প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

সরে শোও

সরে শোও

গল্পে শোনা।

সেকালের এক কর্তার, বিছানায় এঁকেবেঁকে শোওয়ার অভ্যাস ছিল। যখন শুলেন তখন বেশ সভ্যভব্য। চিৎ। পরিপাটি বালিশে মাথা। দুটি হাত বুকের দুপাশ বেয়ে উঠে বুকের মাঝখানে আঙুলে-আঙুল নিয়ে ভগবৎ চিন্তায় ব্যস্ত। তখনকার কালের নিয়মই ছিল, সারাদিন যা পারো অপকর্ম করে নাও। শোওয়ার সময় মন তোমার স্থির করতেই হবে। ইষ্টদেবীকে চোখের সামনে রেখে, নাম করতে-করতে নিদ্রার কোলে ঢুলে পড়ো। হাই উঠলে হাঁ-করা মুখের সামনে ঠাসঠাস করে তুড়ি বাজাও।

এই তুড়ি বাজানোর একটা বৈজ্ঞানিক, শব্দটা মনে হয় ঠিক হল না, ব্যবহারিক দিক আছে। তখনকার মানুষ যা করতেন সবই করতেন বেশ প্রাণ খুলে, মেজাজ দিয়ে। যেমন হাঁচি। বার-বাড়িতে কর্তা অ্যায়সা জোরে হাঁচলেন, প্যাঁট করে কাপড়ের কষি ফেঁসে গেল। গিন্নি কোলের বাচ্চাকে দাওয়ার রোদ থেকে খাটে তুলে শোওয়াতে যাচ্ছিলেন, হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। বড় বউ সাঁড়াশি দিয়ে ধরে উনুন থেকে এক ডেকচি দুধ নামাচ্ছিলেন, হাত আলগা হয়ে পড়ে গেল। কর্তার কর্তা গেলাসের জলে ফোঁটা-ফোঁটা করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ঢালছিলেন, ধ্যারধ্যার করে সবটাই জলে নেমে এল। গোয়ালে গুরুর দুধ দোয়া হচ্ছিল, বাঁট ছুঁড়ে, বালতি উলটে, দড়ি ছিঁড়ে, খোঁটা উপড়ে, গরু দৌড়োতে লাগল মাঠ ভেঙে। ছাদের বোমায় এক ঝাঁক পায়রা বসেছিল। ফড় ফড় করে উড়ে গেল আকাশের দিকে। সেখানে লাট খাচ্ছে, ডিগবাজি মারছে। রকের পাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল কুকুর। লাফিয়ে উঠে দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাজ গুটিয়ে। ভয়ে-ভয়ে তাকাচ্ছে। কর্তা আবার হাঁচবেন, তারই প্রস্তুতি চলছে। মুখ ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠছে। চাঁদমারীর কামানের মতো। মেজর হাঁচি শুনে বড় বললেন, নাক নয়ত, গাদা বন্দুক। ফোর্টে যেন তোপ দাগছে! হাঁচির আবার টেলপিস থাকত। শেষের দিকটা এক একজন, এক এক ভাবে খেলাতেন। অন্যে সেটা উপভোগ করতেন। এখনকার কালে এ সবই হল গ্রাম্য—অসভ্যতা। একালের শিক্ষিত শহুরে অসভ্যতা আবার অন্যরকম। সে কথা পরে বলা যাবে।

হাঁচির মতো হাইও ছিল মারাত্নক। হাওয়ার টানে হাঁ খুলছে। যাকে বলে মুখ-ব্যাদন। যে তিমির হাঁ। হাঁচি যেমন ঝটাস করে হয়ে যায়, হাই তা হয় না। দীর্ঘমেয়াদী প্রলম্বিত ব্যাপার। ওই জন্যে বলে, হাই উঠছে। উঠবে এবং নামবে। তখনকার কালে মশামাছির উপদ্রব এখনকার কালের মতো না থাকলেও, ছিল। একালে অবশ্য খুবই বেড়েছে। বৃদ্ধি মানেই প্রগতি। একটা কিছু অন্তত বাড়ুক। মশা বাড়ুক, মাছি বাড়ুক, ডাকাত বাড়ুক, ডাকাতি বাড়ুক, শান্তি না বাড়ুক অশান্তি বাড়ুক। ওই হাঁ-মুখে যাতে মশামাছি না ঢোকে সেই জন্যেই সিংহ-দরজার প্রবেশ পথে টুসকি মারার বিধান চালু ছিল।

এই হাই প্রসঙ্গটাকে আর একটু টানা যাক। মনেই যখন পড়েছে তখন যতটা পারা যায় বলে দেওয়াই ভালো। হাই হল শরীরের এক ধরনের আক্ষেপ। হাই তোলার নানারকম শব্দ এবং অন্তভঙ্গি জীবজগতে চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। যেমন কান্না। শব্দ হবেই। তবে চেষ্টা করলে রেগুলেট করা যায়। শিশু কেঁদে বাড়ি মাথায় করে ঠিকই, তবে যত বয়েস বাড়ে কান্নার তাড়স, তড়কা, আক্ষেপ বিক্ষেপ কমতে থাকে। বয়েসে মানুষ শুকিয়ে যায়। পড়ে থাকে সামান্য ফোঁপানি, দু-ফোঁটা চোখের জল। বুড়োমদ্দ কখনও শিশুর আবেগে ঠ্যাং ছড়িয়ে, মাথা দুলিয়ে হাঁউহাঁউ করে কাঁদবে না। কাঁদতে পারবে না। মহিলারা (অবশ্যই সেকালের) শেষ পুতুল ভাঙা কান্না শৈশব পেরিয়ে আর একবারই কাঁদতেন মৃত স্বামীর বুকে মাথা রেখে। শেষ বর্ষণ। তারপরই তো শুরু হয়ে যেত খরার দিন। সেকালের হিন্দু বিধবার জীবনে তো ছায়া ছিল না!

হাই আর হাঁচির দাপট কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে হাঙড়ায় হয়ে ওঠে। হাওয়ার খেলা তো। হাঁচি ছাড়ছে। হাই টানছে। হাঁচির গতিবেগ আর পাইপগান থেকে ছোঁড়া গুলির গতিবেগ প্রায় সমান।

শুয়ে-শুয়ে কর্তা হাই তোলার কথা বলতে গিয়ে হাঁচি, কাশি, হাই, কান্না কত কী এসেগেল। এই হল বাঙালির দোষ। ধান ভানতে শিবের গীত গাইবেই। মাঘ থেকে শীত, শীত থেকে বসন্ত, বসন্ত থেকে জলবসন্ত, সেখান থেকে মাগ, ছেলে, লিভার, পিলে। বাঙালি বক্তার বক্তৃতা এই ভাবেই এগোয়। আমার কথা নয়, রসিক উপেন্দ্রনাথের নিরীক্ষা।

আমার গল্পের এই কর্তাটির হাই আর হাঁচি, দুটোই খুব মারাত্মক। ইনি যখন দাঁড়িয়ে হাই তুলতেন তখন হাত দুটো ধীরে-ধীরে মাথার ওপর উঠে যেত। শরীর টানটান হয়ে নর্তকের শরীরের মতো ডাইনে বামে দুলত। মুখে এক ধরনের উঁয়া, উঁয়া শব্দ হত। এই হাত তোলার ফলে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে যেত। একবার ডাক্তারখানায় বসে এমন হাই তুললেন, মাথার অনেক ওপরের র‌্যাক থেকে যাবতীয় সিরাপ মিরাপ, ভিটামিন ফিটামিন সব পড়ে গেল। গিয়েছিলেন পেটের দাওয়াইয়ের জন্যে, ফিরে এলেন মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে। আর একবার এমন হাই তুললেন শিকে থেকে উলটে পড়ে গেল ইলিশমাছের কড়া। শেষ হাই তুলেছিলেন ভায়রাভাইয়ের বাড়িতে। সেবার হাসপাতাল যেতে হয়েছিল। পাখার ঘূর্ণায়মান ব্লেডে হাত লেগে আঙুল ছেতরে গেল। সেই থেকেই ভারি সচেতন। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ওই কর্মটি কদাচিৎ করেন। এখন হয় বসে, না হয় শুয়ে।

ঘুম আসার আগে গোটাদুই আদুরে হাই ওঠে। মুখের কাছে আলতো টুসকি মারেন, আর জড়ানো গলায় বলতে থাকেন, কই গো, তোমার হল। দূরে চলে যাওয়া রেলগাড়ির শব্দের মতো কইগো, তোমার হল কথাটি অস্পষ্ট হতে হতে, শেষে ফুড়ুত ফুড়ুত নাক ডাকায় মিলিয়ে গেল। এইবার শুরু হল কর্তার খেল। তিনি কখনও ডাঁয়ে, কখনও বামে বেঁকতে লাগলেন। খেলতে লাগলেন, স্বপ্নে দ্যাখা ফুটবলে লাথি হাঁকড়াতে লাগলেন, পুকুরে ঢিল ছুঁড়তে লাগলেন। শয্যায় তাঁর সেই দাপটে শয্যাসঙ্গিনী প্রায়শই খাট থেকে দুম করে মেঝেতে পড়ে যেতেন।

একদিন তিনি সাহস করে স্বামীকে ঠেলা মেরে বললেন, ওগো, শুনচ, একটু সরে শোও। বাস, আর যায় কোথায়! সে যুগের মানুষের রাগেও একটা আদর্শ ছিল। রাগের একটা ইজ্জত ছিল। সতীত্ব ছিল।

রাত ঝিমঝিম। কর্তা বিছানা থেকে নামলেন। গায়ে জামা চড়ালেন। কি হতে চলেছে বোঝার আগেই, কর্তা দরজা খুলে একবারে রাস্তায়। সারাদিনের খাটুনির ক্লান্তি, স্ত্রী ঘুমজড়ানো চোখে শুনতে লাগলেন, একপাল কুকুর ডাকতে ডাকতে বহু দূরে চলে যাচ্ছে।

পনেরো দিন পরে একটি পোস্টকার্ড এল, পাঞ্জাব অব্দি সরেছি, আর কি সরতে হবে? কে উত্তর দেবে? যাকে এই প্রশ্ন, সে তখন শোকে ভাবনায় এত দূরে চলে গেছে যেখানে পৃথিবীর ডাক পৌঁছোয় না।

1 Comment
Collapse Comments

KON CHHOTOBELAY PORA. AJO SOMAN BHALO LAGLO.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *