সর্বনাম

কর্তা– আমি আমরা, তুমি তোমরা, আপনি আপনারা, সে তারা, তিনি তাঁরা, এ এরা, ইনি এঁরা, ও ওরা, উনি ওঁরা, কে কারা, যে যারা, কি কিসব কোন্‌গুলো, যা যা’সব যেগুলো, তা সেইসব সেইগুলো।

কর্ম– আমাকে আমাদের তোমাকে তোমাদের (দিগকে), আপনাকে আপনাদের, তাকে তাদের, তাঁকে তাঁদের, একে এদের, এঁকে এঁদের, ওঁকে ওঁদের, কাকে কাদের, কোন্‌টাকে কোন্‌গুলোকে, যাকে যাদের, যেটাকে যেগুলোকে, সেটাকে সেগুলোকে।

করণ– আমাকে দিয়ে, তাকে দিয়ে, কোন্‌টাকে দিয়ে, ইত্যাদি। কেন, কিসে, কিসে কোরে, কি দিয়ে; যাতে, যাতে কোরে, যা দিয়ে; তাতে, তাতে কোরে, তা দিয়ে ইত্যাদি।

অপাদান– আমার চেয়ে এটা ভালো, আমা হতে এ হবে না, আমার থেকে ও বড়ো, এটার চেয়ে, ওটা থেকে ইত্যাদি।

সম্বন্ধ– আমার তোমার তার এগুলোর ওগুলোর ইত্যাদি।

অধিকরণ– আমাতে তোমাতে, এটাতে ওটাতে, আমায় তোমায়, আমাদের মধ্যে, এগুলোতে ইত্যাদি। এখন তখন যখন কখন, এমন তেমন কেমন যেমন অমন, অত তত যত, এখানে যেখানে সেখানে।

বাংলায় কথার ভাষা আর লেখার ভাষা নিয়ে যে তর্ক কিছুকাল চলছে আপনি আমাকে সেই তর্কে যোগ দিতে ডেকেছেন। আমার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত বলে এ কাজে আমি উৎসাহ বোধ করছি নে। সংক্ষেপে দুই-একটা কথা বলব।

কর্ণ অর্জুন উভয়ে সহোদর ভাই হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যখন জাতিভেদ ঘটেছিল, একজন রইল ক্ষত্রিয় আর-একজন হ’ল সূত, তখনি দুই পক্ষে ঘোর বিরোধ বেধে গেল। বাংলা লেখায় আর কথায় আজ সেই দ্বন্দ্ব বেধে গেছে। এরা সহোদর অথচ এদের মধ্যে ঘটেছে শ্রেণীভেদ; একটি হলেন সাধু, আর-একটি হলেন অসাধু। এই শ্রেণীভেদের কারণ ছিলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। সে কথাটা খুলে বলি।

এক সময়ে বাংলায় পদ্য সাহিত্যই একা ছিল; গদ্য ছিল মুখে; লেখায় স্থান পায় নি। পদ্যের ভাষা কোনো এক সময়কার মুখের ভাষার কাছ-ঘেঁষা ছিল সন্দেহ নেই– তার মধ্যে “করিতেছিলাম’ বা “আমারদিগের’ “এবং’ “কিম্বা’ “অথবা’ “অথচ’ “পরন্তু’র ভিড় ছিল না। এমন-কি, “মুই’, “করলুঁ’ “হৈনু’ “মোসবার প্রভৃতি শব্দ পদ্য ভাষায় অপভাষা বলে গণ্য হয় নি। বলা বাহুল্য, এ-সকল কথা কোনো এক সময়ের চলতি কথা ছিল। হিন্দী সাহিত্যেও দেখি কবীর প্রভৃতি কবিদের ভাষা মুখের কথায় গাঁথা। হিন্দীতে আর-একদল কবি আছেন, যাঁরা ছন্দে ভাষায় অলংকারে সংস্কৃত ছাঁদকেই আশ্রয় করেচেন। পণ্ডিতদের কাছে এঁরাই বেশি বাহবা পান। ইংরেজিতে যাকে ড়শষথথভড়বশনড়ড় বলে এ জিনিসটা তাই। হিন্দী প্রাকৃত যথাসম্ভব সংস্কৃত ছদ্মবেশে আপন প্রাকৃতরূপ ঢাকা দিয়ে সাধুত্বের বড়াই করতে গিয়েচে। তাতে তার যতই মান বাড়ুক-না কেন, মথুরার রাজদণ্ডের ভিতর ফুঁ দিয়ে সে বৃন্দাবনের বাঁশি বাজাতে পারে নি।

যা হোক, যখন বাংলা ভাষায় গদ্যসাহিত্যের অবতারণা হল তার ভার নিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। দেশের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে প্রতিদিন যে গদ্য বাণী প্রবাহিত হচ্চে তাকে বহুদূরে রেখে সংস্কৃত সরোবর থেকে তাঁরা নালা কেটে যে ভাষার ধারা আনলেন তাকেই নাম দিলেন সাধুভাষা। বাংলা গদ্য সাহিত্যিক ভাষাটা বাঙালির প্রাণের ভিতর থেকে স্বভাবের নিয়মে গড়ে ওঠে নি, এটা ফরমাসে গড়া। বাঙালির রসময় রসনাকে ধিক্কার দিয়ে পণ্ডিতের লেখনী বলে উঠল গদ্য আমি সৃষ্টি করব। তলব দিলে অমরকোষকে মুগ্ধবোধকে। সে হল একটা অনাসৃষ্টি। তার পর থেকে ক্রমাগতই চেষ্টা চলচে কি ক’রে ভাষার ভিতরকার এই একটা বিদ্‌ঘুটে অসামঞ্জস্যটাকে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগর তাকে কিছু পরিমাণে মোলায়েম ক’রে আনলেন– কিন্তু বঙ্গবাণী তবু বললেন “এহ বাহ্য”। তার পরে এলেন বঙ্কিম। তিনি ভাষার সাধুতার চেয়ে সত্যতার প্রতি বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তখনকার কালের পণ্ডিতেরা দুই হাত তুলে বোপদেব অমরের দোহাই পেড়েছিলেন। সেই বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাও আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হয়ে এসেচে– এখনকার সাহিত্যে ঠিক সে ভাষার স্রোত চলচে না। অর্থাৎ বাংলা গদ্যসাহিত্যের গোড়ায় যে একটা ষক্ষভফভশতর ড়ভশ ঘটেছে কেবলি সেটাকে ক্ষালন করতে হচ্চে। কৌলিন্যের অভিমানে যে একটা হঠাৎ সাধুভাষা সর্বসাধারণের ভাষার সঙ্গে জল-চল বন্ধ ক’রে কোণ-ঘেঁষা হয়ে বসেছিল, অল্প অল্প ক’রে তার পঙ্‌ক্তিভেদ ভেঙে দেওয়া হচ্চে। তার জাত যায়-যায়। উভয় ভাষায় কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে অসবর্ণ বিবাহ হতে শুরু হয়েচে। এখন আমরা চলিত কথায় অনায়াসে বলতে পারি “ম্যালেরিয়ায় কুইনীন ব্যবহার করলে সদ্য ফল পাওয়া যায়।’ পঞ্চাশ বছর আগে লোকের সঙ্গে ব্যাভার ছাড়া ব্যবহার কথাটা অন্য কোনো প্রসঙ্গেই ব্যবহার করতুম না। তখন বলতুম, “ম্যালেরিয়ায় কুইনীনটা খুব খাটে।’ আমার মনে আছে, আমার বাল্যকালে আমাদের একজন চাকরের মুখে “অপেক্ষা’ কথাটা শুনে আমাদের গুরুজনরা খুব হেসেছিলেন। কেননা, কেউ অপেক্ষা করচেন, এ কথাটা তাঁরাও বলতেন না– তাঁরা বলতেন “অমুক লোক তোমার জন্যে বসে আছেন।’ আবার এখানকার লেখার ভাষাতেও এমনি করেই মুখের ভাষার ছাঁদ কেবলি এগিয়ে চলছে। এক ভাষার দুই অঙ্গের মধ্যে অতি বেশি প্রভেদ থাকলে সেই অস্বাভাবিক পার্থক্য মিটিয়ে দেবার জন্যে পরস্পরের মধ্যে কেবলি রফা চলতে থাকে।

এ কথা সত্য ইংরেজিতেও মুখের ভাষায় এবং লেখার ভাষায় একেবারে ষোলো-আনা মিল নেই। কিন্তু মিলটা এতই কাছাকাছি যে পরস্পরের জায়গা অদলবদল করতে হলে মস্ত একটা লাফ দিতে হয় না। কিন্তু বাংলায় চলতি ভাষা আর কেতাবী ভাষা একেবারে এপার ওপার– ইংরেজিতে সেটা ডান হাত বাঁ হাত মাত্র– একটাতে দক্ষতা বেশি আর-একটাতে কিছু কম– উভয়ে একত্র মিলে কাজ করলে বেমানান হয় না। আমি কোনো কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের ডিনার-টেবিলের আলাপ শুনেছি, লিখে নিলে ঠিক তাঁদের বইয়ের ভাষাটাকেই পাওয়া যেত, অতি সামান্যই বদল করতে হত। এই জাতিভেদের অভাবে ভাষার শক্তিবৃদ্ধি হয় আমার তো এই মত। অবশ্য মুখের ব্যবহারে ভাষার যে ভাঙ্‌চুর অপরিচ্ছন্নতা ঘটা অনিবার্য সেটাও যে লেখার ভাষায় গ্রহণ করতে হবে আমি তা মানি না। ঘরে যে ধুতি পরি সেই ধুতিই সভায় পরা চলে কিন্তু কুঁচিয়ে নিতে একটু যত্নের প্রয়োজন হয়, আর সেটা ময়লা হলে সৌজন্য রক্ষা হয় না। ভাষা সম্বন্ধেও সেই কথা।

আশ্বিন-কার্তিক, ১৩২৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *