সহদেববাবুর পোট্রেট
যেটার আগে নাম ছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, সেই মিরজা গালিব স্ট্রিটে ল্যাজারাসের নিলামের দোকানে প্রতি রবিবার সকালে সহদেববাবুকে দেখা যেতে শুরু করেছে মাস তিনেক হল।
প্রথম অবস্থায় লোকাল ট্রেনে হেঁয়ালির বই, গোপাল ভাঁড়ের বই, খনার বচনের বই, পাঁচালির বই, এইসব বিক্রি করে, তারপর সাত বছর ধরে নানারকম দালালির কাজ করে কমিশনের টাকা জমিয়ে সেই টাকায় ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে আজ বছর পাঁচেক হল ইলেকট্রিক কেব্লের ব্যবসা করে সহদেব ঘোষ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে সদানন্দ রোডে তাঁর একটি ছিমছাম ফ্ল্যাট, একটা ফিয়াট গাড়ি, টেলিফোন, টেলিভিশন, দুটো চাকর, একটা ঠাকুর আর একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর। আগে যারা তাঁর খুব কাছের লোক ছিল, তারা এখন তাঁকে দেখলে চট্ করে চিনতে পারে না, বা চিনলেও সাহস করে এগিয়ে এসে কথা বলে না। সহদেববাবুরও খুব ইচ্ছে নেই যে তারা তাঁকে চেনে; তাই তিনি গোঁফ রেখেছেন, ঝুলপিটা এক ইঞ্চি বাড়িয়েছেন, আর চোখ খারাপ না হওয়া সত্ত্বেও একটা পাওয়ারবিহীন সোনার চশমা নিয়েছেন। অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নতুন বন্ধু জুটেছে, যাঁরা তাঁর বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় এসে ভাল চা ভাল সিগারেট খান, প্লাস্টিকের তাসে তিন-তাস খেলেন, আর শনি-রবিবার টেলিভিশনে হিন্দি-বাংলা ছবি দেখেন।
ল্যাজারাসের দোকানে যাওয়ার কারণটা সহদেববাবুর বৈঠকখানায় গেলেই বোঝ যায়। প্রতি রবিবারই তিনি ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্য নিলাম থেকে কিছু-না-কিছু শৌখিন জিনিস কিনে আনেন। ঘড়ি, ল্যাম্প, পিতল আর চীনে মাটির মূর্তি, রুপোর মোমবাতিদান, বিলিতি ল্যান্ডস্কেপ ছবি—ঘরের এ সব কিছুই ল্যাজারাসের দোকান থেকে আনা। এ ছাড়া টেবিল, চেয়ার, সোফা, কার্পেট ইত্যাদি তো আছেই।
আজ ল্যাজারাস কোম্পানির মিহিরবাবু কথা দিয়েছেন যে বিলিতি ঔপন্যাসিকদের ভাল এক সেট বই তিনি সহদেববাবুর জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন। মিহিরবাবু অভিজ্ঞ লোক, বিশ বছর আছেন ল্যাজারাস কোম্পানিতে। বাঁধাধরা খদ্দেরদের চাহিদাগুলো তিনি আগে থেকে আন্দাজ করতে পারেন। সহদেববাবুর পছন্দও তাঁর ভালভাবেই জানা। এর আগেও অনেক হঠাৎ-বড়লোকের চাহিদা তিনি মিটিয়েছেন। এঁরা অনেকেই যে লেখাপড়া বিশেষ না জানলেও ঝলমলে বিলিতি বই দিয়ে আলমারি সাজাতে ভালবাসেন সেটা মিহিরবাবু বিলক্ষণ জানেন।
ষোলোখানা বইয়ের সুদৃশ্য সেট, গাঢ় লাল চামড়ায় বাঁধানো, সহদেববাবুর দেখেই মনটা নেচে উঠেছিল। কিন্তু সেটা দেখার পরমুহুর্তেই, বইগুলো যে-টেবিলের উপর রাখা ছিল, তার পিছনেই দেয়ালে টাঙানো গিলটি করা ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি দেখে তিনি কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়ে বইয়ের কথাটা সাময়িকভাবে ভুলেই গেলেন।
ছবিটা একটা অয়েল পেন্টিং। একজন বাঙালি ভদ্রলোকের পোট্রেট। সাইজে আন্দাজ তিন ফুট বাই চার ফুট। সেটা যে বেশ পুরোনো, সেটা তার ধূলিমলিন অবস্থা থেকে যেমন বোঝা যায়, তেমনি বোঝা যায় ছবিতে দেখানো অনেক খুঁটিনাটি জিনিস থেকে। গড়গড়া, কেরোসিনের ল্যাম্প, রুপোর পানের ডিবে, হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা ছড়ি—এ সবই চলে-যাওয়া দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তা ছাড়া বাবুর পরনে গিলে করা একপেশে বোতামওয়ালা পাঞ্জাবি, ঘন কাজ করা কাশ্মীরি শাল, চুনট করা চওড়া পেড়ে ধুতি, এ সবই বা আজকের দিনে কে পরে? যে কালের ছবি, সেকালে অনেক সম্ভ্রান্ত বাঙালিই আর্টিস্টদের দিয়ে নিজেদের ছবি আঁকিয়ে বাড়িতে টাঙিয়ে রাখতেন; কাজেই তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যেটা সহদেববাবুকে অবাক করল, সেটা হল ভদ্রলোকের মুখ—‘কেমন দেখছেন?’ সহদেববাবুর দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন মিহিরবাবু—‘একেবারে আপনার মুখ বসানো—তাই নয় কি?’
সেটা সহদেববাবুরও মনে হয়েছিল, কিন্তু বিশ্বাসটাকে পাকা করার জন্য হাতের কাছে বিক্রির জন্য রাখা একটা বাহারের আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, ‘সত্যিই তো। এ কার ছবি মশাই?’
মিহিরবাবু জানেন না। বললেন, ‘একটা লট এসেছে চিৎপুরের এক পুরোনো বাড়ির গুদাম থেকে। এখন সে বাড়িতে গেঞ্জির কারখানা বসেছে। অনেক জিনিসের মধ্যে এটাও ছিল।’
‘কার ছবি জানেন না?’ আবার জিগ্যেস করলেন সহদেববাবু।
‘উহুঁ। দেখামাত্র আপনার কথা মনে হয়েছে। কোনও জমিদার-টমিদার হবে। তবে আর্টিস্ট নাকি নাম-করা। শৈলেশ চাটুজ্যে, এলগিন রোডে থাকেন, আর্ট নিয়ে লেখেন-টেখেন, তিনি এই কিছুক্ষণ আগে এসে দেখে বললেন, পরেশ গুঁই-এর নাকি এককালে সুনাম ছিল।’
ছবির ডান দিকের কোণে লাল রঙে লেখা শিল্পীর নামটা সহদেববাবুর দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘এটাও অকশন হবে নাকি?’ জিগ্যেস করলেন তিনি।
‘কেন, চাই আপনার?’
আশ্চর্য, সহদেব ঘোষের অনেক শখের মধ্যে একটা বড় শখ ছিল নিজের একটা পোট্রেট আঁকানো। ল্যাজারাসেই একদিন একটা তেল-রঙে আঁকা পুরোনো পোট্রেট দেখে শখটা মাথায় চাপে। কথাটা মিহিরবাবুকে বলাতে তিনিও উৎসাহ দিয়েছিলেন। —‘এ একটা নতুন জিনিস হবে মশাই। আজকাল আর এটার রেওয়াজই নেই; অথচ পাকা হাতে আঁকা একখানা বেশ বড় সাইজের পোট্রেট আঁকিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখলে সে-ঘরের চেহারাই পালটে যায়। আর এ সব ছবির আয়ু কতদিন ভাবতে পারেন? আর্ট গ্যালারিতে এখনও চারশো পাঁচশো বছরের পুরোনো অয়েল পেন্টিং-এর জেল্লা দেখলে মনে হবে কালকের আঁকা।’
কোনও আর্টিস্টের সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন কী শিল্প জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই বলে সহদেববাবু শেষটায় আনন্দবাজার আর যুগান্তরে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী সাংবাদিক সুজয় বোস বাতলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞাপনের ভাষা—‘তৈলচিত্রে প্রতিকৃতি-অঙ্কনে পারদর্শী শিল্পীর প্রয়োজন। প্রশংসাপত্রসহ নিম্নলিখিত ঠিকানায়’ ইত্যাদি।
একজন শিল্পীর দরখাস্ত দেখে তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠান সহদেববাবু। বছর পঁচিশেক বয়স, নাম কল্লোল, কল্লোল দাশগুপ্ত। গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টস থেকে পাশ করে রোজগারের চেষ্টা করছে। ছাত্র ভাল ছিল তার প্রমাণ রয়েছে সার্টিফিকেটে। কিন্তু ছেলেটির চুল দাড়ি গোঁফের বহর, ঢলঢলে প্যান্ট আর উগ্র বেগুনি রঙের সার্ট দেখে সহদেববাবু ভরসা পাননি। অতিরিক্ত অভাবী বলেই বোধহয় বারণ সত্ত্বেও ছেলেটি আরো দুবার এসেছিল, কিন্তু সহদেববাবুর মন ভেজেনি। যার চেহারা এত অপরিষ্কার তার ছবির হাত পরিষ্কার হবে কী করে?
শেষ পর্যন্ত এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করে এক ভদ্র চেহারাসম্পন্ন আর্টিস্টকে ডেকে দু’দিন সিটিংও দিয়েছিলেন সহদেববাবু। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে যখন দেখলেন যে তাঁর চেহারাটা ছবিতে তাঁর নিজের মতো না হয়ে নিউ মার্কেটের প্যারাডাইজ স্টোর্স-এর ব্রজেন দত্তর মতো হয়ে যাচ্ছে, তখন বাধ্য হয়ে আর্টিস্টের হাতে পাঁচটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছিলেন।
মিহিরবাবুর প্রশ্নের উত্তরে সহদেববাবু বললেন, ‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও তো ভাল আর্টিস্ট পেলাম না, অথচ এ যেন আমারই জন্য তৈরি!—তাই ভাবছিলাম, মানে…’
‘তা হলে আপনার জন্য রেখে দিই ছবিটা?’
‘কী রকম ইয়ে হবে?’
‘দাম? দেখি কত কমে পারি। তবে ওই যে বলছিলাম—আর্টিস্টের নাম ছিল এককালে।’
শেষ পর্যন্ত সাড়ে সাতশো টাকায় এই অজ্ঞাতপরিচয় বাঙালি বাবুর ছবিটি কিনে এনে সহদেব ঘোষ তাঁর বৈঠকখানায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে এমন একটা জায়গায় দেয়ালে স্থান দিলেন। ঘরের চেহারা সত্যিই ফিরে গেল। জবরদস্ত শিল্পী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাশ্মীরি শালের প্রত্যেকটি কলকা কত ধৈর্য ও যত্নের সঙ্গে আঁকা; ডান হাতের অনামিকায় আংটির হিরেটি যেন জ্বলজ্বল করছে; গড়গড়ার রুপোর কলকেটি যেন এইমাত্র পালিশ করা।
বলা বাহুল্য সহদেববাবুর বন্ধুরাও ছবিটি দেখে থ’ মেরে গেলেন। প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন যে সহদেব বুঝি কোনও ফাঁকে কোনও শিল্পীর স্টুডিওতে গিয়ে ছবিটা আঁকিয়ে এনেছেন। তারপর আসল ঘটনাটা শুনে তাদের সকলের চোখ ছানাবড়া। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের প্রত্যেকেরই নাক চোখ কান ঠোঁট মুখের মোটামুটি একই জায়গায় থাকা সত্ত্বেও এক যমজ ভাই-বোন ছাড়া দু’জনের চেহারায় এতটা সাদৃশ্য কোথায় চোখে পড়ে? সত্যনাথ বকশী তো সরাসরি জিগ্যেস করে বসল ‘ইনি তোমার কোনও পূর্বপুরুষ নন তো?’ সেটা অবিশ্যি সম্ভব না, কারণ সহদেবের পূর্বপুরুষদের মধ্যে গত একশো বছরে কেউই পয়সা করেননি। ঠাকুরদাদা ছিলেন রেল স্টেশনের টিকিটবাবু, আর প্রপিতামহ ছিলেন জমিদারি সেরেস্তায় সামান্য কেরানি।
নন্দ বাঁড়ুজ্যের রহস্য উপন্যাস পড়ার বাতিক, সে নিজেকে একটি ছোটখাটো গোয়েন্দা হিসেবে কল্পনা করতে ভালবাসে। সে বলল, ‘এই বাবুটির পরিচয় খুঁজে না বার করা পর্যন্ত সোয়াস্তি নেই। ওই হিরের আংটিটার মধ্যে আমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। নিতাইদার কাছে চার ভল্যুম বংশ-পরিচয় আছে। বাংলার জমিদারদের নাড়ী-নক্ষত্র তাতে জানা যায়; ছবিও আছে অনেকগুলো।’
সেদিন আর তাসের আড্ডা জমল না। এই ধরনের কাকতালীয় ঘটনা আর কার কী জানা আছে সেই সব গল্প করে সন্ধেটা কেটে গেল।
রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে সহদেব অনুভব করলেন যে ছবিটা দিনের বেলায় বৈঠকখানায় থাকলেও, রাত্রে শোবার ঘরে রাখলে ভাল হয়। আর সেই সঙ্গে যদি ছবিটির মাথার উপর একটা ব্লু-লাইটের ব্যবস্থা করা যায়—যেমন ট্রেনের কামরায় থাকে—আর সেটা যদি সারারাত জ্বালিয়ে রাখা যায়, তা হলে ঘুমেরও ব্যাঘাত হবে না, অথচ মাঝ রাত্রে ঘুম ভাঙলেই ছবিটা চোখে পড়বে।
এই কাজটা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকিয়ে পরের দিনই করিয়ে ফেললেন সহদেববাবু।
ছবিটা পাবার তিন দিনের মধ্যেই সহদেববাবু তাঁর ঝুলপিটা ইঞ্চিখানেক কমিয়ে নিলেন, কারণ ঝুলপিতেই ছবির চেহারার সঙ্গে বেমিল ছিল। হাতের নখ নিয়মিত না-কাটার ফলে বেয়াড়া রকম বেড়ে যেত সহদেববাবুর; ছবির বাবুর হাতের নখ গোড়া অবধি পরিষ্কার করে কাটা, তাই সহদেববাবু নিজের নখের যত্ন নিতে আরম্ভ করলেন। পানের অভ্যাস ছিল না; ছবির মতো পানের ডিবে কিনে চাকরকে দিয়ে খিলি পান সাজিয়ে ডিবেয় পুরে পকেটে নিয়ে কাজে বেরোতে শুরু করলেন। গেঁয়ো মানুষ ছোট অবস্থা থেকে বড় হয়েছেন বলেই আদব-কায়দার দিকটা সহদেববাবুর একেবারেই জানা ছিল না। এই সম্ভ্রান্ত ঘরের বাবুর ছবির প্রভাব ক্রমে তাঁর হাবেভাবে একটা পালিশ এনে দিতে শুরু করল। লালবাজারের আপিসে বসে যতক্ষণ কাজ করেন ততক্ষণ কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। টেরিলিনের সার্ট আর টেরিটের প্যান্ট পরে আপিসে যান, গোল্ড ফ্লেক সিগারেট খান, দিনে তিনবার চা আর দুপুরে সীতানাথের দোকান থেকে আনা পুরি-তরকারি আর জিলিপি খান। এ সব অভ্যেস অনেক দিনের। কিন্তু কাজের শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে তিনি আর ঠিক আগের মানুষ থাকেন না। হাঁটাচলার ভঙ্গি, কথা বলার ঢং, তাকিয়া কোলে নিয়ে বাবু হয়ে বসার কায়দা, চাকরকে হাঁক দিয়ে ডাকার মেজাজ, এ সবই নতুন। এ সব অবিশ্যি বন্ধুদের দৃষ্টি এড়ায় না। তারা বলে, ‘ছবির বাবুর প্রভাব তোমার উপর যেভাবে পড়ছে, তোমাকে তো ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে চক-মিলানো বাড়ি দেখতে হচ্ছে! সহদেববাবু মৃদু হাসেন, কোনও মন্তব্য করেন না।
ছবির বাবুর সবচেয়ে বেশি কাছে মনে হয় নিজেকে যখন সহদেববাবু রাত্রে ঘরে ঢুকে অন্য সব বাতি নিভিয়ে কেবল নীল আলোটা জ্বালিয়ে খাটে শোন। তখন সত্যি মনে হয় ওই বাবু আর তিনি একই ব্যক্তি।
আর তখনই মনে হয় ওই রকম একপেশে সোনার বোতামওয়ালা পাঞ্জাবি, ওই বাহারের চওড়া লালপেড়ে ধুতি ওই রকম কাজ করা কাশ্মীরি শাল, ওই চেয়ার, ওই গড়গড়া, ওই হিরের আংটি, ওই হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা ছড়ি, এ সবই তাঁর চাই।
আর সবই একে একে জোগাড়ও হল।
ছড়ি আর চেয়ার দিলেন মিহিরবাবুই। চিৎপুর থেকে লোক ডাকিয়ে স্পেশাল গড়গড়া তৈরি হল ছবির সঙ্গে মিলিয়ে। সেই সঙ্গে ভাল অম্বুরি তামাক আনিয়ে সেটা খাবার অভ্যেসও তৈরি হল। ছবির মতো পাঞ্জাবি তৈরি করার কোনও অসুবিধা নেই, আর তার জন্য সোনার বোতামও কেনা হল।
শালটা জোগাড় হল এক বৃদ্ধ কাশ্মীরি শালওয়ালার কাছ থেকে।
নাদির শা শালওয়ালা গত শীতে সহদেববাবুর বাড়িতে এসেছিলেন হরেক রকম শাল সঙ্গে নিয়ে। সহদেববাবু কিছু কেনেননি। এবার শীত পড়তেই এক রবিবার সকালে শালওয়ালা আবার এসে হাজির। সহদেববাবু তাকে ছবিটা দেখিয়ে বললেন, ‘ঠিক এমনি একখানা শাল জোগাড় করে দিতে পারেন? ’
নাদির শা তৈরি চোখে ছবির দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘এমন জামেওয়ার তো চট করে পাওয়া যায় না আজকের দিনে। তবে টাইম দিলে খোঁজ করে দেখতে পারি।’
সেই জামেওয়ারও চলে এল তিন সপ্তাহের মধ্যে। রঙে সামান্য বেমিল; তবে আসল শালের রং কেমন ছিল কে বলবে? একে তো পুরোনো ছবি, রং বদলে যেতে পারে, তা ছাড়া আর্টিস্টের তেল রং আর আসল শালের রঙে কোনও তফাত নেই একথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে?
‘কত দাম?’ জিগ্যেস করলেন সহদেববাবু।
‘আপনার জন্য স্পেশাল রেট। সাড়ে চার।’
‘সাড়ে চারশো?’—আজকের দিনে ভাল কাশ্মীরি শালের দাম সম্পর্কে সহদেববাবুর কোনও ধারণাই নেই।
‘নো স্যার’, চোখের কোণে খাঁজ ফেলে মৃদু হেসে বললেন নাদির শা—‘ফোর থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ফাইভ হান্ড্রেড।’
স্পেশাল রেট আর কমল না। নাদির শাকে সাড়ে চার হাজার টাকার একটা চেক লিখে দিলেন সহদেব ঘোষ।
ছবির সঙ্গে মেলানো চেয়ার, শ্বেত পাথরের তেপায়া টেবিল, ঘষা কাঁচের ডোমওয়ালা কেরোসিন ল্যাম্প আর সেক্সপিয়রের বই কেনার পরেও একটা জিনিস বাকি রইল।
সেটা হল বাবুর ডান হাতের অনামিকার হিরের আংটিটা।
সহদেব ঘোষ একবার নৈহাটি গিয়ে বিখ্যাত জ্যোতিষী দুর্গাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে তাঁর ভাগ্য গণনা করিয়ে এনেছিলেন। তখন তিনি সবে ব্যবসায় নেমেছেন, কপালে কী আছে জানা নেই। জ্যোতিষী সহদেবের অভাবনীয় আর্থিক সাফল্যের কথা গণনা করে একটা কাগজ লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আট বছরের মধ্যেই যে ব্যবসায় এমন দুর্যোগ দেখা দেবে তার কোনও উল্লেখ সে কাগজে ছিল না। আজ সেই কাগজটিকে ছিড়ে দলা পাকিয়ে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সহদেববাবু।
কারণ আর কিছুই নয়, গত এক মাসের মধ্যে দুটো বড় অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ায় সহদেবের বেশ কয়েক লাখ টাকা লোকসান করিয়ে দিয়েছে।
অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা থেকে শুরু করলেও, সহদেবকে কোনওদিন পড়তির গ্লানি ভোগ করতে হয়নি। নীচ থেকে ধীরে ধীরে সমানে তিনি ওপরের দিকেই উঠেছেন। অর্থাৎ সবটাই চড়াই, উৎরাই নেই। কিন্তু আজ হঠাৎ উৎরাইয়ের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা তাঁকে দিশেহারা করে দিল। আর এই অবস্থাটা যে সাময়িক, তেমন কোনও ভরসাও তিনি পেলেন না।
এই অবস্থায় একজন জ্যোতিষীর উপর আস্থা হারালেও অন্য আরেকজনের কাছে যাবার লোভ সামলাতে পারলেন না সহদেব ঘোষ। ভবানীপুরে গিরীশ মুখার্জি রোডের নারায়ণ জ্যোতিষীকে গিয়ে ধরে পড়লেন তিনি।
নারায়ণ জ্যোতিষীর গণনা করতে লাগল সাড়ে চার মিনিট। সহদেবের চরম দুর্দিন দেখা দিয়েছে। অপগ্রহের প্রভাব চলবে গোটা বছরটাই। এবং কোনও এক ব্যক্তি, যার উপর সহদেব বিশ্বাস রেখেছিলেন, তিনি প্রতারকের কাজ করছেন। এই ব্যক্তি যে কে, সেটা ভেবে বার করার কোনও প্রয়োজন বোধ করলেন না সহদেববাবু। এমন কেউ করতে পারে সেটা আগে জানলে বরং সাবধান হতে পারতেন। ব্যবসায় নেমে অনেকের উপরই বিশ্বাস রাখতে হয়েছে তাঁকে, তাদের মধ্যে কে ল্যাঙ মেরেছে সেটা এখন জেনে কী লাভ? আসল কথা, তাঁর সর্বনাশ হয়েছে, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে।
প্রথমেই গেল ফিয়াট গাড়িটা। চার বছর আগে চৌত্রিশ হাজার টাকায় কেনা গাড়িটা বারো হাজারে বিক্রি করতে হল সহদেববাবুকে।
দুর্দিনের বন্ধুই খাঁটি বন্ধু, এমন একটা প্রবাদ ইংরিজিতে আছে। সহদেববাবুর তিনজন বন্ধুর মধ্যে একজনই দেখা গেল সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। নন্দ বাঁড়ুজ্যে সেই যে বলেছিলেন ছবির বাবুর পরিচয় খুঁজে বার করবেন, সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত সুবিধা করে উঠতে পারেননি। বংশ পরিচয়ের চার খণ্ডের এক খণ্ডে সেলিমগঞ্জের জমিদার ভূতনাথ চৌধুরীর ছবির সঙ্গে আর সব কিছু মোটামুটি মিলে গেলেও, মুখ একেবারেই মেলেনি। নন্দ পাশে থাকাতে এই সংকটের অবস্থাতেও সহদেববাবু তবু সামলে আছেন; না হলে কী হত বলা যায় না।
এই নন্দ বাঁড়ুজ্যেই একদিন সহদেবকে বললেন কথাটা।
‘ছবিটা বিদায় করো ভাই। আমার বিশ্বাস ওটাই নষ্টের গোড়া। আর সত্যি বলতে কী, এখন তোমার যা চেহারা হয়েছে, তার সঙ্গে ওটার মিল সামান্যই।’
হাতে আয়না নিয়ে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের সঙ্গে মিলিয়ে সহদেববাবুরও যে কথাটা মনে হয়নি তা নয়। গত দু’মাসেই কানের দু’পাশে পাকা চুল দেখা দিয়েছে, চোখের তলায় কালি পড়েছে, গাল বসেছে, চামড়ার মসৃণতা চলে গিয়েছে। অথচ ছবির বাবুর কোনও বিকার নেই।
‘ওই ল্যাজারাসেই আবার গিয়ে ফেরত দাও ছবিটা,’ বললেন নন্দ বাঁড়ুজ্যে। ‘তোমাকে তো বলেছিল আর্টিস্টের বেশ নামডাক আছে। খদ্দের মিলে যাবে। আপদ বিদেয় হবে, পয়সাও কিছু আসবে ঘরে।’
সেই রাত্রে ঘরের বাতি নিভিয়ে নীল বাতি জ্বেলে ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সহদেববাবুর মনে যে ভাবটা এল, সেটা আগে কখনও আসেনি। সেটা আতঙ্কের ভাব। বাবুর ঠোঁটের কোণে হাসিটাকে এতদিন প্রসন্ন বলে মনে হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে পৈশাচিক। দৃষ্টিটাও সোজা তাঁরই দিকে হওয়াতে মনে হয় হাসিটা বুঝি তাঁকেই উদ্দেশ করে হাসা। কী আশ্চর্য—কবেকার কোথাকার এক বাবু, সেই বাবুর ছবি আঁকলেন আদ্যিকালের শিল্পী পরেশ গুঁই, আর সেই ছবিই কিনা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁর জীবনটাকে এমনভাবে তছনছ করে দিল? ছবির দামের বাইরে কত টাকা তাঁর খরচ হয়েছে এটা কেনার দরুন সেটা ভাবতে সহদেববাবু শিউরে উঠলেন। তাও তো সামর্থ্য ছিল না বলে হিরের আংটিটা কেনা হয়নি; সেটার পিনে আবার…
আর ভাবতে পারলেন না সহদেববাবু। নীল বাতি নিভিয়ে দিয়ে খাটে শুয়ে স্থির করে ফেললেন কালই সকালে ট্যাক্সি করে ল্যাজারাসে গিয়ে ছবিটা ফেরত দিয়ে আসবেন।
* * *
‘গুড মর্নিং স্যার! ওটা কী বয়ে আনলেন?’
প্রায় এক বছর পরে মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা হল। আজ অবিশ্যি রবিবার না, তাই নিলামের কোনও তোড়জোড় নেই। সহদেববাবু তিনটে বাংলা খবরের কাগজ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া ছবিটাকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে কপালের ঘাম মুছে মিহিরবাবুকে ব্যাপারটা বললেন। অবিশ্যি আসল কারণটা তো আর বলা যায় না, তাই বললেন, ছবিটা দেখে সবাই ঠাট্টা করে মশাই। বলে, “জমিদারি প্রথা কোনকালে উঠে গেল, আর তোমার কিনা হঠাৎ জমিদার সেজে ছবি আঁকার শখ হল?”—শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। তাই ফেরত দেওয়া স্থির করলাম। দেখবেন যদি কেউ কেনে-টেনে। অবিশ্যি পড়ে থাকলেও ক্ষতি নেই।’
ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখলুম? গাড়ি কী হল?’
‘কারখানায়। আসি…’
সহদেববাবু চলে যাবার পর টেলিফোনের বই দেখে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের নম্বর বার করে ভাইপোকে একটা ফোন করলেন মিহিরবাবু। ভাইপোর ছবির এগজিবিশন হচ্ছে সেখানে। বড় পেয়ারের ভাইপো এটি।
‘কে, কল্লোল? আমি মিহিরকাকা। শোন্, তোর প্রথম রোজগার করিয়ে দিয়েছিলুম কী ভাবে মনে আছে?…মনে নেই? সেই যে সদানন্দ রোডের এক ভদ্রলোক পোট্রেট আর্টিস্টের জন্য বিজ্ঞাপন দিলেন, তুই গেলে তোকে খেদিয়ে দিলেন, আর তুই মন থেকে পোট্রেট করলি জমিদারের পোশাক পরিয়ে?…হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ছবি আবার ফেরত এসেছে, বুঝেছিস? তুই এক সময় এসে নিয়ে যাস। দোকানে অনেক মাল, রাখার জায়গা নেই।’
টেলিফোনটা রেখে মিহিরবাবু খদ্দেরের দিকে মন দিলেন। অ্যারন সাহেব এসেছেন সেই দাবার সেটটার খোঁজে। সেটাকে আবার দেড়শো বছর আগে বর্মায় তৈরি বলে চালাতে হবে।