সরল মানুষদের ঘোরপ্যাঁচ
সেকালে লোকরা ধর্ম সম্বন্ধে যে আমাদের চাইতে অনেক বেশি সচেতন ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। ডা. দ্বিজেন মৈত্র ছিলেন নামকরা অস্ত্রচিকিৎসক। তাঁর শ্বশুরমশাই সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেবার পরে ত্রিশ বছর পেনশন ভোগ করেছিলেন। সেটা নাকি চাকরির চেয়েও বেশিদিন।
তাঁর বাড়ির চাকর-বাকররা অনেকে তাঁর প্রভাবে পড়ে ব্রাহ্ম হয়েছিল। নিজেই তাদের খরচপত্র করে ব্রাহ্মমতে বিয়ে-থা দিতেন। শুনেছি একবার তাঁদের ঝিয়ের সঙ্গে পাচকের বিয়ে হচ্ছে। নিজেই আচার্য হয়ে, যেমন ব্রাহ্ম বিয়েতে বলে, পাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘শ্রীমান পাঁচকড়ি তুমি কি এই পবিত্র উদ্বাহ ব্রতের জন্য প্রস্তুত হইয়াছ?’ সে মহা বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ‘প্রস্তুত হইসি না তো আইসি ক্যান্?’
আমাদের বাড়িতেও যারা কাজকাম করত, তারা মাঝে মাঝে সরল মনে বেশ মজার কথা বলত। একবার দেখা গেল খ্রিস্টান বেয়ারা খ্রিস্টান রাঁধুনের হাতে খেতে রাজি নয়। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল, ‘সে কী করে খাব? ওর যে ছোট জাত।’
আমার বাবা অবাক হলেন, ‘তোমরা না খ্রিস্টান?’ বেয়ারা বলল, ‘খ্রিস্টান হয়েছি বলেই কি বাপ-পিতেমো’র ধম্ম ছাড়তে হবে?’
আমাদের খ্রিশ্চান আয়ার সঙ্গে হিন্দু বেয়ারার একবার তর্ক হওয়াতে, আয়া এল নালিশ করতে, ‘নারাণের আক্কেলটা দেখলেন, মা? বলে নাকি লক্ষ্মীঠাকরুণ হিঁদুদের দেবতা!’ আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘ঠিকই বলে আমোদিনী, উনি হিন্দুদের দেবতা!’ আয়া চটে গেল, ‘তা বললেই তো মানবনি, মা। আমরা হলাম গিয়ে চার পুরুষের খ্রিস্টান। আমরা বরাবর ঘটা করে এসেছি একথা কে না জানে! এরপর নারাণ হয়তো বলবে যে খ্রিস্টানদের তুলসীতলায় সন্ধ্যা দিতে নেই। হুঁঃ!’
খাওয়া-শোওয়ার মতো স্বাভাবিকভাবে ধর্মটাকে নেয় এরা। ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে যায় না। সহজ বুদ্ধি যা বলে তাই করে। মধুপুরে আমার ভাসুরের মালির একটা ক্যাবলা ছেলে ছিল। তাকে দিয়ে বাগানের কোনও কাজই করানো যেত না। তবে রান্নাটা পারত। কিন্তু জলচল জাত নয়; বাড়িতে গোঁড়া আত্মীয়স্বজন ছিলেন; কাজেই রান্নাঘরের কাজও দেওয়া যেত না। ছেলের বাপ দিনরাত তাকে যা নয় তাই বলে বকাবকি করত। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা পালিয়ে গেল।
এর অনেক বছর পরে আমার জা পুজো দেখতে কাশীতে একজনদের বাড়িতে গেছেন। নিজেদের মন্দির, ঘটা করে গৃহদেবতার পুজো হয়। সেখানে গিয়ে শুনলেন যে অনেক দিন পরে ভোগ রাঁধবার জন্য একজন ভাল বামুনঠাকুর পাওয়া গেছে।
পুজোর পর সেই বামুনের রান্না খেয়ে সবাই ধন্য-ধন্য করতে লাগলেন। আঁচাবার সময় তার মুখ দেখেই দিদি তাকে চিনতে পারলেন। এ তো সেই মালির ছেলে ছাড়া কেউ নয়!
এতগুলো লোকের কীরকম মনের ভাব হবে, সেকথা ভেবে দিদি কিছু বললেন না। নিজে সব বিষয়ে ভারী উদার ছিলেন। গলির মুখে কিন্তু সেই ছোকরা এসে তাঁর পায়ে পড়ল। ‘খেতে পেলাম না, মা, তাই বাধ্য হয়ে বামুন হয়ে গেলাম। ওনাদের বলে দিলে বাকি মাইনে তো দেবেনই না, তার ওপর ঠেঙিয়েই মেরে ফেলবেন।
দিদি বললেন, ‘তা হলে আজই বিকেলে মায়ের অসুখ বলে, বাকি মাইনে নিয়ে বাড়ি চলে যা। সন্ধ্যায় এসে যেন দেখতে না পাই।’
ছেলেটার জন্য কেমন মায়া লাগল। ‘হ্যাঁরে, তোর বামুন হবার কী দরকার? এত ভাল রাঁধিস্, এমনিতেই লোকে তোকে লুফে নেবে। তুই বরং গিরিডিতে আমাদের বেয়াইমশায়ের বাড়ি চলে যা। তাঁরা তোকে চেনেন। রান্নার লোক খুঁজছেন শুনেছি।’
এইরকম সরল মানুষদের ঘোরপ্যাঁচে সংসারটা ভরতি। সব দেশেই তাই। যারা লেখাপড়া জানে না, তাদের অনেক সরল বিশ্বাস থাকে। কিছুদিন আগে বিলেতের একটা মজার ঘটনার কথা কাগজে পড়েছিলাম। ওখানকার ব্যবস্থা বড় চমৎকার। ৬৫ বছর বয়স হলে, নাগরিকরা বুড়ো বয়সের বিশেষ পেনশন পায়। যাতে না খেয়ে কেউ না মরে। এইরকম দুই পেনশনভোগী বুড়ি একসঙ্গে থাকত। তাদের মধ্যে ভারী ভাব। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে তাদের ঘরকন্না। এক বুড়ির পায়ে বাত, চলে-ফিরে বেড়ানোই দায়। শেষটা অনেক লেখালেখি করে, বাড়িতে সরকারি ইন্সপেক্টর আনিয়ে, খোঁড়া বুড়ির পায়ের অবস্থা দেখিয়ে, এই ব্যবস্থা হল যে ছোট বুড়িই প্রতি সপ্তাহে গিয়ে দুজনার পেনশন তুলে আনবে।
এই ব্যবস্থাই বছরের পর বছর ধরে চলতে লাগল। বারো বছর পরে এক দিন ছোট বুড়ি পেনশন আনতে গিয়ে দেখে তার জন্য পুলিশের লোক অপেক্ষা করছে। কে তাদের বলে দিয়েছে খোঁড়া বুড়ি দশ বছর হল মারা গেছে আর ছোট বুড়ি দুজনার পেনশন বেআইনিভাবে একা ভোগ করছে। কাজেই আইনমতে তাকে ধরে হাজতে পোরা যায়!
শুনে সে তো কেঁদেকেটে এক-সা করল। কোনও বেআইনি কাজ সে করেনি। দুজনার পেনশন সে একা দশ বছর ভোগ করছে সত্যি, কিন্তু খোঁড়া বুড়ি মারা যাবার আগে তার পেনশনটি উইল করে ছোট বুড়িকে দিয়ে গেছে! এই তো সেই উইল, খোঁড়া বুড়ির নিজের হাতে লেখা। পাড়ার দু’জন বন্ধু সাক্ষী হয়ে সই দিয়েছে। পরের জিনিস সে নিতে যাবে কেন? প্রতি রবিবার সে গির্জে যায়!
পেনশন আপিসের কর্মচারীরা মহা মুশকিলে পড়লেন। ৭৭ বছরের বুড়ি, তার সত্যিই বিশ্বাস বন্ধুর পেনশন তারই প্রাপ্য! কোনও কল্যাণ সমিতির দয়ায়, শেষ পর্যন্ত তাকে হাজতে যেতে হয়নি। তবে বন্ধুর পেনশনও আর পায়নি।