সরষের মধ্যে ভূত

সরষের মধ্যে ভূত

এক

সল্টলেক স্টেডিয়ামে অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার ম্যাচ দেখে বাড়ি ফিরছি৷ এমন সময় ফুল্লরার ফোন, ‘কালকেতু, তোমার কি আজ ফিরতে দেরি হবে?’

খুব প্রয়োজন না হলে ফুল্লরা এই সময়টায় ফোন করে না৷ কেননা, ও জানে খবরের কাগজের রিপোর্টারদের কাছে রাত আটটা হল পিক টাইম৷ নিশ্চয়ই কোনো জরুরি দরকার৷ গাড়ি ড্রাইভ করার সময় মোবাইলে কথা বলা আমি পছন্দ করি না৷ চিংড়িহাটার মোড়ে বাইপাসের ধারে গাড়ি সাইড করে বললাম, ‘কেন বলো তো? কোনো প্রবলেম হয়েছে নাকি?’

ও প্রান্ত থেকে ফুল্লরা উদ্বেগভরা গলায় বলল, ‘আরে, পুরকায়স্থদার নাতি দীপকে কারা যেন কিডন্যাপ করেছে৷ স্কুলবাসে ও রোজ ফেরে সন্ধে ছটার সময়৷ আজ বাড়িতে ফেরেনি৷’

বললাম, ‘স্কুলে কেউ খোঁজ নিয়েছিল?’

‘রোজ ওকে রিসিভ করার জন্য পুরকায়স্থদা বিক্রমগড়ের মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করেন৷ আজও দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ অন্য ছেলেদের নামিয়ে দেওয়ার সময় কনডাক্টর নাকি বলেছে, ছুটি হওয়ার পর দীপ বাসেই ওঠেনি৷’

‘কিডন্যাপ হওয়ার কথা তাহলে কে বলল?’

‘একটু আগে কিডন্যাপাররা ফোন করেছিল৷ ওরা আজ রাতের মধ্যেই দশ লাখ টাকা চেয়েছে৷ না দিলে নাকি দীপের লাশ ফেলে দেবে৷ পুরকায়স্থদারা খুব ভয় পেয়ে গেছেন৷ বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে৷ আমি ওদের ফ্ল্যাটে গেছিলাম৷ শিউলি আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কালকেতুদাকে তুমি খবর দাও বউদি৷ পারলে উনিই পারবেন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে৷’

‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?’

‘যদ্দূর মনে হয়, না৷ কিডন্যাপাররা ভয় দেখিয়েছে, পুলিশকে জানালে ফল ভালো হবে না৷ দীপের বাবা এখানে নেই৷ বহরমপুরে গেছে৷ পুরকায়স্থদা একা কোনো ডিসিশন নিতে পারছেন না৷’

‘ওদের বলো, আমি আধঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছোচ্ছি৷’

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে গাড়ি ছোটালাম গলফ গ্রিনের দিকে৷ সিরিয়াস ব্যাপার৷ দীপকে আমি ভালোমতো চিনি৷ ক্লাস ফাইভ না, সিক্সে যেন পড়ে৷ হাউসিং কমপ্লেক্স-এ আমাদের উলটোদিকের ব্লকেই ওরা থাকে৷ বয়সের তুলনায় একটু বেশি পরিণত৷ ফেলুদার খুব ভক্ত৷ মনে আছে, দীপ একবার বলেছিল, ও গোয়েন্দা হতে চায়৷ আমার সম্পর্কে ওর মারাত্মক কৌতূহল৷ দীপের ঠাকুর্দা নির্মল পুরকায়স্থ রিটায়ার্ড জজ৷ আমাদের হাউসিং কো-অপারেটিভের প্রেসিডেন্ট৷ আর দীপের বাবা সুজন আমারই বয়সি, প্রোমোটার৷ যতদূর জানি, পুরকায়স্থদের সঙ্গে কারও বিরোধ নেই৷ তাহলে কারা দীপকে কিডন্যাপ করল? মোটিভ কি নিছক মুক্তিপণ আদায় করা? নাকি ফ্যামিলির উপর কারও রাগ?

গত দশ বছরে নানা ধরনের রহস্যভেদ করেছি৷ কিন্তু কখনও কিডন্যাপিং কেস হাতে পাইনি৷ গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে আসার সময় মনে হতে লাগল, দীপকে যতটুকু চিনি, তাতে জোর করে ওকে তুলে নিয়ে যাওয়া কঠিন৷ জোকা-র একটা নামকরা স্কুলে ও পড়ে৷ প্রায় হাজার দু-এক ছাত্র৷ একেবারে ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর সেই স্কুল৷ ছুটির সময় স্কুলের বাইরেটায় গার্জেনদের ভিড় গিজগিজ করে৷ তাঁদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাউকে অপহরণ করা অসম্ভব৷ তা ছাড়া, যেসব স্টুডেন্ট স্কুল বাসে যাতায়াত করে, তারা একেবারে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে বাসে ওঠে৷ আগে স্কুলটা বেহালার কোনো এক গলির মধ্যে ছিল৷ স্টুডেন্ট বেড়ে যাওয়ায় নতুন বিল্ডিং তুলে চলে গিয়েছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের ঠিক পাশে৷ আমি এতসব জানি, তার কারণ, গতবছর অ্যানুয়াল স্পোর্টস-এর সময় স্কুলের প্রিন্সিপাল মহারাজ আমাকে আর সৌরভ গাঙ্গুলিকে ইনভাইট করেছিলেন, প্রাইজ দেওয়ার জন্য৷

আজ রাতের মধ্যেই কিডন্যাপাররা মুক্তিপণ চেয়েছে৷ তার মানে, খুব দ্রুত ওরা টাকাটা হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়তে চায়৷ কেন জানি না, মনে হল, কিডন্যাপার পেশাদার নয়৷ পুরকায়স্থদারা কেউ না কেউ তাকে বা তাদের চেনেন৷ বাপ আর ছেলে…দুজনকেই পেশাগত কারণে অপরাধ জগতের লোকেদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে৷ পুরকায়স্থদা জজ হিসেবে, সুজন প্রোমোটার হওয়ার কারণে৷ এমনও হতে পারে, পুরকায়স্থদা হয়তো কাউকে কড়া শাস্তি দিয়েছিলেন৷ সে সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে৷ প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহায় সে দীপকে অপহরণ করেছে৷ হাউসিংয়ের কোনো অনুষ্ঠানে যখন আড্ডা বসে তখন কোনো কোনোদিন পুরকায়স্থদা তাঁর জজিয়তি দিনগুলোর গল্প করেন৷ তখনই শুনেছি, এজলাসে বসার পর অপরাধ জগতের লোকেরা ওঁকে কেমন চমকাত!

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমি পুরকায়স্থদার বাড়িতে পৌঁছোতেই সবাই ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়ে গেল৷ কেননা, হাউসিংয়ের সবাই জানেন, সাংবাদিকতা করা ছাড়া আমি শখের গোয়েন্দাগিরিও করি৷ শিউলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কালকেতুদা, যে করেই হোক, আমার দীপকে আপনি ফিরিয়ে এনে দিন৷’

এমন গ্যারান্টি কোনো সত্যান্বেষীই দিতে পারেন না৷ তাই বললাম, ‘শান্ত হও৷ আগে ঘটনাটা ভালো করে শুনি৷ কী হয়েছিল, পুরকায়স্থদা আমায় বলুন তো? বাসের হেল্পার যখন আপনাকে বলল, দীপ বাসে ওঠেনি, তখন ওকে আপনি চেপে ধরলেন না কেন? ছেলেটা বাসে উঠেছে কিনা, এটা দেখার দায়িত্বও তো ওর?’

পুরকায়স্থদা বললেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ ও বলল, বাসে ওঠার লাইনে নাকি দীপ এসে দাঁড়িয়েছিল৷ রাস্তার উলটোদিকে একটা আইসক্রিম পার্লার আছে৷ হঠাৎ ও বন্ধুদের বলে, বাস ছাড়তে তো খানিকটা দেরি আছে৷ যাই, তার মধ্যে আইসক্রিম কিনে আনি৷ তার পর ও বাসে উঠেছে কি না, কেউ আর লক্ষ করেনি৷ গ্রস নেগলিজেন্স৷ আমি ফোন করে প্রিন্সিপাল মহারাজের কাছে কমপ্লেন করেছি৷’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুলিশে খবর দেননি কেন?’

‘ওরা ভয় দেখাল, পুলিশের কাছে গেলে দীপের লাশ ফেলে দেবে৷ সারা জীবন এই ধরনের ক্রিমিনাল ঘাঁটাঘাটি করেছি৷ জানি, ওরা কত নিষ্ঠুর হতে পারে৷ আমার তো মাথাতেই ঢুকছে না, কারা এই জঘন্য কাজটা করতে পারে৷’

‘কিডন্যাপার কখন ফোন করেছিল?’

‘ঠিক সাতটা পাঁচে৷ আমাদের ল্যান্ড লাইনে সিএলআই লাগানো আছে৷ টেলিফোন নাম্বার আর কারেক্ট সময়টা তাই টুকে রেখেছি৷’

বলতে বলতে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজের টুকরো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পুরকায়স্থদা আরও বললেন, ‘ফোনটা কোত্থেকে করেছিল, সেটা চেক করার জন্য এই নাম্বারে আমি ডায়াল করেছিলাম৷ কিন্তু বারবারই বলছে, দিস নাম্বার ডাজ নট এগজিস্ট৷’ কাগজের টুকরোতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, মোবাইল নাম্বার লেখা আছে৷ লাইনটা যে পাওয়া যাবে না, সেটা জানা কথা৷ কিডন্যাপাররা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সিম কার্ড বদলে ফেলেছে৷ নাম্বারটা কার, তা অবশ্য মোবাইল কোম্পানি থেকে বের করা যেতে পারে৷ তাহলে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘টাকাটা কখন নেবে, কিডন্যাপাররা কিছু বলেছিল?’

পুরকায়স্থদা বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছে৷ প্রথমে আমার মোবাইল নাম্বারটা লিখে নিল৷ তার পর বলল, রাত ঠিক বারোটার সময় আমাকে গড়িয়াহাটের মোড়ে যেতে হবে৷ ওখানে কলকাতা কর্পোরেশনের যে বিল্ডিংটা আছে, তার সিঁড়িতে টাকাটা রেখে দিয়ে আসতে হবে৷ ওরা সাবধান করেছে, আমার সঙ্গে যেন আর কেউ না যায়৷ গেলে দীপকে আর জ্যান্ত ফেরত পাওয়া যাবে না৷’

শুনে আমার খটকা লাগল৷ রাত বারোটার সময়ও গড়িয়াহাটের মোড়ে যথেষ্ট লোকজন থাকে৷ কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে প্রচুর দোকান৷ বিয়ের মরশুম বলে এখন অনেক রাত্তির পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকবে৷ না, না, ওখানে টাকা নিতে আসার ঝুঁকি কিডন্যাপার কখনোই নেবে না৷ নিশ্চয়ই ওদের অন্য মতলব আছে৷ বললাম, ‘মনে করে বলুন তো, ওরা আর কিছু বলেছে?’

‘হ্যাঁ৷ বলেছে, টাকাটা কিন্তু কাপড়ের ব্যাগে নিয়ে আসবেন৷’

‘এত টাকা…এত অল্প সময়ের মধ্যে জোগাড় করবেন কী করে?’

‘সেটা প্রবলেম হবে না৷ রায়চকে গঙ্গার ধারে আমার একটা ছোটোখাটো বাড়ি আছে৷ সেটার রিনোভেশন করার জন্য ব্যাংক থেকে আজই দশ লাখ টাকা তুলে এনেছিলাম৷ যে ঠিকাদার কাজটা করছে, সে চেক-এর বদলে নগদ টাকা চেয়েছিল৷ সেই টাকাটা নিয়েই আমায় যেতে হবে৷ তা ছাড়া উপায় কী?’

তার মানে, দশ লাখ টাকা যে বাড়িতে আছে, কিডন্যাপাররা তা জানত৷ বললাম, ‘টাকাটা বাড়িতে আনার পর থেকে আপনার বাড়িতে কে কে এসেছিল?’

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন পুরকায়স্থদা৷ তারপর বললেন, ‘তেমন কেউ না৷ বাড়িতে তখন রান্না করার মেয়েটা…বাসন্তী ছিল৷ আর ছিল শিউলি বউমা৷ টাকার ব্যাগটা আমি বউমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম, আলমারিতে রাখার জন্য৷’

‘এই বাসন্তী কদ্দিন আপনার এখানে রান্না করছে?’

‘তা মাস পাঁচেক হবে৷ ও চলে যাওয়ার পর বাড়িতে আর কেউ এসেছিল বলে তো মনে পড়ছে না৷’

‘কারা কিডন্যাপ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না৷’

বহরমপুর থেকে সুজন ফোন করেছে৷ তার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পুরকায়স্থদা৷ আমি উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ কথাবার্তা শুনে আমি নিশ্চিত, কিডন্যাপাররা পুরকায়স্থদাকে চেনে৷ ভদ্রলোকের বয়স এখন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি৷ বছর খানেক আগে ওঁর বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে৷ এই টেনশন ওঁর ক্ষতি করে দেবে৷ কিডন্যাপাররা যাই বলুক, রাতে একা ওঁকে গড়িয়াহাটের মোড়ে যেতে দেওয়া উচিত হবে না৷ পুলিশকে জানাতেই হবে৷ যাদবপুর থানার ওসি সুদীশ নাগ এখন কলকাতাতে নেই৷ পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ’তে গিয়েছে কী একটা ট্রেনিং নিতে৷ থানার সেকেন্ড অফিসার সৌম্য ঠাকুর কিছুদিন আগে একটা চুরির কেসে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল৷ ডেয়ার ডেভিল টাইপের ছেলে৷ ওকে ফোনে ধরে কিডন্যাপের ঘটনাটা বললাম৷ শুনে সৌম্য বলল, ‘ঠিক আছে৷ আমার টিমকে রেডি করে রাখছি৷ গড়িয়াহাটের মোড়ে আমাদের লোকজন প্লেন ড্রেসে থাকবে৷’

দোতলা থেকে নীচে নামতেই দেখি, পাঁচ-ছজনের জটলা৷ সবাই হাউসিংয়েরই প্রতিবেশী৷ আমাকে দেখে মিস্টার বড়াল বলে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘লেটেস্ট খবরটা কী, কালকেতুবাবু?’

যতটুকু শুনেছি, বললাম৷ শুধু পুলিশের ব্যাপারটা ছাড়া৷ শুনে মিস্টার বড়াল বললেন, ‘বাঁচা গেল, ছেলেটার তাহলে এখনও কিছু হয়নি৷ কী জানেন, একটু আগে টিভিতে একটা খবর দেখাচ্ছিল৷ পুলিশ নাকি কি একটা বাচ্চা ছেলের ডেডবডি পেয়েছে কইখালির নালাতে৷ ছেলেটার পরনে স্কুল ড্রেস ছিল৷ শুনে তো ভয় পেয়ে গেছিলাম, ওই ছেলেটাই আমাদের দীপ কি না?’

শুনে কড়া চোখে আমি মিস্টার বড়ালের দিকে তাকালাম৷ ভদ্রলোক হাউসিংয়ের ইলেকশনে পুরকায়স্থদার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ বিচ্ছিরিভাবে হেরে যান৷ তার পর থেকে পুরকায়স্থদাকে উনি একেবারে সহ্য করতে পারেন না৷ মিটিংয়ে এসে নানাভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেন৷ আমার চাউনি দেখে ভদ্রলোক মানে মানে সরে পড়লেন৷ আমি ফ্ল্যাটের দিকে এগোনোর সময় বিনোদ বলে এক প্রতিবেশী বলল, ‘এটা যুব সংঘের ছেলেদের কাজ নয় তো কালকেতুদা?’

কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ আমাদের হাউসিংয়ের ঠিক পিছনে একটি বস্তি আছে৷ সেখানকারই ক্লাব যুব সংঘ৷ সরস্বতী পুজোর সময় ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হয়েছিল৷ বস্তিতে দু-রাত্তির ধরে ওরা ফাংশান করেছিল অনেক রাত পর্যন্ত৷ পুরকায়স্থদার ব্লকটা একেবারে বস্তির দিকে৷ বিরক্ত হয়ে উনি দ্বিতীয় দিন পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন৷ সেটা জানাজানি হয়ে যায়৷ পুলিশ কয়েকটা ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছিল৷ ছাড়া পেয়ে ছেলেগুলো দু-তিনদিন পর পুরকায়স্থদাকে শাসিয়ে যায়৷ কিন্তু সেটা মাস দু-এক আগেকার ঘটনা৷ শুনে আমি সুদীশকে জানিয়ে রেখেছিলাম৷ সুদীশ ওদের এমন কড়কে দিয়েছিল যে, মনে হয় না, ছেলেগুলো তার পরও কিডন্যাপিংয়ের মতো অপরাধ করবে৷ বিনোদকে বললাম, ‘আমার মনে হয় না, যুব সংঘের ছেলেরা ইনভলভড৷’

‘কালকেতুদা, আপনি যে করেই হোক, দীপকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন৷ ওর সঙ্গে একই বাসে আমার ছেলে সপ্রতিমও স্কুলে যায়৷ সন্ধেবেলায় কিডন্যাপিংয়ের কথা শোনার পর থেকে আমার ছেলে ট্রমার মধ্যে চলে গেছে৷ বারবার ওর মাকে বলছে, দীপকে যদি ওরা মেরে ফেলে, তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘না, কিডন্যাপাররা সেই সাহস পাবে না৷’

রাত প্রায় সাড়ে নটা৷ ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ফুল্লরাকে বললাম, ‘রাতে হয়তো আমাকে বেরোতে হতে পারে৷ আমি আর ড্রেস চেঞ্জ করছি না৷ ডিনার এখনই সেরে নিই৷’

আজ বাড়িতে আমার ডিনার করার কথা ছিল না৷ অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার পার্টি ছিল রাজারহাটের সুইস হোটেলে৷ ফুল্লরার ফোন না পেলে হয়তো ওখানেই যেতাম৷ গেলে এটিকে-র কোচ হাবাসের একটা ইন্টারভিউ পাওয়া যেত৷ লোকটা খিটখিটে মেজাজের৷ সাংবাদিক দেখলেই মুখ তেতো করে ফেলে৷ করবেই বা না কেন? প্রেস কনফারেন্সে যা বোকা বোকা প্রশ্ন হয়, তাতে স্প্যানিশ কোচের মেজাজ খারাপ হওয়ারই কথা৷ কেন জানি না, আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের র্যাঁপো বেশ ভালো৷ আমার সঙ্গে অন্তত উনি মন খুলে কথা বলেন৷

ডিনার সাজিয়ে দেওয়ার সময় ফুল্লরা হঠাৎ বলল, ‘শিউলি বলছিল, পুরকায়স্থদার বদমেজাজের জন্যই নাকি দীপের এই অবস্থা৷’

অবাক হয়ে বললাম, ‘তার মানে?’

‘আরে, কয়েকদিন আগে একজন প্লাম্বার এসেছিল, ওদের ফ্ল্যাটে জলের পাইপ বদলাতে৷ ইয়ং ছেলে৷ কাজ হয়ে যাওয়ার পর সে নাকি দুশো টাকা চেয়েছিল৷ এ নিয়ে পুরকায়স্থদার সঙ্গে ওর তর্কাতর্কি হয়৷ উনি কিছুতেই একশো টাকার বেশি দেবেন না৷ ছেলেটাও দুশোর কম নেবে না৷ ছেলেটা নাকি একটা টাকাও না নিয়ে হুমকি দিয়ে গেছিল, পরে কত টাকা আপনাকে গচ্চ দিতে হবে, বুঝবেন৷ কী দরকার ছিল, সামান্য একশো টাকা নিয়ে দর কষাকষি করার? বাজারে সবজি কেনার সময় আমিও দেখেছি, পুরকায়স্থদা পাঁচ পয়সা কমানোর জন্য কী না করেন৷’

মধু বলে একটা ছেলে হাউসিংয়ে প্লাম্বারের কাজ করে৷ ফুল্লরা তাকে চেনে৷ শিউলি যে ছেলেটার কথা বলেছে, সে নিশ্চয়ই মধু নয়৷ অন্য কেউ হবে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেটা কার সোর্সে ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিল, শিউলি কিছু বলেছে?’

‘আমি জানতে চাইনি৷ পারলে তুমি একবার শিউলিকে জিজ্ঞেস করে নিও৷’

এই প্লাম্বার ছেলেটার কথা পুরকায়স্থদা অবশ্য আমাকে বলেননি৷ এই মুহূর্তে ওঁর মনের যা অবস্থা, তাতে ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক৷ কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এইসব অতি সাধারণ সূত্রও অনেক সময় কাজে লাগে৷ প্লাম্বার ছেলেটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে৷ তবে, পুরকায়স্থদাকে আমি যতটুকু জানি, ওঁকে বদমেজাজি বলা উচিত হবে না৷ উনি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ শুধু অন্যায় আবদার বরদাস্ত করেন না৷ শিউলির সঙ্গে তখন কথা বলার খুব একটা সুযোগ হয়নি৷ ভেবে রাখলাম, ডিনার সেরে যখন ওদের ফ্ল্যাটে যাব, তখন এক ফাঁকে কয়েকটা কথা জেনে নেব৷

মেয়েমহলে এমন অনেক কথা হয়, যা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না৷ খেতে খেতে তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘শিউলি আর কিছু বলল?’

‘ওদের কনজুগাল লাইফটা খুব খারাপ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ দুজন দুজনকে সন্দেহ করে, নাকি এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্সে জড়িয়ে পড়েছে৷ এ নিয়ে ওদের মধ্যে রোজ অশান্তি৷ বি ব্লকের ডলি বউদি আমায় বলছিলেন, ছেলেকে নিয়ে নাকি শিউলি চলে যেতে চেয়েছিল৷ লোকলজ্জার ভয়ে পুরকায়স্থদা ওকে আটকেছেন৷’

‘শিউলিকে তো ভালো মেয়ে বলেই মনে হয়৷’

‘কী জানি৷ বিয়ের আগে শিউলির নাকি স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ছিল৷ সুজনের সন্দেহ, এখনও তার সঙ্গে শিউলির গোপন সম্পর্ক আছে৷ কী ধরনের প্যারানয়েড, ভাবো৷’

‘ওদের বিয়েটা কি প্রেমের, না বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে হয়েছিল?’

‘না, প্রেমের নয়৷ পুরকায়স্থদা পছন্দ করে শিউলিকে নিয়ে এসেছিলেন৷’

সুজন ছেলেটা স্ফূর্তিবাজ বলেই জানি৷ প্রোমোটিং করে ভালো রোজগার করে বলে শুনেছি৷ আগে দেখতাম, শিউলিকে নিয়ে মাঝেমধ্যে সুইফট গাড়িতে বেরিয়ে পড়ত৷ তখন ওদের সুখী বলেই মনে হত৷ দীপ স্কুলে ভরতি হওয়ার পর থেকে ওদের উড়ে বেড়ানো কমে গেছে৷ কিন্তু দাম্পত্য জীবন যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তা এই প্রথম জানলাম৷ দীপ কিডন্যাপড না হলে, এইসব কথা চার দেওয়ালের বাইরে বেরোত না৷ এবার দীপের জন্য একটু টেনশন হতে লাগল৷ যত সময় যাবে, ততই ওর পক্ষে খারাপ৷ মুক্তিপণ আদায় করার পরও কিডন্যাপার যে ওকে ছেড়ে দেবে, তার গ্যারান্টি নেই৷ চেনা-জানা কেউ যদি ওকে তুলে নিয়ে যায়, তাহলে ওর ফিরে আসার চান্স আরও কম৷ অপরাধ বিচারে এটা আইপিসি থ্রি সিক্সটি ফোর ক্যাপিটাল-এ৷ যার শাস্তি লাইফ টার্ম জেল পর্যন্ত হতে পারে৷ অর্থাৎ কিনা যাবজ্জীবন কারাবাস!

রাত পৌনে বারোটার সময় পুরকায়স্থদার ফ্ল্যাটে গিয়ে শুনি, উনি নেই৷ কিডন্যাপারের ফোন এসেছিল৷ মিনিট দশেক আগেই একা উনি টাকার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছেন৷ শিউলি বলল, ‘আপনি যে পুলিশকে সব জানিয়েছেন, সেটা ওরা জেনে গেছে৷ টাকাটা গড়িয়াহাটের মোড় থেকে ওরা নেবে না৷ প্রিয়া সিনেমার উলটোদিকে একটা চায়ের দোকান আছে৷ রাত ঠিক বারোটার সময় সেখানে ওরা যেতে বলেছে৷’

শুনে অবাক হয়ে গেলাম, কিডন্যাপার জানল কী করে আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি?

দুই

পুরকায়স্থদার জন্য সুজনদের ফ্ল্যাটে ওয়েট করছি৷ ফোন করেও ওঁকে ধরা যাচ্ছে না৷ থানা থেকে সৌম্য ঠাকুর অবশ্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল৷ বলছিল, ‘চিন্তা করবেন না কালকেতুদা৷ জিপিএস মারফত আমার লোকেরা মিস্টার পুরকায়স্থর গাড়িকে ফলো করে যাচ্ছে৷ এখন উনি জোকা-র দিকে যাচ্ছেন৷’ দেশপ্রিয় পার্ক থেকে হঠাৎ কেন কিডন্যাপাররা ওঁকে জোকা-র দিকে টেনে নিয়ে গেল, বুঝতে পারিনি৷ ডায়মন্ডহারবারের দিকের রাস্তাটা এমনিতেই নির্জন৷ তার উপর মেট্রোরেলের কাজ চলছে৷ বিরাট বিরাট থামের আড়ালে যে কোনো দুষ্কর্ম সম্ভব৷ কিডন্যাপারদের মনে কোনো কুমতলব নেই তো? এই আশঙ্কাটাই আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷

পুরকায়স্থদা ফিরলেন রাত প্রায় তিনটের সময়, একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়৷ যা বললেন, তাতে মনে হল, কিডন্যাপারদের দলটা বেশ অর্গানাইজড৷ একজনের কাজ নয়, দলটায় অন্তত পাঁচ-ছজন আছে৷ ‘প্রথমে তো ওরা আমাকে প্রিয়া সিনেমার উলটোদিকে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াতে বলেছিল৷ ওখানে পৌঁছোতেই ফোন৷ বলল, আপনি জোকায় আইআইএম-এর কাছে চলে যান৷ রাত সাড়ে বারোটার সময় দৌড়োলাম জোকায়৷ সেখানে ওয়েট করার পর ফের ফোন এল৷ ওরা বলল, আমতলার দিকে গেলে বাঁ দিকে আপনি একটা মন্দির দেখতে পাবেন৷ স্বামীনারায়ণ মন্দির৷ গাড়িটা দাঁড় করাবেন না৷ আমাদের লোক দাঁড়িয়ে থাকবে৷ তার হাতে টাকার ব্যাগটা দিয়েই চলে যাবেন৷

‘মন্দিরের কাছাকাছি যেতেই ফের ফোন৷ ওরা বলল, আপনি আমতলা মোড়ের বাঁদিকে টার্ন নিয়ে সোজা বারুইপুরের দিকে চলে যান৷ আমরা কোত্থেকে ব্যাগটা নেব, পরে জানিয়ে দিচ্ছি৷ এর পর বারুইপুর থেকে গড়িয়া, তার পর যাদবপুর৷ তারও পর ইস্টার্ন বাইপাস কানেক্টর ধরে ওরা আমাকে এগোতে বলল৷ রেলব্রিজের উপর উঠতেই ফোনে ওরা বলল, এবার গাড়ি থেকে নেমে পড়ুন৷ উপর থেকে টাকার ব্যাগটা ফেলে দিন রেললাইনে৷ আমাদের লোক নীচে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওরা কালেক্ট করে নেবে৷ বললাম, আমার নাতিকে তোমরা কখন ফেরত দেবে? ওরা বলল, কাল সকালে বাড়ি পৌঁছে যাবে৷’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পুরকায়স্থদা, ‘মনে হয় না, দীপ আর ফিরে আসবে৷’

কিডন্যাপাররা এমন একটা জায়গা থেকে টাকার ব্যাগটা নেবে, যেখানে পুলিশ চট করে পৌঁছোতে পারবে না৷ আমি এমনটাই আন্দাজ করেছিলাম৷ হলও ঠিক তাই৷ ওরা ঢাকুরিয়া আর বাঘাযতীন স্টেশনের মাঝে ওই ব্রিজ থেকে টাকার ব্যাগটা নীচে রেললাইনে ফেলে দিতে বলেছিল৷ শুনে মারাত্মক জেদ চেপে গেল৷ এই কিডন্যাপারদের ধরতেই হবে৷ কিছুদিন আগে হলিউডের একটা সিনেমা দেখেছিলাম৷ তাতে কিডন্যাপার এইভাবেই মুক্তিপণের টাকা আদায় করেছিল৷ পাঁচ-ছটা জায়গায় ঘুরিয়ে শেষে এমন একটা জায়গা থেকে টাকাটা আদায় করে, পুলিশের চোখের সামনে, অথচ নাগালের বাইরে৷ পরে ওরা যাকে কিডন্যাপ করেছিল, তাকে খুন করে৷ ওই সিনেমার ছকে যদি এগোয়, তা হলে এই কিডন্যাপাররা দীপকেও খুন করতে পারে৷ নানা সম্ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে রাতে দু-ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেই পারলাম না৷

রোজ সকালে রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাবে গলফ খেলতে যাওয়া আমার অভ্যেস৷ ভোর ছটার সময় ঘুম ভেঙে গেল৷ সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম৷ আমার বাড়ি থেকে আরসিজিসি হাঁটা পথ৷ তবুও, গাড়ি নিয়ে সেখানে যাই৷ বিক্রমগড়ের সিগন্যালে গিয়ে দাঁড়াতেই চমক! ডান দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ল, দীপের মতো দেখতে একটা ছেলে হাঁটতে হাঁটতে হাউসিং কমপ্লেক্সের দিকে যাচ্ছে৷ ভালো করে তাকিয়ে দেখি, দীপের মতো নয়, দীপই৷ কিডন্যাপাররা ছেড়ে দিল তাহলে ওকে! কে নামিয়ে দিল? দীপ কোত্থেকে হেঁটে আসছে? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন মনে ভিড় করে এল৷ সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান ছকে ফেললাম৷ ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘দীপ, এই দীপ, উঠে এসো! তোমার সঙ্গে কথা আছে৷’

আমাকে দেখে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ চট করে গাড়িতে উঠে ও বলল, ‘আংকল, বাড়িতে মাকে একবার খবরটা দিয়ে দেবে? বলে দাও, ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে৷’

গত বারো-তেরো ঘণ্টা দীপ কিডন্যাপারদের সঙ্গে কাটিয়েছে৷ অথচ চোখ-মুখে উদ্বেগ বা ভয়ের কোনো ছাপ নেই৷ দেখে একটু অবাকই হলাম৷ ওর অনুরোধটা শুনেও৷ ও জানে, বাড়ির লোকেরা অ্যাংজাইটির মধ্যে আছে৷ বুদ্ধিমান ছেলে, সেই কারণে প্রথমেই বাড়িতে খবরটা দিতে বলল৷ দীপকে এখুনি ওদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়৷ কিন্তু নিয়ে গেলে, হই-হট্টগোলের মাঝে কিডন্যাপারদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য জানা যাবে না৷ গলফ ক্লাবে ওকে নিয়ে গিয়ে বসলে যেটা সম্ভব৷ তাই বললাম, ‘পুরকায়স্থদাকে এখুনি ফোন করে দিচ্ছি৷ আমি এখন গলফ ক্লাবে যাচ্ছি৷ তুমি তো একবার দেখতে যাবে বলেছিলে৷ আজ যাবে?’

দীপ সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল৷ মোবাইলে পুরকায়স্থদাকে ধরার চেষ্টা করলাম৷ ফোনটা ধরল সুজন৷ সম্ভবত পরদায় আমার নামটা দেখেছে৷ অপ্রত্যাশিতভাবে গলা চড়িয়ে ও বলল, ‘আপনাকে এই সর্বনাশটা করতে কে বলেছিল কালকেতুদা?’

বললাম, ‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না সুজন৷’

‘পুলিশকে জানানোর আগে আমার সঙ্গে একবার কনসাল্ট করতে পারলেন না? কিডন্যাপাররা যদি দীপের সঙ্গে খারাপ কিছু করে, তাহলে কিন্তু আপনিই দায়ী হয়ে থাকবেন৷’

‘কিডন্যাপিং কথাটার মানে তুমি জানো সুজন? এটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স৷ আমি যা ভালো মনে করেছি, তাই করেছি৷ যাকগে, তুমি কি এখনও বহরমপুরে?’

‘না, রাতের ট্রেনেই ফিরে এসেছি৷ বাবা ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন, ওঁকে এখন জাগানো ঠিক হবে না৷ যা বলার আমাকে বলুন৷ পুলিশ কি কিডন্যাপারদের ধরতে পেরেছে?’

‘না, এখনও পারেনি৷’

‘আমি তো জানি, দীপকে কে কিডন্যাপ করেছে৷’

‘তুমি জানো? কে সে?’

‘বিক্রম৷ শিউলির এক্স বয়ফ্রেন্ড৷ লোফারটা সব পারে৷ আমার কনজুগাল লাইফ শেষ করে দিল৷’

‘কিন্তু দীপকে কিডন্যাপ করে তার কী লাভ?’

‘প্রথমে দীপকে সরিয়ে নিয়ে গেল৷ তারপর শিউলিকে নিয়েও একদিন কেটে পড়বে৷’

যুক্তিটা আমার মনমতো হল না৷ ফুল্লরার কাছে আগেই শুনেছিলাম, সুজনের সন্দেহের কথা৷ তাই পাত্তা না দিয়ে বললাম, ‘তোমার ধারণা ভুল সুজন৷ শোনো, একটা ভালো খবর আছে৷ শিউলিকে বলে দাও, দীপকে পাওয়া গেছে৷ ও এখন আমার সঙ্গে আছে৷ ওকে নিয়ে আমি ঘণ্টা দু-একের মধ্যেই ফিরে আসছি৷’

‘দীপকে পাওয়া গেছে! আপনি কী করে পেলেন কালকেতুদা?’

প্রশ্নটা খট করে কানে বাঁধলেও বললাম, ‘এখন বলার সময় নেই৷ ফিরে গিয়ে বলব৷ এখন ছাড়ি৷’

সুজনের আচরণ আমার অদ্ভুত লাগল৷ বরাবর ও যথেষ্ট সম্মান দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে৷ কিন্তু আজ ওর গলায় অন্যরকম সুর শুনে একটু অবাকই হলাম৷ দীপ আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে৷ ওর মুখ দেখে মনে হল, আগে ওকে কিছু খাওয়ানো দরকার৷ তারপর ওর পেট থেকে কথা বের করা যাবে৷ গলফ ক্লাবের রেস্তরাঁয় স্যান্ডউইচ আর কোল্ড ড্রিংকস-এর অর্ডার দিয়ে, রঙিন ছাতার তলায় দুটো চেয়ার নিয়ে আমরা বসলাম৷ গলফ কোর্সের সবুজ ঘাসে অনেকে খেলছেন৷ তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশিও আছেন৷ কৌতূহলী চোখে দীপ খেলাটা দেখছে৷ একটু পরে বলল, ‘এটাই ওয়ার্ল্ডের সব থেকে পুরোনো গলফ ক্লাব, তাই না আংকল?’

বললাম, ‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কী করে?’

‘নেট সার্চ করে৷ আমাদের ক্লাসের একটা ছেলের দাদু এই ক্লাবের ক্যাডি ছিলেন৷’

ক্যাডি মানে, টাকার বিনিময়ে যাঁরা গলফারদের খেলায় সাহায্য করেন৷ ক্লাবের বেশির ভাগ ক্যাডিকেই আমি চিনি৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম বলো তো?’

‘জামশিদ আলি৷ আপনি চেনেন?’

‘চিনব না কেন? উনি প্রথম জীবনে ক্যাডি ছিলেন৷ পরে গলফার হিসেবে খুব নাম করেন৷ ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন৷ গলফারদের মধ্যে উনিই প্রথম অর্জুন পুরস্কার পান৷’

গলফ নিয়ে দীপ নানা প্রশ্ন করতে লাগল৷ মাত্র এগারো-বারো বছর বয়স৷ অথচ কত কী জানে! ইতিমধ্যে স্যান্ডউইচ আর কোল্ড ড্রিংকস এসে গেল৷ ওকে গোগ্রাসে খেতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতে কিছু খাওনি?’

‘ওরা আমাকে বিরিয়ানির একটা প্যাকেট এনে দিয়েছিল৷ কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করেনি৷’

‘তোমার তো ফেলুদা হওয়ার খুব ইচ্ছে৷ দেখি, কেমন তোমার অবজার্ভেশন পাওয়ার৷ একটু ভেবে বলো তো, বিরিয়ানির প্যাকেটে কি কোনো রেস্টুরেন্টের নাম লেখা ছিল?’

চোখ বুজে একটু ভেবে নিয়ে দীপ বলল, ‘মনে পড়েছে আংকল, জলসাঘর৷’

জ-ল-সা-ঘ-র! নামটা কোথায় যেন দেখেছি৷ লাল রঙের আলোয় লেখা৷ ঠিক মনে পড়ল না৷ বললাম, ‘একেবারে গোড়া থেকে বলো তো, স্কুল থেকে ওরা তোমাকে কিডন্যাপ করল কী করে?’

‘স্কুলবাসে ওঠার আগে আইসক্রিম কেনার ইচ্ছে হয়েছিল আমার৷ তাই রাস্তার উলটোদিকে আইসক্রিম পার্লারে গেছিলাম৷ ওখানে একটা দাদা দাঁড়িয়েছিল৷ আইসক্রিম কিনে যখন আমি দোকান থেকে নেমে আসছি, তখন সেই দাদাটা আমার নাম জিজ্ঞেস করল৷ তার পর বলল, আজ তোমাকে স্কুলবাসে বাড়ি ফিরতে হবে না৷ তোমার বাবা আমাদের শো-রুম থেকে একটু আগে আই টোয়েন্টি গাড়ি কিনেছে৷ ওই যে দ্যাখো, একটা নীল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভেতরে তোমার বাবা-মা আছেন৷ আমাকে বললেন, তোমায় ডেকে নিতে৷’

‘তুমি তো খুব ইন্টেলিজেন্ট ছেলে৷ দাদার কথা বিশ্বাস করে নিলে কেন?’

‘করতাম না৷ কিন্তু সত্যিসত্যি বাবা কয়েকদিন ধরে বলছিল, আমাদের সুইফট ডিজায়ার গাড়িটা অনেক দিনের পুরোনো হয়ে গিয়েছে৷ এবার একটা আই টোয়েন্টি কিনলে কেমন হয়? মা অবশ্য বারণ করছিল৷ এ নিয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের একদিন তুমুল ঝগড়াও হয়ে গেছিল৷ আই টোয়েন্টির কথা শুনেই দাদাটার কথায় আমার কোনো সন্দেহ হয়নি৷ মা আমাকে নিতে গিয়েছে শুনেও৷ তবুও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কে? আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি? উনি বললেন, আমি শো-রুমের ড্রাইভার৷ গাড়ি ডেলিভারি দিতে এসেছি৷ তুমি আমায় দেখবে কী করে?’

‘তুমি জানতে না, তোমার বাবা বহরমপুরে গেছেন?’

‘শুনেছিলাম, বাবা যাবে৷ কিন্তু অনেক সময় এমন হয়, বাবা যাব বলেও যায় না৷’

‘তারপর কী হল, বলো৷’

‘গাড়ির পিছনের সিটে বসে দেখি, বাবা-মা কেউ নেই৷ একটা অ্যাংকল বসে আছে, যাকে আমি চিনি না৷ সে হঠাৎ আমার নাকে রুমাল চেপে ধরল৷ মিষ্টি একটা গন্ধ৷ সম্ভবত ক্লোরোফর্ম৷ সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম৷’

শুনে মনে মনে হাসলাম৷ দীপের মতো বয়সে ক্লোরোফর্ম সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র আইডিয়া ছিল না৷ শিউলি একদিন বলেছিল বটে, টিভিতে দীপ ক্রাইম প্যাট্রল আর সিআইডি ছাড়া আর কিছু দেখে না৷ আর বাংলা চ্যানেলে, শুধু গোয়েন্দা গিন্নি৷ ফলে, অপরাধ জগৎ সম্পর্কে খানিকটা আইডিয়া ওর আছে৷ ফেলুদার কথা তুলে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি৷ তাই আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হল না৷ গড়গড় করে দীপ বলতে লাগল, ‘যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখি ফাঁকা একটা ঘরে শুয়ে আছি৷ ঘরটা খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো৷ হোটেলের ঘরের মতো৷ নীচ থেকে গান-বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছিল৷ সেইসঙ্গে অনেক লোকের হই-হট্টগোল৷ ডিভান থেকে নেমে দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম৷ দেখলাম, বাইরে থেকে বন্ধ৷ তখনই প্রথম আমার মনে হল, কিডন্যাপড হয়েছি৷’

‘গাড়িতে যে আংকল বসেছিল, তার চেহারাটা তোমার মনে আছে?’

‘স্পষ্ট মনে নেই৷ ফরসা আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ছিল৷ তবে, ড্রাইভার দাদার মুখটা আমার ভালো মনে আছে৷ পুলিশ যদি স্কেচ চায়, আমি স্কেচ বানাতে…হেল্প করতে পারি৷’

‘তোমায় কোথায় রেখেছিল, কোনো আন্দাজ দিতে পারো?’

‘সেটা জানার জন্যই আমি জানলা খোলার চেষ্টা করেছিলাম৷ সময় আর জায়গাটা সম্পর্কে আইডিয়া পাওয়ার জন্য৷ কিন্তু জানলাটা খুলতে পারলাম না৷ হঠাৎ চোখে পড়ল, ড্রয়িং রুমে টিভি আছে৷ সেটা চালাতেই দেখি, জি বাংলা চ্যানেলে দাদাগিরি প্রোগ্রামে টস রাউন্ড চলছে৷ তার মানে, সাড়ে নটা বেজে গেছে৷ মায়ের কথা ভেবে চোখে জল চলে এসেছিল৷ মা নিশ্চয়ই বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু করেছে৷ দাদাই নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ করছে৷ কারা আমাকে কিডন্যাপ করল, ভেবে পেলাম না৷ আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে তো কারও শত্রুতা নেই৷ তখন মনে মনে বললাম, নার্ভ হারালে চলবে না৷ দেখাই যাক না কী হয়৷’

‘ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির আংকলটা আর তোমার সামনে আসেনি?’

‘এসেছিল৷ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায়৷ তখন টিভিতে গোয়েন্দা গিন্নি চলছে৷ সঙ্গে আরও দুজন৷ ওদের দেখে আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলাম৷ ড্রয়িং রুমে ঢুকেই আংকলটা টিভি বন্ধ করে দিল৷ তারপর ভেতরে উঁকি মেরে বলল, ইস, বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ওকে তোরা কিছু খেতে দিসনি? যা, নীচের রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে আয়৷ শুনে সঙ্গে সঙ্গে একজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ এর পর ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বাকি দুজনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল৷ তখনই জানলাম, ফোন করে দাদাইয়ের কাছে ওরা পনেরো লাখ টাকা চেয়েছে৷’

‘দশ লাখ নয়?’

‘প্রথমে দশ লাখ চেয়েছিল৷ কিন্তু দাদাই পুলিশকে জানানোয় টাকার অঙ্কটা ওরা বাড়িয়ে দেয়৷ ওদের আলোচনাতেই শুনলাম, পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য দাদাইকে ওরা নানা জায়গায় ঘোরাবে৷ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির আংকলটাকে অন্যরা শাকালুদা বলে ডাকছিল৷ ওই আংকলটা বারবার ফোনে দাদাইকে ইনস্ট্রাকশন দিতে লাগল, কোথায় টাকাটা দিতে হবে৷ দাদাইকে হ্যারাস করে ওরা খুব হাসাহাসি করছিল৷ এর পর অনেক রাতে আমাকে নিয়ে কী করবে, সেই আলোচনায় বসল৷ একজন বলল, আমাদের দেখে ফেলেছে, বাচ্চাটাকে শেষ করে দাও৷ কিন্তু শাকালু বলল, মার্ডার-ফার্ডারে আমি নেই৷ অলরেডি একটা মার্ডার চার্জে জামিনে আছি৷ বাচ্চাটার দায় আমি নিতে পারব না৷ ওকে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক হবে৷ ওইসময় একটা আন্টি ঘরে এসে ঢুকল৷ তার হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট৷ হিন্দিতে সে বলল, বাচ্চাটাকে এটা খাইয়ে দাও৷ আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি৷ কাল সকালে
র‍্যানসামের টাকাটা আমার কাছে পৌঁছে দিও৷ আর হ্যাঁ, মার্ডার-ফার্ডারের চক্করে যেন আমায় ফাঁসিও না৷ মগন সিংয়ের কানে গেলে কী হবে, তা জানো তো?’

‘এই আন্টিটাকে দেখলে কি তুমি চিনতে পারবে?’

‘না, আংকল৷ বেডরুমে আমি দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিলাম৷ আন্টির ড্রেসটা শুধু দেখতে পেয়েছি৷ কালো রঙের খুব ঝলমলে ড্রেস, চুমকি বসানো৷’

‘তারপর কী হল?’

‘আন্টিটা চলে যাওয়ার পর ওরা আমাকে তুলে বসানোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু আমি ঘুমের ভান করে উঠিনি৷ তখন শাকালু অন্য লোকটাকে বলল, প্যাকেটটা টেবলে রেখে দে৷ রাতে যদি ক্লোরোফর্মের ঘোর কাটে, তাহলে নিজেই খেয়ে নেবে৷ আর শোন, টাকাটা হাতে এসে গেলে তোকে ফোন করে দেব৷ আমার ফোন পাওয়ার পর, ভোরবেলায় বাচ্চাটাকে তুই নিজে বাসে তুলে দিবি৷’

‘কত নম্বর বাসে তোমায় তুলে দিয়েছিল, মনে আছে?’

‘হ্যাঁ আংকল৷ এসি ফর্টিথ্রি৷ ভোরবেলায় ঘুম থেকে তুলে একটা দাদা আমাকে বলল, বাসে তুলে দিলে তুই কি বাড়ি যেতে পারবি? বললাম, হ্যাঁ৷ বাস স্টপেজে নিয়ে গিয়ে দাদাটা বাসের ভাড়া দিয়ে, কনডাক্টরকে বলল, এই বাচ্চাটাকে বিক্রমগড়ের মোড়ে নামিয়ে দেবেন৷’

‘কোন স্টপেজ থেকে তোমাকে বাসে তুলেছিল, মনে পড়ছে?’

‘দাদাটা গাড়িতে করে খানিকটা রাস্তা নিয়ে এল৷ তখন আমার চোখ বাঁধা ছিল৷ তারপর গাড়ি থেকে নামার আগে আমার চোখের বাঁধন খুলে দিল৷ তবে যে ভলভো বাসে আমাকে তুলে দিয়েছিল, আমার মনে আছে সেখানে গণেশ ঠাকুরের একটা ছবি ছিল৷ গণেশ ঠাকুরটা শিবলিঙ্গ জড়িয়ে ধরে আছে৷’

যা তথ্য নেওয়ার, তা পাওয়া হয়ে গেছে৷ তাই বললাম, ‘চলো দীপ৷ এবার তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই৷ একটু আগে আমাকে যা বললে, তা অন্য কাউকে বলার দরকার নেই, কেমন? কারা তোমাকে কী কারণে কিডন্যাপ করেছিল, মনে হচ্ছে এবার তা জানা যাবে৷’

তিন

আমার সন্দেহভাজনদের এক নম্বরে ছিল, প্লাম্বার ছেলেটা৷ জলের পাইপ সারাতে এসে যে পুরকায়স্থদাকে হুমকি দিয়েছিল৷ ছেলেটার নাম ষষ্ঠী, থাকে কলাবাগান বস্তিতে৷ ওর আসল বাড়ি মেদিনীপুরের ঘাটালে৷ মেসো প্লাম্বার, এখানে তার কাছে থেকে, হাতে-নাতে কাজ শিখছে৷

শিউলিদের বাড়িতে ওকে নিয়ে যায় রান্নার মেয়ে বাসন্তী৷ একই বস্তিতে থাকে৷ সৌম্য সেটা জানতে পেরে, সেদিন রাতেই ষষ্ঠীকে তুলে নিয়ে যায় থানায়৷ চড়-চাপড় মেরে জানতে পেরেছিল, বাসন্তীর প্রেমে পড়েছে ছেলেটা৷ বাসন্তীর বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে, বিয়ে শিগগির সেরে ফেলতে হবে৷ সেজন্য ওদের টাকার দরকার৷ পুরকায়স্থদা যেদিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনেন, সেদিন বাসন্তী রান্নাঘরে৷ সৌম্য আর আমি ভেবেছিলাম, খবরটা ওই ষষ্ঠীকে দিয়েছিল৷ সেই কারণেই সন্দেহভাজনদের তালিকায় বাসন্তীও এসে পড়েছিল৷

কিন্তু, পরে বুঝলাম, কিডন্যাপিং যেভাবে হয়েছে, ষষ্ঠীর পক্ষে সেটা করা সম্ভবই না৷ আই টোয়েন্টি গাড়ি ও কোত্থেকে পাবে? দীপকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাখার ক্ষমতাও ওর নেই৷ এ অন্য কোনো পাকা মাথার কাজ৷ তা ছাড়া, সৌম্যকে যখন রিপোর্ট করি, তখন আমি পুরকায়স্থদার ফ্ল্যাটের ঠিক বাইরে৷ তখন ষষ্ঠী বা বাসন্তী কেউ ছিল না৷ তাহলে কিডন্যাপাররা জানল কী করে, পুলিশের হেল্প নিচ্ছি? তখন অবশ্য হাউসিংয়ের কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ খবরটা কি তাঁদেরই কেউ কিডন্যাপারদের কাছে পৌঁছে দিলেন? মিস্টার বড়াল বা বিনোদের মধ্যে কেউ?

কিডন্যাপিংয়ের রাতে যখন দ্বিতীয়বার আমি পুরকায়স্থদার ফ্ল্যাটে যাই, তখন শিউলি কথায় কথায় বলেছিল, রায়চকের যে বাড়িটা পুরকায়স্থদা মেরামতি করছেন, সেই বাড়ি নিয়ে ডিসপিউট আছে৷ পুরকায়স্থদার এক ভাইপো এসে একদিন চেঁচামেচি করে গিয়েছিল৷ বাড়ির ভাগ তাকে দিতে হবে৷ সেই ভাইপো রাজনীতি করে৷ তার অনেক ক্ষমতা৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, দীপকে ফিরে পাওয়ার দিন সন্ধেয় পুরকায়স্থদা ফোন করে আমায় বললেন, ‘তোমায় একটা রিকোয়েস্ট করছি ভাই৷ পুলিশ যেন এই কেসটা নিয়ে আর ইনভেস্টিগেশন না করে৷ আমি কমপ্লেন তুলে নিচ্ছি৷’

তা হলে কি পুরকায়স্থদার সেই ভাইপোই কিডন্যাপিংয়ের পিছনে? উনি তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন? পেশাগত জীবনে পুরকায়স্থদা দীর্ঘদিন জজিয়তি করেছেন৷ উনি নিশ্চয়ই জানেন, এটা ননকম্পাউন্ডেবল অফেন্স৷ এভাবে তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া যায় না৷ ওঁর সঙ্গে আইন নিয়ে তর্ক করতে যাওয়া বৃথা৷ তবুও বললাম, ‘পুলিশ সুযোগমতো একটা কেস শুরু করেছে৷ প্লিজ, আটকাবেন না৷’

পুরকায়স্থদা বললেন, ‘ভাই, তোমায় বলতে আমার দ্বিধা নেই৷ আমার ক্লোজ লোকজনই এতে ইনভলভড৷ প্রকাশ্যে তার নামটা এলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে৷’

শুনে চুপ করে রইলাম৷ মনে মনে ঠিক করে নিলাম, উনি যাই বলুন, কিডন্যাপারটি কে, আমাকে জানতেই হবে৷ দীপ ফিরে আসার দিনই সৌম্যকে বাড়িতে ডেকেছিলাম৷ দীপ যেসব হিন্টস দিয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য৷ প্রথমে জলসাঘর রেস্টুরেন্টে৷ তারপর ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা শাকালু৷ ঝলমলে পোশাকের আন্টি৷ তারও পর ভলভো বাসে শিবলিঙ্গের সঙ্গে গণেশ ঠাকুরের অদ্ভুত ছবি৷ হাতের সামনে এইসব সূত্র৷ জলসাঘর-এর কথা শুনেই সৌম্য বলে উঠল, ‘এই রেস্টুরেন্টটা আমি চিনি কালকেতুদা৷ বার-কাম-রেস্টুরেন্ট৷ ইস্টার্ন বাইপাসের উপর, পঞ্চান্নগ্রাম বলে একটা জায়গায়৷ রাজারহাট, বাগুইহাটিতে যারা সিন্ডিকেট রাজ চালায়, ওটা তাদেরই ডেরা৷ একবার রেইড করতে গিয়েছিলাম৷ দেখেছি, সন্ধের পর ওখানে বার ডান্সাররাও প্রোগ্রাম করে৷’

সঙ্গে সঙ্গে আমারও রেস্টুরেন্টটার কথা মনে পড়ে গেল৷ সল্টলেক আসা-যাওয়ার পথে দেখেছি৷ বললাম, ‘চলো, একবার তাহলে সেখানে ঘুরে আসা যাক৷’

সন্ধেবেলায় দুজনে ঢুঁ মারলাম জলসাঘরে৷ বাউন্সারদের একজন সৌম্যকে চিনতে পারল৷ সেলাম ঠুকে সে বলল, ‘আর তো কোনো লাফড়া হয়নি স্যার৷ আপনি এখানে?’

আমাকে দেখিয়ে সৌম্য বলল, ‘আমার দাদা সানফ্রান্সিসকো থেকে এসেছে৷ তোদের এখানে কাবাবটা খুব টেস্টি৷ তাই খাওয়াতে নিয়ে এলাম৷’

বাউন্সারটা বলল, ‘আসুন স্যার৷ ম্যানেজারবাবুকে এখুনি খবর দিচ্ছি৷ আপনারা কোথায় বসবেন, বার-এ, না, রেস্টুরেন্টে?’

সৌম্য বলল, ‘রেস্টুরেন্টে৷’

জলসাঘরে ঢুকে দেখি, এলাহি ব্যবস্থা৷ ডানদিকে, বার-কাম-ডিসকোথেক৷ সৌম্য দরজাটা একবার খুলতেই বিকট আওয়াজ কানের পরদা ফাটিয়ে দেওয়ার অবস্থা করল৷ এক পলকেই দেখতে পেলাম, ফ্লোরে অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা নাচানাচি করছে৷ কিছু লোক কাউন্টারে বসে ড্রিংক করতে ব্যস্ত৷ বাঁদিকে, রেস্টুরেন্ট সেই তুলনায় ফাঁকা৷ কোণের দিকে একটা টেবলে আমরা বসতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল ম্যানেজার৷ দু-চারটে কথা বলে সৌম্য এমন ভাব দেখাল যেন, সত্যি সত্যি আমরা কাবাব খেতে গিয়েছি৷ ম্যানেজার গদগদ হয়ে বলল, ‘স্যার এখুনি দু-তিন রকম কাবাব পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’ লোকটা চলে যাওয়ার পর সৌম্য আমাকে বলল, ‘বছর দু-এক আগেও ফ্যামিলি নিয়ে এই রেস্টুরেন্টে লোকে খেতে আসত৷ কিন্তু বার খোলার পর থেকে কেউ আসতে সাহস পায় না৷ এখন ক্রিমিনালদের আড্ডা হয়ে গেছে৷ এর মালিক মগন সিং বলে ঝাড়খণ্ডের এক মাফিয়া৷ উপরের তলায় গেস্ট হাউসের মতো করেছে৷ বুঝতেই পারছেন, কী কারণে৷’

সঙ্গে সঙ্গে দীপের কথা মনে পড়েছিল৷ ছেলেটা বলেছিল, যে ঘরে ওকে কিডন্যাপাররা রেখেছিল, সেটা হোটেলের মতো৷ নীচ থেকে গানবাজনার আওয়াজ ভেসে আসছিল৷ তার মানে আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি৷ কিডন্যাপারদের সঙ্গে এই জলসাঘরের কোনো না কোনো কানেকশন আছে৷ শাকালু বলে লোকটার হদিশ পেলেই বোঝা যাবে, সম্পর্কটা কী? মনে হল, শাকালু এই অঞ্চলে খুব অপরিচিত নয়৷ আমার ধারণাটা যে ঠিক, তা টের পেলাম একটু পরেই৷ রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে ঢুকে নিঃশব্দে আমাদের টেবলে এসে বসল একটা ছেলে৷ সৌম্য তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শাকালুর কোনো খবর পেলি ঝন্টু?’

ঝন্টু বলল, ‘ও আজ কলকাতায় নেই স্যার৷ ভবেশ সামন্তর সঙ্গে ভাঙড়ে গেছে৷ ওখানকার রাইভাল পার্টির অফিস তোড়ফোঁড় করার জন্য৷ তবে, রোজ সন্ধেবেলায় এখানে ওকে পাবেন৷ সিন্ডিকেটের হিসসা নিতে আসে৷’

সৌম্য বলল, ‘খোঁজ নিয়ে দেখিস তো, কাল কোনো কিডন্যাপিংয়ে ও ইনভলভ ছিল কি না?’

‘তাহলে একটু ওয়েট করুন স্যার৷ ওর চ্যালা কালুয়াকে এখুনি ডিসকোতে দেখলাম৷ ওকে বাদ দিয়ে শাকালু কোনো কাজ করে না৷ ওকে জিজ্ঞেস করে আসি৷’

কথাগুলো বলেই ঝন্টু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল৷ পুলিশ হওয়ার এই সুবিধে৷ পাড়ায় পাড়ায় ওদের ইনফর্মার থাকে৷ সৌম্যরা চট করে খবর পেয়ে যায়৷ বাইপাসের এই অঞ্চলটা এই পনেরো-কুড়ি বছর আগেও ভেড়ি ছিল৷ ভেড়ি দখল করে, পলিটিক্যাল দাদারা জমি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে৷ এখন তো বাড়ি-ঘরদোর উঠে জায়গাটা বেশ জমজমাট৷ জমির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে প্রোমোটারদের নজরে পড়ায়৷ অ্যান্টিসোশালদের ভিড় হওয়াটা স্বাভাবিক৷ ইতিমধ্যে কাবাবের ডিশ এসে গেল৷ এক টুকরো মুখে দিয়ে সৌম্য বলল, ‘শাকালু সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি কালকেতুদা৷ ওর আসল নাম আফজল৷ এ ধরনের মাস্তানদের একজন গডফাদার থাকে৷ ভবেশ সামন্ত হচ্ছে ওর গডফাদার, রুলিং পার্টির নেতা৷ তাই আমাদের সাবধানে এগোতে হবে৷’

রেস্টুরেন্টের টেবলগুলো ধীরে ধীরে লোকজনে ভরে যেতে লাগল৷ উত্তরদিকে ছোট একটা পোডিয়াম আছে, লক্ষ করিনি৷ সেখানে কয়েকজন বাজনার সরঞ্জাম সাজিয়ে বসেছে৷ সেখান থেকে হঠাৎ মাইকে কে যেন বলল, ‘আমাদের মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম শুরু হতে যাচ্ছে৷ এখুনি গান গাইতে আসছে মিস জুলিয়া৷ হাততালি দিয়ে ওকে সোয়াগত করুন৷’

সঙ্গে সঙ্গে হাততালির ঝড় বয়ে গেল৷ পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অল্পবয়সি মেয়ে৷ মুখে চড়া মেকআপ, পরনে ঝলমলে সালোয়ার-কামিজ৷ হাতে মাইক নিয়ে, সময় নষ্ট না করে, জুলিয়া চটুল হিন্দি গান ধরল৷ দীপ এই ধরনের একজন আন্টির কথা বলেছিল বটে, কিন্তু এ সেই কি না বলা কঠিন৷ মুম্বইয়ে বার ডান্সিং বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাড়া খেয়ে বার ডান্সাররা অন্য শহরগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে৷ এসপ্লানেড অঞ্চলের কয়েকটা বার-এ এদের আমি দেখেছি৷ গান করার সময়ই জুলিয়া কোমর দুলিয়ে নাচতে লাগল৷ সামনের দিকে টেবলে যারা বসেছিল, তারা ওকে দেখে বেশ উত্তেজিত৷ ওর দিকে একজন টাকার বান্ডিল ছুড়ে দিতেই, নোটের বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ দেখে সৌম্য বলল, ‘তোলাবাজির টাকা কার গর্ভে যায় দেখুন কালকেতুদা৷ কেউ খেতে পায় না, কেউ আবার এভাবেও টাকা ওড়ায়৷’

সৌম্যর কথা শেষ হতে না হতেই ঝন্টু ছেলেটা ফিরে এল৷ রেস্টুরেন্টের ভেতর হই-হট্টগোলে ওর কোনো কথা কানে যাবে না বুঝে সৌম্য বলল, ‘উঠুন কালকেতুদা, বাইরে যাওয়া যাক৷’

পিছনদিকে পার্কিং স্পেসটা নির্জন৷ আমাদের পিছন পিছন সেখানে পৌঁছে ঝন্টু বলল, ‘স্যার, আপনাকে আগাম একটা খবর দিয়ে দিচ্ছি৷ আজকালের মধ্যে রাজারহাটে একজন প্রোমোটার মার্ডার হবে৷ এস্পি বলেই সবাই তাকে চেনে৷’

‘সে মার্ডার হবে কেন?’

‘একটা জমি নিয়ে ঝামেলা৷ রাইভাল প্রোমোটার বান্টির সঙ্গে৷ যে পলিটিক্যাল দাদার শেল্টারে এস্পি অ্যাদ্দিন ছিল, তাকে পার্টি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে৷ তাই গত ছ’মাস ধরে, ওর সময়টা ভালো যাচ্ছে না৷ এস্পিকে সরিয়ে দিয়ে বান্টি এবার রাজারহাটে রাজ করবে৷’

‘রাজারহাট থানায় খবরটা দিয়েছিস?’

‘দিয়ে লাভ নেই স্যার৷ দারোগাবাবু কিছুই করবে না৷ সল্টলেকে সেদিন বুড়ো বলে যে প্রোমোটার খুন হল, সেই খবরটা থানায় আগেই দিয়েছিলাম৷ দারোগাবাবু বললেন, নিজেদের মধ্যে মারপিট করে এই শালারা যত মরে, সমাজের ততই মঙ্গল৷’

শুনে মুখ গম্ভীর হয়ে গেল সৌম্যর৷ জিজ্ঞেস করল, ‘কিডন্যাপিংয়ের কথা কিছু জানতে পারলি?’

‘না স্যার৷ কালুয়া মুখ খুলল না৷ রাতে মাল-ফাল খেয়ে যখন আউট হয়ে যাবে, তখন মুখ খোলাব৷’

পকেট থেকে একশো টাকার পাঁচটা নোট বের করে সৌম্য এগিয়ে দিতেই ঝন্টু বলল, ‘কাল সকালের মধ্যে খবরটা পেয়ে যাবেন স্যার৷ আপনি নিশ্চিত থাকুন৷’

…কিডন্যাপিং কেসটা সলভ করার জন্য গতকাল পুরো দিনটা সময় দিয়েছি৷ মনে হয়েছে, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ কথাটা একশো ভাগ সত্যি৷ দীপের কেসটা হাতে না এলে সেটা বুঝতে পারতাম না৷ আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল তিনজন৷ কিন্তু, যাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিনি, শেষে দেখলাম, সে-ই জঘন্য অপরাধটা করেছে৷ মাত্র তিনদিনের মাথায় যে তাকে চিনতে পারব, তা ভাবতে পারিনি৷ তদন্তে যথেষ্ট সাহায্য করেছে সৌম্য ঠাকুর৷ অর্ধেক কাজটা অবশ্য এগিয়ে দিয়েছিল, দীপের দেওয়া তথ্য৷ ও এত সুন্দর কয়েকটা পয়েন্ট দিয়েছিল, শুনে সৌম্যও চমকে বলেছিল, ‘এই ছেলেটা যদি ভবিষ্যতে আমাদের প্রফেশনে আসে, তাহলে উন্নতি করবে৷’

যেমন, সেই বাসের হদিশ৷ যাতে কিডন্যাপাররা দীপকে তুলে দিয়েছিল৷ এসি ফর্টিথ্রি বাস চলে সল্টলেক-গলফগ্রিন রুটে৷ আসে সোজা ইস্টার্ন বাইপাস ধরে৷ তারপর ভলভো বাসটা যাদবপুর কানেক্টর ধরে শহরের ভিতরে ঢোকে৷ গলফগ্রিন গুমটিতে গিয়ে সৌম্য খুঁজে বের করেছিল, গণেশ ঠাকুরের ছবি টাঙানো সেই বাসটাকে৷ কন্ডাক্টর বলেছে, ‘হ্যাঁ স্যার, মনে পড়েছে৷ কাল সকালে একটা বাচ্চা ছেলেকে অভিষিক্তার মোড় থেকে একজন বাসে তুলে দিয়েছিল৷ বাচ্চাকে আমি নিজে নামিয়ে দিয়েছিলাম বিক্রমগড়ের সিগন্যালে৷’ অভিষিক্তার মোড় থেকে জলসাঘর খুব বেশি দূরে নয়৷ গাড়িতে মিনিট পাঁচ-ছয়েকের রাস্তা৷ সকালবেলায় আরও কম সময় লাগার কথা৷ তাই আমরা নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম, দীপের তথ্যটা ঠিক৷

কিডন্যাপিংয়ের মোটিভটা কী ছিল, সেটা পরিষ্কার হচ্ছিল না৷ জট পাকাল, সকালবেলায় টিভিতে একটা খবর দেখে৷ ভাঙড়ে দু-দল দুষ্কৃতীর সংঘর্ষে গুরুতর আহত রাজারহাটের ত্রাস শাকালু৷ ও কার ছত্রছায়ায় ছিল, সেই ঠিকুজি বের করেছে টিভির রিপোর্টার৷ ভবেশ সামন্তর নামটাও উঠে এসেছে৷ যথারীতি ভবেশ সামন্ত বাইট দিয়ে অস্বীকার করলেন, তিনি শাকালুকে চেনেনই না৷ গলফ ক্লাবে বসে কয়েকটা চ্যানেল সার্ফ করে খবরটা যাচাইয়ের চেষ্টা করলাম৷ কেউ বলছে, এটা রুলিং পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব৷ কেউ জোর দিচ্ছে, এলাকা দখলের লড়াই হিসেবে৷ একটা খবরে অবশ্য মোটামুটি সব চ্যানেল একমত, শাকালুর পেটে আর বুকে তিনটে গুলি লেগেছে৷ বাইপাসের ধারে কোনো নার্সিং হোমে ওকে ভরতি করা হয়েছে৷ তার মানে, কিডন্যাপিংয়ের পিছনে যাকে মাস্টারমাইন্ড বলে আপাতত মনে হচ্ছে, তাকেই এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না৷

ক্লাব থেকে হাউসিংয়ে ফিরছি, এমন সময় শিউলির সঙ্গে দেখা৷ ওর চোখ-মুখ দেখেই মনে হল, প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে৷ কাছে এসে শিউলি আমাকে বলল, ‘দাদা, সকাল থেকে অনেকবার ফোনে আপনাকে ট্রাই করেছি৷ না পেয়ে এখন আপনার ফ্ল্যাটেই যাচ্ছিলাম৷ সুজন দু-দিন ধরে নিখোঁজ৷ আমার মনে হচ্ছে, ও সিরিয়াস কোনো গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়েছে৷’

ক্লাবে গলফ খেলার সময় মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে রাখি৷ যাতে কেউ ডিসটার্ব করতে না পারে৷ দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, ‘এ কথা মনে হচ্ছে কেন?’

‘যত কাজই থাক, আমাকে না জানিয়ে, রাতে ও কোনোদিনই বাইরে থাকে না৷ অথচ, গত দু-দিন ধরে ও বাড়ি আসছে না৷ ফোন করেও ওকে পাচ্ছি না৷ প্রতিবারই বলছে, সুইচড অফ৷ ইনফ্যাক্ট, পরশুদিন সকালে আপনি যখন ফোন করে খবরটা দিলেন, দীপকে পাওয়া গেছে, তারপরই ওকে একজন ফোন করেছিল৷ তার সঙ্গে তর্কাতর্কি করে সুজন বাড়ি থেকে সেই যে বেরিয়ে গেল, তারপর আর ফেরেনি৷’

‘তোমার কি মনে হচ্ছে, বিজনেস সংক্রান্ত কোনো গন্ডগোল?’

‘ওর প্রোমোটারি বিজনেসের পুরোটাই তো দু-নম্বরি৷ অ্যান্টিসোশালদের নিয়ে কারবার৷ হাতে কাঁচা টাকা আসার পর থেকে ও কেমন যেন বদলে গেল৷ আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই, ও এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্সে জড়িয়ে পড়েছে৷ সেই মেয়েটার পিছনে টাকা ওড়াচ্ছে৷ আমার সঙ্গে রোজ রোজ অশান্তি, বাবার সঙ্গেও৷ ইদানীং কাউকেই ও সহ্য করতে পারছে না৷ এমনকী দীপকেও না৷ কী বলে জানেন, দীপ নাকি ওর ছেলে না৷’ বলতে বলতে শিউলি কেঁদে ফেলল৷

শিউলি আরও কিছু বলতে চাইছিল৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেসব আমি শুনতে চাইলাম না৷ ফুল্লরার মুখে ওদের দাম্পত্য কলহের কথা খানিকটা শুনেওছি৷ তাই বললাম, ‘আমার মনে হয়, পুলিশকে তোমার জানানো উচিত৷ বেলা দশটার মধ্যে সুজন যদি ফিরে না আসে, তাহলে একবার যাদবপুর থানায় যাও৷ ওখানে সেকেন্ড অফিসার সৌম্য ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে একটা ডায়েরি করে এসো৷ কিডন্যাপিংয়ের কেসটা ও ইনভেস্টিগেট করছে৷ তুমি থানায় যাওয়ার আগে আমি ওকে ফোনে সব বলে রাখব৷’

সুজনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটা বেশ রহস্যজনক৷ এর সঙ্গে দীপের কিডন্যাপিংয়ের কোনো যোগ আছে কি না, ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে ঢুকলাম৷ তখনই মনে হল, একবার অমিতাভকে ফোন করলে কেমন হয়? আমাদের কাগজের নর্থ চবিবশ পরগনার করেস্পন্ডেন্ট হল অমিতাভ৷ বৈদিক ভিলেজে হামলার খবর করে ও প্রথম আমাদের নজরে পড়ে৷ তার পর রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেটরাজ, তোলাবাজি নিয়ে ও অনেক খবর করেছে৷ ওখানকার সবাইকে ও ভালো করে চেনে৷ জলসাঘরের রেস্টুরেন্টে ঝন্টু বলে ইনফর্মারটা কাল সন্ধেবেলায় একটা আগাম খবর দিয়েছিল৷ রাজারহাটে নাকি দু-একদিনের মধ্যে এস্পি বলে কোনো প্রোমোটার মার্ডার হবে৷ সেই খবরটাও ওকে দেওয়া দরকার৷ বাড়ি ফিরেই অমিতাভকে ফোনে ধরলাম৷

‘শোন, এস্পি বলে কোনো প্রোমোটারকে তুই চিনিস?’

ও প্রান্ত থেকে অমিতাভ বলল, ‘ওহ, খবরটা তা হলে আপনি পেয়ে গেছেন?’

‘কী খবর রে?’

‘এস্পি তো কাল রাত এগারোটায় খুন হয়ে গেছে৷ বান্টির লোকেরা ওকে তুলে এনেছিল৷ রাজারহাটের সিন্ডিকেট অফিসে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে ওকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে৷ খবরটা আমি কাল মাঝরাত থেকেই চেস করছি কালকেতুদা৷ শান্তনুদাকে বলে দেবেন, অন্য কোনো রিপোর্টারকে যেন এখানে না পাঠায়৷ বিকেলে অফিসে গিয়ে খবরটা আমি লিখে দেব৷ লিড স্টোরি হতে পারে৷ এর মধ্যে পলিটিক্যাল অ্যাঙ্গেলও আছে৷’

শান্তনু ভট্টাচার্য আমাদের কাগজের নিউজ এডিটর৷ খবরটা একটু পরেই টেলিকাস্ট হবে, নিশ্চয়ই শান্তনুর চোখে পড়বে৷ আমার বলার কোনো দরকার নেই৷ খুন-খারাপি নিত্য হচ্ছে৷ আগাম জানান দিয়েই তা হচ্ছে৷ ঝন্টু তা হলে আমাদের ঠিক খবরটাই দিয়েছিল৷ অমিতাভর উৎসাহ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনার স্টোরিটা কী বল তো?’

‘এস্পির সঙ্গে বান্টির সম্পর্কটা অনেকদিন ধরেই খারাপ৷ এস্পি ছিল এমএলএ বাবিন মণ্ডলের লোক৷ আর বান্টি অম্বরীশ দত্তের৷ পরিবর্তনের পর অম্বরীশের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে৷ ফলে বান্টির এখন রমরমা৷ রাজারহাট থেকে বাবিন মণ্ডলের লোকজনকে মারধর করে ও হটাতে শুরু করেছে৷ এস্পি যদি নিজেকে গুটিয়ে নিত, তা হলে ওর এই দশা হত না৷ কিন্তু জমি ছাড়বে না বলে, বান্টির সঙ্গে ও অহেতুক পাঙ্গা নিতে গেল৷’

‘কেউ অ্যারেস্ট হয়েছে?’

‘হ্যাঁ৷ ন্যান্সি বলে একজন বার ডান্সার৷ বাইপাসে জলসাঘর বলে একটা বার-কাম-রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে মেয়েটা গান গায়৷ রাজারহাট পুলিশ ওকে আজ সকালে তুলে এনেছে৷’

জলসাঘরের নামটা শুনেই চমকে উঠে বললাম, ‘ওকে অ্যারেস্ট করার কারণ?’

‘মেয়েটা আসলে ঝাড়খণ্ডের৷ নাম নয়না সিং৷ কায়দা করে নাম নিয়েছে ন্যান্সি৷ মেয়েটা সেক্সি, দারুণ সুন্দরী৷ জলসাঘরে রোজ মাল খেতে যেত এস্পি৷ ন্যান্সির প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিল৷ একটা সময় ওকে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল রাজারহাটে ওর কোনো একটা ফ্ল্যাটে৷ সেইসময় ন্যান্সি প্রচুর টাকা খিঁচেও নিয়েছে৷ ইদানীং বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, এস্পির টাকাপয়সা ফুরিয়ে এসেছে৷ বাজারে প্রচুর ধারদেনা৷ ও তাই বান্টির দিকে ঝোঁকে৷ এস্পিকে অপমান করার সুযোগটা বান্টিও ছাড়েনি৷ ও প্রকাশ্যেই ন্যান্সির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেয়৷ ক’দিন আগে ন্যান্সিকে নিয়ে ও শেষ চালটা চালে৷ খুব ইন্টারেস্টিং কেস কালকেতুদা৷ খাদিম কর্তা কিডন্যাপিং কেসের কথা মনে আছে আপনার? অনেকটা সেই ধরনের৷’

‘শেষ চাল মানে?’

‘ক’দিন আগে এস্পিকে নাকি ন্যান্সি বলে, ও প্রেগন্যান্ট৷ হয় ওকে বিয়ে করতে হবে৷ নয়তো ও পুলিশের কাছে গিয়ে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কমপ্লেন করবে৷ লোকলজ্জার ভয়ে এস্পি ঘাবড়ে যায়৷ তখন মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে জলসাঘরেরই পোষা এক গুন্ডা শাকালু৷ ও বলে, দশ লাখ টাকা দিলে ন্যান্সি পুলিশের কাছে যাবে না৷ এই কনস্পিরেসির পিছনে যে বান্টি আছে, এস্পি তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ অত টাকা ও পাবে কোথায়? ন্যান্সি নাকি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, শাকালুই এস্পির মাথায় প্রথম ঢোকায় ওর বাবার কাছ থেকে টাকাটা আদায় করতে৷ তার আগে কিডন্যাপিংয়ের একটা নাটক করতে হবে৷ এস্পির দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে আছে৷ তাকে তুলে আনলেই টাকাটা সুড়সুড় করে ওর বাবা বের করে দেবে৷’

এ তো দীপের কিডন্যাপিং কেস-এর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! অমিতাভকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এস্পির আসল নামটা কী, তুই জানিস?’

‘সুজন পুরকায়স্থ৷ স্টাইল মেরে নিজেকে ও বলত এস্পি৷ ওকে আমি চিনতাম কালকেতুদা৷ দু-একদিন জলসাঘরে নিয়ে গিয়ে ও আমাকে কিছু খবরও দিয়েছে৷ ভদ্রঘরের ছেলে, ওর বাবা নাকি জজ ছিলেন৷ আগে এতটা বেপরোয়া ছিল না৷ ন্যান্সির পাল্লায় পড়েই এস্পি হঠাৎ বিগড়ে গেল৷ শুনলাম, ইন্টারোগেশন করার সময় ন্যান্সি নাকি পুলিশকে বলেছে, এস্পির ছেলেকে শাকালুর দল সত্যিই কিডন্যাপ করেছিল৷ দশ লাখ টাকা পাওয়ার পর ছেলেটাকে ওরা ছেড়ে দেয়৷ ভাবতেই পারছি না, বাবা হয়ে এস্পি কী করে এই ঝুঁকিটা নিল? শাকালুরা তো ছেলেটাকে খুনও করতে পারত!’

দীপকে কিডন্যাপ করার কারণটা এবার আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার৷ কিন্তু, টাকা পাওয়ার পরও ওরা সুজনকে খুন করল কেন? প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরোতেই অমিতাভ বলল, ‘কথা ছিল, কিডন্যাপিংয়ের খবর পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছোবে না৷ সেই গ্যারান্টি এস্পি নিজেই দিয়েছিল৷ কিন্তু পুলিশের কাছে খবরটা কেউ পৌঁছে দিয়েছিল৷ পুলিশের লোক তাই ওদের পিছনে লেগেছিল৷ সেটা জানতে পেরে এস্পির কাছে শাকালু কৈফিয়ত চায়৷ দুজনের মধ্যে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয়৷ এরপরই এস্পি জলসাঘরে গিয়ে, কারও কাছে জানতে পারে, ওর সঙ্গে ধোঁকাবাজি হয়েছে৷ ন্যান্সি আসলে প্রেগন্যান্ট নয়৷ এবং পুরো খেলাটার পিছনে রয়েছে বান্টি৷ শুনে রাগে ও অন্ধ হয়ে যায়৷ পরে ও আরও জানতে পারে, ন্যান্সি এখন বান্টির শেলটারে রয়েছে৷ রাতে সামনাসামনি মোকাবিলা করার জন্য ও বান্টির ডেরায় গিয়েই ভুলটা করে৷ ফলে নিজেই খুন হয়ে যায়৷ স্যাড, ভেরি স্যাড৷’

অমিতাভ ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর সোফায় বসে পড়লাম৷ সঙ্গে সঙ্গে পুরকায়স্থদা আর শিউলির মুখ দুটো চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ সুজনের খুন হওয়ার খবরটা নিশ্চয়ই টিভির নানা চ্যানেলে দেখাবে৷ এইসব রসালো ঘটনা কাগজে কাগজে ফলাও করে বেরোবে৷ পুরকায়স্থদারা এরপর হাউসিংয়ের লোকজনকে মুখ দেখাবেন কী করে? এই প্রথম একটা কেস সলভ করেও আমি খুশি হতে পারলাম না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *