সাঁওতালি গানে সমাজচিত্র

সাঁওতালি গানে সমাজচিত্র

সাঁওতালি লোকসংগীত সাঁওতাল লোককবিদের রচনা। এদেব রচনার মান বেশ উন্নতই শুধু নয় এসব রচনা কালোত্তীর্ণ। এই সব কালজয়ী রচনার আবেদন দেশ কালের গণ্ডী ছাড়িয়ে সর্বকালের সর্বলোকের হৃদয়ে সাড়া জাগায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, এইসব লোককবি যাঁরা শুধু দিলেন বিনিময়ে কিছুই পেলেন না তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেলেন। ‘যারা শুধু দিলে, বিনিময়ে কিছুই পেলে না, যারা বঞ্চিত, যারা শোষিত, যারা অবহেলিত তাদের হয়ে বলবার জন্য’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। কিন্তু সাঁওতালি লোক কবিদের হয়ে বলবার কেউ নেই। সুখ এবং দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ। লোককবিরাও রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। তাই সামাজিক যে কোন সমস্যায় তাঁরা নির্বিকার থাকতে পারেন না। সবার দুঃখে লোককবি দুঃখী হন, তাঁর মনকে নাড়া দেয়, সেই ব্যথা বেদনাই তাঁর মুখে কথা যোগায়। সেই ব্যথা বেদনার কথাই তার মুখ থেকে গান হয়ে বেরিয়ে আসে। নিম্নে প্রদত্ত সাঁওতালি লোক কবিদের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি থেকে সমাজচিত্রের যে পরিচয় পাই তার কথাই তুলে ধরা হল :

রাহা—দঙ

হয় রিমিল বিজলি আপাবারে
সেরমা খন দাঃক এরুঃক এঙ্গাঞ তওয়া।।

গানে অন্ত্যমিল নেই। কারণ এ গান সাঁওতালি লোককবিদের রচনা। ইদানীং রচিত গানে অন্ত্যমিল দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু লোককবিদের রচিত গানে অন্ত্যমিল অনুপস্থিত তবে অন্ত্যমিল না থাকলেও গানের প্রতিটি কথায় ছন্দের ঝংকার আছে। এই গানে ইংরেজী সাহিত্যের রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘The cloud’ কবিতার নিম্নলিখিত বক্তব্যই ব্যক্ত হয়েছে :

এইগানের রচয়িতা ‘The cloud’ কবিতা পড়া তো দূরে থাক, রোমাণ্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর নামই হয়ত শোনেননি। আকাশের মেঘ, বৃষ্টির পেছনে যে বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে তাও হয়ত তাঁর অজানা, কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি যে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, সেই অভিজ্ঞতাকে মূলধন করেই গান লিখেছেন। উদাহরণ হিসেবে এখানে আরো দু একটির কথা উল্লেখ করা হল :

রাহা—দঙ

মাই এ হারায়েনা পেড়াগে বাং
বাবুয় হারায়েনা সবলগে বাং।।
মাঝি কওয়াঃক ঢিঙ্কি সাডে লু, লুটুঃক, লু লুটুংক
ইঞাঃক মনে জিউঈ লুটুঃক, লুটুঃক।।

অর্থাৎ, মেয়ে বড় হল পাত্রের দেখা নাই
ছেলেও বড় হল সম্বল যে নাই।।

মাঝি মোড়লদের ঢেঁকির আওয়াজ শুনি লু, লুটুঃক, লু, লুটুঃক। আমার মনের অবস্থাও লুটুঃক, লুটুঃক।।

গানটি আকাশবাণীর সাঁওতালি অনুষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা। লোককবি এখানে নিষ্ঠুর, রূঢ় বাস্তবকেই তাঁর গানের বিষয় বস্তু করেছেন। সাঁওতালদের মধ্যে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজার নিয়ম নেই। তাই গৃহকর্তা মেয়ের বয়স বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত হলেও বিয়ে দিতে পারছেন না। অন্যদিকে আবার সামর্থ্যের অভাবে ছেলেরও বিয়ে দিতে পারছেন না। এই রকম উভয় সংকটে পড়ে তাঁর মন প্রাণের যে কি অবস্থা তার কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মনের অবস্থা গ্রাম প্রধানদের ঢেঁকির আওয়াজের মতন লুটুঃক, লুটুঃক। গানটি Allegory বা রূপকের সুন্দর উদাহরণ।

(২)

সেদায় আকালদ
নাসে নাসে দঞ দিশায় গেয়া।।
সিঞ দলে জমা সিঁজ বিলি
ঞিদা দলে জমা মাতকম লাঠে।

অর্থাৎ, ‘সেদিনের দুর্ভিক্ষের কথা
আজো একটু একটু মনে পড়ে।।
দিনের বেলার আহার পাকা বেল,
আর মহুয়া ফুলের তৈরি মণ্ডা রাতের আহার।।

দুর্ভিক্ষের ছবি কথাকটির মার প্যাঁচে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। মাতকম লাঠে মহুয়া ফুলকে শুকনো করে তৈরি হয়। নেহাত অভাবে না পড়লে এমন খাবার কেউ খায় না।

(৩)

ইঞ লেকা গাড়ি রড়মে লান্দায়মে
আম সালাঃ গাডিঞ অডক চালাঃক।।

অর্থাৎ, আমার মতন গাড়ি কথা বল হাসো
তবেই তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাব।

ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়। তারপরে একদিন (১৮৫৪) সেই রেল লাইনের উপর দিয়ে রেল গাড়ি ছুটতে শুরু করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন রেল লাইনের উপর দিয়ে গাড়ি ছুটতে দেখে বিমূঢ় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা সাময়িক। ঘোর কাটতেই সে তার অসারতা উপলব্ধি করে তাকে বিদ্রুপ করতে শুরু করে।

সহরায় সেরেঞ

‘পুরুলিয়া বাজাররে হড় কড়া সিপাহি
ইঞদ আয়ো জাতিঞ ঘুচাও কেৎ।।
ইঞ এতুমতেদ আয়ো নাইকপে ধুবি কপে
ইঞ ঞতুমতেদ আয়ো কাজ কামায় পে।।‘

অর্থাৎ, ‘পুরুলিয়া বাজারে, মা, পুলিশের কাজ করতে এসে, মা আমার জাত চলে গেল।‘

‘আমার নামে মাগো নাপিত ডাকো ধোবি ডাকো
আমার নামে শ্রাদ্ধ শান্তি কর।।‘

উপরোক্ত সহরায় গানটি কঠিন কঠোর সামাজিক নিয়ম কানুনকে অবলম্বন করে রচিত। সাঁওতালদের মধ্যে পরিবারের কেউ জাতিচ্যুত হলে তার নামে শ্রাদ্ধ শান্তি করতে হয। এখানে সে কথাই বলা হয়েছে। জাতিচ্যুত ব্যক্তি সে কথা জানে বলেই তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে মা পুরুলিয়ায় চাকরি করতে এসে আমার পদস্খলন হয়েছে, সমাজের রিলামালা (জলবৎ তরঙ্গ) নিয়ম ভেঙ্গেছি। তাই আমার অনুরোধ, ধোবা নাপিত ডেকে যেন আমার শ্রাদ্ধ শান্তি করা হয়। উপরোক্ত গানগুলির মোটামুটি একটি বঙ্গানুবাদ দেওয়া হল। কিন্তু গানের অন্তর্নিহিত ভাবকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হলে সাঁওতালি জানা দরকার। এ সব গানের মূল্য অপরিসীম। এদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা অসম্ভব। কারণ সাঁওতালদের মধ্যে সঙ্গীত শিক্ষার আসর বলতে যে শিক্ষাকেন্দ্র বোঝায় তা অতীতেও ছিল না এখনো নেই। লোককবিরা এসব গান রচনা করতেন, নাচগানের আসরে গাইতেন এবং লোকজনকে আনন্দ দিতেন। তবে যে কোনো একজন শ্রোতার পক্ষে মাত্র একবার শুনে সব গান মনে রাখা মুসকিল তা সে স্মরণশক্তি যাই হোক না কেন। দু একটা Common গান হয়ত আছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, হরেক রকমের অসংখ্য গানই অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামে গঞ্জে একসময় বিদ্যমান ছিল। এদের বেশির ভাগটিই এখন মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছে। ইদানীং অবশ্য কেউ কেউ ‘Old is gold’ ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’ বুঝতে পেরে পুরানো গান সংগ্রহ করবার চেষ্টা করছেন, লিপিবদ্ধ করে ব্যাপক অংশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। তাদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। তবে অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটুকু বলতে পারি, সাঁওতালি লোকসঙ্গীত, বাজনা এবং নাচের আদব কায়দা সব জায়গায় এক নয়। এ সব গান যে সব জায়গা থেকে সংগৃহীত হচ্ছে সে সব গান বাজনা সেই সব জায়গার নিজস্ব। সেগুলিকে সবার বলে পরিচয় দেওয়া অনুচিত বলেই মনে করি।

Phrase (বাগধারা)

(১) বেঁগাড় কচা—(গোপন শলা পরামর্শ

(২) সের চাওলে—(আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া)

(৩) সারদি এনেচ রেগে তুমাদাঃক রাপুৎ এনা—(চরম ওঠার পরে হঠাৎ পড়ে যাওয়া)

(৪) বুরসি সেঙ্গেল–(তুষের আগুন

(৫) লাটিচ—(লোকের কাছে বলে বেড়ানো)

(৬) লপং টুটি—(বুড়ো আঙুল দেখানো)

(৭) সাতে লাতার—(আশ্রয়হীন)

(৮) তাহেন রেদ হাটাঃক হাটাঃক বাংরেদ মাটাঃক মাটাঃক (বেহিসেবী) (৯) লহৎ বড়(কুঁড়ে, অলস)

হারাধন অধিকারীর সৌজন্যে

(১) অকা লেকাম এরা অনালেকাম ইরা—(যেমন কর্ম তেমনি ফল)

(২) অডাঃকতে পাই বল লেনখান বাং ওডোঃক আ~(ঋণ নিলে একবার পরিশোধ হয় না আর

(৩) আপনারাঃক জমতে বির হাতী লাগা— (ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো)

(৪) একেন ঠিলিদ সাড়ে গেয়া—(ফৌপরা ঢেঁকির শব্দ বেশি)

(৫) কাথাগে তাঁহেনা হড়দ বাং–(মানুষ চিরদিন থাকে না, বচন থাকে)

(৬) কাড়া, হাপাদ মিৎ ছটগেয় আদা—(ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, অন্ধ একবারই লাঠি হারায়)

(৭) জানুমতে জানুমগে সাহা হুয়ুঃকআ (কাঁটায় কাঁটা তোলা)

(৮) টাকা খান বাহু, দাকা খান কাহু—(ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না)

(৯) ঢিঙ্কি বুটাম সেনঃক রেসে লুবুঃক খদেম জ্ঞাম—(কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *