বিংশ পরিচ্ছেদ
পর দিবস ইনস্পেক্টর বাবুর খুন সম্বন্ধে যে যাহা জানিত তাহার এজাহার লইতে আরম্ভ করিলেন। প্রথমেই রমেন্দ্র বাবুর খানসামার এজাহার লইলেন। সে কিরূপে, কখন এবং কোথায় প্রভুর মৃতদেহ দেখিতে পাইয়াছিল একে একে তাহার সমস্তই বলিল। এই খানসামাটিকে রমেন্দ্রবাবু বিশেষ স্নেহ করিতেন, খানসামা প্রভুর মৃত্যুসম্বন্ধে এজাহার দিতে দিতে কাঁদিয়া ফেলিল, তাহার দুই গণ্ড বহিয়া ঝর ঝর করিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল।
রেলের ডাক্তারবাবু রমেন্দ্রবাবুর মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া-ছিলেন, তিনিও তথায় উপস্থিত ছিলেন। ইনস্পেক্টর বাবু তাঁহাকে কেমন করিয়া রমেন্দ্রবাবু হত হইলেন জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “কে পশ্চাৎ-দিক্ হইতে রমেন্দ্র বাবুর মাথায় মোটা শক্ত লাঠী মারিয়াছিল, সেই এক আঘাতেই তিনি ঘুরিয়া খানার ভিতর পড়িয়াছিলেন, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার মৃত্যু হইয়াছে।”
তথা হইতে ইনস্পেক্টর বাবু সতীশ বাবুর বাড়ী উপস্থিত হইলেন। তথায় যাইয়া তিনি সতীশ বাবুর দাস-দাসীদিগের মুখে শুনিলেন, যে রমেন্দ্র বাবু সে দিন রাত্রি আটটার সময় তথা হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। হেমাঙ্গিনীও সে কথা অস্বীকার করিল না। তাহাকে যখন ইনস্পেক্টর বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন তিনি সে দিনকার সমস্ত ঘটনা বলিয়া বলিলেন, “ডাক্তার বাবু প্রায় আটটার সময় এখান হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন।”
তাহার পর সুধাংশু এজাহার দিল। সে বলিল, “আমি রাত্রের ট্রেনে গিরিধী হইতে ফিরিয়া মধুপুর ষ্টেশন হইতে সতীশ দাদার বাড়ীতে আসিতেছিলাম, তখন রাত্রি বেশ গভীর হইয়াছিল, বোধ হয় একটা বাজিয়া গিয়াছিল। ডাক্তার রমেন্দ্র বাবুর বাটীর সম্মুখে আসিয়া দেখিলাম তাহার বাটীর দ্বারে বিস্তর লোক জড় হইয়া মহাহল্লা করিতেছে। আমি ব্যাপারটা কি জানিবার জন্য সেই ভিড়ের নিকট উপস্থিত হইলাম। একজনকে ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করায় সে বলিল,—“ডাক্তার বাবু খুন হইয়াছেন, তাহাকে কে খুন করিয়া পালাইয়াছে।” মধুপুরে নামিয়াই সহসা এই খুনের সংবাদ পাইয়া আমার মনটা যেন কেমন দমিয়া গেল, আমি বাড়ী পৌঁছিয়াই সমস্ত ব্যাপার সতীশ দা’কে বলিলাম। সেখানে বাড়ীর প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিল।”
পুত্র যাহা বলিল মাতাও সেই কথার সমর্থন করিলেন। ইনস্পেক্টর বাবু তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবামাত্র তিনি বলিলেন, “সুধাংশুর সে দিন আসিবার কথা ছিল না, সহসা সেই রাত্রে সুধাংশুকে আসিতে দেখিয়া আমার প্রাণটা ভয়ে ভাবনায় দুর দুর করিয়া কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। সে আসিয়া বলিল গিরিধীতে কাকাবাবু নাই, তাই আমি রাত্রের গাড়ীতেই ফিরিয়া আসিলাম। ষ্টেশন হইতে আসিতে আসিতে দেখিলাম, এখানে এক খুন হইয়াছে। সংবাদ লইয়া জানিলাম যিনি খুন হইয়াছেন, তিনি এখানকার একজন ডাক্তার নাম রমেন্দ্রনাথ ঘোষ। এখানে একটা খুন হইয়াছে শুনিয়া আমরা সকলে একেবারে ভয়ে কাট হইয়া গেলাম।”
পিসীমা নীরব হইবামাত্র ইনস্পেক্টর বাবু বেশ একটু বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু আপনি একথা প্রফুল্ল বাবুকে বলেন নাই? আপনি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, রমেন্দ্র বাবুর খুনের কথা সতীশ বাবুই আপনাদের প্রথম বলেন। আজ আবার এরূপ বলিবার কারণ কি?”
ইনস্পেক্টর বাবুর কথার উত্তরে পিসীমা বলিলেন, “দুইটা খুন হইয়াছিল তাহা আমি জানিতাম না। তাহার পর এই খুনের কথা শুনিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল। তা’ই আমার এ ভুল হইয়াছিল। তাহার পর যখন সুধাংশু আমার ভুল ভাঙ্গাইয়া দিল তখন মনে পড়িল খুনের কথা সুধাংশুই আসিয়া আমাদিগকে প্রথম বলিয়াছিল।”
সৰ্ব্ব শেষে সতীশচন্দ্র এজাহার দিলেন। তিনি বলিলেন, “আমি বাড়ীতে ফিরিবার সময় মনিয়া মালীর নিকটে শুনিয়াছিলাম, কে একজন খুন হইয়াছে, তাহার পর সুধাংশু আসিয়া ডাক্তারের খুনের কথা বলিল, কাজেই আমার কেমন গোলমাল হইয়া গিয়াছিল। আমার বরাবরই ধারণা ছিল যে মনিয়া মালীই আমায় ডাক্তারের খুনের কথা বলিয়াছিল। দুইটা খুন যে একরাত্রে হইয়াছে এ কথা আমি একেবারেই জানিতে পারি নাই, কাজেই এইরূপে ভুল করিয়াছিলাম।”
ইনস্পেক্টর বাবু যখন সতীশ বাবুর বাড়ীতে এজাহার লইতে আসিয়াছিলেন, তখন প্রফুল্ল বাবু প্রভৃতি কয়েকজন ভদ্রলোক তথায় উপস্থিত ছিলেন। ইনস্পেক্টর বাবু চলিয়া গেলে প্রফুল্লকুমার বাবু হাসিতে হাসিতে সতীশচন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি এক কথা আর মালী আর এক কথা বলায়, সত্য কথা বলিতে কি, আমাদের সকলেরই মন বড় বিপৰ্য্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এতক্ষণে বুঝিলাম তোমার এরূপ ভুল কেন হইয়াছিল। এরূপ অবস্থায় এরূপ ভুল হওয়া বিচিত্ৰ নহে। মধুপুরের ন্যায় সহরে একরাত্রে দুই দুইটা খুন হইতে পারে এ কথা কেহই সহজে ধারণা করিতে পারে না।”
সতীশচন্দ্র প্রফুল্লকুমারকে বাধা দিয়া বলিলেন, “মালীর কাছে শুনিলাম একটা খুন হইয়াছে, তাহার পর সুধাংশু আসিয়া বলিল, ডাক্তার বাবু খুন হইয়াছেন। তাহাতেই আমার মনে হইয়াছিল, মালীও ডাক্তার বাবুর নাম করিয়াছে। আবার একটা খুন যে হইয়াছে, বা হইতে পারে, তাহা একবারও আমার মনে হয় নাই।”
প্রফুল্লকুমারবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “সে যাহা হউক এত দিনে ব্যাপারটা যে পরিষ্কার হইল, ইহাতেই আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি।”
প্রফুল্ল নীরব হইলে সতীশচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুলিশ ডাক্তারের খুন সম্বন্ধে কি বলে? তাঁহারা কি বলে যে দোষাদদের দলের কেহ ডাক্তারকে খুন করে নাই?”
