“সাঁওতালি ভাষার মাণদণ্ডে সভ্যতার বিচার”
আমরা বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তাকে বলা হয় কমপিউটারের যুগ বা Age of Computer. ইতিমধ্যে মানুষ চাঁদে পাড়ি দিয়েছে, মঙ্গলগ্রহের রহস্য উন্মোচনের জন্য ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে দুদিন আগেও যেটা কল্পনা ছিল এখন সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছে কেবল তাই নয় তার সংজ্ঞাও পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু একদিনে তো মানুষ এখানে পৌঁছোয়নি। বহু বছরের সাধনায় একটু একটু করে একেকটা ধাপ ডিঙিয়ে সে আজকের অবস্থায় এসেছে। সাঁওতালরা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসী (Aboriginal) ভূমিপুত্ৰ কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। তারা তথাকথিত সভ্যদের কথায় Semi Savage অর্থাৎ অর্দ্ধ বর্বর। এটাই প্রচলিত ধারণা। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা বহিরাগত আর্যদের তৈরি করা। কথাটা কতদূর সত্য ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে তার বিচার করব। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস রচনার উপাদানের বড় অভাব। এ কথা ঐতিহাসিকরা তাঁদের রচনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক টড বলেছেন, “Much disappointment has been felt in Europe at the Sterility of the historical muse of Hindustan”. হিন্দুস্থানের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইউরোপীয়দের অনেক বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়েছে। ভারতে আগত বিখ্যাত মুসলমান পর্যটক আল বিরুণী বলেন, “হিন্দুরা ঐতিহাসিক রচনার প্রতি উদাসীন, এখানকার কালানুক্রমিক ইতিহাস সম্পর্কেও অজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য চাপ দিলে এরা কল্পনা ও কিংবদন্তীর আশ্রয় গ্রহণ করে”। ঐতিহাসিক ফ্লিট বলেছেন, হিন্দুরা ইতিহাস লিখতে জানত না এবং তাদের ঐতিহাসিক বোধও ছিল না। তারা ক্ষুদ্র ঐতিহাসিক আখ্যান রচনা করতে পারত মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গ্রন্থ নয়”। কিথ বলেন যে, প্রাচীন ভারতীয়দের সাহিত্যের অভাব ছিল না। কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাধান্যের যুগে ভারতের গ্রন্থকারদের মধ্যে কোনও একজনকেও যথার্থ ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করা যায় না” (তথ্য সূত্র অতুল কৃষ্ণ রায় এবং প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত—ভারতের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড)। ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ বা এহেন বিভ্রান্তির কারণ বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণকে অবলম্বন করে বা ভিত্তি করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা, যা কিনা আর্যদের রচনা বলে দাবী করা হয়। অথচ মজার কথা হল বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণে উল্লেখিত নদনদী, স্থান এবং প্রাচীনকালে অবস্থিত রাজন্যবর্গের নাম ইত্যাদি প্রায় সবই ভারতবর্ষের, রচয়িতার নিজের অতীত জীবন নিয়ে এই সব নিদর্শন কিছুই বলে না। ভারতের বাইরের কোনো কিছুরই আলোকপাত বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণ করে না। বাইরের যা কিছুর আলোচনা বা উল্লেখ প্রায় সবই অনুমানের উপর ভিত্তি করে রচিত। এই কারণে পুরাণ রচনার কাল নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো মতে এদের রচনা কাল খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে, কারো মতে খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে এগুলি রচিত। আবার ম্যাক্সমুলারের মতে এগুলো ১২০০-১০০০ অব্দের মধ্যে রচিত (তথ্য সূত্র, ঐ)। বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণ আর্যদের রচনা হলেও হতে পারে। তবে এগুলি যে আর্যদের ভারতে আগমনের অনেক পরে রচিত হয়েছে একথা হলপ করে বলা যায়। কারণ আর্যদের ভারতে আগমনের অব্যবহিত পরেই এগুলো রচিত হলে রচনার কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও থাকতে পারত। কিন্তু তাদের অতীত সম্বন্ধে অর্থাৎ তাদের আদি বাসস্থান সম্বন্ধে মতভেদ থাকার কথা নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে এ নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। একদল ঐতিহাসিকের মতে আর্যরা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ভারতবর্ষ থেকেই এরা পশ্চিম এশিয়ায় গিয়েছিলেন। এঁদের দলে আছেন এ, সি, দাস, পুসলকর এবং লক্ষ্মীধর শাস্ত্রীর মত ঐতিহাসিকরা। আবার অন্য দলের মতে আর্যরা বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। এঁদের দলে আছেন ম্যাক্সমুলার, ম্যাকডোনাল্ড, গিল এবং রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মত নামকরা ঐতিহাসিকরা। আমি আগেই বলেছি বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণ যার রচয়িতা আর্যরা বলে দাবী করা হয় সেই সব গ্রন্থে আর্যদের অতীত জীবন সম্বন্ধে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলে না। অন্যের রচনাকে নিজের বলে দাবী করা আর্যদের কাছে নতুন কিছু নয়। এরা চিরকাল অন্যের ন্যায্য অধিকারকে গায়ের জোরে অস্বীকার করে নিজের বলে দাবী করে এসেছে এবং এখনও করছে। একসময় ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করতেন বৈদিক সভ্যতাই হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা, কিন্তু ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দয়ারাম সাহানীর তৎপরতায় মহেঞ্জোদাড়ো এবং হরপ্পায় সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে সেই দাবী খারিজ হয়ে যায়। আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই যে, এখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এ কথা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই সভ্যতার রচয়িতা কারা? কারা এই সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন? নিঃসন্দেহে সাঁওতালরা। সাঁওতালদের ঐতিহ্য কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির নিরিখে বলা যায় সাঁওতালদের পূর্বপুরুষরাই এই সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। ঐতিহাসিকরা সোজাসুজি এই কথা স্বীকার না করলেও অস্বীকার করেন না অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথা তারা স্বীকার করে নিয়েছেন।
বেদ, উপনিষদ, পুরাণে উল্লেখিত ঘটনা, পর্বত গাত্রে এবং পাথরে উৎকীর্ণ শিলালিপি যদি প্রাচীন কালের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে গ্রহণীয় হয় তবে একটা জাতির জীবনশৈলী যেটা তার নিজস্ব, যেটা সম্পূর্ণভাবে অন্যের প্রভাব মক্ত সেটা কেন ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে গণ্য হবে না? প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি অতীত ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত এবং এখন সর্বজন গ্রাহ্য। সাঁওতালরা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসী। প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনার অসংখ্য উপাদান অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। তাহলে প্রাচীন ইতিহাস রচনায় এগুলো গ্রহণীয় হবে না কেন?
ভাষার মূল সম্পদ তার শব্দভাণ্ডার, একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই শব্দের একাধিক উৎস থাকে তাও বলা হয়েছে। যে কোনো ভাষায় কিছু কিছু শব্দ থাকে যেগুলি তার নিজস্ব আর কিছু থাকে ধার করা বা আগন্তুক— যেগুলি প্রয়োজনের তাগিদে আহৃত। সাঁওতালি ভাষায় বিদেশী শব্দ আছে। কিন্তু তার নিজস্ব বা মৌলিক শব্দ এত বেশি পরিমাণে আছে যে, যেগুলো দিয়ে অবলীলায় প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে, একদা সাঁওতালি সভ্যতা বেশ উন্নত ছিল। বৈদিক যুগের প্রথম দিকে সভ্যতার যে বিবরণ পাওয়া যায় তার অনুরূপ নিদর্শন সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম গুলিতে এখনো অবশিষ্ট আছে। বৈদিক যুগের সমাজব্যবস্থা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা তখন গড়ে ওঠেনি। সাঁওতালদের পূর্ব পুরুষরাই এই গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার গোড়া পত্তন করেছিলেন। গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল গ্রাম এবং যার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল জাহের। জাহেরকে বাদ দিয়ে সাঁওতালরা গ্রামের কথা চিন্তাই করতে পারে না। জাহেরের সঙ্গে সাঁওতালদের সম্পর্ক আবহমান কালের। গ্রামের উপকণ্ঠে জাহের এরার গোড়া পত্তন গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার জ্বলন্ত প্রমাণ।
গোষ্ঠীজীবনের পরবর্তী পর্যায়ে গ্রামকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, মানুষ যখন কৃষিকাজ করতে শিখল তখন সে যাযাবরের মত জীবনযাপন পরিত্যাগ করে এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল। এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অপরিহার্য বাড়ি-ঘর তৈরি করল। বাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ সে প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করল। সেই উপকরণ দিয়ে সে তৈরি করল বাড়ি-ঘর এবং তার নাম দিল ‘অড়াঃক’। এই অড়াঃক শব্দটাকে ভাঙ্গলে বা সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাই দুটো শব্দ অড়+আঃক। অড় বলতে বোঝায় উৎস আর আঃক বলতে বোঝায় ধনুক। আদি বাড়ি-ঘরের রহস্য এখানেই লুকিয়ে রয়েছে। ইদানীং সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে দুই প্রকারেব বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়, তাদের একটাকে বলে বাংলা অড়াঃক এবং অন্যটাকে বলে চাতম আড়াঃক। নামকরণ থেকেই মোটামুটি বুঝতে পারা যায় বাংলার প্রচলন ইদানীং কালের, যার সঙ্গে সাঁওতালদের পরিচয় ছিল না। তারা চাতম অর্থাৎ ছাতার মত দেখতে বা ধনুকাকৃতির সঙ্গেই পরিচিত ছিল। তার সমর্থনে আমি এখানে যে সব নিদর্শন পেশ করব সেটা যে অভ্রান্ত তা সাঁওতালদের যে কোন বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। দেওয়ালের ব্যবহার হয়েছে অনেক পরে। প্রথম দিকে বাড়ি- ঘর তৈরি হত খুঁটি পুঁতে। ধনুকাকৃতি বাড়ি-তৈরি করতেই কেবল এই দুটো খুঁটির প্রয়োজন, বাংলা বাড়ির জন্য নয়। দেওয়ালের প্রচলন হবার পর মাটিতে খুঁটি পোঁতার রেওয়াজ উঠে গেছে। এখন মাটির দেওয়ালে দুটো গর্ত করে সেখানে সাঁঘা বসিয়ে ধনুকাকৃতি বাড়ির জন্য প্রধান অবলম্বন তৈরি করা হয়। কিন্তু অতীতে তা হত না। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ছাতার মত দেখতে ধনুকাকৃতি বাড়িই প্রথমে তৈরি হয়েছিল। বাড়ি তৈরির যে সব উপকরণ লাগে সাঁওতালি ভাষায় তার আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন কাঠামো তৈরির জন্য লাগে সেনের, বাতা এবং ঘর ছাইবার জন্য খড় যাকে সাঁওতালি ভাষায় বুশুপ বলে। এইভাবে তৈরি হল বাড়ি ঘর এবং গড়ে উঠল গ্রাম। গ্রামের দুপাশে বাড়ি ঘরের মাঝখানে যাওয়া আসার রাস্তা সাঁওতালি ভাষায় যাকে বলে কুলহি। এই কুলহির সঙ্গে আবার নদনদীর কিছুটা সাদৃশ্য আছে। নদীর দুপাশে পাড় মাঝখানে জল প্রবাহিত হবার রাস্তা। এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই মনে হয় সাঁওতালদের পূর্ব পুরুষরা গ্রামের নামকরণ করেছিলেন আতু কারন। নদীর দু পাশের পাড়ের মাঝখান দিয়ে জলের স্রোত প্রবাহিত হওয়াকেও সাঁওতালি ভাষায় বলা হয় আতু। এতো গেল আতু আড়াঃক অর্থাৎ বাড়িঘর এবং গ্রামের কথা। কিন্তু ঘর গেরস্থালি করতে গেলে প্রয়োজনীয় উপকরণ লাগে। যেমন খাওয়া দাওয়া, রান্নাবান্না এবং হাত ধোওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। কাঁসা পেতলের ব্যবহার সাঁওতালদের কাছে অজানা ছিল বলেই মনে হয়, তবে বনের লতাপাতা দিয়ে তৈরি পাতড়া এবং ফুডঃক এর ব্যবহার সাঁওতালদের মধ্যে ছিল। পাতড়াকে দেখতে থালার মত এবং ফুডঃক দেখতে বাটির মত গোলাকার এবং কোনো কোনোটা চৌকোনা। এগুলি সরু সরু কাঠি দিয়ে পাতার সঙ্গে পাতা জোড়া দিয়ে তৈরি হয়। এগুলো ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ইদানীং শাল পাতার পুনঃপ্রচলন হয়েছে। কাঁসা পেতলের ব্যবহার না থাকলেও মাটির তৈরি হাঁড়ি কলসির ব্যবহার সাঁওতালদের মধ্যে ছিল। নীচে মাটির তৈরি দু একটা মৃৎপাত্রের নামের তালিকা দেওয়া হল :
(১) টুকুচ—মাটির তৈরি হাঁড়ি কলসি উভয়কেই বোঝায়।
(২) দাকা টুকুচ— ভাতের হাঁড়ি।
(৩) হাঁড়ি টুকুচ—হাঁড়িয়া ধরার জন্য বরাদ্দ মাটির তৈরি হাঁড়ি।
(৪) চেলাং—তরকারি রান্নার জন্য অবিকল কড়াই এর মত দেখতে মৃৎপাত্র।
(৫) কারাহি—ঐ
(৬) হাঁড়া——জল ধরার জন্য বড় হাঁড়ি।
(৭) কাঁড়া—জল বইবার জন্য মাটির হাঁড়ি।
(৮) ঠিলি—কলসী ইত্যাদি।
স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গেলে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন হয় ক্ষেত খামারের। নীচে ফসল ফলাবার জন্য তৈরি দু একটি খামারের নাম দেওয়া হল :
(১) বাড়গে—কাঁচা আনাজ, শাকসবজি এবং মরশুমি ফসল ফলাবার জন্য নির্ধারিত থাকে। এর আয়তন খুব বড় হয়। এর আবার রকমফের আছে। সীমানা দিয়ে তাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
(২) অড়াঃক বাড়গে—বাস্তু জমি। এর এক কোণে থাকে বাসা বাড়ি এবং রাচা বা উঠোন/আর সেই কারণেই এর নাম অডাঃক বাড়গে। এখানে উৎপাদিত হয় কাঁচা আনাজ এবং শাকসবজি।
বাড়গেয় উৎপাদিত কয়েকটি ফসলের নাম :
(১) জঁড়রা—ভুট্টা।
(২) রাহেড় অড়হর ডাল।
(৩) হড়েচ—এদের চাষ সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতেই সীমাবদ্ধ। স্থানীয় নাম কুড়থি ডাল।
(৪) রাঁবড়া—বিউলির ডাল।
(৫) তুড়ি সর্ষে।
(৬) গুঁজা—এদের চাষও সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতেই সীমাবদ্ধ। তেলের জন্যই এদের চাষ হয়।
(৭) আড়াঃক বা শাখ সবজি : শাক সবজির মধ্যে গাঁধারি কাস্থা, চাকণ্ডি ইত্যাদি।
(৮) মারিচ—লঙ্কা।
(৯) সুনুম— তেল।
(i) তুড়ি সুনুম—সর্ষে তেল।
(ii) গুঁজা সুনুম—গুঁজা তেল।
(iii) নিম সুনুম — নিম তেল।
(iv) কুঁইডি সনুম—মহুয়ার ফল থেকে তৈরি সুনুম।
(v) কুরুচ সুনম—করঞ্জা তেল।
(vi) জাডা সুনুম—জাড়া তেল, মালিশের জন্য ব্যবহৃত হয়।
(vii) বারু সুনুম—কুসুম ফল থেকে তৈরি করা তেল।
এ গুলোর মধ্যে তুড়ি এবং গুঁজাই খাওয়া এবং মাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাকিগুলো অন্য কাজে লাগে। এদের মধ্যে আবার বর্তমানে কেবল সরষের চাষ হয়, অন্য তেল এখন আর তৈরি হয় না। তেল তৈরির নিজস্ব পদ্ধতি আগে ছিল। কিন্তু বর্তমানে তার প্রচলন নাই। দু ফালি চ্যাপটা মোটা কাঠের মাঝখানে বীজ ফেলে তেল বার করা হত। তেল নিষ্কাশনের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে পুরোনো বিদায় নিয়েছে। জাডা বা জাড়া ইদানীং আর দেখা যায় না। অতীতে এক সময় গ্রামে গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে জাডা দারে বা জাড়া গাছ দেখা যেত। এর ফল নিংড়ে তেল বার করা হত। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে জাড়া তেল দিয়ে মালিশ করলে ক্লান্তি মুহূর্তেই উধাও হয়ে যেত।
ভুট্টার প্রচলন সাঁওতালদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ছিল। কোথাও কোথাও এখনও আছে। ছোটনাগপুর মালভূমি ভুট্টা চাষের পক্ষে উপযোগী। ভুট্টাকে যেমন পুড়িয়ে খাওয়ার রেওয়াজ আছে অন্যদিকে আবার ভুট্টা প্রধান খাদ্য হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভুট্টা চাষের জমিকে প্রথমে লাঙ্গল দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। জমিতে দু তিনবার লাঙ্গল দেওয়ার পর জমি উপযুক্ত হয়ে গেলে পাত্রে (টুপলাঃক) করে ভুট্টার বীজ এনে লাঙ্গল দেওয়া মাটির পেছন পেছন হেঁটে একটা করে ভুট্টার দানা ফেলে দিতে হয়, সেই বীজ লাঙ্গল দিয়ে চাপা দেওয়া হয়ে গেলে পুনরায় দানা ফেলতে হয়। এই ভাবে দানা ফেলার একটাই কারণ যাতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব বজায় থাকে এবং যাতে সেই বীজ বেড়ে উঠবার জন্য মাটি থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে পারে। ভুট্টার বীজ বোনা হয়ে গেলে মাটিতে মই দিয়ে বীজ চাপা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়। ভুট্টার বীজ ফেলার আগে বেশ কিছুক্ষণ জলে ভিজিয়ে রাখতে হয় ফলে কয়েকদিনের ব্যবধানেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা বেরিয়ে আসে। চারা একটু বড় হলে কোদাল দিয়ে গাছের গোড়ার মাটিকে আলগা করে দিতে হয়। সাঁওতালি ভাষায় তাকে বলে ‘পু’ স্থানীয় কথ্য ভাষায় কড় দেওয়া। ভুট্টা গাছ যাতে লম্বা এবং ফলন ভাল হয় তাই দু বার কড় বা ‘পু’র নিয়ম আছে। যাদের জমি কম তারা নিজেরাই কড় দেয় কিন্তু যাদের জমি বেশি তারা গ্রামের দু পাঁচ জনকে কড় দেওয়ার জন্য ডাকে। আগে তাদের কেবল খাবার এবং যাই হউক একটা কিছু দিলেই হত কিন্তু এখন খাওয়া ছাড়াও নগদে কিছু দিতে হয়। এইভাবে অল্পদিনের ব্যবধানেই ভুট্টার গাছ বড় হয় এবং ফলন ধরে। গাছে সাধারণত একটাই ফল ধরে তবে কোনও কোনও গাছে দুটোও ফল ধরতে দেখা যায়। ফলগুলি যখন ডাঁসা হয় তখন গাছ থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে খেলে প্রচণ্ড সুস্বাদু লাগে। সাঁওতালি ভাষায় তাকে বলে গাদার জঁড়রা। ভুট্টা তিন মাসের ফসল। ভাদ্র মাসের শেষ দিকে ভুট্টার ফল ঝুনোয় রূপান্তরিত হয় তখন ফল গুলিকে তুলে একটার সঙ্গে আর একটাকে বেঁধে মালার (গালাং) মত তৈরি করে ঘরের কড়ি কাঠে কিছুদিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে হয়। পরে তাদের মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে আঘাত করে করে বীজ আলাদা করা হয়। তার থেকে ভুট্টা বীজ আলাদা করে অবশিষ্ট ভুট্টা রাহা খরচের জন্য বরাদ্দ করা হয়। শুকনো ফলকেও পুড়িয়ে খাওয়া হয় বটে তবে শুকনো ফল গাদার বা ডাঁসার মত সুস্বাদু হয় না। এ ছাড়াও আর যেভাবে খাওয়া হয় সেগুলি হল আতা জঁড়রা বা ভুট্টা ভাজা এবং দাঃক মাড়ি বা মাড় ভাত। মাড় ভাতের জন্য ঢেঁকিতে ছেঁটে দানাকে দু ফালি করা হয় আবার ঘেঁট বা পায়েসের জন্য দানাকে সম্পূর্ণ গুঁড়ো করা হয়। সাঁওতালি ভাষায় তাকে লেট বলে। এ ছাড়াও ভাজা ভুট্টাকে ঢেঁকিতে ছেঁটে সম্পূর্ণ রূপে গুঁড়ো করে তার সঙ্গে পরিমাণ মত গুড় মিশিয়ে ডুবুঃক বা মিঠাই বানিয়ে খাওয়া হয়। ভুট্টার গুঁড়িকে সাঁওতালি ভাষায় লুবুঃক বলে।
ভাত পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত হত বকাঃক অর্থাৎ হাতা। এটা তৈরি হত সাধের লাউ দিয়ে। তার জন্য লাউকে না তুলে লতায় রেখে শুকানো হত এবং প্রয়োজনের সময় দুভাগ করে পরিবেশনের জন্য হাতার আকার দেওয়া হত। ১৫/২০ বছর আগেও এদের বেশ ব্যবহার ছিল কিন্তু বর্তমানে নেই বললেই চলে। পরবর্তীকালে ধাতুর ব্যবহার শুরু হলেও এদের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয় নি। এসব হাতা তৈরির জন্য আলাদা একটা সম্প্রদায় ছিল যাদের বলা হত মালোওয়ার। আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও এই মালোওয়ারদের আমি গ্রামে এসে ধাতুর জিনিষ তৈরি করতে দেখেছি। কিন্তু বর্তমানে তাদের আর দেখা যায় না।
বাড়গে বা বাস্তু জমিতে ধান উৎপাদিত হয় না, ধান উৎপাদনের জন্য আলাদা জমির দরকার হয়। তার গঠনও আলাদা। বর্তমানে অবশ্য ফাঁকা মাঠে বোরো ধানের চাষ হলেও আমন চাষের জন্য জমির চারপাশে উঁচু উঁচু আল বা আড়ে দিয়ে জল ধরার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ আমনের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে জলের প্রয়োজন হয় আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে জল ছেড়ে দেওয়া হয়। সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে দু ধরনের জমি দেখতে পাওয়া যায় তার একটাকে বলে বাইদ অর্থাৎ ডাঙ্গা জমি এবং অন্যটাকে বলে বাইহাড় অর্থাৎ জলাজমি। সাঁওতালদের অধিকৃত জমির মধ্যে বাইহাড়ের পরিমাণ অত্যল্প কারণ অতীতে অতি বর্ষণের ফলে জলা জমিতে ফসল ভালো হত না। ধানে পোকা লাগত। রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই জলা জমির তুলনায় ডাঙ্গা জমিকেই তারা বেশি পছন্দ করত। ইদানীং বর্ষার অভাবে ডাঙ্গা জমিতে আর আগের মত ফসল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কৃষিজীবি হয়েও তারা চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি।
চারা বা ইতা হুডু ফেলার জন্যে জমিতে আলাদা জায়গা নির্ধারিত থাকে। চারার জন্য সম্বৎসরের খরচ থেকেই বীজ ধান বা ইতাহুডু আলাদা করে সরিয়ে রাখা হয়। উপযুক্ত সময় হলে নির্ধারিত জায়গার মাটিকে লাঙ্গল দিয়ে মাটিকে চারা গজাবার উপযুক্ত করা হত। সার হিসেবে বাড়িতেই উৎপাদিত গোবর ব্যবহৃত হয়। লাঙ্গল দিয়ে মাটি তৈরি হয়ে গেলেই তার উপরে গোবর ছড়িয়ে ইতা হুডু বা বীজ ধান বুনে মই দিয়ে বীজ ধান চাপা দেওয়া হয় যাতে পশুপক্ষী বীজ ধান খেয়ে নষ্ট না করতে পারে। তারপর বৃষ্টির জল পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ধানের বীজ থেকে চারা গাছ জন্মায়, চারা একটু বড় হলেই লাঙ্গল দিয়ে মাটিকে ধান রোপণের উপযুক্ত করতে হয়। বীজতলা থেকে ধানের চারা তুলে আঁটি বেঁধে রোপণের আগে পর্যন্ত বীজতলায় ফেলে রাখা হয়। ধানের চারা লাগাবার জমি একদিনে তৈরি হয় না। পর পর দু তিন দিন মাটিতে লাঙ্গল দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। প্রথম দিন জমিকে ‘জাভড়’ দিয়ে রেখে পরদিন পুনরায় লাঙ্গল দিতে হয়। জমি পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে মাটিতে ধানের চারা পুঁতে দিতে হয়। বৃষ্টির জল পেয়ে চারা গাছ লম্বা হতে থাকে। ক্রমে ধানের চারায় শিস দেখা দেয়। এই শিসকে সাঁওতালি ভাষায় বলে ‘গেলে’। বাইদ বা ডাঙ্গা জমির ধান তিন মাসের মধ্যে পেকে যায়, কিন্তু বাইহাড় বা জলা জমির ধান পাকতে একটু বেশি সময় লাগে। ডাঙ্গা জমির ধান সাঁওতালদের বড় উৎসব সহরায় এর আগেই ধান ঝাড়ার জন্য নির্মিত খারাই বা খোলায় তুলে ধান ঝেড়ে প্রথমে ধানকে হাঁড়িতে জল ঢেলে সেদ্ধ করা হয়। তারপর পুনরায় তাকে রোদে শুকাতে হয়। পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে ঢেঁকিতে ছাঁটা হয়, তাকেই ঢেঁকি ছাঁটা চাল বলে। সেই ঢেঁকি ছাঁটা নতুন চাল দিয়ে ভাত রান্না হয় বটে তবে সেই নতুন চালের ভাত সাঁওতাল নিজে খায় না, সেই ভাতের সঙ্গে রানু মিশিয়ে হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া তৈরি করে এবং তাদের প্রধান উৎসব সহরায়ের আয়োজন করে। নতুন চালের ভাত দিয়ে তৈরি করা হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া মারাং বুরুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে পাঁচ দিনের উৎসব সহরায়ের মধ্যে দিয়ে কৃষি কাজে নিযুক্ত হালের (বলদ) গরু এবং মহিষের কৃষি কাজে অপরিসীম অবদানের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করে।…তবে এখানে বলে রাখা ভাল সাঁওতালদের কাছে সহরায় মাত্র পাঁচদিনের উৎসব নয়, তার পেছনে থাকে তাদের বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতি। কার্তিক মাসের আমাবস্যা তিথিতে পাঁচদিনের উৎসব সহরায় শুরু হলেও বর্ষা ঋতুর অবসানে আশ্বিনের শুরু থেকেই সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলের আকাশে বাতাসে সহরায়ের সুর এবং বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়। সহরায়, সারি সহরায় এবং জম সহরায় নামে পরিচিত হলেও যেহেতু তারা কৃষিজীবি, কৃষিই তাদের প্রধান উপজীবিকা, তাই কৃষি কাজে গরু এবং মহিষের অপরিসীম অবদানের কথা স্মরণ করে তার বন্দনা করা হয়। পাঁচদিন ধরে তার বাসস্থান অর্থাৎ গোয়াল ঘর সরষের তেল দিয়ে আলোয় আলোকিত করে তোলা হয়। তার ঢুকবার রাস্তায় গোবর দেওয়া হয়। চালের গুঁড়ি জলে গুলে গোবর দেওয়া রাস্তায় নকসা বা আলপনা আঁকা হয়। গোয়াল ঘরে গোয়াল পূজা করা হয়। কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জল দিয়ে ধুয়ে এক জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়। সর্বশেষ ধানের শিস দিয়ে তৈরি ধাঁওয়া ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাই দিয়ে তাকেও সজ্জিত করা হয়। কপালের দুপাশে সিং দুটোয় দুটো ধাঁওয়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যারা তাদের সম্বৎসরের খোরাক যোগায় তাদের কথা স্মরণ করেই এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত কয়েকটি যন্ত্রপাতির নাম। কৃষিকাজের জন্য প্রথমেই লাগে লাঙ্গল এবং হালের গরু।
(১) নাহেল : লাঙ্গল। লাঙ্গল তৈরি করতে সাঁওতালরা ওস্তাদ। এক টুকরো বড় গুঁড়ি কেটে কেটে লাঙ্গলের আকার দেওয়া হয়। তাতে দু, দুটো ফুটো থাকে অন্য দুটো কাঠ লাগাবার জন্য। এই দুটোর একটাকে বলে কাঁড়বা যেটা লাঙ্গল চালাবার সময় বাঁ হাতে চেপে ধরতে হয় এবং ডান হাত দিয়ে লাঙ্গলে জোতা গরুকে লাঠি দিয়ে সঠিক ভাবে পরিচালনা করা হয়। অন্যটাকে বলা হয় ইসি। ইসি হিসেবে ব্যবহৃত কাঠকে অবশ্যই একটু লম্বা এবং সোজা হতে হয়। এর একাপ্রান্তে তিনটে খাঁজ কাটা থাকে এবং ইসির অপর প্রান্ত রুকা (বাটালি) দিয়ে চেঁচে ছোট একটা গর্ত করা হয়। চাঁচা অংশ লাঙ্গলের গর্তে পুরে দিয়ে ইসির গর্ত একটুকরো ছোট কাঠ দিয়ে আটকে দিতে হয় যাতে লাঙ্গল দেওয়ার সময় সেটা খুলে না যায়। ইসির অপর প্রান্তে যেখানে তিনটে খাঁজ কাটা থাকে সেখানে (সাঁওতালি ভাষায় জোয়ালকে আঁড়ার বলে) জোয়াল লাগিয়ে গরুর কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে জমিতে লাঙ্গল দিতে হয়। ইতিমধ্যে Tractor, Power Tiller আবিষ্কৃত হলেও লাঙ্গলের ব্যবহার লুপ্ত হয়ে যায়নি, এখনো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয়নি।
সংরক্ষণের সুবাদে ইদানীং দু একজন চাকরি বাকরি করলেও কৃষির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আবহমান কালের। এরা মূলতঃ কৃষিজীবি। কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ঘর গেরস্থালির প্রয়োজনীয় উপকরণ এরা আবহমান কাল থেকেই তৈরি করে আসছে। হিন্দুদের মত এদের মধ্যে বর্ণভেদ ছিল না। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এরা নিজেরাই করে। বনের বন্য পশুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করে কৃষিকাজের উপযোগী করে তুলেছে এবং সেগুলিকে রাখার জন্য ঘরের মধ্যে পৃথক গড়া অড়াঃক বা গোয়াল ঘরের ব্যবস্থা করেছে। পি. সি. রায় চৌধুরির নিম্নলিখিত মন্তব্য এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :-
‘The Santals have a numbar of other hunting implements, fishing nets etc., all of which go to show that they studied the nature and habits of wild animals, birds and so forth, and have fashioned their implements accordingly.’ (Bihar district Gazetteers Santal Pargana — P. c. Roy Choudhury, পৃষ্ঠা-৮৬৮)
অর্থাৎ, শিকারের জন্য উপযুক্ত যন্ত্রপাতি, মাছ ধরার জন্য জাল, বনের পশু পাখি এবং অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রত্যক্ষ করলে মনে হয় সাঁওতালরা প্রকৃতিকে নিঁখুতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই তৈরি করেছে। নীচে কয়েকটি গৃহ পালিত পশুর নাম দেওয়া হল :
(১) ডাংরা—বলদ গরু, যাদের দিয়ে কৃষি কাজ হয়।
(২) দামকম—পুরুষ গরু কিন্তু কৃষি কাজের উপযুক্ত হয়নি। জোয়াল তখনও কাঁধে পড়েনি।
(৩) গাই ডংরি—গাই গরু যে এক বা একাধিক বাচ্চা দিয়েছে।
(৪) পেঁঠাড় : স্ত্রী গরু কিন্তু বাচ্চা দেয়নি।
(৫) মিহু—বাছুর।
(৬) উরিচ— গাই গরু এবং বলদ গরু উভয়কেই বোঝায়।
(৭) কাডা–পুরুষ মোষ। কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। পুরুষ মোষের লাঙ্গলকে কাডা নাহেল এবং গরুর লাঙ্গলকে ডাংরি নাহেল বলে।
(৮) বিতকিল—স্ত্রী মোষ।
(৯) তওয়া—দুধ।
(১০) দাহে―দই।
(১১) গুরিচ— গোবর। কৃষিকাজে সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জমিতে এক বছর গোবর সার হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার কার্যকারিতা তিন বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। গোয়ালঘর থেকে গোবর তুলে ফেলার জন্য বাড়ির কাছাকাছি গর্ত করা হয়, যাকে গুরিচ গাড়া বলে। এ ছাড়াও গো চারণের ভূমি থেকে গোবর সংগ্রহ করে গোবর ফেলার গর্তে ফেলা হয়। ইদানীং কৃষি কাজে রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হবার ফলে কৃষকের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। এ সব ব্যবহারের ফলে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেলেও জমির উরবতা নষ্ট হয়ে গেছে, ভাতের স্বাদও পাল্টে গেছে। এতদিন পর্যন্ত যারা কৃষকের বন্ধু বলে পরিচিত হয়ে এসেছে, যারা এতদিন ধরে কৃষকের উপকার করে এসেছে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে তাদের বংশধররাও প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে।
(১২) মেরম—ছাগল
(১৩) মেরম হপন—ছাগল ছানা।
(১৪) ভেডা—ভেড়ি।
(১৫) ভেডি— স্ত্রী ভেড়ি।
(১৬) শুকরি—শুয়োর।
(১৭) কুডু— শুয়োর ছানা।
(১৮) ঢঙ্গা—শুয়োরের খাবার জায়গা।
(১৯) সিম–মোরগ এবং মুরগী উভয়েই।
(২০) সাঁড়ি— মোরগ।
(২১) এঙ্গা—মুরগী।
(২২) মুরগীর বাচ্চা — সিমহপন।
(২৩) গেড়ে— হাঁস।
(২৪) গেড়ে এঙ্গা — হংসী।
(২৫) গেড়ে আঁডিয়া — হংস।
(২৬) গেডে হপন—বাচ্চা হাঁস।
(২৭) গুডু—ইঁদুর।
(২৮) চুটিয়া—নেংটি ইঁদুর।
(২৯) রেকটে— মেঠো ইঁদুর।
(৩০) পুষি—বেড়াল।
(৩১) পুষিহপন—বেড়াল ছানা।
(৩২) সেতা হপন—কুকুর ছানা।
কুকুরের প্রভুভক্তি সাঁওতালদের কাছে অজানা ছিল না। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য তাদের কাছেও কুকুর পোষার রেওয়াজ আবহমান কাল থেকেই প্রচলিত। বাংলায় বসার (Sit) প্রকার ভেদ না থাকলেও সাঁওতালি ভাষায় আছে। মানুষের বেলায় ‘দুডুপ’ ব্যবহৃত হলেও চতুষ্পদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘বুরুম’ আবার পাখীর বেলায় বলতে হয় ‘আফ’ আকানায়। এইভাবে বসার রকমফের শব্দ ব্যবহার করে প্রাণীবাচক প্রজাতির মধ্যে সহজেই পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। ধানের চাষ যে সাঁওতালিদের মধ্যে অজানা ছিল না উপরোক্ত আলোচনা থেকে তা সহজেই অনুমেয়। ধানকে সাঁওতালি ভাষায় বলে হুডু। বীজ ধানকে বলে ইতা হুডু। এই বীজ ধান সম্বৎসরের খাবার থেকে আলাদা করে পটম বা বাঁদি করে রাখা হয়। প্রথমে ধান কেটে এক জায়গায় এক সঙ্গে একটু একটু করে জড়ো করা হয়। ধান কাটা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে জড়ো করা ধানের আঁটি বাঁধা হয়। এই আঁটি নির্ভর করে ধানের ফলনের উপর। যে সব ধানের ফলন ভাল খড় একটু লম্বা হয় তাদের আঁটি ছোট হয় কিন্তু যাদের ফলন ভালো নয় এবং খড় লম্বায় কম তাদের আঁটি বড় হয়। সাঁওতালি ভাষায় এদের আলাদা নাম আছে। প্রথমোক্তকে বলে ‘লট’ কিন্তু দ্বিতোয়োক্তকে বলে ‘বিডা’। আঁটি বাঁধা হয়ে গেলে সাগাড় গাড়ীতে অথবা মাথায় করে ধান ঝাড়ার জন্য নির্মিত খোলা, সাঁওতালি ভাষায় যাকে ‘খারাই’ বলে, এনে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয়। সাঁওতালি ভাষায় যাকে বলে ‘লট চাকে’। তারপরে ধান ঝেড়ে একত্রিত করা হয়। তারপর সেখান থেকে রাহা খরচের জন্য কিছু ধান সরিয়ে রেখে বাকিটা সংরক্ষণ করা হয়, এবং সংরক্ষণের জন্য উপকরণ খড় থেকেই তৈরি করা হয় এবং প্রয়োজন মত তা থেকে একটু একটু করে বার করে ঢেঁকিতে ছেঁটে ধান থেকে চাল করা হয়। বাংলার তুসকে সাঁওতালি ভাষায় বলে হেড়ে এবং চালকে বলে চাওলে। এখানে লক্ষণীয় যে তুষকে সাঁওতালি ভাষায় হেড়ে বললেও তুষের আগুনকে কিন্তু হেড়ে সেঙ্গেল বলে না বলে বুরসী সেঙ্গেল। তুষের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে এবং অনেকক্ষণ স্থায়ী হয় বলে সাহিত্যের (Phrase হিসেবে) পাশাপাশি শীতের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য একসময় সাঁওতালদের মধ্যে বুরসি সেঙ্গেলের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কোথাও কোথাও তুষের আগুন বা বুরসি সেঙ্গেলের প্রচলন এখনো আছে। বুরসি সেঙ্গেল ছাড়াও তুষ বা হেড়ে সাঁওতালরা মাটির দেওয়াল লেপার কাজে ব্যবহার করে। এছাড়াও ধানের আর একটা By Product সেটা সাঁওতালরা নিজেরা নয় তাদের গৃহপালিত পশু শুকরি বা শুয়োরকে খাওয়ায় তার নাম ‘লুবুঃক’। নীচে চাল এবং চাল থেকে তৈরি কয়েকটি খাদ্য দ্রব্যের নাম দেওয়া হল :
(১) চাওলে— চাল।
(২) দাকা—বলতে কেবল চালের ভাতকেই বোঝায়।
(৩) দাঃকমাডি— চালের মাড়ভাত। সাঁওতালদের মধ্যে এর বেশ প্রচলন আছে।
(৪) খাজাড়ি— ভুট্টা ভাজাকে জঁড়রা আতা বললেও চাল ভাজাকে চাওলে আতা বলে না, বলে খাজাড়ি। বাংলায় যাকে বলে মুড়ি সাঁওতালি ভাষায় তাকেই বলে খাজাড়ি।
(৫) হলং-চালের গুড়ি। এই গুঁড়ি থেকেই বিভিন্ন রকমের পিঠে তৈরি হয়।
(৬) হাঁড়ি-চাল থেকে ভাত তৈরি হয়। সেই ভাত দাউড়ায় (বেতের তৈরি এক রকমের বড় পাত্র বিশেষ) ছড়িয়ে একটু ঠাণ্ডা করে তার মধ্যে রানু (রোন থেকেই এসেছে, রানু, রান মানে ঔষধ), স্থানীয় কথ্য ভাষায় যাকে বাকর বলে, ছড়িয়ে মাটির হাঁড়িতে তুলে রাখতে হয়। তিন, চার দিন পরে ভাত হাঁড়ি বা হাঁড়িয়ায় রূপান্তরিত হয়। এই হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া সাঁওতাল মারাং বুরুর উদ্দেশ্যে প্রথমে উৎসর্গ করে পালা পার্বণে নিজেও পান করে। হাঁড়িয়া ছাড়া মারাং বুরু সন্তুষ্ট হয় না। সাঁওতালরা যে কৃষিজীবী, আদিকাল থেকে তারা যে কৃষিকাজ করে আসছে এটাই তার জ্বলন্ত উদাহরণ। হাঁড়ি বা হাঁড়িয়া দু রকমের হয়। একটাকে বলে তাং হাঁড়ি এবং অপরটাকে বলে বডচ হাঁড়ি। হাঁড়িয়া স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তো করেই না বরং উপকারে লাগে।
সাঁওতালি ভাষা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। নীচে তাদের কয়েকটির কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হল। সাঁওতালি ভাষায় জলকে বলে দাঃক আর আনাকে বলে আগু। বাংলায় বলে ‘জল আনতে গেছে’ সাঁওতালি ভাষায় কিন্তু তা বলে না বলে ‘দাঃক লুয়’ চালাও আকানা অর্থাৎ জল আনতে গেছে। কুয়ো থেকে জল আনাকে বলে “দাঃকলু’ কিন্তু বাড়ি আনা জলকে আনতে বললে বলে ‘দাঃক আগুয় মে’। আবার জল খাওয়াকে বলে দাঃক ঞ কিন্তু মাড়ভাত খাওয়াকে ‘ঞ’ বলে না বলে ‘জেঁবেদ মে’।
(১) তিঞ—-পাথর ছোঁড়া।
(২) চাপাদ—ঢিল অথবা লাঠি ছোঁড়া।
(৩) লেবদা—ঐ
(৪) তুঞ—তীর ছোঁড়া যেমন বেঝা তুঞ বলতে লক্ষ্য বস্তুর উপর তীর নিক্ষেপ বোঝায়।
(৫) টুটি—ধনুকে ছুঁড়বার এক রকমের অস্ত্র অথবা বন্ধুককে গুলি ছোঁড়াকে বোঝায়।
(৬) জম—খাওয়া যেমন ভাত খাওয়া। তরকারি খাওয়া ইত্যাদি।
(৭) সিৎ, সিদ—শাক তোলা, ফুল তোলা ইত্যাদি।
(৮) হেএচ পাতা তোলা।
(৯) গৎ—বেগুন, টম্যাটো তোলা।
(১০) তিয়োঃক—উপর থেকে কিছু তোলা বা পাড়া।
(১১) হালাং—মাটিতে পড়ে থাকা যা কিছু তুলতে হালাং ব্যবহৃত হয়।
(১২) হৎ—তাড়াতাড়ি একসঙ্গে অনেকগুলি তোলাকে বলে হৃদমে। আবার অনেক সময় তাড়াতাড়ি হাঁটতে বললেও বলে, তাড়াম হৃদমে
(১৩) উঞ—দড়ি পাকানো, খড় দিয়ে তৈরি বড় শিকল ইত্যাদি পাকানোকে উঞ বলে।
(১৪) গালাং-মালা গাথাকে গালাং বলে।
(১৫) গুতু— ফলে দড়ি পরানো, অথবা সরু কিছু দিয়ে গায়ে আঘাত করাকে গুতু বলে।
(১৬) লাড়গা—পাকা ফল অথবা মাছকে একের পরে এক মালার মত গাঁথাকে লাড়গা বলে।
(১৭) পাটি— সরু কাঠি দিয়ে একটার পর একটা পাতা জোড়া দেওয়া অথবা গয়না পরার জন্য নাক অথবা কান ফুটো করা বোঝায়।
(১৮) রঃক—কাঁথা সেলাই অথবা ছুঁচ দিয়ে কোনো কিছু সেলাই করা বোঝায়।
(১৯) তুড়—গায়ে হুল ফোটানোকে বলে তুড় কিদিঞায়।
(২০) হুডুং—ঢেঁকিতে ধান ভানাকে বলে হুড়ং।
(২১) লাহুৎ—ঢেঁকিতে সম্পূর্ণ গুঁড়ো করাকে বলে লাহুৎ।
(২২) সবঃক— লাঠি সোঁটা দিয়ে খোঁচা মারা বোঝায়।
(২৩) তুপুৎ—মোরগের লড়াই। মোরগ অথবা মুরগী যখন মানুষকে ঠোঁট দিয়ে কামড়ায় তখন বলে ‘তুৎ’ কিদিজ্ঞায়।
(২৪) রপঃক— গরুর সঙ্গে গরুর অথবা মোষের সঙ্গে মোষের লড়াই বোঝায়। এবং সিং দিয়ে মারার জন্য যখন মানুষের দিকে তেড়ে আসে তখন বলে ‘ররঃক কানায়।’
(২৫) তাহুড়— শুয়োরের সঙ্গে শুয়োরের লড়াই। অনুরূপভাবে দাঁত বার করে মানুষের দিকে তেড়ে এলে বলে ‘তাহুড় ইঞ লাগিৎ এ।’
(২৬) চাটিচ—দেওয়াল থেকে মাটি সিমেন্ট ইত্যাদি খসে পড়াকে বলে ‘চাটিচ।’
(২৭) ধাসুড়— জলের তোড়ে খামারের আল অথবা বাঁধের আল ধসে পড়লে বলে ধাসুড়। পোড়াবাড়ির দেওয়ালের কিয়দংশ ধসে পড়াকেও বলে ধাড়।
(২৮) ফুড়—নিজেরাই যখন জল বেরিয়ে যাবার রাস্তা করা হয় তাকে ‘ফুড়’ বলে।
(২৯) গাডলাঃক গর্ত।
(৩০) ভুগাঃক—ইঁদুরের গর্ত অথবা ইঁদুরের অনুরূপ যে কোন গর্ত।
(৩১) হেতেল—ইঁদুর যখন গর্ত বানায়। গর্ত থেকে মাটি তুলে বার করে তাকে বলে ‘হেতেল আকাদায়।’
(৩২) তুকা—পাখি অথবা ইঁদুর যখন বাসা বানাবার জন্য খড় কুটো জড়ো করে তাকে বলে “তুকা।’
(৩৩) তেঞ—দড়ি দিয়ে খাট বোনা অথবা জাল বোনাকে বলে ‘তেঞ।’
(৩৪) গাঃক—মাকড়ার জাল বোনাকে বলে ‘গাঃক আকাদায়।’
(৩৫) দাপ—বাড়ির ছাউনি তৈরি করাকে বলে ‘দাপ আকাদায়।’
(৩৬) গেৎ—কুটি কুটি করে কাটা।
(৩৭) মাঃক—কুড়াল দিয়ে কাটা।
(৩৮) রাপুৎ-নিজে থেকেই ভেঙ্গে যাওয়াকে রাপদ বলে।
(৩৯) তপাঃক— দড়ি ছিঁড়ে যাওয়াকে বলে তপাঃক।
(৪০) অড়েচ— গাছের পাতা অথবা বইএর পাতা ছিঁড়ে যাওয়াকে বলে অড়েঃচ।
(৪১) চির—কাপড় ছেঁড়াকে বলে চির।
(৪২) রচৎ—চটকে যাওয়া কিন্তু টুকরো লেগে থাকাকে বলে রচৎ।
(৪৩) আতিঞ–গরু মোষ মাঠে চরানো অথবা বলি দেবার উদ্দেশে! যখন মুরগীকে চরানো হয়।
(৪৪) উড়াও—পাখি উড়ে যাওয়াকে বলে ‘উড়াও এনায়।’
(৪৫) অটাং—কোনো কিছু হাওয়ায় উড়ে যাওয়াকে বলে আটাং।
(৪৬) উডার—রাখাল বালকেরা গো চারণের জন্য গরুর পাল মাঠে নিয়ে যায়। কিন্তু খাবার সময় তারা গরুর পাল মাঠের এক জায়গায় জড়ো করে পালা করে বাড়িতে খেতে আসে। খাওয়া হয়ে গেলে পুনরায় গো চারণের জন্য গরুর পাল উঠিয়ে নিয়ে যায় তাকে বলে উডার।
(৪৭) ডিগলাউ—ধুলো উড়িয়ে আনাকে বলে ডিগলাউ।
(৪৮) গাউয়িচ— হাত দিয়ে ইশারা করা।
(৪৯) গাদুচ— গায়ে হাত দিয়ে ডাকা এবং গর্ত থেকে মাটি তোলা।
(৫০) গেএচ— হাতের নিম্নাংশ দিয়ে চাঁচা।
(৫১) ঢাপৎ—সাময়িক চাপা দেওয়া।
(৫২) তপা—কবর দেওয়া।
(৫৩) এসেৎ—গর্ত অথবা অনুরূপ কিছু আটকাতে এসেদ/এসেৎ।
(৫৪) চুটা–ঐ
(৫৫) এর এনা এবং জরয়েনা—সাধারণ ভাবে পড়ে যাওয়াকে বলে এর এনা কিন্তু যখন সেটা নিরবিচ্ছিন্ন হয় তখন বলে জরয়েনা।
(৫৬) গিতিচ—শোওয়া।
(৫৭) তিচ—লম্বালম্বি পড়ে থাকা
(৫৮) গের—দাঁত দিয়ে কাটা।
(৫৯) পহাঃক—ঐ
(৬০) কুচিৎ–সংকীর্ণ রাচা কুচিৎ এনা, হড়বন সাঁগেয়েনা তুমদাঃক আচুরবেন বাঁওয়ালিতে (দঙ)
(৬১) চিরেৎ—ভিড় ঠেলে অথবা সংকীর্ণ স্থানে প্রবেশ করতে গেলে চিরেৎ ব্যবহৃত হয়।
(৬২) কুটাম—কুড়ুল দিয়ে আঘাত করা।
(৬৩) কটেচ— হাতুড়ি দিয়ে পাথর অথবা ঢিল মারা।
(৬৪) চেপেজ/চপজ~~ চোষা
(৬৫) চাবা—ফুরিয়ে যাওয়া।
(৬৬) মুচাৎ—সমাপ্ত
(৬৭) কাডা/এহের জিকি—হামাগুড়ি দেওয়াকে কাডা বলে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক কেউ যখন নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে থাকে তখন বিদ্রুপ করে বলে এহের জিকি।
(৬৮) চাচো—হাঁটি হাঁটি পা পা।
(৬৯) বায়ার কাডা—খোজা করা হয় নাই এমন মোষ।
(৭০) বান্ধাড় সাদম—খোজা করা হয় নাই এমন ঘোড়া।
(৭১) পটম–পুঁটলি বাঁধা (বৃহদাকারের)।
(৭২) রেৎ—ছোটো পুঁটলি।
লাড় সাকাম হেজমে ধুড়ি সিঁদুর রেদমে হরাসি ভোর বাবু সিঁদুরায়মে।
(৭৩) সাড়িম—ঘরের ছাউনি।
(৭৪) সাতে—ছাউনির দেওয়ালের পরের অংশ।
(৭৫) লড়ে/লাঠা—গাছের রসকে লড়ে বলে আবার এই রস দিয়ে যে আঠা তৈরি হয় তাকে লাঠা বলে।
মূল আলোচনায় যাবার আগে এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই তা হল বসাকে সাঁওতালি ভাষায় দুডুপ বলে কিন্তু গাই গরুর বেলায় বলে বুরুম। কারণ গাই গরুর শোবার ক্ষমতা নাই অপর দিকে আবার পাখীর ক্ষেত্রে দাঁড়ানো আর বসার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নাই বলেই দুডুপ বা বুরুম বলে না। বলে আফ। এই বৈচিত্র্য কেবলমাত্র বসার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নাই, সালতালি ভাষার প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই বৈচিত্র্য অনুধাবন করা যায় না। যাদের মুখের ভাষায় এত বৈচিত্র্য আছে তারা কখনো অসভ্য হতে পারে? পারে না। আসলে এতদিন ধরে যাদের অবজ্ঞা করে এসেছি, অবহেলা করে এসেছি, আদিম, অসভ্য, বর্বর বলে অভিহিত করে এসেছি, বর্তমানের বিচারে তারা একটু পশ্চাদপদ হলেও তারা যে এককালে বেশ উন্নত ছিল সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। অপরদিকে এতদিন পর্যন্ত যারা সভ্য বলে দাবী করে এসেছে ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত তারাই অসভ্য ছিল, এদের সংস্পর্শে এসেই তারা সভ্য হয়েছে কৃষিকাজ করতে শিখে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শিখেছে। ঐতিহাসিক এ. এল. ব্যাসাম ত বলেইছেন, ‘On the other hand they had not developed a city civilization. The complete absence of any words connected with writing in the Rygveda, despite its size and the many context in which such words might be expected to occur, is almost certain proof that the Aryans were illiterate.‘
অর্থাৎ, ‘অন্য দিকে শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তন তারা করেনি। ঋগ্বেদে তার সমর্থনে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই, যদিও সে কথা ঋগ্বেদে উল্লেখ থাকার কথা। কারণ তার আয়তন বিশাল এবং অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, আর্যরা অশিক্ষিত ছিল।’ (The wonder that was INDIA, A. L. Basham, P. 33)
তিনি এও বলেছেন, ‘The invaders of India called themselves Aryas, a word generally anglicized into Aryans. The name was also used by the ancient persians, and survive in the word Iran, white eire the name of the most westerly land reached by the Indo European peoples in ancient time, is also cognate.’
অর্থাৎ, ভারতবর্ষের আক্রমণকারীরা নিজেদের আর্য বলে দাবী করত। আর্য, ইংরেজী আরিয়ান এর অনুরূপ একটি শব্দ। এটা সুপ্রাচীনকালে পার্শিয়ানরা ব্যবহার করত, ইরানে এখনো তার অস্তিত্ব আছে, আবার একেবারে পশ্চিমে আয়ারল্যাণ্ডে সমগোত্রীয় শব্দ ইন্দো ইউরোপীয়ানরাই পৌঁছে দিয়েছিল।’ (গ্রন্থ, ঐ পৃষ্ঠা—২৮)
তাদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
‘About 2000 B. C. The great steppe land which stretches from poland to central Asia was inhabitated by semi nomadic barbar- ians, who were tall, comparatively fair and mostly long headed.’
অর্থাৎ, খৃষ্টজন্মের ২০০০ বছর পূর্বে পোলাও থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত শুষ্ক, ডালপালা বর্জিত অনুর্বর প্রান্তরে অর্ধ বর্বর যাযাবরদের বাসস্থান ছিল, যারা ছিল লম্বা, তুলনামূলকভাবে উজ্জ্বল এবং উন্নত মস্তিষ্ক বিশিষ্ট।’ (গ্রন্থ, ঐ, পৃষ্ঠা- ২৯)
তাদের পেশা ছিল, ‘মূলত পশুপালন এবং যৎসামান্য কৃষিকাজ করত।’ “They were mainly pastoral, but practised a little agriculture.” (গ্রন্থ, ঐ, পৃষ্ঠা-ঐ)
তারা আদি বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন, খৃষ্টজন্মের দুই সহস্র বছর পূর্বে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি অথবা পশুচারণ ভূমির অভাব হেতু অথবা উভয় কারণেই তারা দলে দলে বিভিন্ন অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের একদল পশ্চিম অভিমুখে, একদল দক্ষিণ অভিমুখে এবং অন্য দল পূর্ব অভিমুখে যাত্রা করে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে তাদের শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়।’
‘In the early part of the 2nd millennium, whether from pressure of population, desiccation of pasture lands, or from both causes, these people were on the move. They migrated in bands west words, South wards and East wards, conquering local population, and inter marrying with them to form a ruling class.’ (গহ্ন ঐ, পৃষ্ঠা- ঐ)
ঋগ্বেদ উল্লেখিত সুর এবং অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ থেকে এরকম অনুমান করা অস্বাভাবিক নয় যে, ভারতবর্ষে আগমনের পর আর্যদের সঙ্গে ভারতের আদিম অধিবাসীদের সংঘর্ষ বাধে এবং এই সংঘর্ষে আর্যদের কাছে ভারতবর্ষের আদিবাসীরা পরাজিত হন। কিন্তু পরাজিতদের সবাই আর্যদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। যারা বিজয়ীর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন তারা সবাই বিজয়ীর দাস হিসেবে গণ্য হলেন। কারণ সুপ্রাচীন কালে পরাজিতরা বিজয়ীর দাসে পরিণত হবেন এটাই নিয়ম ছিল। বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণাশ্রম প্রথার চতুবর্ণের চতুর্থ বা শেষ বর্ণ শুদ্র পরাজিতদের অন্তর্ভুক্ত বলেই মনে হয়। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা যা কিনা আর্যদের বলে দাবী করা হয় সেটা গড়ে তুলেছিলেন বর্ণাশ্রম প্রথার চতুর্থ বা শেষ বর্ণ কারণ বর্ণাশ্রম প্রথায় বর্ণিত প্রথম তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের সেবা করত শুদ্ররাই, উপরোক্ত তিন বর্ণের উল্লেখযোগ্য তেমন কোন কাজই ছিল না। অপরদিকে যারা বশ্যতা স্বীকার করেননি তারা ক্রমশ পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে পরবর্তীকালে অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গ নামে পরিচিত স্থানে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে এবং এরাই সাঁলতালদের পূর্বপুরুষ বলে পরিচিত হন।