সরস কলকাতা
এবার আমার বিদায় গাথা লেখার কথা। আমি কয়েকমাস থাকব না সেই কথা জানাতে চাই।
একদা বলতাম ‘যাই’।
মা-ঠাকুরমা বলতেন, ‘যাই বলতে নেই, বলো আসি।’
এখন আর মা-ঠাকুমাও নেই, যাওয়া-আসাও নেই। তবু যেতে হয়, আমি তো শক্তি কবি নই যে বলব, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?’
যাচ্ছি। আপনারা অনুগ্রহ করে ছুটি মঞ্জুর করবেন।
আগের পর্বে সরস কবিতার কথা লিখেছি। তখন লক্ষ করেছিলাম গত শতকের সরস কবিতার একটা বড় অংশ কলকাতাকে বিষয় করে।
বিদায় বেলায় কয়েক গুচ্ছ সরস কলকাতা নিবেদন করছি।
প্রথমেই মহাগুরু কালীপ্রসন্ন সিংহকে স্মরণ করি—
‘আজব শহর কলকেতা।
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি
মিথ্যে কথার কি কেতা।।
হেথা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে…’
গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটকে কলকাতা নিয়ে অনেক রঙ্গ আছে। এককালে লোকের ঠোঁটে গুনগুন করত,
‘রানী মুদিনীর গলি,
সরাপের দোকান খালি,
যত চাও তত পাবে
পয়সা নেবে না।
ঠোঙা করে শালপাতাতে
চাট ফেরে হাতে হাতে,
তেল মাখা মটর ভাজা
মোলাম বেদানা।’
অমৃতলাল বসুর শনিবারের বারবেলা চমৎকার,
ঝি-রা ঘুমুলো পাড়া জুড়ালো
জল ফুরুল কলে।
বাজিয়ে শাঁক ডাকায় নাক,
সাজের বাতি জ্বলে।
সরস কলকাতায় শরৎচন্দ্র পণ্ডিতমশায়কে স্মরণ না করা অনুচিত হবে। তাঁর ‘কলকাতা কেবল ভুলে ভরা, সেথায় বুদ্ধিমানে চুরি করে, বোকায় পড়ে ধরা।…ধাঁধায় পড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াই হাটে- মাঠে, একদিন দেখতে যাব নিমের গাছটি নিমতলার ওই ঘাটে।’
অবশেষে মহাকবি হেমচন্দ্রকে স্মরণ করে আমি এবারের মতো বিষয়ান্তরে যাচ্ছি।
মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শহর বন্দনা লিখেছিলেন, ‘হুতোম প্যাঁচার গান।’
এ হুতোম প্যাঁচা টেকচাঁদ ঠাকুর নন, মহাকবি হেমচন্দ্র স্বয়ং।
কলির শহর কলকাতা বিষয়ে হেমচন্দ্র লিখেছেন,
‘কলির শহর কলকাতাটির
পায়ে নমস্কার
যার জাঁক জমকে ভাগীরথীর
দুধার গুলজার।…
তোর ভজন-গুণে ভোজন কালে
সব হাঁড়ি সমান,
ও তোর কেষ্ট ভজা, বেম্মাচাচা,
হিঁদু মুসলমান।’…
পুনশ্চ: চোখের জলে ভেজা, বেদনা বিধুর বাঙালি হৃদয়ের খুব কাছের একটা গান, বারবার আমাদের জীবন ছুঁয়ে যায়,
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি
অভিরামের দীপান্তর মাগো
ক্ষুদিরামের ফাঁসি।’
ক্ষুদিরাম-অভিরাম কোনও সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ নয়, লোকাতীত এক স্বপ্ন, স্বাধীনতার অন্বেষণ।
একটি অন্ধ ভিখিরি কেন যে খঞ্জনি বাজিয়ে আজ এই ভরসকালে তার সাদামাটা কণ্ঠে এই গানটি শুনিয়ে গেল।
আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। আপনারা একবার বিদায় দিন, ঘুরে আসি। মাস তিনেকের ছুটি চাই। একটু বাইরে যাব। পরে এসে আবার আপনাদের জিজ্ঞাসা করব, ‘কি খবর?’ অবশ্য সম্পাদক মহোদয় যদি অনুমোদন করেন।
সুতরাং এবারের মতো দীনবন্ধু মিত্রকে স্মরণ করে সালাম, নমস্কার, গুড বাই—
আল্লা আল্লা বলরে ভাই,
পালা করলাম শেষ।