1 of 2

সরোজনলিনী দত্ত

অর্থভাণ্ডারে মূল্যবান সামগ্রী লইয়া মানুষ গর্ব করে। কিন্তু তাহার চেয়ে বড়ো কথা স্মৃতিভাণ্ডারের সম্পদ। সেই মানুষই একান্ত দরিদ্র যাহার স্মৃতিসঞ্চয়ের মধ্যে অক্ষয় গৌরবের ধন বেশি কিছু নাই।

তাই সরোজনলিনীর জীবনী পড়িয়া বুঝিলাম জীবনীলেখক তাঁহার স্বামী শ্রীযুক্ত গুরুসদয় দত্ত যথার্থই ভাগ্যবান। কারণ এরূপ স্ত্রীকে মৃত্যুর মধ্যে হারাইয়াও হারানো সম্ভব নহে; শুভাদৃষ্টক্রমে যিনি তাঁহাকে নিকটে পাইয়াছেন তাঁহার জীবনের মধ্যেই তিনি চিরদিন জীবিত থাকিবেন। বইখানি পড়িয়া আমার মনে এই খেদ হইল যে, তাঁহার সঙ্গে একবার ক্ষণকালের জন্য আমার দেখা হইয়াছিল, তাঁহার সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ আমার ঘটে নাই।

সাধারণত আমরা যখন খাঁটি বাঙালির মেয়ের আদর্শ খুঁজি তখন গৃহকোণচারিণীর ‘পরেই আমাদের দৃষ্টি পড়ে। গৃহসীমানার মধ্যে আবদ্ধ যে সংকুচিত জীবন তাহারই সংকীর্ণ আদর্শের বহুবেষ্টনরক্ষিত উৎকর্ষ দুর্লভ পদার্থ নহে। তাহার উপাদান অথবা, তাহার ক্ষেত্র অপ্রশস্ত, তাহার পরীক্ষা অপেক্ষাকৃত অকঠোর।

সরোজনলিনী বাহির সংসারের ভিড়ের মধ্যেই অধিকাংশ জীবন কাটাইয়াছেন, অনেক সময় বিদেশী সমাজের অতিথি বন্ধুদের লইয়া তাঁহাকে সামাজিকতা করিতে হইয়াছে, তাঁহার কর্মজীবনের পরিধি আত্মীয়স্বজন বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যেই অবরুদ্ধ ছিল না; তাঁহার সংসার আত্মীয় অনাত্মীয়, স্বদেশী বিদেশী, পরিচিত অপরিচিত অনেক লোককে লইয়া। এই তাঁর বড়ো সংসারের মধ্যে সকলের সঙ্গে সম্বন্ধকে তিনি মাধুর্যের দ্বারা শোভন ও ত্যাগের দ্বারা কল্যাণময় করিয়াছিলেন। এইরূপ ক্ষেত্রেই নারী জীবনের যথার্থ পরিচয় ও পরীক্ষা। তাঁহার কাছে বাহিরের দ্বারা ঘর ও ঘরের দ্বারা বাহির পরাহত হয় নাই। এই উভয়ের সুন্দর সমন্বয়েই তাঁহার মহিমা প্রকাশিত হইয়াছে। আজকালকার দিনে নারী একান্তভাবেই গৃহিণী তিনি আমাদের আদর্শ নহেন, ঘরে বাহিরে সর্বত্রই যিনি কল্যাণী তিনিই আদর্শ, যাঁহার জীবন কেবলমাত্র চিরাগত প্রাদেশিক প্রথা ও সংস্কারের ছাঁচে ঢালা তিনি আদর্শ নহেন কিন্তু যাঁহার মধ্যে বৃহৎ বিশ্বের জ্ঞান ও ভাবের বিচিত্র ধারা গভীর ও সুন্দরভাবে সংগতি লাভ করিতে বাধা না পায় তিনিই আদর্শ।

সরোজনলিনীর জীবনী পড়িয়া আমরা এই আদর্শের পরিচয় পাইলাম।

২০ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *