ফরাসি রান্নায় সস
SAUCE, n. The one infallible sign of civilization and enlightenment. A people with no sauces has one thousand vices; a people with one sauce has only nine hundred and ninety-nine. For every sauce invented and accepted a vice is renounced and forgiven.
অ্যামব্রোস বিয়ার্সের লেখা শয়তানের অভিধানে সসের এই দারুণ সংজ্ঞা রয়েছে। উৎস হিসেবে স্যালাডের মতো সসের মানেও নোনতা। ল্যাটিন সালসাস থেকে প্রথম অংশটা বাদ পড়ে সস এসেছে। ফ্রিজ আসার আগে বহুদিন মাছ বা মাংস রেখে দিলে তা দিয়ে বিচ্ছিরি গন্ধ বার হত। রান্নাতেও সেই গন্ধ চাপা দেওয়া মুশকিল ছিল। ভারতীয়দের ছিল মশলার সম্ভার, তারা ম্যানেজ করে নিত। বেচারা ইউরোপীয় শেফদের তাই খাবারের কটু গন্ধ ঢাকতে সস ছাড়া চলত না। রোমানরা ম্যাকারেল, টুনা, ইল ইত্যাদি মাছের নাড়িভুঁড়ি নোনাজলে গেঁজিয়ে তীব্র গন্ধের গারুম নামের এক সস বানাত। সেই মিশ্রণের উপরের অংশটা পেতেন অভিজাতরা, আর নিচের থকথকে অংশ রেখে দেওয়া হত মধ্যবিত্ত বা গরিবদের বিক্রি করার জন্য। গারুম শুধু মাত্র রান্নাতেই কাজে লাগত না। ইতিহাসে পাথুরে প্রমাণ আছে, গারুমকে চিকিৎসকরা আলাসার, পেট খারাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, এমনকি কুকুর কামড়ের অব্যর্থ ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সসও ইউরোপীয় রান্নার এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হল। তবে ফরাসি রান্নায় সসের যা গুরুত্ব তেমনটা আর অন্য কোথাও নেই। ফরাসি রেস্তোরাঁতে সসিয়ের নামে একজন আলাদা শেফ থাকেন, যাঁর কাজই হল নানারকম সস বানানো। ফরাসি রান্নায় সসের এই বাড়বাড়ন্তের পিছনে রয়েছেন ফরাসি রানি ক্যাথরিন ডি মেদিচি। ১৫৪৭ সালে রানি হয়েই তিনি স্বদেশ ফ্লোরেন্স থেকে সেরা সস-বানিয়েদের নিয়ে আসেন আর ফরাসি রান্নার খোলনলচে বদলে দেন। সসে ডিম, দুধ কিংবা অরিগানো, থাইমের মতো ভেষজের ব্যবহার ইতালীয়রাই ফরাসিদের শেখান। কিন্তু গুরুমারা বিদ্যা যাকে বলে। কয়েক বছরের মধ্যে ফরাসিরা নিত্যনতুন সসের রেসিপি বানিয়ে ইতালীয়দের চেয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে গেলেন। পাঁচটি মূল ধরন তৈরি হল সসের, যাদের বলা হয় মাদার সস। এদের বিভিন্ন অদলবদলে আরও হাজার হাজার সস বানানো যায়। সংক্ষেপে এদের ধরনটা বলি—
১। বেসামেল সস— সাদা রঙের এই সস ফরাসি সম্রাটের প্রধান স্টুয়ার্ট মারকুই লুই দে বেসামেলের নামে। বানাতে লাগে মাখন, ক্রিম, ফোটানো দুধ আর ময়দা।
২। হল্যান্ডেজ সস— মাখনের মতো দেখতে আর মাখন আর ডিমের কুসুম দিয়ে তৈরি এই সসের আসল নাম ছিল ইন্সাইনি সস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে মাখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে মাখন আনা হত প্রতিবেশী হল্যান্ড থেকে। অতএব…
৩। এস্পানিওল সস— আগে নাম ছিল ব্রাউন সস। বানানো হত বিফ স্টক, ভেষজ, তরিতরকারি ইত্যাদি দিয়ে। পরে ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুইয়ের বিয়ে স্পেনের রানির সঙ্গে হলে স্পেনের কুকরা এই সসে টমেটো মিশিয়ে তার চরিত্রনাশ করে। ফরাসিরা তাই একে এস্পানিওল সস বলে।
৪। ভেলুতে সস— থকথকে গাঢ় সাদা এই সসে চিকেন স্টক, মাছের জুস, ডিম, ক্রিম, মাখন, ভেষজ, মানে যা যা দেওয়া যায় আর কি। ভেলুতে মানে ফরাসি ভাষায় ভেলভেটের মতো।
৫। টমেটো সস— আমাদের চিরপরিচিত। তবে ফরাসিরা এতে পেঁয়াজ, রসুন, মাংসের স্টক, তেজপাতা, লংকা, মাখন, ময়দা, শুয়োরের পেটের দিকের মাংস দিয়ে থাকে। আর হ্যাঁ, টমেটোও দেয়।
১৬৫ সালে প্রকাশিত হয় রান্নার জগতের বাইবেল ‘Le Cuisinier francois’, যাতে মহান শেফ ফ্রাসোয়াঁ পিয়ের ভার্নে নানারকম সসের বিস্তারিত রেসিপি দিয়েছেন। তবে এই সসগুলো মূলত অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের পর সাধারণ মানুষের খাওয়াতেও পরিবর্তন এল। রাস্তার ধারে ধারে বহু রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠল, যারা নিয়মিত ওট কুইজিন (অভিজাত খানা) বানাতেন। এঁদের অনেকেই ছিলেন রাজপরিবারের রাঁধুনি। এঁদের মাধ্যমেই ফরাসি খানার বিশ্বজয় শুরু।
মোহোনিজ থুড়ি মেয়োনিজ রহস্য
বাজারে দুরকম মেয়োনিজ পাওয়া যায়। ডিম দেওয়া আর ডিম ছাড়া। কিন্তু এই ডিম ছাড়া মেয়োনিজকে কীভাবে মেয়োনিজ বলা চলে তা আমার অন্তত মাথায় ঢোকে না। মেয়োনিজ কথাটা এসেইছে ফরাসি ময়ো থেকে, যার মানে ডিমের কুসুম। ঘরে সহজেই বানানো যায়। ডিমের কুসুম, অলিভ অয়েল, লেবুর রস বা ভিনিগার নিয়ে খানিক ব্লেন্ডারে নাড়াচাড়া করলেই টাটকা মেয়োনিজ তৈরি।
তবে মেয়োনিজের নাম নিয়ে প্রচুর তর্ক আছে আর আছে মজার মজার গল্প। মেয়োনের ডিউক চার্লস দি লোরেন নাকি এই সসের এত ভক্ত ছিলেন যে ১৫৮৯ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে আরকোয়ার যুদ্ধে এই সস মাখানো মুরগির ঠ্যাং খেতে ব্যস্ত থাকায় তিনি যুদ্ধটাই হেরে যান। ইংরাজরা চিমটি কাটতে ভোলেন না। তাঁরা এই সসের নাম রাখেন মেয়োনিজ। আয়ারল্যান্ডে অবশ্য আর-এক গল্প চলে। সেখানকার এক জেনারেল ম্যাকমোহন নাকি এই সস প্রথম বানান। তাঁর নামেই সসের নাম রাখা হয় ম্যাকমোহনিজ আর সেটাই লোকমুখে মেয়োনিজ হয়ে গেছে। ম্যাকটা কোথায় গেল জানি না, বোধহয় ম্যাকডোনাল্ডসে বার্গার খেতে গেছে। তবে মেয়োনিজের নাম নিয়ে সেরা গল্পটা ব্রিটিশদের নিয়ে। সেটা বলতেই হবে।
মিনোর্কা দ্বীপকে বহুবার বহু মানুষ অধিকার করেছে। হ্যানিব্যালের নিজের ভাই মাগো এই দ্বীপ দখল করে মোহন বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন, সেও যিশুর জন্মের আগের কথা। ১৭৫৬ সালে ব্রিটিশরা এই দ্বীপ অধিকার করে। দ্বীপের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন সেনাপতি জন ব্যাং আর তাঁর তেরোটি রণতরী। ফরাসিরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের সেনাপতি রিসেলিউ (এই ভদ্রলোক ন্যুড ডিনার পার্টি দিতেন) প্রায় ১৫০০০ সৈন্য নিয়ে দ্বীপ আক্রমণ করে ব্রিটিশদের ৩০০০ সৈন্যকে ঘিরে ফেলেই বললেন, ‘চলো ডিনার করা যাক।’ এদিকে মি. ব্যাং পালালেন জিব্রাল্টারে। তাঁর বিচার হল আর বিচারে প্রাণদণ্ড হল কর্তব্যে গাফিলতির জন্য। ১৯ এপ্রিল রিসেলিউ মোহন দখল করে নিয়মিত ডিনার পার্টি দিতে লাগলেন। একদিন তাঁর হেড খানসামা দেখলেন ভাঁড়ারে ক্রিম নেই। এদিকে জেনারেল বলেছেন বেসামেল সস বানাতে। না বানালে কী হবে খুব ভালো জানতেন সেই ভদ্রলোক। ভয়ে ভয়ে হাতের কাছে যা ছিল, ডিম, অলিভ তেল আর ভিনিগার দিয়েই সস বানালেন তিনি। জেনারেল খুশ। শুধু খুশ না, ফ্রান্সে ফিরে যাবার সময় তিনি এর রেসিপিও নিয়ে গেলেন, আর মোহন বন্দরকে মনে রেখে তিনি এর নাম দিলেন মোহনিজ। তারপর? কোথা থেকে কী হইয়া গেল, মোহনিজ মেয়োনিজে পরিণত হইল।
নুন আর গোলমরিচ
শুরুতেই বলে রাখি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা শব্দটা এখন খারাপ অর্থে দেখা হলেও আসলে তা ভালোর জন্য। যুদ্ধে বা অন্য কোনও কারণে কোনও সৈন্যর আঘাত লাগলে তাঁর বন্ধুরা সেই আঘাতে প্রাথমিকভাবে নুন ডলে দিত। তাতে জ্বালা বহুগুণ বেড়ে গেলেও ঘা সারত তাড়াতাড়ি। নুনের অভ্যাস মানুষের প্রাচীনতম অভ্যাসের একটা। হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ খাবারে নুনের ব্যবহার শুরু করে। তবে তখনকার এই নুন আজকের যুগের সাগরের জল পরিশুদ্ধ প্রক্রিয়াজাত নুন নয়। তখন নুন সংগ্রহ করা হত খনি থেকে। সেই সময়ের লোকেরা নিজস্ব উপায়ে খনি থেকে নুন উত্তোলনের প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছিল। চিনের সানশি প্রদেশের ইয়নচুনে এরকম এক খনির কথা জানা যায়। এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচাইতে প্রাচীন খনি, যেখান থেকে মানুষ মাটি খুঁড়ে নুন বের করতে পারত। বর্তমানে পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়া সহ আরও কিছু দেশে এখনও নুনের খনির দেখা মেলে। অস্ট্রিয়ার একটি এলাকার নাম সালজবুর্গ, যার মানে হল নুনের শহর। এই এলাকাটির সতেরো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে একটি নুনের খনি। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয়রা নুনকে পবিত্র বলে মনে করত। তাই তারা কবরে নুন রাখত। মৃতদেহ নুন দিয়ে মাখালে তা টিকে থাকে অনেকদিন। তাই তারা মৃত মানুষের কবর দেবার সময় নুন রেখে দিত। নুনের অন্য ধরনের ব্যবহারও তখন থেকে চালু হয়ে আসছে। নুন মাখিয়ে খাবার সংরক্ষণ করার উপায় বের করেছিলেন মিশরীয়রাই। মিশরীয়রা মাছে নুন মাখিয়ে বিক্রি করত ফিনিশিয়দের কাছে। নুনের নানান ধরনের ব্যবহারের ফলে নুনের ব্যবসা অনেক জমজমাট হয়ে ওঠে। নুন বিক্রির জন্য আফ্রিকায় একটি আলাদা রাস্তা তৈরি হয়েছিল। সেই রাস্তা আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে টুয়ারেগ নামের এক জাতি বছরে প্রায় ১৫০০০ টন নুন নিয়ে যেত।
নুনের ইতিহাস কিন্তু শুধু খাওয়ায় নুনের ব্যবহার বা নুন নিয়ে বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতন দেওয়া হত এই নুন দিয়ে। ইংরেজিতে ‘সোলজার’ মানে হল সৈন্য আর সেলারি মানে বেতন। এই দুটি শব্দ এসেছে ‘সল্ট’ থেকে। সেখান থেকেই শব্দটা রয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। ‘কার নুন খাও’ বা ‘যার নুন খাই, তার গুণ গাই’-এর মধ্যেও রয়ে গেছে প্রাচীন নুন খাওয়ার তুলনাটি। তেমনি আবার ‘নিমকহারামি’ বলা হয় বিশ্বস্ততা হারালে বা আনুগত্যের খেলাপ করলে। অনেক ধর্মে নুন খুব পবিত্র ব্যাপার। জাপানের শিন্টোরায় যে-কোনো মানুষ বা স্থানকে পরিশুদ্ধ করতে নুন ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক সেইজন্য সুমো কুস্তিগিরদের উপর নুন ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
নুন যে শুধু মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে এনেছে তা কিন্তু নয়। অনেক যুদ্ধও কিন্তু এই নুনের কারণে হয়েছিল। ইতালির ভেনিস শহরের সাথে জেনোয়া নামের আর-একটি শহরের লড়াই ঘটেছিল শুধুমাত্র নুনকে কেন্দ্র করে। এই নুন নিয়ে আরও একটি মজার ঘটনা আছে। ১৮০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের এক জায়গায় নুন পাওয়া যায়। আর এই নুন সরবরাহ করতে গিয়েই লিভারপুল নামে এক বিশাল বন্দর গড়ে ওঠে।
১৩৪২ সালের প্রবাসী পত্রিকায় জীতেন্দ্রকুমার নাগ বাংলার লবণ শিল্প নিয়ে লিখেছেন, ‘ভিক্টোরিয়ার যুগের বহু বিদেশী গ্রন্থ হইতেও আমাদের দেশের তদানীন্তন লবণ-শিল্পের প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায় । মুসলমান-আমলে বহু দিন হইতে নিম্নবঙ্গে, বিশেষতঃ হিজলী প্রদেশে, বিস্তৃত ভাবে লবণ প্রস্তুত হইত। সমুদ্রতীরবাসীদের মধ্যে ইহা একটি কুটিরশিল্প হিসাবে সেদিনও পর্যাপ্ত বাঁচিয়া ছিল । মেদিনীপুর ও সুন্দরবন ছিল লবণ ব্যবসায়ের প্রধান আড্ডা । তাহা ছাড়া ব্যাপক ভাবে বণিক-সম্প্রদায় এই প্রদেশে লবণ প্রস্তুত করিয়া থাকিতেন। খালাড়ি হইতে অতি সহজে লবণ লইয়া যাইবার জন্য বদরওলাচরের সন্মুখ ভাগ হইতে সাঁকরাইলের নিকটবর্তী সরস্বতী নদী পর্যস্ত একটি ক্ষুদ্র খাল কাটা হইয়াছিল । লবণবাণিজ্যের অস্তিত্বে এই খালকে তখনকার লোকে বলিত নিমকির থলি । হিজলীতে যে-সমস্ত স্থানে লবণ-কারবার ছিল সেই স্থানকে নিমক্-মহাল বলা হইত। বাংলার শাসনকর্তা সুলতান সুজার রাজস্ব বন্দোবস্তে এই নিমক্মহালের উল্লেখ পাওয়া যায়। নবাবী আমলে হিজলীর কারবার পরিচালনা করিতেন নবাব-সরকারের অধীন কয়েক জন জমিদার । এই লবণ ছিল নবাব-সরকারের অন্যতম প্রধান আয়ের বস্তু, কারণ লবণের উপর শুল্ক বসান হইয়াছিল, যদিও অধুনা ইংরেজ-শাসকের লবণশুল্কের তুলনায় তাহা কিছুই নহে। যাহা হউক, বাংলার এই ইতিহাস-বিখ্যাত ব্যবসায়ে হিজলী প্রদেশে কাশ্মীরী, পঞ্জাবী, মুলতানী, ভাটির প্রভৃতি প্রাদেশিক সওদাগরগণ এখান হইতে লবণ ক্রয় করিয়া লইয়া যাইতেন।’ গোলমরিচের ইতিহাসও বেশ পুরোনো। দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে তার জন্ম। কিন্তু সেই অতীত থেকেই ঝাল বলতে মানুষ গোলমরিচ ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। বেশ কিছু পরে লবঙ্গ আসে। লংকা তো সেদিনের ছোকরা। ১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মমি হওয়া মিশরীয় সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিস-এর নাকে গোলমরিচ গোঁজা ছিল। রাজা মারা গিয়েও প্রিয় এই মশলাকে ভুলতে পারেননি। আর সেই যুগে ভারত আর মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগ ছিল, এটাও গোলমরিচের এই ক্লু ছাড়া জানা যেত না। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা তাদের সমস্ত আমদানিকে ৮৬ পাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল— যার মধ্যে গোলমরিচও ছিল। কিন্ত মূলত ওষুধ বানাতে ব্যবহার করা সেদিনের সেই গোলমরিচ ছিল সাংঘাতিক দামি— একসময় ইউরোপে ১২ আউন্স গোলমরিচের দাম ছিল ৫০ পাউন্ড। গথরা যখন ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোম নগরী ঘিরে ফ্যালে, শান্তিস্থাপনের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল তিন হাজার পাউন্ড ভারতীয় গোলমরিচ! ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে শ্যামের রাজা পনেরো হাজার পাউন্ড মূল্যের গোলমরিচ আর চন্দনকাঠ উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন চিনে, দু-বছর পরে তিনি পাঠালেন তার দশগুণ মূল্যের মালপত্র।
রানি প্রথম এলিজাবেথের আমলে শীতকালে ইংল্যান্ডের সাহেবদের খাবার বলতে ছিল শীত আসার আগে থেকে নুন মাখিয়ে রেখে দেওয়া মাংস আর শুঁটকি মাছ। আর তা খেতে হত কোনও মশলা ছাড়া— কারণ মশলা ছিল দুষ্প্রাপ্য আর নুন দুর্মূল্য। ওই দুর্গন্ধওয়ালা খাবার গলাধঃকরণ এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাহেবদের কাছে— বেঁচে থাকার তাগিদে দমবন্ধ করে সাহেবরা তা-ই খেয়েছে বছরের পর বছর। কিছুদিন পর্তুগিজদের কাছ থেকে মশলা কিনেছিল, কিন্তু মওকা বুঝে তারা মশলার দাম বাড়িয়ে দেয়। ওলন্দাজদের কাছে মশলা কিনতে গিয়ে আরও ঝামেলা। ১৫৯৯ সালে তারা ইংল্যান্ডে গোলমরিচ বিক্রি করল পাউন্ড প্রতি তিন শিলিং দামে, আর ক-মাসের মধ্যেই তা বাড়িয়ে করে দিল আট শিলিং! অগত্যা জন্ম হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ১৬০১ সালে ওঁরাও জাহাজ ভাসালেন ভারতের দিকে, আড়াই বছর পর ফেরত এলেন দশ লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ নিয়ে! আর লাভের অংশ? ১৬২০ সালে আড়াই লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ কিনেছিলেন পাউন্ড প্রতি আড়াই পেনি দরে। বিক্রি করেছেন এক শিলিং আট পেনি দরে! এক বার মনে করিয়ে দিই এখানে ১২ পেনি=১ শিলিং আর ২০ শিলিং=১ পাউন্ড ছিল সেই জমানার হিসেব। অর্থাৎ পরিষ্কার আট গুণ বেশি দামে! পর্তুগিজরা আর ওলন্দাজরা যতই জাহাজ ভর্তি করে গোলমরিচ ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলো থেকে ভাস্কো দা গামা-র আবিষ্কৃত পথ দিয়ে ইউরোপে পাঠাক আর টাকা কামাক, ইউরোপে গোলমরিচ তার অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। শুধু ইউরোপে নয়, চিন দেশেও কিন্তু গোলমরিচ পাওয়া যায় ভাস্কো দা গামা-র ভারতীয় গোলমরিচের দর্শন আর ডাকাতির বহু দিন আগে থেকেই। মার্কো পোলোর লেখায় পাওয়া যায় কুবলাই খান তাঁর কিন্সে শহরের জন্য দৈনিক ৯৫৮৯ পাউন্ড গোলমরিচ জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আর তৃতীয় শতাব্দীর চিনা পুঁথিতে ‘হুজিজাও’ বলে গোলমরিচের উল্লেখ করা হয়েছে— যার মানে বিদেশি মরিচ।
এখানেই গোলমরিচের গল্প শেষ করা যেত, কিন্তু প্রাণকৃষ্ণ দত্তের দুর্গাপুজো নিয়ে একটা লেখা পেয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না, “নবমীর বলিদানের আমোদ আরও অদ্ভুত। কেবল মহিষ মেষ ছাগ কুষ্মাণ্ড ও আখ বলি নহে, তাহার পর আমোদ করিয়া গোধিকা, কপোত, মাগুরমাছ, লেবু, সুপারি এমনকি গোলমরিচ অবধি বলিদান হইত। বলিদান শেষ হইলেই শুরু হইত নৃত্য। সেই রক্তপ্লাবিত প্রাঙ্গণে মোষের মুণ্ড, আখ, লেবু, নারিকেল লইয়া কাড়াকাড়ি আর রক্তে গড়াগড়ি দেওয়া হইত।” গোলমরিচ বলিদান? ভাবা যায়!!
টমেটো কেচাপের অজানা কথা
সসের আগে কেচাপের উৎপত্তি। আর শুরুতে এর সঙ্গে টমেটোর দূরদূরান্তের কোনও সম্পর্ক ছিল না। একসময় কিন্তু টমেটোকে ভাবা হত বিষফল। খুব বেশি দিন আগে নয়, ২০০ বছর আগেও রান্নার বইতে টমেটো সসকে বলা হয়েছে ‘নোংরা, পচা আর দুর্গন্ধযুক্ত’ একটি তরল। আমেরিকাতে প্রথম টমেটো সস জনপ্রিয় হলেও বিষয়টির সূত্রপাত এশিয়ায়। চিনা নাবিকরা ‘কি-চুপ’ নামের একটি বিশেষ সস বানাতেন। সামুদ্রিক মাছের নাড়িভুঁড়ি ভালো করে পরিষ্কার করে নুন দিয়ে মাখিয়ে জারে ভরে রেখে দিতেন চিনারা। গরমে ২০ দিন, বর্ষায় ৫০ দিন আর শীতকালে ১০০ দিন জারে ভরে রাখলেই তৈরি হয়ে যেত সস। বিষয়টি প্রথম লক্ষ করেন ইংরেজরাই। এই পদ্ধতির আদলে দেশে ফিরে অনেক রকমের সস বানায় ইংরেজরা। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের মাছ আর মাশরুমের ওপরেই চলছিল সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কোনও কোনও ব্রিটিশ রাঁধুনি সসের উপকরণ হিসাবে টমেটো ব্যবহার করলেও তা জনপ্রিয় হয়নিও একটুও। প্রথম কেচাপের রেসিপি লেখেন এলিজা স্মিথ নামে এক ভদ্রমহিলা তাঁর ‘কমপ্লিট হাউসওয়াইফ’ বইতে। মজার ব্যাপার, সেই রেসিপিতে আরচিভো, স্যালো, ভিনিগার, সাদা মদ, আদা, নাটমেগ, গোলমরিচ, নুন, লেবুর খোসা সব থাকলেও টমেটোর কোনও উল্লেখ ছিল না। টমেটো কেচাপের রেসিপি প্রথম পাই ১৮০১ সালে স্যান্ডি অ্যাডিসন নামে এক মার্কিন শেফের রেসিপি বইতে।
১৮২০ সালে কর্নেল রবার্ট জনসন টমেটোর জন্য যা করলেন, তাতে চিরকাল তাঁর কাছে টমেটোর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। নিউজার্সিতে একটি আদালতকক্ষের সামনে প্রকাশ্যে এক ঝুড়ি টমেটো খেয়ে প্রমাণ করেন টমেটো বিষফল নয়। মাত্র দশ বছরের মধ্যেই আমেরিকাতে জনপ্রিয় হয় টমেটো। আসে অন্য বিপত্তি। অনেকেই টমেটোর ট্যাবলেট বানিয়ে ওষুধ হিসেবে বিক্রি করা শুরু করেন। তাঁদের দাবি ছিল এই ট্যাবলেট খেলে সেরে যাবে ডায়েরিয়া, বদহজম সহ আরও নানান অসুখ। কেউ কেউ আবার ‘টনিক’ হিসেবেও বেচতে শুরু করেন টমেটোর সস। এইভাবে নানা খানা-খন্দ পেরিয়ে বিংশ শতাব্দীতে জনপ্রিয় হয় টমেটো সস।
সেই সময় সস পাওয়া যেত শুধুই টমেটো ফলনের মরশুমে। বছরের বাকি সময় তা সরবরাহ করার জন্য নানান অস্বাস্থ্যকর দ্রব্য মেশানো হত টমেটো সসে। ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভস, ফরম্যালিন, বোরিক অ্যাসিড, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, বেঞ্জোয়িক অ্যাসিড মেশানোর জন্য টমেটো সস হয়ে উঠত বিষাক্ত। কেউ কেউ গাঢ় লাল করার জন্য কয়লার টার-ও মেশাতেন। তাই সারাবছর খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও টমেটো সস খাওয়ার যোগ্য ছিল শুধু শীতের মরশুমেই। ১৮৭০ সালে আসরে নামেন হেনরি হেইঞ্জ। কারখানার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য তাঁর সুনাম ছিল আমেরিকায়। তাঁর নজরে আসে সারাবছর টমেটো সস ব্যবহারে সীমাবদ্ধতার বিষয়টি। নিজের পরিচ্ছন্নতার ধারাবাহিকতা সামনে আনতেই টমেটো সসের বোতলকে স্বচ্ছ রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯০৪ সালে প্রিজারভেটিভস ছাড়াই টমেটো সস তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাঁর গবেষকেরা। বাকিটা ইতিহাস। হেইঞ্জের সাফল্যের পিছনে ছিল দারুণ এক বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইন। এর আগে সস তৈরি হত ঘরেই। বানাতেন মহিলারা। হেইঞ্জের টার্গেট গ্রুপ হন তাঁরাই। বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইনে লেখা ছিল, ‘Blessed relief for Mother and the other women in the household.’ ভালো বিজ্ঞাপন কী না করতে পারে! দু-বছরের মধ্যেই ৫০ লক্ষ বোতল বিক্রি করেন হেইঞ্জ। আরও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসে কেচাপ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কেচাপে ভিনিগার বা অ্যাসেটিক অ্যাসিড থাকলেও টমেটো সসে তা থাকে না। আবার টমেটো সসকে গরম করে রান্নায় ব্যবহার করা গেলেও কেচাপ ব্যবহার করা হয় ঠান্ডা অবস্থাতেই।
শেষে একটা তথ্য দিয়ে যাই, ব্রিটেনে সবচেয়ে জনপ্রিয় H.P. Sauce এখন প্রায় ওঁদের জাতীয় সস। বাদামি রঙের এই সসের আবিষ্কার ১৮৯৬ সালে ফ্রেডরিক গার্টন নামে নটিংহ্যামের এক মুদির হাতে। তিনি একবার কানাঘুষোয় শুনলেন এই সস নাকি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্যান্টিনেও সার্ভ হয়। আর যায় কোথায়? বোতলের উপরে হাউস অফ পার্লামেন্টের ছবি দিয়ে H.P. Sauce লিখে ব্রিটেনের জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দিয়ে লাখে লাখে সসের বোতল বিক্রি করে লাল হয়ে গেলেন।
লি আর পেরিনের সস
একেবারে অ্যাক্সিডেন্ট যাকে বলে, ঠিক সেইভাবে এই সসের আবিষ্কার। তাও বেশি দিন না, ১৮৩০ নাগাদ। উরচেস্টারশায়ারে লি অ্যান্ড পেরিনের এক দোকান ছিল। তাঁরা অন্য অনেক জিনিসের সঙ্গে নানারকম সসও বানাতেন। একবার হয়েছে কী, এক খদ্দের তাঁদের চুনো মাছ, সয়া সস আর ভিনিগার দিয়ে সেই রোমান গারুমের মতো এক সস বানানোর অর্ডার দিয়েছিলেন। অনেকে বলেন এই খদ্দের ছিলেন স্বয়ং বাংলার গভর্নর লর্ড মার্কাস স্যান্ডিস। তিনি বাংলার আচারের রেসিপি মেনে অর্ডার দিয়েছিলেন। তাঁরা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেননি। এক পিপে সেই সস বানিয়েছেন। স্যান্ডিস এসে বললেন, ‘এ কী যা-তা বানিয়েছ? নেব না।’ ব্যস! পিপে তাঁদের গুদামে বেশ কয়েক বছর রয়ে গেল। যখন তাঁদের চৈতন্য হল, ভাবলেন ফেলে দেবেন। ফেলে দেবার আগে একটু চেখে দেখলেন। ভাগ্যিস! দেখলেন গেঁজে গিয়ে সেই সসে দারুণ এক স্বাদ হয়েছে, যেমনটি আর কোনও সসে নেই। ১৮৩৮ সালে রীতিমতো বোতলে ভরে তাঁরা এই সস বিক্রি করতে লাগলেন। লেবেলে নাম দিলেন ‘Lee & Perrins Worcestershire Sauce’। লি আর পেরিনের ভাগ্য খুলে গেল শুধু এই সস বেচে। ১৮৫৫-তেই তাঁরা তিরিশ হাজার এই সসের বোতল বেচেন। ব্রিটেনে ততটা জনপ্রিয় না হলেও চিনা আর জাপানি রান্না উস্টার সস ছাড়া পানসে।