সর্বমঙ্গলা

সর্বমঙ্গলা

সর্বমঙ্গলা ঠাকরুনের দেহটি আশি বছর পরে সজ্জিত হয়ে উঠছিল। সাদা গরদের কাপড়ে সরু একটু মেরুন পাড়। সারদা-মার যেমন থাকত। ফুলের মালা গলায়। বস্তুত সারা শরীরই ফুলে ঢাকা। কপালে চন্দনের রসকলি। মাথার শনের নুড়ি চুলগুলি গুছিয়ে চারদিকে ছড়ানো, তার ওপর রঞ্জার মামিমারা ছোট ছোট সাদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। মামিরা বলতে সাতজনের মধ্যে অবশিষ্ট তিনজন। চারজন এক-এক করে মারা গেছেন। মামারাও বেশির ভাগই গত। দুজন কোনওক্রমে বেঁচেবর্তে আছেন। যে মহিলা দুটি সর্বমঙ্গলার দিন ও রাতের সেবা করত তারাই খালি সা নয়নে বসে আছে। তাদের খুব সম্ভব চেষ্টা করলেই চোখে জল আসে এবং কোনও মৃত্যুর ক্ষণ কান্না ছাড়া অশুভ এমন একটা ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা সেই প্রফেশন্যাল মোর্নার বা রুদালিদের মতো কান্না সাপ্লাই করছিল। রঞ্জার মা বেদবতী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন—সেজবউদি বললেন, বস বেদো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কিছু করতে পারবি?

বেদবতী বসলেন। বেদবতীর আনা কাপড়ই মাকে পরানো হয়েছে। একমাত্র মেয়ে। জীবিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনিই এখন সবচেয়ে বড়। না, তিনি কিছু করতে চাননি। এর আগে যখন মা আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন, তখন কিছু করার ছিল কিনা ভাবছিলেন। কোথাও কোনও ত্রুটি হয়ে গেছে কি না। যে কোনও মানুষের মৃত্যুর সময়ে আপনজনদের মনে এই প্রশ্নটা জাগে। ‘একটু চিকিৎসার সময় পাওয়া গেল না’ কি ‘একটু সেবা নিলে না মা’—এই ধরনের কথাবার্তা মৃত্যুর পর শোনা যায় খুব। সবাই জানে চিকিৎসার সময় পাওয়া গেলে যে পরিমাণ অর্থব্যয় হত সেটা ভাবনার কারণ, কঠিন অসুখ এক চিকিৎসায় সারেও না। এক পৌনঃপুনিক কষ্ট ও দুশ্চিন্তা ও অর্থব্যয়ের উৎসও হয়ে থাকে। আর সেবা নেওয়া? সেবা যাকে নিতে হয়, আর যাকে দিতে হয়, দিনের পর দিন উভয়েই মনে মনে কী প্রার্থনা করে? সে কি উচ্চারণ করা যায়?

নাঃ, সর্বমঙ্গলার জন্য বেদবতীর কেন, কারওই কিছু করার ছিল না। তাঁর রোগ বার্ধক্য। বয়সের ভারে একটি একটি করে দেহযন্ত্র বিকল হয়েছে। সর্বমঙ্গলার মনের, মগজের মৃত্যু ঘটে গেছে অনেক দিন, বেদবতীর এখন যা বয়স তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। তিনি মনে করতে পারেন মা সামান্য কটা গোলমেলে কথা বলেছিলেন একদিন।

—নাতজামাই পরশু দিন এসেছিল, বড় ভাল লাগল রে।

—কে নাতজামাই?

—ওই যে রে তোর রঞ্জুর বর?

—সুবীর? এসেছিল?

—হ্যাঁ, বউমারা নুচি মাংস খাওয়ালে। আমায় পেন্নাম করলে। বেশ ভাল আঁব এনেছিল।

তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সুবীর কাউকে পেন্নাম করবার পাত্র নয়, মামা-শ্বশুরবাড়িতে কবে নাকি সে অপমানিত হয়েছিল, জীবনে কখনও পা দেয়নি। আজও আসেনি। তিনি জনান্তিকে বউদিদের জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাঁরা অবাক! —সুবীর? নুচি…? আঁব… তুমিও যেমন বেদো, মায়ের আজকাল ভীমরতি হয়েছে। মনে মনে ভাবেন, কল্পনার জগতে বাস করেন।

তাঁর দাদাদের নাতি-নাতনিরা কেউ-কেউ হাসাহাসি করে বলেছিল কর্তা মা এবার গপ্পো লেখো। ভালই তো বানাতে পারো দেখছি।

ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলেন মা। —সুবীর আসেনি? তবে কে এল খুকি? কে আঁব দিল? ছাড়িয়ে দিল আমাকে সেজবউমা, এখনও যে জিবে সোয়াদ লেগে রয়েছে রে!

তখন আরও বুঝেছিলেন বেদবতী— এ স্বপ্ন কল্পনা। সেজবউমা অর্থাৎ তাঁর সেজবউদি প্রমীলা মাকে আদর করে আঁব ছাড়িয়ে দেবার পাত্রীই নয়। সাত বউয়ের মধ্যে সবচেয়ে মুখরা, কুচুটে, মায়ের মুখের ওপর কড়া কথা বিশ্রীভাবে বলতে প্রমীলা বউদির কখনওই বাধত না।

—নুচি-ক্ষীর খেতে সাদ হয়েচে? আর কত খাবে মা? নিজের তিন তিনটে ছেলেকে, দুটো বউকে তো গপাগপ খেলে! এর ওপর আবার নুচি-ক্ষীর? হেগে ছত্রাকার করলে কে পোস্কার করবে? কোন বউ, ডিউটি ভাগ করে দাও দিকিনি!

এসব বেদবতীর উপস্থিতিতেই। ধমধম করে চলত সেজবউদি, সেজদা মারা যাবার পর খেপে গিয়েছিল একেবারে। সন্ন্যাস রোগে মারা গেলেন সেজদা, মা কী করবেন? দিবারাত্র ছেলের মাথার ওপর আইসব্যাগ ধরে বসে থাকতেন। সে-ও শেষ হয়ে গেল। অপয়া বুড়ি। ছেলের পরমাই নিজে কেড়ে থুয়েছে।

সর্বমঙ্গলা তখনও একেবারে অ-ব্যক্তি হয়ে যাননি, ছেলের মৃত্যুর খোঁটা শুনে তিনি জ্বলে গিয়েছিলেন, বলেন—বউমা এখন আমি যদি তোমাকে অপয়া বলি, তো কী হয়? গ্রামদেশ থেকে বউ এনে কী ভুলই করেছি। কথাবার্তা একেবারে যাচ্ছে-তাই। শোনো মা, কোথায় লাগছে তোমার আমি বুঝতে পারছি। তুমি পেড়ে শাড়ি পরবে, গয়না গা থেকে নামাবে না, এই আমি তোমার শাউড়ি আজ হুকুম দিয়ে দিচ্ছি। তোমার মাছ-ভাত যেন কেউ বন্ধ না করে। করলে আমার এই মেয়ের মাথার দিব্যি!

সর্বনাশ! ছেলে খেয়েছে আবার মেয়েও খেতে চায়! সবাইকার মনোভাব তখন এইরকম। কিন্তু সত্যিই আজও সেজবউদির মাছ-ভাত অটুট আছে। অন্যরা বৈধব্য পালন করে। সেজবউদির বেলা ঠাকরুনের অমোঘ নির্দেশ। সেজবউদি দেখতে সুন্দর ছিল। মানে ফরসা, বড় বড় চোখ নাক এই। বেদবতীর ভাল লাগত না। সুন্দর হলেই কি আর সুন্দর হয়? যেন বিষধর সর্প। কথার বিষে সংসার জ্বালিয়ে দিত। সব তার চাই। কাপড় গয়না না পেলে সেজদার ধুধ্‌ধুড়ি নাড়িয়ে দিত। খাবার সময়ে বলত—আমার বাপ-কাকা সব জমিদার। পাত-কুড়োনো খেয়ে ভাই আমার অভ্যেস নেই। আগে আমার ভাত-তরকারি আলাদা করে রাখবে। বড় গাদার মাছ ছাড়া আমি খেতে পারি না। শেষ পাতে একটু দুধ চাই। খেতেও পারত খুব। বলত—বাপ মা চিরকাল খাইয়েছে মাখিয়েছে। সাত ছেলের পর এক মেয়ে, আদরে মানুষ হয়েছি—আমি সেইরকমই চালিয়ে যাব, না দিতে পারো তো বাপের বাড়ি চললুম।

মেয়েরা সব শেষে হাঁড়ি-কড়া-পোঁছা খাবে। মাছ জুটবে না, ছাল কাঁটা দিয়ে সধবা-ধর্ম রক্ষা করতে হবে, দুধ বাচ্চারা বুড়োরা আর ব্যাটাছেলেরা খাবে—এইরকমই তো নিয়ম তখন সব বাড়িতে। ভাল জিনিসটি আগে ব্যাটাছেলেদের পাতে পড়বে—এই। সেজবউদি তুমুল করত। কুটুম বাড়ি থেকে তত্ত্ব এল—আগে একটা বড় রেকাবির মতো ক্ষীরমোহন তুলে নিল। শাশুড়ি বললেন—ও কী করছ, তত্ত্বের জিনিস যে ভাগ হবে গো, ওই ক্ষীরমোহন যে তিন ভাগ হবে, বাড়ির সবাই, এপাশ ওপাশ দু বাড়ি, আত্মীয়স্বজন… সেজবউদি বলল—আমার মা-বাবা সবচেয়ে আগে আমার পছন্দের জিনিসটি তুলে নিতে দিত, সে শাড়িই হোক খাবারই হোক। এখন তো আপনাকে মা মেনেছি, আপনি না দিলে অগত্যা আমাকেই নিতে হয়। আমার বাপের বাড়ি থেকে ঠিলে ঠিলে পাটালি, কলসি কলসি নলেন গুড়, মুক্তকেশী বেগুন, কাঁড়ি কাঁড়ি সজনে ফুল খাচ্ছেন না? —খাউন্তি-বউ, জাঁহা বেজে, অলক্ষ্মী, কিছু বলেই সেজবউদিকে কায়দা করতে পারা যায়নি।

সেই সেজবউদি আজ বেদবতীর জন্যে এক গেলাস মিছরির পানা এনে দাঁড়িয়েছে—খাও দিকি! তোমার আমার বয়সটাও কিছু কম হল না। শোকবাড়িতে কারও সেসব মনে থাকবে না, আরেকটা মিত্যু ঘটে যাবে।

দাঁত বাঁধানো হলেও সেজবউদি র-ফলা ঋ-ফলা উচ্চারণ করতে পারছে না আজকাল।

—চলো, ভেতরে চলো বউদি।

—কেন বেদো? সবার সামনে খেতে লজ্জা করছে? আশি বছরে ঘা দিলুম, কেউ আর আমাদের দিকে দেখবে না। কী রে, দেখবি তোরা? মাঝখান থেকে পিত্তি পড়ে আমরাই ভুগব। নাও দিকি খেয়ে নাও। মায়ের পরানটা ঠান্ডা হবে। ‘আমার খুকি খাচ্ছে।’ খুকি বলবার আর কেউ রইল না তোমার।

গড় হয়ে সর্বমঙ্গলার পায়ে প্রণাম করলেন সেজমামিমা—কত অকথা কু-কথা বলেছি মা। মাফ করে দিয়ে। দু ফোঁটা চোখের জল পড়ল সেজমামিমার চোখ থেকে।

এখনও এক পিঠ কাঁচা-পাকা চুল মামির। মায়ের চেয়ে ক’ মাসের ছোট। মানে ওই আশিই। সোজা দাঁড়ায়, পেন্নাম করে হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুখটি যেন ঘষামাজা, সবুজ নকশাপাড় টাঙাইল শাড়িটি পাটভাঙা। মৃতদেহ নামানোর পর মামিমা ভাল শাড়ি পরে চুলটুল গুছিয়ে পাবলিক-এ নেমেছেন।

হাসিও পেল। কিন্তু সূক্ষ্ম একটা শংসা এঁর জন্য তার বরাবরই ছিল। মা জীবনে কখনও কারও নিন্দে করেননি। সেজমামিরও না। কিন্তু অপছন্দটা তো বোঝা যেত! রঞ্জা কিছু বললে অবশ্য খুব মন দিয়ে শুনতেন, মাঝে মাঝে মাথা নাড়তেন।

—আচ্ছা মা, গ্রামের ধনী ঘরের আদরের দুলালি। নির্ভীক স্পষ্টবাদী তৈরি হয়েছেন। একটু স্পয়েল্ট মানছি। শ্বশুরবাড়িতে এসে একজন মেয়ে অর্থাৎ শাশুড়ির অন্য মেয়েদের জন্য বরাদ্দটা যদি পছন্দ না হয়, বঞ্চনা আর অপমানটা যদি ভাল না লাগে? অন্যরা মেনে নিয়েছে মুখ বুজে। আড়ালে গজগজ করেছে। সেজমামি সোজাসুজি প্রোটেস্ট করেছেন। নিজের অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছেন। না দিলে তো কেড়ে নিতে হবে। হবে না? কেড়ে নেওয়ার ভাষাটা কড়াই হয়।

মা মৃদু হেসে চিন্তিত মুখে মাথা নাড়তেন—কী জানিস রঞ্জা, মেয়েদের এই যে সব ব্রতপার্বণ জয় মঙ্গলবার, ইতু, শীতলষষ্ঠী, চাপড়াষষ্ঠী… এসব আমার মনে হয় মেয়েদের খাওয়ানোর জন্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। জয় মঙ্গলবারে আম। ইতুতে নতুন শীতের তরিতরকারি ঘি দিয়ে, শীতল বা চাপড়া ষষ্ঠীর তরিবতও কিছু কম নয়। আমাদের গোটাসেদ্ধর সঙ্গে, ঝুরো পোস্ত, সজনে ফুল চচ্চড়ি, দই— এসব পাঁচরকম ব্যঞ্জন থাকতই, একেবারে মাস্ট।

তাই নাকি? তা দুর্গাষষ্ঠীর উপোসটা? জামাই-ষষ্ঠীতে ষোড়শ ব্যঞ্জন রান্না করে নিজের উপোস, না ফলার? তা-ও আবার কোন ভাগ্যবানের জন্য? কে না কে জামাই, যে নাকি কক্ষনো আপন হয় না তার জন্য। হাসালে মা।

—ফলার তো ভাল রে! ফলে শরীর সুস্থ হয়। ফল দুধ তো সব রকমের ভিটামিন তোকে দিচ্ছে। তাই তো মেয়েরা বেশি বাঁচে।

—যদিও সে বাঁচার তেমন কোনও…

‘মানে নেই’ বলতে গিয়েছিল রঞ্জা। সামলে নিয়েছিল। মায়ের জীবনের কোনও মানেও তো তা হলে অস্বীকার করা হবে। নিজেকে নিজে চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল রঞ্জার।

মা মৃদু চোখে চেয়ে ছিলেন। রঞ্জার বরাবর ধারণা মাকে যতটা মনে হয় মা তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরেন। অসাধারণ ডিপ্লোম্যাট। কোনও মেয়ের যদি মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস খুব বেশি থাকে তা হলে সে তার যুক্তি বুদ্ধি এসব স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে পারে। কিছু কিছু লোকে তাকে বাড়ির বড়সাহেব কি ডেপুটি কিংবা জাঁহাবেজে ইত্যাদি বললেও সে তার অস্তিত্ব চমৎকার টিকিয়ে রেখে নিজের সংসারের মঙ্গল করতে পারে, যেমন দিদিমা সর্বমঙ্গলা। কিন্তু যে বুদ্ধিমতী অথচ মৃদু স্বভাবের, চাপা, তাকে অবলম্বন করতে হয় ডিপ্লোম্যাসি, যার ঠিকঠাক বাংলা ‘কূটনীতি’ নয়। কিছুই বুঝি না, আমি ভালমানুষ লোক বাপু এই ভাবে এরা বুদ্ধি খাটিয়ে যায় অন্তরাল থেকে। বেদবতী সেই জাতীয় মেয়ে। রঞ্জার হঠাৎ মনে পড়ল তার দিদি মঞ্জুলিকার যৌবনের একটা ঘটনার কথা। দিদি খুব ফরসা ছিল, খুব কেশবতী, বয়সের মায়ায় তার দেহে তখন রূপের জোয়ার, মনে আবেগের। পাড়ার একটি দাদা-গোছের ছেলের প্রেমে পড়ল দিদি। পুজোর সময়ে যেসব অস্থায়ী প্রেম গজায় তেমনই সবাই মনে করেছিল। কিন্তু দাদা অর্থাৎ সঞ্জয় একদিন এসে মুখ গম্ভীর করে ঘোষণা করল রমেনের সঙ্গে মঞ্জুকে এখানে সেখানে দেখা যাচ্ছে। মা বললেন—তোরা ওকে কেউ বকাঝকা করতে যাসনি!

—মানে? তোমার প্রশ্রয়েই…

—হ্যাঁ বাবা, প্রশ্রয়ও আমার, আশ্রয়ও আমার। আর দেখো, বাবার কানে তুলো না, আমি দেখি কী করতে পারি।

রঞ্জা পুরো ঘটনাটা জানত। সে উৎকর্ণ হয়ে আছে মা কী করেন, কী বলেন দেখতে। মঞ্জু তার প্রথম প্রেমের ঘোরে রাতে তখনও জেগে আছে, মা ভেবেছেন রঞ্জা বুঝি ঘুমিয়ে গেছে। আস্তে ডাকলেন—মঞ্জু-উ।

—উঁ!

—তোকে একটা কথা বলব?

—কী বলবে জানি মা। আমায় তোমরা ক্ষমা কোরো। আমি রমেন ছাড়া আর কাউকে…

—না না, আমি সে কথা বলছি না রে। ভালবাসার ওপর কারও হাত নেই। তুই যদি ওকে সত্যিই ভালবাসিস, নিশ্চয় দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব। আমি নিজে। তা তুই সতিন নিয়ে ঘর করলেও।

—মানে?

—না, দ্বিতীয় বিয়ে এখন আইনে অসিদ্ধ হলেও অনেকেই করছে। লুকিয়ে রাখছে।

—তো?

—শুনেছি রমেনের কলাবাগান বস্তির যমুনার সঙ্গে গত বছর থেকে জানা-শুনো। যমুনার মা বলছিল। কে জানে কালীঘাটে সিঁদুর দিয়েছে কি না। ও বিয়ে অবশ্য সিদ্ধ নয়। যমুনা যমুনার মা কিচ্ছু করতে পারবে না… আমি ভাবছিলুম… মা কথা শেষ করলেন না।

কিছু দিন পর রমেন ও তার দলবলের হাতে মঞ্জুর ছোটভাই রঞ্জন যারপরনাই লাঞ্ছিত হল।

রাস্তার ঠিক মোড়ে, রঞ্জন বাড়ি ফিরছে। রমেন বলল—কী হে ছোট সম্বন্ধী, আমার নামে নাকি যা নয় তাই বলে বেড়াচ্ছ। খচড়ামো বার করে দেব মেরে, ঠ্যাং নিয়ে আর জীবনে হাঁটতে হবে না। আরও বহু গালাগাল। রঞ্জন কাঁদো-কাঁদো উত্তেজিত মুখে বাড়ি ফিরে মঞ্জুলিকা অর্থাৎ তার অতি প্রিয় দিদিকেই সব বলল—শালা, খচড়ামো, ঠ্যাং ভেঙে দেব…সব। রঞ্জন কিছুই জানত না। মঞ্জুলিকা শুনে চুপ। সাত দিন বাড়ি থেকে বেরোল না। তারপর তিন দিন ঠিক ইউনিভার্সিটি গেল। চতুর্থ দিন বাড়ি এসে বলল—মা, আমি রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছি, যদি অ্যাসিড বাল্‌ব মারে! ভয় দেখিয়েছে।

বাগবাজারে এই মামার বাড়ি থেকে মঞ্জুলিকার বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম বারো বছর সে আমেরিকায় ছিল, এখন দিল্লিতে দেবেশদা পোস্টেড। সেখানেই আছে। বাড়ি করেছে ময়ূর বিহারের দিকে। শিগগিরই দেবেশদার রিটায়ারমেন্ট।

সর্বমঙ্গলার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রঞ্জার মনে হল—এই মাতামহী ঈশার প্রমাতামহী, পুতির বিয়ে দেখে গেছেন। কী অসীম উৎসাহ ও দাপট। উনি যখন স্ববশে ছিলেন বাগবাজারের বাড়িতে, সর্বমঙ্গলার কথাই ছিল শেষ কথা। কত গ্রীষ্মের ছুটিতে বাগবাজারের বাড়িতে কাটিয়ে গেছে। মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে হুল্লোড়। দিদিমার টঙের ঘর থেকে আচার চুরি করে খাওয়া। দিদিমা বুকে একটা কোমরে একটা গামছা পরে মাংস রাঁধছেন, সেই অপরূপ দৃশ্য দেখে ভাইবোনেদের হাসি, ছোটমামার ঘোষণা গামছা পরে রাঁধা পাঁঠা সে খাবে না, দিদিমার মুচকি হাসি—কী করব বল, তোদের বাবা বেঁচে থাকলে লাল পাড় শাড়ি পরে রেঁধে দিতুম এখন। কাপড়টা অবশ্য তারপর কেচে দিতে হত। কিন্তু এখন আর… গামছাই তো ভাল। কী ভীষণ শুচিবাই ছিল দিদিমার। দিনে কতবার যে স্নান করতেন! রাস্তার কাপড়ে ট্রেনের কাপড়ে কেউ ছুঁলে স্নান। সকালবেলা পুজোর আগে স্নান, দুপুরবেলা ভাত খেয়ে স্নান। বিকেলের নিয়মমাফিক গা ধোয়া, তাদের কারও দিদিমাকে প্রণাম করার হুকুম ছিল না।

রঞ্জু, মঞ্জু শুনে যা… ভাইবোনেরা ছুটল, সবার হাতে একটা করে আপেল দিলেন। দিদিমার রাত্রে ফলাহার বলে ফল থাকত বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনও ফল হাতে করে আসতেন। ডাক্তারের হুকুম ছিল রোজ একটা করে আপেল তাঁকে খেতেই হবে। দরকার হলে সেদ্ধ করে। কিন্তু আপেল নাকি বিলিতি ফল, তাই নাতি-নাতনিদের একটা করে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে কাপড় কেচে ফেলতেন দিদিমা। তখন মাথায় জল দিয়ে স্নানকে ‘কাপড় কাচা’ বলত, বৈঠকখানাকে ‘বাইরের ঘর’ বলত, শৌখিন স্ন্যাক্স জাতীয় খাবারদাবারকে ‘খাবার’ বলা হত। ন’মামিমা খুব ভাল ‘খাবার’ করতে পারতেন। তখন লোকে বাড়ি এসে কড়া নাড়ত। ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/বন্ধ হল রাতের কড়া নাড়া’… সেই কড়া-নাড়ার রূপকল্পতে বছরকয় পরেই ফুটনোট দিতে হবে। এই অতীত এখন ওই খাটে শুয়ে। শ্মশানে চলে যাচ্ছেন সেজেগুজে। কিছু দিন স্মৃতি-ছবি হয়ে থাকবেন, তারপর সমাজে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবেন। ‘সেকালের নারী’ বলে কেউ ইতিকথা লিখবেন। ‘শেষ প্রমাতামহী’ বলে উপভোগ্য রম্যরচনা। কোথাও মধুর, কোথাও বিধুর কোথাও আবার হাস্যরসে টইটম্বুর।

হে সর্বমঙ্গলা, তুমি সমাজের হাতে গড়া রক্তমাংসের এক প্রতিনিধি পুতুল। আমি জানি না তুমি বিশেষ কি না। তুমি সেই সময়ের সব বধূর মতো শাশুড়ি-নিপীড়িতা, সব শাশুড়ির মতো বউ-কাঁটকি। সব মায়ের মতো ছেলেদের ব্যাপারে স্নেহান্ধ, মেয়েদের ব্যাপারে ভীত, তুমি সে সময়ের কলকাতা চব্বিশ-পরগনার ভাষায় আঁব, নুচি, নংকা বলতে, নেপ রোদে দিতে, নেবুর আচার করতে, কোনও অজ্ঞাত বিচারে বিলিতি আমড়ার ভক্ত থাকলেও বিলিতি বেগুন নৈব নৈব চ। টকের কাজ সারতে তেঁতুল দিয়ে, মিষ্টির কাজ সারতে গুড় দিয়ে, তোমার শিলে প্রতিদিন তিন চারটি গোলা পিষে ঘষে তৈরি হত হলুদ, জিরে, ধনে ও লংকা। এই এবং গুড়-তেঁতুল সম্বল করে তুমি অমৃত রাঁধতে তোমার কালিঝুলিমাখা রান্নাঘরে। তুমি কোনও পদ ‘বানাতে’ না, রান্না করতে কিংবা তোয়ের করতে। তোমার হেঁশেলে তরিতরকারি কোটা হত, আনাজ কাটা হত না। তুমি দইয়ে দম্বল দিতে, সাজা না, তুমি ঝোল সাঁতলাতে, ‘সম্বরা’ দিতে না। ব্রাহ্মণ-বালককে গুরুপুত্র বলে প্রণাম করতে। পইতের ওপর তোমার গভীর ভক্তি ছিল। ভক্তি করে তাকে মাছের ‘মুড়ো’ দিয়ে মুগের ডাল নামক এক নম্বর অমৃতটি খাওয়াতে। মাছের ‘মাথা’ কী জিনিস তোমার কাছে অজ্ঞাত বা অবজ্ঞাত ছিল; তুমি মাছের বিশেষত ইলিশ মাছের টক রাঁধতে ওস্তাদ ছিলে। তোমার গুরু ও গুরুপুত্র দুটি পাত চেটে চেটে পিঁপড়ের জন্য আর কিছু বাকি রাখত না। মৌরলা মাছ কুমড়ো বেগুন কখনও বা মুলো দিয়েও তুমি অম্বল রাঁধতে। মাছের টক, কিন্তু আঁবের অম্বল।

হে সর্বমঙ্গলামঙ্গল্যে শিবে সবার্থসাধিকে, তুমি দু বছর অন্তর একটি করে শাবকের জন্ম দিতে। স্তন্য দিতে দিতে সংসারের কাজ সারতে। তোমার ঘুঁটে ও গুল দেওয়া আমি স্বচক্ষে দেখেছি, এরা সংসারের প্রভূত সাশ্রয় করত। কাপড় ছিঁড়লেই তা দিয়ে ছোট ও বড় কাঁথা সেলাই করা ছিল তোমার দুপুরের অবসরযাপন। বুড়ো আঙুলে পাড় বেঁধে তা থেকে সুতোর গুছি বার করার দৃশ্যটি ভাবলে এখনও আমরা রোমাঞ্চিত হই, বড়ি আচারের একটি সাংবৎসরিক ভাঁড়ার ছিল তোমার, যা প্রায় মধুসূদনদাদার ভাঁড়ের মতো অনিঃশেষ, তোমার ছোট ছাতের কিচেন গার্ডেনের দৌলতে দু’চার দিন ভারী বৃষ্টিপাত হলে বাড়ি থেকে কারও বাজার যাবার দরকার হত না। অর্থাৎ তুমি জন্মদাত্রী, তুমি মহাপালিকা। তুমি সেবিকা হিসেবেও অনন্যা। দাদামশাই, মামারা ও মামিরা যাঁরা দুরারোগ্য রোগে মারা গেলেন তাঁদের প্রত্যেককে তুমি অনন্য মনে সেবা করেছিলে, সেই সেবার মিষ্টতা আমার যখন চিকেনপক্স হয় আমিও পেয়েছিলাম। তুমি আমাদের টালিগঞ্জের পুরনো বাড়িতে এসেছিলে যত দিন না আমার নিম হলুদ হয়। সংসারের কত টাকা তুমি তোমার পরিশ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে বাঁচিয়ে দিতে ঈশ্বর জানেন। ঈশ্বরই একমাত্র। কেননা রোজগেরে পুরুষমানুষের অন্নপানের রাজকীয় ব্যবস্থা নিজেকে এবং বউমাদের বঞ্চিত করে তুমিই করতে। টাকার অঙ্কে সবটা অনেক। মামিরা কিছু হাত-খরচ হয়তো পেতেন তাঁদের স্বামীদের কাছ থেকে, কিন্তু ভাত-কাপড় ছাড়া আর কিছু তোমাকে দেওয়ার কথা কারও মনে হয়নি। নাপিত-বউকে পুজোয় একটা শাড়ি, ছোটনাতির একটা খেলনা, প্রতিবেশী গিন্নিকে অর্থাৎ সখীকে একখানা ছাঁটা ফুলের আসন বুনে দিতে ইচ্ছে করলে টাকাটুকুর জন্য শরণার্থী হতে হত। অসীম কর্ত্রীত্বময়ী তোমার নিজের বলতে কিছু ছিল না। গহনাগুলি বউমারা মেয়েরা নাতনিরা দফায় দফায় পেয়েছে। সাচ্চা জরির বেনারসি দিয়ে বাসন কিনেছ। আর কী থাকতে পারে এক গৃহকর্ত্রীর। যোগ বিয়োগ করে হাতে সে-ই একটা ক্ষয়া পেনসিল।

হে প্রপিতামহী, সুফলা তুমি এত দিন এত দীর্ঘ সময় নিষ্ফল বেঁচেছ যে আজ তোমার জন্য সামান্য দু ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারছি না। ক্ষমা কোরো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *