সর্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে
তুষারমণ্ডিত অভ্রভেদী হিমালয় দেখিবার ইচ্ছা বহুকাল হইতে আমার হৃদয়ে নিতান্তই বলবতী ছিল, তাই আমার চিরসহচর প্রাণের বন্ধু প্রবোধচন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া আমি একদিন দার্জিলিং রওনা হইলাম।
আমরা পথে এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিলাম। আমাদের উভয়েরই মত যে, রেলে গেলে হিমালয় প্রকৃতভাবে দেখা হইবে না। রেল যেন উড়িয়া যায়, এরূপ অবস্থায় রেলে গমন করিলে হিমালয়ের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য প্রকৃত উপলব্ধি করা কোন প্রকারেই সম্ভবপর হইবে না। এই জন্য আমরা উভয়েই স্থির করিলাম যে, আমরা শিলিগুড়ি হইতে পদব্রজে দার্জিলিং রওনা হইব।
সকালে শিলিগুড়ি উপস্থিত হইলাম। যতক্ষণ দার্জিলিংএর সুন্দর ক্ষুদ্র গাড়িগুলি দৃষ্টিপথে রহিল, ততক্ষণ স্টেশনে আমরা তাহার বিচিত্ৰগতি দেখিতে লাগিলাম। তৎপরে দুই কুলির মস্তকে আমাদের দুইজনের দুই ট্রাঙ্ক চড়াইয়া দিয়া নিজ নিজ হাতে ব্যাগ ঝুলাইয়া বাজারের দিকে চলিলাম।
পথেই দুই একটি বাঙালীর সহিত দেখা হইল। আমরা বাজারেই বাসা লইব স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই তাহা করিতে দিলেন না। জোর করিয়া তাঁহাদের বাসায় লইয়া গেলেন। আমরা যাঁহার বাড়িতে উঠিলাম, তিনি এখানে শালকাঠের ব্যবসায় করেন।
সেদিন সে রাত্রি আমরা শিলিগুড়িতেই রহিলাম। সকলেই আমাদিগকে বলিলেন, পাহাড়ে হাঁটিয়া যাইতে ভারি কষ্ট হইবে, বরং গরুর গাড়ি করিয়া যান। আমরা পদব্রজে যাওয়া মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম। প্রকাশ্য সদর রাস্তা দিয়া যাইব না, তাহাও স্থির। সে রাস্তায় বহু লোক চলাচল করে, বহু গরুর গাড়ি মাল লইয়া সর্বদাই যাতায়াত করিয়া থাকে, অধিকন্তু তাহারই পার্শ্ব দিয়া রেল গিয়াছে। সুতরাং এ রাস্তায় হিমাচলের গুরুগম্ভীর সৌন্দর্য উপভোগের সুবিধা হইবে না, সুতরাং আমরা সে পথে প্রাণ থাকিতে যাইব না।
যে পথে পাহাড়ীয়াগণ চলা-ফিরা করে, সেই ক্ষুদ্র অপরিসর পথ দিয়া আমরা যাইব। তবে পাহাড়ের পথ দুৰ্গম, তাহাতে আমরা পথ চিনি না, সুতরাং আমাদের একজন পথপ্রদর্শক আবশ্যক।
অর্থে কি না হয়? আমাদের নূতন বন্ধুদিগের অনুগ্রহে, আমরা তাহাদের বিশ্বাসী একজন মহাবলবান্ ভুটিয়া পথপ্রদর্শক পাইলাম। সে তাহার তিনজন বিশ্বাসী কুলি সংগ্রহ করিল। পরদিবস অতিপ্রত্যূষে কুলির মস্তকে দ্রব্যাদি দিয়া ভগবানের নাম মনে মনে উচ্চারণ করিয়া আমরা যাত্রা করিলাম।
প্রথমে আমাদের অগ্রে—কোমরে দুই খুক্রী, হস্তে এক বৃহৎ লগুড়, ভুটিয়া থম্বিমেনা। তৎপশ্চাতে আমরা দুইজন, তৎপশ্চাতে তিনজন কুলি। আমরা মহানন্দা নদীর পোল পার হইয়া মাটিয়াখোলার হাট উত্তীর্ণ হইলাম, তৎপরে নক্সাবারীর পথ ধরিয়া চলিলাম।
পথে এক কাঁইয়ার দোকান পাইয়া তথায় রন্ধন ও ভোজনকার্য সারিয়া লইলাম। এই দুর্গম জঙ্গলেও মাড়োয়ারী মহাত্মাদিগের অভাব নাই, মধ্যে মধ্যেই দোকান, দোকানে প্রায় সর্বদ্রব্যই ক্রয় করিতে পারা যায়।
আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া আবার রওনা হইলাম। আমাদের হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য বর্ণন করিবার এখানে উদ্দেশ্য নহে, নতুবা আমরা এই রূপের শেখর শ্ৰীযুত হিমালয় মহাশয়েরর রূপ বর্ণন করিবার চেষ্টা পাইতাম। সুতরাং আমরা এ কথার উত্থাপন করিব না।
এই হিমালয়ে এমন প্রায়ই ঘটে যে কোথাও কিছু নাই অকস্মাৎ কুয়াশা উত্থিত হইয়া চারিদিক আচ্ছন্ন ও অন্ধকারময় হইয়া যায়। তখন আর কিছুই দেখা যায় না—অতি কষ্টে, অতি সাবধানে পথ অতিক্রম করিতে হয়।
আমরা যে পথে যাইতেছিলাম, তাহা অতি দুর্গম—একদিকে অতলস্পর্শী খাদ, পড়িলে সহস্ৰহস্ত নিয়ে আসীন হইতে হয়। একজনের অধিক দুইজনে পাশাপাশি যাইবার উপায় নাই। অনেক সময় হামাগুড়ি দিয়া কষ্টে উঠিতে হয়। অতিকষ্টে কুয়াশার অন্ধকার ঠেলিয়া আমরা পাহাড়ে উঠিতে লাগিলাম।
এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়—দারুণ প্রবল শীত, তাহার উপর বৃষ্টি। হিমালয়ে এই বৃষ্টি না থাকিলে বোধ হয় ইহাই ইন্দ্রের অমরাবতী ও নন্দনকানন হইত। একটা মাথা রাখিবার স্থান পাইলেই আমরা তথায় আজিকার মত বিশ্রাম করি। নিতান্ত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। কুয়াশার ভিতর দিয়া কোন দিকে যাইতেছি, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছিলাম না। আমাদের পথপ্রদর্শক বলিতেছিল যে, নিকটেই কাঁইয়ার দোকান ও বস্তি আছে। কিন্তু আমরা এক ঘণ্টা কষ্টে চলিয়াও কোন পল্লী পাইলাম না।
হিমালয়ের সন্ধ্যা আমাদের দেশের মত সহজ রকমে হয় না। সন্ধ্যা বলিয়া কোন ব্যাপার এখানে নাই। সহসা না বলিয়া কহিয়া অবাধ্য মেয়ের মত যেন একেবারে তিমিরবসনা নিশা হিমালয়কে নিজের কৃষ্ণাঞ্চলে ঢাকিয়া দেয়। আজ ইহা স্বচক্ষে দেখিলাম। অনুভব করিলাম, সহসা চারিদিক ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হইল। আর কিছু দেখিবার উপায় নাই।
আমাদের পথপ্রদর্শক উচ্চৈঃস্বরে নানাবিধ শব্দ করিতে করিতে চলিল, আমরা তাহার গলার স্বর অনুসরণ করিয়া হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া চলিলাম। একটু পা পিছলাইলেই গিয়াছি আর কি—ভয়াবহ মৃত্যু। এখন আমরা বুঝিলাম, আমাদের শিলিগুড়ির বন্ধুগণ হিতবাদী বটেন। কিন্তু—মরণকালেতে রোগী যদি ঔষধ না খায়—গতানুশোচনায় আর ফল কি?
সহসা পথপ্রদর্শক দাঁড়াইল, আমরাও স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। তখন বুঝিলাম, সে নিজেই অন্ধকারে পথ হারাইয়াছে—গ্রামের পথে না গিয়া অন্য পথে আসিয়াছে, দুর্গম পাহাড়ের দুর্গমতম স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে—কোনদিকে কোথায় যাইবে, স্থির করিতে পারিতেছে না। সে নিজে এ কথা স্বীকার না করিলেও তাহার গলার স্বরে আমাদের বেশ উপলব্ধি হইতেছিল।
তখন আমাদের হৃদয়ের ভিতর হৃদয় বসিয়া গেল। বুঝিলাম, এই পাহাড়ের দুর্গম জঙ্গল মধ্যেই আজ রাত্রি কাটাইতে হইবে। তাহাতে বড় কিছু যায় আসে না—তবে পতিত হইয়া চূর্ণবিচূর্ণ না হইলেই এক্ষণে ভগবানের অসীম দয়া।
থম্বিবেনা বলিল, ‘ফিরিয়া এই পথে একটু নামিয়া গেলেই একটা বস্তি পাইব।’
অগত্যা তাহাই করা শ্রেয় ভাবিয়া আমরা ফিরিলাম। কিন্তু কয়েক পদ যাইবামাত্র আমি একটা গড়ানে স্থানে আসিলাম। তাহার পর কি হইল, ঠিক মনে নাই। আমি গড়াইতে গড়াইতে কতদূর চলিলাম, তাহাও মনে নাই। এইমাত্র বুঝিলাম, আমার লম্বা কোট দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া বন্ধুবর প্রবোধচন্দ্রও ঠিক আমার গতি অনুকরণ করিয়া আমার অনুসরণ করিতেছে। শব্দে বুঝিলাম, গুণবন্ত থম্বিবেনারও সেইরূপ দশা—গড়াইয়া আসিতেছে।
সহসা কিসে লাগিয়া আমাদের অধঃপতনের গতি বন্ধ হইল। স্পর্শে বুঝিলাম, কি একটা কাষ্ঠনির্মিত দ্রব্যে আমাদের বেগ নিরোধ হইয়াছে। পকেটে দেশলাই ও বাতি ছিল, জ্বালিলাম।
সেই অন্ধকারে দীপালোকেও ভাল দেখা যায় না।
আলোটা উচ্চে তুলিয়া দেখিলাম, সেটা একখানা কাষ্ঠনির্মিত ঘর। আমরা তিনজনই সেই গৃহের কাষ্ঠনির্মিত প্রাচীরপার্শ্বে পতিত। আমরা কষ্টে-সৃষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
যাহা হউক, প্রাণটা যে বাজেখরচ হয় নাই, ইহাই ভাল! সম্ভবতঃ আশ্রয় মিলিবে। এ গৃহে যেই থাকুক না কেন এ অবস্থায় আশ্রয় দিতে কখনও অসম্মত হইবে না। আমরা আলো ধরিয়া ধরিয়া গৃহের দ্বারে আসিলাম। দরজা বন্ধ।
আমি দরজায় করাঘাত করিলাম—কেহ উত্তর দিল না। এবার আমি আরও বেশিরকম শব্দ করিয়া সবলে করাঘাত করিলাম, তবুও কেহ উত্তর দিল না। তখন আমি দরজা ঠেলিয়া খুলিয়া ফেলিলাম, কড় কড় শব্দ করিয়া দরজা খুলিয়া গেল। ভিতরে বাহির হইতেও অন্ধকার।
আমি আলো লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম—প্রবোধ ও ঘষিবেনা আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল। কিন্তু তৎপরে এক অভূতপূর্ব ব্যাপার ঘটিল। থম্বিবেনা বিকট চিৎকার করিয়া উঠিল, তৎপরে ছুটিয়া অন্ধকারে অন্তর্হিত হইল। আমরা উভয়ে বিস্মিত হইয়া তাহাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলাম, কিন্তু অন্ধকার হইতে কেবল একটা ভীতিব্যঞ্জক আর্তরব আমাদের কর্ণে প্রবেশ করিল, আমরা কেবলমাত্র সেই শব্দের এইমাত্র বুঝিলাম
‘শয়তান কা ঔরত।’
প্রবোধ বলিল, বোধ হয় এখানকার লোকের বিশ্বাস, এই বাড়িতে ভূত আছে—পাহাড়ীমাত্রেই ভূত বড় বিশ্বাস করে। যাহাই হউক, খাদে পড়িয়া যে আজ প্রাণটা যায় নাই, এইজন্য ভগবানকে ধন্যবাদ দিই। শীতে বুক গুর্ গুর্ করিতেছে। এ আশ্রয়ও ভগবান মিলাইয়া দিয়াছেন। এখন কাঠকুটা সংগ্রহ করিয়া আগুন জ্বালা যাক। আলো দেখিলে কুলি দুইটা আর গুণবন্ত থম্বিবেনা প্রাণের দায়ে এখানে আবার ফিরিয়া আসিতে পথ পাইবে না।
আমরা বাহিরে আলো লইয়া কতকগুলা শুষ্ক ডালপালা সংগ্রহ করিলাম, তৎপরে তাহা জ্বালাইয়া গৃহমধ্যে আগুন করিলাম। আগুনে হাত সেঁকিয়া কতকটা প্রকৃতিস্থ হইলাম। আমাদের ব্যাগে সর্বদাই আমরা কিছু-না-কিছু আহার্য রাখিতাম। প্রবোধ তাহাই বাহির করিয়া প্রবলবেগে ভোজন আরম্ভ করিল। আমি বলিলাম, ‘আগে ঘরটা ভাল করিয়া দেখা যাক্।’ প্রবোধ বলিল, ‘আগে প্রাণে বাঁচলে তো আর সব, ক্ষুধায় প্রাণ যায়। এই পাহাড়ে শীতে আর এই পাহাড়ে রাস্তায় যেন ক্ষুধা হাজার গুণ বাড়িয়া উঠে।’ অগত্যা আমরা উভয়ে সেই আগুনের পাশে বসিয়া কিছু আহার করিয়া লইলাম।
আহার শেষ হইলে উভয়ে বাতি লইয়া ঘরটি ভাল করিয়া দেখিতে চলিলাম, একটি ঘর নহে পাশাপাশি দুইটি ঘর। গৃহমধ্যে নানাবিধ তৈজসপত্র পড়িয়া আছে। দেখিলেই বোধ হয়, শেষে যাহারা এই বাড়িতে ছিল, তাহারা যে কারণেই হউক, হঠাৎ এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে। তাহাদের অনেক জিনিসপত্র পড়িয়া আছে, লইয়া যাইবার সময় হয় নাই—তাড়াতাড়ি যে চলিয়া গিয়াছে, এই ঘরের অবস্থা দেখিলে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না।
একটা বাক্সও ঘরের কোণে পড়িয়া আছে।—দেখিলাম, ডালা খোলা। তুলিয়া দেখি, তাহার ভিতরে অনেকগুলি নানা তারিখের বাংলা চিঠি রহিয়াছে।
এই দুর্গম স্থানে এই নির্জন বাড়িতে তাহা হইলে পূর্বে কোন বাঙালী বাস করিয়াছিল। কে সে? এত স্থান হইতে এখানে আসিয়াছিল কেন? দারুণ কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া আমরা বাতিটি সেই বাক্সের উপর রাখিয়া পত্রগুলি একে একে পাঠ করিতে লাগিলাম। যখন সর্বশেষ পত্রখানির পা শেষ হইল, তখন নিম্ন হইতে সেই অন্ধকার আলোড়িত করিয়া এক হৃদয়বিদারক উচ্চ আর্তনাদ উঠিতে লাগিল। সমস্ত রাত্রিই এই ভয়াবহ শব্দ আমাদের কানে আসিতে লাগিল। ইহা আমাদের বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা না কোন মুনষ্যের আর্তনাদ, তাহা কেবল ভগবান বলিতে পারেন। আমরা এইমাত্র বলিতে পারি যে, আমরা সমস্ত রাত্রি সেই গৃহমধ্যে জাগিয়া বসিয়া রহিলাম, ভয়ে চক্ষু মুদিত করিতে সাহস করিলাম না।
যে সকল পত্র আমরা পাঠ করিলাম, তাহার প্রথমখানি এই—
প্রথম পত্র
প্রিয় সুরেশ
কলিকাতার সেই সোরগোল অশান্তির মধ্য হইতে পলাইয়া আসিয়া এই নির্জন পাহাড় মধ্যে এই স্থানে আমি যে কি শান্তি অনুভব করিতেছি, তাহা বলিতে পারি না। আর লোকালয়ে থাকিব না। লোকালয়ে থাকিলে আর আরাম হইতে পারিব না, এইজন্য এই দুর্গম স্থানে আশ্রয় লইয়াছি। আমার মস্তিষ্ক যেরূপ উষ্ণ হইয়াছিল—তাহা আর নাই, আমি এখন শান্তচিত্তে চিন্তা করিতে পারিতেছি। আর এই স্থানের ন্যায় চিন্তা করিবার স্থান দ্বিতীয় আর কোথায়?
আমার এই বাড়ি পর্বতের মাঝামাঝি স্থাপিত, পশ্চাতে স্তরে স্তরে পর্বতশ্রেণী আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়া গিয়াছে সম্মুখে একটু আগে একেবারে মহা-খাদ, দুই সহস্র হাত নিম্নে একটি নদী রজতসূত্রের ন্যায় দেখিতে পাওয়া যায়।
এ বাড়িখানিতে দুইটি মাত্র ঘর। ঘর বলিতে চাও, আর যাহা বলিতে চাও, তাহাই ইহাকে বলা যায়। কতকগুলি শালকাঠ জোড়া দিয়া প্রাচীর নির্মিত হইয়াছে—চালও ওই শালকাঠে জোড়া। এখানে শালকাঠের অভাব নাই, চারিদিকেই শালকাঠ—কাটিয়া লইলেই হইল। আমার সঙ্গে চাকর-বাকর নাই, চেষ্টা করিয়াও পাই নাই। প্রায় দুই ক্রোশ দূরে একটা ভুটিয়া বস্তি আছে, সেখানে সপ্তাহে একদিন হাট হয়। হাটের দিন সকালে রওনা হইয়া আমার দরকার মত দ্রব্যাদি লইয়া সন্ধ্যার সময় ফিরি।
সময় কাটাইবার জন্য একখানা খুব বড় উপন্যাস লিখিতেছি। বোধ হয়, তাহাতেই আমি জগদ্বিখ্যাত হইব।
আমি একজন লোক পাইয়াছি। রাত্রে সে কিছুতেই এ বাড়িতে থাকিতে চাহে না। তা না থাকুক ক্ষতি নাই। দিনেই সমস্ত কাজকর্ম সারিয়া চলিয়া যায়, সুতরাং আমার স্ত্রীকে আর পূর্বের ন্যায় খাটিতে হইতেছে না।
এই নির্জন দুর্গম স্থানে থাকিতে সে সম্পূর্ণ নারাজ হইয়াছিল। আমিই বুঝাইয়া রাখিয়াছি, লোকালয়ে থাকিলে আমার রোগ আরাম হইবার আশা নাই। এই কথা বলায় সে সম্মত হইয়াছে।
রাত্রে সে পার্শ্বের ঘরে নিদ্রা যায়—আমি সম্মুখের ঘরে বসিয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই প্রকাণ্ড উপন্যাসখানা লিখি।
তোমার মন্মথ।
দ্বিতীয় পত্র
( দ্বিতীয় পত্র কেবল সেই উপন্যাসের কথা এবং সেই উপন্যাসের প্রশংসার ভাগই অধিক।)
তৃতীয় পত্র
প্রিয় সুরেশ।
তোমাকে দুইখানা পত্র লিখিয়াছি, এইখানা লইয়া তিনখানা হইবে, কিন্তু কোনখানাই এখনও ডাকে দিতে পারি নাই। ডাকঘর প্রায় দশ ক্রোশ দূরে। পত্র তিনখানা ডাকে দিবার জন্য এখনও কোন লোক সংগ্রহ করিতে পারি নাই। তাহার একটা গুরুতর কারণ আছে। সহজে এ বাড়ির নিকট কেহ আসিতে চাহে না, অধিক পয়সা দিতে চাহিলেও না। আগে ইহার কারণ জানিতে পারি নাই, একদিন এক বৃদ্ধকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সেই বৃদ্ধ আমাকে এ রহস্যের বর্ণনা করিল। ব্যাপার এই—
সোহো বলিয়া একটা লোক এই কুটীর নির্মাণ করে। সে ভুটিয়াদিগের মধ্যে একজন কবি বলিয়া গণ্য ছিল। সে নির্জনে বাস করিবার ইচ্ছা করিয়াই এই দুর্গম স্থানে এই কুটীর নিমাণ করিয়াছিল। এখানে সে নিজের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে লইয়া বাস করিত।
সুখেই তাহাদের দিন কাটিতেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ নিকটস্থ এক ব্যক্তির একটি ভুটিয়া যুবতী সেই নিভৃত নিবাসী কবির প্রেমে পড়িল। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, এই কুটীরে দুইটি ঘর। যখন গভীর রাত্রে পার্শ্বের গৃহে সোহোর যুবতী স্ত্রী নিদ্রা যাইত, সেই সময়ে এই যুবতী তাহার পার্শ্বে বসিয়া মৃদু কণ্ঠে প্রেমালাপ করিত।
একদিন রাত্রে তাহার স্ত্রী সমস্তই জানিতে পারি, কিন্তু কোন কথা কহিল না।
এই যুবতীকে এই কুটীরে আসিতে হইলে একটা কাঠের সাঁকো পার হইয়া আসিতে হইত। এই সাঁকোর প্রায় পাঁচশত হাত নিম্নে এক ঝরণা বা ঝোরা। প্রবলবেগে সেই ঝরণা দিয়া জল পড়িত বলিয়া ভুটিয়ারা ইহার নাম ‘পাগলা ঝোরা’ রাখিয়াছে। প্রত্যহ রাত্রে এই ঝরণার উপরের সাঁকো দিয়া সেই যুবতী যাতায়াত করিত।
একদিন সোহো গৃহে না থাকায় তাহার স্ত্রী সুবিধা পাইয়া সেই সাঁকোর কাঠ একদিক্ টাঙ্গি দিয়া কাটিয়া রাখিয়া আসিল। এমন সামান্যমাত্ৰ সাঁকোর কাঠ পাহাড়ে সংলগ্ন রহিল যে, মনুষ্যভার পড়িলেই তাহা নিশ্চিত পতিত হইবে।
তাহাই ঘটিল। সে রাত্রে পূর্বের ন্যায় সোহো প্রণয়িনীর প্রতীক্ষা করিতেছে, সহসা তাহার কর্ণে এক মর্মভেদী আর্তনাদ প্রবেশ করিল। তাহার পরই প্রকাণ্ড কাঠ ও পাথরের পতনের শব্দ আসিল, তাহার প্রণয়িনী পাঁচ শত হস্ত নিম্নে পাগলা ঝোরায় বিসর্জিত হইয়াছে।
কে এ কাজ করিয়াছে, তাহা সোহোর বুঝিতে বিলম্ব হইল না। ইহার ফলে একদিন সোহো ও তাহার স্ত্রী উভয়েই গভীর খাদে পতিত হইল।
সোহো তাহার স্ত্রীর গলা টিপিয়া তাহাকে হত্যা করিতে চেষ্টা পাইয়াছিল। কিন্তু ভুটিয়া স্ত্রীলোকদিগের দেহে অসীম বল, সোহোর স্ত্রী তাহাকে টানিতে টানিতে খাদের নিকট লইয়া আইসে, তথাপি সোহো তাহার গলা হইতে হাত অপসারিত করিল না। তাহার স্ত্রীর চক্ষু কপালে উঠিল, তাহার জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িল, তবুও সে তাহার স্বামীকে ছাড়িল না। উভয়ে দুই সহস্র হাত নিম্নে গিয়া চূর্ণবিচূর্ণ হইল।
এতদূর বলিয়া বৃদ্ধ ভুটিয়া বলিল, সেই পর্যন্ত সোহোর প্রণয়িনী সোহোর বাড়িতে প্রেত হইয়া আইসে। ভিতরে আলো দেখিলে সে দরজায় আঘাত করে। তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করিতে না দেয়, এমন সাধ্য কাহারও নাই। অনেকে এই বাড়িতে বাস করিতে ইচ্ছা করিয়াছে, কিন্তু এ বাড়িতে যে বাস করে, তাহারই মৃত্যু হয়।
এই জন্যই এই সোহো-প্রণয়িনীর ভূতের জন্য কেহ সাহস করিয়া এখানে আসে না। আমার দ্রব্যাদি হাট হইতে আমাকেই নিজে আনিতে হয়, এই জন্যই এ পর্যন্ত পত্র ডাকে পাঠাইতে পারি নাই।
তোমার মন্মথ।
চতুর্থ পত্র
প্রিয় সুরেশ
দেশে হইলেও এ কথা আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম। বোধ হয় অর্ধঘন্টার মধ্যেই একথা একেবারেই ভুলিয়া যাইতাম। কিন্তু এই নির্জন দুর্গম স্থানে ভূতের কথা সহজে বিস্মৃত হওয়া যায় না।
রাত্রে—অনেক রাত্রি পর্যন্ত—বসিয়া আমার সেই বিরাট উপন্যাসখানা আমি প্রত্যহ লিখিয়া থাকি, কিন্তু বৃদ্ধ ভুটিয়ার নিকট এই কথা শোনা পর্যন্ত রাত্রে আমার লেখা একরূপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তুমি শুনিলে নিশ্চয়ই মনে মনে হাসিবে, কিন্তু সত্য গোপন করাও ঠিক নহে, প্রকৃতই সেই দিন হইতে রাত্রে লিখিতে লিখিতে মধ্যে মধ্যে লেখা বন্ধ করিয়া আমি কান পাতিয়া শুনিতাম, দরজায় কেহ ঘা মারিতেছে কিনা। যথার্থ-ই কি আমার মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে। ইহারই মধ্যে যেন সোহো-প্রণয়িনী আমার স্কন্ধে ভর করিয়াছে! হাসিও না, এই নির্জন দুর্গম লোকশূন্য স্থানে সকলই সম্ভব। তোমার সেখানে যাহা হাস্যজনক, এখানে তাহা ভীতিপ্রদ।
কাল যাহা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমারও যে বুদ্ধিভ্রংশ হইতেছে, মাথা খারাপ হইয়া আসিতেছে, তাহা আমারই নিজের বিশ্বাস হইয়াছে।
সন্ধ্যার সময়ে আমি কুটীরের বাহিরে বেড়াইতেছি। বেড়াইতে বেড়াইতে সেই ভগ্ন সাঁকোর নিকট আসিয়া দাঁড়াইলাম। উকি মারিয়া সাঁকোটার নিম্নস্থ পাগলা ঝোরা দেখিতেছিলাম, সহসা মাথা তুলিয়া দেখিলাম, দূরে সুন্দর বনফুলে সজ্জিত একটি পাহাড়িয়া যুবতী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
তখন চারিদিক ধীরে ধীরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছিল। এখানে এ কুটীরের এত নিকটে এ-পর্যন্ত আমি কোন স্ত্রীলোক বা পুরুষ জনপ্রাণী দেখিতে পাই নাই। এখান হইতে লোকালয় দুই ক্রোশের নিকটে নহে। রাত্রে এই দুর্গম পথ দিয়া কাহারও গমন করা সম্ভব নহে।
তবে তরুণী কে? এ এখনও এখানে কেন? আমি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কণ্ঠ পরিষ্কারের অব্যক্ত শব্দ করিলাম, তথাপি সে নড়িল না। আমি ডাকিলাম, তবুও সে নড়িল না। এই দুর্গম পর্বতে আমার গলার শব্দ তাহার নিকট পৌঁছিতেছে না ভাবিয়া, আমি তাহাকে হাত নাড়িয়া ডাকিলাম। তখন সে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশিয়া গেল। —আমি গৃহের দিকে ফিরিলাম, আমার শিরায় শিরায় যেন কে বরফের প্রবাহ ছাড়িয়া দিল। কেন আমার এ ভাব হইল তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তবে কি মনুষ্য নহে, এই কি সেই সোহো-প্রণয়িনী?
তোমার মন্মথ।
পঞ্চম পত্র
( পূর্বোক্ত পত্রের এগার দিন পরে লিখিত। )
প্রিয় সুরেশ
যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। সে আসিয়াছে। আমি যেদিন সন্ধ্যাকালে তাহাকে পর্বতমধ্যে দেখিয়াছিলাম, সেই দিন হইতে হৃদয়ের সহিত বিশ্বাস করিয়াছিলাম, সে নিশ্চয়ই একদিন আসিবে।
কাল রাত্রে সে আসিয়াছে। আমরা উভয়ে উভয়ের চোখের দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ বসিয়াছিলাম।
তুমি নিশ্চয়ই বলিবে, আমি উন্মত্ত হইয়াছি—আমার রোগ সারে নাই, এখনও সেই জ্বর আছে, তাই সে জ্বরের প্রকোপে বিকৃতমস্তিষ্কে কল্পনায় আমি এই প্রেতাত্মা দেখিতেছি।
তুমি বলিবে কেন। আমি নিজেকেই নিজে এ-কথা অনেকবার বলিয়াছি, এ সকল সত্য ও সে আসিয়াছে। কি সে? রক্তমাংসের দেহধারিণী নারীমূর্তি অথবা আকাশের প্রাণী—বায়ুমূর্তি—আমার কল্পনার সৃষ্টি? যাহাই হউক, তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না। আমার নিকট ইহা কল্পনা নহে, বায়ু নহে, আকাশ নহে, মিথ্যা নহে। সত্য—অতি সত্য!
গত রাত্রে সে আসিয়াছিল। আমার স্ত্রী পাশের ঘরে নিদ্রিতা, আমি অনেক রাত্রি পর্যন্ত সম্মুখের ঘরে বসিয়া সেই উপন্যাসখানা লিখিতেছিলাম। এই সময়ে সে আসিয়া উপস্থিত হইল।
প্রত্যহ রাত্রে আমি ইহার প্রতীক্ষা করিয়াছি—দ্বারে মৃদু করাঘাতের শব্দ শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে অপেক্ষা করিয়াছি, ইহার আসার আশায় প্রতিক্ষণে ব্যাকুল হইয়াছি। এখন আমি আমার মনের এ অবস্থা বেশ বুঝিতে পারিতেছি।
আমি সাঁকোর উপর ইহার পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছি, তিনবার দরজায় আঘাত সুস্পষ্ট শুনিতে পাইয়াছি—তিনবার মাত্র।
ইহাতে আমার কঙ্কালের ভিতর যেন তীক্ষ্ণ তুষারধারা প্রবাহিত হইয়াছে, মস্তিষ্কে একরূপ অব্যক্ত বেদনা অনুভব করিয়াছি, আমি সবলে আমার বুক চাপিয়া ধরিয়াছি, তবুও সেই শব্দ, সেই দ্বারে আঘাত,—তিনবার মাত্র। আমি উৎকর্ণ হইয়া শুনিয়াছি।
আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। ধীরে ধীরে গিয়া পার্শ্ববর্তী গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম—দ্বারে শিকল টানিয়া দিলাম। তৎপরে উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। আবার সেই শব্দ—সেই দ্বারে আঘাত, তিনবার—তিনবার মাত্র।
তখন আমি গিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া দিলাম—অতিশীতল বায়ু প্রবলবেগে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া আমার কাগজপত্র কতক উল্টাইয়া, কতক গৃহতলে ছড়াইয়া দিল। রমণী গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল, আমি নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম।
সে তাহার মস্তক হইতে শাল সরাইয়া স্কন্ধে ফেলিল, কণ্ঠদেশ হইতে একখানা রঙিন রুমাল খুলিয়া পার্শ্বে রাখিল, তাহার পরে আমার সম্মুখে আগুনের কাছে আসিয়া বসিল। আমি দেখিলাম, তাহার উন্মুক্ত পা দু’খানি তখনও শিশিরসিক্ত রহিয়াছে। আমি তাহার সম্মুখে বসিলাম, বিস্ফারিত নয়নে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। সে আমার দিকে চাহিয়া মৃদু মধুর হাসিল—সে হাসি মধুর, অথচ বিস্ময়কর, যেন ধূর্ততা শঠতা তাহাতে মাখা। সেই হাসিতে আমি আত্মহারা হইলাম। আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইল, আমি তাহাকে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত—সর্বত্যাগী হইতে প্রস্তুত।
সে কথা কহিল না, নড়িলও না। আমি তাহার কথা শুনিবার কোন আবশ্যকতা মনে করিলাম না। সেই বিলোল চোখ, সেই চপল দৃষ্টি, তাহাই যেন আমার সহিত কত প্রাণের কথা কহিতে লাগিল। সে আমার দিকে চাহিয়া আছে, আমি তাহার দিকে চাহিয়া আছি—তাহার চক্ষু আমার চক্ষুর সহিত—আমার চক্ষু তাহার চক্ষুর সহিত পরস্পর সম্মিলিত—সে আনন্দ সে সুখ—সে যে কি, তাহা বর্ণনা করিবার ক্ষমতা আমার নাই।
আমি কতক্ষণ এইরূপভাবে বসিয়াছিলাম বলিতে পারি না। সহসা সে নিজের বুকের কাছে একটা হাত তুলিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত কান পাতিয়া কি শুনিতে লাগিল। তখনই পার্শ্বস্থ গৃহ হইতে একটা অতি মৃদু শব্দ কানে আসিল। অমনি সেই অপরিচিত বামা সত্বর সেই শালখানা তাহার মাথায় টানিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তৎপরে অতি দ্রুতপদে দরজা খুলিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল— যাইবার সময় দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া গেল।
আমি ভিতরের ঘরের শিকল খুলিয়া কান পাতিয়া শুনিলাম, কোন শব্দ নাই। তখন আমি ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। তাহার পর বোধ হয়, সেই স্থানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।
ঘুম ভাঙিবামাত্র আমার মনে হইল যে, রমণী রাত্রে রুমালখানি লইয়া যাইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। সে যেখানে বসিয়াছিল, তাহার চলিয়া যাইবার পরও আমি তথায় রুমালখানি দেখিয়াছিলাম। তাই ঘুম ভাঙিবামাত্র সেখানা লুকাইয়া রাখিব বলিয়া সেই দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, রুমাল তথায় নাই। —আমার স্ত্রী ঘর ঝাঁট দিয়া সমস্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়াছে, আমার চাএর জল গরম করিতেছে। সে আমার দিকে দুই এক বার চাহিল—আমি তাহাকে এমন করিয়া চাহিতে আর কখনও দেখি নাই। কিন্তু সে কোন কথা কহিল না—রুমালের কথাও কিছু বলিল না।
তাহাতেই আমার মনে হইল যে, আমি স্বপ্ন দেখিয়াছি মাত্র। কাল রাত্রে যাহা সত্য ভাবিয়াছিলাম, তাহা আর কিছু নহে, স্বপ্নমাত্র। কিন্তু অপরাহ্ণে আমি একবার বাহির হইতে দেখিলাম, আমার স্ত্রী সেই রুমালখানি হাতে লইয়া বিশেষ করিয়া দেখিতেছে। তাহার মুখ অপর দিকে ছিল, সুতরাং সে আমাকে দেখিতে পাইল না। —আমি স্পষ্ট দেখিলাম, সে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া রুমালখানা দেখিতেছে।
আমি কতবার মনে করিলাম যে, রুমালখানা আমার স্ত্রীরই। কাল রাত্রে যাহা দেখিয়াছি, তাহা সমস্তই আমার কল্পনা—স্বপ্ন মাত্র। আর তাহা যদি না হয়, তবে কাল রাত্রে যে আসিয়াছিল, সে প্রেতাত্মা নহে—প্রকৃতই কোন স্ত্রীলোক।
কিন্তু মানুষ মানুষে চিনিতে পারে, বুঝিতে পারে। কাল রাত্রে যে আমার সম্মুখে বসিয়াছিল, সে রক্তমাংসের কোন জীব নহে—ইহা আমি বেশ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলাম।
সম্ভবত সে কোন স্ত্রীলোক হইতে পারে। এখান হইতে দুই ক্রোশের মধ্যে কোন বস্তি বা লোকালয় নাই। দিনেই এই পার্বত্য পথে চলা-ফেরা বিপজ্জনক—রাত্রে অসম্ভব। কোন্ স্ত্রীলোক অন্ধকার রাত্রে এই ভয়াবহ কঠিন পর্বত পথে আসিতে সাহস করিবে? তাহাতে ঘোর অন্ধকার, দারুণ শীত—কোন স্ত্রীলোকের এই দুর্গম স্থানে, এ কুটীরে আগমন একেবারেই অসম্ভব।
আরও কারণ— কোন্ স্ত্রীলোকের উপস্থিতিতে শিরায় শিরায় অস্থিমজ্জায় গলিত তুষারস্রোত প্রবাহিত হয়?
যাহাই হউক, সে যেই হউক, সে যদি একবার আসে, তাহা হইলে তাহার সহিত কথা কহিব। আমি হাত বাড়াইয়া তাহাকে ধরিব। তাহা হইলেই দেখিতে পাইব, সে রক্তমাংসের জীব, না বায়ু—কেবল কল্পনা, কেবল শূন্য, একটা ছায়ামাত্র।
তোমার মন্মথ।
ষষ্ঠ পত্র
প্রিয় সুরেশ
এই সকল পত্র কখনও যে তুমি পাইবে, সে আশা আমার নাই। আমি এখান হইতে এ সকল চিঠি তোমাকে পাঠাইব না। তোমার নিকট এ সকল পাগলের পাগলামি, উন্মত্তের প্রলাপ ব্যতীত আর কিছুই বোধ হইবে না। যদি কখনও দেশে ফিরি তাহা হইলে হয়তো কোনদিন-না-কোনদিন এই সকল পত্র তোমায় দেখাইতে পারি, তাহাও শীঘ্র নহে। যখন আসিয়া এই সব লইয়া হাস্য বিদ্রূপ করিতে পারিব, কেবল সেই সময়েই তোমায় এ সকল পত্র দেখাইব। এখন আমি এগুলি লিখিতেছি, আমার মনের যাতনায়। এগুলি এইরূপে না লিখিলে হয়তো আমাকে চিৎকার করিয়া মনের যাতনা লাঘব করিতে হইত।
সে প্রত্যহ রাত্রে আসে, সেইরকম আগুনের কাছে বসে, সেইরকম আমার দৃষ্টির সহিত দৃষ্টিবিন্যাস করে—সেই কুহকিনী মৃদুমধুর হাসি হাসে—আমার মস্তিষ্ক ঘোরতররূপে বিচঞ্চল হইয়া উঠে, আমি আত্মহারা হই—আমার অস্তিত্ব যেন তাহার মধ্যে লীন হইয়া যায়।
এখন আমার লেখা সম্পূর্ণ-ই বন্ধ হইয়া গিয়াছে—লিখিবার চেষ্টাও করি না। আমি সাঁকোর উপর তাহার শুভাগমনের পদশব্দ—ঘাসের উপর পদশব্দ—দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দ শুনিবার জন্য ব্যাকুলচিত্তে উৎকর্ণ হইয়া থাকি।
সে আসিলে সেই ভাব—আমি আর কথা কহিতে পারি না—আমি আর আমাতে থাকি না—কোন কথাই আর মনে হয় না—সেও কোনকথা কহে না, কেবল সেইরূপভাবে চাহিয়া থাকে, সেইরূপ হাসি হাসে।
প্রত্যহ আমি মনে করি, আজ সে আসিলে আমি নিশ্চয়ই তাহার সহিত কথা কহিব, নিশ্চয়ই তাহাকে স্পর্শ করিব। কিন্তু সে আসিবামাত্র আমি সকলই ভুলিয়া যাই, আমার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া যায়।
কাল রাত্রে যখন আমি তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিলাম, সেই সময়ে ক্রমে ক্রমে আমার মন তাহার অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হইয়া গেল, তাহার ওষ্ঠ ঈষৎ উন্মুক্ত হইল, সে চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আমি পার্শ্ববর্তী কক্ষের গবাক্ষের দিকে চাহিলাম, চাহিবামাত্র বোধ হইল, কে জানালা হইতে সহসা মুখ সরাইয়া লইল। এইদিকে নিমেষমধ্যে সে শাল মস্তকে টানিয়া দ্রুতপদে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমি আলো লইয়া পার্শ্বের গৃহে গেলাম। দেখিলাম, আমার স্ত্রী নিদ্রিতা রহিয়াছে।
তোমার মন্মথ।
সপ্তম পত্র
প্রিয় সুরেশ
রাত্রির জন্য আমি ভীত নহি, দিনের জন্যই ভীত। যে স্ত্রীলোককে আমি আমার স্ত্রী বলিয়া আসিতেছি, তাহাকে আমি প্রাণের সহিত এখন ঘৃণা করি। সে ঘৃণার ইয়ত্তা নাই—সীমা নাই—অন্ত নাই। তাহার যত্ন শ্রদ্ধা সোহাগ সমস্তই এখন বিষবৎ বোধ হয়। কি জানি, কেন তাহার চোখের দিকে চাহিলে আমি শিহরিয়া উঠি।
সে সকলই দেখিয়াছে, সকলই জানিতে পারিয়াছে, আমি ইহা বেশ বুঝিতেছি। —তাহাই কি?
অথচ সে আমাকে এখনও ভালোবাসে, যত্ন পূর্ববৎ, অনুরাগ পূর্ববৎ—ভক্তি পূর্ববৎ। তথাপি আমার মনে হইতেছে সমস্ত জাল, সমস্ত মিথ্যা, সমস্তই ছলনা, প্রতারণা—আমরা পরস্পরে প্রণয় ভালোবাসা জানাইতেছি—অথচ সব জাল, সব মিথ্যা, সব ছলনা। আমি জানি, সে সব দেখিয়াছে, সব জানিয়াছে, তাহার চোখ আমাকে ইহা স্পষ্ট বলিয়া দিতেছে। আমি জানি, সে কেন এই ভীষণ প্রতিহিংসার আয়োজন করিতেছে।
তোমার মন্মথ।
অষ্টম পত্র
প্রিয় সুরেশ
আজ সকালে হাটে যাইব বলিয়া আমি বাহির হইলাম। আমার স্ত্রী দরজায় দাঁড়াইয়া রহিল, ক্রমে আমি তাহার দূরবর্তী হইতে লাগিলাম। পরে একবার চাহিয়া দেখি, দূর হইতে আমার স্ত্রীকে একটি ক্ষুদ্র পুত্তলিকার ন্যায় দেখাইতেছে। অবশেষে পর্বত বেষ্টন করায় আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।
তখন আমি উঠিতে উঠিতে পড়িতে পড়িতে মহাবেগে ছুটিয়া অন্য পথ দিয়া গৃহের দিকে আসিতে লাগিলাম। পার্বত্যপথ সহজ নহে, কত উঠিয়া পড়িয়া তবে অন্যদিক দিয়া আমার গৃহের নিকট আসিলাম। তথায় এক বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের পার্শ্বে লুক্কায়িত থাকিয়া আমার গৃহপ্রতি সতর্কদৃষ্টি রাখিলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, আমার স্ত্রী এক টাঙ্গি লইয়া কাঠের সাঁকোর নিকট আসিল। আমি যেখানে ছিলাম, তথা হইতে, সে কি করিতেছে, তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম না। কিয়ৎক্ষণ পরে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। সেই দূর হইতেও আমি তাহার মুখে হাসি লক্ষ্য করিলাম—কিন্তু মনে হইল, সে হাসির ভিতরে প্রতিহিংসার বহ্নি ধক্ ধক্ জ্বলিতেছে।
সে গৃহে চলিয়া গেলে আমি আবার হাটের দিকে চলিলাম। হাট হইতে সন্ধ্যার সময় গৃহে ফিরিলাম, সে আমাকে পূর্বের ন্যায় সমাদরে গৃহে অভ্যর্থনা করিয়া লইল।
আমি যে তাহার ভয়াবহ কার্য দেখিয়াছি, তাহা ঘুণাক্ষরে তাহাকে জানিতে দিলাম না। তাহার শয়তানী কার্য ওইরূপই থাক। সে ভাবিয়াছে, কোন স্ত্রীলোক রাত্রে সাঁকো পার হইয়া আমার সহিত প্রেমালাপ করিতে আসে, তাই সে সাঁকো কাটিয়া রাখিয়া আসিয়াছে। আজ সে আসিলে অতল খাদ-নিম্নে পতিত হইয়া যাইবে।
আমি কিছু বলিলাম না। ইহাতে আজ সপ্রমাণ হইবে যে, প্রত্যহ রাত্রে আমার কাছে যে আসে—সে কে। যদি সে প্রেতাত্মা হয়, তাহা হইলে ভগ্নপ্রায় সেতুতে তাহার কোন অনিষ্ট ঘটিবে না, আর যদি সে প্রকৃতই কোন স্ত্রীলোক হয়, তাহা হইলে—
আমি এ চিন্তা প্রাণ হইতে দূর করিলাম। ভাবিতেও আমার সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল।
যদি প্রকৃতই মানবী হয়, তাহা হইলে কথা না কহিয়া কেবলই আমার দিকে চাহিয়া থাকে কেন? আমিই বা কেন তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি না। কেন তাহার সম্মুখে আমার অস্তিত্ব নষ্ট হইয়া যায়। নিশ্চয়ই মানবী নহে। আমার স্ত্রী তাহার কোন অনিষ্টই করিতে পারিবে না। হতভাগিনী প্রতিহিংসার এই ব্যর্থ চেষ্টায় আরও জ্বলিয়া অস্থির হইবে। —বেশ হইবে।
কিন্তু যদি সে প্রেতলোকবাসিনীই হইবে, তবে আমি তাহার পদশব্দ শুনিতে পাই কেন? কেনই বা তাহার পায়ে স্পষ্ট শিশিরের দাগ দেখিতে পাই—কেনই বা তাহার দ্বারে আঘাত শব্দ শুনিতে পাই? এ সকল তো প্রেতের চিহ্ন নহে।
রাত্রি হইয়াছে, পূর্বের ন্যায় পার্শ্বের ঘরে আমার স্ত্রী ঘুমাইতেছে। আমি একান্তমনে গৃহে বসিয়া উৎকর্ণ হইয়া তাহার পদশব্দের প্রতীক্ষা করিতেছি।
যদি সে প্রেতাত্মা হয়, তাহা হইলে সে পূর্বের ন্যায় আমার কাছে আসিবে, আর যদি সে যথার্থ-ই কোন স্ত্রীলোক হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সাঁকো হইতে পড়িবার সময়ে আর্তনাদ শুনিতে পাইব। অথবা কোন প্রেতলোকের অজানিত কুহকজালে আমাকে ঘেরিয়া ফেলিতেছে! সহসা একি— একি এ প্রেতাত্মার বিদ্রুপ!
আমি শুনিয়াছি—আমি সেই ভয়াবহ আর্তনাদ এইমাত্র শুনিয়াছি, হৃদয়ভেদী—গগনভেদী আর্তনাদ আমি শুনিয়াছি।
আকাশ পাতাল প্রকম্পিত করিয়া, অন্ধকাররাশি আলোড়িত করিয়া সেই ভয়ানক আর্তনাদ সাঁকোর নিকট হইতে উত্থিত হইল, সেই গভীর খাদমধ্য হইতে উত্থিত হইয়া পর্বতের শৃঙ্গে শৃঙ্গে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। সে আর্তনাদের বর্ণনা নাই। সে আর্তনাদ এখনও আমার কর্ণপথ দিয়া আমার শিরায় শিরায় শোণিতের সহিত ছুটিতেছে।
আমি গৃহ হইতে সবেগে বাহির হইলাম। সাঁকোর নিকটে আসিলাম। শুইয়া পড়িয়া হাত বাড়াইয়া দেখিলাম, সাঁকো আর নাই।
নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, ঘোর অন্ধকার—সেই গভীর গহ্বর ঘোর অন্ধকারে পূর্ণ— কিছু দেখিবার উপায় নাই!
প্রবলবেগে বাতাস বহিতেছে। আমি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া ডাকিলাম। সেই প্রবল বাতাসে আমার উচ্চ প্রবল চিৎকার যেন পৈশাচিক হাস্যকল্লোলের ন্যায় দিগ্বলয় কম্পিত করিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।
আমি বুঝিতেছি। এতদিন যে উন্মত্ততা ধীরে ধীরে আমাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে, আর কোন উপায় নাই—চেষ্টা বৃথা—বৃথা—বৃথা—
আমি কতবার মনে মনে বলিতেছি, এ কেবল আমার বিকৃত অসুস্থ পীড়িত মস্তিষ্কের কল্পনামাত্র—এ আর্তনাদও আমার কল্পনামাত্র। —না—না—না—ওই সেই শব্দ! ওই সেই আর্তনাদ! ওই সেই মর্মভেদী আর্তনাদ!
প্রতিক্ষণে আমার মস্তিষ্কে কে যেন গুরুভার লোহার হাতুড়ি দিয়া নির্দয় আঘাত করিতেছে। আমি বুঝিয়াছি সে আর আমার কাছে আসিবে না।—এই শেষ!
তোমার মন্মথ।
শেষ পত্র
প্রিয় সুরেশ
আমি একটা বড় খামে সমস্ত পত্রগুলি রাখিয়া তোমার ঠিকানা লিখিয়া যাইব। যদি কখনও কেহ এইখানে আসে, তাহা হইলে সে হয়তো তোমাকে এই পত্র পাঠাইয়া দিতে পারে।
আমার লেখাপড়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমরা—আমি আর আমার স্ত্রী—তোমাকে বুঝাইবার জন্য যাহাকে এখনও আমার স্ত্রী বলিতে হইতেছে—আমরা উভয়ে মুখোমুখি হইয়া বসিয়া থাকি, কেহ কোন কথা কহি না। এ এক অতি আশ্চর্য পরিবর্তন।
যখন কথা কহি, তখন এইরূপভাবে কথা কহি, যেন আমাদের উভয়ের এই প্রথম দেখা সাক্ষাৎ হইয়াছে। যে দুই একটা কথা কহি, তাহাও আমাদের পরস্পর মনের ভাব গোপন করিবার জন্য—আমাদের উভয়ের কেহই আর পূর্বের মত নাই। আমি সর্বদাই তাহার মুখে বিদ্রূপের হাসি দেখিতেছি। —সে ইহা গোপন করিতে চেষ্টা পায়, কিন্তু আমি ইহা দেখিতেছি। তাহার চেষ্টা বৃথা!
প্রত্যহ রাত্রে নির্জনে বসিয়া থাকিতে থাকিতে মনে হয়, যেন সে পূর্বের ন্যায় দ্বারে আঘাত করিতেছে, আমি সত্বর গিয়া দরজা খুলিয়া দিই, কিন্তু কই, কেহ নাই, কেবল অন্ধকার—সেই অন্ধকারের ভিতর দিয়া গৃহ মধ্যে বাহিরের কতকটা শীতল বাতাস প্রবেশ করে মাত্র—আর কিছুই না।
এই দুর্গম স্থানে বাস করিয়া আমি দানব হইয়াছি। ভালোবাসা ও ঘৃণা দুইই ভয়াবহভাবে আমার হৃদয়ে উদ্বেলিত হইয়া আমার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ ছুটাইয়াছে, আমার মস্তকে শত চিতানল জ্বালাইয়া দিয়াছে। আমার লেখাপড়া, শিক্ষা, সদ্গুণ,— সমস্ত এই পাহাড়ের বাতাসে যেন আমার হৃদয় হইতে উড়িয়া গিয়াছে! আমি হিংস্র পশু হইয়াছি।
কবে ইহার—এই স্ত্রীলোকের, যে এক সময়ে আমার স্ত্রী ছিল, তাহার কুসুমকোমল কণ্ঠদেশ আমার এই রোগশীর্ণ কঙ্কালসার কঠিন অঙ্গুলি দ্বারা সবলে পেষণ করিব—তাহার চমৎকার চক্ষু ধীরে ধীরে মুদিত হইয়া আসিবে, তাহার ওষ্ঠাধর উন্মুক্ত হইবে—তাহার আরক্ত জিহ্বা লতাইয়া পড়িবে, কবে তাহার গলা ধীরে ধীরে, জোরে জোরে, আরও জোরে টিপিতে থাকিব। দেরি নাই—দেরি নাই—দেরি নাই! তাহার পর ধীরে ধীরে তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে পশ্চাতে ঠেলিতে ঠেলিতে এই কুটীর হইতে লইয়া যাইব—এই বন্ধুর কঠিন পাথরের উপর দিয়া লইয়া যাইব—এই খাদের নিকট আনিব। সে বড় বিদ্রুপের হাসি হাসিয়াছিল বটে! এবার হাসির পালা আমার! হো-হো-হো—
আমি জোর করিয়া তাহাকে ধীরে ধীরে ঠেলিয়া লইয়া যাইব, ধীরে ধীরে আদর করিয়া—এই খাদের ধারে যখন তাহার পায়ের একটিমাত্র অঙ্গুষ্ঠ পাহাড়ে থাকিবে—সে হেলিয়া পড়িবে তখন আমি তাহার দিকে অবনত হইয়া তাহার আরক্ত অধর চুম্বন করিব। —তাহার পর নিম্নে—নিম্নে—নিম্নে—কুয়াশার মধ্য দিয়া, লতাপাদপগুল্ম ভেদ করিয়া, পশুপক্ষীকে স্তম্ভিত করিয়া—নিম্নে—নিম্নে—গভীরতর নিম্নে—দুইজনে একত্রে যাইব—যাইব—যাইব—যাইব—যতক্ষণ না তাহার সহিত মিলিত হই—’
(এই পত্ৰ অসম্পূর্ণ)
এই শেষ পত্র—এই ভয়াবহ পত্র কয়েকখানি পাঠ করিয়া আমি প্রবোধের মুখের দিকে চাহিলাম, সেও আমার মুখের দিকে চাহিল। আমি তাহার মুখে যে ভাব দেখিলাম, সে বোধ হয় আমার মুখে তাহাই দেখিল। আমি দেখিলাম, প্রবোধের মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গিয়াছে।
আমরা উভয়ে কেহ কাহারও সহিত কথা কহিতে সাহস করিলাম না। উভয়েরই হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতেছিল।
সংসারে এই ভয়াবহ ব্যাপার যে ঘটিতে পারে, তাহা আমাদের বিশ্বাস ছিল না। আমাদের পথপ্রদর্শক থম্বিবেনা ‘শয়তান কা ঔরত’ বলিয়া যে ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করিয়া পলাইয়াছে, এখন বুঝিলাম, তাহার যথেষ্ট কারণ আছে।
এতদিন ভূতপ্রেতের কথা বিশ্বাস হয় নাই। ভূতপ্রেত হউক বা না হউক, পত্রলেখক মন্মথ এই নিভৃত স্থানে বাস করিয়া ভূতের কথা ভাবিয়া ভাবিয়া ভয়ঙ্কর উন্মত্ত হইয়া গিয়াছিল। সেই উন্মত্ততায় হতভাগ্য আপনার স্ত্রীকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছে, নিজেও মরিয়াছে। তাহার প্রমাণ এই সকল পত্র।
ভোর হইতে-না-হইতে আমরা সে স্থান হইতে পলাইলাম। রামোচন্দ্র! আর সেখানে এক মিনিট থাকে! বস্তিতে আসিয়া আমাদের দুই কুলি ও থম্বিমেনাকে পাইলাম। আমরা যে সেই গৃহে রাত্রিযাপন করিয়া এখনও জীবিত আছি, ইহা দেখিয়া তাহারা বিস্মিত হইয়া আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
আমরা দার্জিলিং পৌঁছিয়া পত্রগুলি সমস্ত কমিশনার সাহেবকে দিলাম। শুনিয়াছি, তাঁহার আজ্ঞায় এই ভয়াবহ কুটীরটা একদিন জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে।