সহধর্মিণী – ১৫

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

সুধাংশু শয়নমাত্রেই নিদ্রিত হইল। কিন্তু পিসীমা ঘুমাইলেন না। পুরাণ ঝি বসিয়া পান সাজিতেছিল, সে পিসীমাকে দেখিয়া বলিল, “এই কথা শুনে পর্য্যন্ত ভয়ে আমার প্রাণ কাঁচে, ঘুমুতে পাচ্ছি না।” পিসীমা বলিলেন, “অন্য কেউ হলে এত ভয় হতো না, তিনি এখান হ’তে চলে যা’বার পরেই এই কাণ্ডটা হয়েছে কি না!”

“কে চলে যাবার পর?”

“ডাক্তার বাবু।”

“ডাক্তার বাবু! সে কি?”

“হাঁ, তাইতো। তুমি তা শোননি! তুমি খানসামার কাছে কেবল মাড়োয়ারীর কথাই শুনেছিলে? তা নায়, ডাক্তার রমেন্দ্রনাথ খুন হইয়াছেন।

“ডাক্তার বাবু—সে কি! কে বলিল?’

“সতীশ বলিল। সে বাড়ীতে ফিরিবার সময় পথে কাহার কাছে এ কথা শুনিয়া আসিয়াছে।”

“বাবু, কা’র কাছে এ কথা শুনিলেন? খানসামা ঠিক শুনিয়া আসিয়াছে, একজন মাড়োয়ারী খুন হইয়াছে। মিছা-মিছি লোকে মাড়োয়ারীর কথা বলিবে কেন?”

“খানসামা ভুল শুনিয়াছিল, তোমাদের বাবু ঠিক শুনিয়াছেন।”

“না, তিনিই ভুল শুনিয়াছেন। যে লোক মাড়োয়ারীকে মরিয়া পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিল, খানসামা তাহার মুখ থেকে একথা শুনিয়া আসিয়াছে। তোমাদের কাছে সাহস করিয়া সব কথা বলিতে পারে নাই, আমাদের কাছে সব বলিয়াছে। ডাক্তার বাবু মারা যাবেন কেন? আহা তিনি দেবতা লোক!”

“সুধাংশুও তাই বলিতেছিল।”

“হাঁ, সকলেই রমেন্দ্র বাবুকে ভালবাসিত—কেবল–”

“কেবল! কেবল কে?”

“কেবল আমাদের বাবু তাহাকে দেখিতে পারিতেন না। দিদিমণির জন্যেই তাঁদের মধ্যে আগে ভারি ঝগড়া ছিল। আমি দিদিমণিদের পুরাণ ঝি, আমি সবই জানি। বে’র পর এতদিন আর কিছু দেখিনি, কিন্তু এখানে এসে অবধি বাবুর মেজাজ যেন খারাপ হইয়া গিয়াছে, তাই মনে করিতেছি বাবু সেই পুরান কথা ভাবিয়া এই রকম হইয়াছেন।”

“হেম সে রকম মেয়ে নয়?”

“না—না—তা নয়। আগে যাই হোক, এখন দিদিমণি বাবুকে বড় ভালবাসে।”

“এখানে দেখা হ’বার আগে আর কখনও হেমের সঙ্গে রমেন্দ্রের দেখা হইয়াছিল?”

“না, আর কখনও দেখা হয় নাই। যা হোক্‌গে, আমার এ জায়গাটা ভাল লাগচে না, এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচি।”

সেই রাত্রে হেমাঙ্গিনী শয়নকালে স্বামীকে বলিল, “এখন আর সে কথা বলিয়া ফল নাই, কোথায় বে’ হবে—না কি ভয়ানক!”

সতীশচন্দ্র কেবলমাত্র বলিলেন, “ভয়ানক – নিশ্চয়ই ভয়ানক!

“তাঁহার বিবাহ হইত—প্রফুল্ল বাবুর মেয়ের সঙ্গে বে’র কথা হইতেছিল—”

“তোমায় ছেড়ে—তোমায় ভুলে?” এ কথা বলিবার এখন আর সতীশচন্দ্রের কোন আবশ্যকতা ছিল না।

অন্য সময় সতীশচন্দ্র এ কথা বলিলে হেমাঙ্গিনী কি করিত বলা যায় না;কিন্তু অদ্যকার লোমহর্ষণ ব্যাপারে হেমাঙ্গিনীর মন একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। সে অতি কাতর কণ্ঠে বলিল, “কেন তুমি এ সকল কথা বল? তোমার পায় পড়ি, তুমি এ সব ভুলে যাও। আমি ভগবানের নাম করে বলছি তোমার সঙ্গে আমার বে’ হ’বার পর আমি অন্য কাহাকেও কখনও এক নিমেষের জন্যও মনে স্থান দিই নাই। কেন এ সব কথা বলিয়া আমাকে কষ্ট দাও?”

সতীশচন্দ্র কোন কথা বলিলেন না। হেম বলিল, “আজ তাঁহার বিবাহের কথা বলিবার জন্যই তিনি আসিয়াছিলেন।“

এবারও সতীশচন্দ্র কোন কথা কহিলেন না, নীরবে শয়ন করিলেন। কিন্তু সে রাত্রে তিনি নিদ্রিত হইতে পারিয়াছিলেন কি না, তাহা তিনি ব্যতীত আর কেহ জানে না।

প্রাতে সতীশচন্দ্র সুধাংশুকে সঙ্গে লইয়া বাজারের দিকে প্রস্থান করিলেন। তাঁহারা চলিয়া যাইবার একটু পরেই প্রফুল্ল বাবু তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সতীশচন্দ্রের সহিত তাঁহার বিশেষ বন্ধুত্ব হইয়াছিল, ‘আপনি’ ছাড়িয়া উভয় উভয়কে ‘তুমি’ বলিতেন। তাহার উপর সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে সেরূপ পরদা-ব্যবহারও ছিল না, বিশেষতঃ মধুপুরে জেনানা-রীতি বড় একটা নাই বলিলেই হয়। এই সকল কারণে প্রফুল্ল বাবু হেমাঙ্গিনীর সহিত অবাধে কথাবার্তা কহিতেন। এখানে আসিয়া পিসীমাও অনেকটা স্বাধীন হইয়াছিলেন।

প্রফুল্ল বাবু আসিয়াই বলিলেন, “কি ভয়ানক! শুনিয়াছেন?”

হেমাঙ্গিনী অতি দুঃখিতস্বরে বলিল, “হাঁ, তিনি কি একেবারে মৃত, না গুরুতর আহত হইয়াছেন?”

প্রফুল্ল অতি বিষণ্ণ মুখে বলিলেন, “তাহারা কি আর কিছু বাকী রাখিয়া গিয়াছে!”

পিসীমা নিকটে বসিয়াছিলেন, বলিলেন, “তাহা হইলে রমেন্দ্র বাবুই ঠিক,—আমাদের সতীশ তাহাই বলিতেছিল। কিন্তু খানসামা বলে একজন কে মাড়োয়ারী খুন হয়েছে।”

প্রফুল্লকুমার বলিলেন, “তাহার কথাও ঠিক। একজন মাড়োয়ারীও কাল রাত্রে খুন হইয়াছে। এক রাত্রে দুই-দুইটা খুন! মধুপুরে এ রকম ভয়ানক কাণ্ড আর কখনও হয় নাই। মাড়োয়ারী অনেক টাকা লইয়া মধুপুরে আসিতেছিল, কে তাহাকে খুন করিয়া টাকা লইয়া পালাইয়াছে। ডাক্তারের বিষয় স্বতন্ত্র। কে ডাক্তারকে তাহার নিজের বাড়ীর সদর দরজার পাশে লাঠী মারিয়া খুন করিয়াছে।”

পিসীমা বলিলেন, “সতীশ তাহাই বলিয়াছিল।”

হেমাঙ্গনী মৃদুস্বরে বলিল, “তিনি এখান হইতে যাইবার পরেই বোধ হয় এ কাণ্ড হইয়াছিল?”

প্রফুল্লকুমার জিজ্ঞাসিলেন, “এখানে কাল রাত্রে ডাক্তার আসিয়াছিল?”

হেমাঙ্গিনী কহিল, “হাঁ, খোকাকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। বোধ হয় রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটার সময় এখান হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন।

প্রফুল্লকুমার বলিলেন, “নিশ্চয় তাহার অনেক পরে তিনি খুন হইয়াছিলেন। কখন এ কাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহা ঠিক বলা যায় না। অনেক রাত্রেও ডাক্তার বাড়ীতে না ফেরায় তাঁহার চাকর তাঁহাকে খুঁজিতে বাহির হয়। তাঁহাকে কোথাও না পাইয়া যখন বাড়ীর দিকে ফিরিতেছিল, সেই সময়ে সদর দরজার একটু দূরে মৃতদেহ দেখিতে পায়।”

পিসীমা বলিলেন, “সতীশ কিন্তু আগে এ খবর পাইয়াছিল।”

প্রফুল্লকুমার বলিলেন, “ডাক্তার খুন না হইবার আগে তিনি কিরূপে তাহার খুনের কথা জানিবেন?”

পিসিমা বলিলেন, “খানসামা আসিয়া মাড়োয়ারীর খুনের কথা বলিলে, সে বলিয়াছিল যে মাড়োয়ারী খুন হয় নাই, ডাক্তার খুন হইয়াছে। হয়ত তখন আর কেউ শুনিয়া থাকিবে, তাহার কাছে শুনিয়া আসিয়াছিল।”

প্রফুল্লকুমার বলিলেন, “রাত্রি একটার আগে তাহার চাকরও জানিত না যে ডাক্তার খুন হইয়াছে। কেহই তখন মনে করিতে পারে নাই যে ডাক্তার খুন হইয়াছে।”

পিসীমা বলিলেন, “সতীশ নিশ্চয়ই কারুরও কাছে শুনিয়াছিল, না হইলে সে আমাদের এ কথা কেমন করিয়া বলিবে? কোথায় কি রকমে ডাক্তার বাবু খুন হইয়াছেন, তা’পৰ্য্যন্ত বলিয়াছিল।”

প্রফুল্লকুমার চিন্তিত ভাবে বলিলেন, “আশ্চর্য্যের বিষয় সন্দেহ নাই। বলিতে পারি না, সতীশবাবু কা’র কাছে এ কথা শুনিয়াছিলেন।”

পিসীমা বলিলেন, “রাস্তায় কাহারা ছুটিয়া যাইতেছিল, তাহাদের কাছে শুনিয়াছিল। তখন রাত্রি কত হইবে? রাত্রি নয়টার সময় সতীশ বাড়ী আসিয়াছিল না?”

প্রফুল্ল কুমার বলিয়া উঠিলেন “কি ভয়ানক! হয় ত তাহারাই ডাক্তারকে খুন করিয়া পালাইতেছিল। ডাক্তার যে খুন হইয়াছিল, তাহা সে সময়ে আর কাহারই জানিবার উপায় ছিল না। এই লোককে আমাদের খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে। রমেন্দ্রর খুনী যত দিন সাজা না পায় ততদিন আমরা কেহই নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। এখন সতীশ বাবু এই লোকদের চিনিতে পারিলে হয়।”

“তারা কোন বাগানের মালী।”

এই সময়ে সতীশচন্দ্র ও সুধাংশু বাড়ীতে ফিরিলেন।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

সতীশচন্দ্রকে দেখিয়াই প্রফুল্লকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তারের খুনের কথা তুমি কাল রাত্রেই শুনিয়াছিলে?”

সতীশচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ, শেঠের বাগানের মালী মনিয়ার কাছে শুনিয়াছিলাম।”

“মনিয়ার কাছে? এই খুনী ধরিতেই হইবে।”

সতীশচন্দ্র কোন কথা বলিবার পূর্ব্বেই প্রফুল্লকুমার ছুটিলেন।

শেঠের বাগান সেখান হইতে বেশী দুর ছিল না। অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই তিনি ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “তাহারা ত এ কথা অস্বীকার করে। তাহারা বলে যে, তাহারা ডাক্তারের খুনের কথা তোমায় বলে নাই। ডাক্তার যে খুন হইয়াছে, তাহারা রাত্রে আদৌ তাহা জানিত না।”

সতীশচন্দ্র বলিলেন, “কি জন্যে মিথ্যাকথা বলিতেছে জানি না। আমি রাত্রে বাড়ীর দিকে আসিতেছিলাম, দেখিলাম দুইটা লোক ছুটিয়া যাইতেছে, ইহারা মধুপুরের দিক্ হইতে আসিতেছিল। হাতে একটা মশাল, তাহারই আলোতে তাহাদের চিনিতে পারিয়াছিলাম। তাহাদিগকে ছুটিয়া যাইতে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হইয়াছে? তাহারা বলিল, ‘ভয়ানক কাণ্ড হইয়াছে—ডাক্তার বাবু খুন হইয়াছেন’—তাহারা না বলিলে আমি এ কথা শুনিব আর কাহার কাছে? তখন আমার আর কাহারও সঙ্গে দেখা হয় নাই।”

প্রফুল্লকুমার সন্দিগ্ধভাবে কহিলেন, “তবে তাহারা এখন একথা অস্বীকার করিতেছ কেন? মনিয়া অনেক কাল শেঠের বাগানে কাজ করিতেছে, তাহাকে সকলেই ভাল লোক বলিয়া জানে। সে না হইলে আমি মনে করিতাম যে তাহারা এই খুনের মধ্যে আছে। আমি তাহাকে তোমার সম্মুখে আনিতে চাই, দেখি তখন সে কিরূপে মিথ্যা বলিতে সাহস করে।”

“অনায়াসে।”

প্রফুল্লকুমার আবার ছুটিলেন। তিনি রমেন্দ্রনাথকে বিশেষ ভাল বাসিতেন, তাঁহার সহিত নিজের কন্যার বিবাহ দেওয়া স্থির করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে তিনি হৃদয়ে বিশেষ আঘাত পাইয়াছিলেন। তবে তিনি দুর্বল-প্রকৃতির লোক নহেন, মনের ভাব প্রকাশ হইতে দেন নাই। এ অবস্থায় তিনি যে রমেন্দ্রর হত্যাকারীকে ধৃত করিবার জন্য ব্যগ্র হইবেন, তাহাতে আশ্চৰ্য্য কি?

কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই তিনি বৃদ্ধ মনিয়া মালীকে ধরিয়া সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে আনিলেন। মালী বলিল, “বাবু—আপনি হুজুর—কি বলিয়াছেন, তাই ইনি বাবু আমায় ধরিয়া আনিলেন।”

সতীশচন্দ্র বলিলেন, “কাল রাত্রে তুমি আর একটী লোক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটিতেছিলে—সেই যে সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয়—“

মালী বলিল, “হাঁ—হুজুর—আপনি জিজ্ঞাসা করিলে আমি বলিলাম একজন খুন হইয়াছে।”

সতীশচন্দ্র প্রফুল্লকুমারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “শুনিলে?” তারপর মনিয়ার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “যে কথা আমায় বলিয়াছিলে এখন প্রফুল্লবাবুকে বল।”

মালী বলিল, “হুজুর, বলিয়াছিলাম যে একজন লোক খুন হইয়াছে”

“হাঁ—ঠিক তাই।”

প্রফুল্ল কুমার বলিলেন, “তুমি কি বলিয়াছিলে যে ডাক্তার রমেন্দ্র বাবু খুন হইয়াছেন।”

মালী বলিল, “না হুজুর, আমি বলিতে যাইতেছিলাম যে এক জন মাড়োয়ারী খুন হইয়াছে, কিন্তু হুজুর সে কথা না শুনিয়াই চলিয়া গিয়াছিলেন। রাত্রে আমরা ডাক্তার বাবুর খুনের কথা শুনি নাই, আজ সকালে শুনিয়াছি। আজ জানিলাম ত যে দুইটা খুন হইয়াছে?”

সতীশচন্দ্র বিস্মিত ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “দুইটা খুন! সে কি?”

প্রফুল্লকুমার বলিলেন, “একজন মাড়োয়ারী দোকানদারও কাল রাত্রে খুন হইয়াছে। মালী সেই খুনের কথাই বোধ হয় তোমায় বলিতে যাইতেছিল, কারণ ডাক্তার যে খুন হইয়াছে, তখন কেহ তাহা জানিত না। রাত্রি একটার সময় তাহার চাকর এ কথা জানিতে পারে। তাই ভাবিতেছি, তুমি  তখন কাহার কাছে শুনিলে যে ডাক্তার খুন হইয়াছে?”

সতীশচন্দ্র কোন কথা বলিলেন না, কি বলিবেন খুঁজিয়া পাইলেন না। ক্ষণকাল তিনি নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন। সে নীরবতা ভয়াবহ, ঘোর সন্দেহজনক। প্রফুল্লকুমার এবার গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সতীশ, তুমি এ কথা কাল রাত্রে কাহার কাছে শুনিয়াছিলে?”

তথাপি সতীশচন্দ্র নীরব। তাঁহার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতে লাগিল, অতি কষ্টে আত্মসংয়ম করিয়া তিনি অন্য দিকে চাহিয়া রহিলেন। সুধাংশু, পিসীমা, এবং আর সকলেই বিস্ফারিতনয়নে সতীশচন্দ্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

সতীশচন্দ্র বুঝিলেন, যাহা তিনি পূর্ব্বে বলিয়া ফেলিয়াছেন, এখন তাহার সুসঙ্গতি বজায় রাখা একান্ত দুরূহ, কথা বদল করিবারও আর উপায় নাই, ক্রমেই গুরুতর হইয়া উঠিতেছে। অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া অবশেষে সতীশচন্দ্র কথা কহিলেন, বলিলেন, “আমি এই মালির কাছেই শুনিয়াছিলাম, এখন কেন অস্বীকার করিতেছে জানি না।”

মনিয়া বলিল, “হুজুর, অন্যায় বলিতেছেন। আমি ডাক্তার বাবুর কথা রাত্রে শুনি নাই, হুজুরকে কেমন করে বলিব? হুজুর রাত্রে কেবল খুনের কথা শুনিয়াই চলিয়া গিয়াছিলেন। আমি এখন যাইতেছি, হুজুর। হুকুম করিলেই হুজুরে হাজির হব।”

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

মধুপুর বড় সহর নহে, এখানে এক রাত্রে দু’দুটো খুন হইলে সমস্ত মধুপুর যে চঞ্চল হইয়া উঠিবে, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? বিশেষতঃ যাঁহারা খুন হইয়াছেন, তাঁহারা দুইজনেই অতি সম্ভ্ৰান্ত লোক, মধুপুরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই তাঁহাদিগকে চিনিত। মাড়োয়ারী একজন বড় দোকানদার, আর রমেন্দ্রনাথ সকলেরই প্রিয় ছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের এই লোমহর্ষণ হত্যাকাণ্ডে সকলেই বিশেষ দুঃখিত হইল, এবং সহরময় একটা গোলযোগ পড়িয়া গেল। গত রাত্রি হইতে এই খুনের কথা ব্যতীত আর কাহারও মুখে কোন কথাই নাই।

প্রথমে সকলেই ভাবিয়াছিল যে আততায়িগণ মাড়োয়ারীকে খুন করিয়াছে, তাহারা ডাক্তার বাবুকেও খুন করিয়াছে। কিন্তু মাড়োয়ারীর টাকাকড়ি সমস্তই চুরি গিয়াছিল, সুতরাং তাহারাই যদি রমেন্দ্র বাবুকে খুন করিত, তাহা হইলে তাঁহার সঙ্গে যাহা কিছু ছিল, তাহা কখনই ছাড়িয়া যাইত না। কিন্তু রমেন্দ্র বাবুর সোনার ঘড়ী চেন, তাঁহার হাতের হীরার আংটী, তাঁহার পকেটের টাকা কিছুই অপহৃত হয় নাই;কাজেকাজেই বেশ বুঝিতে পারা যায়, টাকার জন্য কেহ তাঁহাকে হত্যা করে নাই, কেননা তাহা হইলে তাহারা কখনই তাঁহার আংটী, ঘড়ী প্রভৃতি ছাড়িয়া যাইত না। এইজন্য সকলে মনে করিল যে যাহারা মাড়োয়ারীকে খুন করিয়াছিল, তাহারা রমেন্দ্রনাথকে খুন করে নাই, রমেন্দ্রনাথের হত্যাকারী অন্য কেহ। এখন জিজ্ঞাসা সে কে? কেন রমেন্দ্রনাথকে খুন করিল? মধুপুরে তাহার কোন শত্রু ছিল না, তবে কি অন্য কোন স্থান হইতে কেহ আসিয়া তাঁহাকে খুন করিয়া পালাইল? মধুপুরবাসিমাত্রেই এই সকল কথা লইয়া পথে ঘাটে মাঠে বাড়ীতে আলোচনা করিতে লাগিল।

রমেন্দ্রনাথের মৃতদেহ দেখিয়া জানা গেল যে কেহ তাঁহার পশ্চাদ্ভাগ হইতে তাঁহার মস্তকে লগুড়াঘাত করিয়াছিল; সেই আঘাতেই তিনি ঘুরিয়া পথি-পার্শ্বস্থ খানার ভিতরে পড়িয়া গিয়াছিলেন। খুব সম্ভব তাঁহার মস্তকে যে আঘাত লাগিয়াছিল, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল। তিনি মরিয়াছেন কি জীবিত আছেন তাহা তাঁহার হত্যাকারী আর ফিরিয়া দেখে নাই, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে পলাইয়াছিল।

সেখানকার মাটী পাথরের ন্যায় কঠিন, কাজেই নিকটে কাহারই পায়ের দাগ পড়ে নাই। কয় জন লোক সে সময়ে তথায় উপস্থিত ছিল, তাহাও জানিবার উপায় নাই।

রমেন্দ্রনাথের ভৃত্য বলিল, সে বাবুর প্রতীক্ষায় জাগিয়া বসিয়া ছিল। রাত্রি প্রায় দশটার সময় সে বাহিরে একটা শব্দ শুনিতে পাইয়াছিল, কিন্তু পথে অন্ধকারে কেহ পড়িয়া গিয়াছে ভাবিয়া সে তাহা আর তত লক্ষ্য করে নাই। তাহার পর অনেক লোক মাড়োয়ারী ভদ্রলোককে দেখিবার জন্য বাবুকে ডাকিতে আসিয়াছিল, তখনও বাবু ফিরেন নাই। রাত্রি বারোটা বাজিল, তবুও বাবু ফিরিল না দেখিয়া সে লণ্ঠন লইয়া বাবুকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। বাবুকে কোথায়ও দেখিতে না পাইয়া সে বাড়ীতে ফিরিয়া আসিতেছিল। বাড়ীর কাছে আসিবামাত্র লণ্ঠনের আলোতে সে দেখিল যে কে যেন খানার ভিতরে পড়িয়া রহিয়াছে। আলো ধরিয়া ভাল করিয়া দেখিয়া সে জানিল, তাহার প্রভু। তখন সে ভয় পাইয়া সকলকে খবর দিয়াছিল।

বলা বাহুল্য প্রফুল্লকুমার, মনিয়া মালী ও সতীশচন্দ্র যাহা তাহাকে বলিয়াছিলেন তাহা সকলকেই বলিলেন। মনিয়াকে সকলে চিনিত, তাহার উপর সন্দেহ করিবার কোন কারণও ছিল না, সুতরাং তাহার কথা সহজে কেহ অবিশ্বাস করিতে পারিল না। আবার সতীশচন্দ্র বড় লোক। যদিও তিনি অল্পদিন মধুপুরে আসিয়াছেন, তথাচ সকলেই তাঁহাকে অতিভদ্রলোক বলিয়া জানিয়াছিল, সুতরাং তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহাও কেহ অবিশ্বাস করিতে পারিল না। তবে এই দুই জনের দুই রকম কথায় সকলেই কিছু না কিছু বিস্মিত হইল মাত্র, কেহই কোন কারণ স্থির করিতে পারিল না।

যাহাই হউক, পুলিশ নিশ্চিন্ত ছিল না। তাহারা এই দুই খুনের অনুসন্ধান বিশেষরূপে করিতেছিল। তিন দিনের দিন পুলিশের দ্বারা মাড়োয়ারীর দুই খুনী ধৃত হইল। ইহারা দুই জন অতি বলবা দোষাদ, ইহাদের কার্য্যই চুরি ডাকাতি। পুলিশ-বিনা কারণে ইহাদিগকে ধৃত করে নাই। মাড়োয়ারীর নিকট হইতে ইহারা যাহা কিছু অপহরণ করিয়াছিল, পুলিশ তাহা সমস্তই ইহাদের নিকটে পাইল। পুলিশ ইহাদের বিরুদ্ধে আরও অনেক প্রমাণ পাইয়াছিল, সে সকলের উল্লেখ এখানে নিষ্প্রোয়জন। অনুসন্ধানে জানা গেল, কয় দিন হইতে এই দুই জন দোষাদ মধুপুরে ঘুরিতেছিল, ইহাদের সঙ্গে দামন নামে আর একটা লোকও ছিল; কিন্তু পুলিশ তাহার কোন সন্ধান পাইল না। যে দুইজন ধরা পড়িয়াছিল, তাহারা বলিল, দামন কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহা তাহারা জানে না।

মাড়োয়ারী ও ডাক্তার যে প্রায় একই সময়ে খুন হইয়াছিলেন, তাহাও একরূপ সপ্রমাণ হইল সুতরাং সকলেই বুঝিল, এই দোষাদগণ কখনই রমেন্দ্রনাথকে খুন করে নাই। তিনি অন্য কোন লোক কর্তৃক হত হইয়াছেন।

পুলিশ মাড়োয়ারীর হত্যাকারি-দ্বয়কে ধরিয়া রমেন্দ্র বাবুর খুনীকে ধরিবার জন্য বিশেষ সচেষ্ট হইল। ইনস্পেক্টর আগামী রবিবারে এ সম্বন্ধে সকলের এজেহার লইবেন, তাহা প্রচার করিলেন।

এই সময়ে রমেন্দ্রনাথের বৃদ্ধা জননী দেশ হইতে মধুপুরে উপস্থিত হইলেন। প্রফুল্লকুমার প্রভৃতি অনেকেই তাঁহাকে নিজ নিজ বাড়ীতে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিলেন; কিন্তু তিনি তাঁহাদের কাহারও অনুরোধ রক্ষা করিলেন না, তাঁহার মৃত পুত্রের বাড়ীতেই আশ্রয় লইলেন।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

ক্রমে সতীশচন্দ্রের উপরেই ডাক্তারের খুনের সন্দেহ বিশেষরূপে পড়িল। তবে মধুপুরের কে সহজে তাঁহার উপর সন্দেহ করিতে পারিল না, কেননা তাহারা জানিত না যে রমেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার স্ত্রীর পরিচয় ছিল, আর তাহারা সতীশচন্দ্রের মনের ভাবও জানিত না;কাজেই তাঁহার উপরে তাঁহাদের সন্দেহ তেমন বদ্ধমূল হইতে পারিল না।

কিন্তু হেমাঙ্গিনীর কথা স্বতন্ত্র। তাহার স্বামীর মনের ভাব, তাঁহার ভয়াবহ ঈর্ষা—রমেন্দ্রের উপরে বিজাতীয় ক্রোধ, হেমাঙ্গিনী এ সকলই সম্পূর্ণ জানিত। এমন কি একদিন সতীশচন্দ্র তাহার কাছে বলিয়াও ফেলিয়াছিলেন, তিনি রমেন্দ্রকে বিধিমত শিক্ষা দিবেন। তাহার উপর সেদিন সতীশচন্দ্ৰ অনেক রাত্রে বাড়ীতে ফিরিয়াছিলেন এবং চোরের ন্যায় কাহারও সহিত কোন কথা না বলিয়া একেবারে শয়নগৃহে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়াছিলেন, শেষে অনেকক্ষণ পরে তিনি কাপড় জামা ছাড়িয়া অন্য কাপড় জামা পরিয়া বাহিরে আসিয়াছিলেন। তা হৌক, এ সকল সত্ত্বেও তাঁহার উপর সন্দেহ হইবার কারণ ছিল না, কেননা তিনি একজন শিক্ষিত চরিত্রবান্ বিশিষ্ট ভদ্রলোক, সর্ব্বোপরি তিনি তাহার স্বামী। তবে তিনি যে সময়ে রমেন্দ্রের হত্যার খবর দিয়াছিলেন, তখন এই হত্যাসম্বন্ধে মধুপুরে কেহ কিছু জানিত না—জানিবার সম্ভাবনাও ছিল না। কিরূপে তাহা হইলে তিনি জানিলেন? হেমাঙ্গিনী আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিল, তাহার দৃষ্টিপথে পৃথিবী যেন হেলিয়া পড়িতে লাগিল, অতি বেগে তাহার বক্ষে বেপন আরম্ভ হইল।

ইহা ভিন্ন সতীশচন্দ্র সর্ব্বদাই বাহির হইবার সময়ে একটা বড় লাঠী লইয়া বাহির হইতেন। তিনি সেই রাত্রে সেই লাঠী লইয়া বাড়ীতে ফিরিয়াছিলেন কি না, তাহা হেমাঙ্গিনী দেখে নাই; তবে সেই দিন হইতে এ পর্যন্ত সে আর সে লাঠী দেখিতে পায় নাই। সে লাঠী কোথায় গেল? তিনি সে লাঠীগাছটা কি করিলেন? হেমাঙ্গিনী শুনিয়াছিল যে, কে পশ্চাদ্দিক্ হইতে রমেন্দ্রনাথের মস্তকে লাঠী মারিয়া তাহাকে হত্যা করিয়াছে। স্বামীর উপর এই ভীষণ সন্দেহে হেমাঙ্গিনীর মস্তিষ্কে কে যেন এক প্রচণ্ড দাবানল সংযোগ করিয়া দিল। কিন্তু তাহার স্বামী যে এরূপ ভয়াবহ কাজ করিবেন, কিছুতেই একথা তাহার মন মানিতে চাহিল না। দারুণ কারণপরম্পরায় সন্দেহ গাঢ়ীভূত না হইয়া আর উপায় নাই, কিন্তু কোনমতে সে ইহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। দাম্পত্য এমনই পবিত্র বন্ধন বটে, সহধর্মিণী নিজের চক্ষুকে অবিশ্বাস করিতে পারে, এমনকি গুরু ও ইষ্টদেবতার কথায় অনাস্থা করিতে পারে, কিন্তু পতিকে কখনও অবিশ্বাস করিবে না।

পর দিন সতীশচন্দ্র বেড়াইতে বাহির হইলে হেমাঙ্গিনী আসিয়া শয়নগৃহের দরজা বন্ধ করিল। সেই ঘটনার দিন তাহার স্বামী যে জামা পরিয়া বাহির হইয়াছিলেন, তিনি সর্ব্বদাই যে লাঠীখানি ব্যবহার করিতেন, তাহা কোথায় গেল, তাহা জানিবার জন্য হেমাঙ্গিনী উন্মাদিনীর মত হইল। তাহার বিশ্বাস, তাহার স্বামী সে সকল এই ঘরে কোনখানে লুকাইয়া রাখিয়াছেন—খুব সম্ভব, তিনি তাঁহার নিজ বাক্স মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছেন। যতক্ষণ এই সম্বন্ধে সত্য মিথ্যা জানিতে না পারিবে, ততক্ষণ হেমাঙ্গিনী কিছুতেই স্থির হইতে পারিবে না, আর এ অবস্থায় অধিকক্ষণ থাকিলে সে সত্য সত্যই একেবারে উন্মত্ত হইয়া উঠিবে।

হেমাঙ্গিনী ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া গৃহমধ্যে তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিল। কিন্তু সে যাহা খুঁজিতেছিল, তাহা কোথায়ও পাইল না। তবে কি সে যাহা ভাবিয়াছে, তাহাই সত্য? প্রকৃতই কি তাঁহার স্বামী তাঁহার সে দিনের জামা, কাপড় ও লাঠী তাঁহার নিজের বাক্সে লুকাইয়া রাখিয়াছেন?

সতীশচন্দ্রের তিন চারিটা বড় বাক্স ছিল। এই সকল বাক্সের চাবী তিনি নিজের নিকটে রাখিতেন। হেমাঙ্গিনী নিজের চাবীগুলি লইয়া সেই কয়েকটি বাক্স খুলিবার চেষ্টা পাইতেঁ লাগিল। অনেকক্ষণ পরে অনেক কষ্টে সে একটা বাক্স খুলিল, তাহাতে সে কাপড় জামা নাই। আর একটা খুলিল, তাহাতেও নাই। তাহার পরে আর একটা খুলিল, অমনি কে যেন তাহার বুকে সহসা প্রবলবেগে একটা ধাক্কা দিল—সে উন্মীলিত নেত্রে চারিদিক্ অন্ধকার দেখিল!

সেই বাক্সের মধ্যেই সেই লাঠী—ভাঙ্গা—দুই খণ্ডে বিভক্ত!! কি একটা কালো দাগ লাঠীর মাথায় রহিয়াছে। লাঠীর নীচেই সেই জামা ও কাপড়—রক্তসলিল-সিক্ত—কি ভয়ঙকর!

হেমাঙ্গিনী ক্ষিতিতল-ন্যস্ত-জানু হইয়া বসিয়া পড়িল এবং নিমেষমধ্যে তাহার দৃষ্টিতে, তাহার নিশ্বাসে, তাহার শিরায় শিরায়, তাহার অস্থিগুলির মধ্যে, একটা অতি তীব্র বিদ্যুৎ-প্রবাহ খেলিয়া গেল, সর্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তবে—তবে—যথার্থই তাহার স্বামী নরহন্তা—তাহার স্বামী নিরীহ রমেন্দ্রকে সত্য সত্যই হত্যা করিয়াছেন!

হেমাঙ্গিনীর চিন্তাশক্তি একবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল—সে স্তম্ভিত হইয়া বহুক্ষণ বসিয়া রহিল। সে কি করিয়াছে!—তাহার স্বামী যে তাহা জানিতে পারিবেন! এখন জানিলেই বা কি! তাহার আর  সংসারের কোন কিছুতেই আস্থা নাই,—মায়া মমতা নাই,—তাহার হৃদয়ের গ্রন্থি ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। তাহার পুত্র কন্যা না থাকিলে সে যে এতক্ষণ কি করিত, তাহা বলা যায় না।

এই সময় কে দরজায় আঘাত করিল, অমনি শরাহত হরিণীর ন্যায় হেমাঙ্গিনী এক লম্ফে উঠিয়া দাঁড়াইল। বাহির হইতে পুরাণ ঝি বলিল, “দিদিমণি, একজন কে এসেছে।”

হেমাঙ্গিনী কি উত্তর দিল, তাহা সে নিজে জানে না, তাহার কোন জ্ঞান ছিল না। ঝি আবার বলিল, “একজন কে এসেছেন।”

কম্পিত-হস্তে হেমাঙ্গিনী সত্বর বাক্স বন্ধ করিল, তারপর ধীরে দীরে গিয়া দরজা খুলিল। ঝি বলিল, “একজন মেয়ে মানুষ তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন, তাহাকে আগে আর কখনও দেখি নাই। একি! দিদিমণি তোমার কি অসুখ করিয়াছে! তোমার মুখ চোখ এ রকম হইয়াছে কেন?”

হেমাঙ্গিনী অতি অস্পষ্ট স্বরে বলিল “না, মাথাটা বড় ধরিয়াছে। কে আসিয়াছেন? বল গিয়ে আমার অসুখ—ভারি অসুখ করিয়াছে।”

ঝির পশ্চাদ্দিক্ হইতে একজন বলিল, “দুই একটা কথা কহিব মাত্র, বেশি বিরক্ত করিব না।

স্ত্রীলোকটী নিঃশব্দে ঝির পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছিল। হেমাঙ্গিনী তাহাকে দেখিবামাত্রই চিনিতে পারিয়াছিল। তাহাকে দেখিবামাত্র তাহার হৃদয় আরও দমিয়া গেল, সে চারিদিক্ অন্ধকার দেখিল। হেমাঙ্গিনী এই স্ত্রীলোককে চিনিতে পারিয়াছিল—ইনি রমেন্দ্রের জননী।

কলিকাতায় একবার রমেন্দ্রের জননীর সহিত হেমাঙ্গিনীর দেখা হইয়াছিল। সংসারে এই দরিদ্রা জননী ব্যতীত রমেন্দ্রের আর কেহই ছিল না। রমেন্দ্রনাথ মাতার নিকটে নিজের কোন কথাই গোপন করিতেন না। হেমাঙ্গিনীর বিষয় তিনি জননীকে সকলই বলিয়াছিলেন, তাই কলিকাতায় আসিয়া জননী হেমাঙ্গিনীর সহিত একবার সাক্ষাৎ করেন। সেই দিন হইতে হেমাঙ্গিনী তাহাকে অত্যন্ত ভয় করিত, অথচ কেন ভয় করিত তাহা সে জানিত না।

হেমাঙ্গিনী রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আসুন বসুন।”

রমেন্দ্রের জননী আসিয়া গৃহমধ্যস্থ শয্যায় বসিলেন। যতক্ষণ ঝি না চলিয়া গেল, তিনি ততক্ষণ কোন কথাই কহিলেন না, হেমাঙ্গিনীরও কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না।

ঝি চলিয়া গেলে রমেন্দ্রনাথের জননী অতি গম্ভীর ভাবে ধীরে ধীরে বলিলেন, “কে আমার রমেনকে খুন করিয়াছে, তাহা শুনিতে আমি তোমার কাছে আসিয়াছি।”

হেমাঙ্গিনীর বোধ হইল তাহার পদতল হইতে পৃথিবী ধীরে ধীরে সরিয়া যাইতেছে। কে যেন দুই হাতে সজোরে তাহার গলা চাপিয়া ধরিল! তাঁহার সম্মুখেই সেই বাক্সমধ্যে তাঁহার পুত্রের হত্যার ঘোরতর প্রমাণ লুক্কায়িত রহিয়াছে! তাহা কত ভয়ানক—কত ভীষণ—তাহা হেমাঙ্গিনীর ভাবিবারও ক্ষমতা নাই! হেমাঙ্গিনী কথা কহিতে পারিল না।

রমেন্দ্রের জননী বলিলেন, “তুমিই তাহকে খুন করিয়াছ!”

হেমাঙ্গিনী আর সহ্য করিতে পারিল না, কাঁদিয়া ফেলিল। তারপর অশ্রুপ্লাবিতনেত্রে সে বলিল, “আমি তাঁহাকে খুন করিয়াছি! এই কথা বলিতে আপনি আমার কাছে আসিয়াছেন?”

রমেন্দ্রের জননী বলিলেন, “আমার ছেলে কিরূপে মরিয়াছে, তাহা আমি সব শুনিয়াছি। কে আমার বাছাকে খুন করিল, আমি রাত দিন তাহাই ভাবিতেছিলাম। সকলেই এখানে বলিতেছে, আমার ছেলেকে সকলেই ভাল বাসিত। আজ এইমাত্র শুনিলাম, তুমি এইখানে আছ। এই কথা শুনিবামাত্র আমার মনে হইল—’ওঃ এখন বুঝিতেছি, আমার ছেলে—আমার সোণার চাঁদ বাছা, কেন হত হইয়াছে।’ আমি জানি, তুমি নিজের হাতে তাহাকে খুন কর নাই—করিতে পারও না—তবে অন্য লোক দিয়া তাহাকে খুন করাইতে পার! তাহাই কি করিয়াছ?”

হেমাঙ্গিনী নরীবে সর্ব্বাঙ্গে প্রস্তরবর্ষণবৎ এই সকল ভয়ানক কথা শুনিতে লাগিল; তাহার রাগ হইল না। সে বিনীতভাবে বেদনাপ্লুত হৃদয়ে বলিল, “আপনি এমন ভয়ানক কথা বলিবেন না, আমার প্রাণ দিলে যদি তিনি প্রাণ পাইতেন, আমি তাহাও করিতাম।”

রমেন্দ্রের জননী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন; অবশেষে বলিলেন “তুমি আমার ছেলের সুখ শান্তি এক সময়ে নষ্ট করিয়াছিলে—তুমি তাহার জীবনের শনি, কাজেই তাহার এই রকম মৃত্যুতে আমার সন্দেহ স্বভাবতঃ তোমার উপরই হইয়াছে।”

তথাপি হেমাঙ্গিনী রাগ করিল না, যেন লজ্জায় ঘৃণায় মাটীর সঙ্গে মিশাইয়া গেল; সেই রকম ভাবেই কহিল, “যাহা বহুদিন হইয়া গিয়াছে, তাহার কথা তুলিয়া আমাকে আর কষ্ট দিবেন না আপনার ছেলে এখানে আমার ছেলের রোগে প্রাণরক্ষা করিয়াছেন, আপনার ছেলের অনিষ্ট হয়, এমন কাজ আমি করিব!”

এইবার রমেন্দ্রের মা সুর ফিরাইয়া বলিলেন, “তোমায় এমন দেখিতেছি কেন? তোমার কি হইয়াছে? এত শরীরের অসুখ বলিয়া বোধ হয় না! এ যে মনের অসুখ! কিসের জন্য?”

হেমাঙ্গিনী সরল হৃদয়ে বলিল, “আপনার কাছে গোপন করিব না—আপনার ছেলের এই রকম আকস্মিক ভীষণ হত্যায় আমার অত্যন্ত দুঃখ হইয়াছে। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি তাঁহার মৃত্যুর বিষয় কিছু জানি না।”

“আর তোমার স্বামী?”

“আমার স্বামী! তিনি কেন তাঁহার অনিষ্ট করিবেন?”

হেমাঙ্গিনীর সে সময়ের মনের অবস্থা কি বর্ণনা করা যায়? তাহার প্রাণ যেন বুক ফাটিয়া বাহির হইতেছিল। সে এইমাত্র স্বামীর ভগ্ন যষ্টি ও সলিলসিক্ত বস্ত্রাদি দর্শনে একরূপ অকাট্য প্রমাণ পাইয়াছে কে রমেন্দ্রকে খুন করিয়াছে। খুনী তাহার স্বামী—তাহারই পুত্র কন্যার পিতা! আর তাহার সম্মুখে উপবিষ্টা নিহত রমেন্দ্রের জননী! যে কখনও তাহার মত অবস্থায় না পড়িয়াছে, সে কখনও কি তাহা উপলব্ধি করিতে পারে! হেমাঙ্গিনীর যেন নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল।

নিঃসঙ্গের ন্যায় হেমাঙ্গিনী বলিল, “আপনি কখনও এ কথা মনে স্থান দিবেন না, আমরা আপনার ছেলের অনিষ্ট করিব। ইহা অসম্ভব।”

রমেন্দ্রের জননী উঠিলেন, উঠিয়া বলিলেন, “হেমাঙ্গিনী, অনেক দিন আগে এক সময়ে তুমি আমার সুখ শান্তি নষ্ট করিয়াছিলে, তোমারই জন্য সে আজ পর্য্যন্ত বিবাহ করে নাই। সেই সময় যখন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল, তখন বলিয়াছিলাম, যদি তোমার জীবন কখনও দুঃখের, যাতনার, কষ্টের শ্মশানক্ষেত্র হয়, তখন মনে করিও যে, তুমি তোমার নিজের পাপের দণ্ড পাইতেছ! এখনও সেই কথা বলিতেছি—আমার কথা যেন বেশ মনে থাকে!”

হেমাঙ্গিনীর কণ্ঠরোধ হইল। যথার্থই কি তাহার পাপের দণ্ড-ভোগ আরম্ভ হইতেছে। উঃ কি ভীষণ!

রমেন্দ্রের মা দ্বারের নিকটে গিয়া অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে তোমরা জান না, কে আমার ছেলেকে খুন করিয়াছে?”

হেমাঙ্গিনী ক্লিষ্টনিশ্বাসসহকারে বলিল, “আমরা কেমন করিয়া জানিব?”

রমেন্দ্রের মা প্রস্থান করিলেন। তাঁহার সঙ্গে যাইয়া তাঁহাকে যে একটু অগ্রসর করিয়া দেওয়া উচিত, তাহাতে হেমাঙ্গিনীর সাহস হইল না। সে সেইখানে বসিয়া পড়িল, সমগ্র পৃথিবী তাহার নেত্রপথে ঘুরিতে লাগিল, একটা মহা কোলাহলময় স্বপ্ন-বিভীষিকা যেন তাহার সম্মুখে জমাট বাঁধিয়া রহিল।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

এই সময়ে হেমাঙ্গিনী গৃহের বাহিরে কাহার পদশব্দ শুনিল। সেই শব্দে তাহার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল—আবার কি রমেন্দ্রের মা ফিরিয়া আসিতেছেন!

না, এবার তিনি নহেন। হেমাঙ্গিনী নিশ্বাস ফেলিল, তখনই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন পিসীমা। পিসীমা গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেও হেমাঙ্গিনী কোন কথা কহিতে পারিল না। পিসীমা হেমাঙ্গিনীর পার্শ্বে আসিয়া বসিলেন। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “মা, তোমার এ কি চেহারা হইতেছে, তাহা কি দেখিতেছ না?”

তবুও হেমাঙ্গিনী কথা কহিতে পারিল না। তখন তাহার কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না। পিসীমা ধীরে ধীরে বলিলেন, “এখানকার সকল লোকেই নানা কথা বলিতেছে। হেম, আমি তোমায় দুই-একটা কথা বলিতে চাই।”

তথাপি হেমাঙ্গিনী নীরব—তাহার দৃষ্টি পিসীমার চোখের উপরে—নিশ্চল, নিষ্পন্দ!

পিসীমা বলিলেন, “দেখ হেম, কে এই ভয়ানক কাজ করিয়াছে, কি কে করে নাই, তাহা আমি বলিতেছি না। সতীশ সে দিন যাহা বলিয়াছিল, তাহা এখন এখানকার সকলেই শুনিয়াছে। এই জন্য নানা লোকে এখন নানা কথা বলিতেছে। যখন রমেন্দ্র খুন হইয়াছে কি না তাহা কেহ জানিত না, তখন কেমন করিয়া আমাদের সতীশ জানিল, রমেন্দ্র খুন হইয়াছে? কেবল কি খুন হইয়াছে—তাহা নহে, কেমন করিয়া কি ভাবে সে খুন হইয়াছে, তাহা পৰ্য্যন্ত সে বলিয়াছিল। এ কথা তাহার না বলাই ভাল ছিল, আমিও তখন না বুঝিতে পারিয়া প্রফুল্ল বাবুর সম্মুখে বলিয়া ফেলিয়াছিলাম। আমরা স্ত্রীজাতি অতি মূৰ্খ, কাণ্ডজ্ঞান-শূন্য, নিতান্ত অদূরদর্শী। তাই লোকে চিরদিন সত্যই বলে—স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার উপায় নাই। যাহাতে ইহার জন্য ভাবিষ্যতে আর কোনও অনিষ্ট হইতে না পারে, তাহাই করিতে হইবে।”

হতভাগিনী হেমাঙ্গিনী রুদ্ধকন্ঠে শুধু বলিল, “হা ভগবান!”

“উপায় আছে—হেম।”

“কি উপায়?”

“উপায়? আমি আর সুধাংশু দুইজনেই মিথ্যাকথা বলিব। যখন পুলিশ আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবে,—নিশ্চয়ই তাহারা আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে ছাড়িবে না, তখন আমরা উল্টা কথা বলিব। সতীশ যাহা বলিয়াছিল, তাহা বলিব না—সতীশকেও আমাদের মত কথা বলিতে হইবে।”

“কি বলিবেন?”

“সুধাংশু বলিবে সে গিরিধী হইতে সে রাত্রে ফিরিবার সময়ে ডাক্তারের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া আসিতেছিল, সেইখানে অনেক লোক দেখিয়া সেও দাঁড়ায়, তখন রমেন্দ্রের মৃতদেহ দেখিতে পাইয়াছিল। কি হইয়াছিল, সে সেই সব লোকের নিকটে শুনিতে পায়, তাহার পর সেই রাত্রে সে আমাদের কাছে আসিয়াই সে কথা বলে।”

“কিন্তু এ কথা ত ঠিক নয়?”

“তাহা আমি জানি, ঠিক না হইলেও এখন সতীশকে ইহাই বলিতে হইবে—এখন আর অন্য উয়ায় নাই। আমিও বলিব আমি ভুল করিয়া সতীশের নাম করিয়াছিলাম। খুনের কথা শুনিয়া মাথা ঠিক ছিল না, তাই সুধাংশুর নাম না করিয়া ভুলিয়া সতীশের নাম করিয়াছিলাম। সতীশও ভুলক্রমে মালীর কথার সহিত সুধাংশুর গোল করিয়া ফেলিয়াছিল। সে তখন জানিত না যে দুইটা খুন হইয়াছে, তাই মালী যে খুনের কথা বলিয়াছিল, সতীশ সে খুন ডাক্তার সম্বন্ধেই ভাবিয়াছিল। এরূপ ভুল হওয়া সম্ভব, আমাদের সকলেরই ভুল হইয়াছিল। এ কেবল ভুল—আর আমাদের সকলেরই সব কথা ঠিক মনে থাকিবে ত? পুলিশ আসিবার আগেই আমাদের সকলেরই সব কথা ঠিক করিয়া রাখা উচিত।”

হেমাঙ্গিনী অস্পষ্ট জড়িত স্বরে বলিল, “হাঁ, পিসীমা তাই—ভগবান আমার অদৃষ্টে ইহাও লিখিয়াছিলেন—!”

পিসীমা বলিলেন, “এখন ও সব কথা যাক্, অন্য কথায় আর এখন কাজ নাই। এখন যাহাতে সতীশ রক্ষা পায়, যাহাতে সকলে আমরা রক্ষা পাই, তাহাই করিতে হইবে। এখন আর কিছু ভাবিবার আবশ্যক নাই।”

“আর—আর—সুধাংশু—সে কি—”

“তাহার বিষয় নিশ্চিন্ত থাক। সুধাংশু মূর্খ ছেলে নয়। আমি তাহার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিয়াছি। সে ঠিক বলিবে, তাহার জন্য কোন ভয় নাই। সৌভাগ্যের বিষয়, সতীশ সে রাত্রে এ কথা চাকর-বাকরদের সম্মুখে বলে নাই।”

হেমাঙ্গিনী কথা কহিল না, নীরবে নিষ্পন্দভাবে বসিয়া রহিল। পিসীমা বলিলেন, “সতীশকে এ কথা বলিও। সেও যেন ঠিক এই কথা বলে, তাহা হইলে তাহার কথায় লোকে যে তাহার উপর সন্দেহ করিতেছে, সে সন্দেহ আর থাকিবে না, সমস্ত গোলই মিটিয়া যাইবে।”

পিসীমা চলিয়া গেলেন। হেমাঙ্গিনী সেইখানে করতল-লগ্ন শীর্ষ শূন্যহৃদয় পাষাণ-প্রতিমার মত বসিয়া রহিল। তাহার বোধ হইল যেন তাহার মাথা ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। অনেকক্ষণ পরে সে উঠিয়া খোকার ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল।

পিসীমা তাহার স্বামীকে যে কথা বলিতে বলিয়াছেন, সে কথা এখন হেমাঙ্গিনী কিরূপে তাহাকে বলিবে? ইহা কি বলা সম্ভব? হেমাঙ্গিনী সমস্ত দিন ইহাই ভাবিল। সতীশচন্দ্র বাহির হইয়া গিয়াছিলেন, সুতরাং একাকী বিছানায় পড়িয়া সে ইহাই ভাবিতে লাগিল, কিন্তু ভাবিয়া ভাবিয়া, সমস্ত দিন ভাবিয়াও সে কিছুই স্থির করিতে পারিল না।

বৈকালে সতীশচন্দ্র ফিরিয়া আসিলেন। তিনি হেমাঙ্গিনীকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, “কি! ভারি অসুখ করিয়াছে না কি?”

হেমাঙ্গিনী কাতরে বলিল, “হাঁ, একটু অসুখ করিয়াছে।”

“নিজের ঘরে একটু ঘুমাও গে যাও, তাহা হইলে অসুখ সারিবে।”

“এইখানে বেশ আছি।”

সতীশচন্দ্র মুখ অবনত করিয়া সস্নেহ মৃদুহাস্যে হেমাঙ্গিনীর ললাটে চুম্বন করিতে উদ্যত হইলেন, হেম অতি কাতরকন্ঠে অর্দ্ধস্ফুট আর্তনাদ করিয়া বালিশে মুখ লুকাইল। তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছিল, ঘরের ভিতরে অল্প অন্ধকার সঞ্চিত হইয়াছিল, সতীশচন্দ্র সেই অন্ধকারে হেমাঙ্গিনীর পাণ্ডুবর্ণ অশ্রুপ্লাবিত অস্তোন্মুখ চন্দ্রমার ন্যায় মুখখানি দেখিতে পাইলেন কি?

সতীশচন্দ্রের ললাট অন্ধকার হইল। তিনি মৃদু স্বরে অতি দৃঢ় ভাবে বলিলেন, “কি ভুল বিশ্বাস মাথার ভিতর আনিয়াছ—আমি বলিতেছি—সম্পূর্ণ ভুল—সম্পূর্ণ ভুল।”

তিনি আর কোন কথা না কহিয়া সে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

ক্রমে সন্ধ্যা হইল। অন্ধকার এক-পা এক-পা করিয়া সমস্ত দখল করিল। সন্ধ্যার পর সুবিধা পাইয়া পিসীমা আসিয়া হেমাঙ্গিনীকে জিজ্ঞাস করিলেন, “কেমন, সতীশকে সে কথা বলিয়াছিলে?”

হেমাঙ্গিনী অতিখিন্ন কম্পিত স্বরে বলিল, “পিসীমা, তুমি বলিও—আমি পারিব না।”

পিসীমা কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “কাজেই দেখিতেছি আমারই বলিতে হইল। সতীশের সব কথা জানা উচিত।”

হেমাঙ্গিনীর হৃদয়মধ্যস্থ এ দারুণ দেবাসুরের দ্বন্দ্ব কে বুঝিবে! তাহার স্বামী হত্যাকারী! না, তাহা কি কখনও হয়! না হইবে কেন? প্রমাণ যে জ্বলন্ত, চাক্ষুষ-প্ৰায়! না না তাহা হইতে পারে না! তাহার হৃৎপিণ্ড যে উপরিয়া যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *