সাঁওতালি ভাষা

সাঁওতালি ভাষা

ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষার মূল সম্পদ শব্দ ভাণ্ডার। যে ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে যত বেশি শব্দ আছে সে ভাষা তত বেশি উন্নত বা সমৃদ্ধ। শব্দের উৎস হচ্ছে তিনটি। সেই উৎস গুলি হল, প্রথমতঃ, মৌলিক বা নিজস্ব। ইংরেজীতে বলা হয় Inherited। দ্বিতীয়তঃ, আগন্তুক বা কৃতঋণ ইংরেজীতে Borrowed বা Loan word এবং তৃতীয় উৎস হচ্ছে। নবগঠিত বা Newly formed, প্রথমতঃ রিকথ রূপে উত্তরাধিকার সূত্রে যে ভাষাগুলি সঞ্চিত হয় তাকে বলা হয় মৌলিক বা নিজস্ব। ইংরেজীতে বলা হয় Inherited. কিন্তু ভাষা তার চলার পথে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কে যখন অন্য ভাষার সংস্পর্শে আসে তখন সে বস্তু বা ভাব প্রকাশের জন্য অন্য ভাষার গ্রহণযোগ্য শব্দগুলি নিজের ভাষাভুক্ত করে নেয়। এই সব শব্দ প্রয়োজনের তাগিদে আহৃত বলে এদের আগন্তুক বা ইংরেজীতে বলা হয় Borrowd. সংস্কৃত এবং সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ভারতীয় ভাষাগুলি সমৃদ্ধ হবার পেছনে সাঁওতালি ভাষার অবদান অপরিসীম। ভাষাবিজ্ঞানীরা বা ভাষাতাত্বিকরা সাঁওতালি ভাষার এই ঋণকে অস্বীকার করেন না বা অস্বীকার করতে পারেন না।

সাঁওতালদের মুখের ভাষা হচ্ছে সাঁওতালি। সাঁওতালি ভাষাও উপরোক্ত তিনটি উপাদানে গঠিত। তার আত্তীকরণ ক্ষমতা অপরিসীম। কিন্তু তার নিজস্ব বা মৌলিক বা রিকথ রূপে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শব্দভাণ্ডার খুবই উন্নত। সেটা প্ৰমাণ করার জন্য আমি এখানে নমুনা হিসাবে ভাব প্রকাশের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের (Salient feature) কথা উল্লেখ করব। সাঁওতালি ব্যাকরণ রচনার প্রয়াস থেকে আমি বিরত থাকব, কারণ আমি প্রথমেই উল্লেখ করেছি, আমি এমন কিছুর কথা বলব যা অন্য কোনো পুস্তকে পাওয়া যাবে না। আমি আমার লেখা “সাঁওতালি ভাষার লিপি সমস্যা এবং সেই সমস্যা সমাধানের সন্ধানে” বই-এ মন্তব্য করেছি সাঁওতালি ভাষার মত এত বৈচিত্র আর কোনো ভারতীয় ভাষায় নেই, পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় আছে কিনা আমি জানি না। কারণ আমি ভাষাতাত্বিক নই। সাঁওতালি ভাষা শেখা খুব সহজ। কি ভাবে? সেটাই আমি এখানে উল্লেখ করব। যে কোনো ভাষায় দখল বা আয়ত্ত করায়ত্ত করতে গেলে ‘Tense’ বা ‘কাল’ জানা অপরিহার্য। এ ধারণা সর্বজনগ্রাহ্য। তবে অন্য ভাষার সঙ্গে সাঁওতালির মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। অন্য ভাষার মত সাঁওতালি ভাষাকে আয়ত্ত করতে এত কসরত করতে হয় না। সাঁওতালি ভাষায় Tense বা কাল জানার আগে Number বা বচন অবশ্যই জানতে হবে। Number বা বচন জানতে পারলে যে কেউ সহজেই সাঁওতালি ভাষা শিখতে সক্ষম হবে। ইংরেজীতে Number এবং বাংলা বচন দুই প্রকারের। যেমন (১) Singular বাংলায় একবচন এবং (২) Plural বাংলায় বহুবচন কিন্তু, সাঁওতালি ভাষায় Number বা বচন সংস্কৃতের মত তিন প্রকারের। আমি আলোচনার শুরুতেই বলে নিয়েছি সংস্কৃত এবং সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ভারতীয় ভাষাগুলি সাঁওতালি থেকে শব্দ ধার করে সমৃদ্ধ হয়েছে। সংস্কৃতের বহু আগে থেকেই সাঁওতালি ভাষা বিদ্যমান ছিল। একমাত্র ইংরেজী ছাড়া পৃথিবীর আর কোন ভাষায় ব্যুৎপত্তি আমার নেই, তাই অন্যদের কথা আমি বলতে পারছি না। ইংরেজী সংস্কৃতের স্বজাতির ভাষা অথচ ইংরেজীতে বচন সংস্কৃতের মত তিন নয়, দুই। এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না, আর্যদের সংস্কৃত সাঁওতালির প্রভাবে প্রভাবিত। সেই কারণেই সংস্কৃতেও বচন বা Number এর সংখ্যা তিন। সেই তিনটি বচন হল : একবচন, দ্বিবচন, এবং বহুবচন। সাঁওতালি ভাষার এই বচনকে কি করে সহজেই আয়ত্ত করা যায় এবং তা আয়ত্ত করলে কি করে সাঁওতালি Tense বা কাল সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা জন্মায় তাই এখানে উল্লেখ করছি :

একবচন – আয়
দ্বিবচন – আকিন
বহুবচন – আক

Auxiliary বা সাহায্যকারী ক্রিয়ার ব্যবহার ইংরেজীতে আছে। সেই ক্রিয়াগুলি হল, am, is, are, have, has, was, were, had, shall এবং will প্রভৃতি। এই সহায়কগুলি Tense অনুসারে ব্যবহৃত হয়। সাঁওতালি ভাষাতেও অনুরূপ কয়েকটি Auxiliary Verb বা সাহায্যকারি ক্রিয়ার সাক্ষাত পাই। সেগুলি হল, এৎ, লেৎ, কেৎ, এন, কান, আকান, আকাৎ ইত্যাদি Presant এবং Past tense এর জন্য ভবিষ্যৎ বা Future tense এর জন্য আয়, আকিন এবং আক ইত্যাদি মাত্র কয়েকটি সহায়ক ক্রিয়া আয়ত্ত করতে পারলেই যে কেউ সাঁওতালি tense বা কাল নির্ণয় করতে পারবে। এই সহায়কগুলির সঠিক এবং নিখুঁত ভাবে ব্যবহারের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিটি আয়ত্ত করা প্রয়োজন।

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
এদায়এদাকিনএদাক
লেদায়লেদাকিনলেদাক
কেদায়কেদাকিনকেদাক
লেদেয়ায়লেদেয়াকিনলেদেয়াক
কেদেয়ায়কেন্দ্রেয়াকিনকেদেয়াক
মেয়ায়মেয়াকিনমেয়াক
এনায়এনাকিনএনাক
কানায়কানাকিনকানাক
আকানায়আকানাকিনআকানাক
আকাদায়আকাদাকিনআকাদাক
খন (হইতে)খনকিনখনক
দয় (অব্যয়)দকিনদক
বায় (না)বাকিনবাক
আলয় (না)আলকিনআলক

ইংরেজীতে Main verb এর সঙ্গে ing এবং বাংলায় ইতেছ, ইতেছি এবং ইতেছিল যোগ করে Tense বা কাল নির্ধারণ করা হয়। অনুরূপভাবে সাঁওতালি ভাষায় Main verb এর পরে (আগে নয়) উপরোক্ত কয়েকটি Auxiliary verb বা সাহায্যকারী ক্রিয়ার সঙ্গে আয়, আকিন এবং আক যোগ করে সাঁওতালি ভাষায় যতগুলি tense বা কাল আছে তার সবগুলিকেই প্রকাশ করা যায়। তবে এখানে অন্যদের সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার মৌলিক পার্থক্য আছে। সাঁওতালি ভাষার একমাত্র উদাহরণ সাঁওতালিই। তার মত ভাষা পৃথিবীতে আর দুটি নেই। অন্য ভাষার ক্ষেত্রে যেহেতু Subject বা কর্তার বচন হয়, ক্রিয়ার কোনো বচন হয় না— তাই Subject বা কর্তার উল্লেখ অপরিহার্য। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় তার প্রয়োজন হয় না। সাঁওতালি ভাষায় যেহেতু ক্রিয়ারও Number বা বচন হয় তাই বাক্য গঠন প্রণালীতে সাঁওতালি ভাষার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। আমি উদাহরণ স্বরূপ এখানে দু একটির কথা উল্লেখ করব তাহলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

Present tense বা বর্তমান কাল

(1) He is Comming (Singular)

সে আসিতেছে

(2) They are Comming (Plural)

তারা আসিতেছে

Past tense বা অতীতকাল।

(1) He was Comming (Singular)

সে আসিতেছিল

(2) They were Comming (Plural)

তারা আসিতেছিল

Future tense বা ভবিষ্যৎ কাল

(1) He will come (Singular)

সে আসিবে

(2) They will come (Plural)

তারা আসিবে

উপরে তিনটি উদাহরণ দেওয়া হল। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন Tense বা কালের। প্রথমে ইংরেজীতে তৎপরে বাংলায়। বাক্যগুলি বাক্য গঠনের নিয়ম অনুসারে গঠিত। উপরোক্ত বাক্যগুলিতে কেবলমাত্র is comming. was comming এবং will come বললে বাক্যগঠন সম্পূর্ণ হয় না। নির্দিষ্ট ধারণাও জন্মায় না। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় উপরে বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করে কেবলমাত্র ক্রিয়ার সাহায্যে Subject বা কর্তার উল্লেখ ছাড়াই বাক্যগুলিকে প্রকাশ করা শুধু যায় না Subject সম্বন্ধেও সুনির্দিষ্ট ধারণা জন্মে।

(1) হিজুঃক কানায় (Singular)
(2) হিজুঃক কানাকিন (Dual)
(3) হিজুঃক কানক (Plural)

(1) হিজুঃক কান তাঁহেনায় (Singular)
(2) হিজুঃক কান তাঁহেনাকিন (Dual)
(3) হিজুঃক কান তাঁহেনাক (Plural)

(1) হিজুঃক আয় (Singular)
(2) হিজুঃক আকিন (Dual)
(3) হিজুঃক আক (Plural)

প্রথম তিনটি বাক্যে (হেএচ/হেজ=আসা) মূল ক্রিয়ার সঙ্গে Auxiliary verb বা সহায়ক ক্রিয়া কান এর সঙ্গে আয়, আকিন এবং আক যোগ করে বচনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

হেএচ/হেজ+কান+আয়=হিজুঃক কানায় (বর্তমান) হেএচ/হেজ+কান+আকিন=হিজুঃক কানাকিন (ঐ) হেএচ/হেজ+কান+আক=হিজুঃক কানাক (ঐ)

অনুরূপভাবে পরবর্তী দুটি বাক্যের একটিতে অর্থাৎ, অতীত কালের বাক্যে, বাক্যটিকে কেবলমাত্র শ্রুতিমধুর করার জন্য তাঁহেকানায়, তাঁহে কানাকিন এবং তাঁহে কানাকর পরিবর্তে তাঁহের আগে কান বসিয়ে তাঁহের সঙ্গে আয়, “আকিন এবং আক যোগ করা হয়েছে। তাই বাক্যটি শ্রুতি মধুর হয়েছে এবং সর্ব শেষের সঙ্গে কেবলমাত্র আয়, আকিন এবং আক মূল ক্রিয়ার সঙ্গে যোগ করে ক্রিয়াটিকে ভবিষ্যৎ কালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। উপরোক্ত উদাহরণ প্রত্যক্ষ করে যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে যে, প্রথম উদাহরণে একজনের, দ্বিতীয় উদাহরণে দুজনের এবং তৃতীয় উদাহরণে দুয়ের অধিকের কথা বলা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আরও কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হল।

Present

(1) He is working. সে কাজ করিতেছে।

সাঁওতালি—কামি+এ+আয়=কামিয়েদায়

(2) They (two) are working. তারা (দুজন) কাজ করিতেছে।

সাঁওতালি—কামি+এৎ+আকিন=‘কামিয়েদাকিন

(3) They (more than two) are working. তারা (দুয়ের অধিক) কাজ করিতেছে সাঁওতালি—কামি+এ+আক=কামিয়েদাক

Past

(1) He ran away সে পালিয়ে গেল

সাঁওতালি—দাইড়+কেৎ+আয়=দাইড়কেদায়

(2) They both ran away তারা দুজনেই পালিয়ে গেল

সাঁওতালি, দাইড়+কেৎ+আকিন=দাইড়কেদাকিন

(3) They all ran away তারা সবাই পালিয়ে গেল

সাঁওতালি—দাইড়+কেৎ+আক=দাইড়কেদাক

(1) He had Finished সে শেষ করিয়া ফেলিয়াছিল

সাঁওতালি—চাবা+লে+আয়=চাবালেদায়

(2) They both had Finished তারা দুজনেই শেষ করিয়াছিল

সাঁওতালি—চাবা+লেৎ+আকিন=চাবালেদাকিন

(3) They all had Finished তারা সবাই শেষ করিয়াছিল

সাঁওতালি—চাবা+লেৎ+আক=চাবালেদাক

Future

(1) He will start soon সে শীঘ্রই শুরু করবে

সাঁওতালি—লগনগে এহব+আয়=এহবায়

(2) They both will start soon তারা দুজন শীঘ্রই শুরু করবে

সাঁওতালি–লগনগে এহব+আকিন=এহবাকি

(3) They all will start soon. তারা সবাই শীঘ্রই শুরু করবে

সাঁওতালি—লগনগে এহব+আক=এহবাক

এইভাবে উপরে নির্দেশিত নিয়ম অনুসরণ করে কর্তা এবং কর্ম ছাড়াই কেবলমাত্র ক্রিয়ার সাহায্যে সাঁওতালি ভাষায় সমস্ত Tense বা কাল নির্ণয় করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তির সংখ্যাও জানতে পারি। অনুরূপভাবে সেটা যদি First Person বা উত্তম পুরুষ হয় তখন আয়, আকিন এবং আক’র বদলে আঞ, আলিঞ এবং আলে ব্যবহৃত হবে। যেমন-

(1) I am comming আমি আসছি

সাঁওতালি—হিজুঃক কানাঞ (কান+অঞ)

(2) We (two) are comming

আমরা (দুজন) আসছি

সাঁওতালি—হিজুঃক কানালিঞ (কান+আলিঞ)

(3) We (all) are comming

আমরা (সবাই) আসছি

সাঁওতালি—হিজুঃক কানালে (কান+আলে)

এইভাবে, জম এদাঞ, জজম কাণাঞ (আমি খাচ্ছি) রুওয়াড় হিজুঃক কানাঞ (আমি ফিরে আসছি) ইত্যাদি।

Past

(1) I ran away আমি পালিয়ে এলাম

সাঁওতালি—দাইড় কেদাঞ (কেদাৎ+আঞ)

(2) We (two) ran away

আমরা (দুজন) পালিয়ে এলাম

সাঁওতালি—দাইড় (ঞি) কেদালিঞ (কেৎ+আলিঞ)

(3) We (all) ran away আমরা (সবাই) পালিয়ে এলাম

সাঁওতালি—দাইড় (ঞি) কেদালে (কেৎ+আলে)

এইভাবে হেএচ এনাঞ (আমি চলে এলাম) হেএচ আকানাঞ (আমি চলে এসেছি (Past) রাওয়াড় আকানাঞ (আমি ফিরে এসেছি (Past) রাপুদ আকাদাঞ (আমি ভেঙ্গে ফেলেছি (Past) ইত্যাদি।

Future

(1) I shall start

আমি শুরু করব

সাঁওতালি—এহবাঞ (এহব+আঞ)

(2) We (two) shall start আমরা (দুজন) শুরু করব

সাঁওতালি—এহবালিঞ (এহব+আলিঞ)

(3) We (all) shall start

আমরা (সবাই) শুরু করব

সাঁওতালি—এহবালে (এহব+আলে)

এইভাবে জমাঞ (আমি খাবো) রহয়াঞ (আণি রোপন করব) ইত্যাদি। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। যেগুলি সাঁওতালিতে বহু প্রচলিত এবং ব্যবহৃত। উদাহরণ স্বরূপ এখানে মাত্র কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হল।

কিন্তু নির্দিষ্টভাবে এবং বিস্তারিতভাবে বলতে হলে Affirmative এবং Negative অর্থাৎ হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক অংশে উল্লেখিত নিয়ম প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ ক্রিয়ার সঙ্গে পুরুষের প্রথমাংশ থেকে যাবে এবং শেষাংশ Sentence বা বাক্যের অন্য অংশে যুক্ত হবে। যেমন—হুডুয় রহয় এদা অর্থাৎ সে ধান রুইছে। আয় এর আ এৎ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে এদা এবং য়’ হুডু’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে হুডুয়। অনুরূপ ভাবে, দাকায় জম এদা (সে ভাত খাচ্ছে), জামায় হরঃক এদা (সে জামা বা সার্ট পরছে) প্রথম পুরুষে দাকাঞ জম এদা। হুডুঞ রহয় এদা, জামাঞ হরঃক এদা ইত্যাদি।

সাঁওতালি ভাষায় অপর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত পুরুষগুলির একযোগে উচ্চারণ। যেমন রুওয়াড় কাতামাঞ অর্থাৎ, আমি তোমার দেওয়া ফিরিয়ে দেব, এখানে কাঃক এর আম এবং আঞ যুক্ত হয়ে হয়েছে কাতামাঞ। দাল মেয়াঞ—আমি তোমাকে পেটাব। হহ আমাঞ—আমি তোমাকে ডেকে পাঠাব ইত্যাদি।

তবে প্রত্যেক ভাষায় কিছু কিছু মৌলিক বা নিজস্ব শব্দ থাকে, যেগুলি তার নিজস্ব ব্যাকরণ অনুসারেই গড়ে ওঠে। তাই তার সঙ্গে অন্য কোন ভাষার হুবহু মিল খোঁজা অর্থহীন। সাঁওতালি ভাষাও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।

অনুরূপ আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কথা আমি এখানে উল্লেখ করব। আমরা সবাই জানি Sentence বা বাক্যে Subject, Predicate, verb ইত্যাদি থাকে। এই নিয়মের হেরফের ঘটিয়ে আমরা Interrogative Sentence অর্থাৎ জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য তৈরি করি অর্থাৎ Sentence এর জায়গায় verb বসিয়ে এবং verb এর জায়গায় subject বসিয়ে Interrogative Sentence অর্থাৎ জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য তৈরী করি। যেমন :

Is he comming?

অর্থাৎ, সে কি আসছে? Tense বা কালের মত এখানেও এতসব নিয়ম ছাড়াই সাঁওতালি ভাষায় কেবল একটিমাত্র শব্দে জিজ্ঞাসাসূচক চিহ্ন বা Note of Interrogation বসিয়ে Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য তৈরি করা যায়। তবে বাক্যটিকে নিখুঁত করার জন্য Number বা বচনের সঙ্গে সঙ্গে person বা পুরুষ জানা অবশ্যই দরকার। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি সাঁওতালি ভাষায় বচনের সংখ্যা তিন এবং অন্যদের মত person বা পুরুষের সংখ্যাও তিন। সেগুলি হল :

First Person উত্তম পুরুষ

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
ইঞআলিঞআলে
আঞআলাংআব

2nd Person মধ্যম পুরুষ

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
আমআবিন/আবেনআপে
এমবেনপে

3rd Person প্রথম পুরুষ

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
উনিউনকিনউনকু
নুইনুকিননুকু
হানিহানকিনহানকু

আমরা জানি ইংরেজী এবং বাংলায় First Person বা উত্তম পুরুষের সংখ্যা দুই। যেমন, I, we বা আমি, আমরা। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় বচন যেহেতু দুটো নয় তিনটি তাই উত্তম পুরুষের সংখ্যাও তিন হওয়ারই কথা কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি সাঁওতালি ভাষায় উত্তম পুরুষের সংখ্যা ছয়। ইংরেজী এবং বাংলার মোট পুরুষের সমান। সাঁওতালি ভাষা যে, যথেষ্ট উন্নত এবং সমৃদ্ধ সেটা এই একটিমাত্র উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যায়। সাঁওতালি ভাষায় ব্যক্তির নির্দেশকে নিখুঁত করার জন্য First Person বা উত্তম পুরুষের সংখ্যা ছয় করা হয়েছে। আমি বা আমরা যখন আমাদের উদ্দেশ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে বলব তখন উপরের তিনটি অর্থাৎ ইঞ, আলিঞ এবং আলে ব্যবহৃত হবে কিন্তু আমরা নিজেরা যখন আমাদের মধ্যে আলোচনা করব তখন নীচের তিনটি আঞ, আলাং এবং আব ব্যবহৃত হবে। দু একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন :

চেৎ লেকা মেনাঃকবিনা/বেনা? অর্থাৎ তোমরা কেমন আছ? (মেনাঃক এর সঙ্গে আ বিনা যুক্ত হয়ে হয়েছে আঃবিনা (দ্বিবচন)। উত্তর হবে আলিঞ দলিঞ বেশ গেয়া। (গেয়ালিঞ এর লিঞ অব্যয় দ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং আ গেয়ার সঙ্গে পড়ে আছে) অর্থাৎ আমরা ভালই আছি। কিন্তু যদি এমন হয় আমরা বিপদে পড়েছি, কি করে উদ্ধার হব সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি তখন আলিঞ নয় ব্যবহৃত হবে আলাং। আলাং দ চেৎ লাং চিকায়া? এখন আমরা কি করব? (চিকায়ালাং এর লাং চেৎ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আ চিকার সঙ্গে পড়ে আছে)। অনুরূপ ভাবে দুয়ের অধিক হলে আবদ চেৎ বন চিকায়া? আমরা (বহুবচন) এখন কি করব? (চিকায়াবন এর বন চেৎ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং আ চিকার সঙ্গে যুক্ত আছে, এসব নিয়ে পরে আলোচনা করব) এখানে শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য আর একটা ছোট্ট নিয়মের কথা উল্লেখ করব। সেটা হল 3rd Person বা প্রথম পুরুষের Singular Number বা একবচনে কোনো কিছুই যোগের প্রয়োজন নাই। কিন্তু দ্বিবচনের ক্ষেত্রে শুধু ‘কিন’ এবং বহুবচনের ক্ষেত্রে কু উচ্চারিত (উনকু) হয় তবে অন্য ক্ষেত্রে কেবল ‘ক’ যোগ করলেই হবে।

যেমন :

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
হড় (মানুষ)হড়কিনহড়ক
কুল (সিংহ)কুলকিনকুলক
হাঁডু (হনুমান)হাঁড়কিনহাঁড়ক
গাড়ি (বানর)গাড়িকিনগাড়িক

এখন পুরুষ আয়ত্ত করলে Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসূচক বাক্য কি ভাবে তৈরি করা হয় সেটাই আলোচনা করব। যেমন :

(1) Are you weeping? তুমি কি কাঁদছ?

সাঁওতালি – রাঃক এদাম?

রাঃক মনে কান্না, এৎ+আম, আম মানে তুমি (একবচন) এবং যেহেতু ইংরেজীতে ing এবং বাংলায় ইতেছ যোগ করা হয়েছে তাই পূর্বে আলোচিত এৎ যোগ করা হয়েছে এবং তার ফলে Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসাসূচক বাক্যগঠনের নিয়ম ছাড়াই একটিমাত্র ক্রিয়াবাচক শব্দ দিয়ে Interrogative Sentence তৈরি করে বচনকেও নির্দেশ করা হয়েছে। অনুরূপ ভাবে :

(2) Are you (two) weeping? তোমরা কি কাঁদছ?

সাঁওতালি – রাঃ এদাবিনা/ বেন? (এৎ+আবিন/আবেন)

(3) Are you (all) weeping? তোমরা (বহুবচন) কি কাঁদছ?

সাঁওতালি – রাঃক এদাপে? (এৎ+আপে)

অপরের বাড়িতে প্রবেশ করতে অনুমতি নিতে হয়।

(1) May I come in? আমি আসতে পারি?

হিজুঃক আঞ?

হেএচ, হেজ মানে আসা এবং First Person, Singular Number বা উত্তম পুরুষের একবচনে ইঞ বা আঞ ব্যবহৃত হয়।

(2) May we (two) come in? আমরা (দুজন) কি আসতে পারি?

সাঁওতালি – হিজুঃক আলিঞ?

(3) May we (all) come in? আমরা (বহুবচন) কি আসতে পারি?

সাঁওতালি – হিজুঃক আলে?

(1) Are you eating? তুমি কি খাচ্ছ?

সাঁওতালি – জম এদাম? (এৎ+আম)

(2) Are you (two) eating? তোমরা (দুই) কি খাচ্ছ?

সাঁওতালি – জম এদাবিন এদাবেন? (এৎ+আবিন/আবেন)

(3) Are you (all) eating? তোমরা (বহুবচন) কি খাচ্ছ?

সাঁওতালি – জম এদাপে? (এৎ+আপে)

এইভাবে সাঁওতালি ভাষার Person বা পুরুষ জানতে পারলেই Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা জন্মায়। Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য তৈরি করার সময় Person বা পুরুষ অনুসারে ক্রিয়া ব্যবহারের সাধারণ নিয়ম কানুন নীচে উল্লেখ করা হল।

First Person বা উত্তম পুরুষ

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
এদায়িঞএদালিঞএদালে
এদাঞ  
লেদাঞলেদালিঞলেদালে
লেদেয়াঞলেদেয়ালিঞলেদেয়ালে
কেদাঞকেদালিঞকেদালে
কেদেয়াঞকেদেয়ালিঞকেদেয়ালে
মেয়াঞমেয়ালিঞমেয়ালে
এনাঞএনালিঞএনালে
কানাঞকানালিঞকানালে
আকানাঞআকানালিঞআকানালে
আকাদাঞআকাদালিঞআকাদালে
বাঞ (না)বাংলিঞবাংলে
খনিঞ (হইতে)খনলিঞখনলে
দঞ (অব্যয়)দলিঞদলে
লেদালাংলেদাব
লেদেয়ালাংলেদেয়াব
কেদালাংকেদা
কেদেয়ালাংকেদেয়াব
মেয়ালাংমেয়াব
এনালাংএনাব
কানালাংকানাব
আকানালাংআকানাব
আকাদালাংআকাদাব
বাংলাংবাংব
খনলাংখনব
দলাংদব

Second Person বা মধ্যমপুরুষ

একবচনদ্বিবচনবহুবচন
এদামএদাবিন/বেনএদাপে
লেদামলেদাবিন/বেনলেদাপে
লেদেরামলেদেয়াবিন/বেনলেদেয়াপে
কেদামকেদাবিন/বেনকেদাপে
কেদেয়ামকেদেয়াবিন/বেনকেদেয়াপে
মেয়ামমেয়াবিন /বেনমেয়াপে
এনামএনাবিন/ বেনএনাপে
কানামকানাবিন/বেনকানাপে
আকাদামআকাদাবিন/বেনআকাদাপে
বাম (না)বাবিন/বেনবাংপে
আলম (না)আলবিন/বেনআলপে
খনেম (হইতে)খনবিন/বেনখনপে
দম (অব্যয়)দবিন/বেনদপে

এক কথায় জিজ্ঞাসা সূচক বাক্য তৈরী করতে উপরোক্ত নিয়ম প্রয়োগ করলেই হবে। কিন্তু যদি কখন, কোথায়, কোথা থেকে, কেন (When, Where, Which, Who) ইত্যাদি শব্দ দিয়ে Interrogative Sentence বা জিজ্ঞাসা সূচক বাক্য তৈরী হয় তখন When, Where, Which এবং Who র সঙ্গে বচনে উল্লেখিত শব্দের শেষাংশ যুক্ত হবে এবং প্রথমাংশ ক্রিয়ার সঙ্গে থাকবে। যেমন কোথা থেকে আসছ? এখানে আসছ’র সঙ্গে আ এবং কোথার সঙ্গে ম যুক্ত হবে। ফলে বাক্যটি শ্রুতি মধুর হয়ে উঠবে। অকা খনেম হিজুঃ কানা? হিজুঃক কানাম (কানাম) আম এর ম খনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে খনেম এবং আ কান এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে কানা ফলে বাক্যটি শ্রুতি মধুর হয়ে উঠেছে। এইরূপ ভাবে তুমি কবে এসেছে? তিসেম হেএচ আকানা? তুমি কোথায় যাবে? আকাতেম চালাঃক আ? তুমি কখন আসবে? তিনরেম হিজুঃকআ? তুমি ভাত খেয়েছ? দাকাম জম আকাদা? অনুরূপ ভাবে দ্বিবচন এবং বহুবচনের ক্ষেত্রে ‘ম’র বদলে বিন/বেন এবং পে ব্যবহৃত হবে ব্যক্তি বাচকের ক্ষেত্রে, কিন্তু বস্তুবাচক বা জড় পদার্থের বেলায় কেবলমাত্র আ ব্যবহৃত হবে। ‘আ’ এর পরবর্তী অংশ ব্যবহৃত হবে না। তখনই বোঝা যাবে কথোপকথন প্রাণীবাচক না বস্তুবাচকের উদ্দেশ্যে। যেমন, হুডু গেলে আকানা? ধানে কি শিস ধরেছে? জঁড়রা অমন আকানা? ভুট্টার দানা থেকে চারা গজিয়েছে? তিনাঃক সাডে কানা?’ কটা বেজেছে? দারে রাপুদ আকানা? গাছ কি ভেঙ্গে গেছে? দাঃক হিজুঃকোনা, দাঃক ঞেলঃক কানা? ঝড় বৃষ্টি কি আসবে বলে মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে? ইত্যাদি।

সাঁওতালির মত বাংলাতেও অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে শব্দের সংক্ষিপ্ত প্ৰয়োগ বিধি লক্ষ করা যায় (এটাকে সাঁওতালির ব্যর্থ অনুকরণ বলা যায়)। কিন্তু সাঁওতালির মত তা নিখুঁত এবং নির্দিষ্ট নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ৩/৪ জন ছাত্র ইস্কুলে পৌঁছে দেখলেন যে, শিক্ষক মহাশয় ইতিমধ্যেই শ্রেণী কক্ষে পৌঁছে গেছেন। তাদের কেউ একজন (সবাই এক সঙ্গে বলে না) যথারীতি মাস্টার মশাই কে জিজ্ঞেস করলেন স্যার, আসতে পারি? মাস্টার মশাই হ্যাঁ বলে অনুমতি দিলেন। কিন্তু এখানে যেটা লক্ষণীয়, মাস্টার মশাই হ্যাঁ বলে অনুমতি দিলেও বিভ্রান্তি থেকে যায়। কারণ শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করার জন্য তিনি একজনকেই নাকি সবাইকেই অনুমতি দিয়েছেন সেটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় হিজুঃক আঞ, হিজুঃক আলিঞ এবং হিজুঃক আলে বললে আর কোন বিভ্রান্তি থাকে না। কারণ এই জিজ্ঞাসা সূচক বাক্যের মধ্যেই জিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির সংখ্যাও বলা আছে। আবার অনেক সময় কর্তার উল্লেখ ছাড়াই, কোথায় যাব? কবে যাব ইত্যাদি কথা বাংলায় ব্যবহার হয় বটে তবে এখানেও সাঁওতালির সঙ্গে বাংলার মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ সাঁওতালি ভাষায় ‘অকাতেম’ ‘তিসেম’ ইত্যাদি প্রশ্নবাচক শব্দের মধ্যেই ব্যক্তির সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখিত আছে। অন্য ভাষার সঙ্গে সাঁওতালি ভাষার মৌলিক পার্থক্য এখানেই। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, সাঁওতালির এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য সম্পর্কে কেউই তেমন সচেতন নন আর তাই বাংলায় যেমন বাংলা এবং ইংরেজীর সংমিশ্রণে তৈরি অর্থাৎ বাংরেজীর রেওয়াজ বহুল পরিমাণে প্রচলিত, সাঁওতালদের মধ্যেও অনুরূপভাবে বাংলার সঙ্গে সাঁওতালির অর্থাৎ বাঁওতালির রেওয়াজ ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে।

সাঁওতালি ভাষার আর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে আমি ভাষার মানদণ্ডে সাঁওতালি সভ্যতা কতটা উন্নত ছিল তার আলোচনা করব। সেই দুটির একটি হল Affirmative এবং Negative এবং অপরটি The.

Sentence দু প্রকারের। প্রথমত Affirmative এবং দ্বিতীয়ত Negative অর্থাৎ হ্যাঁ-বাচক এবং না-বাচক। সাঁওতালি ভাষায় Negative বা না-বাচক বাক্য গঠনের সময় না-বাচকের ‘না’র বচন পরিবর্তিত হবে অর্থাৎ Interrogative Sentence এর মত এখানেও পুরুষের শেষাংশ ‘না’ র সঙ্গে যুক্ত হবে এবং প্রথমাংশ মূল ক্রিয়ার সঙ্গে থেকে যাবে। যেমন :

সে আসবে না—উনিদ বায় হিজুঃক আ (আয় এর আ হিজুঃক এর সঙ্গে রয়ে গেছে এবং ‘য়’ বাংএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বায় হয়েছে)।

যেয়োনা—আলঅ চালাঃকমা (আম এর আ চালাঃক এর সঙ্গে রয়ে গেছে এবং ‘ম’ আলর সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে আলম)।

সে যেন না আসে—–আলয় হিজুঃক মা (আয় এর আ ‘মা’র সঙ্গে রয়ে গেছে এবং ‘য়’ আলর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলয় হয়েছে)।

কিন্তু Affirmative বা হ্যাঁ-বাচক বাক্যে কর্তার উল্লেখ করতে হয় না। (যেখানে উল্লেখ করতে হয় সেখানে Introgative Sentence এর কখন, কোথায়, কোথা থেকে ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য হয় এখানেও সেই নিয়ম প্রযোজ্য হবে)। এখানে কর্তার পরবর্তী অংশের সঙ্গে পুরুষের শেষাংশ প্রযুক্ত হবে এবং প্রথমাংশ যথারীতি মূল ক্রিয়ার সঙ্গে থেকে যাবে। যেমন :

আমি আগেই বলেছি—মড়াংরেগেঞ লাই আকাদা।

আমি কালকেই এসেছি—হলারেগেঞ হেএচ আকানা।

আমি এখনই চলে যাব—নিতগিঞ চালাংক আ।

মাড়াং, হলা এবং নিত এর সঙ্গে আঞ (ইঞ) এর ‘ঞ’ যুক্ত হয়েছে এবং আ যথারীতি আকাৎ, আকান এবং চালাঃক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাই আলাদা ভাবে প্রথমেই ইঞ’ উল্লেখের (আমি) প্রয়োজন হয় নাই।

নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ইংরেজীতে যেমন ‘The’ ব্যবহৃত হয় অনুরূপ ভাবে সাঁওতালি ভাষায় নির্দিষ্ট ভাবে বলার জন্য ‘ইচ’ ব্যবহৃত হয়। যেমন, শিশির জাওইচ (সৃষ্টিকর্তা) সাপড়াওইচ (সম্পাদক) এবং জজমইচ (যমরাজ) ইত্যাদি। তবে ইংরেজীর মত সাঁওতালি ইচ’ শব্দটি নির্বিচারে এবং পাইকারি হারে ব্যবহৃত হয় না। কারণ সাঁওতাল বিশ্বাস করে সবাই (The) তার উপযুক্ত নয়। যোগ্যও নয়। কিন্তু সাঁওতালদের নূতন প্রজন্ম এই স্নব Traditional এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত নিয়ম কানুনকে Backdated মনে করে বর্জন করতে শুরু করেছে এবং স্থান, কাল, পাত্র ছাড়াই নির্বিচারে তাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এই অধঃপতন সমাজ জীবনের কোন স্তরে গিয়ে পৌঁচেছে সেটা বোঝা যায় যখন দেখি ‘আম’ এর পরিবর্তে বাংলার আপনি এবং হিন্দি আপ এর অনুকরণে নির্বিচারে ‘আবিন’ ব্যবহার করতে। সাঁওতালি ভাষায় ‘আম’ এর পরিবর্তে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ‘আবিন’ ব্যবহারের রীতি আছে বটে তবে সর্বত্র ‘আবিন’ ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ‘আবিন’ কে নির্বিচারে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করে নিজেদের হাস্যস্পদ করে তুলেছেন, অন্যকেও বিড়ম্বনায় ফেলছেন।

সাঁওতালি ভাষার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে গিয়ে আমি (উল্লেখ বলেছি Sentence বা বাক্যের দুটো অংশ, Affirmative অর্থাৎ হ্যাঁ-বাচক এবং Negative অর্থাৎ না-বাচক। Sentence বা বাক্য তৈরি করার সময় বচনের প্রথমাংশ auxialiary verb অর্থাৎ সাহায্যকারী ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে এবং শেষাংশ Negative বা নাবাচকের ক্ষেত্রে ‘না’র সঙ্গে কিন্তু Affirmative এর ক্ষেত্রে যা কর্তার পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার সঙ্গে যুক্ত হবে। নিম্নে প্রদত্ত ক্রিয়ার বেলায় অর্থাৎ যেখানে আম, আবিন এবং আপে’র পরিবর্তে কেবল এম/মে, বিন/বেন এবং পে যুক্ত হচ্ছে সেখানে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এখানে বাক্যের কোথাও আর কিছু যোগ বিয়োগের প্রয়োজন নাই।

একবচন – দ্বিবচন – বহুবচন

(এম/ মে) – (বিন) – (পে)

‘অ’

অলমে – অলবিন/বেন – অলপে

অজগমে – অজগবিন/ঐ – অজগপে

অতায়েম – অতায়েবিন/ঐ – অতায়েপে

অরেমে – অরেবিন/ঐ – অরেপে

‘আ’

আগুইমে – আগুইবিন/বেন – আগুইপে

আকরিক্রমে – আকরিঞবিন/ঐ – আকরিঞপে

আকরিঞএম – আকরিঞএবিন/ঐ – আকরিঞএপে

আঁতেনমে – আঁতেনবিন/ঐ – আঁতেনপে

‘ই’

ইরমে – ইরবিন/বেন – ইরপে

ইদিমে – ইদিবিন – ইদিপে

‘এ’

এরমে – এরবিন/বেন – এরপে

‘উ’

উদুগমে – উদুগবিন/বেন – উদুগপে

উকুইমে – উকুইবিন/বেন – উকুইপে

উদমে – উদবিন/বেন – উদপে

‘ক’

কুলিয়েম – কুলিয়েবেন/বিন – কুলিয়েপে

কুলেমে – কুলেনি/ বেন – কুলেপে

কয়েমে – কয়েবিন/বেন – কয়েপে

কয়মে – কয়বিন/বেন – কয়পে

কয়কম(বহু) – কয়কবিন/বেন – কয়গপে

কিরিঞমে – কিরিঞবিন/বেন – কিরিঞপে

কিরিঞআয়মে – কিরিঞআয়বিন/বেন – কিরিঞআয়পে

কয়গমে – কয় গবিন/বেন – কয়কপে

‘খ’

খজমে – খজবিন / বেন – খজপে

খজেমে – খজেবিন/বেন – খজেপে

‘গ’

গডমে – গডবিন/বেন – গডপে

গজেমে – গজেবিন/বেন -গজেপে

গলমে – গলবিন/বেন – গলপে

গিড়িমে – গিডিবিন/বেন – গিডিপে

গটায়মে – গটায়বিন/বেন – গায়পে

গিতিচমে – গিতিচবিন/বেন – গিতিচপে

গদমে – গদবিন/বেন – গদপে

গদঃকমে – গদঃকবিন/বেন – গদঃকপে

গংমে – গংবিন/বেন – গংপে

গংএমে – গংএবিন/বেন – গংএপে

গগমে – গগবিন – গগপে

গুগুইমে – গুগুইবিন/বেন – গুগুইপে

গাতেয়েম – গাতেয়েবিন/বেন – গাতেয়েপে

গাতেঃকমে – গাতেঃকবিন/বেন – গাতেঃকপে

‘চ’

চাপাদেম – চাপাদেবিন/ বেন – চাপাদেপে

চাপাদমে – চাপাদবিন/বেন – চাপাদপে

‘জ’

জগমে – জগবিন/বেন – জগপে

জমমে – জমবিন/ঐ – জমপে

জমেমে – জমেবিন/ঐ – জমেপে

জাপিৎমে – জাপিৎবিন/বেন – জাপিৎমে

‘ঞ’

ঞইমে – ঞইবিন/বেন – ঞইপে

ঞিরমে – ঞিরবিন / ঐ – ঞিরপে

‘ত’

তেঞমে – তেঞবিন/বেন – তেঞপে

তিঞেমে – তিঞেবিন/ঐ – তিঞেপে

তুলমে – তুলবিন / ঐ – তুলপে

তুলেমে – তুলেবিন/ঐ – তুলেপে

তলমে – তলবিন/ঐ – তলপে

তুদমে – তুদবিন/ঐ – তুদপে

তলেমে – তলেবিন/ঐ – তলেপে

তাঁগিঞমে – তাঁগিঞবিন/ঐ – তাঁগিঞপে

তিঁগ্‌নমে – তিঁগুনবিন/ঐ – তিঁগ্‌নপে

তাঁহেনমে – তাঁহেনবিন/ঐ – তাঁপেনপে

থাইয়ায়েম – থাইয়ায়েবেন/বেন – থাইয়ায়েপে

থায়য়মে – থায়য়বিন/বেন – থায়য়পে

থাপায়েম – থাপায়েবিন/বেন – থাপায়েপে

‘দ’

দালমে – দালবিন/বেন – দালপে

দহয়মে – দহয়বিন/বেন – দহয়পে

দালেমে – দলেবিন/বেন – দালেপে

দিপিলমে – দিপিলবিন/বেন – দিপিলপে

দুডুপমে – দুডুপবিন/বেন – দুডুপপে

‘ন’

নতেমে – নতেবিন/বেন – নতেপে

নঙ্কায়মে – নঙ্কায়বিন/বেন – নঙ্কায়পে

‘প’

পেরেজমে – পেরেজবিন/বেন – পেরেজপে

পুইমে – পুইবিন/ঐ – পুইপে

পাঁজায়েম – পাঁজায়েবিন/ঐ – পাঁজায়েপে

পাড়হাওমে – পাড়হাওবিন/ঐ – পাড়হাওপে

পাঁজায়মে – পাঁজায়বিন/ঐ – পাঁজায়পে

‘ফ’

ফুডুগমে – ফুডুগবিন/বেন – ফুডুগপে

‘ব’

বাগিয়েম – বাগিয়েবিন/বেন – বাগিয়েপে

বায়মে – বায়বিন/বেন – বায়পে

বাগিমে – বাগিবিন – বাগিপে

বেরেমে – বেরেদবিন/বেন – বেরেদপে

‘ম’

মেনমে – মেনবিন/বেন – মেনপে

মাগমে – মাগবিন/বেন – মাগপে

মাগেমে – মাগেবিন/বেন – মাগেপে

মেতায়মে মেতায়বিন/বেন মেতায়পে

‘র’

রড়মে – রড়বিন/বেন – রডপে

রাগমে – রাগবিন/ঐ – রাগপে

রহয়মে – রহয়বিন/ঐ – রহয়পে

রেদমে – রেদবিন/ঐ – রেদপে

রয়েমে – রয়োবিন/ঐ – রয়েপে

রেজেমে – রেজেবিন/ঐ – রেজেপে

রেয়াড়ঃকমে – রেয়াড়ঃকবিন/ঐ – রেয়াড়ঃকপে

রাড়ায়মে – রাড়ায়বিন/ঐ – রায়াড়পে

রুইমে – রুইবিন/ঐ – রুইপে

‘ল’

লাইমে – লাইবিন/বেন – লাইপে

লায়মে – লায়বিন/ঐ – লায়পে

লুইমে – লুইবিন/বেন – লুইপে

ললয়মে – ললয়বিন/বেন – ললয়পে

লাগমে – লাগবিন/বেন – লাগপে

‘স’

সিদমে – সিদবিন/বেন – সিদপে

সেনঃকমে – সেনঃকবিন/বেন – সেনঃকপে

(চালাঃক) – (ঐ) – (ঐ)

সেরেঞমে – সেরেঞবিন/বেন – সেরেঞপে

সাবেমে – সাবেবিন/বেন – সাবেপে

সাগাড়মে – সাগাড়বিন/ঐ – সাগাড়পে

‘হ’

হহয়মে – হহয়বিন/বেন – হহয়পে

হাতাওমে – হাতাওবিন/বেন – হাতাওপে

হাইরমে – হাইরবিন/বেন – হাইরপে

হালাংমে – হালাংবিন/বেন – হালাংপে

হৃদমে – হৃদবিন/বেন – হৃদপে

হবরমে – হবরবিন/বেন – হবরপে

হবরএম – হবরএবিন/ঐ – হবরেপে

হেওয়েমে – হেওয়েবিন/ঐ – হেওয়েপে

হেওয়েএম – হেওয়েএবিন – হেওয়েএপে

এখনো পর্যন্ত অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে আমি বলতে পারি, সাঁওতালি ভাষার অন্তর্ভুক্ত মোট শব্দকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। বাক্যরচনার নিরিখে এই দুভাগের একভাগকে বলতে পারি পরিবর্তনশীল অর্থাৎ Flexible এবং অন্যভাগকে রক্ষণশীল অর্থাৎ Rigid। নীচে পরিবর্তনশীল ও রক্ষণশীলের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল।

পরিবর্তনশীল (Flexible)

(১) রু (বাজানো) বাক্যরচনার সময় তার সঙ্গে ‘ই’ যোগ করে উচ্চারিত হবে রুইমে অর্থাৎ তোমাকে বাজাতে বলছি।

(২) পু (কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করা) পুই মে

(৩) এ (পান করা) এইমে

(৪) গৃগু (পিঠে করে নেওয়া) গুগূই মে

(৫) উকু (লুকানো) উকুই মে

(৬) আগু (নিয়ে আসা) আগুই মে

(৭) সিৎ (শাক, ফুল তোলা) সিদ মে

(৮) গদ (কাঁচা আনাজ, ফল তোলা) গদ মে

(৯) তুৎ (উপড়ানো) তুদমে

(১০) চাপাৎ (ঢিল মারা) চাপাদ মে

(১১) রেৎ (পুঁটলি) রেদ মে

(১২) হেএচ (আসা/পাতা ছেঁড়া) হিজুঃকমে/ হেজমে

(১৩) রেএচ (কেড়ে নেওয়া) রেজে মে

(১৪) র (ঝলসানো অর্থে) রয়ে মে

(১৫) লা (গর্ত খোঁড়া) লায় মে

(১৬) উদুঃক (দেখানো) উদুগ মে

(১৭) উৎ (গিলে ফেলা) উদ মে

(১৮) অজঃক (গায়ে মাখা) অজগ মে

(১৯) কয়ঃক (তাকিয়ে দেখা) কয়গ মে

(২০) ফুডুঃক (শাল পাতার তৈরী বাটি) ফুডুগমে ইত্যাদি।

রক্ষণশীল (Rigid)

রক্ষণশীলে ক্ষেত্রে বচন পরিবর্তনের সময় কোন কিছুই যোগ করতে হয় না।

(১) রহয় (রোপন করা) রহয় মে

(২) দিপিল (মাথায় নেওয়া) দিপিল মে

(৩) কিরিঞ (কেনা) কিরিঞ মে

(৪) আকরিঞ (বেচা) আকরিঞ মে

(৫) গড (ভূমিষ্ট প্রনাম) গড মে

(৬) গিতিচ (শোওয়া) গিতিচ মে

(৭) হালাং (কুড়িয়ে আনা) হালাং মে

(৮) হাইর (ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করা) হাইর মে

(৯) গং (সাড়া দেওয়া অর্থে) গং মে

(১০) গিডি (ফেলে দেওয়া) গিডি মে

(১১) দাল (লাঠি পেটা) দালে মে

(১২) দুডুপ (বসা) দুডুপ মে

(১৩) সাগাড় (গাড়ি) সাগাড় মে

(১৪) হাতাও (নিয়ে নেওয়া অর্থে) হাতাও মে ইত্যাদি।

ব্যাকরণ রচনা আমার উদ্দেশ্য নয় (সেটা অন্যত্র করব)। সে কথা আমি আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। সাঁওতালি ভাষার বিশেষ বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কথাই এখানে উল্লেখ করা হল। আমি হলপ করে বলতে পারি এবং guarantee দিতে পারি, আলোচ্য অধ্যায়ে আলোচিত বৈশিষ্ট্য সমূহকে আয়ত্ত করলেই যে কেউ সাঁওতালি ভাষাকে অনুধাবন করতে পারবে। তবে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয় তার জন্য সাঁওতালি শব্দ জানার প্রয়োজন আছে। কারণ সাঁওতালি ভাষায় দু একটা এমন শব্দ আছে যাদের উচ্চারণ ভুল করে আম, ইঞ মনে হতে পারে।। যেমন, তাপাম (লড়াই) সুনুম (তেল) উনুম (চোবানো) ঞতুম (নাম) হুতুম (হ’ত মুখ ধোওয়া), সাগিঞ (দূরে) তিঞ (পাথর ছোঁড়া) তুঞ (তীরমারা) ইত্যাদি।

আমরা এখন যে যুগে বাস করছি তাকে গতির যুগ বলা হয়। এখন হাঁটলে চলবে না দৌড়াতে হবে। কারণ মানুষের হাতে এখন একদম সময় নেই। তথাকথিত সভ্যদের এটা বুঝতে একবিংশ শতাব্দী লেগে গেল আর সাঁওতালদের পূর্বপুরুষরা সেটা কয়েক হাজার বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে তাদের মুন্সিয়ানা বা কুশলতা বা দক্ষতা সে কথাই সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করে। সাঁওতাল নিজে তার শ্রম দিয়ে তার প্রতিবেশীকে উন্নত করেছে, সমৃদ্ধশালী করেছে অপরদিকে আবার তাঁর মুখের ভাষাও তার প্রতিবেশীর মুখের ভাষাকে নিজের উপকরণ দিয়ে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। এটা কথার কথা নয়, ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *