়ি থেকে বেরই করে দিল হয়তো। এ বাড়ির বাতাসে শ্বাস না নিয়ে বুক মরুভূমি হয়ে থাকে। সাধুটা মরে গেল! ডাক্তারও কেমন যেন করছে। তাই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না আজ। মেজোবউয়ের সেবার নাম করে সারাটা দিন থেকেছে। বড়োবউ ডেকে দু—মুঠো খাইয়েছে দুপুরে। সে কথা ভাবতেই মনটা ভালো লাগে।

সন্ধের পর একটু ফাঁক পেয়েই কমললতা বুড়োমানুষটার ঘরে আসে।

ডিসপেনসারি থেকে উঠে এসে কখন বিছানায় শুয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় কমললতার মুখের দিকে চাইল। বলল, মাছিটা কেবল বসছে।

কোথায় মাছি?

কপালে। সকাল থেকে উড়ে উড়ে বসছে!

কমললতা কপালটা দেখে। বলে, নেই তো।

আছে।

কমললতা যতীন ডাক্তারের মুখখানা দেখে ভালো করে। চোখ ঘোলা আর লালচে। শ্বাস গরম। কপালে হাত চেপে ধরলে বোঝা যায়, শিরার মধ্যে রক্ত লাফাচ্ছে।

কমল বলে, আমি কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

তুমি থাকো।

থাকার জো কী? বিষ্ণুচরণ এলেই তাড়াবে।

না। তুমি থাকো।

আচ্ছা। শরীরটা কি খারাপ।

না। বড়ো একা লাগে।

একা কেন? সবাই রয়েছে।

কেউ নেই।

কমললতার চোখে জল আসে। গাল বেয়ে নামে। নাকে সর্দি টানার একটা শব্দ হয়। একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে সে। সংসার বড়ো মায়াহীন।

ডাক্তার দেখে কমললতা চাঁদকে লণ্ঠনের মতো ধরে আলো দেখাচ্ছে। ডাক্তার ওঠে। বলে, দাঁড়াও ওষুধ বানাচ্ছি।

বানাও।

এ ওষুধে দু—জনের সব সেরে যাবে, বুঝলে কমল?

জানি। তুমি ধন্বন্তরী।

ডাক্তার জ্যোৎস্নার লণ্ঠনে কমললতার সঙ্গে পথ চিনে বাগানে যায়। ফুলে তুলে আনে চুপিচুপি ডিসপেনসারিতে ঢোকে দু—জনে। ডাক্তার একটা ঝিনুকে ফুল টিপে মধু ফেলে ক—ফোঁটা। একটু জ্যোৎস্না মেশায়। একটু চোখের জল তার সঙ্গে।

আর দু—ফোঁটা অ্যাকসিস।

অমৃত। ঝিনুকটা তুলে ডাক্তার বলে।

জানি।

দু—জনে খাই, এসো।

স্বপ্নটা ভেঙে যায়। ডাক্তার জাগে। কেউ কোথাও নেই। মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা সব বোধ গুলিয়ে দেয়।

যতীন ওঠে। তারপর শূন্য ডিসপেনসারিতে গিয়ে ঢোকে। অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে দুধের মতো জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে ঘর।

আধছায়ায় যতীন ডাক্তার উলটোদিকের চেয়ারটায় গিয়ে বসে। তারপর নিজের বসা শূন্য চেয়ারটার দিকে বলে, ডাক্তারবাবু, আমার বড়ো অসুখ। বড়ো অসুখ।

হরিচরণ তখন বউকে জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে হাতে—পায়ে বেঁধে রেখেছে। নারায়ণী ঘুমের মধ্যে ঠেলা দিয়ে বলে, আঃ, দম আটকে মারবে নাকি বাপু?

হরিচরণ ঘুমচোখে বলে, তুমি যা দুষ্টু হয়েছ।

উঃ, সরো বাপু। গরম লাগছে।

হরিচরণ বলে, তোমার জন্যে সবসময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।

নারায়ণী পাশ ফিরে বলে, ইঃ।

তখন হামলে তাকে আদর করতে থাকে হরিচরণ। বাধা মানে না।

বিষ্ণুচরণ বউয়ের গা—ঘেঁষা ভাব পছন্দ করে না। লাইনের ওধারে তার আবার মেয়েছেলে রাখা আছে। এক কাতে শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে বউ বলল, কমল কিন্তু অনেক সেবাটেবা করেছে।

করুগগে। আর ঢুকতে দিয়ো না।

মায়া পড়ে গেছে তোমাদের ওপর।

হুঁ। শেষমেষ বাড়ির অংশ চাইবে। তা ছাড়া কলঙ্ক। আপদ যখন বিদেয় হয়েছে, আর না।

কোলেপিঠে করেছে তোমাদের।

খুব দরদ যে!

বলছিলাম মাঝেমধ্যে আসে যদি আসুক।

উহুঁ। ফের যদি ঢুকতে দাও তোমার কপালে কষ্ট আছে।

কিন্তু ওকে ছাড়া বুড়োমানুষটা যে থাকতে পারে না।

বিষ্ণুচরণ ঝাঁকি মেরে ওঠে, পারে না! অ্যাঁ। এই বুড়ো বয়সেও রস আছে নাকি? ভয় খেয়ে বড়োবউ চুপ করে যায়।

ডিসপেনসারি থেকে উঠে নিজের ঘরে আসে যতীন। আবার ডিসপেনসারিত যায়। তারপর বেভুল হয়ে এ—ঘর ও—ঘর ঘুরতে থাকে হারানো শিশুর মতো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু কাঁদে। মাছিটা উড়ে উড়ে বসছে ভ্রুতে, নাকে, কপালে সুড়সুড়ি পায়ে হাঁটছে, যতীন ডাক্তারের চারধারে পৃথিবীর রহস্যটা গুলিয়ে ফেলতে থাকে। চাঁদের আলো, গাছপালা, ঘরদোর— সবকিছুই অবোধ চোখে দেখে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, কমললতা মা, মা গো, কমলমা, মাছিটা তাড়িয়ে দাও… মাছিটা তাড়িয়ে দাও… মা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *