সহযাত্রী
ত্রিদিববাবুর সাধারণত একটা হালকা বই পড়েই সময়টা কেটে যায়। কলকাতা থেকে দিল্লি ট্রেনে যাওয়া। কাজের জন্যই যেতে হয় দু মাসে অন্তত একবার। একটা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মচারী তিনি, হেড আপিস দিল্লিতে। প্লেনটা একদম পছন্দ করেন না ত্রিদিববাবু, অতীতে একবার ল্যান্ডিং-এর সময় কানে তালা লেগে গিয়েছিল, সেই তালা ছাড়াতে তাঁকে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়েছিল। সেই থেকে তিনি ট্রেনেই যাতায়াত করছেন। কলকাতায় তাঁর বাড়িতে খালি তাঁর স্ত্রী আছেন। একটিমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে গত মাসে, ছেলে আমেরিকায় বায়ো কেমিস্ট্রি পড়ছে। আপিস আর বাড়ি, এই দুটোর মধ্যেই ত্রিদিববাবুর গতিবিধি। অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে বিশেষ কেউ নেই, তবে কাছেই রডন স্ট্রিটের চৌধুরীরা স্বামীস্ত্রীতে মাঝে মাঝে আসেন গল্পগুজব করতে, ত্রিদিববাবুরাও তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যান।
হাতের বইটা বন্ধ করে রেখে দিলেন ত্রিদিববাবু। একেবারে অপাঠ্য। এবারে হয়তো ঘুমিয়ে সময়টা কাটিয়ে দিতে হবে। ঘরে আরও তিনটি বার্থে তিনজন লোক, তার মধ্যে তাঁর পাশের লোয়ার বার্থের ভদ্রলোকটি ছাড়া অন্য দুজনেই অবাঙালি। বইটা রেখে ত্রিদিববাবু তাঁর পাশের বার্থের দিকেই চেয়ে ছিলেন; তার ফলে বাঙালি ভদ্রলোকটির সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেল। মোটামুটি তাঁরই বয়সী হবেন, মাঝারি রঙ, চুলে এর মধ্যেই অল্প পাক ধরেছে। ভদ্রলোক বোধহয় আলাপের জন্য উৎসুক হয়েছিলেন, কারণ দৃষ্টি বিনিময় হতেই তিনি একটা প্রশ্ন করে বসলেন।
আপনি দিল্লিতে থাকবেন কদিন?
ত্রিদিববাবুর কথা বলতে আপত্তি নেই, কারণ সত্যি বলতে কী তাঁর এখন আর কিছু করার নেই। বললেন, দুদিন। বুধবার ফিরে আসব।
আমারও ঠিক একই ব্যাপার। আপনি কোনও মিটিং অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছেন কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমিও একই ব্যাপারে। আমার হল বিজ্ঞাপনের কারবার। দিল্লিতে হেড আপিস। আমাদের আপিসের নাম শুনে থাকতে পারেন। এভারেস্ট অ্যাডভারটাইজিং।
হ্যাঁ। শুনেছি। আমার এক শালা এক সময় ওখানে চাকরি করত।
আই সি। কী নাম বলুন তো?
অমরেশ চ্যাটার্জি।
বাঃ–তাকে তো খুব চিনতুম। সে দিব্যি ছিল–বেশ করিৎকর্মা ছেলে। বেটার অফার পেয়ে চলে গেল। ইয়ে, আমার নামটা আপনাকে বলা হয়নি। সঞ্জয় লাহিড়ী।
ও। আমার নাম ত্রিদিব ব্যানার্জি।
আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল।
তা হতে পারে।
আপনি কি গান বাজনা শুনতে যান?
তা ওস্তাদি গান বাজনা, মাঝে মাঝে যাই।
গতমাসে কলামন্দিরে গেলেন কি–আমজাদ খাঁর সরোদ শুনতে?
হ্যাঁ, তা গিয়েছিলাম বটে। আপনিও গিয়েছিলেন বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওখানেই দেখেছি। খাসা বাজিয়েছিল সেদিন।
হ্যাঁ। আমজাদ তো আজকাল ভালই বাজাচ্ছে।
এখন ডিভিওর দৌলতে তো সিনেমা যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে, গান বাজনা শুনতেই যাই মাঝে মাঝে।
তা ছাড়া সিনেমা গেলেও, হাউসের যা দুর্দশা, মাটিতে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভ্যাপসা গরম…
যা বলেছেন। অথচ ইয়াং বয়সের লাইটহাউস, মেট্রোর কথা ভেবে দেখুন।
ওসব দিন চলে গেছে।
মনে আছে কলেজ থেকে মাঝে মাঝে চলে আসতুম চৌরঙ্গি। মেট্রোর সামনে গিয়ে দাঁড়াতুম। ঠাণ্ডায় প্রাণটা জুড়িয়ে যেত।
আমারও ওই হ্যাবিট ছিল।
ঠাণ্ডা বলতে মনে পড়ল–দার্জিলিং আর সে দার্জিলিং নেই।
জানি। সেই জন্যে তো এবার আমরা মানালি গেলাম। আগে তিন বছরে অন্তত দুবার করে দার্জিলিং যেতাম।
আমরাও। কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দৃশ্য তো আর কোথাও নেই। ওই একটা জিনিস পুরনো হবার নয়।
আর আধুনিক সভ্যতাও ওর কোনও পরিবর্তন করতে পারবে না।
মোগলসরাইতে দুজন ভাঁড়ে চা খেলেন। কথা আরও চলল। ত্রিদিববাবুর বেশ লাগছিল সঞ্জয়বাবুকে। তা ছাড়া কিছু কিছু মিলও বেরিয়ে যাচ্ছিল দুজনের মধ্যে, তাতে আলাপটা জমতে সুবিধে হচ্ছিল। সন্ধের দিকে সঞ্জয়বাবু বললেন, একটা আসল প্রশ্নই করা হয়নি। আপনি থাকেন কোথায়?
লী রোড।
কত নম্বর লী রোড? তিন নম্বরে আমার এক পাঞ্জাবি বন্ধু থাকে।
আমার বাড়ির নম্বর সেভেন বাই ওয়ান।
দাঁড়ান, আমি ডায়রিতে নোট করে নিচ্ছি। কলকাতায় ফিরে গিয়েও আলাপটা চালু রাখবার ইচ্ছে হতে পারে।
তা তো বটেই।
দিল্লিতে এসে অবশ্য দুজনে যে যার পথ ধরলেন। দুজনেই হোটেলে থাকবেন, তবে দুই হোটেলে দুস্তর ব্যবধান। সঞ্জয়বাবু একটা ট্যাক্সিতে চাপবার আগে হাত নেড়ে বলে গেলেন, আশাকরি কলকাতায় গিয়েও দেখা হবে।
.
দিল্লির মিটিং সেরে কলকাতায় ফিরে এসে ত্রিদিববাবু তাঁর কাজের বাঁধা ছকের মধ্যে পড়ে গেলেন। স্ত্রী শিপ্রাকে একবার সঞ্জয়বাবুর কথা উল্লেখ করেছিলেন। এইসব আলাপগুলো ভারী মজার, বলেছিলেন ত্রিদিববাবু, ওই একটি দিনের জন্য ব্যস। কিন্তু ওই একদিনেই কত কথা, কত আলোচনা। তারপর যে যার নিজের জগতে চলে যাও। দ্বিতীয়বার আর দেখা হয় না।
ত্রিদিববাবু কিন্তু কথাটা ঠিক বলেননি, কারণ কলকাতায় ফেরার তিন সপ্তাহের মধ্যেই সঞ্জয়বাবু এক রবিবারের সন্ধ্যায় এসে হাজির, হাতে বাক্সে মিষ্টি।
দেখলেন তো, আলাপটাকে গেঁজে যেতে দিলুম না। ভাল আছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ–আসুন বসুন। টিভিতে একটা ভাল প্রোগ্রাম ছিল, কিন্তু ত্রিদিববাবুর তাতে আক্ষেপ নেই, কারণ সঞ্জয় লাহিড়ীর আসাটা তিনি পছন্দই করলেন। ত্রিদিববাবু বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন সঞ্জয়বাবুকে।
আজ থেকে তুমিতে চলে গেলে হত না? বললেন সঞ্জয় লাহিড়ী।
তাতে আমার কোনই আপত্তি নেই।
ভেরি গুড। বেশ বাড়ি তোমার। কদিন আছ এখানে?
বছর সাতেক হল। তুমি থাকো কোথায়?
এখান থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়। মিডলটন রো–পঁচিশ নম্বর।
আই সি।
আসছে শনিবার যাচ্ছ কি?
রবীন্দ্রসদনে? ত্রিদিববাবু জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। ভীমসেন যোশীর গান আর চৌরাসিয়ার বাঁশি।
ইচ্ছে তো আছে যাবার। উদ্যোক্তারা দুখানা টিকিটও পাঠিয়েছেন।
চলো, আর তারপর চলো ক্যালকাটা ক্লাবে খাওয়া যাক–আমরা চারজনে।
আমি তো মেম্বার নই, বললেন ত্রিদিববাবু।
তাতে কী হয়েছে? তোমরা যাবে আমার গেস্ট হয়ে।
তা বেশ তো। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
তুমি এখনও মেম্বার হওনি কেন? এই বেলা হয়ে পড়ো–দেখবে হয়তো অনেক পুরনো বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে যাবে।
তা তো হতেই পারে।
আমার তো তাই হল। তিন-তিনজন স্কুলের বন্ধু। ত্রিশ বছর পর দেখা। আমরা হচ্ছি নাইনটিন সিক্সটির ব্যাচ। মিত্র ইনস্টিটিউশন। সেই সব পুরনো দিনের পুরনো শিক্ষকদের কথা হচ্ছিল।
আরও মিনিট পনেরো থেকে কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম, লোডশেডিং ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে ত্রিদিববাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে চা খেয়ে সঞ্জয়বাবু উঠে পড়লেন।
আমার আবার ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তোমার বাড়ি পথে পড়ল, তাই একবার না এসে পারলুম না। এবার কিন্তু ভাই তোমার আসার পালা–পঁচিশ নম্বর মিডলটন রো। না এলে আমি আর আসছি না।
নিশ্চয়ই যাব।
আসি তা হলে—
গুড নাইট।
ত্রিদিববাবু দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বসবার ঘরে ফিরে এলেন। আশ্চর্য! তাঁর এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনিও যে ওই একই স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। সঞ্জয় ওরফে ফটিক লাহিড়ী ছিল ক্লাসের পয়লা নম্বর বিচ্ছু, আর ত্রিদিব ব্যানার্জির পরম শত্রু, কারণ ত্রিদিব ওরফে দিবু ছিলেন ভাল ছেলের দলে। কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে ফটিকের। এর সঙ্গে কি বন্ধুত্ব করা যায়? বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ত্রিদিববাবু স্থির করলেন যে সঞ্জয় আজ আর সেই সঞ্জয় নেই, একেবারে সভ্যভব্য নতুন মানুষ হয়ে গেছে। আর তাকে যখন ত্রিদিববাবুর ভালই লেগেছে, তখন বন্ধুত্বতে কোনও আপত্তি নেই। তবে এটা ঠিক যে ত্রিদিব কখনও বলবেন না যে তিনি সঞ্জয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন। সেই অতীতকে চাপা রাখাই ভাল, আজ যেটা সত্যি সেটাকেই মানতে হবে।
ত্রিদিববাবু টিভিটা চালু করে দিলেন।
আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৪০২ রচনাকাল: ১২ জুন, ১৯৮৯
———–
সন্দেশ পত্রিকায় নতুন বন্ধু নামে বাবার একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে। আর তার ঠিক দেড় বছর পরের এক খসড়া খাত থেকে বেরোল সহযাত্রী। একই চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এই দ্বিতীয় গল্পটি লেখার কারণ যে কী হতে পারে, তা আজ অনুমান করা কঠিন। হয়তো লেখার সময় প্রথমটির কথা উনি ভুলে গিয়েছিলেন, এবং ফেয়ার করতে গিয়ে হঠাৎই মনে পড়ে যায়। সেইজন্যই বোধহয় সহযাত্রী অপ্রকাশিত থেকে গেছে।
সন্দীপ রায়
২৭.৭.৯৫