প্রফুল্ল বাবু বলিলেন, “হাঁ পুলিশ বলে যে, দোষাদদের দলের কাহারও ডাক্তারকে খুন করিবার কোন সম্ভাবনা দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না। তাহারা অর্থের জন্যই মানুষকে খুন করে, কিন্তু এ স্থলে ডাক্তারের টাকা কড়ি, ঘড়ী, ঘড়ীর চেন কিছুই খোয়া যায় নাই, সমস্তই ডাক্তারের মৃতদেহে পাওয়া গিয়াছে।”
সতীশচন্দ্র অন্যমনস্ক ভাবে বলিলেন, “তাহাতো নিশ্চয়ই! তবে ডাক্তারকে খুন করিল কে?” প্রফুল্লকুমার চিন্তিত ভাবে বলিলেন, “স্থানীয় পুলিশ তো কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। সতীশবাবু, আমরা এখানে সকলে চাঁদা করিয়া কিছু টাকা তুলিতেছি, যে ব্যক্তি ডাক্তার রমেন্দ্র বাবুর খুনের সন্ধান দিতে পারিবে আমরা তাহাকে সেই পুরস্কার দিব।”
সতীশচন্দ্র বেশ একটু আগ্রহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আমিও চাঁদা দিতে প্রস্তুত আছি। রমেন্দ্রবাবুর খুনী যাহাতে ধৃত হয় তাহার জন্য তোমরা আমাকে যাহা করিতে বলিবে, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি। বিশেষতঃ এই এক রাত্রে দুই দুইটা খুন হওয়াতে সকলেই অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িয়াছে। আমার স্ত্রী এত ভয় পাইয়াছে যে সে আর এখানে থাকিতে চাহিতেছে না। সে যা’ হউক, তোমরা কে কি চাঁদা দিতেছ?”
প্রফুল্লকুমার বাবু বলিলেন, “এখন বিশেষ কেহ কিছু দেয় নাই। তবে সকলে দশ দশ টাকা করিয়া দিয়া আমরা পাঁচশত টাকা তুলিব মনে করিতেছি।“
সতীশচন্দ্ৰ মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “পাঁচশত টাকা বিশেষ কিছু নহে, ইহাতে বিশেষ কোন কাজ হইবে বলিয়া আমার মনে হয় না।”
প্রফুল্লকুমার বাবু বলিলেন, “মধুপুরের ন্যায় এই ক্ষুদ্র সহরে পাঁচশত টাকা উঠানই শক্ত। ইহার অধিক উঠিবার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। তোমার নামে কত টাকা ফেলিব?”
সতীশচন্দ্রের কণ্ঠ হইতে একটা গম্ভীর স্বর বাহির হইল, “পাঁচ হাজার টাকা।”
পাঁচ হাজার টাকা! প্রফুল্লকুমার এবং তথায় অন্য যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা এই অপ্রত্যাশিত- পূর্ব্ব টাকার কথা শুনিয়া অতি বিস্মিত ভাবে সতীশচন্দ্রের মুখের দিকে চাহিলেন। রমেন্দ্র সতীশবাবুর কে যে তিনি তাহার জন্য এত টাকা ব্যয় করিতে প্রস্তুত!
সতীশচন্দ্র তাঁহাদের মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “পাঁচ হাজার টাকা বেশী কিছু নয়। ডাক্তার বাবুর খুনী যদি ইহাতে ধরা পড়ে, তাহা হইলে আমি অতি আনন্দের সহিত এ টাকা দিতে প্রস্তুত আছি।”
বেলা পড়িতেছে দেখিয়া প্রফুল্লকুমার ও অন্যান্য সকলে চলিয়া গেলেন। সতীশচন্দ্র সেই স্থানেই স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। তাঁহার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি ছিল না। সমস্ত সংসারটা যেন একটা গাঢ় অন্ধকারের ধোঁয়ার মত তাহার চক্ষের সম্মুখে ঘুরিতে লাগিল, তিনি চারিভিতে কেবল অপার অনন্ত সীমাহীন ভীষণ মহামরু দেখিতে পাইলেন।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
সতীশচন্দ্র যে কতক্ষণ বাহিরে বৈঠকখানাগৃহে বসিয়াছিলেন তাহা তাঁহার নিজেরই খেয়াল ছিল না। সহসা কি মনে হওয়ায় তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন ও ধীরে ধীরে ভিতর বাটীতে প্রবেশ করিলেন। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া শুনিলেন হেমাঙ্গিনী শয়ন গৃহে শুইয়া আছে, আজ একবারের জন্যও উঠে নাই, তাহার শরীর নিতান্ত অসুস্থ। সতীশচন্দ্র স্ত্রীকে দেখিবার জন্য ধীরে ধীরে শয়ন গৃহে প্রবেশ করিলেন। হেমাঙ্গিনী পালঙ্কের উপর আনমনে গবাক্ষের দিকে চাহিয়া শুইয়াছিল, স্বামীর পদ-শব্দে সে বেশ একটু বিচলিতভাবে দ্বারের দিকে চাহিল। সতীশচন্দ্রের দৃষ্টি পত্নীর মুখের উপর পড়িল। তিনি দেখিলেন তাহার সমস্ত মুখখানির উপর যেন একটা কাল বিষাদ-রেখা নিবিড় হইয়া উঠিয়াছে। তিনি ধীরে ধীরে পত্নীর নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুনিলাম সমস্ত দিন তুমি উঠ নাই, বিশেষ কোন অসুখ বিসুখ করে নাই ত?”
হেমাঙ্গিনী বিশুষ্ক পাণ্ডুর বিষাদ-ক্লিন্ন মুখে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চাহিল। সে দৃষ্টির প্রখরতা সতীশচন্দ্র সহ্য করিতে পারিলেন না, তিনি দৃষ্টি আনত করিলেন। হেমাঙ্গিনী কিছুক্ষণ সেই ভাবে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া সহসা বলিয়া ফেলিল,—”এখন তুমি কি করিবে স্থির করিতেছ? আমাকে স্পষ্ট ব’ল, আমার সমস্ত বুকটা ভাঙ্গিয়া চুরমার হইবার মত হইতেছে।”
সতীশচন্দ্র পত্নীর এ কথার অর্থ ভাল বুঝিতে পারিলেন না। হেমাঙ্গিনী সহসা তাঁহাকে এ প্রশ্ন করিল কেন? সতীশচন্দ্র একটা বিস্মিতির দৃষ্টি লইয়া কিছুক্ষণ পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তোমার এ কথার অর্থ আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না। ‘এখন তুমি কি করিবে স্থির করিয়াছ’ সহসা তোমার এ প্রশ্ন করিবার অর্থ কি?”
হেমাঙ্গিনী দাঁত দিয়া ঠোঁট চাপিয়া ধরিয়া নিজকে একটু সামলাইয়া লইয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, “অর্থ তো বেশ পরিষ্কারই রহিয়াছে? যাক্ বেশী কথায় কাজ নাই। আমি জানি রমেন্দ্রবাবুকে কে খুন করিয়াছে।”
পত্নীর এই কথায় একটা বিষাদ-হাসি সতীশচন্দ্রের সমস্ত মুখখানার উপর যেন বিদ্যুতের মত চমকাইয়া উঠিল। তিনি অতি সহজ কন্ঠে বলিলেন, “তুমি কিছুই জান না।”
হেমাঙ্গিনীর স্বর গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, সে সেই স্বরেই বলিল, “আমি তোমার সহিত তর্ক করিতে চাহি না, আমার আর সে ক্ষমতাও নাই। পিসীমা ও সুধাংশুও জানে রমেন্দ্রের খুনী কে। আর তাহার প্রমাণ এই ঘরেই আছে।”
পত্নীর কথায় সতীশচন্দ্রের সমস্ত মুখখানা একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল,—তিনি নিতান্ত বিচলিত কন্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “এখানে! সে কি?”
হেমাঙ্গিনীর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত বহিতেছিল, সে একটা বুক-ভাঙ্গা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তোমার সেই লাঠী—ভাঙ্গা লাঠী, আর তোমার রক্ত-জল-মাখা জামা কাপড়!”
পত্নীর কথায় ক্রোধে সতীশচন্দ্রের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলেন, তারপর অতি কঠোর কন্ঠে বলিলেন, “কে চুরি করিয়া আমার বাক্স খুলিয়াছিল?”
হেমাঙ্গিনী ধীরে, অতি গম্ভীর স্বরে বলিল, “আমি—আমিই খুলিয়াছিলাম। যাক্ সে কথা, তুমি খুনী! এক্ষণে আমি আর তোমার সহিত একত্র থাকিতে পারি না—থাকা অসম্ভব! আমার ছেলে মেয়ে না থাকিলে, অনেক পূৰ্ব্বেই আমি তোমার বাড়ী হইতে চলিয়া যাইতাম। তুমি আমার স্বামী,—তোমাকে আমি কিছুই বলিতে পারিব না। তবে তোমার নিকটে আমার কাতর মিনতি যত শীঘ্র সম্ভব তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও।”
স্তব্ধ হইয়া সতীশচন্দ্ৰ পত্নীর কথাগুলি শুনিতেছিলেন। তিনি একটু বিষাদহাসি হাসিয়া বলিলেন, “আগাগোড়া সমস্তই ভুল। হেম, বিবেচনা শক্তি হারাইও না।”
হেমাঙ্গিনীর গণ্ড বহিয়া অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছিল। সে জড়িত কণ্ঠে বলিল, “যাহা বলিতেছি শোন, যাও দেশে গিয়া থাক। আমি আমার ছেলে মেয়ে লইয়া বাপের বাড়ীতে থাকিব।”
সতীশচন্দ্র আবার বলিলেন, “হেম, বড়ই ভুল করিতেছ।”
“আমি মনে মনে ইহা স্থির করিয়াছি,—আমি—আমি—” হেমাঙ্গিনী কথা আর শেষ করিতে পারিল না, অশ্রুবেগে তাহার কন্ঠ-রোধ হইয়া আসিতেছিল, সে বালিশে মুখ লুকাইল। অনেকক্ষণ পরে অতি কাতর কন্ঠে বলিল, “আজ হইতে আমি জীবনৃতা—হৃতসর্বস্বা, নিরাশ্রয়া, এই বিশাল বিশ্বমধ্যে নিতান্ত একাকিনী, কখন তুমি ধরা পড়—কখন তোমার—উঃ কি সর্ব্বনাশ! “
হেমাঙ্গিনী আর বলিতে পারিল না, তাহার কন্ঠ কে যেন চাপিয়া ধরিল। সতীশচন্দ্ৰ বাধা দিয়া বলিলেন, “চুপ! তুমি যাহা ভাবিতেছ তাহা নহে—আমি খুন করি নাই-“
হেমাঙ্গিনী কাতর স্বরে বলিল,—”আমি—আমি–“
সতীশচন্দ্র বাধা দিয়া বলিলেন, “যাক্, এখন তোমার কথাই থাক। আজই তুমি এখান হইতে যাইতে চাও, না যতদিনের জন্য এ বাড়ী ভাড়া লওয়া হইয়াছে, ততদিন এখানে থাকিবে?
হেমাঙ্গিনী স্বামীর মুখের দিকে চাহিল, এত শীঘ্র যে তাহার স্বামী তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইবেন তাহা সে ভাবে নাই। সে কিয়ৎক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু অশ্রু তাহার কন্ঠ চাপিয়া ধরায় মুখ হইতে একটাও কথা বাহির হইল না। সে বিহ্বল দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সতীশচন্দ্র মৃদুস্বরে বলিলেন, “ব্যস্ত হইও না। সুধাংশু থাকিল, পিসীমা থাকিলেন—লোকজন সবই রহিল। যতদিন বাড়ী ভাড়া আছে ততদিন তুমি এই খানেই থাক। আমি আজই রাত্রে কলিকাতায় যাইতেছি। তাড়াতাড়ি এখান হইতে সকলে চলিয়া যাইলে, কেবল সন্দেহ বৃদ্ধি করা হইবে মাত্র।”
কথাগুলি অনল-লোহিত-লৌহফলকবৎ হেমাঙ্গিনীর কুসুম-কোমল হৃদয় বিদ্ধ করিল। হেমাঙ্গিনী স্বামীর কথার উত্তরে একটাও কথা কহিতে পারিল না, বালিশে মুখ লুকাইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল। অবলার রোদন ব্যতীত আর কি সম্বল আছে? যাহার একমাত্র সহচর, ইহকাল পরকালের অভিন্নবন্ধন, প্রচণ্ড হলাহল পান করিয়াছে তাহার আর কি উপায় আছে, সে আর কি করিবে? আত্মহত্যা! এই দারুণ ক্লেশভার অপনয়নের আপাত-মধুর অমোঘ ঔষধ বটে। কিন্তু পূত-চরিত্রা পতিব্রতা আত্মহত্যা করিবে কেন? সে জানে, যে গুরুতর পাপফলে তাহার এই দারুণ মনোব্যাথা, উহার পূর্ণ ভোগ না হইয়া গেলে আত্মহত্যায় নিবারণের চেষ্টা শুধু মূর্খতা মাত্র, কেবল ভোগের উপর অধিকতর ভোগ বাড়ান মাত্র। দেহত্যাগে কি কৰ্ম্মফলভোগের পরিহার হয়? শুধু আত্মহত্যার দারুণ পাপের ভোগ উহাতে বাড়ে মাত্র। হেমাঙ্গিনীর জীবন এখন অবিরাম-দুঃখময়—অশেষ – ক্লেশাকর, মৃত্যু আবার ততোধিক ভয়ঙ্কর!
.
সতীশচন্দ্ৰ এত সহজে এত শীঘ্র স্ত্রী পুত্র পরিবার ত্যাগ করিয়া পলাইতেছেন কেন! তবে কি তিনি বুঝিয়াছেন যে ফাঁসী কাষ্ট হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় পলায়ন! সে দিন—সে রাত্রে কুক্ষণে তিনি সর্ব্বাগ্রে রমেন্দ্রের খুনের কথা না বলিলে আজ আর কেহই তাঁহাকে এমন সন্দেহ করিতে পারিত না? কেন ঘোর উন্মত্ততা বশতঃ তিনি এই দারুণ মূর্খের কাজ করিয়াছিলেন? ইহার একমাত্র উত্তর, ‘সর্ব্বঙ্কষা ভগবতী ভবিতব্যতৈব’—বিধিলিপি অখণ্ডনীয়, কে তাহার গতিরোধ করিবে? যাহা হইবে তাহা চিরকালই হইবে, মানুষের সাধ্য কি যে সে তাহার অন্যথা করে।
সতীশচন্দ্র গৃহ হইতে বাহির হইতে যাইতেছিলেন, ফিরিয়া বলিলেন, “রমেন্দ্রের খুনীকে যে ধরাইয়া দিতে পারিবে আমি তাহাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরষ্কার দিব বলিয়াছি।”
হেমাঙ্গিনীর মনে হইল তাহাকে উপহাস করিবার জন্যই যেন স্বামী এ কথাগুলা তাহাকে শুনাইলেন—যেন মরার উপর খাড়ার ঘা দিবার জন্যই তিনি ইহা বলিলেন। কথা শুনিবামাত্র তাহার বুকটা যেন ফাটিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িবার মত হইল। সতীশচন্দ্র আর একটাও কথা বলিলেন না, একবার মাত্র বিষাদ-দৃষ্টিতে পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীকে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
স্বামী গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর জড়ীভূত হৃদয় আরও অবসন্ন হইয়া যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল, সে চারিদিকে কেবল ঘোরতর অন্ধকার দেখিতে লাগিল। পিসীমা হেমাঙ্গিনীর মনের অবস্থা জানিতেন। সতীশচন্দ্র গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরে তিনি আসিয়া হেমাঙ্গিনীর পার্শ্বে বসিলেন, কিন্তু একটাও কথা কহিলেন না। তখন হেমাঙ্গিনীর সংজ্ঞা আছে, অথচ নাই,—সে জাগ্রত অথচ নিদ্রিত—জীবন ও মরণের গহন সন্ধিস্থলে সমাসীন।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
সেই দিন রাত্রেই সতীশচন্দ্র কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছিলেন, কেননা মধুপুরে থাকা এখন তাঁহার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছিল, চারিদিক হইতে নানা বিভীষিকা আসিয়া তাঁহার সমস্ত প্রাণটাকে একেবারে অশান্তির আলয় করিয়া তুলিয়াছিল। কাজেই তিনি একটু শান্তি পাইবার জন্য, একটু হাঁপ ছাড়িবার জন্য, প্রথম সুবিধাতেই মধুপুর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। হেমাঙ্গিনীও ভাবিয়াছিল যত শীঘ্র সম্ভব সেও মধুপুর পরিত্যাগ করিবে; কিন্তু তাহার ভাগ্যে তাহা ঘটিল না। পরদিন তাহার প্রচণ্ড জ্বর হইল, জ্বরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে ভুল বকিতে আরম্ভ করিল। বাটীর সকলেই হেমাঙ্গিনীর জন্য ভীত হইয়া পড়িল। সে সময় যদি তথায় পিসীমা ও শুধাংশু না থাকিতেন তাহা হইলে যে কি হইত, তাহা কেবল এক ভগবান্ বলিতে পারেন।
আর রমেন্দ্রবাবু নাই যে তিনি তাহার চিকিৎসা করিবেন, কাজেই রেলের ডাক্তারবাবুকে ডাকা হইল। তিনিই হেমাঙ্গিনীর চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। বিকারের মুখে, পাছে হেমাঙ্গিনী রমেন্দ্রবাবুর খুন সম্বন্ধে কোন কথা বলিয়া ফেলে,—পাছে তাহা কেহ শুনিতে পায়,—সেই জন্য পিসীমা সহজে কাহাকেও হেমাঙ্গিনীর নিকটে যাইতে দিতেন না। সৰ্ব্বদা হয় তিনি না হয় তাহার পুত্র সুধাংশু হেমাঙ্গিনীর নিকটে থাকিতেন। বস্তুতঃ পিসীমা এখন একজন অপূৰ্ব্ব প্রতিভাময়ী অভিজ্ঞা পুরন্ধ্রীর কার্য্য করিলেন।
সংসারের বিশেষ একটী কাজের বন্দোবস্ত করিবার জন্য এক দিন পিসীমা পুত্রকে হেমাঙ্গিনীর নিকটে রাখিয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য রোগিণীর গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। পিসীমাকে গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়া হেমাঙ্গিনীর পুরাতন ঝি তাহার পার্শ্বে যাইয়া বসিল। হেমাঙ্গিনী জ্বরে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল,—জ্বরের ঝোঁকে সে ক্রমাগতই রমেন্দ্রবাবুর নাম করিতে লাগিল। এই ব্যাপারে সুধাংশু একটু ভীত হইয়া পড়িল, কারণ হেমাঙ্গিনী জ্বরের ঝোঁকে কেবল যে রমেন্দ্রবাবুর নাম করিতেছিল তাহা নহে, তাঁহার খুন সম্বন্ধেও অনেক কথা তাহার কণ্ঠ হইতে জড়িত ভাবে বাহির হইয়া আসিতেছিল। সুধাংশুর তখন কেবলই মনে হইতেছিল, পুরাতন ঝি পার্শ্বে বসিয়া আছে—এ সময় তাহাকে উঠিয়া যাইতে বলাও সম্ভব নয়, অথচ তাহার উপর কিছুতেই আস্থা স্থাপন করিতে পারা যায় না। এ অবস্থায় না জানি কি হইতে কি হয়।
সেই সময়ে সংসারের কাজ সারিয়া পিসীমা আসিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া পুরাতন ঝি বলিয়া উঠিল, “পিসীমা, দিদিমণি জ্বরের ঝোঁকে কেবলই ডাক্তার বাবুর নাম করিতেছেন। বাবুর সহিত নাকি ডাক্তার বাবুর ভারি ঝগড়া ছিল। হাঁ পিসীমা, দিদিমণি বার বার ডাক্তার বাবুর নাম করিতেছেন কেন? সত্যই কি ডাক্তরবাবুর সহিত বাবুর খুব ঝগড়া হইয়াছিল?”
দাসীর কথায় পিসীমা রীতিমত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু সুবিজ্ঞা প্রবীণা গৃহিণীর ন্যায় মনের ভাব মনেই দমন করিয়া বলিলেন, “ডাক্তারবাবু এখান হইতে যাইবার পরেই খুন হইয়াছিলেন, সে জন্যই হেম জ্বরের ঝোঁকে বার বার তাহারই নাম করিতেছে। এ অবস্থায় জ্বরের ঝোঁকে হেম যে ডাক্তার বাবুর নাম করিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই। তা’ ছাড়া জ্বরের ঝোঁকে মানুষ কত রকম ভুল বকে, সে সব কথার কি কোন মানে আছে? সতীশ ডাক্তার বাবুর খুনীকে যে ধরিতে পারিবে তাহাকে পাঁচ হাজার টাকা দিবে বলিয়াছে। এবার আমার বিশ্বাস শীঘ্রই খুনী ধরা পড়িবে।”
দাসী মুখখানা একটু বিকৃত করিয়া বলিল, “সকলেই তাহাই বলিতেছে। নিশ্চয়ই সেই দোষাদের দলের কাহারও এই কাজ। আচ্ছা, পিসীমা, তোমার কি মনে হয়?”
পিসীমা দাসীদের কথায় সায় দিয়া বলিলেন, “আমারও তাহাই মনে হয়,—ইহারা না পারে পৃথিবীতে এমন কোন কাজই নাই।”
কিছুক্ষণ কাহারও মুখে কোন কথা নাই, সহসা দাসী আবার জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা পিসীমা, দিদিমণির এত ব্যায়ারাম আর বাবু কল্কাতায় রহিলেন, তিনি এখন এলেন না?—আশ্চর্যের কথা!” দাসীর কথার উত্তরে প্রত্যুৎপন্নমতি পিসীমা তখনই বলিলেন, “তোর বাবু তো তোর দিদিমণির অসুখের খবর পান নাই।”
দাসী বেশ একটু আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, “খবর পান নি! সে কি?”
পিসীমা গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “এখন তাকে খবর দিয়ে তো কোন ফল নাই, মিছে সে ভেবে সারা হ’বে। তাই আমি সুধাংশুকে তাহাকে কোন খবর দিতে নিষেধ করিয়াছি। হেম একটু ভাল হইলেই তাহাকে খবর পাঠাইব।”
পিসীমা আসিয়াই হেমাঙ্গিনীর পার্শ্বে বসিয়াছিলেন, কাজেই দাসী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেল। পিসীমা পুত্রের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ব্যাপার দিন দিন যা দাঁড়াইতেছে তাহাতে আমার তো আর কোনই ভরসা নাই। ভয়ে দিন রাত্রই আমার বুকটা দুর দুর করিতেছে। সতীশ—”
সুধাংশু নীরবে বসিয়া একখানা ইংরাজী উপন্যাস পাঠ করিতেছিল, সে তাহার মাতাকে বাধা দিয়া বলিল, “মা, তুমি বুদ্ধিমতী। সবই বুঝিতেছ, তবে এ সব কথার যত আলোচনা না হয় ততই ভাল। যাহা হইবার তাহা হইবেই—ভয় ভাবনা সকলই মিছা।”
পিসীমা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলেন। সুধাংশু আবার তাহার সেই উপন্যাসে মনোনিবেশ করিল।
.
হেমাঙ্গিনীর জ্বরের অবস্থা যেরূপ দাঁড়াইয়াছিল তাহাতে আর তাহার জীবনের কোনই আশা ছিল না, কেননা ডাক্তার বলিয়াছেন এ দারুণ মস্তিষ্ক-বিকৃতি জ্বর, ইহাতে রক্ষা পাওয়া বড়ই দুর্ঘট। কিন্তু যাহার পরমায়ু আছে তাহার কিছুতেই বিনাশ নাই। কাজেই হেমাঙ্গিনী রক্ষা পাইল। সে ধীরে ধীরে ক্রমেই ভাল হইয়া উঠিতে লাগিল। সে তখন একেবারে সারে নাই,তবে আজ চার পাঁচ দিন হইতে জ্বর নাই, সেই সময় এক দিন সে পিসীমাকে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “পিসিমা, আমায়—আমায় এখান থেকে লইয়া চল,—এখানে থাকিলে আর আমি বাঁচিব না। সেই—সেই খুন দিন রাত আমি যেন চোখের উপর দেখিতেছি। পিসীমা, আমি তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যত শীঘ্র পার আমায় এখান হইতে লইয়া চল।”
পিসীমা অতি কোমল স্বরে বলিলেন, “ছিঃ মা, অমন করিয়া কি ব্যস্ত হইতে আছে? অমন ব্যস্ত হইলে যে অসুখ আবার বাড়িবে। তুমি আর একটু ভাল হইলেই আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইব।”
আরও কয়েক দিন কাটিয়া গেল, হেমাঙ্গিনী পথ্য পাইয়াছে। এবার তাহাদের মধুপুর হইতে যাইবার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। হেমাঙ্গিনী পিসীমাকে ডাকিয়া বলিল, “চল পিসীমা, কালই আমরা এখান হইতে চলিয়া যাই।”
পিসীমা মুখখানি ভার করিয়া বলিলেন, “ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, তোমার এখনও রেলে যাইবার অবস্থা হয় নাই। আরও চার-পাঁচদিন এখানে তোমার থাকিয়া যাওয়া উচিত।”
অগত্যা আরও কয়েক দিন হেমাঙ্গিনীকে মধুপুরে থাকিতে বাধ্য হইতে হইল। সে মধুপুর পরিত্যাগ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছিল, কেননা এখানে থাকিলে মাঝে মাঝেই রমেন্দ্রের খুনের কথা তাহার মনের ভিতর নড়িয়া চড়িয়া উঠে, তাহাতে তাহাকে যেন উন্মাদিনীর মত করিয়া তুলে। হেমাঙ্গিনী বেশ জানিত যে এখান হইতে গিয়াও শান্তি পাইবে না,—কোথায় গিয়াও আর তাহার শান্তি পাইবার আশা নাই। দারুণ যন্ত্রণা ও বিভিষিকার মধ্যে তাহাকে জীবন অতিবাহিত করিতে হইবে। কোন্ দিন সীতশচন্দ্র ধরা পড়েন—কোন্ দিন তাঁহার বিচার হয়—কোন দিন তাঁহার ফাঁসী হয়—কত কাল সে এই ভয়ে, এই ভীষণ আতঙ্কে জীবন কাটাইবে! তাহার পর সকলেই তাহাকে দেখাইয়া বলিবে, ঐ দেখ ইহারই স্বামী খুন করিয়া ফাঁসী গিয়াছে। পুত্র কন্যাকে দেখাইয়া বলিবে, ইহাদের বাপের ফাঁসী হইয়াছিল। কতকাল তাহার অদৃষ্টে এ অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ আছে!
এ সব ত গেল বাহিরের কথা। হেমাঙ্গিনীর অন্তর-মধ্যে অনুক্ষণ যে কি দুর্বিষহ নরক যন্ত্রণা হইতেছিল তাহা সকল বর্ণনার অতীত। দুরারোগ্য ব্যধিবশতঃ যাহার দেহের উত্তমার্দ্ধ দারুণ বিষাক্ত হইয়া গিয়াছে, যাহার উপরে ডাক্তারের একমাত্র ব্যবস্থা যে বিষাক্ত অর্দ্ধাঙ্গের ছেদন ব্যতীত পীড়ার আর কোনও চিকিৎসা নাই, সে রোগীই শুধু হেমাঙ্গিনীর হৃদয় যন্ত্রণা বুঝিতে পারিবে। এ যন্ত্রণা অন্তর্দাহিনী—পলে পলে মৰ্ম্মস্থানগুলি পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই করিয়া ফেলিতেছে, কিন্তু বাহিরে কিছুই প্রকাশ নাই। দাবানল বুঝি এই আন্তর দাহের তুলনায় চন্দনসেক মাত্র। হেমাঙ্গিনী বুঝিয়াছে, সে একরূপ চাক্ষুষ প্রমাণ পাইয়াছে যে, তাহার স্বামীই খুনী, তিনিই এই লোক-বিগর্হিত পশুর আচরণ করিয়াছেন, অথচ তাহার কথায় বেশ বুঝা যাইতেছে যে তিনি উহার জন্য অনুতপ্ত, এমন কি, একটু দুঃখিতও নহেন। তাহার স্বামী,—তাহার ইহকাল পরকালের দেবতা, কি এমনই পশু-প্রকৃতি! এমনই—! না, সে আর ভাবিতে পারে না। তাহার মাথার ভিতরে মগজগুলি টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠে—তাহার চেতনা একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায়! আবার প্রেম ও বিশ্বাস আসিয়া মধুর মোহন সুরে বলে—না গো না, তাহা কি কখনও হইতে পারে? সতীশচন্দ্র যে মহৎ কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তিনি যেরূপ সুবিদ্বান্, তাঁহার চরিত্র যেরূপ অনিন্দ্য—সৰ্ব্বলোক সমাদৃত, সর্ব্বোপরি তিনি যে তোমার পতি—তোমায় প্রাণাপেক্ষা ভালবাসেন—তাঁহা হইতে কি এরূপ নারকীয় কার্য্য, সম্ভব! এ কথা—এমন কি, এই ভাবনা কি তোমার চিত্তে উঠিতে পারে? তোমার চক্ষু তোমায় প্রতারণা করিয়াছে, তোমায় ভুল দেখাইয়াছে! অমনই আবার সন্দেহ শতমুখে আসিয়া তাহার প্রেম ও বিশ্বাসের গোড়ায় দারুণ কুঠার বসাইয়া দেয়। হেমাঙ্গিনী এই নিদারুণ আন্তর দেবাসুরদ্বন্দ্বে নিপীড়িতা—সে এখন প্রচণ্ড-ঝটিকাবিক্ষুব্ধ উত্তাল-তরঙ্গমালা-সমাকুল মহাসাগর বক্ষে নিপতিতা! ইহার পরিণাম যে কি হইবে তাহা এক অন্তর্যামী ব্যতীত আর কাহারও বিদিত নহে।
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
পিসীমা স্নান করিয়া আসিয়া আহ্নিক করিতে যাইতেছিলেন, সেই সময় একজন ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল, “আপনার সঙ্গে প্রফুল্ল বাবু একবার দেখা করিতে চাহেন।”
ভৃত্যের এই সংবাদে পিসীমা একটু অবাক্ হইয়া গিয়াছিলেন। তিনি বিস্মিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “আমার সহিত দেখা করিতে চাহেন! কে—প্রফুল্ল বাবু?”
ভৃত্য ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিল, “আজ্ঞে, হাঁ,—কি বিশেষ কথা আছে।”
বিশেষ কথা আছে! পিসীমার বক্ষ দুরু দুরু করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তিনি অবাক্ হইয়া ভৃত্যের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমার সঙ্গে কি কথা! বলগে পিসীমা আসিতেছেন।”
ভৃত্য চলিয়া গেল,—পিসীমা শঙ্কিত হৃদয়ে প্রফুল্ল বাবুর সম্মুখে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। প্রফুল্ল বাবু বাহিরে বৈঠকখানা গৃহে একখানা চেয়ার দখল করিয়া বসিয়াছিলেন। পিসীমাকে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “শুনিলাম সতীশ বাবুর স্ত্রী এখন ভাল আছেন, সেই জন্য একটা খবর তাহাকে বলিতে আসিলাম। কিন্তু এ অবস্থায় তাহাকে বলা উচিত কি না তাহাই জিজ্ঞাসা করিবার জন্য আপনাকে ডাকাইয়াছি।”
প্রফুল্ল বাবুর এই কথায় পিসীমার বুকটা আরও কাঁপিয়া উঠিল,—তিনি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি খবর? নতুন কিছু–সতীশের—?” প্রফুল্লবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—”না—না—সে সব কিছু নহে, এতদিন পরে রমেন্দ্রের খুনী ধরা পড়িয়াছে।”
পিসীমা উন্মুক্তনেত্রে অন্ধকার দেখিলেন,—তবে কি পুলিশ সতীশকে ধরিয়াছে! পিসীমার কণ্ঠ হইতে কথা বাহির হইল না, তিনি নিষ্পন্দদেহে পলক শূন্য-নেত্রে প্রফুল্ল বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। প্রফুল্ল বাবু বলিতে লাগিলেন, “এ খবরটা আমি নিজেই দিতে আসিলাম। সতীশবাবু যে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন বলিয়াছিলেন তাহাতেই খুনী ধরা পড়িয়াছে।”
পিসীমার স্বর কম্পিত হইল। তিনি সশঙ্ক প্রফুল্ল বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই খুনী কেমন করিয়া ধরা পড়িল?”
প্রফুল্ল বাবু বলিলেন, “সতীশ বাবু কলিকাতায় যাইয়াই সেখানকার গোয়েন্দা পুলিশের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করেন, এবং রমেন্দ্র বাবুর খুন সম্বন্ধে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া বলেন, যে ব্যক্তি এই খুনীকে ধরিতে পারিবে তিনি তাহাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। গোয়েন্দা পুলিশের এক সাহেব সতীশ বাবুর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনিয়া একজন সুদক্ষ কর্ম্মচারীকে এই খুনীকে ধরিবার জন্য এখানে প্রেরণ করেন। তিনি আসিয়া কয়েকদিন অনুসন্ধানের পরেই রমেন্দ্র বাবুর খুনীকে ধৃত করিয়াছেন। লোকটা সেই দোষাদদের দলের একজন, তাঁহার নাম দামন। অন্য দুইজন যখন মাড়োয়ারীকে খুন করিয়া তাহার টাকা কড়ি লইবার জন্য পথি-পার্শ্বে লুকাইয়া ছিল, তখন দামন নিজে স্বতন্ত্র ভাবে কিছু রোজগার করিবার জন্য ডাক্তারকে আক্রমণ করে। সেই পর্যন্ত বদমাইস লুকাইয়া ছিল।”
প্রফুল্ল বাবুর কথা পিসীমা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি মনে মনে যেন বুঝিলেন যে পুলিশ সম্পূর্ণ ভুল করিয়া এই দামনকে ধরিয়াছে,—রমেন্দ্র বাবুর খুনী দামন নহে। তিনি কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুলিশ কেমন করিয়া জানিল যে এই দামনই রমেন্দ্র বাবুকে খুন করিয়াছে?”
প্রফুল্ল বাবু গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “সেই গোয়েন্দা পুলিশ এই দোষাদ-দলের একজনকে খুঁজিয়া বাহির করে, এবং তাহাকে হাজার টাকা দিবে বলায় টাকার লোভে সেই সে গোয়েন্দা পুলিশকে সমস্ত কথা বলিয়া দেয়। এটা একটা ছোড়া, দোষাদদের দলে ছিল বটে, কিন্তু এখনও পাকা হইতে পারে নাই। ছোড়াটার বয়স নিতান্তই অল্প, ষোল সতের বৎসরের কিছুতেই বেশী নহে। দামন কোথায় লুকাইয়াছিল তাহাও সেই সে গোয়েন্দা পুলিশকে বলিয়া দেয়। তাহার পর পুলিশ যাইয়া দামনকে তথায় ধৃত করে।”
এত কথায়ও পিসীমার মন মানিতেছিল না। তিনি প্রফুল্ল বাবুকে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই ছোকরা কি দামনকে ডাক্তার বাবুকে খুন করিতে দেখিয়াছিল?”
প্রফুল্ল বাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না, এ কথা আমি জিজ্ঞাসা করি নাই।”
পিসীমা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “তাহা হইলে কেবল এই ছোক্বার কথার উপর নির্ভর করিয়াই এই লোকটাকে পুলিশ ধরিয়াছে?”
প্রফুল্ল বাবু বলিলেন, “হাঁ, এখন তাহাই বটে, পরে অন্য প্রমাণও হইবে।”
তাহার পর আর দুই চারিটী কথা হইবার পর প্রফুল্ল বাবু বিদায় লইলেন। পিসীমা কিন্তু নিশ্চন্ত হইতে পারিলেন না, কেননা প্রকৃত খুনী কে তিনি যে তাহা জানেন। তবে এই লোকটা ধৃত হওয়ায় তিনি মনে মনে সত্যই বেশ একটু সন্তুষ্ট হইলেন, কেননা লোকটা দোষী হউক আর নাই হউক সতীশের উপর আর কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না।
.
দামন ধৃত হইয়া মধুপুরে আসিলে, মধুপুরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলে তাহাকে দেখিতে ছুটিল। চারিদিকে একটা হুলস্থুল পড়িয়া গেল।
যথাসময়ে দামন হাকিমের সম্মুখে নীত হইল। তখন সেই দোষাদবালক এইরূপ জবানবন্দী দিল :-
একদিন দোষাদেরা একজন মাড়োয়ারীকে খুন করিয়া তাহার টাকাকড়ি লইবার বন্দোবস্ত করিয়া তাহার জন্য পথের পাশে লুকাইয়া থাকিল। দামন তাহাদিগকে বলিল, “তোরা দুইজনেই মাড়োয়ারীটাকে ঠিক করিতে পারিবি, আমি ডাক্তারটাকে দেখি। সে রোজ রাত্রেই বাহিরে বাহির হয়, সঙ্গে তাহার ঘড়ী চেন, টাকাও যথেষ্ট থাকে।’ এই কথা বলিয়া সে ডাক্তারের সন্ধানে তাহার বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার বাড়ীর নিকটে আসিলেন। ডাক্তার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে যাইবেন, ঠিক সেই সময় দামন পশ্চাদ্ভাগ হইতে তাহার মাথায় লাঠীর আঘাত করে। সেই আঘাতেই ডাক্তার ঘুরিয়া পড়িয়া যান। দামন ডাক্তারের বুক পকেট হইতে ঘড়ী চেন খুলিয়া লইতেছিল, ঠিক সেই সময়ে আর এক ব্যক্তি আসিয়া তথায় উপস্থিত হয়। সেই ব্যক্তি তাহার কীর্ত্তি দেখিয়াছে ভাবিয়া দামন তৎক্ষণাৎ ডাক্তারকে ছাড়িয়া সেই লোকটাকে আক্রমণ করে। সেই লোকটার হাতে একটা লাঠি ছিল, ধাক্কাধাক্কিতে সেই লাঠী ভাঙ্গিয়া যায়। কিন্তু দামন দেখিল সেই লোকটার সহিত সে বলে পারিবে না, কাজেই সে সেই লোকটাকে ছাড়াইয়া ছুটিয়া অন্ধকারে পলাইয়া একেবারে আসিয়া আড্ডায় উপস্থিত হয়। তাহার ডাক্তারকে খুন করিবার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না,—কেবল তাঁহার টাকা কড়ি লইবার ইচ্ছা ছিল।”
দোষাদ-বালক যাহা বলিল, প্রকৃত তাহাই ঘটিয়াছে, ইহা সকলেই বিশ্বাস করিল। দামনও যখন দেখিল আর পরিত্রাণের কোনও উপায় নাই, তখন সে নিজেই খুন স্বীকার করিল। সে বলিল, “হাঁ, আমি ডাক্তারের টাকাকড়ি লইতে গিয়াছিলাম, তাহাকে খুন করিবার আমার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। সে যে লাঠীর আঘাতেই কেমন করিয়া মরিল তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারিতেছি না। আমি তাহার পকেট হইতে ঘড়ী চেন টাকা কড়ি লইতে যাইতেছিলাম, সেই সময় আর একজন লোক সহসা পশ্চাৎ হইতে আসিয়া আমাকে আক্রমণ করে, আমি নিজেকে বাঁচাইবার জন্য তখনি তাহাকে আক্রমণ করি। মারা-মারিতে তাহার লাঠী ভাঙ্গিয়া যায়। আমি যখন দেখিলাম তাহার সহিত বলে পারিব না তখন ছুটিয়া অন্ধকারে পলাইয়া যাই।”
হাকিম তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সে লোক কে? এখন তাহাকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে?”
দামন ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “না হুজুর, সে দিন ভয়ঙ্কর অন্ধকার রাত্রি, আমি তাহাকে ভাল দেখিতে পাই নাই। তবে এটা বেশ বুঝিয়াছিলাম সে লোকটা একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোক।”
মাজিষ্ট্রেট সমস্ত শুনিয়া দামনকে দায়রায় সোপর্দ করিলেন। দামনের এই কথা সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে নানাভাবে নানা লোকের মুখে উপস্থিত হইল। কিন্তু তখনও পিসিমা তাহাকে রমেন্দ্রের খুনী বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারে নাই,—বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। তিনি বাটীর পুরাতন দাসীকে ডাকিয়া বলিলেন, “এখন এ সব কথা হেমকে যেন বলিও না। এ সব কথা শুনিবার মত এখনও তাহার অবস্থা হয় নাই। এখন তাহার শরীর তো তেমন সারে নাই?”
পুরাতন দাসী কিন্তু অন্যরূপ বুঝিল। সে ভাবিল হেমাঙ্গিনী রমেন্দ্রকে খুব যত্ন ও ভক্তি করিত। তাহার খুনী ধরা পড়িয়াছে শুনিলে হেমাঙ্গিনী সন্তুষ্ট হইবে। সেই জন্য সে পিসীমার এ নিষেধে কান দিল না। হেমাঙ্গিনীকে সমস্ত কথা বলিবার জন্য সুযোগ খুঁজিতে লাগিল।
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
আজ রাত্রের গাড়ীতে হেমাঙ্গিনী কলিকাতায় যাইবে, সকাল হইতেই দাস-দাসীরা দ্রব্যাদি গুছাইয়া বাঁধিতে আরম্ভ করিয়াছে। হেমাঙ্গিনী যদিও এখন অত্যন্ত দুর্বল, তথাপি সে উঠিয়া বসিয়াছে। সে এখান হইতে যাইতে পারিলে বোধ হয় কিছু শান্তি পায়, এখানকার বাতাসে যেন তাহার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আইসে।
পুরাতন দাসীকে ডাকিয়া হেমাঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করিল, “সব বাঁধা ছাঁদা শেষ হইয়াছে?”
ঝি বলিল, “হাঁ দুপুরের মধ্যেই সব বাঁধা ছাঁদা শেষ হবে। তবে—”
দাসী কথাটা বলিতে যাইয়া চুপ করিল, হেমাঙ্গিনী বেশ একটু বিচলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি ঝি?”
দাসী বেশ একটু কিন্তু-স্বরে বলিল, “সেই লোকটা ধরা পড়িয়াছে।”
হেমাঙ্গিনী দাসীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “কোন লোকটা?”
দাসী উত্তর দিল, “খুনী,—যে লোকটা ডাক্তার বাবুকে খুন করিয়াছিল।”
হেমাঙ্গিনী নিতান্ত অস্পষ্ট স্বরে বলিল, “কে—কে–কে সে?”
দাসী বলিল, “একজন দোষাদ—তার নাম দামন, সে খুন স্বীকার করিয়াছে। সে ডাক্তার বাবুর মাথায় লাঠী মারিয়া তাহাকে খুন করিয়াছিল।”
হেমাঙ্গিনী মহাবিচলিত স্বরে বলিয়া উঠিল, “পিসীমা—পিসীমাকে ডেকে দে।”
পিসীমা আসিলেন। হেমাঙ্গিনী কি হইয়াছে পিসীমাকে সমস্ত বলিতে বলিলেন। পিসীমা যাহা কিছু শুনিয়াছিলেন, একে একে সমস্তই হেমাঙ্গিনীকে বলিতে লাগিলেন। এই সময় সহসা হেমাঙ্গিনী অর্দ্ধ স্ফুট আর্তনাদ করিয়া উঠিল,—দ্বারে দণ্ডায়মান সতীশচন্দ্র!
দেখিলেই বোধ হয় তিনি এইমাত্র ট্রেনে আসিয়াছেন, তাঁহার বেশ অপরিষ্কার—ধূলি ধূসরিত, বস্ত্রাদিও বিক্ষিপ্ত। তিনি হেমাঙ্গিনীর নিকটে আসিয়া বলিলেন, “হেম! এখন তো বিশ্বাস হইয়াছে?” হেমাঙ্গিনী কি বিশ্বাস করিবে—তিনি খুনী না অপর কেহ খুনী! সে ব্যাকুল, বিষণ্ণ, বিস্ফারিত নয়নে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সে কি দৃষ্টি! দেখিয়া মনে হয়, কি এক দারুণ আর্ত্তনাদ যেন সেই চোখ দুটী বিদীর্ণ হইয়া এখনই বাহির হয়!
পিসীমা বলিলেন,—”সতীশ, সতীশ, তুই বল্—তুই বল্—যে তুই—’
“পিসীমা, তুমিও কি আমাকে এমনই পাষণ্ড মনে করো! না, পিসীমা আর একটু আগে উপস্থিত হইতে পারিলে এই দোষাদ কখনই রমেন্দ্রকে খুন করিতে পারিত না। আমিই গিয়া পড়িয়াছিলাম। আমার ভয়েই এই দোষাদ পালাইয়াছিল। কিন্তু সকলই বৃথা হইল। পিসীমা, হেমের সঙ্গে আমার কথা আছে। তুমি একটু ঐ ঘরে যাও।”
পিসীমা সতীশের উপর নিজের অন্যায় সন্দেহ বিশেষ দুঃখিত হইয়া ধীরে ধীরে সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন! সতীশচন্দ্র স্ত্রীর সম্মুখে নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন।
তখন হেমাঙ্গিনী রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “এ কি! এ কি সত্য?”
সতীশচন্দ্র বলিলেন, “এ কথা আবার জিজ্ঞাসা করিতেছ?”
“তবে—তবে এ কথা আমায় আগে বল নাই কেন?”
“তোমার এই কথার উত্তর দেবার আগে, আমি তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, যদি সে সময় আমি এ কথা তোমায় বলিতাম তাহা হইলে তুমি কি তখন আমায় বিশ্বাস করিতে?”
হেমাঙ্গিনী বুঝিল, সে কথা ঠিক। তাহার হৃদয়ে ইতিপূর্ব্বে যে নিদারুণ সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়াছিল, তাহার স্বামী সহস্র শপথ-সহকারে অস্বীকার করিলেও সে সময়ে তাহার হৃদয় হইতে সে সন্দেহ দূরীভূত হইত না।
সতীশচন্দ্র বলিলেন, “আমি জানিতাম, আমি তখন সব কথা খুলিয়া বলিলেও তোমার মন হইতে এ সন্দেহ যাইবে না। সেজন্য আমি সে সময়ে তোমায় কোন কথা বলি নাই, কেবল বলিয়াছিলাম- হেম, ভ্রমে বিশ্বাস হারাইও না। তারপর আমি তোমায় এখানে রাখিয়া প্রকৃত খুনী যাহাতে ধরা পড়ে, তাহারই চেষ্টায় গিয়াছিলাম। এখানে পাঁচ হাজার টাকা দিব বলিয়া, কলিকাতায় গিয়া ডিটেক্টিভ পুলিসে খবর দিয়াছিলাম, ও তাহাদের সাহায্য লইয়াছিলাম। আমি তোমার উন্মত্তের প্রলাপে কান দিই নাই, তোমার কথায় স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ঘরবাড়ী ছাড়িয়া পলাই নাই।”
এ কখনও দোষীর কথা নহে হেমাঙ্গিনীর চোখে যে সন্দেহের করাল ছায়া পড়িয়াছিল, তাহা অপসারিত হইয়া গেল। সে কথা কহিতে পারিল না, স্বামীর বুকে মুখ লুকাইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল!
সতীশচন্দ্র হেমাঙ্গিনীকে হৃদয়ে টানিয়া লইয়া সে রাত্রে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সমস্তই বলিলেন।
তিনি সেই রাত্রে হেমাঙ্গিনীর নিকটে রমেন্দ্রকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া উন্মত্ত প্রায় হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহাকে হত্যা করিবার কথা তাহার মনে এক নিমেষের জন্যও উদিত হয় নাই। যাহাতে রমেন্দ্র আর তাঁহার বাড়ীতে না আসেন, যাহাতে তিনি আর হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে দেখা না করেন, তাহাই বলিবার জন্য তিনি রমেন্দ্রের বাড়ীর দরজায় গিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি একটা শব্দ ও অস্ফুট আর্তনাদ নিকটে শুনিয়া ছুটিয়া সেইদিকে গেলেন; দেখিলেন, একটা লোক ডাক্তারের পকেট হ’তে ঘড়ি চেন লইতে চেষ্টা পাইতেছে। সে তাহাকে দেখিবামাত্র আক্রমণ করিল, তিনিও তাহাকে আক্রমণ করিলেন। ইহাতে তাহার লাঠী ভাঙ্গিয়া গেল। লোকটা ধরা পড়ে দেখিয়া তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল। অন্ধকারে তাহাকে ধরা অসম্ভব দেখিয়া তিনি আর তাহার অনুসরণ করিলেন না। পকেট হইতে দেশলাই জ্বালাইয়া দেখিলেন, রমেন্দ্রনাথ আর জীবিত নাই। তখন কেহ এ অবস্থায় তাঁহাকে দেখিলে পাছে সন্দেহ করে বলিয়া, তিনি তথা হইতে চলিয়া গেলেন। কিন্তু পথে এত অন্ধকার যে তিনি পথ ভুলিয়া একেবারে অজয়ের জলে গিয়া পড়িলেন, তাহার কাপড়- চোপড় জামা সব ভিজিয়া গেল। পাছে কেহ তাহাকে সন্দেহ করে বলিয়াই তিনি সেই ভাঙ্গা লাঠী আর ভিজা কাপড় নিজের বাক্সের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন।
স্বামীর বক্ষে মাথা রাখিয়া হেমাঙ্গিনী তাঁহার কথাগুলি যেন দুই কর্ণদ্বারা পান করিতে লাগিল। তাহার দুই চক্ষু বহিয়া অজস্র অশ্রুধারা ঝরিতে ছিল। কিন্তু ইহা শোকের দারুণ উত্তপ্ত মৰ্ম্মদাহী অশ্রুপরবাহ নহে, শীতল, সর্ব্বসন্তাপহর সান্ত্বনার নেত্রাসার—বিমল আনন্দবাষ্পধারা! হেমাঙ্গিনী কেবল কাঁদিতে ছিল—এ কান্না যে কত সুখের—কত সান্ত্বনার—শত যন্ত্রণার আরাম—তাহা বলিবার নহে। সর্ব্বাঙ্গের সুদীর্ঘকাল সঞ্চিত তাপরাশি একেবারে গলিয়া গেল। তাহার হৃদয় হইতে সন্দেহ- পিশাচ কোথায় অন্তর্হিত হইল, এবং প্রেম ও বিশ্বাস দিব্য কলেবর তাহার স্থানে অধিষ্ঠিত হইয়া পূত সুখাশ্রুতে পুনরভিষিক্ত হইলেন। ব্রততী আবার তাহার আশ্রয় তরু বক্ষে শোভিত হইল—পতি-পরায়ণা সহধর্মিণী পতি অঙ্কে আবার প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন।