সহচরী

সহচরী

আমি সব সময় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি। ছেলেবেলা থেকেই নানান স্বপ্ন দেখে আসছি, সে-সব স্বপ্ন সচরাচর হয়—কখনও মজার, কখনও ভয়ের, কখনও বা অন্য কিছুর। অদ্ভুত, অসম্ভব স্বপ্নও আমি অনেক দেখেছি। যেমন, ছেলেবেলায় একবার দেখেছিলাম আমার বাবা তাঁর পিঠ চোল্‌কানোর হাড়ের লম্বা মার মাথায় ছুঁইয়ে দিতেই মা সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর কুয়া হয়ে গেল। এটা আমায় ভীষণ অবাক করলেও ভেবে দেখেছিলাম আগেকার দিনে যাদুর কাঠি ছুঁইয়ে বা কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে মানুষকে পশুপাখি পাথর করা গেলেও এখন আর তা করা যায় না। কিংবা যৌবনে আমি আরও অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখেছিলাম, আমাদের বাড়িতে ভীষণ আগুন লেগেছে, ঘরদোর পুড়ে ছারখোর হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি আমার ঘরে বসে পর্বতপ্রমাণ নরম তুলোর মধ্যে গুহার মতন একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। এসব স্বপ্ন আমার কাছে বরাবরই অদ্ভুত এবং অর্থহীন মনে হয়েছে। নয়ত কে কবে দেখেছে, আমারই শব চলেছে খাটিয়ায় দুলতে দুলতে আলো-অন্ধকারের তলা দিয়ে আর আমি সেই শবের পেছনে পেছনে একাই হরিধ্বনি দিতে দিতে চলেছি।

কিন্তু এখন; আমার এই যৌবনের শেষে এসে আমি যে স্বপ্নটি দেখলাম—তেমন স্বপ্ন আগে আর কখনও দেখেছি বলে আমার মনে পড়ছে না। আমি সরসীকে স্বপ্ন দেখলাম। সরসীকে আমি আগেও স্বপ্ন দেখেছি। মাঠে ঘাটে ঘরে বিছানায় সর্বত্র এবং সর্বভাবেই সরসীকে স্বপ্ন দেখলেও এভাবে কখনও দেখিনি। কাল রাত্রে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম; সরসী আমায় যেন কোথায় নিয়ে গেছে। মনে হল তার বাড়িতে। সরসীর ঘরে আমার এক সময় শোওয়া-বসা ছিল। তার বিছানার মাথার দিকে একটা বেশ সুন্দর বাতিদান থাকত। এই বাতিদান ছাড়া আমার চোখে আর কিছু পরিচিত দ্রব্য না পড়ায় আমি জোর করে বলতে পারি না সরসী আমায় অন্য কারও ঘরে, অন্য বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিল কি না! আমি বিছানায় শুয়েছিলাম। এবং অপেক্ষা করছিলাম। সরসী এল। নিবাস। আসার পর দেখলাম, সে বিনা বাক্যব্যয়ে আমার ওপর বসে চকচকে একটা ছোরা আমার বুকে এবং কণ্ঠনালীতে কয়েকবার বসিয়ে দিল। দিয়ে আমার দুটি হাত বিচ্ছিন্ন করে দিল, নিম্নাঙ্গ মাটিতে ফেলে দিল, কী আশ্চর্য, আমি কণ্ঠহীন, হৃদয়হীন, হস্তপদহীন দরজির দোকানের তুলো ভরা নকল উধ্বাঙ্গ মূর্তির মত হয়ে পড়লেও সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। সরসী আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেললেও তা বাতিল করে দেয়নি। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। শেষে দাঁতের ডাক্তারের মতন সে আমার দাঁতের মাড়ি সমেত ওপর এবং নিচের পাটি দুটো খুলে নিল। তারপর সরসী আমার মুখচুম্বন ও অশ্রুপাত করতে করতে বলছিল: নবীন, আমি আজ বড় সুখী, বড় সুখী; তুই আমার লক্ষ্মী, তুই আমার সোনা, তুই আমার সর্বস্ব। তুই আমার কাছে কিছু চা, চেয়ে চেয়ে নে…।’ এই বলে সে আমায় শিশুর মতন স্তন্যদান করতে যাচ্ছিল…স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে অনেকক্ষণ আমি নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে ছিলাম। তখনও পুরোপুরি ভোর হয়নি। শুয়ে থেকে থেকে নিজের হাত পা, অন্যান্য অঙ্গ এবং আমার ইন্দ্রিয়গুলি অটুট আছে কি না তা স্পষ্ট করে অনুভব করতেও আমার ভয় করছিল। সরসী হয়ত আর নেই, কিন্তু চোখ মেলে উঠে বসার পর যদি আমার নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলিকে খাটের নিচে থেকে খুঁজে বের করে নিতে হয় তবে সে বড় মুশকিল হবে। কোথায় কী ছড়িয়ে আছে তা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। রাত্রে শুতে এসে আমি পায়ের চটি জোড়া বরাবরই খাটের তলায় খুলে রাখি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি চোখে চটি জোড়া খুঁজতেই আমায় অর্ধেক দিন হাতড়াতে হয়। এই রকম যার অবস্থা—তার পক্ষে অতগুলো জিনিস ঠিক ঠিক খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া আমার কোমরের তলা থেকে নিচের অংশটা নেই; আমার পক্ষে বিছানায় উঠে বসাই বা কী করে সম্ভব? হায়রে, আমি কত বড় মূখ দেখুন: আমি যে বলছি উঠে বসে আমি সব খুঁজে নেব, কিন্তু কী করে খুঁজব, আমার চোখ কোথায়? সরসী আমার দুটি চোখই যে তুলে নিয়ে সরিয়ে রেখেছে কোথাও। সরসীর ওপর আমার প্রবল রাগ ও ঘৃণা হচ্ছিল।

ক্রোধ কিংবা ঘৃণা প্রবল হয়ে উঠলে অনেক সময় নিজেকে অনুভব করা সহজ হয়। সরসীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠার পর আমার স্বপ্নাবেশ সম্পূর্ণভাবে কেটে গেল। অনুভব করলাম, আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি অক্ষত আছে। তারপরে চোখ খুলে তাকালাম। শরতের ধবধবে সকাল আমার ঘরে এসে মশারির কাপড় দুলিয়ে দিচ্ছে। কিঙ্করবাবুদের বাগানে পাখিরা ডাকাডাকি করছিল। কোথাও একটা রিক্শা যাচ্ছে, যেতে যেতে তার টুনটুনি বাজাচ্ছিল বাউল বৈরাগীর মতন। তখন আমার মন কানায় কানায় জেগে উঠেছে। সরসী এবং স্বপ্ন দুই-ই আমি কিছুক্ষণের জন্য একেবারেই ভুলে গেলাম; আর কি আশ্চর্য যে এখন শরৎকাল, আশ্বিন মাস চলছে—এসব মনে পড়ে যাওয়া মাত্র বেশ ভাল লাগছিল। শরৎকাল আমার বরাবরই ভাল লাগে এবং এই আশ্বিন মাস। আশ্বিনে আমার জন্ম। বাংলা মাস বলে তারিখটা আমি খেয়াল করতে পারলাম না; আমার জন্ম দিনের হিসেবটাও তাই ঠিক করা গেল না। হাল্কা এবং খুশি মনে আমি ছেলেবেলার মুখস্থ করা সেই পদ্যটা—’আজিকে তোমার মধুর মুরতি’ মনে মনে আওড়ে নিলাম। আওড়াবার সময় ‘অমল শোভাতে’ কথাটা মনে আসার পর এই আচমকা জ্বলে ওঠা খুশির সলতেটুকু দপ করে নিবে গেল। শোভা আমার মার নাম—পুরো নাম শোভাময়ী। মাকে মনে পড়ার পর দু’চারটি স্মৃতি দূরে গোচারণের মাঠের কয়েকটি গাভীর মত বিচরণ করছিল, সহসা সরসীকে আবার মনে পড়ল। এবং বিগত রাত্রের স্বপ্নটিও। বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় আমি অনুভব করছিলাম: আমার হাত পা বুক দাঁত চোখ সব যথাযথ অবস্থায় থাকলেও কিছু একটা ঘটে গেছে—যার ফলে আমি আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়গুলিকে স্বাভাবিক আয়ত্তের মধ্যে পাচ্ছি না।

এই অবস্থায় আমার সকাল কাটল। আমি অবিবাহিত, সাংসারিক পরিবেশ আমার বাড়িতে নেই। নিরিবিলিতে আমি সকালের কাগজ দেখলাম, বাহাদুর পুলিশ এবং ততোধিক বাহাদুর জনতার প্রস্তর যুদ্ধের একটি বড় ছবিও দেখলাম মনোযোগ দিয়ে, বিখ্যাত নেতাদের অর্থহীন দু-একটি কথাও চোখে পড়ল, বাস দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের-সংবাদটি দেখে নেবার সময় নিজের ভাগ্য সম্পর্কেও আমার হতাশা এল এইভাবেই চলছিল: চা খাওয়া, দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি শেষ হলে বঙ্কু এসে খাবার কথা বলল। বঙ্কু আমার গৃহরক্ষক। বলতে কি, যদিও আমি নিত্য দিনের মত প্রাত্যহিক কর্মগুলি করে যাচ্ছিলাম তবু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ক্রমাগত বাড়ছিল। আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না; রাত্রের সেই অদ্ভুত, অস্বস্তির স্বপ্নটি আমার চেতনার উপর পুরু সরের মত জমে যাচ্ছিল। যখন অফিসে যাচ্ছি, কলমটা তুলে নেবার পর বুক পকেটে রাখতে গিয়ে আচমকা, অনুভব করলাম, আমার কী যেন—কিছু যেন হারিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে এত ভয় হল যে, হাতটা বুকের ওপর জোর করে চেপে রেখে অনুভব করলাম, হৃদপিণ্ডটা যথাস্থানে আছে কিনা, স্পন্দন আছে অথবা নেই। স্পন্দন ছিল, কিন্তু হৃদপিণ্ড যা আমার বলেই এ যাবৎ জেনে এসেছি, সেই হৃদপিণ্ডই যথার্থ রয়েছে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে। কি না সে বিষয়ে আমার যেন সন্দেহ দেখা দিল।

আমার নাম নবীন। আমি বিখ্যাত এক বিদেশী ওষুধ কোম্পানির হিসেবপত্র দেখাশোনা করি। অফিসে আমার নিজের জন্য ছোট একটি বাহারি কুঠরি আছে, ফোন আছে, একটি দীর্ঘাঙ্গী বাঙালি যুবতী আছে টাইপের কাজকর্ম করার জন্যে; উপরন্তু ক্লান্তি বিনোদনের জন্যে একপাশে একটি আর্ম চেয়ার রয়েছে। কখনও কখনও আমি, স্বভাবতই বিকেলের পর বীজাণুনাশক সাবানে হাত মুখ ধুয়ে, পরিষ্কার টাওয়েলে মুখ পরিপাটি করে মুছে নিয়ে, মাথার চুল আঁচড়ে আর্ম চেয়ারে আরাম করে বসে চা, স্ন্যাকস এবং সিগারেট খেতে খেতে আমার টাইপিস্ট মিসেস গুহর সঙ্গে জামাইবাবুর মতন রসিকতা করি, এবং আমার এই অনাত্মীয় শ্যালিকাটির সদানন্দ শরীরে স্নেহদান করি।

আজ অফিসে এসে আমার কোনো কিছুতেই মন বসছিল না। কাজকর্ম চাপা দিয়ে রেখে বা অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে বসে বসে আমি স্বপ্নের কথা ভাবছিলাম। মাথাটা অবেলাতেই ধরে উঠল। দুটো অ্যাসপিরিনের বড়ি খেলাম। কাগজপত্র কিছু কিছু সই করার সময় আমার মনে হচ্ছিল, আমি নিজের হাতে সই করছি না। এমন কি মিসেস গুহ একবার এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনার শরীর খারাপ?”—তখন আমার মনে হল, আমি নিজের চোখ দিয়ে মিসেস গুহকে দেখছি না। ওকে যে চোখ দিয়ে দেখছিলাম সেটা কোনো ক্রমেই আমার চোখ হতে পারে না।

কমলবাবু বয়সে আমার বড় হলেও কেরাণীবাবু। ভদ্রলোক দুটি জিনিস অত্যন্ত ভাল বোঝেন, কোষ্ঠীবিচার এবং কলকাতার ঘোড়া-মাঠ। আমায় বরাবরই বিশেষ স্নেহ করেন। এক সময় কমলবাবু এসে বললেন, “আপনার নাকি শরীর খারাপ হয়েছে, স্যার? এখন কলকাতায় খারাপ টাইপের একটা ডেঙ্গু হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে ভিয়েতনামের দিকে আমেরিকানরা ভাইরাস ছেড়েছে। এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে। আপনি বরং বাড়ি চলে যান, গিয়ে দুটো নভালজিন খেয়ে শুয়ে পড়ুন। রেস্ট নিন। একটা পাঁচশো মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ও খেয়ে নেবেন।”

কমলবাবুর ওপর আচমকা আমার কী যে হল—”ইউ শাট আপ, শালা, শুয়োরে বাচ্চা” বলে লাফ মেরে তাঁকে ধরতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না, চেয়ারে পা লেগে পড়ে গেলাম। কমলবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

তারপর অফিসে একটা বিশ্রী কাণ্ড। বড়রা ছুটে এলেন, ছোটরা এলেন। “কী হয়েছে? ফিলিং আনইজি? ডাক্তার ডাকব? ইনস্যানিটির ফার্স্ট সাইন নাকি রে বাবা? ইউ জাস্ট গো হোম মুখার্জি; টেক সাম রেস্ট।” .… কী বিশ্রী বলুন তো।

আপনারা যান; প্লিজ গো। আমি ভাল আছি। ফিলিং ফাইন। কমলবারকে একবার ডেকে দিন। কমলবাবু, আমি খুবই দুঃখিত, আসলে আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারি নি, খুব অন্যমনস্ক ছিলাম, তাছাড়া আমার গলা আজ ঠিক আমার গলা বলে আমারই মনে হচ্ছে না। আপনি আমায় মাপ করুন।

অফিসে আমি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারলাম না। বিকেল নাগাদ বেরিয়ে পড়ার সময় মিসেস গুহকে ঘরে ডেকে পাঠিয়ে পার্টিশানের গায়ে চেপে ধরে একটা চুমু খেলাম। খাবার অন্য কোনো কারণ ছিল না, শুধু দেখতে চাইছিলাম—সরসী কাল যে ভাবে আমার দু পাটি দাঁত খুলে নিয়েছিল তারপর আজকের দু পাটি দুটো নকল না আমার নিজস্ব। চুমুটা এতই বিস্বাদ যে এক চামচ মিল্ক অফ ম্যাগনেশিয়ার মতন মুখে লেগে থাকল। স্বভাবতই আমার মনে হল—দাঁতের দুটো পাটি আমার নয়।

অফিস থেকে বেরিয়ে নিচে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাবার পর আমার মনে হল, এখনই এই মুহূর্তে আমার সরসীর কাছে যাওয়া দরকার। সরসীর ওপর রাগে আমার গা ভীষণ জ্বরের মতন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। সরসী একটা জাঁহাবাজ, শয়তান, ডাইনি টাইপের মেয়েছেলে। বিচ। সে আমার অনেক কিছু চুরি করে নিয়েছে, ডাকাতি করে কেড়ে নিয়েছে, নিয়ে কতক নকল—ফলস্ মাল ভরে দিয়েছে। তুমি কি ঘড়ি সারাইয়ের দোকান খুলেছ? নাকি তুমি আমায় অচল ঘড়ি পেয়েছ যে হাতে পেয়ে আমার কলকজা সব খুলে নিয়ে পটাপট কতকগুলো বাজে মাল ভরে দেবে? চোর, চোট্টা মেয়েছেলে কোথাকার!

ট্যাক্সি অনেকটা চলে আসার পর আমার খেয়াল হল, এখন সরসীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বৃথা। এ সময় তাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না। সে নিজের কাজে কর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইনসিওরেন্সের মেয়ে এজেন্ট হিসেবে তার কাজকর্ম ভাল—বেশ ভালই চলে। সরসী কোথায়, কার সঙ্গে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে বিশ পঁচিশ পঞ্চাশ হাজার কিংবা লাখের বিজনেস শেষ করার চেষ্টা করছে কে জানে। তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় এটা নয়। তাহলে?

আমি ট্যাক্সিটাকে পার্ক স্ট্রিটে যেতে বলে দিলাম। আপাতত ঘণ্টা দেড় দুই মদ্যপানে কাটানো ছাড়া উপায় নেই।

সরসীর সঙ্গে আমার অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। অন্তত বছর খানেক। শেষ দেখা হয়েছিল আচমকা খড়গপুর স্টেশনে, দুজনেই দীঘা বেড়াতে যাচ্ছিলাম। দিন চারেক দীঘায় সরসীর সঙ্গে থাকা গিয়েছিল। মন্দ নয়, ভালই কেটেছিল। বিশেষ করে রাতগুলো। সরসী আজকাল তার চলা ফেরা’ যে পরিমাণ সংযত রাখছে তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। না, আমার সঙ্গে তার দীঘার পরও বার দুই ছোট ছোট দেখা—বা যাকে বলা যায় ‘ব্রিফ কাউন্টার হয়েছে। এই তো নতুন বর্ষায় সরসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল; অল্প সময়ের জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই শেষ। ইতিমধ্যে দু-চারবার ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। মামুলি কথা।

আসলে দুপুরে অফিসে বসেই উচিত ছিল সরসীকে একবার ফোনে ধরার। ফোনে পাওয়া গেলে কথা বলা যেত: ‘সরসী? সরসী নাকি? সরসী, আমি নবীন কথা বলছি। আমার গলা চিনতে পারছ না? না পারার জন্যে আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি বলো। আমি তোমায় জিজ্ঞেস করছি। এ তুমি কী করেছ? আমি বুঝতেই পারিনি তুমি এরকম করবে। কী সাংঘাতিক। বিস্টলি ! তুমি আমার সমস্ত কিছু কেটেকুটে ছিঁড়ে খুঁড়ে সরিয়ে নিয়েছ; আজ সকালে উঠে দেখি, আমি আমার নিজের কিছু আর খুঁজে পাচ্ছি না, বেটার আই শুড সে আই পজেজ নাথিং অফ মাই ওউন। এর মানে কী? তোমার উদ্দেশ্যটা কী? কোন শালা পাগলার মালপত্র আমার মধ্যে ফিট করে দিয়েছ? সরসী, তুমি ভীষণ খারাপ কাজ করেছ ! তুমি শয়তান, নৃশংস পশু; ইউ আর এ বিচ; শালা, খচড়ি মাগী কাঁহাকা্‌…”

দমকলের গাড়ির ঘন্টা অনবরত বাজতে থাকায় আমার হুঁশ হল। পার্ক স্ট্রিট দিয়ে ট্যাক্সিটা চলেছে। উলটো মুখ দিয়ে দমকলের গাড়িগুলো ছুটে গেল। আকাশে কোথাও মেঘ হয়েছে। বিকেলটা মেঘলা হয়ে গিয়ে পার্ক স্ট্রিট ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। সরসীর কথা আমার দুপুরে মনে পড়লেও আমি ফোন না করে ছেলেমানুষী করেছি, নাকি তখনও আমার কী কী খোয়া গেছে তা স্পষ্ট বুঝতে না পারার জন্যে ফোন করতে পারিনি—ঠিক যে কী কারণে সরসীর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি তা বুঝতে পারলাম না।

অ্যাই ট্যাক্সি, থামো, রোকো।

ট্যাক্সি থেমে গেল। আমি নবীন, ট্যাক্সিঅলাকে ভাড়া মিটিয়ে ‘বার’-এ ঢুকে গেলাম।

সচরাচর আমি হুইস্কি খাই। আজ হুট করে ‘রাম’ চেয়ে বসলাম। সামান্য খাবার পর আমার মনে হল, এ আমি খাই না, গৌর খায়। ‘রাম’ খাওয়ার পর গৌরের গায়ের সমস্ত লোমকূপ দিয়ে গন্ধ বেরোয় ঘামের সঙ্গে। আই হেট ইট। আমি ‘রাম’ খাই না, আমি গৌর নয়, তবে কেন ‘রাম’ খাচ্ছি। নিশ্চয় আজ আমি আমাতে নেই, সরসী আমাকে নবীনের পোশাক পরিয়ে রেখেছে; আসল নবীন কোথায়?

রাগের মাথায় আমি উলটো পালটা যখন যা খুশি খেয়ে যখন ‘বার’ থেকে বেরোলাম তখন বাস্তবিকই আমি সবই হারিয়ে ফেলেছি। এ একটা মজার নবীন। তোমরা দেখো, উনপঞ্চাশ বছরের লম্বা চেহারার লোকটাকে এবার দেখো। নবীন মুখার্জি। শালার গায়ে লিণ্ডসে স্ট্রিটের ইব্রাহিম আলীর তৈরি কোট, টেরিকটের ট্রাউজার্স, ইজিপশিয়ান কটনের সাদা শার্টের বোতাম খোলা, টাইট ট্রাউজার্সের পকেট থেকে বেরিয়ে লেজের মতন পেছনে ঝুলছে। লোকটা তার চশমা ফেলে এসেছে, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখমুখ ফুলে টসটস করছে, শালা নবীন মুখার্জি ত্রিভক্ষ মুরারী হয়ে ট্যাক্সি ডাকছে হাত নেড়ে নেড়ে। তার গলা উঠছে না; সে দুলছে। আর মাঝে মাঝে বলছে: আই অ্যাম লস্ট—আই অ্যাম্ রবড অফ…হেই ট্যাক্সি—ট্যাক্সি…। ট্যাক্সিটা পেয়ে যাবার পর আমি গদির মধ্যে গিয়ে গড়িয়ে পড়লাম। ল্যান্সডাউন রোড; আমায় সরসীর বাড়ি নিয়ে চলো ট্যাক্সিঅলা। দেশপ্রিয় পার্কের আগে। …শোনো ট্যাক্সিঅলা, যদি সরসী বলে—এ লোক নবীন নয়, তুমি বলবে—হ্যাঁ এ নবীন—নবীন মুখার্জি। সাহেবকে আমি চিনি। তার অফিস চিনি, বাড়ি চিনি। এই সাহেবই নবীন মুখার্জি, আলবাত…। আমি বলি কি, তুমি একটু ঘুরেফিরে চলল। সরসী এখনও বাড়ি পৌঁছে গেছে কিনা কে জানে। সরসীর কাছে যাবার আগে আমি তৈরি হয়ে নিতে চাই, আমার মগজ পরিষ্কার হওয়া দরকার। সে যেন না ভাবে আমি মাতলামি করতে গিয়েছি। আমার যুক্তিটুক্তি অটুট থাকা দরকার। সরসীর কাছে আমি এক্সপ্লানেশান চাইব। আমি জানতে চাইব, এ সব কি? কেন তুমি আমার সমস্ত কিছু কেটে ছিঁড়ে নিয়েছ? এটা কোন ধরনের রসিকতা? কী খেলা?

আমি বোধ হয় তখন কী খেলা—কী খেলা তব—’ বলে একটু গান গাইবার ছেষ্টা করছিলাম, একপাল বুনো ঘোড়া ছুটে আসার মতন তেড়ে বৃষ্টি এসে গেল। আঃ, মার্ভেলাস! কী বৃষ্টি। ফাইন জলো বাতাস এসেছে…না না, ট্যাক্সিঅলা তুমি কাচ তুলে দিও না। মুখে চোখে একটু জল বাতাস লাগতে দাও। আমি তোমায় টাকা দেব, এক্সট্রা টাকা। এই বৃষ্টি সুন্দর! কী ভালো, কী ভালো ! এটা আশ্বিনের বৃষ্টি। আশ্বিন আমার জন্মমাস। কে বলতে পারে আজ আমার জন্মদিন নয়? হয়ত আজই আমার জন্মদিন। আমি বাংলা তারিখ না জানার জন্য বুঝতে পারছি না। সরসী জানতে পারে। সরসী আগে জানত। এখন বোধহয় ভুলে গেছে।

আই ট্যাক্সিঅলা, তুমি শালা ঘুমোচ্ছ নাকি, দেখছ না লাল হয়ে গেছে। ছুটে পালালেই হল? দাঁড়াও। অপেক্ষা করো। তুমি উজবুক জানো না, তোমার ট্যাক্সিতে কাকে নিয়ে যাচ্ছ ! নারে ভাই, আমি মন্ত্রী ফন্ত্রী নই, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট নেতাও নই, সিনেমা অ্যাক্টর নই। আমি নবীন মুখার্জি হলেও, তুই জানিস নারে ভাই, কী মাল তুই নিয়ে যাচ্ছিস! বেটার সে—বহন করছিস। তুই জানিস না, এই নবীনের তলায় অরিজিন্যাল কিছু নেই। সরসী বিলকুল সব খুলে নিয়েছে, বাতিল করে দিয়েছে, দিয়ে তার ফলস্ মাল ঢুকিয়ে দিয়েছে। না দিলে মাডার চার্জে পড়ত। এখন আর পড়বে না। বরং কে বলতে পারে আগামীকালের কাগজে সরসীর ছবিটবি দিয়ে তার বিরাট কীর্তির কথা বেরোবে না। অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছে এর ভাই সরসী, নবীন মুখার্জির কিছু আর বাকি রাখে নি, সমস্ত কেটেকুটে ফেলে নতুন করে আবার তার খুশি মতন জিনিস ভরে দিয়েছে। কী বলে যেন আজকাল? ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। তবে তাই। এর ফলে এই যে দেখছ, আমি তোমার ট্যাক্সিতে শুয়ে শুয়ে যাচ্ছি, আমি একটা মহামূল্যবান জিনিস হয়ে গেছি, মানুষের কাছে, সভ্যতার কাছে। তাই বলছি, মানব সভ্যতার কত বড় কীর্তিকে তোমার ট্যাক্সিতে বয়ে নিয়ে যাচ্ছ, তুমি জানো না।

জোর বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক যেন বুনো ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে এলোমেলো ছোটার মতন ছুটছে। ভিজে মাথা গাড়িগুলো ছুটটে বাড়ি পালাচ্ছে। নিয়নগুলো তোমার চোখের সামনে হাসুক, নাচুক, চোখ টিপুক—তুমি ভাই ধীরে সুস্থে, ঘুরে ফিরে চলো ট্যাক্সিঅলা। লোকজন বাঁচিয়ে। যেতে যেতে যদি শুনতে চাও আমি কোথাও যাচ্ছি, শোনো।

আমি যাচ্ছি সরসীর কাছে। ‘সরসী আরসী মোর’—সেই সরসীর কাছে। সরসী আমার কিশোর বয়সের বান্ধবী। সখী, সহচরী। সে আমার চেয়ে বছর খানেকের বড় হলেও হতে পারে। এক সময় তাকে আমি দিদি বলতাম, সরসীদি। তখন মা বেঁচে ছিল। পরে সরসী সরসী করেছি। ও আমায় তুই বলত, তুমি বলত; আমিও ওকে তুই তুমি বলেছি। আর খানিকটা বয়স বাড়তেই ‘সরসী আরসী মোর’। এটা অবশ্য ঠাট্টা করে বলা। তবু বলা চলে ওকে দেখে আমার নিজেকে দেখতে শেখা। কিন্তু সেইটুকু শেখা যেটুকু ওর ঠোঁট, গাল, বুকটুক শেখায়। তার বেশি আমি শিখিনি। শেখা কি উচিত ছিল? না। আমি মনে করিনি উচিত ছিল। আমি বরাবরই একটু দেহতত্ত্ব সম্পর্কে উৎসাহী। না ভাই, দেহতত্ত্বের গানটান যে লাইনে হয় সে লাইনে নয়; আমি অন্যভাবে বলছি। দেহ বিজ্ঞানের ছবিটবি দেখা বা পড়ার মতন আমি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সরসীর হাত পা কোমর দেখতে পারতাম। যখন ও পূর্ণ যুবতী, তখন বিবসনা সরসীকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওর সব কিছুই নির্দিষ্ট, নিয়মিত; এমন কি তার সামান্য স্ফীত গোলাপি রঙের উদর খাদ্য পরিপাক এবং বংশবৃদ্ধির জন্যে পঠিত। আমি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়েই অভিভূত বা উন্মত্ত হতাম না। সরসী আমার সখী ও সহচরী হিসেবে অবশ্যই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু তার মধ্যে আমি ঝাঁপ খেয়ে পাতালে যেতে রাজি নই। সরসী আমায় কী বর্ষা, কী শীত, কী বা বসন্তে তার সমস্ত মায়া মোহ লজ্জা দিয়ে অধিকার করার চেষ্টা করেছে। পারেনি। আমার বাবা তখন মৃত। আমি পয়সাকড়ি মোটামুটি ভালই পেয়েছিলাম। আমি সুখের জন্যে তার অধিকাংশটাই খরচ করেছি। সুখ সব সময়েই ক্ষণস্থায়ী। তাতে কী ! এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে যে, আমার দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থায় যেতে হবে। সরসীকে আমি অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি, কিছু লোক—যারা হয় ঠগ, না হয় জোচ্চোর অথবা অক্ষম অসহায়—তারা তাদের দল ভারি করার জন্যে সুখকে দুয়োরানীর মতন করে সাজিয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে তা নয়, সুখ নোঙরা বা ছোট নয়। জগতটা সম্পর্কে আমার বিচার আলাদা। আমি যখন তাস নিয়ে বসেছি তখন সব তাসই আমার কাছে তাস, আমি তাস তুলে নিয়ে চুমু দিয়ে খেলে যাব। আর আমি তাই খেলেছি। আমি কিছুই গ্রাহ্য করিনি। এই করে করে বয়েস বেড়ে গেল, সরসীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাঙল, জুড়ল, আবার ভাঙল, আবার জুড়ল। কিন্তু সেটা পাতলা হয়ে গেল। আমারই ভাবতে অবাক লাগে, সরসী কেন বরাবরের মতন সম্পর্কটা ভেঙে দিল না।

বৃষ্টিটা বোধহয় কমে এসেছে। আশ্বিনের বৃষ্টি এই রকমই। আসে যায়, যায় আবার আসে। সরসী আর আমার সম্পর্কের মতন অনেকটা। …যা বলছিলাম, আমাকে ভীষণ অত্যাচারী, পাপীতাপী, পশুটশু ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি অশ্বমেধের ঘোড়ার মতন না হলেও উৎসাহী প্রাণবান, সমর্থ যাত্রীর মতন সুখের সমস্ত সাধারণ রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার দুঃখ, অনুতাপ, অনুশোচনা নেই। আমি কারও ক্ষতি করিনি, কাউকে খুন করিনি, কোনো গর্হিত অপরাধ নয়। আমি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। প্রেম, ভালবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, আত্মত্যাগ, আদর্শ—এই সব আর কী। এমন কী, তুমি ভেবো না, আমি নারীর শরীরও বিশ্বাস করি। তাও করি না। আমি কি নিজের শরীরকেই বিশ্বাস করি ! যদি করতাম, আমার ঐ জ্বলজ্যান্ত দেহটা মরার খাটিয়ায় তুলে দিয়ে আমি নিজেই হরিধ্বনি দিতে দিতে যেতাম না।

কোথায় এলাম? …আচ্ছা, আচ্ছা আর একটু এগিয়ে নিয়ে ট্যাক্সিটা থামিয়ে দিও। …শোননা হে ট্যাক্সিঅলা, তুমি কি বুঝবে কথাটা, তবু শুনে রাখো, ফাঁকা ঘরে তোমার ঘুমের জন্যে বিছানা আশা করো না, যেখানে পারো শুয়ে পড়ো, নয়তো বসে থাকো। …এই দুনিয়ায় আমরা ফাঁকা ঘরে এসেছি।

হ্যাঁ এইখানে। এখানেই থাম। তুমি একটা চমৎকার ট্যাক্সিঅলা। …আচ্ছা ভাই, আসি…

সরসী তখনও ফেরেনি।

সরসীর বাবা তাঁর ঘরে আরাম কেদারায়, শুয়ে শুয়ে গুনগুন করে হরিনাম গাইছিলেন।

“কে, কে গো তুমি?”

“নবীন।”

“নবীন! …কেমন আছ তুমি? অনেকদিন এদিকে আসনি। এসো বাবা, বসো।

“সরসী ফেরেনি?”

“এখনও ফেরেনি; ফেরার সময় হয়ে গেছে। তুমি বসো।”

“আমি বরং নিচে রাস্তায় বেড়াচ্ছি। …দেখি সরসী আসছে কিনা!”

আমার গা গুলিয়ে বমি আসছিল। সরসীর বাবার ঘরে বমিটমি করে ফেলার চেয়ে রাস্তাঘাটে বমি করাই ভাল। তাছাড়া এই বুড়ো লোকটার ঘরে সে তার হরিনাম শোনার ধৈর্য আমার নেই। মুখ থেকে খারাপ গালাগাল বেরিয়ে যেতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় আমার মনে হচ্ছিল, প্রায় আশি বছর বয়স হতে চলল সরসীর বাবার। এখনও বুড়ো কোন আশায় বেঁচে আছে? কী লাভ এই বেঁচে থাকায়? হরি ছাড়া তার সঙ্গী নেই; আর হরিও এমন সঙ্গী—যে, বুড়ো যদি এখন হুট করে মরে যায়—তার হরি দেখতে আসবে না। তবু বুড়ো তার হরি নিয়ে আছে।

রাস্তায় নেমে দেখি ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে আবার। আমি ভাল মতন দেখতে পাচ্ছিলাম না। চশমাটা কোথায় ফেলে এসেছি কে জানে; হাতটা খালি খালি লাগছে, ফোলিও ব্যাগটা কী ট্যাক্সিতেই পড়ে থাকল? নাকি ‘বার’-এ ফেলে এলাম? …দূর শালা, এ হাত কি আমার? কার হাত আমার কাঁধে ঝুলছে কে জানে! সরসী তাড়াহুড়োয় ডান বাঁ, বাঁ ডান ঠিক মতন দেখে জুড়েছিল কিনা কে জানে! বোধ হয় নয়; জুড়লে আমার এরকম অস্বস্তি লাগছে কেন? হাঁটতে, হাত তুলতে, কোমরটা ঘোরাতে এমন বেকায়দা লাগার কথা নয়।

হাঁটতে, চলতে, দেখতে আমার এতই অসুবিধে হচ্ছিল যে আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে কোমর ভাঙা নুলো ভিখিরি টিখিরির মত যাচ্ছিলাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। মুখ, চুল, কোট প্যান্ট সবই ভিজে গেছে আমার। গাড়ি-টাড়িগুলো চলে যাবার সময় এমন করে আমার ওপর আলো ছুঁড়ে যাচ্ছে যেন আমি কোনো ফেরারি আসামী, পালিয়ে যাচ্ছি, পুলিশের গাড়ির সার্চ লাইটের মতন তারা আমায় দিশে করে নিচ্ছে।

সরসী, সরসী !… না ও সরসী নয়। ট্যাক্সিটা আমার গায়ের পাশ দিয়ে ঘুরে গলির মধ্যে ঢুকে গেল। পাশের দোকানে ছাতা মাথায় কতক লোক দাঁড়িয়ে, বাস গেল পর পর দুটো, পায়ের তলার মাটি কাঁপছিল, ঝকঝকে দোকানটার মধ্যে রেকর্ড বাজছে: ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন…’

সরসী! এই সরসী!..ননা, ও সরসী নয়। রিকশাটা ঠুনঠুন করে চলে গেল।

বৃষ্টি বুঝি থেমে গেছে। আকাশে কোথাও মোলায়েম করে মেঘ ডেকে গেল। এখন অনেকটা ঝাপসা অন্ধকার, মস্ত বাড়ির পাঁচিল টপকে গাছের ডাল দুলছে। এখানে আপাতত আমায় দাঁড়াতে হল, তারপর মাটিতে বসে পড়ে খানিকটা বমি করলাম। বমি করার পর ভীষণ তৃষ্ণা বোধ হল। বুক যেন ফেটে যাচ্ছে।

কাছাকাছি কোনো পানের দোকান থেকে একটা সোডা বা লেমনেড খাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম আবার। সরসী বড় বেশি দেরি করছে। এত দেরি করা উচিত নয়। এখন রাত হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে আরও রাত হয়ে যাবে, কম এলোমেলো বৃষ্টি, আকাশে মেঘ, হু হু ঠাণ্ডা বাতাস ছুটছে, সরসী তোমার আর দেরি করা উচিত নয়। তোমার বাড়ি ফিরে আসা দরকার। আমি—নবীন তোমার জান্যে আমার সহ্যের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এখন বাস্তবিক পক্ষে আমার ভেতরটা একদম ফাঁকা লাগছে, ভীষণ ফাঁকা, আমার হাত পা আর আমাকে টানতে পাৱছে না, আমার শীত করছে, চোখে দেখতে পাচ্ছি না, আমি আছি কি নেই—এ বোধ আমার হারিয়ে যাচ্ছে। তোমার উচিত এখন ফিরে আসা; ফিরে এসে আমায় কালো কেন তুমি আমার সঙ্গে এই নৃশংস, ইতরের খেলা খেললে? কোন অধিকারে তুমি আমায় একটা ফলস নবীন মুখুজ্যে তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছ।

এ রাস্তায় পানের দোকান পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আমার মনে হল, বমির একটা বিশ্রী দমক এসে মাথার মধ্যে কোথাও চাপা খোঁচা মেরেছে। মাথায় খোঁচা খেয়ে খেয়াল হল, একেবারেই আচমকা, যে—আমার হাত পা নেই, নিম্নাঙ্গ কোথাও খুলে পড়ে আছে, গলার কণ্ঠনালী কাটা, বুকের কাছটা গর্ত মতন, হৃদপিণ্ড খোওয়া গেছে, মুখের দু পাটি মাড়ি খোলা, চোখ নেই…। সরসী সমস্তই কেটেকুটে ছিড়ে ফেলে দিয়েছে। হায় হায়, আমি এই অন্ধকারে কোথাও তা খুঁজে পাচ্ছি না, খুঁজতেও পারছি না…। সরসী, শয়তান মাগী কোথাকার, ইউ বীচ; ইউ…। দাঁড়াও আমি বলছি তুমি দাঁড়াও। আমি তোমায় এবার দেখতে পেয়েছি, তুমি আসছ…

এরপর বোধ হয় ভুল করে আমি রাস্তার আলো অন্ধকারে কোনো মহিলাকে গিয়ে জাপটে ধরে ফেলেছিলাম। তার আচমকা চিৎকারে এখান ওখান থেকে কিছু লোক ছুটে এল। একটা ট্যাক্সি তখন রাস্তার কুকুর চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

আমায় কেউ প্রচণ্ড জোরে ঘুঁষি মারল। মেরেই চলল। চুলের মুঠি ধরে লাথি মারল কোমরে। পেটে মারল। তখন আমি রাস্তার মাটিতে। আমার বুকের ওপর বসে কে যেন চুলের ঝুটি ধরে রাস্তায় মাথা ঠুকে দিচ্ছিল। তোমরা আমায় কেন মারছ? আমি নবীন মুখুজ্যে। ভদ্রলোক। আমি সরসীকে খুঁজতে এসেছি। বিলিভ মি।

শালা মাতাল, লোফার, লোজ্জা; মার শালাকে, মেরে ফেল। ভদ্দর লোকের মেয়েকে জড়িয়ে ধরা। শালার প্যান্ট খুলে নে। মাইরি, কী গন্ধ বেরুচ্ছে রে বমির। ছেড়ে দে ঘণ্টা, মাতালটা পড়ে থাকুক রাস্তায়, লরিতেই খতম হয়ে যাবে।

আমার হাত, পা, মুখ, মাথা, বুক কিছুই আর থাকল না; সব যেন জোড় থেকে খুলে ফেলে দিয়ে ওরা চলে গেল। আমার তখন জ্ঞান শেষ হয়ে এসেছে।

কতক্ষণ পর যে পাতলা একটু চেতনা ফিরেছিল জানি না। ইলশেগুঁড়ির মত বৃষ্টি হচ্ছে, অল্প দূরে একটা আলো জ্বলছে রাস্তার, রিক্‌শা যাচ্ছে ঠুনঠুন করে, ভিজে রাস্তায় শব্দ তুলে এক আধটা গাড়ি বুঝি চলে গেল। তারপর আর শব্দ নেই, নিস্তব্ধ, নির্জন।

কার যেন পায়ের শব্দ আসছিল। শব্দটা আমার কাছে এল, গায়ের পাশ দিয়ে চলে গেল।

চলে গিয়ে থামল, আবার ফিরে আসছিল, খুট খুট শব্দ হচ্ছিল। শব্দটা আমার মাথার কাছে এসে থামল।

কে যেন রাস্তার পাশে আমার গায়ের ওপর নুয়ে পড়ছে। সে অনেকটা নিঁচু হয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লে মনে হল, সরসী। সরসী এসেছে।

সরসী তুমি এসেছ। এই দেখো, আমি তোমার নবীন রাস্তায় পড়ে আছি। আমার হাত, পা নেই; আমার গলা জবাই করা। ছাগলের মতন প্রায় দু খণ্ড; আমার বুক দেখো—মস্ত গর্ত, হৃদপিণ্ড নেই; আমার মুখ চুপসে আছে; মাড়ি বা দাঁত নেই; আমার চোখের মধ্যে তুমি তোমার আঙুল ডুবিয়ে দিতে পার।

সরসী তুমি আমার এই অবস্থা করেছ। তুমি আমার বুকের কাছে উলঙ্গ হয়ে বসে মহা উৎফুল্লে আমার সকল অঙ্গ, সকল ইন্দ্রিয় পিশাচীর মতন কেটে কেটে নিয়েছ, নিয়ে অন্ধকারে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ। এখন আর আমি নবীন নই। তুমি কি সুখী হয়েছ?

গত রাত্রের সেই স্বপ্নের মতন দেখলাম: সরসী আমার মুখ চুম্বন ও অশ্রুপাত করতে করতে বলছে “নবীন, আমি আজ বড় সুখী; তুই আমার লক্ষ্মী, তুই আমার সর্বস্ব। তুই আমার কাছে কিছু চা, চেয়ে চেয়ে নে।”

এ তোমার কেমন সুখ সরসী? এ তোর মুখ? এই কি তোর সেই নবীন? তোর নবীন ছিল তোর চোখের মণি, রাজার দুলাল। আজ আর নবীন রাস্তায় কাদায় লুটোচ্ছে চাপা পড়া কুকুরের মতন।

সরসী যেন আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল: “নবীন, তোকে তখন দেখেছি—তোর সুখে। কতকাল ধরে দেখেছি। আজ দেখছি তোর দুঃখে। … তোকে আমি অর্ধেক করে দেখতে চাইনি, সম্পূর্ণ করে দেখতে চেয়েছিলাম। তুই আজ সম্পূর্ণ। এই দেখার জন্যে আমি এত বছর অপেক্ষা করে আছি। তুই যে আমার সর্বস্ব।”

আমার চেতনা আবার মরে আসছিল। মরে আসতে আসতে শুনলাম—সরসী বলছে, “তুই আমার কাছে কিছু চা, চেয়ে চেয়ে নে।”

কী আমি চাইব? অন্য কোনো হৃদয়? অন্য কোনো চক্ষু? …আমি কিছুই চাইতে পারছিলাম না। চেতনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সরসীর মুখে ছায়া যেন আমার চোখের পাতার ওপর অন্ধকার বিছিয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *