সহ অভিনেত্রীর কাঁচি !
কাঁচকাটা হীরে’র পর ‘কেদার রাজা’। পিঠোপিঠি দুটো ছবি। ‘কেদার রাজা’র ডিরেক্টর হিসেবে নাম ছিল বলাই সেনের। আসলে পুরো কাজটাই করেছিলেন তপনদা। তপনদা তখন তাঁর স্নেহের পাত্র বলাইকে টেনে তোলবার খুব চেষ্টা করছেন। কিন্তু বলাই অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেই স্বচ্ছন্দ্য। তপনদা হাজার চেষ্টা করেও বলাইকে ডিরেক্টর করে তুলতে পারেনি।
ছবিটায় প্রচুর আউটডোর ছিল। শুটিং হয়েছিল মেদিনীপুরে। আউটডোরে আমরা ছিলাম শমিত ভঞ্জের বাড়িতে। ও তখনও ইন্ডাস্ট্রিতে আসেনি। সম্পূর্ণ অচেনা মুখ। ‘কেদার রাজা’র সূত্রেই তপনদার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। মেদিনীপুরে তখন চাঁদি ফাটানো গরম। তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তার মধ্যে আমার চরিত্রটি ছিল বাল্যবিধবার। খালি পায়ে শুটিং করতে হত। শুটিং এর আগে মেঝেতে জল ঢেলে দেওয়া হত। তাতেও কোন কাজ হত না। পা ফেললেই পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। আমার সানস্ট্রোক হয়ে গেল। ডাক্তার এসে বললেন- ”এই গরমে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, আর আপনারা শুটিং করছেন! সানস্ট্রোক হওয়াটাই স্বাভাবিক”।
সানস্ট্রোক তো হলোই, সঙ্গে ধূম জ্বর। সেই অবস্থাতেই তপনদা, বলাইদা দুজনে মিলে বলে কিনা- ”লক্ষীটি, একটাই মাত্র শট বাকি। এরপর সন্ধে হয়ে যাবে। আলো থাকবে না। চল মা শুটিংটা সেরে আসি। হয়ে গেলেই তোকে ডাবের জল খাওয়াবো”।
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। এরা কী মানুষ! যদিও পরে বুঝেছি টাইট শিডিউল, সময়ে শুটিং শেষ না হলে হাজারটা ঝঞ্ঝাট। সেই চিন্তায় ওরা অস্থির ছিল।
‘কেদার রাজা’য় একটা ছোট পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্র ছিল। বলাই সেন আর অজিত তো বন্ধু। বলাইদা ওকে চেপে ধরলো।
”এই ছোট্ট রোলটা তোমাকে করে দিতেই হবে”। ও রাজি হয়নি। বলেছিল- ”এক বাড়ি থেকে দু’জন সিনেমায় নামলে আর রক্ষে নেই”। বলাই সেনের আগে একবার অরুন্ধতি দেবীও খুব চেষ্টা করেছিলেন। তবু কিছুতেই ওঁকে সিনেমায় নামানো যায়নি। পরে অজিতের কথাতেই চরিত্রটায় বুবুকে নেওয়া হয়। বুবু মানে আমাদের শমিত ভঞ্জ। বুবুর সেই শুরু। পরে তপনদার ‘আপনজন’-এ বুবু মূল চরিত্রে অভিনয় করলো। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্ডাস্ট্রির নামজাদা অ্যাক্টর হয়ে উঠলো। ওঁর মধ্যেও দেখেছিলাম উষ্ণ আবেগ। জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা বুবুকে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। বুবু ছিল ভীষণ আন্তরিক। ওর অকালে চলে যাওয়াটা আমাকে বড় কষ্ট দেয়। ‘কেদার রাজা’র আগে আমার সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছিল। ছবির নামটা ঠিক মনে নেই। শুভেন্দুদা ছিলেন হিরো। পার্থপ্রতিম চৌধুরী ডিরেক্টর। ওঁরা জানতো আমি ‘কেদার রাজা’র আউটডোরে আছি। হঠাৎ আউটডোরে প্রোডাকশন ম্যানেজারকে দিয়ে খবর পাঠালো পরের দিনই শুটিং শুরু। আমাকে যেতে হবে। বললাম- কী করে সম্ভব! আমার এখানে আউটডোর চলছে। তোমরা তো আগে থেকে ডেট নাওনি। এভাবে আমি যেতে পারবো না। কথাগুলো ওঁদের বলতে বলতেই ভাবছিলাম, কেন এমন হল! আগে থেকে ডেট না নিয়ে হঠাৎ খবর পাঠানোর মধ্যে একটা অসম্মানের ব্যাপার তো ছিলই, আরও অন্য কিছুও কী ছিল! মন বড় ভার হয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম পুরো ব্যাপারটাই ছিল পরিকল্পনা মাফিক। আমি যে শুটিং ছেড়ে আসতে পারবো না, সেটা ওরা আগে থেকেই জানতো। পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর অনিচ্ছাতেই আমাকে বাদ দেওয়া হয়। আসলে পার্থপ্রতিমের সঙ্গে অপর্ণা সেনের তখন খুব মাখোমাখো সম্পর্ক। ফ্লোরে ওদের নিয়ে রোজ নিত্যনতুন গসিপ ছিল বাঁধা। অপর্ণাকে নেবে বলেই আমাকে একরকম প্ল্যান করে বাদ দেওয়া হল। প্রোডিউসার আমাকে অ্যাডভান্স করে দিয়েছিলেন। বলেছিলাম টাকা ফিরিয়ে দেবো। উনি নেননি। শুধু নীচু স্বরে বলেছিলেন- ভুলটা তো আপনার নয়। ভুলটা আমাদের। ও টাকা আমি নিতে পারবো না।
এই সমস্ত কারণেই বোধহয় আজও টিকে আছি। সমসাময়িক কেউ কেউ অভিনয়ে কল্কে না-পেয়ে রাজনীতিতে মাথা গলিয়েছে। কাউকে এই শেষ বয়সে রোলের জন্য মাথা নোয়াতে হয়। অনেকে বাড়িতে বসে থেকে থেকে হতাশ। তাদের সকলের জন্য আমার সমবেদনা রইল।