দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

সহবাস

সহবাস

খাঁসাহেব গান ধরেছেন, দমদমের বাগান বাড়িতে। সেকালের কালে খাঁ, একালের আমীর খাঁ সাহেব নন। বাঙালি ক্ল্যাসিকাল খাঁ। মার্গ সংগীতের শুকনো বাগানে শেষ কয়েকটি বুলবুলের একটি। ভালো তালিম, শ্লেষ্মাহীন গলা, সঠিক লয়কারি, শুদ্ধ সরগম, বিশুদ্ধ পাঞ্জাবি, শাস্ত্রীয় পাজামা। সন্ধের মুখটায় শিল্পী পুরিয়া ধরেছেন। শ্রোতা, কিছু প্রাচীন অ্যারিস্টোক্র্যাট, কিছু আধুনিক—দলছাড়া বাছুর (ড্রপ আউটস), গৃহস্বামী ও তাঁর বিবাহযোগ্য কন্যা।

শিল্পী বেশ জমিয়ে বসেছেন। তানপুরা মিঠিমিঠি বাজছে। হারমোনিয়ামে আঙটি পরা আঙুল, নর্তকীর চপল পায়ের মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে উটছে। তবলচির হাত তবলার ওপর নিসপিস নিসপিস করছে। এক ঝলক সুর ঘরে লুটিয়ে দিয়ে, ওস্তাদ পরের ঝলকটি গলা ঝেড়ে বের করার জন্যে বেশ বড় সাইজের একটি হাঁ করেছেন এবং তৎক্ষণাৎ। সুর নয়, অসুর। দমফাটানো ঘর-ফাটানো কাশি, কাশির পর কাশি। একটা বেরোল, দুটো বেরোল। এক ব্যাটেলিয়ান ঢুকেছিল। সব কি আর বেরোল! কিছু সোজা ফুসফুসে গিয়ে আটকে রইল।

এক গেলাস জল খান ওস্তাদজি। আরে না না, জল খাবেন কি! মশা তো আর ভিটামিন ক্যাপসুল নয়, জল দিয়ে গিলে ফেলবেন! মসকুইটো ভয়ানক ডেনজারাস জিনিস, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, এনকেফেলাসটিস। কেশে কেশেই বের করে ফেলতে হবে, বাবাজি। বাইরে গিয়ে সেই চেষ্টাই করো। ওরে বাপরে, বুকটা ভীসণ ঝাঁঝাঁ করছে! মশার কী রকম টেস্ট মশাই? একটু নোনতা, ঈষৎ টকটক? মানে, র‌্যাসপবেরি, স্ট্রবেরির মতো কি? বলতে পারব না, আজ্ঞে ওসব বিদেশি ফল চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে ট্যাঁপরির মতো হতে পারে। ও ইয়েস গুজবেরি, গুজবেরি। আমি যখন ফ্রানসে ছিলুম, তখন স্ট্র র‌্যাসপ গুজ। আরে রাখো তোমার ফ্রান্স, বসে আছ দমদমে, চুলকে চুলকে পশ্চাদ্দেশ ফুলে গেল, র‌্যাসপবরি, স্ট্রবেরি।

গৃহস্বামী বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ওস্তাদকে কাশিয়ে এলেন—ছিছি, কী লজ্জা বলুন তো। মানুষ চাঁদে চলে গেল, আর আমরা, আমরা এই মশার উৎপাত কমাতে পারলুম না। একটু কাশির ওষুধ খাবেন, ওস্তাদজি? কাশির ওষুধে কী হবে, খেতে হলে মশা-মারা ওষুধ খেতে হয়। গৃহস্বামী সবিনয়ে বললেন, বাড়িতে একটি মাত্র বড় মশারি, সেইটাই খাটিয়ে দি, ওস্তাদজি দলবল নিয়ে ভেতরে বসুন, ওনার তো মুখ খোলার কাজ, আমরা বরং মুখ বুজিয়ে বাইরেই বসি, তালে তালে হাত-পা নাড়ি, শরীর চাবড়াই।

ত্রৈলোক্যবাবুর ডমরুধর, সুন্দরবনের আবাদে গিয়ে চড়াই পাখির মতো বড়, ঝাঁকঝাঁক মশা দেখেছিলেন। মশাদের পরস্পরের কথাও শুনেছিলেন। মশারা সব বাবু ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, ও আমার বাবু, ও তোমার বাবু। খাস কলকাতার মানুষ এখন মশাদের প্রজা। মসকুইটো কিংডামে কত সুখ! মশার কামড় একটু সহ্য হয়ে গেলে, মন্দ লাগে না। লঙ্কা ঝাল বলেই তো তার আদর। নারী মুখরা বলেই না এত প্রেম! মউমাছির হুল বলেই না চাকে এত মধু! দংশনের একটা স্বাদ আছে, তার আছে, অ্যালকহলের মতো! মশা কামড়ালেই চুলকোতে থাকি, জায়গাটা আস্তে আস্তে ফুলতে থাকে। তারপর। যেকোনও ফুলো জায়গায় হাত বুলোতে ভীষণ মজা লাগে।

উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম মধ্য-কলকাতার সর্বত্রই মশক-বাহিনী মার্চ করছে। কলকাতা করপোরেশানের স্বাস্থ্য দপ্তরের সৈনিকরা, সরকারের ম্যালেরিয়া দমনের ডি ডি টি বাহিনী বিনাযুদ্ধে এই শহর ‘মসকুইটো স্কোয়ড্রনের’ হাতে তুলে দিয়েছেন। দংশনহীন সন্ধ্যা, মশারিহীন মধুচন্দ্রিকা আর তো ভাবা যায় না, ভাবা যায় না।

গত বিশ বছরে মশাদের হালচাল স্ট্র্যাটেজি সব পালটে গেছে। মশাদের সৈন্য বাহিনীতে দুরকমের সৈনিক পাওয়া যাবে। একদল ফিনফিনে গাইয়ে ধরনের, যাদের আক্রমণের ধরনটাই হল—’হিট অ্যান্ড রান।’ এরা বোধ হয় স্ত্রী-মশা। কিছু-কিছু মহিলার চেহারা ছিপছিপে, রুক্ষ-রুক্ষ, সূক্ষ্ম মিহি গলা, আর কথা বলার সময় কখন যে ঠুসঠাস চড় মেরে, চিমটি কেটে বসবেন, সাবধান হওয়ার সময়ই দেন না। স্বভাবের মিল দেখেই সিদ্ধান্ত।

আর এক শ্রেণির মশা হল, গাবদা-গোবদা কালচে, হাইপোডার্মিক নিডলের মতো হুল। মশারির বাইরে বসে টেনে-টেনে জাল ফাঁক করে সটাসট ঢুকে পড়তে পারে। আন্ডারওয়্যার, মোটা প্যান্ট, জামা আর গেঞ্জির স্যান্ডউইচ ভেদ করে নিমেষে হুল চালিয়ে শরীরের নরম জায়গা থেকে উষ্ণ তাজা রক্ত তুলে নিতে পারে। যেমন একগুঁয়ে তেমনি বলিষ্ঠ। লুকোচুরির ধার ধারে না। কানের কাছে অন্ধকারে পিনপিন, পিনপিন করে গান গেয়ে বলে না, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ঘুমিয়ে পড়ো শুষতে থাকি। চড়-চাপড় চালালে দু-একটাকে ঘায়েলও করা যায়।

ডি ডি টি, মবিল ইনসেকটিসাইডের, অপ্রচুর খামখেয়ালী প্রয়োগে ভেজাল-খেকো বাঙালির মতো একরোখা, কৌশলী হয়ে উঠেছে। প্রখরবুদ্ধি প্যারাসাইট। যে মানুষটি আহারে ব্যস্ত, মশা জানে, ব্যাটার ডান হাত কাবু, বুদ্ধি করে শরীরের বাঁ-দিকে কামড়াতে থাকি। শিরদাঁড়া ধরে পিঠের বাঁ-দিকে এমন একটা স্থান বেছেনি, যেখানে এঁটো ডান হাত পৌঁছোবে না। অহঙ্কারী মানব, তুমি কি অসহায়! মিহি গলায় স্ত্রীকে ডাকো, মিনু মিনু, উ হু হু হু, একটু চুলকে দাও, প্লিজ !

চুলকে দাও, প্লিইজ ! দাঁত খিঁচোবার সময় মনে থাকে না। পারব না, যাও।

মিনু, প্লিইজ ! কোনখানটা বলো। আর একটু নীচে, একটু বাঁ-দিক ঘেঁষে উঁ হুঁ হুঁ হুঁ একটু ওপরে, থ্যাতরেরি ইডিয়েট। সরি! ইডিয়েট তুমি নয়—আমি, আমি ইডিয়েট, আমার চৌদ্দপুরুষ ইডিয়েট! হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই জায়গাটা। আস্তে আস্তে। চুলকোচ্ছো! না আঁচড়াচ্ছো, নখটাও কাটতে পারো না জানোয়ার, না না, তুমি না, আমি—আমি।

অপেক্ষা করে থাকি সেই জায়গায়, যেখানে মানুষকে নগ্ন হতেই হবে। তারপর তীরের মতো দংশন। বড় সায়েব, ছোট সায়েব, হালকা সায়েব, পাতলা সায়েব, রেহাই নেই, মুক্তি নেই। কামড়ে যাই, কামড়ে যাই।

নবারুণ গুপ্ত জার্মানি থেকে বিয়ে করে এনেছে জার্মান বউ।

সঙ্গে বছরতিনেক বয়সের ইন্দোজার্মান সন্তান তৈরি করে এনেছে। কলকাতার প্রথম রাতেই জার্মান ললনা নাইলেকস মশারি দেখেই লাফিয়ে উঠল, ডাসেল ডার্ফ ভন গুটেনবার্গ। হোয়াট ইজ দিস। তিন বছরের ছেলে ভয়ে সারা বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। জীবনে মশা দ্যাখেনি, কামড়ও খায়নি। চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে—মেফিসটোফিলিস, ড্রাকুলা, ড্রাকুলা। পরের দিনই লুফত-হানসা। নবারুনের বউ পালিয়েছে। সে এখন মসকুইটো প্রুফ বউ খুঁজছে। আইনজ্ঞের পরামর্শ নেবে কিনা ভাবছে। করপোরেশানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করবে।

হৃদয়বাবুর ইদানীং এমন অভ্যাস হয়েছে, বসলেই কদম কদম পা নাচাতে থাকেন। ভদ্রসমাজে আর মিশতে পারেন না। পংক্তি ভোজনের টেবিলে বসে পা নাচাচ্ছেন? মাটির নড়বড়ে জলের গেলাস টাল খেয়ে উলটে পড়ল। কী করছেন, মশাই! বাসের আসনে বসে পা নাচাচ্ছেন। সহযাত্রী বিরত হলেন, কী হচ্ছে মশাই! ব্যাড হ্যাবিট। ইঞ্জেকসান নিতে গিয়ে পা নাচাচ্ছেন। কমপাউন্ডার বললেন, ছুঁচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেলে আমি দায়ী নই। কেন এমন করেন হৃদয়বাবু! সাধে করি ভাই। রাতে টেবিলে বসে লেখাপড়া করতে হয়। অনেক দিনের অভ্যাস। ছুঁচ-ফোটানো মশা। পা নাচিয়ে তাড়াতে-তাড়াতে এই রকম নাচন-পা হয়ে গেছি।

বৃন্দাবনবাবু প্যারালিসিসে ছ-বছর শয্যাশায়ী। প্রথম-প্রথম সংসারের সেবা পেতেন। এখন আর তেমন আদর নেই। যে গরু দুধ দেয় না, তার আবার আদর কীসের। এক পাশে পড়ে থাকেন। সন্ধের অন্ধকার যত গাঢ় হতে থাকে, ঘরে মশার কীর্তন পার্টি তত জমে উঠতে থাকে। প্রথমে মশাদের নর্তন-কুর্দন, পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ওড়া, তারপর অসহায় বৃদ্ধের শরীর থেকে যেটুকু রক্ত পড়ে আছে, সেটুকু দিন-দিন শুষে নেওয়ার উল্লাস। বৃদ্ধ হাত-পা নাড়াতে পারেন না। অসাড় অংশে তেমন টের পান না। যেটুকু অংশে সাড় আছে লঙ্কাবাটার মতো জ্বলতে থাকে। ক্ষীণ গলায় ডাকতে থাকেন—বউমা, বউমা, মশারিটা। বউমা শুনেও শোনে না। থাকো ব্যাটা বুড়ো, খোলা পড়ে থাকো, রৌরব নামক নরকে। সুস্থ অবস্থায় বউমার পেছনে লাগবার শাস্তি! ছেলে এসে মশারি ফেলবে। কী আশ্চর্য! বৃদ্ধ ইদানীং একটু-একটু হাত-পা নাড়তে পারছেন। ডাক্তার বলছেন—আকুপাংচারে কাজ হচ্ছে। বউমার মহা আপশোশ। মন্দ করতে গিয়ে ভালো হয়ে গেল যে রে বাবা! এখন সারাদিনই মশারির ভেতর রাখে। বৃদ্ধ আগের চেয়ে জোর গলায় চিৎকার করেন—বউমা মশারিটা তুলে দিয়ে যাও। বউমা শুনেও শোনে না। ও ভুল আর করছি না, বাছাধন। তুমি খাড়া হলেই আগের মূর্তি ধরবে।

চিত্রার কাজ বেড়েছে। শোওয়ার আগে, মশারির ভেতর হাঁটু গেড়ে বসে লাফিয়ে- লাফিয়ে মশা মারে একটা-একটা করে। চিত্রা বলে, কামড় তবু সহ্য করা যায় কিন্তু কানের কাছে সারারাত কালোয়াতি অসহ্য। রবির খুব মজা। শুয়ে-শুয়ে চিত্রার হাঁটুমোড়া হাত-তোলা নৃত্য দ্যাখে, আলো নেবার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে। অব্যর্থ ধূপ বের করেছেন, ভেষজ শাস্ত্র মন্থন করে অবিনাশবাবু। এক হাত লম্বা, মোটা কঞ্চির মতো মিশমিশে কালো বস্তু। বাল্যবন্ধু সুধাসিন্ধুকে একটি উপহার দিয়ে বলছেন—জ্বালিয়ে দেখো, মশারা সব গুলিলাগা প্লেনের মতো ঘুরপাক খেতে-খেতে পড়বে। এক প্যাকেট দেশলাই ফাঁক, ধূপ আর জ্বলে না। সুধাবাবুর স্ত্রী বললেন, কেরোসিনে আগে চুবিয়ে নাও তবে যদি জ্বলে। অবশেষে ধূপ জ্বলল। এ ধূপ বসবে কিসে? সাধারণ ধূপদানিতে তো হবে না। আধখানা লাউছিল ঘরে, তাতেই গোঁজা হল। ধূপের যেমন আকৃতি তেমনি ধোঁয়া, তেমনি উৎকট গন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুধাসিন্ধু সপরিবারে রাস্তার খোলা হাওয়ায়। অবিনাশ বললেন, মাই পারপাস ইজ সার্ভড। মশা কিন্তু ভাই একটাও মরেনি। ঘরের মধ্যে যেমন ভ্যানভ্যান করে তেমনি করেছে মহা উল্লাসে। তাতে কি! মশা থেকে তোমাকে দূরে রাখতে পেরেছি, সেইটাই তো আমার সাকসেস হে!

মেয়র সাহেব! কলকাতার মশা যে আপনার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কলকাতবাসীকে এই ত্রাসের হাত থেকে রক্ষার কোনও উপায় আপনার জানা নেই?

আছে। আছে! নিশ্চয়ই আছে। কী উপায় স্যার! প্রাকৃতিক উপায়। ঘরে ঘরে কোলাব্যাঙের চাষ করান। জানেন নিশ্চয়ই ব্যাং মশা খায়। সারা ঘরে কেঁদো কেঁদো ব্যাং থপথপ করে ঘুরবে আর কপাক করে মশা ধরবে। ব্যাং একটু পোষ মেনে গেলে মশারির মধ্যে নিয়েও শুতে পারেন।

সেকি মশাই! আজ্ঞে হ্যাঁ, মশাই। মোটা বউ নিয়ে শুতে পারেন, কোলাব্যাং নিয়ে শুতে পারবেন না! ব্যাঙ এমন কিছু খারাপ শয্যাসঙ্গিনী নয়, মাঝে-মাঝে একটু জলত্যাগ করে—এই যা, আর বর্ষাকালে একটু ডাকাডাকি করে, তা মশাই, আপনার স্ত্রীর হাঁকডাকেরও কি কিছু কমতি আছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *