সাঁকো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সাঁকো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ওরা আমার হাত দুটো পেছন দিকে মুড়ে বাঁধল নাইলনের দড়ি দিয়ে। চোখে বেঁধে দিল নিরেট কালো কাপড়। মুখের মধ্যে একটা বেশ বড় তুলোর গোল্লা ভরে দিয়ে ঠোঁটে আটকে দিল স্টিকিং প্লাস্টার। তারপর বুঝতে পারলাম, দু’তিনজন লোক আমাকে উঁচু করে তুলে বেশ খানিকটা বয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল একটা কাঠের তক্তার ওপরে।

একজন খুব ঝকঝকে পালিশ করা গলায় বলল, এবারে তুমি হাঁটো সামনের দিকে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, এক পা এক পা করে হাঁটো।

আমি এক পা বুলিয়ে দেখলুম, কাঠের তক্তাটা মাত্ৰ-বিঘতখানেক চওড়া, তলার দিকে শূন্যতা।

এটা-একটা সাঁকো? নীচে কোনও পাহাড়ি নদী? জ্যোৎস্নহীন রাতে আমরা আসছিলুম একটা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে, গাড়ি থেমেছিল একটা জঙ্গলের মধ্যে। এমন নিস্তব্ধতা যে বাতাসেরও কোনও শব্দ নেই।

যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই আততায়ীদের একজন হেসে বলল, হ্যাঁ, এটা তিস্তা নদীর ওপর একটা অস্থায়ী সাঁকো। জল প্রায় পাঁচ ছ’শো ফুট নীচে। যদি পা পিছলে পড়ে যাও সঙ্গে সঙ্গে ছাতু হয়ে যাবে। তোমাকে আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

আমি বুঁ বুঁ শব্দ করে বলতে চাইলুম, আমাকে এই সেতুটা পার হতে বলছ কেন?

সে ঠিক বুঝতে পেরে বলল, এটা একটা খেলা।

আমি ওইভাবেই আবার বললুম, এ খেলা যদি আমি খেলতে না চাই?

সকৌতুক উত্তর এল, তাহলে তোমাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হবে। তুমি গড়াতে গড়াতে পড়বে, আমরা সেটা টর্চ ফেলে দেখব!

এরপর আমি নিজেই জিজ্ঞেস করলুম, আর যদি ওপারে পৌঁছতে পারি?

আবার হাসির সঙ্গে উত্তর এল, তখন দেখবে কী হয়। নিশ্চয়ই একটা কিছু খুব মজার ব্যাপার হবে। নাউ স্টার্ট। আমরা ঠিক দশ গুনব, তার মধ্যে এগোতে শুরু না করলে…এক, দুই, তিন…

প্রথম পা ফেললুম সামনের দিকে। খুব একটা শক্ত কিছু মনে হল না। কাঠের পাটাতনটা বেশ মজবুত। একপা সামনে দিয়ে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে তারপর দ্বিতীয় পা এগিয়ে ঠিক মতন বুঝে নিয়ে সেটা ফেলতে হবে। এই রকম ভাবে প্রত্যেকবার। একটুও অন্যমনস্ক হলে চলবে না। অসম্ভব কিছু নয়। এর থেকেও অনেক শক্ত খেলা আছে পৃথিবীতে।

ওদের গোনা শেষ হবার আগেই আমি তিন পা এগিয়ে এসেছি। কী ভাবে ওরা আমাকে? ওরা গায়ের জোরে আমাকে ধরে এনেছে বলেই আমি ওদের কাছে হার স্বীকার করব? ওরা কি ভেবেছিল, আমি কেঁদে কেটে, প্রথমেই ভয় পেয়ে গিয়ে দয়া চাইব ওদের কাছে? আমাকে এখনও চেনে না।

এই সাঁকোটা কতখানি লম্বা? তিস্তা নদী তো কম চওড়া নয়। জুবিলি ব্রিজ পার হয়েছি অনেকবার। উঁচু পাহাড়ের ওপরে হয়তো কিছুটা সরু। এ জায়গাটা কোথায়?

এ কী, আমার পা কাঁপছে কেন? মাথা ঠিক আছে, তবু পা কাঁপছে? সামনের দিকে এগোবার জন্য একটা পা তুলতেই অন্য পা-টা যেন শরীরের ভর রাখতে পারছে না। মানুষ তো এক পায়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সামনের দিকে পা বাড়ানোই দারুণ শক্ত। পাশের দিকে নয়, শুধু সামনের দিকে। একেবারে সোজা হাঁটতে মানুষ জন্ম থেকেই শেখে না।

ওদের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল, থামলি কেন? গুঁতো খাবি কিন্তু।

আমার মুখ বন্ধ, আমি উত্তর দেব কী করে? ওরা তা জানে না? অবশ্য ওদের ওই প্রশ্নের কোনও উত্তরও হয় না।

আবার ওরা বলল, হয় গুঁতো খাবি, নইলে গুলি করা হবে। থেমে থাকা চলবে না। আবার দশ গুনছি, এক-দুই-তিন…

একটা যদি লাঠি দিত ব্যালান্স রাখার জন্য। হাঃ, লাঠি, হাত দুটোই খোলা রাখেনি। ছেলেবেলায় যখন কোনও পাঁচিলের ওপর দিয়ে কিংবা রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটেছি, হাত দুটো এমনিতেই দু’পাশে সোজা হয়ে গেছে, হাত দুটো তখন ডানা হয়ে যায়।

অন্ধকার রাত্তিরে চোখ খোলা থাকলেও এরকম একটা সরু সাঁকো পার হওয়া কথার কথা নয়। তবু ওরা চোখ বাঁধতে গেল কেন? তেমন প্রয়োজন হলে মানুষ নাকি অন্ধকারেও দেখতে পায়। চোখ খোলা থাকলে, আর কিছু না হোক শুধু অন্ধকারও তো দেখা যেত। অন্ধকার কতরকম। পৃথিবীতে কোথাও খাঁটি কালো অন্ধকার নেই।

না অসম্ভব পা কাঁপছে। আমি পারব না। এরই মধ্যে একবার টলে পড়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে। এটা অন্যায় খেলা।

ওরা আর লাঠি ফাঠি নিয়ে গুঁতো মারতে পারবে না। তার থেকে দূরে চলে এসেছি নিশ্চয়ই। গুলি করতে পারে। কিন্তু ওদের গুলি খেয়ে আমি কিছুতেই মরব না। ওরা গুনতে শুরু করলে নয় পর্যন্ত গোনার পরই আমি ঝাঁপ দেব।

—নীলু!নীলু!

বাবার গলার আওয়াজ। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন আগে। বাবা এখানে এই নদীর ওপর এসে আমায় ডাকতে পারেন না। মানুষের আত্মা বলে কিছু যদি থেকেও থাকে, কিন্তু সেই আত্মা কি পাখি যে অন্ধকার নদীর ওপর এসে উড়বে? এটা আমার কল্পনা, গল্প-উপন্যাসে এরকম থাকে। অবচেতনে আমি কি শিশু হয়ে গিয়ে বাবার সাহায্য চাইছি?

—নীলু, নীলু, তুই পারছিস না? আমি তোর হাত ধরব?

—বাবা, আমার হাত বাঁধা। তোমারও কি হাত আছে?

—না,—আমার হাত নেই। কিন্তু তোকে থামলে চলবে না। তুই এগিয়ে আয়, আস্তে আস্তে, মনে কর, একটু সামনেই তোর মা বসে আছে।

—মা কি সামনে থাকে, না পেছনে?

একটা দমকা হাওয়া দিল। এতক্ষণ বাতাসের অস্তিত্বও টের পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ গরম, কিন্তু বেশি জোর হাওয়া ভাল নয়। একটা পা তুললেই আমার শরীরটা যেন একটা শুকনো ফুলের পাপড়ির মতন পলকা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের ধাক্কাতেও পড়ে যেতে পারি।

আমি আর এগোতে পারছি না। না, পারব না।

পেছন থেকে ওরা গুনছে, এক-দুই তিন…সাত-আট…

—নীলু, নীলু, ঝাঁপ দিও না।

মায়ের গলা? না তো, অন্যরকম, অথচ খুব চেনা চেনা। কে, তুমি কে?

—নীলু, ঝাঁপ দিও না। এসো সামনে এসো। তুমি আমায় চিনতে পারছ না, নীলু?

—রিনি! সত্যি প্রথমটা চিনতে পারিনি। অথচ ভেবেছিলুম, সারা জীবনে তোমাকে ভুলব না। আশ্চর্য।

—সত্যিই তুমি আমায় ভুলে গিয়েছিলে, নীলু?

—না, রিনি, ভুলে যাইনি, আবার অনেকদিন মনেও পড়েনি তোমার কথা। এতদিন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে?

—আমি তো হারিয়ে যাইনি, তুমিই অনেক দূরে চলে গেলে!

—রিনি আমার চোখ বাঁধা, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি আগের মতোই আছো? ঘুঘু পাখির চোখের মতন অবাক অবাক ভাব, একটা উড়ন্ত পালকের মতন তোমার শরীর।

—কথা বলো না, নীলু, এগিয়ে এসে আমার হাত ধরো।

—আমি পারছি না রিনি, আমি আর পারব না, এই দ্যাখো, একটা পা তুলতে কতক্ষণ সময় লেগে যাচ্ছে।

—তুমি একসময় তোমার সবকিছু ছেড়ে আমার দিকে ছুটে এসেছিলে।

—আমি ছুটে গিয়েছিলুম না তুমি আমাকে চুম্বকের মতন টেনেছিলে? এখন আবার সেই রকম ভাবে টানতে পারো না?

—মাঝখানে কতগুলো বছর…নীলু, তুমি সামনাসামনি না এগিয়ে পাশ ফিরে হাঁটো। দ্যাখো, তাহলে পা তুলতে হবে না। একটা পা ঘষে ঘষে এগোবে। পা কাঁপবে না। আমি হাত বাড়িয়ে আছি তোমার দিকে।

—তাই তো, পাশ ফিরে হাঁটা কিছুটা সহজ লাগছে। রিনি তুমি কী করে জানলে? তোমাকে কি এরকম সাঁকো পার হতে হয়েছে কখনও?

আর কোনও উত্তর নেই। রিনি আসেনি। আবার অবচেতন? পাশ ফিরে হাঁটার বুদ্ধিটা রিনি দিয়ে গেল, না আমি নিজেই উদ্ভাবন করলুম? বহুদিন রিনির কথা মনে পড়েনি, রিনি হারিয়ে গেছে, না আমি দূরে চলে গেছি? এক সময় রিনির খুব কাছে পৌঁছনার জন্য সাঙ্ঘাতিক ব্যাকুলতা ছিল। কত কাছে? রোদ্দুর যেমন বহু লক্ষ মাইল দূর থেকে ছুটে এসে মানুষের শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে ভেতরে চলে যায়, অন্ধকার মজ্জা-মাংস শিরা-রক্তে আলো জ্বালিয়ে দেয়, সেই রকম? না, আমি আলো জ্বালিনি, রিনিই জ্বালিয়েছিল, এক চিল-ডাকা দুপুরে ওদের বাড়ির একতলায় বসবার ঘরে রিনি আমার চোখের সামনে ওর একটা হাত তুলে বলেছিল, এই আঙুলের ডগায় কী আছে বলো তো? আমার মনে হয়েছিল, সেখানে থেমে আছে অনন্ত মুহূর্ত।

তবু আমরা পরস্পরকে হারিয়ে ফেললুম কী করে? আর রিনিকে ছাড়ব না, এবার রিনিকে পেতেই হবে। মনে করা যাক এখান থেকে ঠিক দশ পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি, সেই আঙুলটা তুলে, আমায় ওই পর্যন্ত যেতেই হবে।

—নীলু আমি কিন্তু ঠিক ঠিক দশ পা দূরেই দাঁড়িয়ে আছি। তুমি গুনে গুনে পা ফেলে এসো।

—রিনি তোমার কাছে পৌঁছোলে তুমি আমার চোখের বাঁধনটা অন্তত খুলে দেবে? তোমাকে একবার দেখব।

—তোমার চোখ বাঁধা আছে, তাতে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। নীচের দিকে তাকালে তোমার মাথা ঘুরে যেত। নদীর জলে একটু আলো চিকচিক করছে। অনেক নীচে।

—নীচের দিকে তাকাব না, শুধু তোমার আঙুলের ডগাটা আর একবার ভাল করে দেখব।

এই দশ পা যেতে আমার পা কাঁপল না। রিনি সেখানে নেই। কীসের শব্দ, অনেক নীচের নদীর জলস্রোতের? ওহে অবচেতন, তুমি আরও শক্তিশালী হয়ে রিনিকে রক্তমাংসে তৈরি করতে পারলে না? কী গাধা আমি, মাত্র দশ পা দূরে রিনি থাকবে, কেন একথা ভাবতে গেলুম? যদি ভাবতুম পঞ্চাশ পা দূরে, কিংবা সাঁকোর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে রিনি, আকাশে কালপুরুষের দিকে তার কোমল আঙুলখানি তুলে তাহলে সেই টানে হয়তো পৌঁছে যাওয়া যেত।

কৃপণের মতন আমি মাত্র দশ পা উচ্চারণ করে রিনিকে খরচ করে ফেলেছি। এখন অবচেতন তোলপাড় করলেও আর রিনি ফিরে আসবে না।

পেছন থেকে কর্কশ হুংকার ভেসে এলো এই হারামজাদা, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আমরা কি এখানে সারা রাত কাটাতে এসেছি? গুলি চালাব?

ওরা কি টর্চ ফেলে দেখছে আমাকে? ওরা সব মিলিয়ে ছ’জন আমি গুনেছি। ওদের বাধা দেবার কোনও উপায় ছিল না। ওরা কি অপেক্ষা করে আছে, কখন আমি পড়ে যাব? কিংবা ওরা নিজেদের মধ্যে বাজি ফেলেছে?

সিনেমায় এরকম দৃশ্যে থাকে, হঠাৎ একবার পা ফসকে পড়ে যায় নায়ক। দর্শকদের বুক ধড়াস করে ওঠে। নায়ক কিন্তু সত্যি সত্যি পড়ে যায় না, শেষ মুহুর্তে ধরে ফেলে এক হাতে। ঝুলতে থাকে। তলায় হাঁ করে আছে কুমির। নায়ক সেই অবস্থাতেও উঠে আসে কায়দা করে।

আমি পড়ে গেলেও ধরতে পারব না, আমার হাত বাঁধা। মুখ দিয়ে কাঠটাকে কামড়ে ধরারও উপায় নেই। আমার এক চুলও ভুল করলে চলবে না। তা ছাড়া আমি নায়কও নই। এটা সিনেমা নয়, এটা বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা।

বাঁচতেই যে হবে, তার কী মানে আছে? একটা কুঁড়েঘরের চাল থেকে ঝুঁকে পড়া রোমশ, হালকা সবুজ লাউডগায় বসে আছে একটা লালচে রঙের ফড়িং, তিরতির করে কাঁপছে তার ডানা, কী নিশ্চিন্ত ও আনন্দময় তার বসে থাকার ভঙ্গি, যদিও যে-কোনও মুহূর্তে একটা শালিক তাকে ঠোঁটে চেপে নিয়ে যেতে পারে। কেন এই দৃশ্যটা মনে আসছে?

আর কত দুর যেতে হবে? অর্ধেক এসেছি কী? একটা মুহূর্ত, যদি লাফ দিয়ে পড়ি, তাহলে আর কোনও যাতনা সহ্য করতে হবে না। অনেক উঁচু থেকে পড়লে বাতাসের চাপেই নাকি নিঃশ্বাস শেষ হয়ে যায়। অন্য যে-কোনও মৃত্যুর চেয়ে নদীর বুকে হারিয়ে যাওয়া অনেক ভাল।

দুলছে, দুলছে সেতুটা, দুলছে। ওপার থেকে কি ওরা ইচ্ছে করে দোলাচ্ছে? তাহলে ওদের খেলাটা এই, আমাকে কিছুতেই পার হতে দেবে না। মাঝনদীতে ফেলে দেবে।

কিংবা এত লম্বা কাঠের সেতু, নীচে যদি কোনও সাপোর্ট না থাকে, তাহলে মাঝখানটা বেঁকে যেতে তো পারেই। এইখানটা ঢালু হয়ে গেছে, দুলছে। মানুষ নয়, এই কাঠের তক্তার দুর্বলতাই ফেলে দেবে আমাকে।

—নীলু, নীলু তুমিও তোমার শরীরটা দোলাও। নইলে ভারসাম্য রাখতে পারব না!

—কে, গগনদা? আপনি কোথা থেকে এলেন?

—কথা বলার সময় নেই নীলু। নিজের শরীরটা দোলাও, তারই সঙ্গে একটু একটু করে এগিয়ে এসো।

আমি আর পারছিনা, গগনদা। জল আমাকে টানছে। আর, গেলাম…

—না না, তুমি পারবে, তোমাকে পারতেই হবে, নীলু। কাঠের তক্তার দুলুনির সঙ্গে শরীরটা দোলাও সেই সঙ্গে একটা পা বাড়িয়ে দাও, মনের জোর আনো, শরীরে জোর আনো, নীলু তুমি ঠিক জয়ী হবে।

আঃ এসব কী হচ্ছে, অবচেতন! গগনদাকে কোথা থেকে এনে হাজির করলে? একই সঙ্গে শরীর দোলাব, পা বাড়াব, মনের জোর, শরীরের জোর আনব, আমি কি ভেল্কিবাজি জানি? কলেজ জীবনে গগনদা আমাকে যত রাজ্যের ভুল জিনিস শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে গ্রামের ভাষায় কথা বলতে। শেখো। বলেছিলেন, বিপ্লবের জন্য অস্ত্র তুলে নাও। বলেছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম-ভালবাসা বিসর্জন দাও। বলেছিলেন, আদর্শের জন্য বন্ধুর বুকেও ছুরি মারবার জন্য তৈরি হও। সবগুলো এক সঙ্গে, আমার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল, আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলুম। যখন আমি চোখ মেললুম, তখন দেখলুম গগনদা নিজে এসব কিছুই মানেননি, নিজে দিব্যি ফুরফুরে জীবন কাটাচ্ছেন। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই তিনি বললেন, তুমি কে, আমি তোমাকে চিনি না।

বাবা, রিনি, গগনদার কথা অবচেতন থেকে উঠে আসছে কেন? এটা কি রূপক নাকি? অন্ধকার রাত্তিরে একটা খরস্রোতা-পাহাড়ি নদীর ওপরের বিপজ্জনক সাঁকো দিয়ে আমি একলা পার হচ্ছি, এটা কোনও প্রতীকের ব্যাপার। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতয়া…ধারালো ক্ষুরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নামই জীবন, উপনিষদ ফুপনিসদে এরকম কিছু গালভরা কথা আছে না? যাঁড়ের পেচ্ছাপ। রূপক টুপক কিছু না, হলে বাঁচা যেত। ছ’খানা উৎকট আততায়ী জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে এল। কেন আমার ওপর তাদের রাগ তা জানি না, আমাকে এক গুলিতে খতম না করে তারা আমাকে এই বীভৎস তামাসায় নামিয়ে দিয়েছে, সামান্য পদস্খলন হলেই সোজা মৃত্যু, এটাই কঠোর বাস্তব। আমার জীবনে আজকের এই রাতটা শেষ হবে না বোধ হয়।

—এই দুই-তিন-চার পাঁচ…

—যাচ্ছিরে বাবা, যাচ্ছি। বাঁচতে কার না সাধ হয়? যে-কোনও উপায়ে, দাঁতে দাঁত কামড়ে সবাই বেঁচে থাকতে চায়। যাচ্ছি যাচ্ছি।

কাঠের তক্তার দুলুনিটা থেমে গেছে হঠাৎ। তাহলে সম্ভবত পেরিয়ে এসেছি মধ্যপথ। খুব গরম লাগছে। জামাটা খুলে ফেলতে পারলে ভাল হত। এই অন্ধকারে প্যান্টটা খুলে ফেললেই বা ক্ষতি কী ছিল, শরীরটা আরও হালকা হত। ওরা একটা ভাল কাজ করেছে, হয়তো ভুল করেই, আমাকে খালি পায়ে আসতে দিয়েছে। পায়ের আঙুলগুলো আমার বহুকাল আগের পূর্বপুরুষের মতন আঁকড়ে ধরেছে তলার অবলম্বনটা।

—নীলু তুই ভয় পাসনি, আমি সবসময় তোর সঙ্গে সঙ্গে আছি।

—বাবা তুমি আবার এসেছ? বাবা, তুমি যখন সঙ্গে থাকতে না, তখনও কি আমি অনেক অচেনা রাস্তায় হারিয়ে যাইনি? আমি নিজেই তো শেষ পর্যন্ত পথ খুঁজে পেয়েছি।

—নীলু, সেই সব সময়েও বাবা-মায়ের স্নেহ ঘিরে থাকে সন্তানকে। সন্তানেরা বোঝে না, স্নেহ নিম্নগামী বলেই তারা বোঝে না, তারা বাবা মায়ের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে থাকে…

ভাই অবচেতন, কেন বাবাকে ফিরিয়ে আনলে? এতে যে আমি আরও দুর্বল হয়ে পড়ব। বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি, বাবার অনেক সঠিক নির্দেশ আমি মানিনি, বন্ধুবান্ধব সান্নিধ্যে, একটা অদ্ভুত ছটফটানির মধ্যে মত্ত হয়ে ছিলুম। কিন্তু এই কি সেই সব ব্যাপার নিয়ে অনুশোচনার সময়? যদি কারুকে আনতেই হয়, রিনিকে নিয়ে এসো। আর কিছু না হোক, রিনির কণ্ঠস্বরই আমাকে সঞ্জীবনী শক্তি এনে দেবে।

—নীলু, আমি গগনদা, এসো, সঠিক পা ফেলে এগিয়ে এসো, আর বেশি দেরি নেই, তুমি পৌঁছে যাবে, সেতুর ওপারে কী বিশাল সম্ভাবনা যে অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য, তা তুমি জানো না। যারা আদর্শের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে, তারাই আসলে সব কিছু পায়।

ওঃ হো আমার নিজেরই অবচেতন, অথচ আমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। চাইলুম রিনিকে, নিয়ে এল গগনদাকে। ওগো প্রিয় অবচেতন, তুমিও কি ওই ছ’জন অপরাধ কর্মীর মতন মজা মারছ আমাকে নিয়ে? নইলে এখন গগনদাকে নিয়ে আসার কী মানে হয়? গগনদার মতন মানুষেরা চিরকালই এই রকম বড় বড় গালভরা বাণী দিয়ে যাবে। তা শুনে হয়তো দু’চারজন শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে মুক্তির দরজায়, আর বাকি যে কয়েকশো বা কয়েক হাজার টুপটাপ করে খসে পড়ে যাবে অতলে, তাদের হিসেব কে রাখবে? আমি ওই খসে পড়ার দলে। অথচ আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। সত্যি বলছি, মা কালীর দিব্যি, আমার ভীষণ বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। যারা নেমন্তন্ন বাড়ির বাইরে বসে এঁটো পাতা চাটে, আমি তাদের একজন হয়েও বেঁচে থাকতে চাই। আমি নদীতে আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হতে চাই না।

ডান পা, বাঁ পা, ডান পা, বাঁ পা, ডান পা, বাঁ পা! আমার অবচেতন নেই। এখন সমস্ত মন শুধু আমার পায়ে। আমার চোখ বাঁধা, মুখ বাঁধা, আমার হাত বাঁধা। শুধু পা দুটো খোলা। এই পা নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে। আমি পিছিয়ে যেতে পারব না। আমি থেমে থাকতে পারব না। ওরা রাইফেল উঁচিয়ে টর্চ ফেলে কি এখনও দেখছে আমাকে? আর কত দূর, কত দূর, কত দূর, আমি কতক্ষণ ধরে হাঁটছি।

কাছেই যেন গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সত্যি সত্যি মানুষের গলা, অবচেতন নয়, কল্পনা নয়, পিওর অ্যান্ড সিম্পল বাস্তব। আমি কি তাহলে পৌঁছে গেছি, বেঁচে গেছি। ব্রিজের এপারেও মানুষ আছে, তারা কথা বলছে। ভাগ্যিস ওরা আমার কানও বেঁধে দেয়নি। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

একজন বলল, বাক আপ! বাক আপ! এসে গেছে! এসে গেছে! আর কয়েক পা!

আর একজন বলল, মাই গড, সত্যি হারামজাদাটা পৌঁছে গেল?

আরও একজন বলল, ওয়ান ইজ টু ফোর। আমি বলেছিলুম না, প্রাণের টান বড় টান। এ শালা ঠিক পার হয়ে যাবে। আমার বাজির টাকা দিতে হবে কিন্তু।

আমি থমকে গেলুম। কণ্ঠস্বরগুলো আমার চেনা। এরাই ওপারে ছিল, এরাই আমাকে জোর করে ধরে এনেছে।

কাছাকাছি আরও কোনও সুবিধেজনক, নিরাপদ, সংক্ষিপ্ত সেতু আছে নিশ্চয়ই, তা দিয়ে ওরা পেরিয়ে এসেছে। সেই সব সেতুর সন্ধান, এমনকী এই অন্ধকার রাত্তিরেও ওরাই শুধু জেনে যায়। ওরা সব কিছু সহজে পায়।

ওদের একজন বলল, থামলি কেন রে। এবার জোর কদমে চলে আয়, আর কোনও ভয় নেই।

অন্য একজন বলল, এই লোকটা যে কামাল করবে, ভাবতেই পারিনি। একে একটা কিছু পুরস্কার টুরস্কার দেওয়া উচিত।

আর একজন বলল, নিশ্চয়ই, আমরা স্পোর্টসম্যানস স্পিরিট দেখাতে জানি। ও এপাশের মাটিতে পা দিলেই ওকে উইনার বলে ডিক্লেয়ার করব। ওরে, তুই কী চাস, দেড় বিঘে জমির ওপর বাড়ি, ফরেন ট্রিপ, ওষুধের এজেন্সি, রাস্তা তৈরির কন্ট্রাকটরি, কী চাস বল?

আমার পা দুটো ঠক ঠক করে কাঁপছে। ছেলেবেলায় একটা কথা শুনেছিলুম, খেজুর গাছের তিন হাত। সাধারণ লোকের পক্ষে খেজুর গাছ বেয়ে ওঠাই শক্ত, সবচেয়ে শক্ত শেষ তিন হাত ওঠা। তীরে এসে যেমন তরী ডোবে। আমি আর এগুতে পারছি না। না আর এক পা-ও বাড়ানো যাবে না।

আমার অবচেতন বললো, যাঃ, একী করছ মাইরি। এখানে সাঁকোর তলায় জল নেই, মাটি, তুমি এখন এক দৌড়ে পার হয়ে যেতে পারো।

আমি হেসে পেছন ফিরলুম।

ওপারে পৌঁছলেই লোকগুলো আমাকে কিছু পুরস্কার দেবে বলছে। এটা ওদের খেলা। সবাই বাঁচতে চায়, আমিও বাঁচতে চাই। কিন্তু বেঁচে থাকার মধ্যে একটা আত্মগরিমা থাকবে না? তা না হলে শুধু পোকা-মাকড়ের মতন…। শুধু একটা বাস্তব জীবন? কেউ সামনে একটা গাজরের টুকরো ঝুলিয়ে রাখবে, তাই দেখে ছুটে যাওয়া? আমাকে ওদের নিয়মে খেলতে হবে।

আমি উল্টো দিকে ফিরে পা বাড়াতেই এপারের লোকজন হইহই করে বলে উঠল, আরে আরে লোকটা পাগল হয়ে গেছে নাকি? ওরে গাধা, কোন দিকে যাচ্ছিস? এদিকে আয়, দৌড়ে আয়, তুই বেঁচে গেছিস…

আমার মুখ বন্ধ, তবু আমি বললুম, এবার শুরু হবে আমার নিজস্ব খেলা।

১৫.১১.১৯৮৭

লেখক পরিচিতি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪-এ ফরিদপুর জেলায় জন্ম। টিউশনি দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। ১৯৬৬-র শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। সনাতন পাঠক, নীললোহিত এবং নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামেও লেখেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯-এ আনন্দ পুরস্কার। ১৯৮৩-তে বঙ্কিম পুরস্কার, ১৯৮৫-তে অকাদেমি পুরস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *