সর্বেশ্বরের কেরামতি – সুভদ্রকুমার সেন

সর্বেশ্বরের কেরামতি – সুভদ্রকুমার সেন

কিছুকাল হল কলকাতায় ও কলকাতার আশেপাশে ব্যাঙ্ক ডাকাতি প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেদিন প্রভাতী সংবাদপত্রের পাতায় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ‘সোনার বাংলা’ ব্যাঙ্কে ডাকাতির খবর পড়ে শহরবাসী সকলেই চমকে উঠেছিল। আজ পর্যন্ত এত বড় ডাকাতি এ-দেশে আর কোথাও হয়নি। চব্বিশ লক্ষ তিয়াত্তর হাজার পাঁচশো পঞ্চান্ন টাকা নিয়ে আর ব্যাঙ্কের দারোয়ানকে গুরুতররূপে আহত করে ডাকাতরা চম্পট দিয়েছে। এমনিতেই সংবাদপত্রের পাতায় পুলিশের ব্যর্থতার সমালোচনা বের হচ্ছিল। এই ঘটনার পর সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ্যে পুলিশের মুণ্ডপাত করতে লাগল। তাই ডাকাতির সংবাদের তলায় যদিও লেখা ছিল যে, ওই ডাকাতি সম্বন্ধে মূল্যবান সূত্র পুলিশের হাতে এসেছে এবং পুলিশ এ সম্পর্কে জোর তদন্ত চালাচ্ছে— সবাই তা একদম বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিল। কিন্তু যেদিন ডাকাতির খবর পড়ে শহরবাসী চমকে উঠেছিল তখন কেউ কি অনুমান করতে পেরেছিল যে, আরও বড় চমক তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে?

ঠিক ন’দিনের দিন সেই চাঞ্চল্যকারী খবরটি সব সংবাদপত্রে বড় বড় হরফে ছাপা হল: আন্দামানগামী এস এস হর্ষবর্ধন জাহাজে ‘সোনার বাংলা’ ব্যাঙ্কের ডাকাতির নায়ক অনুপ সিংহ ধরা পড়েছে। তার পরের ঘটনা তো সবাই জানে। পুলিশের কাছে অনুপ সিংহ সব কথা স্বীকার করে এবং তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ দলের বাকি সবাইকে ধরে এবং সব টাকাটা না হলেও বেশ মোটা টাকা উদ্ধার করে। তবে যে কথাটা অনেকেই জানে না সেটা হল অনুপ ধরা পড়ল কী করে। পুলিশের হাতে অনুপের ধরা পড়ার খাঁটি খবর জানতে হলে আমাদের পরিচিত হতে হবে এই চমকপ্রদ কাহিনির নেপথ্য-নায়ক সর্বেশ্বর দাসের সঙ্গে। কেননা অনুপকে ধরার সবটুকু কেরামতি সর্বেশ্বরের।

সর্বেশ্বর খুব দমে আছে। এখন তার ধ্রুব বিশ্বাস হয়েছে যে, ‘ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র’। পুরুষকার—অন্তত তার তিরিশ বছরের যেটুকু অভিজ্ঞতা—নেহাতই ছেলেভুলানো কথা। তা না হলে ডিসটিংশন নিয়ে বিএসসি পাশ করে তাকে কিনা আজ এই অনাথ দেব লেনের গলিতে চণ্ডীমাতা হেয়ার কাটিং অ্যান্ড হেয়ার ড্রেসিং সেলুনের একমাত্র কাটার-কাম-মালিক হয়ে তারপর কবে-কখন-একটা-খদ্দের-আসবে এই প্রত্যাশায় বসে থাকতে হয়? জীবনে তো সে অসাধারণ বা অসামান্য কিছু হতে চায়নি। আজকাল যে কী হয়েছে তার, ভাবনার কেমন যেন খেই হারিয়ে যায়। সর্বেশ্বর একটু গুছিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে।

একটি ইভনিং কলেজ থেকে সর্বেশ্বর যখন ডিসটিংশন নিয়ে বিএসসি পাশ করলে তখন তার বাবা পরমেশ্বর জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, কী করবি এখন?” সর্বেশ্বর তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। ভবিষ্যৎ জীবনের নানারকম রঙিন ছবি তার চোখের সামনে ভাসছে। সে বললে, “আমি পড়ব।” পরমেশ্বর জাতে এবং পেশায় পরামানিক, সুযোগের অভাবে লেখাপড়া করতে পারেননি। তাই ছেলে যখন বললে ‘পড়ব’ খুব খুশি হলেন তিনি। কিন্তু সর্বেশ্বরের আত্মবিশ্বাসে প্রথম আঘাত লাগল যখন সে কলেজের কেমিস্ট্রি অধ্যাপক নরেশবাবুর কাছে শুনলে যে, অনার্স না থাকলে এমএসসি-তে ভরতি হওয়া যায় না। কেমিস্ট্রিতে এমএসসি করে তার কেমিস্ট হবার বাসনার কথা শুনে নরেশবাবু বললেন, “এক কাজ করো। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাও আর ছোটখাটো কোনও কেমিক্যাল কোম্পানিতে অ্যাপ্রেন্টিস বা ওই ধরনের কাজ জোগাড়ের চেষ্টা দেখো। ভাল করে বিষয়টা শিখে নিলে ডিগ্রি না থাকলেও তোমার কেমিস্ট হবার পথে কোনও বাধা হবে না। দরকার হলে আমার কাছে এসো। যতদূর পারি তোমাকে সাহায্য করব।’’—সর্বেশ্বরের এইসব ঘটনা সেদিনের কথা বলে মনে হয়। বস্তুত তা তো নয়, এসব প্রায় আট-দশ বছর আগেকার কথা।

নরেশবাবুর কথা শুনে সর্বেশ্বর খুব উৎসাহের সঙ্গে পড়াশোনার এবং কেমিক্যাল কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে কোনও চাকরি বা অ্যাপ্রেন্টিসগিরি যখন জোটাতে পারল না তখন তার বাবা বললেন, “ওরে, সকালের দিকে আমার সঙ্গে দোকানে বোস। একটু একটু করে জাত-ব্যাবসাটা শেখ। আখেরে ভালই হবে।” সর্বেশ্বর বাধ্য ছেলে, বাবার কথায় রাজি হয়ে গেল। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। সর্বেশ্বরের জীবনেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তার পিতৃবিয়োগ হয়েছে এবং সেলুনটাই তার জীবিকা হয়ে গেছে। বাবার আমলেই সর্বেশ্বর তাদের সেলুনে চুলে কলপ লাগানো ব্যবস্থা শুরু করে। এই একটা ব্যাপারে সে বরাবরই খুব উৎসাহ বোধ করত। বাজারে যেসব চুলের কলপ পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার না করে সে তার নিজের রসায়নজ্ঞানের সাহায্যে নিজেই কলপ প্রস্তুত করত। আর তার করা এই কলপ যে একবার ব্যবহার করত সে কিন্তু আবার তার দোকানেই আসত। ফলে তার বেশিরভাগই বাঁধা খদ্দের।—এই হল সর্বেশ্বরের পরিচয়। এখন আমরা আবার বর্তমানে ফিরে আসি।

সেদিন সর্বেশ্বর দোকানে বসে বহুবার পড়া বাসি ‘আনন্দ সংবাদ’ কাগজখানা আবার খুঁটিয়ে পড়ছিল। আর ভাবছিল পুলিশের বিজ্ঞপ্তির কথা। রবিবারের ‘আনন্দ সংবাদ’ পত্রিকায় কলকাতা পুলিশ কর্তৃপক্ষ এই মর্মে একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল।

দশ হাজার টাকা পুরস্কার

যদি কেহ নিম্নে প্রদত্ত বিবরণের কোনও ব্যক্তির সম্পর্কে কোনও সংবাদ দিতে পারেন তবে তিনি যেন সত্বর সর্বনিকটস্থ পুলিশ থানায় যোগাযোগ করেন। সংবাদ সঠিক হলে এবং ওই সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলে সংবাদদাতা দশ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার পাবেন। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির দৈহিক বিবরণ— ফর্সা রং, মাঝারি উচ্চতা, স্বাস্থ্যবান। শেষ যখন তাকে দেখা যায় তখন পরনে হাওয়াই শার্ট ও প্যান্ট ছিল। এখন অবশ্য অন্য পোশাক থাকাই সম্ভব। মাথার চুল লাল। তবে চুলের রং চাপা দেবার জন্যে যে-কোনও ধরনের টুপি ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ চিহ্ন বাঁ হাতের মধ্যমা অন্যান্য আঙুলের তুলনায় ছোট।

ওই দিনের পত্রিকায় আর একটা খবর ছিল। সেই ব্যাঙ্কের দারোয়ানটি মারা গেছে। তবে মৃত্যুর আগে সে পুলিশের কাছে বলে গেছে যে, যখন তার সঙ্গে একজন ডাকাতের ধস্তাধস্তি হচ্ছিল তখন সে দেখতে পেয়েছিল যে, তার বাঁ হাতের মাঝের আঙুলটা ছোট আর তার মাথার চুল অস্বাভাবিক রকমের লাল।

সর্বেশ্বর ভাবছিল কে সেই ভাগ্যবান যে পুলিশকে ওই ব্যক্তির সঠিক সন্ধান দিয়ে ওই দশ হাজার টাকা পাবে আর টাকাটা দিয়েই বা সে কী করবে? এইসব ভাবতে ভাবতে তার মনে হল, আচ্ছা, এখন যদি সে দশ হাজার টাকা পায় তবে সে কী করবে? এই দোকানটাই বড় করবে না আবার কেমিস্ট হবার চেষ্টা করবে? কী যে করবে সর্বেশ্বর ভেবে ঠিক করতে পারল না।

এর দু’-একদিন পর। সন্ধে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। সর্বেশ্বর সেলুন বন্ধ করবে করবে ভাবছে এমন সময় একজন মাঝবয়সি লোক এল। লোকটির বেশবাস বেশ পরিষ্কার আর যাকে বলে—‘মড’। সর্বেশ্বর জিজ্ঞেস করল, “আজ্ঞে চুল না দাড়ি?” সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, “চুল।”

সর্বেশ্বর একটা চেয়ার টেনে তাকে বসতে দিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল যে, তার শরীরের মধ্যে যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল। সেই লোকটি চেয়ারে বসে মাথা থেকে একটা কালো সিল্কের টুপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল মাথা-ভরতি বড় বড় লাল চুল।

“হ্যাঁ হে, তোমার এখানে হেয়ার ডাইংয়ের ব্যবস্থা আছে?”

যদিও মনকে জোর করে বোঝাতে লাগল যে, ভারতবর্ষে লালচুলো লোকের অভাব নেই এবং লালচুলো লোক হলেই যে ব্যাঙ্ক-ডাকাত হবে তার কোনও মানে নেই, তবুও উত্তেজনায়, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে অনেক চেষ্টা করে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, “হ্যাঁ।”

“বেশ।”

তারপর খানিকটা গায়ে পড়েই লোকটি তাকে বলতে লাগল, “কী মুশকিল দেখো না, আমার এত সুন্দর লাল চুল আবার আমার স্ত্রীর পছন্দ নয়। আজ আমাদের বিয়ের তারিখ, সে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে যে, আজ কলপ দিয়ে চুল কালো করে তবে যেন বাড়ি ঢুকি। নইলে সে কুরুক্ষেত্র করবে। কী হে, পারবে নাকি বেশ কালো করে দিতে?”।

সর্বেশ্বর উত্তর দিল, “নিশ্চয়ই। কুচকুচে কালো করে দেব।” কিন্তু তার মনে যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল সেটা ঘনীভূত হল। এটা কার্তিক মাস। এ মাসে তো সাধারণভাবে বিয়ে হয় না। আর তখনই তার মনে হল যে, বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে সেই লোকটার বাঁ হাতের মধ্যমাটা ছোট। যখন লোকটি এসেছিল তখন সর্বেশ্বর তো ওর হাতের দিকে নজর দেয়নি। আর এখন তো লোকটি হাত দুটোকে চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে। কী উপায়ে ওর বাঁ হাতের আঙুলগুলো দেখা যাবে? মনে মনে যখন এইসব ভাবছে তখন সে দেখলে যে, আয়নার মধ্যে দিয়ে লোকটি তাকে স্থির দৃষ্টিতে লক্ষ করছে। ওর চোখ দুটো দেখেই ভয়ে সর্বেশ্বরের বুক হিম হয়ে গেল। আর একটু হলেই হাত থেকে কাঁচিটা পড়ে যেত। কোনওরকমে সে নিজেকে সামলে নিলে বটে কিন্তু তার বুকের ধকধকানি দ্বিগুণ বেড়ে গেল, কান-মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল, হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা জেদও তাকে পেয়ে বসল। যেমন করেই হোক লোকটির বাঁ হাতের আঙুলগুলো তাকে দেখতেই হবে। কিন্তু কী করে? ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ইচ্ছে করে খানিকটা কাটা চুল লোকটির বাঁ কানে লাগিয়ে রেখে জল আনবার ছুতো করে ঘরের উলটোদিকের দেয়ালে টাঙানো আয়নার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সর্বেশ্বর দেখল যে, লোকটি টপ করে বাঁ হাত বের করে চুলগুলো ঝেড়ে ফেলে দিল। লোকটির বাঁ হাতের মধ্যমটা ছোট। সর্বেশ্বর বুঝতে পারল না যে তার ঠিক কী করা উচিত। সেলুনে এ-সময়ে যদি আরও একটা খদ্দের থাকত তা হলে নয় দু’জনে মিলে ধরে ফেলা যেত। একবার সে ভাবলে বাইরে গিয়ে কাউকে ডেকে আনে। কিন্তু তাতে যদি লোকটি কিছু সন্দেহ করে। কে বলতে পারে ওর কাছে ছোরা কি রিভলভার নেই? এই কার্তিক মাসের সন্ধেবেলায় ভয়ে আর উত্তেজনায় সর্বেশ্বর ঘেমে একেবারে জবজবে হয়ে গেল। হঠাৎ তার নজর পড়ল কলপ করার রাসায়নিক দ্রব্যের শিশিগুলোর ওপরে। মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে নিল। আর আশ্চর্য ব্যাপার, সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ায় তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল।

লোকটি চুল ছেঁটে ডাই করে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতেই সর্বেশ্বর দোকানে তালা লাগিয়ে ছুটল বটতলা থানায়। বটতলা থানার ওসি তো তার কথা শুনে প্রথমে হতভম্ব এবং পরে হাসির প্রবল বেগে ভেঙে পড়লেন। তারপর বটতলা থেকে লালবাজারে খবর গেল। লালবাজার তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না। যাই হোক, শেষে লালবাজার থেকে ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং কাছাকাছি অন্য দেশে খবর পৌঁছে গেল। দিন তিনেক পরে আন্দামানগামী জাহাজ এস এস হর্ষবর্ধনের ক্যাপ্টেনের খবর পেয়ে পুলিশ তেরো নম্বর কেবিন থেকে অনুপকে ধরল। অনুপের চুল আর ভুরু সর্বেশ্বর এমন কায়দায় ডাই করে দিয়েছিল যে কয়েক ঘণ্টা পরে সব গাঢ় সবুজ রঙের হয়ে গিয়েছিল।

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮২

অলংকরণ: দেবাশিস দেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *