সর্বাপেক্ষা সঙ্কটময় শিকার

সর্বাপেক্ষা সঙ্কটময় শিকার

উইটনি বলল, ডান দিকে ঠিক কোথায় জানিনে বেশ বড় একটা দ্বীপ রয়েছে। সে একটা রহস্য

রেনসফর্ড শুধাল, নাম কী দ্বীপটার?

পুরনো দিনের ম্যাপে নাম রয়েছে জাহাজ-ফাঁদ দ্বীপ। নামটার থেকেই অর্থ কিছুটা আমেজ করা যায়, নয় কি? মাঝি-মাল্লাদের ভিতর দ্বীপটার প্রতি কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভয়। কী জানি কেন। কিছু একটা কুসংস্কার বোধহয়

ইয়ট জাতের ছোট্ট জাহাজধানির চতুর্দিকে গরম দেশের গাঢ়, ভেজা ভেজা অন্ধকার যেন চেপে ধরেছে। তারই ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চালাবার নিষ্ফল চেষ্টা করে রেসফ বলল, ওটাকে দেখতে পাচ্ছিনে তো।

উইটনি হেসে বলল, তোমার দৃষ্টিশক্তি খুবই প্রখর সে আমি জানি। চারশো গজ দূর থেকে মূস-মোষের মতো শিকারকে ঝোঁপের ভিতর দেখে ফেলতে আমি তোমাকে দেখেছি কিন্তু ক্যারেবিয়ান সমুদ্রের অন্ধকার রাত্রে চার-পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত দেখা তোমারও কর্ম নয়।

রেনসফর্ড সম্মতি জানিয়ে বললে, চার গজও না। আখ–অন্ধকারটা যেন কালো মখমল।

উইটনি যেন আশ্বাস দিয়ে বলল, রিয়ো পৌঁছলে বিস্তর আলোর মেলা পাবে, ভয় কী! কয়েকদিনের ভিতরেই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছি। জাগুয়ার শিকারের বন্দুকগুলো পর্দোর কাছ থেকে পৌঁছে গেলেই হয়। আমাজন অঞ্চলে উত্তম শিকার পাব বলে আশা করছি। শিকারের মতো আর কোনও খেলই হয় না।

পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা খেল। সম্মতি জানালে রেনসফর্ড।

কিঞ্চিৎ সংশোধন করে উইটনি বলল, শিকারির পক্ষে জাগুয়ারের পক্ষে নয়।

আবোল-তাবোল বকো না, উইটনি। তুমি বড় বড় জানোয়ারের শিকারি–তুমি দার্শনিক নও। জাগুয়ার কী অনুভব করে, না করে তাতে কার কী যায়-আসে?

হয়তো জাওয়ারের যায়-আসে।

ছেঃ! তারা আবার ভাবতে পারে নাকি?

তা সে যাই হোক, আমার কিন্তু মনে হয়, তারা অন্তত একটা জিনিস বোঝে–ভয়। যন্ত্রণার ভয় আর মৃত্যুভয়।

গাঁজা!– হেসে উঠল রেনসফর্ড। গরমে তোমার মগজ গলে যাচ্ছে–বুঝলে উইটনি? বাস্তববাদী হতে শেখ। পৃথিবীতে দুটি শ্রেণি আছে। শিকারি আর শিকার। কপাল ভালো যে তুমি-আমি শিকারি। আচ্ছা, আমরা কি ওই দ্বীপটা পেরিয়ে এসেছি।

অন্ধকারে বলতে পারব না। আশা তো করছি তা-ই।

 কেন?

জায়গাটার নাম আছে- বদনাম।

 নরখাদক আছে ওখানে?

তার সম্ভাবনা অল্পই। এমন লক্ষ্মীছাড়া জায়গাতে ওরাও থাকতে যাবে না। কিন্তু বদনামটা খালাসি-মাঝিদের মধ্যে যে করেই হোক রটে গেছে। লক্ষ করনি আজ ওরা কীরকম যেন এক অজানা আতঙ্কে সন্ত্রস্ত ছিল?

তোমার বলাতে এখন মনে হচ্ছে, কেমন যেন তাদের ধরনধারণ আজ অন্য রকমের ছিল। কাপ্তান নিলসেন পর্যন্ত

হ্যাঁ, এমনকি ওই যে তাগড়া কলিজার বুড়ো সুইড় নিলসেন–খুদ শয়তানের কাছে গিয়ে যে নির্ভয়ে দেশলাইটি চাইতে পারে, মাছের মতো অসাড় তার নীল চোখেও আজ এমন ভাবের পরিবর্তন লক্ষ করলুম, যেটা পূর্বে কখনও দেখিনি। যেটুকু বলল তার মোদ্দা, খালাসি-লস্করদের ভিতর এ জায়গাটার ভারি দুর্নাম। তার পর অত্যন্ত গম্ভীরভাবে আমাকে শুধোল, কেন, আপনি কিছু টের পাচ্ছেন না? যেন আমাদের চতুর্দিকের আকাশ-বাতাস বিষে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। দেখ, ওই নিয়ে কিন্তু হেসে উঠ না, যদি বলি আমারও সর্বাঙ্গ যেন হঠাৎ হিম হয়ে গেল। ওই সময়ে কোনও বাতাস বইছিল না। ফলে সমুদ্র জানালার শার্শির মতো পালিশ দেখাচ্ছিল। আমরা তখন ওই দ্বীপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। আমার মনে হচ্ছিল আমার বুকটা যেন শীতে জমে হিম হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ যেন এক অজানা ত্রাসে।

রেনসফর্ড বলল, নির্ভেজাল আকাশ-কুসুম! একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নাবিক সমস্ত জাহাজের নাবিকদের মাঝে ভয় ছড়িয়ে দিতে পারে।

তাই হয়তো হবে। কিন্তু জান, আমার মনে হয়, নাবিকদের যেন একটা আলাদা ইন্দ্রিয় আছে, যেটা বিপদ ঘনিয়ে এলে তাদের জানিয়ে দেয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অমঙ্গল। যেন একটা বাস্তব পদার্থ ধ্বনি বা আলোর থেকে যেরকম তরঙ্গ বেরোয়, অমঙ্গলের শরীর থেকেও ঠিক তেমনি। সে ভাষায় বলতে গেলে বলব, অমঙ্গলের পাপভূমি যেন বেতারে অমঙ্গল ছড়ায়। তা সে যা-ই হোক, এ এলাকাটা ছাড়িয়ে যেতে পারছি বলে আমি খুশি। যাক গে, আমি এখন শুতে চললুম, রেনসফর্ড।

রেনসফর্ড বলল, আমার এখনও ঘুম পায়নি। পিছনের ডেকে বসে আমি আরেকটা পাইপ টেনে নিই।

তা হলে গুডনাইট, রেনসফর্ড। কাল ব্রেকফাস্টে দেখা হবে।

 ঠিক আছে! গুডনাইট, উইটনি।

রাত্রি নিস্তব্ধ নীরব। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে যে ইঞ্জিন ইয়টটিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল শুধু তারই চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছিল আর তার সঙ্গে প্রপেলারের মার খেয়ে জলের শব্দ।

ডেক্ চেয়ারে হেলান দিয়ে অলসভাবে রেনসফর্ড তার শখের ব্রায়ার পাইপে টান দিচ্ছিল। রাত্রি যেন ঘুমের ঢুলুঢুলু ভাব তার শরীরে আবেশ লাগাচ্ছিল। আপন মনে চিন্তা করল, রাতটা এমনই অন্ধকার যে মনে হয় চোখের পাতা বন্ধ না করেই ঘুমুতে পারব; রাতটিই হবে আমার চোখের পাতা

হঠাৎ একটা আওয়াজ এসে তাকে চমকে দিল। ডানদিক থেকে শব্দটা এসেছিল। এসব ব্যাপারে সে সজাগ, সবকিছু ঠিক ঠিক জানে। তার কান ভুল করতে পারে না। আবার সে সেই শব্দটা শুনতে পেল, তার পর আবার। ওই দূরের অন্ধকারে কে যেন তিনবার গুলি ছুঁড়েছে।

কী রহস্য বুঝতে না পেরে রেনসফর্ড লাফ দিয়ে উঠে ঝটিতি রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। যেদিক থেকে শব্দটা এসেছে সেইদিকে যেন চোখ ঠেলে দিল; কিন্তু এ যেন কম্বলের ভিতর দিয়ে দেখবার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। আরেকটু উঁচু থেকে দেখার জন্য সে রেলিঙের একটা রডে লাফ দিয়ে উঠে তার উপর দাঁড়াল। তারই ফলে একটা দড়িতে লেগে তার পাইপটা মুখ থেকে ঠিকরে পড়ে যেতে সেটাকে ধরবার জন্য সে ঝটিতি সামনের দিকে ঝুঁকতেই তার গলা থেকে কর্কশ আর্তনাদ বেরুল- কারণ সে তখন বুঝে গিয়েছে যে বড্ড বেশি এগিয়ে যাওয়ার ফলে সে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছে। তার সে আর্তনাদ টুটি চেপে ধরে বন্ধ করে দিল ক্যারেবিয়ান সমুদ্রের কুসুম কুসুম গরম জল। তার মাথা পর্যন্ত তখন সে জলে ডুবে গিয়েছে।

যেন ধস্তাধস্তি করে সে জলের উপরে উঠে চিৎকার দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু ইয়টের দ্রুতগতির মারে ছুটে আসা জল যেন কষাল তার গালে চড় আর নোনা জল তার খোলা মুখের ভিতরে ঢুকে যেন তার টুটি চেপে ধরে বন্ধ করে দিল। দুবাহু বাড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে সে মরিয়া হয়ে ক্রমশ অদৃশ্যমান ইয়টের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল, কিন্তু পঞ্চাশ ফুট চলার পূর্বেই সে আর সে-চেষ্টা দিল না। ততক্ষণে তার মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে; জীবনে এই তার সর্বপ্রথম কঠিন সঙ্কট নয়। জাহাজের কেউ তার চিৎকার শুনতে পাবে সে সম্ভাবনা অবশ্য একটুখানি ছিল, কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং ইয়ট যতই দ্রুতগতিতে এগুতে লাগল সে সম্ভাবনা ততই ক্ষীণতর হতে লাগল। যেন পালোয়ানের মতো শক্তি প্রয়োগ করে সে নিজেকে তার জামাকাপড় থেকে মুক্ত করে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু ইয়টের আলো ক্ষীণতর হতে লাগল, যেন দূরের ক্রমশ অদৃশ্যমান জোনাকি পোকা। সর্বশেষে ইয়টের আলোকগুলোকে অন্ধকার যেন শুষে নিল।

ইয়টের ডেকে বসে রেনসফর্ড যে গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল সেগুলো তার স্মরণে এল। সেগুলো এসেছিল ডানদিক থেকে। চরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে সেদিকে সাঁতার কাটতে লাগল ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি বাঁচিয়ে সে ভেবেচিন্তে হাত দুখানা ব্যবহার করছিল। ক-বার সে হাত ছুড়ছে সেটা সে শুনতে আরম্ভ করল; সম্ভবত সে আরও শ-খানেক বার হাত ফেলতে-টানতে পারবে, এমন সময়

রেনসফর্ড একটা শব্দ শুনতে পেল। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে উচ্চকণ্ঠে পরিত্রাহি চিৎকারের শব্দ। কঠোরতম যন্ত্রণা ও ভীতির চিৎকার।

কোন প্রাণী এ আরব ছাড়ল সে সেটাকে চিনতে পারল না চেষ্টাও করল না। নবোদ্যমে সেই চিৎকারের দিকে সাঁতার কেটে এগুতে লাগল। সেটা সে আবার শুনতে পেল। এবারে সেটা অন্য একটা ছোট্ট, হঠাৎ বেজে-ওঠা শব্দে অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

সাঁতার কাটতে কাটতে মৃদুকণ্ঠে রেনসফর্ড বলল, পিস্তলের শব্দ।

আরও দশ মিনিট অধ্যবসায়ের সঙ্গে সাঁতার কাটার পর রেনসফর্ডের কানে আরেকটা ধ্বনি এল–জীবনে সে এরকম মধুর ধ্বনি আর কখনও শোনেনি– পাহাড়ি বেলাভূমির উপর ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার মূৰ্ছনা এবং গুমরানো। পাড়ের পাথরগুলো দেখার পূর্বেই প্রায় সে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে; রাত্রি অতখানি শান্ত না হলে ঢেউগুলো তাকে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে দিত। অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে সে কোনও গতিকে ঢেউয়ের দ থেকে নিজেকে টেনে তুলল। এবড়ো-খেবড়ো পাথরের পাড় বেরিয়ে এসেছে নিরেট অন্ধকার থেকে! দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে সে উপরের দিকে চড়তে আরম্ভ করল। হাত তার ছড়ে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে উপরের সমভূমিতে এসে পৌঁছল। গভীর জঙ্গল সেই পাথুরে পাড়ের শেষ সীমা অবধি পৌঁছেছে। এই জঙ্গল আর ঝোঁপঝাড়ের ভিতর তার জন্য অন্য কোনও বিপদ আছে কি না, সে চিন্তা রেনসফর্ডের মনে অন্তত তখন উদয় হল না। তার মনে তখন শুধু ওইটুকু যে, সে তার শত্রু সমুদ্রের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে আর তার সর্বাঙ্গে অসীম ক্লান্তি। জঙ্গলের প্রান্তে সে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে তার জীবনের গভীরতম ন্দ্রিায় ডুবে গেল।

যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরাহু শেষ হয় হয়। নিদ্রা তাকে নবীন জীবনরস দিয়েছে আর তীক্ষ্ণ ক্ষুধায় পেট কামড়াতে আরম্ভ করেছে। প্রায় আনন্দের সঙ্গেই সে চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখল।

রেনসফর্ড চিন্তা করল, যেখানে পিস্তলের শব্দ হয় সেখানে মানুষ আছে। আর যেখানে মানুষ আছে সেখানে খাদ্যও আছে। কিন্তু প্রশ্ন, কীরকমের মানুষ এরকম ভীষণ জায়গায় থাকে–এ চিন্তাও তার মনে উদয় হল। কারণ চোখের সামনেই একটানা আঁকাবাকা শাখা, এবড়ো-খেবড়ো জড়ানো গুল্মলতা এক্কেবারে পাড় পর্যন্ত।

ঠাসবুনোটের লতাপাতা আর গাছের ভিতর দিয়ে সে সামান্যতম পায়ে চলার চিহ্ন বা পথও দেখতে পেল না। তারচেয়ে একেবারে পাড়ের উপর দিয়ে সমুদ্রের কাছে কাছে এগিয়ে যাওয়াই সহজ। হোঁচট খেয়ে খেয়ে সে এগুতে লাগল। যেখানে সে প্রথম পাড়ে নেমেছিল তার অদূরেই সে দাঁড়াল।

নিচের ঝোপে কোনও আহত প্রাণী চিহ্ন থেকে মনে হল বড় আকারেরই– আছাড়ি-বিছাড়ি খেয়েছে। জঙ্গলের লতাপাতা ছিঁড়ে গিয়েছে আর শ্যাওলা থেতলে গিয়েছে। একটা জায়গা রক্তরাঙা। একটু দূরেই কী একটা চকচকে জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তুলে দেখল কার্তুজের খোল।

রেনসফর্ড আপন মনে বলল, বাইশ নম্বরের। কীরকম অদ্ভুত ঠেকছে। আর ওই শিকারটা বেশ বড় ছিল বলেই তো মনে হচ্ছে। খুবই ঠাণ্ডা মাথার শিকারি ছিল বলতে হবে যে তার সঙ্গে ওই ছোট্ট হাতিয়ার নিয়ে মোকাবেলা করল। আর এটাও তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে জন্তুটা বেশ লড়াইও দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, প্রথম যে তিনটে শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম তখন শিকারি তাকে দেখতে পেয়ে তিনটে গুলি ছুঁড়ে তাকে জখম করেছিল। তার পর তার পালিয়ে যাবার চিহ্ন ধরে ধরে এখানে এসে তাকে খতম করেছে। শেষ আওয়াজ যেটা শুনতে পেয়েছিলুম সেটা সে-ই।

রেনসফর্ড জমিটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করে যা দেখতে পাবার আশা করেছিল তাই পেল শিকারির জুতোর চিহ্ন। সে যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল জুতোর চিহ্ন সেই দিকেই গিয়েছে। উদগ্রীব প্রতীক্ষায় সে এগিয়ে চলল। কখনও-বা পচা গাছের গুঁড়ি বা আধখসা পাথরে সে পিছলে যাচ্ছিল, কিন্তু অগ্রসর হচ্ছিল ঠিকই। দ্বীপের উপর তখন রাত্রির অন্ধকার আস্তে আস্তে নেমে আসছে।

রেনসফর্ড যখন প্রথম আলোকগুলো দেখতে পেল তখন ঠাণ্ডা অন্ধকার সমুদ্র আর জঙ্গলটাকে কালোয় কালোময় করে দিচ্ছিল। বেলাভূমির একটা বেঁকে-যাওয়া জায়গায় মোড় নিতে সে সেগুলো দেখতে পেল এবং প্রথমটায় তার মনে হয়েছিল, সে কোনও গ্রামের কাছে এসেছে– কারণ আলো দেখতে পেয়েছিল অনেকগুলো। কিন্তু ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখে বিস্মিত হল যে সবকটা আলো আসছে একই বিরাট বাড়ি থেকে প্রকাণ্ড উঁচু বাড়ি, তার চুল মিনারের মতো টাওয়ার উপরের অন্ধকারের দিকে ঠেলে ধরেছে। বিরাট দুর্গের মতো রাজপ্রাসাদের (শাটো) আকার প্রচ্ছায়া তার চোখে ধরা পড়ল এবং দেখল শাটোটি একটি উঁচু জায়গার উপর নির্মিত। তার তিন দিকে খাড়া পাহাড়ের পাঁচিল সমুদ্র পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। সেখানে কালো ছায়াতে ক্ষুধার্ত সমুদ্র যেন। দেওয়ালগুলো ঠোঁট দিয়ে চাটছে।

মরীচিকাই হবে– ভাবল রেনসফর্ড। কিন্তু যখন সে বাড়িটার ফলকওলা গেটটা খুলল তখন বুঝল যে মোটেই মরীচিকা নয়। পাথরের সিঁড়িগুলোও যথেষ্ট বাস্তব; পুরু ভারী পাল্লার দরজাও যথেষ্ট বাস্তবতার গায়ে রয়েছে দৈত্যমুখাকৃতি কড়া–কিন্তু তবু কেমন যেন সমস্ত জায়গাটার চতুর্দিকে অবাস্তবতার বাতাবরণ।

দরজার কড়া উপরের দিকে তুলে ঘা মারতে গেলে সেটা চড়চড় করল; রেনসফর্ডের মনে হল ওটা যেন কখনও ব্যবহার করা হয়নি। কড়াটা ছেড়ে দিতেই সেটা এমনই সুগুরুগম্ভীর নিনাদ ছাড়ল যে, রেনসফর্ড নিজেই চমকে উঠল। তার মনে হল ভিতরে যেন কার পায়ের শব্দ শুনতে পেল দরজা কিন্তু খুলল না। সে তখন আবার কড়া তুলে ছেড়ে দিল। তখন এমনই হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল যে তার মনে হল যে দরজাটা যেন স্প্রিং দিয়ে তৈরি। ঘরের ভিতর থেকে সোনালি অত্যুজ্জ্বল আলোর বন্যাধারা তার চোখ যেন ধাধিয়ে দিল। তার ভিতর দিয়ে রেনসফর্ড সর্বপ্রথম যা দেখতে পেল সেটা তার জীবনে এ পর্যন্ত দেখার মধ্যে সর্ববৃহৎ মনুষ্য কলেবর বিরাট দৈত্যের মতো আকার-প্রকার, নিরেট দড় মালে তৈরি, আর কোমর অবধি নেমে এসেছে কালো দাড়ি। তার হাতে লম্বা নলওলা রিভলভার আর সেটা সে নিশানা করেছে সোজা রেনসফর্ডের বুকের দিকে।

সেই দাড়ির জঙ্গলের ভিতর থেকে দুটি ছোট্ট চোখ রেনসফর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

ভয় পেয়ো না বলে রেনসফর্ড স্মিত হাস্য করল; তার মনে আশা ছিল যে ওই স্মিতহাস্য লোকটার মনের সন্দেহ দূর করে দেব। আমি ডাকাত নই। একটা ইয়ট থেকে সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলুম, আমার নাম সেঙ্গার রেনসফর্ড-নিউ ইয়র্কের।

কিন্তু লোকটার ভীতি-উৎপাদক দৃষ্টির কোনও পরিবর্তন হল না। রিভলভারটা নড়নচড়ন না করে ঠিক তেমনি তার বুকের দিকে নিশান করে রইল, যেন দৈত্যটা পাথরে তৈরি। রেনসফর্ডের কথাগুলো যে সে বুঝতে পেরেছে তারও কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। এমনকি সে আদপেই শুনতে পেয়েছে কি না তা-ই বোঝা গেল না। লোকটার পরনে কালো উর্দি তার শেষ প্রান্তে বাদামি রঙের আস্ত্রাখান লোমের ঝালর।

রেনসফর্ড আবার শুরু করল, আমি নিউ ইয়র্কের সেঙ্গার রেনসফর্ড। আমি একটা ইয়ট থেকে পড়ে গিয়েছিলুম। আমার ক্ষিধে পেয়েছে।

লোকটা উত্তরে শুধু বুড়ো আঙুল দিয়ে রিভলভারের ঘোড়াটা তুলল। তার পর রেনসফর্ড দেখল যে, লোকটার খালি হাতখানা মিলিটারি সেলাম দেবার কায়দায় কপাল ছুঁল, এক জুতো দিয়ে অন্য জুতো ক্লিক করে এটেনশনে দাঁড়াল। আরেকজন লোক চওড়া মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন। ইভনিং ড্রেস পরা একদম খাড়া, পাতলা ধরনের লোক।

বিখ্যাত শিকারি সেঙ্গার রেনসফর্ডকে আমার বাড়িতে শুভাগমন জানাতে পেরে আমি আনন্দ ও গর্ব অনুভব করছি। চোস্ত খানদানি গলায় লোকটি কথাগুলো বললেন। তাতে বিদেশি উচ্চারণের সামান্য আমেজ ছিল বলে কথাগুলো যেন আরও সুস্পষ্ট, সুচিন্তিত বলে মনে হল।

আপনা-আপনি যেন রেনসফর্ড তাঁর সঙ্গে করমর্দন করল।

লোকটি বুঝিয়ে বললেন, তিব্বতে বরফের চিতেবাঘ শিকার সম্বন্ধে আমি আপনার বই পড়েছি, বুঝলেন তো। আমার নাম জেনারেল জারফ।

রেনসফর্ডের প্রথম ধারণাই হল যে, লোকটি অসাধারণ সুপুরুষ। দ্বিতীয় হল যে জেনারেলের চেহারায় যেন এক অপূর্ব অনন্যতা, প্রায় বলা যেতে পারে বিচিত্র ধরন রয়েছে। লোকটি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছেন, কারণ তার চুল ধবধবে সাদা কিন্তু তার ঘন জ্ঞ, আর মিলিটারি কায়দায় উপরের দিকে তোলা ছুঁচল গোঁফ মিশমিশে কালো– যেন ঠিক সেই অন্ধকারের কালো যার ভিতর থেকে রেনসফর্ড এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে। তার চোখদুটোও মিশমিশে কালো আর অত্যন্ত উজ্জ্বল। গালের হাড়দুটো তাঁর উঁচু, নাকটি টিকলো আর মুখ শীর্ণ ধরনের ঈষৎ বাদামি– এ ধরনের চেহারা হুকুম দিতে অভ্যস্ত খানদানি লোকের চেহারা। জেনারেল সেই উর্দি-পরা দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে ইশারা করাতে সে তার পিস্তল নামিয়ে নিয়ে তাঁকে সেলুট করে চলে গেল।

জেনারেল বললেন, ইভানের গায়ে অসুরের মতো অবিশ্বাস্য শক্তি, কিন্তু বেচারির কপাল মন্দ– সে বোৰা আর কালা। সরল প্রকৃতির লোক, কিন্তু সত্যি বলতে কী তার জাতের আর-পাঁচজনের মতো একটুখানি বর্বর।

লোকটা কি রাশান?

জেনারেল স্মিত হাস্য করাতে তার লাল ঠোঁট আর উঁচল দাঁত দেখা দিল। বললেন, কসাক। আমিও। তার পর বললেন, চলুন, এখানে আর কথাবার্তা নয়। আমরা পরে সেটা করতে পারব। আপনার এখন প্রয়োজন জামাকাপড়, আহারাদি এবং বিশ্রাম। সব পেয়ে যাবেন। এ জায়গাটি পরিপূর্ণ শান্তিময়।

ইভান আবার দেখা দিল। জেনারেল তার সঙ্গে কথা কইলেন, সুদ্ধমাত্র ঠোঁট নেড়ে, কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে।

জেনারেল বললেন, আপনি দয়া করে ইভানের সঙ্গে যান। আপনি যখন এলেন তখন আমি সবেমাত্র ডিনারে বসেছিলুম। এখন আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আমার জামাকাপড় আপনার গায়ে ফিট করবে মনে হচ্ছে।

বরগাওলা বিরাট এক বেডরুম, টোপরওলা যে বিছানা তাতে ছ জন লোক শুতে পারে– সেখানে গিয়ে পৌঁছল রেনসফর্ড নীরব-দৈত্যের পিছনে পিছনে। ইভান একটি ইভনিং ড্রেস বের করে দিল। পরার সময় রেনসফর্ড লক্ষ করল স্যুটে লন্ডনের যে দর্জির নাম সেলাই করা রয়েছে তারা সাধারণত ডিউকের নিচের পদবির কারও জন্য স্যুট সেলাই করে না।

যে ডাইনিংরুমে ইভান তাকে নিয়ে গেল সেটাও বহুদিক দিয়ে লক্ষণীয়। ঘরটায় যেন ছিল মধ্যযুগীয় আড়ম্বর। দেয়ালে ওক কাঠের আস্তর, উঁচু ছাদ, বিরাট খাবার টেবিলে দু কুড়ি লোক খেতে পারে এসব সামন্তযুগের কোনও ব্যারনের হলঘরের মতো দেখাচ্ছিল। দেয়ালে লাগানো ছিল নানা প্রকারের পশুর মাথা– সিংহ, বাঘ, হাতি, ভালুক। এমন সর্বাঙ্গসুন্দর এবং বৃহৎ নমুনা রেনসফর্ড ইতোপূর্বে আর কখনও দেখেনি। সেই বিরাট টেবিলে জেনারেল একা বসে।

জেনারেল যেন প্রস্তাব করলেন, একটা ককটেল খাবেন তো, মিস্টার রেনসফর্ড ককটেলটি আশ্চর্য রকমের ভালো এবং রেনসফর্ড আরও লক্ষ করল যে, টেবিলের সাজসরঞ্জামও সর্বোত্তম পর্যায়ের টেবিলক্লথ, ন্যাপকিন, স্ফটিকের পাত্রাদি, রুপো এবং চীনেমাটির বাসনকোসন– সবকিছুই।

তারা ঘন মশলাওলা সরে মাখানো বৰ্শ সুপ খাচ্ছিলেন। এ সুপটি রাশানদের বড় প্রিয়। যেন আধো মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে জেনারেল জারফ বললেন, সত্যতা যেসব সুখ-সুবিধা দেয় আমরা এখানে সেগুলো রক্ষা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা দিই। ত্রুটিবিচ্যুতি হলে মাফ করবেন। জনগণের গমনাগমনের বাঁধা রাস্তা থেকে আমরা যথেষ্ট দূরে– বুঝলেন তো? আপনার কি মনে হয় অনেক দূরের সমুদ্রপথ পেরিয়ে এসেছে বলে শ্যাম্পেনের স্বাদ খারাপ হয়ে গিয়েছে?

রেনসফর্ড বলল, একদম না। তার মনে হয় জেনারেলটি অতিশয় অমায়িক ও যত্নশীল অতিথিসেবক- সত্যিকার বিশ্বনাগরিক। শুধু জেনারেলের একটি ক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্য রেন্সফর্ডের মনে অস্বস্তির সঞ্চার করছিল। যখনই প্লেট থেকে মুখ তুলে সে তার দিকে তাকিয়েছে তখনই দেখেছে তিনি যেন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, সূক্ষ্মতমভাবে যাচাই করে নিচ্ছেন।

জেনারেল জারফ বললেন, আপনি হয়তো আশ্চর্য হয়েছেন আমি আপনার নাম চিনলুম কী করে। বুঝেছেন কি না, ইংরেজি, ফরাসি এবং জর্মন ভাষায় যেসব শিকারের বই বেরোয় আমি তার সব কটাই পড়ি। আমার জীবনের ব্যসন মাত্র একটি, মিস্টার রেনসফর্ড–শিকার।

সুপক্ক ফিলে মিনো খেতে খেতে রেনসফর্ড বলল, আপনার শিকারের মাথাগুলো চমৎকার। ওই যে কেপ মহিষের মাথা এত বড় মাথা আমি কখনও দেখিনি।

ও! ওই ব্যাটা! পুরোদস্তুর দান ছিল সে।

আপনার দিকে তেড়ে এসেছিল নাকি?

একটা গাছের উপর আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আমার খুলিতে ফ্রাকচার হয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমি ব্যাটাকে ঘায়েল করি।

রেনসফর্ড বলল, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে যে বড় শিকারের ভিতর কেপের মোষই সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকার।

এক লহমার তরে জেনারেল কোনও উত্তর দিলেন না– তাঁর লাল ঠোঁট দিয়ে তিনি সেই বিচিত্র স্মিত হাস্য হেসে যেতে লাগলেন। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, না, আপনি ভুল করেছেন, স্যর! কেপ মহিষ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক শিকার নয়। তিনি মদের গেলাসে · একটি ছোট্ট চুমুক দিলেন, এই দ্বীপে আমার খাস মৃগয়া ভূমিতে আমি তারচেয়েও বিপজ্জনক শিকার করে থাকি।

রেনসফর্ড বিস্ময় প্রকাশ করে শুধোল, এই দ্বীপে বড় শিকার আছে নাকি?

জেনারেল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, সবচেয়ে বড়।

সত্যি?

ও! প্রকৃতিদত্ত নয়– নিশ্চয়ই। আমাকে স্টক করতে হয়।

আপনি কী আমদানি করেছেন, জেনারেল? বাঘ?

জেনারেল স্মিত হাস্য করে বললেন, না। বাঘ শিকারে আমার আর কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই– কয়েক বছর হয়ে গেল। বাঘের মুরোদ কতখানি তার শেষ পর্যন্ত আমার দেখা হয়ে গিয়েছে। বাঘ আর আমাকে উত্তেজনা দিতে পারে না কোনও সত্যকার বিপদে ফেলতে পারে না। আমি জীবন ধারণ করি বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য, মিস্টার রেনসফর্ড।

জেনারেল তার পকেট থেকে একটি সোনার সিগারেট কেস বের করে তার অতিথিকে রুপালি টিপওলা একটি লম্বা কালো সিগারেট দিলেন; সুগন্ধি সিগারেট ধূপের মতো সৌরভ ছাড়ে।

জেনারেল বললেন, আমরা অত্যুত্তম শিকার করব আপনাতে-আমাতে। আপনার সঙ্গ পেলে আমি বড়ই আনন্দ লাভ করব।

কিন্তু কী ধরনের শিকার–

বলছি আপনাকে। আপনার খুব মজা লাগবে আমি জানি। সবিনয়ে বলছি, আমি একটি নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছি। আপনাকে আরেক গেলাস পোর্টওয়াইন দেব কি?

ধন্যবাদ, জেনারেল।

জেনারেল দুটি গেলাস পূর্ণ করে বললেন, ভগবান কোনও কোনও লোককে কবি বানান, কাউকে তিনি রাজা বানান, কাউকে ভিখিরি। আমাকে তিনি বানিয়েছেন শিকারি। আমার পিতা বলতেন, আমার হাতখানি বন্দুকের ঘোড়ার জন্য নির্মিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন খুবই ধনী; ক্রিমিয়াতে তার আড়াই লক্ষ একর জমি ছিল এবং শিকারে ছিল তার চরম উৎসাহ আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখন তিনি আমাকে ছোট্ট একটি বন্দুক দেন বিশেষ অর্ডার দিয়ে সেটি মস্কোতে তৈরি করা হয়েছিল চড়ই শিকার করার জন্যে। আমি যখন ওইটে দিয়ে তার কতকগুলি জাত টার্কি মুরগি মেরে ফেলি তিনি তখন আমাকে কোনও সাজা দেননি; আমার আগের তিনি প্রশংসা করলেন। দশ বছর বয়সে ককেসাসে আমি আমার প্রথম ভালুক মারি। আমার সমস্ত জীবন একটানা একটা শিকার। আমি ফৌজে যোগ দিই– খানদানি ঘরের ছেলে মাত্রের কাছ থেকেই সে যুগে এই প্রত্যাশা করা হত এবং কিছুকালের জন্য আমি একটা ঘোড়সওয়ার কসাক ডিভিশনের কমান্ডারও হয়েছিলুম কিন্তু আমার সত্যকার আকর্ষণ সর্বসময়ই ছিল শিকার। সর্বদেশে আমি সর্বপ্রকারের জন্তু শিকার করেছি। আমি কটা জন্তু মেরেছি সেটা আপনাকে গুনে বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।

রাশা যখন তছনছ হয়ে গেল তখন আমি দেশ ছাড়লুম। কারণ জারের একজন অফিসারের পক্ষে তখন সেখানে থাকা অবিবেচনার কাজ হত। অনেক খানদানি রাশান সর্বস্ব হারালেন। আমি কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে প্রচুর মার্কিন শেয়ার কিনে রেখেছিলুম। তাই আমাকে কখনও মন্টিকার্লোতে চায়ের দোকান করতে হবে না, বা প্যারিসে ট্যাক্সি ড্রাইভার হতে হবে না। অবশ্য আমি শিকার চালিয়ে যেতে লাগলুম। আপনাদের রকি অঞ্চলে গ্রিজলি, গঙ্গায় কুমির, পূর্ব আফ্রিকায় গণ্ডার। আফ্রিকাতেই ওই কেপ মহিষ আমাকে জখম করে ছ মাস শয্যাশায়ী করে রাখে। সেরে ওঠামাত্রই আমি আমাজনে জাগুয়ার শিকার করতে বেরোলুম, কারণ আমি শুনেছিলুম যে, তারা অসাধারণ ধূর্ত হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কসাক বললেন, মোটেই না। বুদ্ধি সজাগ রাখলে আর জোরদার রাইফেল থাকলে তারা কোনও শিকারির সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে না। আমি মর্মান্তিক নিরাশ হলুম। এক রাত্রে আমি তাঁবুতে শুয়ে অসহ্য মাথাব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি এমন সময় একটা ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা আমার মাথায় ঢুকল। শিকার আমার কাছে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। এবং মনে রাখবেন শিকারই ছিল আমার জীবন। শুনেছি, মার্কিন দেশে ব্যবসায়ীরা আপন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে প্রায়ই যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েন, কারণ এই ব্যবসায়ই ছিল ওদের জীবন।

রেনসফর্ড বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

জেনারেল স্মিতহাস্য করলেন। আমার কিন্তু ভেঙে পড়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। আমাকে তা হলে কিছু একটা করতে হয়। দেখুন, আমার হল গিয়ে বিশ্লেষণকারী মন, মিস্টার রেনসফর্ড। নিঃসন্দেহ সেই কারণেই আমি শিকারের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যায় এত আনন্দ পাই।

রেনসফর্ড বলল, এতে কোনও সন্দেহই নেই, জেনারেল জারক।

তাই আমি নিজেকে শুধালুম, শিকার আমাকে এখন সম্মোহিত করে না কেন? আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট, মিস্টার রেনসফর্ড, এবং আমি যতখানি শিকার করেছি আপনি ততখানি করেননি কিন্তু তবু আপনি হয়তো উত্তরটা অনুমান করতে পারবেন।

সেটা কী?

সোজাসুজি এই; শিকার তখন আমার কাছে আর হয় হারি নয় জিতি ধরনের বিষয় নয়। আমি প্রতিবারেই আমার শিকারকে খতম করছি। সবসময়। প্রতিবারেই। সমস্ত ব্যাপারটা তখন আমার কাছে অত্যন্ত সরল হয়ে গিয়েছে। আর পরিপূর্ণতার মতো একঘেয়েমি আর কিছুতেই নেই।

জেনারেল আরেকটা সিগারেট ধরালেন।

 কোনও শিকারেরই আর তখন আমাকে এড়াতে পারবার সৌভাগ্য হতো না। আমি দেমাক করছি না। এ যেন একেবারে অঙ্কশাস্ত্রের নিশ্চয়তা। পশুটার কী আছে– তার পা আর সহজাত প্রবৃত্তি। অন্ধ প্রবৃত্তি তো বুদ্ধির সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারে না। এ চিন্তা যখন আমার মনে উদয় হল সে সময়টা আমার পক্ষে বিষাদময়, আপনাকে সত্যি বলছি।

রেনসফর্ড টেবিলের উপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গোগ্রাসে তার কথা গিলছে।

জেনারেল বলে যেতে লাগলেন, আমাকে কী করতে হবে, সেটা যেন একটা অনুপ্রেরণার মতো আমার কাছে এল।

এবং সেটা কী?

জেনারেল আত্মপ্রসাদের স্মিত হাস্য করলেন। মানুষ কোনও প্রতিবন্ধকের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সেটাকে অতিক্রম করতে পারলে যে মৃদু হাসি হাসে। বললেন, শিকার করার জন্য আমাকে নতুন পশু আবিষ্কার করতে হল।

নতুন পশু? আপনি ঠাট্টা করছেন।

জেনারেল বললেন, মোটেই না। আমি শিকারের ব্যাপার নিয়ে কখনও মশকরা করিনে। আমার প্রয়োজন ছিল একটা নতুন পশুর। পেলুমও একটা। তাই আমি এই দ্বীপটা কিনলুম, বাড়িটা তৈরি করলুম এবং এখানে আমি আমার শিকার করি। আমার কাজের জন্য এই দ্বীপটি একেবারে সর্বাঙ্গসুন্দর- জঙ্গল আছে, তার ভিতর পায়ে চলা-ফেরার রীতিমতো গোলকধাঁধা রয়েছে, পাহাড় আছে, জলাভূমি–

কিন্তু সেই পশুটা, জেনারেল জারফ?

জেনারেল বললেন, ও! এই দ্বীপ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাদায়ক শিকার করতে দিয়েছে। অন্য যে কোনও শিকারের সঙ্গে এর তুলনা এক লহমার তরেও হয় না। আমি প্রতিদিন শিকার করি এবং একঘেয়েমি আমার কাছেই আসতে পারে না কারণ আমার শিকার এমনই ধরনের যে তার সঙ্গে আমার বুদ্ধির লড়াই চালাতে পারি।

রেনসফর্ডের মুখে হতভম্ব ভাব।

আমি চেয়েছিলুম শিকারের জন্য একটা আদর্শ পশু। তাই আমি নিজেকে শুধালুম, আদর্শ শিকারের কোন কোন গুণ থাকে? তার উত্তর স্বভাবতই; তার সাহস, চাতুর্য, এবং সর্বোপরি সে যেন বিচারশক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

রেনসফর্ড আপত্তি জানাল, কিন্তু কোনও পশুরই তো বিচারশক্তি নেই।

 জেনারেল বললেন, মাই ডিয়ার দোস্ত, একটা পশুর আছে।

কিন্তু আপনি তো সত্যই সেটা বলতে রেনসফর্ডের দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

না কেন?

আমি বিশ্বাস করতে পারিনে যে আপনি যথার্থ কথা বলছেন, জেনারেল জারফ। একটা বীভৎস রসিকতা।

আমি যথার্থ কথা বলব না কেন? আমি শিকারের কথা বলছি।

শিকার? ভগবান সাক্ষী, আপনি যা বলছেন সে তো খুন!

জেনারেল পরিপূর্ণ খুশ মেজাজে হেসে উঠলেন। রেনসফর্ডের দিকে তিনি মজার সঙ্গে তাকালেন। বললেন, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না যে আপনার মতো সভ্য ও আধুনিক যুবা– আপনাকে দেখলে সেই তো মনে হয় মানুষের প্রাণ সম্বন্ধে রোমান্টিক ধারণা পোষণ করবে। নিশ্চয়ই যুদ্ধে আপনার অভিজ্ঞতা

রেনসফর্ড কঠিন কণ্ঠে বলল, নৃশংস খুন ক্ষমা করতে দেয় না।

উচ্চহাস্যে জেনারেল দুলতে লাগলেন। বললেন, কী অসাধারণ মজার মানুষ আপনি! আজকের দিনে শিক্ষিত সম্প্রদায়ে–এমনকি আমেরিকাতেও এ ধরনের হাবাগোবা সরলবিশ্বাসী– আর যদি অনুমতি দেন তবে বলি– মধ্য ভিক্টোরীয় ধারণার মানুষ পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, তবে কি না, কোনও সন্দেহ নেই আপনার পূর্বপুরুষ গোঁড়া শুদ্ধাচারী (রিটান) ছিলেন। কত না আমেরিকাবাসীর পিতৃপুরুষ এই সম্প্রদায়ের। আমি বাজি ধরছি, আমার সঙ্গে শিকারে বেরুলে এসব ধারণা আপনি ভুলে যাবেন। আপনার অদৃষ্টে খাঁটি নতুন রোমাঞ্চকর উত্তেজনা সঞ্চিত রয়েছে।

অনেক ধন্যবাদ। আমি শিকারি; খুনি নই।

বিচলিত না হয়ে জেনারেল বললেন, হায়, আবার সেই অপ্রিয় শব্দ! কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি আপনার কাছে প্রমাণ করতে পারব, আপনার নৈতিক দ্বিধা ভিত্তিহীন।

সত্যি?

জীবন জিনিসটাই শক্তিমানের জন্য, বেঁচে থাকবে শক্তিমান, এবং প্রয়োজন হলে সে জীবন নিতেও পারে। দুর্বলদের এই পৃথিবীতে রাখা হয়েছে শক্তিমানকে আনন্দ দেবার জন্য। আমি শক্তিমান। আমি আমার বিধিদত্ত উপহার কাজে খাটাব না কেন? আমি যদি শিকার করতে চাই তবে করব না কেন? তাই আমি দুনিয়ার যত আবর্জনাকে শিকার করি– রদ্দি জাহাজের খালাসি, মাঝিমাল্লা, কৃষ্ণাঙ্গ, চীনা, শ্বেতাঙ্গ, দুআঁসলা– একটি অবিমিশ্র রক্তের ঘোড়া বা কুকুর এদের কুড়িটার চেয়ে মূল্যবান।

রেনসফর্ড গরম হয়ে বলল, কিন্তু তারা মানুষ।

জেনারেল বললেন, হুবহু খাঁটি কথা। সেই কারণেই আমি ওদের ব্যবহার করি। আমি তাতে আনন্দ পাই। তারা বিচারশক্তি প্রয়োগ করতে পারে, অবশ্য যার ঘটে যেমন বুদ্ধি সেইটুকু দিয়ে। তাই তারা বিপজ্জনক।

কিন্তু শিকারের জন্য মানুষ জোগাড় করেন কী প্রকারে? রেনসফর্ড শুধাল।

 ক্ষণতরে জেনারেলের বাঁ-চোখের পাতাটি নড়ে গিয়ে যেন কটাক্ষ মারল। উত্তর দিলেন, এ দ্বীপের নাম জাহাজ-ফদ দ্বীপ। কখনও কখনও ঝঞ্ঝামথিত ক্রুদ্ধ সমুদ্রদেব আমার কাছে এদের পাঠিয়ে দেন। যখন ভাগ্যদেবী অপ্রসন্না, তখন আমি তাকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করি। আমার সঙ্গে জানালার কাছে আসুন।

রেনসফর্ড জানালার কাছে এসে বাইরের সমুদ্রের দিকে তাকাল।

জেনারেল বলে উঠলেন,  লক্ষ করুন! ওই ওখানে বাইরে! রেনসফর্ড শুধু নিশির অন্ধকার দেখতে পেল। তার পর যেই জেনারেল একটি বোতাম টিপলেন অমনি দূর সমুদ্রে একাধিক আলোর ছটা দেখতে পেল।

জেনারেল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ওই আলোকগুলোর অর্থ, ওখানে চ্যানেল পথ আছে যেখানে সে জাতীয় কিছুই নেই। বিরাট বিরাট পাথর তাদের ক্ষুরের মতো ধারালো পাশ নিয়ে হাঁ করে ঘাপটি মেরে বসেছে সমুদ্রদৈত্যের মতো। তারা অতি অক্লেশে একখানা জাহাজ গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিতে পারে এই যেরকম আমি অক্লেশে এই বাদামটা খুঁড়িয়ে দিচ্ছি। তিনি শক্ত কাঠের মেঝের উপর একটি বাদাম ফেলে দিয়ে জুতোর হিল দিয়ে খুঁড়িয়ে চুরমার করে দিলেন। যেন কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিতান্ত কথায় কথায় বললেন, আমার ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা আছে। আমরা এখানে সভ্য থাকবার চেষ্টা করি।

সত্য? আর আপনি গুলি করে মানুষ খুন করেন?

জেনারেলের কালো চোখে ক্রোধের সামান্য রেশ দেখা দিল। কিন্তু সেটা এক সেকেন্ডের তরে। অতি অমায়িক কণ্ঠে বললেন, হায় কপাল! কী অদ্ভুত নীতিবাগীশ তরুণই-না আপনি! আমি আপনাকে প্রত্যয় দিচ্ছি, আপনি যা বলতে চাইছেন আমি সেরকম কিছুই করি না। সেটা হবে বর্বরতা। আমি আমার অতিথিদের চরম খাতিরযত্ন করে থাকি। তারা প্রচুর খাদ্য পায়, প্রয়োজনীয় কায়িক পরিশ্রম করে শরীর সুস্থ-সবল রাখতে পায়। তাদের স্বাস্থ্য চমৎকার হয়ে ওঠে। কাল আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।

মানে?

মুচকি হেসে জেনারেল বললেন, কাল আমরা আমার ট্রেনিং স্কুল দেখতে যাব। স্কুলটা মাটির নিচের সেলারে। উপস্থিত সেখানে আমার প্রায় ডজন খানেক ছাত্র আছে। তারা এসেছে হিসপানি বোট সানলুকার থেকে জাহাজখানার দুর্ভাগ্যবশত সেটা ওই হোথায় পাথরগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সবকটাই অতিশয় নিরেস, বাজে-মার্কা ডেকের উপর চলা-ফেরাতে যতখানি অভ্যস্ত, জঙ্গলে ততখানি নয়।

তিনি হাত তুলতেই ইভান- সে-ই ওয়েটারের কাজ করছিল– গাঢ় টার্কিশ কফি নিয়ে এল। রেনসফর্ড অতিকষ্টে নিজেকে কথা বলা থেকে ঠেকিয়ে রাখছিল।

ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে খোলাখুলিভাবে জেনারেল বলে যেতে লাগলেন, বুঝতে পারছেন তো এটা হচ্ছে শিকারের ব্যাপার। আমি এদের একজনকে আমার সঙ্গে শিকারে যেতে প্রস্তাব করি। আমি তাকে যথেষ্ট খাদ্য আর উৎকৃষ্ট একখানা শিকারের ছোরা দিয়ে আমার তিন ঘন্টা আগে বেরুতে দিই। পরে বেরুই আমি, সবচেয়ে ছোট ক্যালিবারের আর সবচেয়ে কম পাল্লার মাত্র একটি পিস্তল নিয়ে। পুরো তিন দিন যদি সে আমাকে এড়িয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে তবে সে জিতল। আর আমি যদি তাকে খুঁজে পাই জেনারেল মুচকি হেসে বললেন, তবে সে হারল।

সে যদি শিকার হতে রাজি না হয়?

 ও! সেটা বাছাই করা নিশ্চয়ই আমি তার হাতে ছেড়ে দিই। সে যদি না খেলতে চায় তবে খেলবে না। সে যদি শিকারে যেতে রাজি না হয় তবে আমি তাকে ইভানের হাতে সমৰ্পণ করি। ইভান একদা মহামান্য তে জারের সরকারি চাবুকদারের সম্মানিত চাকরি করেছে। এবং খেলাধুলা, শিকার বাবদে সে আপন নিজব ধারণা পোষণ করে। কোনও ব্যত্যয় হয় না, মিস্টার রেনসফর্ড, কোনও ব্যত্যয় হয় না। তারা সব্বাই আমার সঙ্গে শিকার করাটাই পছন্দ করে নেয়।

আর যদি তারা জিতে যায়?

 জেনারেলের মৃদু হাস্য আরও বিস্তৃত হল। বললেন, আজ পর্যন্ত আমি হারিনি।

সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, আপনি ভাববেন না, মিস্টার রেনসফর্ড, আমি দেমাক করছি। বস্তুত ওদের বেশিরভাগই অতিশয় সরল সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। মাঝে মাঝে দু-একটা দুদে দেখা দেয় বটে। একজন প্রায় জিতে গিয়েছিল। শেষটায় কুকুরগুলোকে ব্যবহার করতে হয়েছিল আমাকে।

কুকুর?

এদিকে আসুন; আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

জেনারেল রেনসফর্ডকে একটা জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। জানালার আলোগুলো নিচের আঙিনায় আলো-ছায়ার হিজিবিজি প্যাটার্ন তৈরি করছিল। রেনসফর্ড সেখানে ডজনখানেক বিরাট আকারের কালো প্রাণীকে নড়াচড়া করতে দেখল। তারা তার দিকে মুখ তুলতেই তাদের চোখে সবুজ রঙের ঝিলিমিলি খেলে গেল।

জেনারেল মন্তব্য করলেন, আমার মতে উত্তম শ্রেণির। প্রতিরাত্রে সাতটার সময় এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কেউ যদি আমার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে কিংবা বেরিয়ে যাবার তবে তার পক্ষে সেটা শোচনীয় হতে পারে। জেনারেল গুন গুন করে ফলি বেজেঁরের একটি গানের কলি ধরলেন।

জেনারেল বললেন, এখন আমি যে নতুন মাথাগুলো জমিয়েছি সেগুলো আপনাকে দেখাতে চাই। আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে আসবেন কি?

রেনসফর্ড বলল, আমি আশা করছি, আজকে রাত্রের মতো আপনি আমায় ক্ষমা করবেন। আমার শরীরটা আদপেই ভালো যাচ্ছে না।

জেনারেল উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন, আহা, তাই নাকি! কিন্তু সেইটেই ভো স্বাভাবিক এতখানি দীর্ঘ সাঁতার কাটার পর। আপনার প্রয়োজন রাত্রিতর শান্তিতে সুন্দ্রিা। কাল তা হলে আপনার মনে হবে, আপনি যেন নতুন মানুষ হয়ে গিয়েছেন। আমি বাজি ধরছি। তখন আমরা শিকারে বেরুকী বলেন? কালকের শিকার উত্তম হবে বলেই আমি আশা করছি

রেনসফর্ড তখন তাড়াতাড়ি সে ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে।

জেনারেল পিছন থেকে গলা তুলে বললেন, আজ যে আপনি আমার সঙ্গে শিকারে বেরুতে পারছেন না তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আজ ভালো শিকারের আশা আছে-বড় সাইজের, তাগড়া নিগ্রো। দেখে তো মনে হচ্ছে অন্ধিসন্ধি জানে– আচ্ছা, গুডনাইট, মিস্টার রেনসফর্ড! আশা করি রাত্রিটা পুরো বিশ্রাম পাবেন।

বিছানাটা ছিল খুব ভালো, বিছানায় পরার পাজামা-কুর্তা সবচেয়ে নরম রেশমের তৈরি, তার সর্ব পেশি-মায়ুতে ক্লান্তি, কিন্তু তবুও ন্দ্রিার ওষুধ দিয়ে সে তার মগজটাকে শান্ত করতে পারল না পড়ে রইল দুটো খোলা চোখ মেলে। একবার তার মনে হল, তার ঘরের সামনের করিডরে কার যেন চুপিসাড়ে চলার শব্দ শুনতে পেল। সে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল; খুলল না। জানালার কাছে গিয়ে সে বাইরের দিকে তাকাল। তার ঘরটা ছিল উঁচু টাওয়ারগুলোর একটাতে। বাড়ির আলো তখন নিভে গিয়েছে। নীরব, অন্ধকার। শুধু আকাশে একফালি পার চাঁদ; তারই ফ্যাকাসে আলোতে সে আঙিনায় আবছায়া দেখতে পাচ্ছিল। কতকগুলি নিস্তব্ধ কালো আকারের কী যেন সেখানে আনাগোনা করে আলো-ছায়ার আলপনা কাটছিল; কুকুরগুলো জানালাতে তার শব্দ শুনতে পেয়ে কিসের যেন প্রতীক্ষায় তাদের সবুজ চোখ তুলে তাকাল। রেনসফর্ড বিছানায় ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ার জন্য সে বহু পদ্ধতিতে চেষ্টা করল। তার পর যখন কিছুটা ফল পেয়ে, পাতলা ঘুমে ঝিমিয়ে পড়েছে ঠিক ভোরের দিকে তখন অতিদূর জঙ্গলের ভিতর সে পিস্তল ছোঁড়ার ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেল।

দুপুরের খাওয়ার পূর্বে জেনারেল জারফ দেখা দিলেন না। লাঞ্চে যখন এলেন তখন তার পরনে গ্রামাঞ্চলের জমিদারের নিখুঁত টুইডের স্যুট। তিনি রেনসফর্ডের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেনারেল বললেন, আর আমার কথা যদি তোলেন, তবে বলি আমার ঠিক ভালো যাচ্ছে না। আমার মনে দুশ্চিন্তা, মিস্টার রেনসফর্ড। কাল রাত্রে আমি আমার পুরনো ব্যারামের চিহ্ন অনুভব করলুম।

রেনসফর্ডের চাউনিতে প্রশ্ন দেখে জেনারেল বললেন, একঘেয়েমি। বৈচিত্র্যহীনতার অরুচি।

আপন প্লেটে আবার খানিকটা ক্রেপ স্যুজে তুলে নিয়ে জেনারেল বুঝিয়ে বললেন, কাল রাত্রে ভালো শিকার হয়নি। লোকটার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। সে এমন সোজাসুজি চলে গিয়েছিল যে, তাতে করে কোনও সমস্যারই উদ্ভব হল না। খালাসিগুলোকে নিয়ে এই হল মুশকিল। একে তো আকাট, তায় আবার বনের ভিতর চলাফেরার কৌশল জানে না। নিরেট বোকার মতো এমন সব করে যা দেখামাত্রই স্পষ্ট বোঝা যায়। ভারি বিরক্তিজনক। আরেক গেলাস শাবলি চলবে কি মিস্টার রেনসফর্ড?

রেনসফর্ড দৃঢ়কণ্ঠে বললে, জেনারেল, আমি এখুনি এই দ্বীপ ত্যাগ করতে চাই।

তাঁর দুই ঝোঁপ-ভুরু উপরের দিকে তুললেন; মনে হল তিনি যেন আঘাত পেয়েছেন। আপত্তি জানিয়ে বললেন, সে কী দোস্ত! আপনি তো সবে এসেছেন। শিকারও তো করেননি।

রেনসফর্ড বলল, আমি আজই যেতে চাই। তার পর দেখে, জেনারেলের কালো চোখদুটো তার দিকে মড়ার চোখের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকে যেন যাচাই করে নিচ্ছে। হঠাৎ জেনারেল জারফের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বোতল থেকে প্রাচীন দিনের শাবলি ঢাললেন রেনসফর্ডের গেলাসে। বললেন, আজ রাত্রে আমরা শিকারে বেরুব– আপনাতে-আমাতে।

রেনসফর্ড ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বলল, না জেনারেল, আমি শিকারে যাব না।

জেনারেল ঘাড়দুটো তুলে নামিয়ে অসহায় ভাব দেখালেন। বাগানের কাঁচের ঘরে বিশেষ করে ফলানো একটি আঙুর মোলায়েমসে খেতে খেতে বললেন, আপনার অভিরুচি, দোস্ত! কী করবেন, না করবেন সেটা সম্পূর্ণ আপনার হাতে। তবে যদি অনুমতি দেন তবে বলব, শিকার-খেলা সম্বন্ধে ইভানের ধারণার চেয়ে আমার ধারণা আপনার অধিকতর মনঃপূত হবে।

যে কোণে ইভান দাঁড়িয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে জেনারেল মাথা নাড়লেন। দৈত্যটা সেখানে তার পিপের মতো পুরু বুকের উপর দু বাহু চেপে কুটি-কুটিল নয়নে তাকাচ্ছিল।

রেনসফর্ড আর্তকণ্ঠে বলল, আপনি কি সত্যি বলতে চান–।

জেনারেল বললেন, প্যারা দোস্ত! আমি কি আপনাকে বলিনি, শিকার সম্বন্ধে আমি যা-ই বলি না কেন, সেটা সত্য সত্য বলি। কিন্তু এটা আমার খাঁটি অনুপ্রেরণা। আসুন, আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশে আমি পান করি।

জেনারেল তার গেলাস উঁচু করে তুলে ধরলেন; কিন্তু রেনসফর্ড তার দিকে শুধু স্থির নয়নে তাকিয়ে রইল।

সোৎসাহে জেনারেল বললেন, আপনি দেখবেন এ শিকার শিকারের মতো শিকার। আপনার বুদ্ধি আমার বুদ্ধির বিপক্ষে। আপনার শক্তি, আপনার লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার বিরুদ্ধে। মুক্তাকাশের নিচে দাবা খেলা! এবং যে বাজি ধরা হবে তার মূল্যও কিছু কম নয়–কী বলেন?

আর যদি আমি জিতি, রেনসফর্ডের গলা থেকে শব্দগুলো যেন ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বেরুল।

জেনারেল জারফ বললেন, তৃতীয় দিনের মধ্যরাত্রি অবধি যদি আমি আপনাকে খুঁজে না পাই তবে আমি সানন্দে আপন পরাজয় স্বীকার করে নেব। আমার নৌকা আপনাকে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনও শহরের কাছে ছেড়ে আসবে।

জেনারেল যেন রেনসফর্ডের চিন্তা পড়ে ফেলে বললেন, ও। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ভদ্রলোক এবং শিকারি হিসেবে আমি আপনাকে প্রত্যয় দিচ্ছি। অবশ্য আপনাকেও তার বদলে কথা দিতে হবে যে, এখানে আপনার আগমন সম্বন্ধে কিছু। বলবেন না।

রেনসফর্ড বললেন, আমি আদপেই এরকম কোনও কথা দেব না।

জেনারেল বললেন, ও? তা হলে কিন্তু এখন কেন সে আলোচনা? তিন দিন পরে দুজনাতে এক বোতল ভ্যভক্লিকো খেতে খেতে সে আলোচনা করা যাবে, অবশ্য যদি

জেনারেল মদে চুমুক দিলেন।

কারবারি লোকের ব্যস্ততা তাকে সজীব করে তুলল। রেনসফর্ডকে বললেন, ইভান। আপনাকে শিকারের কোটপাতলুন, আহারাদি ও একখানা ছোরা দেবে। আমাকে যদি অনুমতি দেন তবে বলি, আপনি নরম চামড়ার তালিওলা জুতোই পরবেন। এতে করে চলার পথে দাগ পড়ে কম। এবং পরামর্শ দিই, দ্বীপের দক্ষিণপুব কোণের বিস্তীর্ণ জলাভূমিটা মাড়াবেন না। আমরা ওটাকে মরণ-জলা নাম দিয়েছি। ওখানে চোরাবালি আছে। এক আহাম্মুক ওইদিক দিয়ে চেষ্টা দিয়েছিল। শোকের বিষয় যে, ল্যাজুরা তার পিছনে পিছনে যায়। আপনি আমার বেদনাটা কল্পনা করে নিতে পারবেন, মিস্টার রেনসফর্ড। আমি ল্যাজরাকে ভালোবাসতুম; আমার দলের ওইটেই ছিল সবচেয়ে সরেস ভালকুত্তা। তা হলে, এখন আপনার কাছে আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি। দুপুরে আহার করার পর আমি একটু গড়িয়ে নিই। আপনি কিন্তু নিদ্রার ফুরসত পাবেন না। নিশ্চয়ই আপনি রওনা হতে চাইবেন। গোধূলিবেলার পূর্বে আমি আপনার পেছনে বেরুব না। রাত্রিবেলার শিকারে উত্তেজনা অনেক বেশি, দিনের চেয়ে–কী বলেন? আচ্ছা তবে দেখা হবে, মিস্টার রেনসফর্ড, ও রিভোয়া।

নিচু হয়ে নম্র অভিবাদন জানিয়ে জেনারেল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ইতান অন্য দরজা দিয়ে ঘরে এল। তার এক বগলে শিকারের খাকি পোশাক, খাবারের হ্যাঁভারস্যা, চামড়ার খাপের ভিতর লম্বা ফলাওলা শিকারের ছোরা। তার ডানহাত রক্তরঙের কোমরবন্ধের ভিতরে গোজা রিভলভারের ভোলা ঘোড়ার উপর।

দু ঘন্টা ধরে রেনসফর্ড ঝোঁপজঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেন লড়াই করে চলেছে আর দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করেছে, আমি মাথা গরম হতে দেব না, আমার মাথা গরম হলে চলবে না।

শাটোর গেট যখন তার পিছনে কড়া করে বন্ধ হয়ে যায় তখন তার মাথা খুব পরিষ্কার ছিল না। প্রথমটায় তার সর্বপ্রচেষ্টা নিয়োজিত হয়েছিল ভার আর জেনারেল জারফের মাঝখানে যতখানি সম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি করতে, আর ওই উদ্দেশ্য মনে রেখে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সামনের দিকে। যেন এক করাল বিভীষিকা ঘোড়সওয়ারের জুতোর কাটার মতো খোঁচা মেরে মেরে তাকে সম্মুখপানে খেদিয়ে নিয়ে চলেছিল। কিন্তু এতক্ষণে সে অনেকখানি আত্মকর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছে; সে দাঁড়িয়ে গিয়ে তার নিজের পরিস্থিতিটা বিচার-বিবেচনা করতে লাগল।

সোজা, শুধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই কারণ তাতে করে সে সমুদ্রের কাছে গিয়ে মুখোমুখি হবে। সে যেন চতুর্দিকে সমুদ্রের ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির মাঝখানে; সে যা-ই করুক না কেন, এই ফ্রেমের ভিতরই তাকে সেটা করতে হবে।

রেনসফর্ড বিড়বিড় করে বলল, দেখি, আমার চলার পথ সে খুঁজে বের করতে পারে কি না। এতক্ষণ সে জঙ্গলের কাঁচা পায়ে চলার পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটা ছেড়ে এখন নামল দিকদিশেহীন ঘন জঙ্গলের ভিতর। সে অনেকগুলো জটিল ঘোর-প্যাঁচ খেয়ে তার উপর দিয়ে বার বার এলোপাতাড়ি আসা-যাওয়া করতে করতে শেয়াল-শিকারের সমস্ত কলাকৌশল, আর শেয়ালের এড়িয়ে যাবার তাবৎ ধূর্ত সধন্ধ-সুড়ুক স্মরণে আনতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার যখন নামল তখন সে গভীর জঙ্গলে ভরা একটা টিলার প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পা দুটো শ্রমক্লান্ত, হাত আর মুখ জঙ্গলের শাখা-প্রশাখার আঁচড়ে ভর্তি। সে বেশ বুঝতে পারল, এখন তার গায়ে শক্তি থাকলেও এই অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে চলাটা হবে বদ্ধ পাগলামি। এখন তার বিশ্রাম নেওয়ার একান্ত প্রয়োজন। মনে মনে ভাবল, এতক্ষণ আমি শেয়ালের যা করার তাই করেছি, এখন বেড়ালের খেলা খেলতে হবে। কাছেই ছিল একটা বিরাট গাছ– মোটা হুঁড়ি আর বিস্তৃত কাণ্ড নিয়ে। অতি সাবধানে সামান্যতম চিহ্ন না রেখে সে গাছ বেয়ে উঠে যেখানে একটা মোটা শাখা গুঁড়ি থেকে বেরিয়েছে সেখানে চওড়া শাখাটার উপর গা এলিয়ে দিয়ে যতখানি পারা যায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করল। এই বিশ্রান্তি তার বুকে যেন এক নতুন আত্মবিশ্বাস এনে দিল; এমনকি সে অনেকখানি নিরাপত্তাও অনুভব করতে লাগল। মনে মনে নিজেকে বলল, জেনারেল জারফ যত বড় উৎসাহী শিকারিই হোন না কেন, এখানে তিনি তাকে খুঁজে পাবেন না। সে যে গোলকধাঁধার প্যাঁচ পিছনে রেখে এসেছে তার জট ছাড়িয়ে অন্ধকারে এই জঙ্গলের ভিতর একমাত্র শয়তানই এগুতে পারবে। কিন্তু হয়তো জেনারেল একটা শয়তানই–

আহত সর্প যেরকম ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়, এই উদ্বেগময়ী রজনীও সেইরকম কাটতে লাগল, এবং জঙ্গলে মৃতা ধরণীর নৈস্তব্ধ্য বিরাজ করা সত্ত্বেও রেন্সফর্ডের চোখের পাতায় ঘুম নামল না। ভোরের দিকে যখন আকাশ ঘোলাটে পাঁশুটে রঙ মাখছিল তখন চমকে ওঠা একটা পাখির চিৎকার রেনসফর্ডের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করল। কী যেন একটা আসছে ঝাড়ঝোঁপের ভিতর দিয়ে ধীরে, সাবধানে সেই এলোপাতাড়ি গোলকধাঁধা বেয়ে, ঠিক যেভাবে রেনসফর্ড এসেছিল। ডালের উপর চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে পড়ে সে পাতায় বোনা প্রায় কার্পেটের মতো পুরু আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যে বস্তু আসছিল সে মানুষ।

জেনারেল জারফ! সর্বচৈতন্য কেন্দ্রীভূত করে, গভীরতম মনোযোগের সঙ্গে তিনি এগিয়ে আসছিলেন। প্রায় ঠিক গাছটার সামনে তিনি দাঁড়ালেন, তার পর মাটিতে হাটু গেড়ে জমিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। কিছুমাত্র চিন্তা না করে রেনসফর্ডের প্রথম রোখ চেপেছিল নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে লক্ষ করল জেনারেলের ডানহাতে ধাতুর তৈরি কী একটা বন্ধু ছোট্ট একটি অটোম্যাটিক পিস্তল।

শিকারি কয়েকবার মাথা নাড়লেন, যেন তিনি ধন্ধে পড়েছেন। তার পর সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে কে থেকে তার কালো একটা সিগারেট বের করলেন; তার তীব্র সুগন্ধ ভেসে উঠে রেনসফর্ডের নাকে পৌঁছল।

রেনসফর্ড দম বন্ধ করে রইল!

জেনারেলের চোখ তখন মাটি ছেড়ে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাছের গুঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। রেনসফর্ড বরফের মতো জমে গিয়েছে, তার সবকটা মাংসপেশি লাফিয়ে পড়ার জন্য টনটন করছে। কিন্তু যে ডালটার উপর রেনসফর্ড শুয়েছিল ঠিক সেখানে পৌঁছবার পূর্বে শিকারির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেমে গেল। তার রোদেপোড়া মুখে দেখা দিল স্মিত হাস্য। যেন অতিশয় সুচিন্তিতভাবে তিনি ধুয়োর একটি রিং উপরের দিকে উড়িয়ে দিলেন, তার পর গাছটার দিকে পিছন ফিরে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথেই ফিরে চললেন। ঘাসপাতার উপর তার শিকারের বুটের খসখস শব্দ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে লাগল।

ফুসফুসের ভিতরে রেফর্ভের বন্ধ প্রশ্বাস উগ্র বিস্ফোরণের মতো ফেটে বেরুল। তার মনে প্রথম যে চিন্তার উদয় হল সেটা তাকে ক্লিষ্ট, অবশ করে দিল। শিকার যেটুকু সামান্যতম চিহ্ন রেখে যেতে বাধ্য হয় জেনারেল সেই খেই ধরে রাতের অন্ধকারে বনের ভিতর এগুতে জানেন; তিনি ভুতুড়ে শক্তি ধরেন। সামান্যতম দৈববশে কাক তার শিকার এবার দেখতে অক্ষম হয়েছেন।

রেনসফর্ডের দ্বিতীয় চিন্তা বীভৎসতর রূপে উদয় হল। সে কুচিন্তা তার সর্বসত্তার ভিতর মরণের হিমের কাঁপন তুলে দিল। জেনারেল মৃদুহাস্য করলেন কেন? তিনি ফিরে চলে গেলেন কেন?

তার সুস্থ বিচার-বুদ্ধি তাকে যে কথা বলছিল রেনসফর্ড সে সত্য বিশ্বাস করতে চাইল না– অথচ ঠিক সেই সময় প্রভাত-সূর্য যেরকম কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল সে সত্য ঠিক ওইরকমই প্রত্যক্ষ। জেনারেল তার সঙ্গে শিকার-খেলা খেলছেন! আরেকদিনের শিকার-খেলার জন্য জেনারেল তাকে বাঁচিয়ে রাখছেন! কসাকই বেড়াল; সে ইঁদুর। মৃত্যুর আতঙ্ক তার পরিপূর্ণ অর্থ নিয়ে এই প্রথম রেন্সফর্ডের কাছে আত্মপ্রকাশ করল।

আমি আত্মকর্তৃত্ব হারাব না, কিছুতেই না।

সে গাছ থেকে পিছলে নেমে আবার ঘন বনের ভিতর ঢুকল। তার মুখ তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় কঠিন এবং সে তার মস্তিষ্কযন্ত্র সবলে পূর্ণোদ্যমে কাজে লাগিয়ে দিল। প্রায় তিনশো গজ দূরে সে বিরাট একটা মরাগাছের গুঁড়ির সামনে দাঁড়াল। সেটা বিপজ্জনকভাবে পড়-পড় হয়ে একটা ছোট জ্যান্ত গাছের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রেনসফর্ড তার খাবারের ব্যাগ মাটিতে ফেলে দিয়ে খাপ থেকে শিকারের ছোরা বের করে পূর্ণোদ্যমে কাজে লেগে গেল।

অনেকক্ষণ পরে কর্ম সমাপ্ত হল। শ-ফুট খানেক দূরে একটা শুকনো কাঠের গুঁড়ি পড়ে ছিল। রেনসফর্ড তার আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বেড়ালটা ওই তো আবার আসছে, ইঁদুরের সঙ্গে খেলবে বলে!

ডালকুত্তার মতো দ্বিধাহীন প্রত্যয় নিয়ে জেনারেল জার আসছেন রেনসফর্ডের খেই ধরে ধরে। তার সদসন্ধানী কালো চোখকে কিছুই এড়িয়ে যেতে পারে না– একটিমাত্র তেলে যাওয়া ঘাসের পাতা না, বেঁকে যাওয়া ছোট্ট ডালের টুকরোটি না, শ্যাওলার উপর ক্ষীণতম চিহ্নটি না থোক না সে যতই ক্ষীণ। সন্ধান খুঁজে খুঁজে এগুতে গিয়ে জেনারেল এতই নিমগ্ন ছিলেন যে রেনসফর্ড তার জন্য যে জিনিসটি তৈরি করেছিল সেটা না দেখার পূর্বেই তার উপরে এসে পড়লেন। তার পা পড়ল সামনে-এগিয়ে-পড়া একটা ঝোঁপের উপর– এইটেই রেন্সফর্ডের পাতা ফাঁদের হ্যাঁন্ডিল। কিন্তু তার পা ওইটে ছোঁয়ামাত্রই জেনারেলের চৈতন্যে বিপদের পূর্বাভাস চমক মারল—-সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্র বানরের মতো তিনি তৃরিত বেগে পিছনের দিকে লাফ দিলেন। কিন্তু যতখানি ক্ষিপ্র হওয়ার প্রয়োজন ছিল ঠিক ততখানি হননি; কাটা জ্যান্ত গাছের উপর সন্তর্পণে রাখা মরা গাছটা মড়মড়িয়ে পড়ার সময় জেনারেলের ঘাড়ের উপর মারল ট্যারচা ঘা। জেনারেলের ক্ষিপ্ত বিদ্যুৎগতি না থাকলে তিনি গাছের তলায় নিঃসন্দেহে গুঁড়িয়ে যেতেন। টাল খেয়ে তিনি টলতে লাগলেন বটে কিন্তু মাটিতে পড়লেন না; এবং পিস্তলটিও হস্তচ্যুত হল না। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জখমি ঘাড়টাতে হাত ঘষতে লাগলেন। রেনসফর্ডের বুকটাকে সেই ভীতি আবার পাকড়ে ধরেছে; সে শুনতে পেল জেনারেলের ব্যঙ্গ-হাস্য জঙ্গলের ভিতর খলখলিয়ে উঠছে।

তিনি যেন ডেকে বললেন, রেনসফর্ড, আপনি যদি আমার কণ্ঠস্বরের পাল্লার ভিতরে থাকেন এবং আমার বিশ্বাস আছেন, তবে আপনাকে আমার অভিনন্দন জানাই। মালয় দেশের মানুষ ধরার ফাঁদ খুব বেশি লোক বানাতে জানে না। কিন্তু আমার কপাল ভালো যে, আমিও মালাক্কাতে শিকার করেছি। আপনি সত্যি এখন আমার কাছে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠছেন। আমি এখন আমার জখমটাকে পট্টি বাধতে চললুম; জখমটা সামান্যই। কিন্তু আমি ফিরে আসছি। আমি ফিরে আসছি।

জেনারেল যখন তাঁর ছড়ে যাওয়া ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেলেন তখন রেনসফর্ড আবার আরম্ভ করল তার পলায়ন। এবারে সত্যকার পলায়ন– আশাহীন, জীবনমরণের পলায়ন, এবং সে পলায়ন চলল কয়েক ঘণ্টা ধরে। গোধূলির আলো নেমে এল, তার পর অন্ধকার হল, তবু তার অগ্রগতি বন্ধ হল না। পায়ের নিচের মাটি তখন নরম হতে আরম্ভ করেছে, গুলতা ঘনতর নিবিড়তর হতে লাগল, পোকাগুলোও ভীষণভাবে তাকে কামড়াতে আরম্ভ করেছে। তার পর আরেকটু এগুতেই তার পা জলা-মাটিতে ঢুকে বসে গেল। সে তার পা-টা মুচড়ে টেনে বের করবার চেষ্টা করল কিন্তু সেই চোরা-কাদা বিরাট জোকের মতো তার পা পাশবিক শক্তির সঙ্গে শুষতে লাগল। প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে রেনসফর্ড তার পা-খানা মুক্ত করল। সে তখন বুঝতে পেরেছে, কোথায় এসে পৌঁছেছে। এ সেই মরণ-জলা তার চোরাবালি নিয়ে।

তার হাত দুটি তখন মুষ্টিবদ্ধ। যেন তার বিচারবুদ্ধির সুস্থ স্নায়ুবল ধরা-ছোঁয়ার জিনিস এবং সেইটাকে অন্ধকারে কে যেন তার কজা থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওই থলথলে মাটি তার মনে এক নতুন কৌশল এনে দিল। চোরাবালি থেকে ডজনখানেক ফুট পিছিয়ে গিয়ে যেন কোনও আদিম অন্ধকার যুগের মৃত্তিকা খননদক্ষ বিরাট বিভারের মতো সে মাটি খুঁড়তে লাগল।

ফ্রান্সে যুদ্ধের সময় মাটি খুঁড়ে রেনসফর্ড ট্রেঞ্চের ভিতর আশ্রয় নিয়েছে তখন এক সেকেন্ডের বিলম্ব হওয়ার অর্থ ছিল মৃত্যু। তখনকার মৃত্তিকাখনন এর তুলনায় তার কাছে গদাইলস্করি চালের খেলাধুলো বলে মনে হল। গর্তটা গম্ভীর হতে গভীরতর হতে লাগল; যখন সেটা তার ঘাড়ের চেয়েও গম্ভীর হল তখন সেটার থেকে বেয়ে উঠে কতকগুলো শক্ত গাছের চারা কেটে ডগাগুলো সূচাগ্র তীক্ষ্ণ করে বানাল বর্শার মতো করে। ডগাগুলো উপরমুখো করে সেগুলো সে পুঁতে দিল গর্তের তলাতে। আগাছা আর ছোট ছোট ডাল নিয়ে দ্রুত হস্তে একটা এবড়ো-খেবড়ো কার্পেটের মতো করে বুনল এবং সেটা গর্তের উপর পেতে মুখটা বন্ধ করে দিল। ঘামে জবজবে ভেজা ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর নিয়ে সে গুঁড়ি মেরে বসল একটা বাজে পোড়া গাছের গুঁড়ির পিছনে।

সে বুঝতে পেরেছে তার তাড়নাকারী আসছে; নরম মাটির উপর পায়ের থপ থপ শব্দ শুনতে পেয়েছে এবং রাত্রের মৃদু বাতাস জেনারেলের সিগারেট-সৌরভ তার কাছে নিয়ে এসেছে। তার মনে হল যেন জেনারেল অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন; আগের মতো এক ফুট এক ফুট করে সমঝে-বুঝে আসছেন না। যেখানে শুড়ি মেরে রেনসফর্ড বসে ছিল সেখান থেকে সে জেনারেল বা গর্তটা কোনও কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। প্রত্যেকটি মিনিট যেন তার কাছে এক-একটা বছরের আয়ুষ্কাল বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। তার পর, হঠাৎ সে উল্লাসভরে সানন্দে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। কারণ সে শুনতে পেয়েছে মড়মড় করে গর্তের ঢাকনা ভেঙে নিচে পড়ে গিয়েছে; ধারালো কাঠের ডগাতে পড়ে কে যেন বেদনার তীক্ষ্ণ আতাঁর ছেড়েছে। তার লুকানো জায়গা থেকে সে লাফ দিয়ে উঠেছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে যেন মুষড়ে গিয়ে পিছু হটল। গর্ত থেকে তিন ফুট দূরে একজন মানুষ ইলেকট্রিক টর্চ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেনারেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। শাবাস রেনসফর্ড, তোমার বর্মা-পদ্ধতিতে তৈরি গর্তটা আমার সবচেয়ে সেরা কুকুরদের একটাকে গ্রাস করেছে। আবার তুমি জিতলে। এবারে দেখব মিস্টার রেনসফর্ড, তুমি আমার পুরো পাল কুকুরের বিরুদ্ধে কী করতে পার। আমি এখন বাড়ি চললুম একটু বিশ্রাম করতে। ভারি আমোদে কাটল সন্ধ্যাটা তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

জলাভূমির কাছে শুয়ে রাত কাটানোর পর ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙল এমন একটা শব্দ শুনে যেটা তাকে বুঝিয়ে দিল যে ভয় বলতে কী বোঝায় সে সম্বন্ধে এখনও তার নতুন কিছু শেখবার আছে। শব্দটা আসছিল দূর থেকে ক্ষীণ, এবং ভাসা ভাসা। একপাল কুকুরের চিৎকার।

রেনসফর্ড জানত, সে দুটোর একটা করতে পারে। যেখানে আছে সেখানেই থেকে অপেক্ষা করা। সেটা আত্মহত্যার শামিল। কিংবা সে ছুট লাগাতে পারে। সেটা হবে অবধারিতকে মুলতবি করা। এক মুহূর্তের তরে সে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। তার মাথায় যা এল সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। কোমরের বেল্ট শক্ত করে নিয়ে সে জলাভূমি ত্যাগ করল।

কুকুরগুলোর চিৎকার আরও কাছে আসছে, তার পর আরও কাছে, তারচেয়ে আরও কাছে। পাহাড়ের খাড়াইয়ের উপরে একটা গাছে চড়ে রেনসফর্ড দেখতে পেল, একটি জলধারার পোয়াটাক মাইল দূরে একটা ঝোঁপ নড়ছে। চোখ যতদূর সম্ভব পারে টাটিয়ে দেখতে পেল জেনারেলের একহারা শরীর আর তার সামনে আরেকজনের বিশাল স্কন্ধ জঙ্গলের উঁচু বোনো ঘাস ঠেলে ঠেলে এগুচ্ছে। এ সেই নরদানব ইভান। তাকে যেন কোন অদৃশ্য শক্তি টেনে টেনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে; রেনসফর্ডের বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না সে কুকুরগুলোর চেন হাতে ধরে রেখেছে।

যে কোনও মুহূর্তে তারা তার ঘাড়ে এসে পড়বে। তার মগজ তখন ক্ষিপ্তবেগে চিন্তা করছে। ইউগান্ডায় শেখা গ্রামবাসীদের একটা ফন্দি তার মনে এল। গাছ থেকে নেমে সে একটা লিকলিকে চারাগাছের সঙ্গে তার শিকারের ছোরাটার ডগা নিচের দিকে মুখ করে বাঁধল সে যে-পথ দিয়ে এসেছে তার ঠিক উপরে; সর্বশেষে চারাগাছটাকে লতা দিয়ে ধনুর মতো বাঁকিয়ে পিছন দিকে বাঁধল। তার পর সে দিল প্রাণপণ ছুট। কুকুরগুলো ইতোমধ্যে আবার তার গন্ধ পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে তীব্রতর স্বরে। এইবারে রেনসফর্ড হৃদয়ঙ্গম করল, কোণঠাসা শিকারের বুকে কোন অনুভূতি জাগে।

দম নেবার জন্য তাকে থামতে হল। হঠাৎ কুকুরগুলোর চিৎকার থেমে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডের হৃদস্পন্দনও যেন থেমে গেল। তা হলে তারা নিশ্চয়ই ছোরা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।

রেনসফর্ড উত্তেজনার চোটে চড়চড় করে একটা গাছে উঠে পিছনপানে তাকাল। তার তাড়নাকারীরা তখন দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু গাছে চড়ার সময় রেনসফর্ড তার হৃদয়ে যে আশা পুষেছিল সেটা লোপ পেল; সে দেখতে পেল শুকনো উপত্যকার উপর জেনারেল জারফ আপন পায়ের উপরই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ইভান নয়। জ্যা-মুক্ত চারাগাছের আঘাতে ছোরাটা সম্পূর্ণ নিষ্ফলকাম হয়নি।

রেনসফর্ড হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়তে না পড়তে কুকুরগুলো আবার চিৎকার করে উঠল।

আবার দৌড়তে আরম্ভ করে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলছে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, হবে, হবে। একদম সামনে, গাছগুলোর ফাঁকে দেখা দিয়েছে এক ফালি নীলরঙের ফাঁকা! রেনসফর্ড প্রাণপণ ছুটল সেদিক পানে। পৌঁছল সেখানে। সেটা সমুদ্রের পাড়। সমুদ্র সেখানে খানিকটে ঢুকে গিয়ে ছোট্ট উপসাগরের মতো আকার ধরেছে। রেনসফর্ড তারই ওপারে দেখতে পেল বিষণ্ণ পাওটে পাথরের তৈরি জেনারেলের শাটো। রেনসফর্ডের পায়ের বিশ ফুট নিচে সদ্ৰ গজরাচ্ছে আর ফোঁস ফোঁস করছে। রেনসফর্ড দোটানায়। শুনতে পেল কুকুরগুলোর চিৎকার। লাফ দিয়ে পড়ল দূরে, সমুদ্রে।

জেনারেল আর তার কুকুরের পাল সে জায়গায় পৌঁছলে পর তিনি সেখানে থামলেন। কয়েক মিনিটের তরে তাকিয়ে রইলেন নীলসবুজ বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে। ঘাড়ের ঝাঁকুনি দিয়ে যাকগে ভাব প্রকাশ করলেন। তার পর মাটিতে বসে কুপোর ফ্লাস্ক থেকে ব্রান্ডি খেয়ে সুগন্ধি সিগারেট ধরিয়ে মাদাম বাটারফ্লাই গীতিনাট্য থেকে খানিকটা গান গুনগুন করে গাইলেন।

সে রাত্রে তার কাঠের আস্তরওলা বিরাট ডাইনিং হলে জেনারেল জারফ অত্যুকৃষ্ট ডিনার খেলেন। সঙ্গে পান করলেন এক বোতল পল রজের আর আধ বোতল শ্যাবেরতা। দুটি যৎসামান্য বিক্তিকর ঘটনা তাকে পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগে বাধা দিল মাত্র। তার একটা, ইভানের স্থলে অন্য লোক পাওয়া কঠিন হবে এবং অন্যটা, তার শিকার হাতছাড়া হয়ে গেল বলে-স্পষ্টই দেখা গেল যে মার্কিনটা আইনমাফিক শিকারের খেলাটা খেলল না। ডিনারের পর লিক্যোয়ে চুমুক দিতে দিতে অন্তত জেনারেলের তাই মনে হল। আরাম পাবার জন্য তাই তিনি তার লাইব্রেরিতে মার্কস আউরেলিয়ুসের রচনা পড়লেন। দশটার সময় তিনি শোবার ঘরে ঢুকলেন। দোরে চাবি দিতে দিতে তিনি আপন মনে বললেন, আজকের ক্লান্তিটা তার বড় আরামের ক্লান্তি। সামান্য একটু চাঁদের আলো আসছিল বলে তিনি বাতি সুইচ করার পূর্বে জানালার কাছে গিয়ে নিচে আঙিনার দিকে তাকালেন। বিরাট কুত্তাগুলোকে দেখে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আসছে বারে তোমাদের কপাল ভালো হবে, আশা করছি। তার পর তিনি আলো সুইচ করলেন।

খাটের পর্দার আড়ালে যে লোকটা লুকিয়ে ছিল সে সেখানে দাঁড়িয়ে।

জেনারেল চেঁচিয়ে বললেন, রেনসফর্ড! ভগবানের দোহাই, তুমি এখানে এলে কী করে?

রেনসফর্ড বলল, সতরে। আমি দেখলুম, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে না এসে এভাবেই তাড়াতাড়ি হয়।

জেনারেল ঢোক গিললেন, তার পর মৃদু হেসে বললেন, আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনি শিকারে জিতেছেন!

রেনসফর্ড স্মিতহাস্য হাসল না। নিচুস্বরে হিসহিসিয়ে সে বলল, আমি এখনও কোণঠাসা শিকারের পশু। তৈরি হোন, জেনারেল জার!

জেনারেল যেভাবে নিচু হয়ে বাও করলেন সেটা তাঁর গভীরতম বাওয়ের একটি। বললেন, তাই নাকি? চমৎকার! আমাদের একজনকে কুত্তাগুলোর খানা হতে হবে। অন্যজন ঘুমুবে এই অতি উৎকৃষ্ট শয্যায়। এসো রেনসফর্ড, হুশিয়ার…

রেনসফর্ড সিদ্ধান্ত করল, এরচেয়ে ভালো বিছানায় সে কখনও ঘুমোয়নি।

[বিদেশি গল্পের অনুবাদ।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *