সহকারি

সহকারি

বাইরে থেকে মেঘ ডাকার আওয়াজ ভেসে এল। গম্ভীর ডাক। এই ধরনের ডাক বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে লাগে। মনে হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। সেই বৃষ্টি আর কখনও থামবে না।

বকুল মনে মনে ভগবানকে ডাকছে। মেঘ ডাকার ভগবান।

‘হে মেঘ ডাকার ভগবান, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি ডাকতে থাকো। যত পারো তেড়েফুড়ে ডাকতে থাকো। এই বিপদ থেকে কেবল তুমিই পারো উদ্ধার করতে। মেঘের ডাক শুনে টাকাপয়সার কথা ভুলে পাওনাদাররা এখনই বাড়ির দিকে ছুটবে। আমার স্যার অপমানের হাত থেকে বেঁচে যাবেন। উনি একজন অতি ভালো মানুষ। আমার খুব খারাপ সময়ে উনি আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। বেতন কম, কিন্তু দিয়েছিলেন। ওর অপমান আমি সহ্য করতে পারব না।’

শো শেষ হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক। অন্ধকার হল খাঁ-খাঁ করছে। চেয়ারগুলোকে দেখাচ্ছে কালো কালো ঢিপির মতো। হঠাৎ তাকালে মনে হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপ। অথচ শোয়ের সময় এই চেয়ার থেকেই হইচই হয়। হাসি, কান্না, হাততালি। আজ অবশ্য এসব কিছুই হয়নি, আজ হলের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। দর্শক ছিল হাতে গোনা বত্রিশ জন। এর মধ্যে তিন জন নাকি টিকিট কাটেনি। ভ্যাগাবন্ড, বাউন্ডুলে টাইপ মানুষ। যাওয়ার কোনও জায়গা নেই তাই হলের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। গেটকিপার আপত্তি করেনি। হল তো গড়ের মাঠ হয়ে আছে। দু-পাঁচজন বিনাপয়সায় ঢুকে বসলে ক্ষতি কী?

রাত বাড়ছে। হলের কর্মচারী, শো-এর লোকজন প্রায় সকলেই বেরিয়ে গেছে। বাকিরা তাড়াহুড়ো করছে। মেঘের ডাক শুনে সেই তাড়াহুড়ো আরও বেড়ে গেল। মালপত্র সব তুলে দেওয়া হয়েছে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানে। জিনিস অনেক। ‘ম্যাজিক শো’-তে মালপত্র বেশি হয়। নানা ধরনের চেয়ার, টেবিল, আলো লাগে। সবই বিশেষ কায়দায় বানানো। কোনও চেয়ারের হাতল গুটিয়ে ফেলা যায়, কোনও টেবিলের তলা দিয়ে মানুষ গলে গেলেও কেউ বুঝতে পারবে না। আলোও বাহারি। কমানো, বাড়ানো, রং বদলানোর জন্য ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও হাজার রকমের ছোটখাটো আইটেম। তাসের প্যাকেট থেকে শুরু করে, জল ভরার জন্য পিতলের কলসি, চোখ বাঁধার রুমাল, পিছন ফিরে ছবি আঁকার ব্ল্যাক বোর্ড, পেট কাটার জন্য করাত, হাত বাঁধার জন্য দড়ি, শূন্যে ভাসার জন্য কপিকল আর সরু তারের বান্ডিল। সব মিলিয়ে তিনটে সিন্দুকে বোঝাই হয়ে গেছে। সিন্দুকের গায়ে সাদা রং দিয়ে লেখা ‘কেশবরঞ্জন দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান এন্ড কোং’। ‘এন্ড কোং’ কথাটা আগে ছিল না। বছরখানেক হল যোগ করা হয়েছে। নামে ‘এন্ড কোং’ থাকলে নাকি ভারিক্কি শোনায়। দর্শক টানতে সুবিধে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনও সুবিধে হয়নি। গত একবছরে ‘কেশবরঞ্জন দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান এন্ড কোং’-এর অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। কোনও শো নেই। কেউ বায়না করে না। নিজের খরচে হল নিতে চাইলেও ঝামেলা। হল মালিকরা হল দিতে চায় না। বলে, ‘ওরে বাবা কেশবরঞ্জনের ম্যাজিক শো তো বিরাট ফ্লপ করবে। হলের বদনাম হয়ে যাবে।’ জাদুকর কেশবরঞ্জন আজকের শোয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন অনেক কষ্টে। হলের মালিককে বুঝিয়ে ছিলেন, ‘হাউসফুল’ কেউ ঠেকাতে পারবে না। ‘হাউসফুল’-এর বদলে মোটে বত্রিশ জন।

মালপত্র সবই ভ্যানে তোলা হয়ে গেছে। ভ্যানের সোজা গোডাউনে চলে যাওয়ার কথা। এখনও যায়নি। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানের ড্রাইভার রাজু ঠিক করেছে ভাড়া না নিয়ে সে আজ গাড়ি ছাড়বে না। দলের ম্যানেজার কানাই পাল। তাকে খবর পাঠানো হয়েছে। সে বাইরে এসে ভাড়া মেটালে রাজু গাড়ি ছাড়বে। কানাই আসেনি। তার পক্ষে আসা সম্ভবও নয়। শুধু গাড়ি ভাড়া নয়, আজ কাউকেই টাকা দেওয়া যাবে না। আলো, সাউন্ড, মিউজিক, মেকআপ, পোশাক—সব কিছুর লোক অপেক্ষা করে আছে। এদের টাকাপয়সা মেটানোর অনেকটাই নির্ভর করে শো-এর টিকিট বিক্রির ওপর। উনত্রিশটা টিকিট বিক্রি হলে কাউকে টাকা দেওয়া যায় না। কানাই গ্রিনরুমে গা ঢাকা দিয়েছে। সে ধুরন্ধর লোক। প্ল্যান কষছে কীভাবে পাওনাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, বকুল যেরকম চাইছিল ঘটনা অনেকটা সেরকমই ঘটছে! মেঘ ডাকার ভগবান যদি সত্যি কেউ থেকে থাকেন, তিনি বকুলের মিনতি শুনেছেন। মেঘ ঘন ঘন ডাকতে শুরু করেছে। সেই ডাকে জোরও বেড়েছে। যারা এতক্ষণ টাকার জন্য অপেক্ষা করেছিল, তারাও ‘কাল সকালে অফিসে টাকা নিতে যাব’ বলে বেরিয়ে পড়ল। বকুল স্টেজের পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ‘মেঘ ডাকার ভগবান’-এর উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকাল। বকুল ছেলেটা ভালো। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। ‘কেশবরঞ্জন দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান এন্ড কোং’-এর একজন অতি সামান্য কর্মচারী। জাদুকরের সহকারি। সে করে নকল দর্শকের চাকরি। ম্যাজিক শো-তে নকল দর্শক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। ঘাপটি মেরে আসল দর্শকদের মধ্যে বসে থাকতে হয়। বিভিন্ন খেলায় জাদুকর দর্শককে স্টেজে ডেকে নেন। তাসের খেলা, ছুরির খেলা, অঙ্কের খেলা। সব সময় আসল দর্শক স্টেজে উঠলে সর্বনাশ। ম্যাজিক করা যায় না। তখন নকল দর্শকদের উঠতে হয়। তিন বছর আগে বকুল কাজ চাইতে কেশবরঞ্জনের কাছে আসে। তখন বেচারির হতদরিদ্র অবস্থা। দু-বেলা খাবার জোটানোই মুশকিল। ছেলেটার অতি সাধারণ চেহারা আর অতি সাধারণ ভাবভঙ্গি দেখে কেশবরঞ্জনের পছন্দ হল। তিনি বকুলকে বললেন, ‘কাজ দিতে পারি, তবে কাজে সাহস লাগবে আর খুব বিশ্বাসী হতে হবে। জাদুকরের সহকারিকে সবার আগে বিশ্বাসী হতে হয়। মাইনেকড়ি খুব বেশি হবে না বাপু। তবে আমি যদি টাকা পাই তুমিও পাবে, আমি যদি খেতে পাই তুমিও পাবে। এখন বলো তোমার সাহস আছে কিনা?’

বকুল বলল, ‘কেমন সাহস চাই স্যার? বাড়ি পাহারা দেওয়ার সাহস?’

কেশবরঞ্জন হেসে বললেন, ‘না, না, এই সাহস অন্য সাহস। ম্যাজিক ভালোবাসার সাহস। কোনও অবস্থাতেই ম্যাজিকের রহস্য ফাঁস করা চলবে না। লোভে পড়ে তো নয়ই, এমনকি চড়, কিল, ঘুষি খেলেও নয়।’

বকুল এমন কথা কখনও শোনেনি। ম্যাজিক কোম্পানিতে কাজ করতে গেলে সাহস লাগে নাকি! ভারি মজা তো। এই মানুষটাও চমৎকার। বলছে কিনা আমি টাকা পেলে তুমিও পাবে! সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। নকল দর্শকের চাকরি করার সময় সে জামা বদলে বদলে দর্শকদের মাঝখানে গিয়ে বসে। একেকটা খেলায় একেকরকম। কখনও সামনে, কখনও পিছনে। খুবই ঝুঁকির ব্যাপার। ধরা পড়লে পাবলিক সহজে ছাড়বে না। অনেক সময় আসল দর্শকরা কেউ যাতে স্টেজে না উঠে আসে তার জন্যও জাদুকরদের ভয় দেখাতে হয়। কায়দা আছে। যেমন ছুরির খেলায়। জাদুকর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দয়া করে আপনাদের মধ্যে থেকে একজন মঞ্চে উঠে আসুন। ভয় পাবেন না, উঠে আসুন প্লিজ। এসে আপনার নিজের রুমাল দিয়ে আমার চোখ ভালো করে বেঁধে দিন। আমি চোখ বাঁধা অবস্থাতে আপনার হাতে ধরে থাকা একটা আপেল ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটব। কেটে খেয়ে ফেলব। চিন্তা করবেন না, এক টুকরো আপনাকেও দেব। খেলাটা একটু ঝামেলার। লক্ষ্য ভুল হলে ছুরি আপনার হাতের ওপর পড়বে। দু-মাস আগে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছিল। আমি লক্ষ্য ভুল করে ফেলেছিলাম, বেচারি এক দর্শকের দুটো আঙুল ঘ্যাচাং…তবে ভয় পাবেন না, আমি নিশ্চিত আজ আমার ভুল হবে না। আসুন কে আসবেন?’ খুব স্বাভাবিক ভাবেই এরপর কোনও দর্শকই স্টেজে উঠতে সাহস পায় না। তখন আসল দর্শকদের মাঝখান থেকে উঠে আসে নকল দর্শক। সে এমন ভাবে ম্যাজিশিয়ানের চোখ বাঁধে যাতে রুমালের ফাঁক দিয়ে সব স্পষ্ট দেখা যায়। নকল দর্শকের চাকরি যারা করে এই কারণে তাদের খুব বিশ্বাসী হতে হয়। বকুলও তাই। সে তার মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞও বটে।

বকুলকে ডেকে খবর নিল কানাই। পাওনাদাররা ঝড়-বৃষ্টির ভয়ে চলে গেছে। এমনকি ভ্যান নিয়ে রাজুও পালিয়েছে। কানাই ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার কোথায়?’

বকুল বলল, ‘জানি না। দেখে আসব?’

কানাই বলল, ‘না থাক। আমি চলে যাচ্ছি। স্যার যদি খোঁজ করে বলবি, কোথায় গেছে জানি না। হলের দারোয়ান কী করছে?’

বকুল বলল, ‘মেইন গেটের সামনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। জ্বর এসেছে। আমাকে দেখে লাল লাল চোখ খুলে বলল, যাওয়ার সময় গেটে তালা দিয়ে যাবি। দরজার পাশে তালা চাবি রাখা আছে।’

কানাই খুশি হল। বলল, ‘হলের বাকি স্টাফদের দেখলি?’

বকুল বলল, ‘না। সবাই চলে গেছে। তুমি কী করবে?’

কানাই বিরক্ত মুখে বলল, ‘কী আবার করব? আমিও পালাব। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে না পালিয়ে উপায় আছে? এই নিয়ে তোর স্যারের পর পর সতেরোটা শো ফ্লপ করল। কত টাকা ধার জমেছে জানিস? না পালালে পাওনাদাররা সবাই মিলে পিটিয়ে মারবে।’

বকুল অবাক হয়ে বলল, ‘পালাবে! স্যারকে ফেলে পালাবে কানাইদা? তুমি না দলের ম্যানেজার?’

কানাই বলল, ‘ম্যানেজার তো কী হয়েছে? মার খেয়ে যাব নাকি?’

কথা বলতে বলতে গ্রিনরুমের ড্রয়ার হাতড়ে একটা মোটা নকল গোঁফ বের করল কানাই। নিশ্চয় কোনও নাটকের মেকআপ ম্যান ফেলে গেছে। বকুল অবাক হয়ে বলল, ‘ওটা কী করছ?’

কানাই মুচকি হেসে বলল, ‘নকল মানুষ সাজছি। যেমন তুই নকল দর্শকের পার্ট করিস। এই গোঁফ লাগিয়ে সোজা স্টেশন চলে যাব। কাল ফার্স্ট ট্রেন ধরে চম্পট। যদি ভালো চাস তাহলে তুইও পালা। এখানে পড়ে থাকলে বিপদে পড়বি। টেবিল হাতড়ে দ্যাখ আমার মতো কোনও নকল গোঁফ-দাড়ি পাস কিনা। পেলে পরে নে। কেউ চিনতে পারবে না।’

কানাই পাল পা টিপে টিপে বেরিয়ে যাওয়ার পর, বকুল কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে? তারও কি পালানো উচিত? অবশ্যই উচিত। এই দলে থাকার আর কোনও মানে হয় না। গত কয়েক মাস ধরে ঠিক মতো মাইনে পায় না। কখনও অর্ধেক, কখনও তারও কম। তাছাড়া পাওনাদাররা ঝামেলা করবে। ম্যানেজারকে না পেয়ে তাকেই চেপে ধরতে পারে। সত্যি হয়তো দু-চার ঘা দিয়েই দেবে। তার থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে বকুল একেবারে হলের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। দারোয়ান ঘুমোচ্ছে। বাইরে থেকে তালা চাবি দিয়ে চলে গেলে কেউ টের পাবে না। দরজার বাইরে পা রাখতেই একটা কাণ্ড হল। চারপাশ আলো করে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। থমকে গেল বকুল। তার অন্ধকার ভেতরটাও যেন আলো হয়ে গেল! পালিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এই বিপদের সময় ‘স্যার’কে একা ফেলে চলে যাওয়া তো ভীতুর কাজ হবে। অথচ সে চাকরিটা পেয়েছিল সাহসের কারণে। মানুষটা তাকে বিশ্বাস করে…না, না, এটা ঠিক হবে না। যত ঝামেলাই হোক, এখন স্যারের পাশে থাকতে হবে। আবার ভেতরে ঢুকে পড়ল বকুল। বাইরে তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বকুলের চিন্তা হল। স্যার কোথায়?

বকুলের ‘স্যার’ অর্থাৎ জাদুকর কেশবরঞ্জন বসে আছেন স্টেজের এককোনায়। কাঠের চেয়ারে। বিধ্বস্ত, ক্লান্ত একজন মানুষ। স্টেজ অন্ধকার। শুধু মাথার ওপর একটা আলো জ্বলছে। কম পাওয়ারের আলো। সেই আলোয় বিশাল স্টেজটাকে স্টেজ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, স্টেজের ছায়া। সামনের ভারী পরদাটাও দুপাশে সরানো। তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ায় হলের কর্মীরা পরদাটাও টেনে দিতে ভুলে গেছে। কেশবরঞ্জন উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছেন অন্ধকার হলের দিকে। সারি সারি শূন্য চেয়ার যেন তাকে ঠাট্টা করে হাসছে! এই শোয়ের ওপর অনেক আশা ছিল। সব ব্যর্থ। কয়েক বছর ধরেই ‘কেশবরঞ্জন দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান এন্ড কোং’-এর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আগে এরকম ছিল না। রমরমা বাজার ছিল। তার ‘টেবিল টেনিস’, ‘জলতরঙ্গ’, ‘সাজ বদল’, ‘নাছোড়বান্দা আগুনের বল’, ‘শূন্যে ভাসা অঙ্ক’ খেলাগুলো দারুণ প্রশংসা পেত। স্টেজে টেবিল টেনিস বোর্ড পেতে কেশবরঞ্জন যখন সহকারির সঙ্গে খেলা শুরু করতেন দর্শকরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। খেলা হত অন্ধকারে। শুধু আলোর একটা সরু রেখা এসে পড়ত টেবিল টেনিস বলের ওপর। বলের পিছু-পিছু ছুটত। মজা হল, খেলতে খেলতে জাদুকর খুশি মতো বলটাকে দিতেন ভ্যানিশ করে। প্রতিপক্ষ ভ্যাবাচেকা খেয়ে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। হাতে ব্যাট কিন্তু মারার জন্য বল নেই! ‘জলতরঙ্গ’ খেলায় বাটিতে জল ছাড়াই মধুর বাজনা বাজিয়ে ফেলতেন কেশবরঞ্জন। বাজনা শেষে দেখা যেত বাটিগুলো জলে ভরে গেছে। কেশবরঞ্জন বলতেন, ‘জলতরঙ্গ বাজনায় জল থেকে বাজনা হয়। আমি বাজনা থেকে জল নিয়ে এলাম।’ হাততালিতে হল ফেটে পড়ত। ‘সাজ বদল’-এর খেলায় মুহূর্তেই পরদার আড়াল থেকে জাদুকর কখনও বেরিয়ে আসতেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, কখনও কোট প্যান্টে। ‘নাছোড়বান্দা আগুনের বল’ ছিল দমবন্ধ করে দেওয়া ম্যাজিক। আগুনের বল ছুটে বেড়ায় স্টেজময়। জাদুকরকে তাড়া করে বেড়ায়। এমনকি স্টেজ থেকে নেমে চলে যেতে চায় দর্শকদের দিকেও। দর্শকরা ভয়ে চেয়ারের ওপর পা তুলে নিত। ‘শূন্যে ভাসা অঙ্ক’ খেলায় সবথেকে মজা পেত ছোটরা। হাসি, হাততালি আর উত্তেজনায় গোটা হল টগবগ করে ফুটত! ধীরে ধীরে সব হাততালি থেমে গেছে। কেশবরঞ্জনের আজকের শো-টা ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা। লাভ হল না কিছুই। তিনি আজ একজন বাতিল জাদুকর। দর্শকরা তাকে ছুড়ে ফেলেছে। দলের সবাইও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। দু-হাতে মুখ ঢেকে মাথা নামিয়ে ফেললেন কেশবরঞ্জন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, চেয়ারে ভেঙে পড়া মানুষের ছায়া পড়ে আছে।

পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন কেশবরঞ্জন। সামনে বকুল দাঁড়িয়ে আছে, হাতে চায়ের কাপ। কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। কেশবরঞ্জন অবাক হলেন। সেই সঙ্গে খুশিও। যাক, একজন তাহলে রয়ে গেছে।

‘কীরে বকুল তুই! বাড়ি যাসনি?’

চায়ের কাপ এগিয়ে এক গাল হেসে বকুল বলল, ‘স্যার, যাব কী করে? বাইরে তো আকাশ ভেঙে পড়েছে। নিন, চা ধরেন স্যার।’

কেশবরঞ্জন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, ‘চা কোথা থেকে পেলি?’

বকুল মাথা চুলকে হেসে বলল, ‘ম্যাজিক করে। ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে থাকতে থাকতে ম্যাজিক শিখে গেছি।’

এত দু:খেও কেশবরঞ্জন হেসে ফেললেন। বকুল বলল, ‘গ্রিনরুমে চা তৈরির ব্যবস্থা আছে। জল গরম করার হিটার, চা, চিনি, কাপ সব আছে। ভাবলাম স্যারের তো রাতে কিছু খাওয়া হবে না, এক কাপ চা অন্তত করে ফেলি। পেট না ভরুক ক্লান্তিটা তো কমবে।’

কেশবরঞ্জন কাপে আরামের চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বুঝলি বকুল, ম্যাজিক কোম্পানিটা তুলেই দেব ঠিক করেছি। জিনিসপত্র বিক্রিবাটা করে যেটুকু যা টাকা পাওয়া যাবে, ধার শোধ করব খানিকটা। পাবলিক আর কেশবরঞ্জনের ম্যাজিক শো দেখতে রাজি নয়। তা ছাড়া আমার তো বয়স হল। তেমন করে আর পারছি না।’

মাটিতেই পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে বকুল। কোনও তাড়া নেই। আকাশের যা অবস্থা তাতে আজ আর বাড়ি ফেরার প্রশ্ন নেই। একেবারে কাল সকালে দেখা যাবে। সুতরাং যতক্ষণ পারা যায় স্যারের সঙ্গে বসে গল্প করা যাক। তাছাড়া স্যারের সঙ্গে তার একটা ‘প্রাইভেট’ কথা আছে। পাঁচজনের সামনে বলা যাবে না। খানিক আগে কথাটা তার মাথায় এসেছে। বকুলকে উশখুশ করতে দেখে কেশবরঞ্জন বললেন, ‘কিছু বলবি?’

‘স্যার, যদি রাগ না করেন একটা কথা বলি।’

কেশবরঞ্জন বললেন, ‘কী কথা?’

‘আর একবার চেষ্টা করলে হয় না? আর একটা চান্স?’

কেশবরঞ্জন খুবই অবাক হলেন। বকুলের মতো একজন অতি সাধারণ ছেলের মুখে একথা শুনবেন তিনি আশা করেনি। সবাই যখন হাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখন ও বলছে, আর একটা সুযোগ নিলে কেমন হয়! বকুল আমতা আমতা করে বলল, ‘রেগে গেলেন নাকি? ভাবছিলাম, জমজমাট একটা খেলা নিয়ে আপনি যদি আবার স্টেজে আসেন…এই ধরুন সিন্দুক ভ্যানিশের মতো কোনও খেলা।’

যতই হোক কেশবরঞ্জন জাদুকর। ম্যাজিকের কথা শুনলে ভেতরে ভেতরে একটা উৎসাহ তৈরি হয়। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘সিন্দুক ভ্যানিশ! সেটা আবার কী খেলা?’

বকুল লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, ‘আমি দেখিনি কখনও, গল্প শুনেছি। বড় বড় জাদুকররা দেখাতেন। হাত-পা শিকলে বেঁধে সিন্দুকের ভেতর শুয়ে পড়তেন। স্টেজের আলো নিভেই জ্বলে উঠত। দেখা যেত জাদুকর সিন্দুকের বাইরে। হাসছে।’

কেশবরঞ্জন হেসে উঠলেন। বললেন, ‘সিন্দুক ভ্যানিশ কোথায়! ও তো মানুষ ভ্যানিশ। ওই ম্যাজিকের অনেক ঝামেলা। অনেক প্র্যাকটিস করতে হয়। তা ছাড়া খরচও আছে। বিশেষ কায়দায় সিন্দুক, লোহার শিকল বানাতে হয়। ওই যে বললি না, এক সেকেন্ডের অন্ধকারেই জাদুকর বেরিয়ে আসে? আসলে সিন্দুকটাই ওরকম করে বানানো। গোপন দরজা থাকে। ভেতর থেকে খুলে ফেলা যায়। তারপর নিমেষে বেরিয়ে আসতে হয়। ম্যাজিকটা খুবই ইন্টারেস্টিং, কিন্তু এই বয়েসে আমি আর অত তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করতে পারব না। এতে খুব ভালো রিফ্লেক্স লাগে। না রে, ওসব হবে না।’

বকুল একটুক্ষণ মাথা নামিয়ে বসে রইল। তারপর নীচু গলায় বলল, ‘আমি পারব না?’

বাইরে বিকট আওয়াজে বাজ পড়ল। কেশবরঞ্জন চমকে উঠে বললেন, ‘তুই!’

‘হ্যাঁ, আমি। আমার তো আর তেমন বয়স হয়নি স্যার। চিমসে ধরনের চেহারা। সিন্দুকের ভেতর থেকে চট করে গলে বেরিয়ে আসব।’ বকুল এগিয়ে গিয়ে কেশবরঞ্জনের হাঁটু চেপে ধরল। বলল, ‘একটা চান্স নিন না স্যার। শো না-হয় ক’দিন পরেই হবে। কথা দিচ্ছি, আমি জোর প্র্যাকটিস করব, একেবারে নাওয়া-খাওয়া ভুলে। খেলাটা একবার লেগে গেলে দেখবেন ম্যাজিক কোম্পানি আবার ছুটতে শুরু করেছে।’

কেশবরঞ্জন অন্যমনস্ক হয়ে খালি কাপেই দুবার চুমুক দিলেন। তার চোখের মণি স্থির হয়ে গেছে। বকুলের কথাটা তার মাথার ভিতর ঢুকে গেছে! ছেলেটা বাজে কথা বলেনি। ম্যাজিকের ইতিহাসে এই উদাহরণ আছে। ‘বন্দিদশা’ থেকে নিজেকে মুক্ত করার খেলা দেখিয়ে অনেক জাদুকর নাম করেছেন। যেমন হ্যারি হুডিনি। তাকে হাত-পা বেঁধে, বাক্সে পুরে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি সুস্থ শরীরে বেরিয়ে এসে পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। শুধু বিদেশি কেন, বাঙালি জাদুকরও এই খেলা দেখিয়েছেন। বিখ্যাত জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী দেখাতেন। খেলার নাম ছিল ‘ইলিউশন বক্স’। হুডিনির কায়দায় হাত-পা বেঁধে ঢুকে পড়তেন কাঠের বাক্সে। সময় হলে বেরিয়ে আসতেন। আবার বাক্স খুলে দেখা যেত ভেতরে শুয়ে আছেন ঠিক আগের মতো। তাহলে? তাহলে তিনি কেন পারবেন না? বরং তার খেলার নতুন জিনিস থাকবে। যা কেউ কখনও করেনি। কেশবরঞ্জনের শো-এ জাদুকর নিজে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হবে না। সে মুক্ত করবে ‘বন্দি দর্শক’-কে। বকুল সেই দর্শক হবে। ছাপোষা মানুষ সেজে বসে থাকবে অডিটোরিয়ামে, একেবারে পিছনের সিটে। ডাকার পর স্টেজে উঠবে বটে, কিন্তু অভিনয় করবে ভয়ের। কাঁপতে শুরু করবে। অনেক বোঝানোর পর হাত-পা বেঁধে ঢুকবে বস্তার ভেতর। বস্তা ঢুকবে সিন্দুকে। তালা বন্ধ সিন্দুক। হল কাঁপিয়ে বাজনা বাজবে। আলো নিভবে মুহূর্তের জন্য। তারপর সবাই দেখবে…।

কেশবরঞ্জন ঝুঁকে পড়ে বকুলের কাঁধে হাত রাখলেন। গাঢ় স্বরে বললেন, ‘পারবি তো? কাজটা কিন্তু খুব কঠিন, সাহস লাগবে।’

বকুল ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে একগাল হেসে বলল, ‘পারব স্যার। আমার খুব সাহস। বুঝতে পারছেন না?’

কেশবরঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, ‘তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমি নিজেও আবার ম্যাজিক দেখানোর সাহস ফিরে পাচ্ছি। এটাই মজা। সাহসী মানুষ অন্যের সাহস বাড়িয়ে দেয়। এখন এখান থেকে ভাগ। আমাকে একা থাকতে দে। সারারাত ধরে খেলাটাকে মাথার ভেতর সাজিয়ে ফেলি। ভালো করে অভিনয় করতে হবে কিন্তু বকুল।’

ঠিক হয়েছিল তিন মাস পরে শো হবে। লেগে গেল চার মাস। টাকা জোগাড় হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত গ্রামের পৈতৃক জমিটা বেচে দিলেন কেশবরঞ্জন। অর্ডার দিয়ে গোপনে বিশেষ দরজা লাগানো সিন্দুক, কব্জা লাগানো লোহার শিকল তৈরি হল। বকুল আরও একমাস সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসার কসরত রপ্ত করল। শোয়ের দশদিন আগে পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে গেল শহর। বড় বড় করে লেখা—সাবধান, সাবধান, সাবধান। যারা ভীতু তারা এবার কেশবরঞ্জনের এই ম্যাজিক শো দেখতে আসবেন না। বলা যায় না, হয়তো আপনাকেই হাত-পা শিকলে বেঁধে ঢুকতে হবে সিন্দুকের ভেতর। জাদুকর মন্ত্রবলে আপনাকে মুক্ত করবেন। মন্ত্র ভুল হলে সর্বনাশ। সুতরাং সাবধান!’

তিনদিনের মধ্যে সব টিকিট বিক্রি। মজার কথা, চলে যাওয়া পুরোনো লোকেরা সব ফিরে এসেছে। এমনকী ম্যানেজার কানাই পর্যন্ত। কেশবরঞ্জন সকলকেই যতটা পারেন টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়েছেন। শনিবার সন্ধেবেলা শো শুরু হল বিরাট উত্তেজনায়। প্রচারে কৌতূহলী হয়ে পত্রপত্রিকার সাংবাদিক, ফটোগ্রাফাররাও এসেছে। শেষ খেলা সিন্দুকের। বকুল দুর্দান্ত অভিনয় করল। কেশবরঞ্জন নিজে অভিভূত হলেন। নকল দর্শকের অভিনয় যে এতটা ভালো হবে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। পরিকল্পনা মতো বকুলকে সিন্দুকে ঢোকানোর পর হল কাঁপিয়ে বাজনা শুরু হল। হিসেব মতো মুহূর্তের জন্য সব আলো নিভে পরক্ষণেই জ্বলে উঠল। কিন্তু বকুল কোথায়! তার তো সিন্দুকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। ঠিক ছিল, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জাদুকরের কাছে কাঁপা গলায় সে এক গ্লাস জল চাইবে। কিন্তু কোথায় সে! দর্শকরা দমবন্ধ করে আছে। কেশবরঞ্জনের শরীর কেঁপে উঠল। তবে কি কোনও দুর্ঘটনা ঘটছে? বকুল সিন্দুকের ভেতর আটকে পড়েছে নাকি? দরদর করে ঘামতে লাগলেন কেশবরঞ্জন। ঠিক এমন সময় পিছন থেকে কে যেন কাঁপা গলায় চিৎকার করে উঠল—’এই তো স্যার, আমি এখানে।’ সবাই চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল পিছনে নিজের সিটে বসে আছে বকুল! হাত নাড়ছে আর বোকার মতো হাসছে। সেই হাসিতে চাপা একটা পরিতৃপ্তি! কেশবরঞ্জনের মনে হল, তিনি জ্ঞান হারাবেন। কী করে এমন ঘটল! বকুল ওখানে গেল কী করে? অসম্ভব, অসম্ভব এ হতেই পারে না। কোনওরকমে নিজেকে সামলালেন তিনি। আবার সব আলো নিভল। শো শেষ। দর্শকদের তুমুল হাততালি। থামতেই চায় না। ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। কেশবরঞ্জন হাত তুলে পরদা টানার নির্দেশ দিলেন। পরদা টানা হলেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন স্টেজের ওপর। ‘কেশবরঞ্জন দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান এন্ড কোং’-এর শো-এর জন্য বায়না করতে তখন বহু লোক স্টেজের দিকে দৌড়েছে। ম্যানেজার কানাই পাল তাদের সামলাচ্ছে।

সিন্দুকের ভেতর বকুলের মৃতদেহ পাওয়া গেল। মুখে যন্ত্রণার ছাপ নেই, বরং পরিতৃপ্তির হাসি। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, কোনও কারণে সিন্দুকের লুকোনো দরজা খুলতে পারেনি বেচারি। তাতেই দমবন্ধ হয়ে যায়। হয়তো চিৎকার করেছিল। কিন্তু সেই চিৎকার শোনা যায়নি। বাজনায় ঢাকা পড়ে গেছে। ঘটনা খুব কম লোকই জানতে পারল। কানাই পাল সব ম্যানেজ করছে। সবাই জানল, বকুল নামে একটা মানুষ হারিয়ে গেছে। একজন ‘নকল দর্শক’ হারিয়ে গেলে কার কি এসে যায়?

আজও কেশবরঞ্জন সিন্দুকের খেলা দেখান। সহকারি হিসেবে তিনি অন্য লোক নিয়েছেন। খেলা শেষে দর্শকরা তুমুল হাততালি দেয়। পরদা টানা হয়ে গেলে কেশবরঞ্জন দু-হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন। দলের সবাই অবাক হয়। এত হাততালি পেয়েও মানুষটা কাঁদে কেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *