সাঁঝবাতি

সাঁঝবাতি

আমি কাজ পেয়েছি। পেয়েছি না বলে নিয়েছি বললে ঠিক হবে। কাজটা কঠিন তবে ইন্টারেস্টিং। করতে পারলে অনেকগুলো টাকা পাওয়া যাবে। একটা হইচইও পড়ে যাবে। আমার যে টাকা বা হইচইয়ের প্রতি লোভ হয়েছে এমন নয়। কাজটার ওপর লোভ হয়েছে। আজ সেই কাজ শুরু করেছি আমি। হাওড়া স্টেশন থেকে সন্ধের ট্রেন ধরে এসেছি উত্তরপাড়া। আমার পকেটে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার।

সাগর ‘কাজ’ করছে শুনে সকলেই হাসবে। বলবে, দূর, ও একটা অলস গাধা। কুঁড়ের বাদশা। দুটো টিউশন, মাঝেমধ্যে কলেজ স্ট্রিটের প্রুফ দেখা, আর ধারদেনা—এই হচ্ছে ওর সোর্স অফ উপার্জন। তার ওপর এই মুহূর্তে টিউশন এবং প্রুফ দুটোই ঘ্যাচ হয়ে গেছে। যে বেকার তরুণের জীবন থেকে টিউশন এবং প্রুফের কাজ চলে যায়, সে কোনও ছোটখাটো সাইজের গাধা নয়, বড় সাইজের গাধা। তাছাড়া সাগরকে এর আগে যে-ক’বার চাকরি করতে বলা হয়েছে সে পালিয়েছে। একবার ইন্টারভিউয়ের দিন সেজেগুজে ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে রওনা হয়েছিল। পথে একটা ভয়ংকর কাণ্ড করল। সেই ‘কাণ্ড’ শুনলে বোঝা যাবে এই ছেলে কত বড় কুঁড়ের বাদশা।

সেবার তমাল অনেক কষ্টে তার এই অলস বন্ধুটির জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে। সেই চাকরি ছিল ‘হাতের মোয়া চাকরি’। ইন্টারভিউতে বসে কিছু বলতে হত না। গেলেই হয়ে যেত। সাগর অবাক হয়ে তমালকে জিগ্যেস করল, ‘সে কী রে! ইন্টারভিউতে কিছু বলতে হবে না! বসলেই চাকরি পেয়ে যাব?’

তমাল মাতব্বরের ঢঙে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘ইয়েস। বসলেই চাকরি। হাতের মোয়া চাকরির এটাই নিয়ম। ইন্টারভিউতে কোনও প্রশ্ন থাকে না। তাই উত্তরও থাকে না। শুধু মিটিমিটি হাসতে হয়। তোর জন্য আমি সেই হাসি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করেছি।’

সাগর একটু থমকে আপ্লুত গলায় বলেছিল, ‘তোর এই হাতের মোয়া ঋণ কীভাবে আমি শোধ করব তমাল? তোর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমি চির…চির…। চির-র সঙ্গে আর কী যায় রে? চিরনবীন? চিরসবুজ?’

তমাল ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘চোপ। বেশি নাটক করবি না। আমার কাছ থেকে যাতে আর টাকা ধার না করিস সেই জন্য এটা করলাম। এই প্রথম না, আগেও তোর চাকরির চেষ্টা করেছি। তুই অ্যাকসেপ্ট করিসনি। করলে এতদিনে তুই আমার মতো সেটলড হয়ে যেতিস। ফ্ল্যাট কেনার জন্য ব্যাঙ্কে লোনের জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারতিস। কার লোন নিতে পারতিস। পারসোনাল লোন পেতিস। জেনে রাখবি সাগর, পুরুষ মানুষের আসল পরিচয় ব্যাঙ্ক লোনে। যে পুরুষের ব্যাঙ্ক লোন নেই সে মূল্যহীন। যাক, বেশি না বকে, ক্যামাক স্ট্রিটে গিয়ে ইন্টারভিউটা দিয়ে আয়। দিয়ে আয় মানে বসে আয় আর কী। বেরিয়ে আমাকে একটা ফোন দিবি।’

সাগর অবাক গলায় বলেছিল, ‘তোকে ফোন দেব কেন!’

তমাল আবার বন্ধুকে ধমক দেয়। বলল, ‘দিতে বলেছি দিবি। হাতের মোয়া চাকরির কতগুলো নিয়মকানুন আছে। ইন্টারভিউ হয়ে গেলে ধরা লোককে ফোন করতে হয়।’

সাগর চোখ কপালে তুলে বলল, আমি আবার কখন তোকে চাকরির জন্য ধরলাম! ধরেছিস তো তুই। ধরে আমাকে জোর করে পাঠাচ্ছিস। নিয়ম অনুযায়ী ফোন তো তোর আমাকে করা উচিত।’

তমাল চোখ পাকিয়ে, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘ফাজলামি হচ্ছে? এখান থেকে এখন যাবি? নাকি অফিসের দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দেব? কাল ভদ্রলোকের মতো ড্রেস করিস। ইস্তিরি করা জামা আছে? টাই? ঠিক আছে আজ রাতে বাড়িতে এসে একটা টাই নিয়ে যাবি। টাইয়ের সঙ্গে আমার স্যুট পরবি। ঢিলে লাগলে সেফটিপিন মেরে নিবি। স্যুট-টাই না পরে যাবি না। কর্পোরেট হল স্যুট টাইয়ের জায়গা। ওছাড়া চলে না।’

সাগর সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়ল এবং পরদিন শেষ বিকেলে তমালকে ফোনও করল।

তমাল এত উদগ্রীব গলায় বলল, ‘এত দেরি কেন? আমি তোর ফোনের জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। ইন্টারভিউ কেমন হল?’

সাগর বলল, ‘দেরি করে ফেলেছি বলে ভেরি সরি। ইন্টারভিউ খুবই ভালো হয়েছে। এক্সলেন্ট।’

‘ভেরি গুড। আমি জানতাম। মিস্টার জগমিয়া আমাকে বড্ড ভালোবাসেন। কালই বলেছেন, ডোন্ট ওয়ারি মালবাবু। কুছু চিন্তা নেই। আমি ইন্টারভিউ বোর্ডের সব মেম্বারকে বলে রেখেছি। সি নামে একজন যাবে। সি শুনে আমি তো খুব হাসলাম। উনি তোর নাম সাগরের বদলে সি করে দিয়েছেন। হা-হা। আমাকেও তাই। হা হা। তমালের বদলে মাল। হ্যাঁ রে সাগর, ইন্টারভিউতে তোকে কিছু জিগ্যেস করেনি তো?’

সাগর বলল, ‘করেছে।’

একটু থমকে গম্ভীর গলায় তমাল বলল, ‘সেকী! কিছু জিগ্যেস করার তো কথা নয়। শুধু মিটিমিটি হাসবার কথা। কী জিগ্যেস করল?’

সাগর আনন্দিত গলায় বলল, ‘জিগ্যেস করল, কোথায় যেতে চাই?’

তমাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন। বলে, ‘ও তাই বল। ভেরি গুড, ভেরি ভেরি গুড। এর অর্থ তুই কোথায় পোস্টিং নিতে চাস জানতে চেয়েছে। তুই কি বললি? কলকাতায় বলেছিস নিশ্চয়।’

সাগর বলল, ‘না, না, কলকাতা বলব কেন। বলেছি লোধাশুলি।’

‘কী শুলি!’

সাগর এবার জোর গলায় বলল, ‘লোধাশুলি। ঝাড়গ্রামের কাছে।’

‘জায়গাটা ঠিক চিনতে পারছি না। এত জায়গা থাকতে হঠাৎ ওখানে কেন?’

সাগর হেসে বলল, ‘লোধাশুলিতে চমৎকার জঙ্গল আছে।’

‘জঙ্গল! ওখানেও ওদের অফিস আছে। তোকে বলল?’

সাগর বলল, ‘অফিস কেন? বাংলো আছে। ফরেস্ট বাংলো।’

তমাল একটু চুপ থেকে থমথমে গলায় বলে, ‘কী ব্যাপার বল তো সাগর। আমি তোর কথার ছাই মাথা কিছু বুঝতে পারছি না। তুই কি বাংলোর কেয়ারটেকার হবি? ভেঙে বল তো কী হয়েছে? কে তোর ইন্টারভিউ নিল?’

সাগর হেসে বলেছিল, ‘আমার ইন্টারভিউ নিল কলকাতা-ঝাড়গ্রাম রুটের বাস কন্ডাক্টর শ্রীমান সতীশ। অতি চমৎকার ছেলে। সে আমাকে একটি মাত্র কোয়েশ্চন করেছে। কোথাকার টিকিট দেব? আমি তোর কথা মতো মিটিমিটি হেসে বললাম, লোধাশুলি। সতীশ বলল, ঝাড়গ্রাম থেকে ট্রেকার নিয়ে নেবেন। তারপর টিকিট দিয়ে আমাকে একটা ভালো সিট দিল। সেই সিটে বসে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। এখন ঝাড়গ্রামের পথ ধরে হাঁটছি। শালগাছের গন্ধ পাচ্ছি তমাল।’

তমাল আর্তনাদ করে উঠল, ‘মানে! তুই ক্যামাক স্ট্রিট যাসনি! আর ইউ ম্যাড?’

ফোনের ওপার থেকে সাগর কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘ক্ষমা করে দে তমাল। আসলে কী হয়েছিল জানিস, আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। কেউ খাবারে লোভ করে, কেউ নারীতে। আমি এসপ্ল্যানেডের বাস গুমটিতে ঝাড়গ্রামের বাস দেখে লোভ করে বসলাম। আউট অব কন্ট্রোল হয়ে গেলাম। ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে ইন্টারভিউ দিতে না গিয়ে তোর দেওয়া স্যুট টাই পরে সোজা ঝাড়গ্রাম চলে এসেছি। শুনেছি, লোধাশুলির জঙ্গলে একটা চমৎকার বাংলো আছে। ওখানে ক’টাদিন থাকব।’

তমাল আধ মিনিট মতো চুপ করে থাকে। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে।

‘শালা, সুনীল গাঙ্গুলির নীললোহিত হয়েছ? হুমায়ূন আহমেদের হিমু? বেশি বেকারি ফলাও? বোহেমিয়ান? কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রেমিক যুবক? বিরাট উদাস হয়েছ না? নদীর পাড়ে শুয়ে থাকবে? মাঠে ঘুমিয়ে পড়বে? চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব তোমার। চাঁদের আলোয় পথে পথে হাঁটা বের করে দেব তোমার। নীললোহিত আর হিমুর নকল করে বিরাট কায়দা হয়েছে? আমি এখন মিস্টার জগমিয়াকে কী কৈফিয়ৎ দেব? কী বলব? আমার মাথা কাটা গেল। ছি ছি। কলকাতায় এসো তোমার নীললোহিত আর হিমু ফলানো বের করব।’

সাগর মিনমিন করে বলেছিল, ‘শান্ত হ তমাল। বি কোয়াইট। তুই ভুল করছিস। আমি নীললোহিত বা হিমু হতে যাব কোন দু:খে? ওরা বিরাট ব্যাপার। আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সাগর। নীললোহিতের মতো আমি প্রেম করতে পারি না, আবার হিমুর মতো মিসটিক ওয়ার্ল্ডেও ঢুকতে জানি না। আমাকে কখনও কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নিয়ে নীললোহিতের মতো নদীর পাড়ে ঘুরতে দেখেছিস না হিমুর মতো জ্যোৎস্না রাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে শহর টহল দিই? আমি ওসবে নেই। সাগর একজন প্র্যাকটিকাল মানুষ। সে প্র্যাকটিকাল পথে অন্যের সমস্যার সমাধান করে। করতে গিয়ে নিজে সমস্যায় পড়ে। তাছাড়া, হিমু যদি নীললোহিতের মতো হতে পারে, নীললোহিত যদি হিমুর মতো হতে পারে তাহলে সাগরের ওদের মতো হতে দোষটা কোথায়? সুবোধ ঘোষের শুন বর নারী গল্পটা পড়িসনি? সেখানে হিমাদ্রি নামে এক যুবক ছিল। তাকে হিমুও ডাকা হত। বোহেমিয়ান যুবক। কোথাও ধরা দিতে চাইত না মোটে। সে তো হুমায়ূনসাহেবের হিমু বা সুনীলবাবুর নীললোহিতের আগের কেস। তারপর ধর বিভূতিভূষণের সেই গপ্পটা যেটা নিয়ে তরুণ মজুমদার মশাই পলাতক ছবি করলেন। সেই গল্পের নায়কও তো নোঙর করত না। ভেসে ভেসে বেড়াত। আসলে এই উদাসীন, বাউণ্ডলেপনা, আলসেমি কারও একার নয়। সবার। তা ছাড়া আলসেমি আর আমার হল কই? নীললোহিতের মতো ফুলটাইম বেড়াতে পারলে তো হয়েই যেত…। সাগর ঠিক একটা না একটা ঝামেলায় পড়ে যায়…মুখ ফেরাতে পারে না…।’

মাঝপথেই তমালের হুংকার, ‘চোপ। আর কোনওদিন আমার মুখ দর্শন করবি না। কোনওদিন নয়।’

সাগর লোধাশুলির ট্রেকারে উঠতে উঠতে সেদিন বলেছিল, ‘আচ্ছা দেখাব না। এখন যাই?’

তাই সকলে বলছে, এই ছেলে কাজ পাবে কী করে! অসম্ভব।

সকলে যাই বলুক ঘটনা সত্যি। আমি কিন্তু কাজ একটা পেয়েছি। অদ্ভুত কাজ। সেই অদ্ভুত কাজের কথা বলার আগে একটু কৈফিয়ত দিয়ে নিই। আমার নামে এতগুলো অভিযোগ হল, আর একটু কৈফিয়ত দেব না? এক দুই তিন করে দিই? বেশ টু দ্য পয়েন্ট হবে। আজকের যুগ হল টু দ্য পয়েন্টের যুগ। বেশি ভ্যানতাড়া শুধু টিভির টক শোতে চলে। এক মিনিটের কথা একেক জনকে এক ঘণ্টা করে বলতে হয়। ওখানে অতিরিক্ত বকবক না করলে চলে না। যতক্ষণ না লোকে বলছে ‘উফ কী বাজে বকছে রে বাবা’ ততক্ষণ টকশো জমে না। বাঙালি সারাদিন কম কথা শুনতে চায়, শুধু সন্ধেবেলা টিভির বেশি কথার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে।

কৈফিয়ত ১ : আমার সঙ্গে গাধার কোনও তুলনা হয় না। এতে গাধা সম্পর্কে ভুল ইমপ্রেশন দেওয়া হবে। গাধা কখনোই অলস নয়। গাধা একজন পরিশ্রমী প্রাণী। খুব খাটাখাটনি করতে পারে। সেই কারণেই প্রবাদ আছে গাধার খাটুনি। একসময় জমিদার বাড়িতে প্রাইভেট হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে প্রাইভেট গাধাও থাকত। জমিদারবাড়ির গাধাদের বিশেষ খাতির ছিল। লর্ড কার্জনের আমলে সালকিয়ার এক জমিদারবাড়ির গাধাকে ‘খাটুনিশ্রী’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বাকি জীবন তার অবসরে কাটে। সিবনসাহেবের বিখ্যাত ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল জমিনদারি’ বইতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। গাধাদের জন্য একটাই দু:খ সেই বই আর এখন পাওয়া যায় না।

কৈফিয়ত ২ : আমি টিউশন ছেড়েছি বাধ্য হয়ে। আমার কোনও দোষ নেই। সত্যি কথা বলতে কী কারোরই দোষ নেই। প্রেম এমন একটা জিনিস কারও হাতে তার ভাগ্য নির্ভর করে না। বরং তার হাতেই ভাগ্য নির্ভরশীল। সেই হাত থেকে রক্ষা পেতেই টিউশনস্থল থেকে আমার পলায়ন। একটু ভেঙে বলি।

ছাত্রীর নাম কায়দা মার্কা। দেবত্রা। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। সায়েন্সে ভালো, বাংলায় গাড্ডা। বিশেষ করে ব্যাকরণে একেবারে বৃহস্পতি। আমি তাকে পড়াতাম বাংলা ব্যাকরণ। গতমাসে বেতন পাওয়ার আগের দিন দেবত্রা আমাকে একটা চিরুকুট ধরিয়ে ফিসফিস করে বললে, ‘মাস্টারমশাই এই চিঠি রাতে পড়বেন।’ রাতে সেই চিঠি পড়ে আমার মাথায় বাজ পড়ল।

‘মাস্টারমশাই, আপনিই আমার কারক, বিভক্তি, আপনি আমার সমাস। আপনি আমার নত্ব বিধান সত্ব বিধান, আপনি আমার এক কথায় প্রকাশ। আপনি বেতিরেকে জীবনের সব ব্যাকরণ বৃথা। কাল পড়াতে এসে আপনি যদি হ্যাঁ না বলেন তাহলে সুইসাইড ছাড়া আমার জীবনের কোনও ক্যালকুলাস মিলবে না। ইতি আপনার প্রাণের মুনমুনি।’

মুনমুনি! দেবত্রা কবে আমার প্রাণের মুনমুনি হল? এ তো ডেনজারাস মেয়ে! পরদিন থেকেই টিউশন বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলাম। পরে অবশ্য ভেবে দেখেছি, কাজটা বোকামি হয়েছে। একটা দিন পরেই বেতনের তারিখ ছিল। মাইনেটা নিয়ে যাওয়া বন্ধ করা উচিত ছিল। একদিন প্রেম করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত? মহাভারতে বহু একদিনের প্রেমের ঘটনা আছে। তাতে কি মহাভারতের দাম কিছু কমেছে? খুব বোকামি হয়ে গেছে। বেকার মানুষ অতগুলো টাকা…।

পু : এখন কানঘুষোয় শুনছি, দেবত্রা নাকি মাঝেমধ্যেই এই কাণ্ড করে। মাস্টারমশাইয়ের বেতনের তারিখ এসে গেলে ফট করে প্রেমপত্র ধরিয়ে দেয়। মাস্টার ঘাবড়ে গিয়ে পালায়। যদিও এই অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। ভাবছি, একদিন গিয়ে জিগ্যেস করব। ঘটনা যদি সত্যি হয় মাস্টার তাড়ানোর অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আসব।

কৈফিয়ত ৩ : আমি প্রুফ দেখা ছেড়েছি বিরক্ত হয়ে। অতি অখাদ্য একটি বইয়ের প্রুফ দেখার পর। বইটির নাম মনে নেই। লেখকের নাম মনে আছে। সেটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। যতই হোক বেচারি করে খায়। আমার প্রকাশক অতি সজ্জন মানুষ। টাকাপয়সা মোটে বাকি রাখেন না। খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। সকালে গেলে সরবত, বিকেলে গেলে মুড়ি-চানাচুর, সন্ধে গড়ালে ফিশফ্রাই। আমি বিকেল থেকে সন্ধে গড়ানো পর্যন্ত থাকি। মুড়ি চানাচুর এবং ফিশফ্রাই খাই। আমাকে এক দিন এক দিস্তে ম্যাটার দিয়ে উনি বললেন, নাও পড়ো। সেই লেখা পড়তে গিয়ে আমার পাগল পাগল অবস্থা। সকালে হেঁচকি। বিকেলে বদহজম। রাতে দু:স্বপ্ন। এরপরই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আর নয়। হয় প্রুফ দেখা বন্ধ করতে হবে, নয়তো অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। প্রুফের বান্ডিল গিয়ে ফেরত দিয়ে এলাম। প্রকাশক ভদ্রলোককে বললাম, ‘আমাকে মাপ করবেন। আমি এই লেখকের বই দেখতে পারব না। দেখলে অসুস্থ হয়ে পড়ব।’ আগেই বলেছি ভদ্রলোক অতি ভালো। আমাকে স্নেহ করেন। অন্য কেউ হলে রাগারাগি করতেন। আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে। এটা রেখে যাও। তোমার আগেও কয়েকজন বলেছে, এই লেখকের লেখা পড়া যায় না। অপাঠ্য। দেখি নতুন বই এলে তোমাকে ডাকব। সুনীলবাবুর অপ্রকাশিত একটা উপন্যাস বের করার চেষ্টা করছি। তুমি ওটার প্রুফ দেখো।’

আমি গদগদ গলায় বললাম, ‘সুনীলবাবুর বই পেলে আমি ধন্য হব।’

প্রকাশক বললেন, ‘আমি দেখব। তুমি চলে যেও না সাগর। একটা ফিশফ্রাই খেয়ে যাও।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে বসছি।’

লেখকের নাম বলব? বলেই দিই। আমাকে যারা অলস বলে গালমন্দ করে তারা নিজেরা একবার তার লেখা পড়ে দেখুক। কত ধানে কত চাল টের পাবে। একটা ভাতে একটা কাঁকড়। সেই অখাদ্য লেখকের নাম প্রচেত গুপ্ত। দেশে সুশাসন থাকলে এইসব লোকের লেখা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হত। কী করা যাবে। দেশে যখন সুশাসন নেই অনেক কিছু সহ্য করতে হবে।

কৈফিয়ত ৪ : চাকরির ইন্টারভিউ দেবার বদলে লোধাশুলির গ্রামে চলে যাবার বিষয় আমি কিছু বলতে চাই না। বলে কী লাভ? কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি নিজেও করছি না। নিজের কথা নিজেই যেখানে বিশ্বাস করি না, সেখানে অন্যকে দোষ দিয়ে কী লাভ?

সেদিন সকালবেলা ঢলঢলে স্যুটের ওপর টাই ঝুলিয়ে সেজেগুজে সবে ইন্টারভিউ দেবার জন্য বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি হঠাৎ কোথা থেকে কবিতার তিনটে লাইন উড়ে এসে মাথায় জুড়ে বসল। এরকম হয়। গানের লাইন, কবিতার লাইন মাথায় ঢুকে মশার মতো পিনপিন করতে থাকে। কিছুতেই যেতে চায় না। আমি প্রমাদ গুণলাম। এমনি কবিতা ঠিক আছে, কিন্তু কোট-টাই পরা অবস্থায় কবিতা খুব অলুক্ষুনে। লাইনগুলো এরকম—’জানি গো দিন যাবে এ দিন যাবে / একদা কোন বেলাশেষে মলিন রবি করুণ হেসে / শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে।’ লাইন ক’টা ঘুরতেই লাগল, ঘুরতেই লাগল ঘুরতেই লাগল।

আমি এসপ্ল্যানেডে নেমে রেবাকে ফোন করলাম।

রেবা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী হয়েছে?’

রেবা আমার গলা শুনলেই বিরক্ত হয়। আবার গলা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে বসে থাকে। অদ্ভুত না?

‘একটা বিপদে পড়েছি রেবা।’

অন্য যে-কোনও প্রেমিকা হলে উদ্বিগ্ন গলায় বলত, ‘কী হয়েছে সাগর? কী হল তোমার? কীসের বিপদ?’ রেবা এই ধরনের কাজ করে না। এই কারণে তাকে আমি ভালোবাসি।

রেবা নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘আমি কী করব?’

‘তুমি বিপদ থেকে বেরোনোর পথ বলে দাও।’

রেবা টেলিফোনে হাই তোলার আওয়াজ করল। বলল, ‘পারব না।’

আমি বললাম, ‘পারতে হবে না। শুধু পাশে থাকো। বিপদের সময় ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকাটাই আসল। রক্ষা করাটা আসল নয়।’

রেবা আরও বিরক্ত গলায় বলল, ‘নেকা কথা না বলে কী হয়েছে বলো।’

আমি রেবাকে ঘটনা জানালাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘রেবা, একটু পরে আমার চাকরির ইন্টারভিউ। যে সে চাকরি নয়, হাতের মোয়া চাকরি। তার জন্য মিটিমিটি হাসি ইন্টারভিউ। এই সময় কবিতা টবিতা নিয়ে সময় নষ্ট করা পাগলামি। অথচ লাইনগুলো মাথা থেকে যেতেই চাইছে না। তুমি শিগগিরই একটা পথ বাতলাও।’

রেবা একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘একটাই পথ। তুমি কবিতাটার পরের তিনটে লাইন মনে করে ফ্যালো। একমাত্র তবেই তুমি আগের লাইন থেকে মুক্তি পাবে। নইলে ওরা তোমার মাথায় তাঁবু ফেলে বসে থাকবে। রাতে আগুন জ্বেলে ক্যাম্প ফায়ার করবে।’

আমি নার্ভাস হয়ে বললাম, ‘রেবা তুমি কি কবিতার পরের তিনটে লাইন জানো?’

রেবা ফিক করে হেসে বলল, ‘ওমা জানব না? এ তো খুব চেনা কবিতা। সবাই জানে।’

‘তাহলে আমাকে বলে দাও। আমার মনে পড়ছে না। মেমারি লস হয়েছে।’

রেবা বলল, ‘তা হবে না। বিপদ কাটানির নিয়ম হল লাইনগুলো নিজেকে মনে করতে হবে। তুমি নিজে মনে করো। আমি ছাড়লাম। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

আমি অনেক চেষ্টা করেও পরের তিন লাইন মনে করতে পারলাম না। এসপ্ল্যানেডে অনেক পায়চারি করলাম। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল ‘জানি গো দিন যাবে এ দিন যাবে’। এসপ্ল্যানেডের দূরপাল্লা বাস গুমটির কাছে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে করে চা খেলাম। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল ‘একদা কোন বেলা শেষে মলিন রবি করুণ হেসে।’ আমি বুঝতে পারলাম একটা বিপদ থেকে বাঁচাতে গিয়ে রেবা আমাকে আর একটা বিপদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। চা খাওয়া শেষ করে আমি এগিয়ে গেলাম। তারপর ‘কলকাতা হইতে ঝাড়গ্রাম’ লেখা একটা ফাঁকা বাসে দুম করে চেপে বসলাম। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল ‘শেষ বিদায়ের চাওয়া আমার মুখের পানে চাবে’। বাস ছাড়ার পর আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল, শহরের হট্টগোল, লোভ, স্বার্থপরতা থেকে পালিয়ে যেতে পারলে কবিতাটার পরের লাইনগুলো মনে পড়ে যাবে।

বিশ্বাস করতে বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আমিও করব না। ঝাড়গ্রামের মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মতো পরের ক’টা লাইন আমার মাথায় ঝলসে উঠল! আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে উঠলাম—রেবা আমি পেরেছি। আমি পেরেছি।

মোবাইল থেকে রেবার নম্বর টিপলাম। ফোন বন্ধ। আবার টিপলাম। ফোন বন্ধ। আমি জানি, রেবা আজ কিছুতেই ফোন খুলবে না। রেবা জানে, অনেক দূরে কোথাও গিয়ে কবিতার লাইনগুলো আমার মনে পড়বেই। আমি তাকে বলব। শুনে তার মন খারাপ হবে। সেই মন খারাপের হাত থেকে সে বাঁচতেই ফোন বন্ধ করে রাখবে।

আমার এত কৈফিয়তই বলে দিচ্ছে আমি নির্দোষ। কোনও অন্যায়ই আমি নিজ ইচ্ছায় করিনি। যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি। অনেক খুন মানুষ নিজের ইচ্ছেতে করে না। যে খুন হয় সে-ই করে। দোষ হয় খুনির।

যাই হোক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ধারদেনাই আমার মূল রোজগার। এতে লজ্জার কিছু নেই। আমাদের দেশের ধনী মানুষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা ধার আছে। আমাদের দেশেরও আছে। বড়লোক বিদেশের কাছে ধার আছে। আমরা কি সবাই লজ্জা লজ্জা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি? তাহলে? সব দোষ কেবল সাগরের বেলায়? আমার বাড়িওয়ালার কাছে ধার, ভাত-ডালের দোকানে ধার, বন্ধুর কাছে ধার, শত্রুর কাছে ধার। শত্রুর কাছে ধার কথাটা শুনে অবাক লাগছে? লাগবারই কথা। শত্রু কখনও ধার দেয়? বরং অনেক ‘বন্ধু’ ধার দিয়ে ‘শত্রু’ হয়ে যায়। ধারের টাকা ফেরত না দিলে গাল দেয়। শুধু সাগরের বেলায় অন্য নিয়ম। তমালের মতো মানুষেরা আসলে আমার শত্রু। আমাকে চাকরিতে ঢুকিয়ে সুখ কেড়ে নিতে চায়। হিংসেতে করে। বেটারা সকালবেলা চকচকে বুট পরে অফিসে যায়। আমি পড়ে পড়ে ঘুমোই। সহ্য হয় না। তবে এই শত্রুটি কিন্তু আমাকে বড্ড ভালোবাসে। আমাকে নিয়মিত টাকাপয়সা দিয়ে চলেছে। ধার বলে, কিন্তু শোধ নেয় না।

এবার কাজের কথায় আসি।

অদ্ভুত এই কাজ আমি পেয়েছি ইন্টারনেট যোগাযোগে। ইন্টারনেটের এই যোগাযোগ হয়েছে ভায়া ঝিঙ্কু। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব হয়। চাকরি থেকে বাকরি। বিয়ে থেকে ইয়ে। ক্রাইম থেকে রাইম। এই পর্যন্ত শুনে কেউ যেন ভেবে না বসে বেকার অলস গাধা সাগরের এই সব আয়োজন আছে। আমার কম্পিউটার কেনবার মুরোদই নেই তো ইন্টারনেট। শ্যামলদার মেয়ে ঝিঙ্কু একজন বিরাট ওস্তাদ মেয়ে। সে আইটি সেক্টরে চাকরি করে। সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে। সে-ই আমাকে ঠেলেঠুলে কাজটায় ঢুকিয়ে দিল।

‘একটা ট্রাই নিয়ে দ্যাখো সাগরকাকা। অ্যাডভেঞ্চারের মতো হবে। কাজটাও দারুণ ইন্টারেস্টিং। যদি সাকসেসফুল হও ঘরে বসে রোজগার। ডলার-ফলার পেয়ে যাবে।’

রোজগার জানি না, কাজটা যে মজার এতে সন্দেহ নেই। একে কাজ না বলে গবেষণা বলা উচিত। গোটা বিশ্ব জুড়ে এই গবেষণার কাজ চলছে। বড় বড় ইউনিভার্সিটি ব্যস্ত। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঝিঙ্কু দেখাল, বহু মানুষ ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এখনও সাফল্য তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। সবাই হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ আংশিক দাবি করছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার প্রিসিলা ডানস্ট্যান নামে এক মহিলা। তিনি দাবি করেছেন…যাই হোক। পুরো সাফল্য পেলে হইচই লেগে যাবে। গবেষণার বিষয় হল—

থাক। পরে বলছি।

আজ আমি কাজ শুরু করেছি। ঝিঙ্কু আমাকে একটা ছোট টেপরেকর্ডার দিয়েছে। বুক পকেটে ঢুকে যায়। আমার একটু ভয় ভয় করছে। ঠিক সময় যন্ত্রটা চালাতে পারব তো? বোতাম কোনটা? লাল না সবুজ? আমি কি একজন গবেষক? নাকি গোয়েন্দা?

কাজ শুরুর আগে বিস্তর খবরাখবর জোগাড় করতে হয়েছে। দশটা বাড়ির লিস্ট থেকে উত্তরপাড়ার এই বাড়ি বেছেছি। ঠিক বাড়ি নয়, ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়ির সামনে আলো, রঙিন কাগজ, বেলুন। ওপরের ফ্ল্যাটের বারান্দায় ঝলমলে আলো। বাড়িটা থেকে লুচি-আলুরদমের সঙ্গে মজা আর আনন্দের গন্ধ ভেসে আসছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হইচইও শুনছি। গেটের সামনে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁধে শাল। আমি এগিয়ে গেলাম।

‘স্যার, ভালো আছেন?’

বয়স্ক মানুষ ভালো করে আমাকে দেখলেন। যাকে বলে আপাদমস্তক দেখা। সাজপোশাক দেখে বিরক্ত হলেন। আমি হলেও হতাম। অনুষ্ঠানের বাড়িতে ঢলঢলে প্যান্ট, রং-চটা, ইস্তিরিবিহীন জামা চলে না।

ভদ্রলোক রাগ রাগ গলায় বললেন, ‘কী চাই?’

আমি একগাল হেসে বললাম, ‘স্যার এটাই নিশ্চয় মৌসুমী-পিনাকপানির বাড়ি?’

ভদ্রলোক আবার আপাদমস্তক দেখলেন। বললেন, ‘তারা ব্যস্ত।’

‘ব্যস্ত তো হবেই স্যার, আজ তাদের কন্যার প্রথম জন্মদিন। একবছর বয়সের অনুষ্ঠান। বিরাট আনন্দের ঘটনা। আজ তারা ব্যস্ত হবে না তো কে হবে?’

‘তুমি কে? তুমি কি ওদের পরিচিত কেউ?’

মানুষটার গলায় এবার রাগের সঙ্গে ঘোর সন্দেহ। এরকম পোশাক পরা এবং ন্যালবেলে আচরণের কেউ যে অধ্যাপিকা মৌসুমী বা সাংবাদিক পিনাকপানির পরিচিত হতে পারে উনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার ওপর আমার হাতে উপহারের কোনও প্যাকেট নেই। জন্মদিনে এসেছি, কিন্তু গিফট আনিনি এ কেমন কথা! সন্দেহ হওয়ারই কথা। ভদ্রলোককে আমার ভালো লাগল। সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারেন। নিমন্ত্রিত হলে থাকো নয়তো কেটে পড়ো বাছাধন। সোজা কথা বলার মানুষ দিন দিন কমে আসছে। আমি হাসলাম। যার অর্থ দুটোই হতে পারে। মৌসুমি, পিনাকপানি আমাকে চেনে অথবা চেনে না। কী করব? আমি কি বলতে পারি, এই বাড়ির কাউকেই আমি চিনি না। আমি আমার কাজের জন্য এদের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করেছি মাত্র। আমার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। একটা ভুল করে বসে আছি। বহুদিন নেমন্তন্ন বাড়িতে না যাওয়ার কারণে ভালো জামা পরবার কথা মনে ছিল না। হাতের কাছে হাবিজাবি যা পেয়েছি পরে ফেলেছি। এটা ঠিক হয়নি। অনুষ্ঠান বাড়িতে রং-চটা জামা পরলে সকলের চোখে পড়ে যায়। সাজগোজ করলে কেউ ঘুরেও তাকায় না। তমালের কাছ থেকে একটা ভালো জামা ধার করতে পারতাম। তাছাড়া ঝিঙ্কুর কাছ থেকে গিফট কেনবার টাকা নিলে হত। পরে ডলার-টলার পেলে শোধ করে দিতাম না হয়। তাহলে আর পাঁচজনের সঙ্গে মিশে যেতে পারতাম। কারণ এর পরের কাজটা কঠিন। চট করে কারও চোখে পড়লে চলবে না। কাজের মধ্যে একটা ‘চোর চোর’ ব্যাপার।

ভদ্রলোকের পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ চলে এলাম ওপরে। এবার আমাকে সাবধান হতে হবে। কোথায় সে?

ঘরের ভেতর খুব হইহই হচ্ছে। সবাই হাসছে। অকারণে চিৎকারও করছে। কেউ আমার সাজপোশাকের দিকে আলাদা করে তাকাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ-বাড়ির মানুষগুলোর কাছে পোশাকের আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই, শুধু হাসি আনন্দের গুরুত্ব আছে। ঝলমলে, রং-চটা, বোতাম ছেঁড়া সব সমান। তার কাটা বাড়ি। সমাজ যেমন নিয়মের তার বেঁধে দিয়েছে, এই বাড়ির লোকেরা তার খানকতক কেটে দিয়েছে। আমার ভালোই হল। কারও নজরে পড়তে চাই না।

খানিকটা থতমত খেয়ে ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। এবার কী করব? তাকে কী করে খুঁজে পাব? এই সময় এক কিশোরী এগিয়ে এসে বলল, ‘ওমা! কী মজা! তপুদা তুমি চলে এসেছ! তুমি কী করে খবর পেলে? চেন্নাই থেকে কখন এলে? এসো এসো। ছোটমা, মেজকা দ্যাখো কে এসেছে।’

আমি কিশোরীর ভুল ভাঙালাম না। পরিচিত জনের মতো হেসে নীচু গলায় বললাম, ‘ওসব পরে হবে। আগে বলো সে কোথায়?’

কিশোরী হাত তুলে পাশের ঘর দেখাল, ‘ওই ঘরে।’

আমি হেসে বললাম, ‘তুই একবার নিয়ে আয় দেখি।’

অচেনা কিশোরী পরির মতো একটা ছোট মেয়েকে কোলে করে এনে আমার কোলে বসিয়ে বলল, ‘বারান্দায় নিয়ে গিয়ে তুমি ওর সঙ্গে একটু খেলা করো তপুদা। এত ভিড় বেচারির ভালো লাগছে না। আমি মেজকাকে ডেকে আনি।’

এর পরের কাহিনি যেমন অবিশ্বাস্য তেমন চমকপ্রদ।

মৌসুমী-পিনাকপানির এই কন্যার নাম সাঁঝবাতি। সাঁঝবাতিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এক বছরের ফুটফুটে এই মেয়েটি সম্পর্কে আমি যা খবরাখবর জোগাড় করেছি সেখান থেকে জেনেছি সাঁঝবাতি মূলত চার ধরনের বাক্য বলতে পারে। ‘তাই তাই তাই’, ‘না না না’, ‘নে নে নে’ এবং ‘দে দে দে’। আমার কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব এই বাক্যগুলি টেপ করে এখান থেকে ভেগে যাওয়া। বাড়ি গিয়ে টেপ চালিয়ে কথাগুলো বার বার শুনব এবং মানে বের করতে চেষ্টা করব। যাকে বলে ‘ডি-কোড’ করব।

পৃথিবী জুড়ে এই কাজ চলছে। শিশুর গলা থেকে বেরোনো আওয়াজের অর্থ বের করতে হবে। তাদের হাসির অর্থ চাই, কান্নার অর্থ চাই। কেউ দাবি করছেন কান্না, হাসি, আওয়াজের কিছু কিছু নাকি বোঝা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষক প্রিসিলা বলেছেন, শিশু কান্নার নাকি চার-পাঁচরকমের অর্থ। এসব কিছুই নতুন কথা নয়। ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।

যেটা পাওয়া যাবে না সেটা হল, ঝিঙ্কু আমাকে এই গবেষণায় যুক্ত করে দিয়েছে। আমি সাঁঝবাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সে কি আবোল তাবোল বলে তার মানে বুঝতে হবে।

কিন্তু এ কী ঘটল!

এত কোলাহলের মধ্যেও আমি স্পষ্ট শুনলাম পাখির ডাকের মতো মিষ্টি গলায় সাঁঝবাতি বলছে, ‘অ্যাই সাগর, এসব কী শুরু করেছিস? তাই তাই তাই তাই…।’

আমি চমকে উঠলাম। কে কথা বলে!

সাঁঝবাতি বলল, ‘এই যে আমি বলি। শুনতে পাস না? হাঁদা কোথাকারে। না না না।’

আমি অবাক হয়ে কোলে বসা শিশুটির মুখের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর হাসি! হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘আমরা আমাদের মতো কথা আবোল তাবোল, হিজিবিজি বকি, হাসি, কাঁদি। তাতে বড়দের কী? তোরা কেন নাক গলাতে চাস? ওই নাক কামড়ে দেব। নে নে নে।’

আমি পকেটের টেপ চালিয়ে দিয়েছি।

‘খবরদার, খিচিবিজি বকা, সিজিবিজি হাসি, ফিচিমিজি কান্না নিয়ে মাথা ঘামাবি না। আমি জানি আজ তুই ওই মতলবে এসেছিস। কী ভেবেছিস? ছোট বলে কিছু বুঝি না? সব বুঝি। দে দে দে।’

আমি বিস্ময় কাটিয়ে বললাম, ‘সাঁঝবাতি, তোমাদের আওয়াজ, হাসিকান্না সব আমাদের বোঝার দরকার আছে। তা হলে তোমাদেরই সুবিধে। তোমাদের কতরকমের সমস্যা আমরা বুঝতে পারব।’

সাঁঝবাতি বলল, ‘না না না, কিচ্ছু বুঝতে হবে না। আমার মা সব বোঝে। খিদে পেলে খেতে দেয়, ঘুম পেলে ঘুম পাড়ায়। তোরা সব বড়রা কে? তোরা তোদের সমস্যা বোঝ। আমাদের নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো এমন চিলচিৎকার দেব যে কান একেবারে…দে দে দে দে…। তোদের তো একটা কথার দশটা মানে। তার কী হবে? তাই তাই তাই। তাই নিয়ে আগে গবেষণা করেছিস? কাল থেকে শুরু করবি। নইলে…নে নে নে নে। ছোটদের সব আওয়াজের একটাই মানে। নে নে নে নে।’

‘একটাই মানে!’

বুঝতে পারছি, ঘরের ভেতরে সাঁঝবাতির খোঁজ পড়েছে। সে আমার নাক খামচে বলল, ‘হ্যাঁ রে সাগরবাবু, একটাই মানে। সে আমি দে দে-ই বলি আর নে নে-ই বলি, হাসি-কাঁদি যা-ই করি। আমি শুধু বলি, আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি, আমি তোমাদের ভীষণ ভালোবাসি। নে এবার আমাকে ঘরের ভেতর দিয়ে আয়। মা খুঁজছে। আর শোন, না খেয়ে যাবি না। ফিশ চপ হয়েছে। দুটো খাবি। শুনলাম ভালো হয়েছে। আমাকে দিচ্ছে না। না না না…। তোরা বড়রা এই জিনিসটা বুঝতে চাস না। একটা-আধটা চপ-কাটলেট খেলে ছোটদের কী হবে? কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া আজ আমার জন্মদিন।’

কিশোরীর হাতে সাঁঝবাতিকে তুলে দিয়ে আমি কোওনরকমে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। পালিয়ে এসেছি। টেপে আমার সব ধরা পড়ে গেছে। রিকশাতে চেপে স্টেশনে যাওয়ার পথে আমি টেপ চালিয়ে শুনে নিলাম। সাঁঝবাতির মিষ্টি রিনরিনে গলা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সব কথা! এবার কী হবে? উত্তেজনায় আমার হাত কাঁপছে। আমার পা কাঁপছে। শিশুর গলার রকমারি আওয়াজের অর্থ নয়, একেবারে আস্ত কথা ধরে ফেলেছি আমি! সারা পৃথিবীতে তোলপাড় পড়ে যাবে। কত টাকা পাব? অনেক?

হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে একটা বোকার মতো কাণ্ড করলাম। জানলা দিয়ে ঝিঙ্কুর টেপরেকর্ডারটা দিলাম ছুঁড়ে বাইরে। অন্ধকার ঝোপঝাড়ে গিয়ে পড়ল ঝুপ করে। ছোট্ট সাঁঝবাতি আমার মনের মধ্যে থেকে স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘বা বা বা… ওয়েল ডান সাগর। এই জন্য তোকে এত ভালোবাসি।’

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি সোনা। শুভ জন্মদিন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *