সরকার ও বাঙলা
‘তেরশত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ মোতাবেক উনিশশত বাহাত্তর খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে রচতি, বিধিবদ্ধ ও সমবেতভাবে গৃহীত ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’-এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে আছে তিন শব্দের একটি বাক্য : ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ সংবিধানটি প্রথমে রচিত হয়েছিলো ইংরেজিতে, পরে রূপান্তরিত হয় বাঙলায়। বাহাত্তরের সংবিধানটি যে প্রথমে ইংরেজিতে রচিত হয়েছিলো, এটি একটি বড়ো ও তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ- সংবাদটি জানায় যে ঔপনিবেশিক ঘোর কাটানো শক্ত। সংবিধান প্রণেতারাও সম্ভবত বুঝছিলেন এ-কথাটি, এবং এও বুঝেছিলেন যে স্বাধীন দেশে অনুবাদিত সংবিধান যথেষ্ট মর্যাদা পাবে না। তাই এটিকে মর্যাদা দেয়ার জন্যে স্থির করা হয় যে সংবিধানের বাঙলা ও ইংরেজি সংস্করণের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দিলো বাঙলা সংস্করণটি প্রাধান্য পাবে। ১৯৭২-এর ছোটো তন্বী সংবিধানটিকে এর পরে বারবার কাটাছেঁড়া করা হয়, চেপে চেপে ডলে মথে এটিকে শাসকদের জন্যে সুখকর করা হয়; ১৯৭৯-র ফেব্রুয়ারিতে এটি পরিণত হয় তিনশো সাতাশ পৃষ্ঠার এক মোটাসোটা গ্রন্থে এর অনেক অনুচ্ছেদ সংশোধিত হয়েছে, বিলুপ্ত হয়েছে নানা অংশ (কোনো দিন হয়তো বিলুপ্ত হ’তে পারে সবটাই), কিন্তু তৃতীয় অনুচ্ছেদটির গায়ে আঁচড় লাগে নি। যতো দিন বাঙলাদেশ জীবিত থাকবে, আশা করা যায়, ততো দিনই অটুট থাকবে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ অনুচ্ছেদটি। সংবিধান অনুসারে বাঙলাদেশের প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব বাঙলা ভাষাকে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করা, অন্য ভাষা ব্যবহার করা সংবিধান অমান্য করার সমতুল্য। কিন্তু বাঙলাদেশের বাঙলা সংবিধানের ভেতরেই ঢুকেছে ইংরেজি : প্রথমে ঢোকে ১৯৭৪-এর মে মাসের ষোলো তারিখে ভারতের সাথে একটি চুক্তিরূপে; পরে ঢোকে ১৮-১২-১৯৭৮ তারিখে “দি সেকেণ্ড প্রোক্লেমেশন (ফিফটিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডার’ নামে। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি সরকার এসেছে, বাঙলা প্রচলনে কখনো উদ্যম কখনো আলস্য দেখা দিয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই বাঙলা ভাষাকে অবহেলা করে নি বা করতে পারে নি। যে-রাষ্ট্রপতিদের সরকার টিকেছে কয়েক বছর, তাঁরা তো বাঙলা প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছেনই, মাত্র উনাশি দিন রাষ্ট্রপতিত্ব করেছেন যিনি, তিনিও টুপি আচকান প’রে বাঙলা প্রচলনের নির্দেশ দিতে ভোলেন নি। এতে বোঝা যায় বাঙলাদেশের প্রধান কর্মকর্তাগণ বাঙলা ভাষাকে সব সময়ই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন, যদিও তাঁদের নির্দেশ ব্যাপকভাবে প্রতিপালিত হয় নি।
কোনো সরকারই বাঙলা প্রচলনের নির্দেশ দিতে কুণ্ঠাবোধ করে নি; বরং প্রতি বছর, ফেব্রুয়ারি আসতে-না-আসতে বা অন্য যে-কোনো সময়, নির্দেশ প্রচার ক’রে, সর্বস্তরে বাঙলা প্রচলনের অনুরোধ জানিয়ে ব্যক্ত করেছে বাঙলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প। প্রচারিত হয়েছে রাষ্ট্রপতিদের স্বাক্ষরিত নির্দেশ, উপরাষ্ট্রপতির নির্দেশ, অসংখ্য সচিব উপসচিব শাখা অফিসারের স্বাক্ষরিত ‘অনুরোধ-নির্দেশ’। সব মিলিয়ে ক-হাজার ‘অনুরোধ-নির্দেশ’ জারি হয়েছে, তা কেউ বলতে পারে না, কোনো মন্ত্রণালয়ের ফাইলেই ওর সবগুলো নেই। তবে বোঝা যায় এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ‘সচিব কমিটি’র অনেক সভা, অনেক কাগজ, এবং অনেক ঘণ্টা এ-কাজে ব্যস্ত থেকেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য মুদ্রাক্ষর ও সাইক্লোস্টাইল যন্ত্র। এ-সব সিদ্ধান্ত-নির্দেশ শুধু বাঙলা ভাষায়ই প্রকাশ পায় নি, ইংরেজি ভাষায়ও গৃহীত হয়েছে বাঙলা প্রচলনের অনেক সিদ্ধান্ত, জারি হয়েছে অনেক নির্দেশ। বাঙলা প্রচলনের জন্যে বাঙলাদেশের তৃতীয় সরকার সৃষ্টি করেছিলো ‘সচিব কমিটি’ নামক এক শক্তিমান, কিন্তু প্রায় নিষ্ক্রিয়, সংঘ। এ-সংঘ বাঙলা প্রচলন সম্বন্ধে বেশি ভাবার সময় যদিও পায় নি, তবে যখন ভাবতে বসেছে তখনি ভেবেছে ইংরেজিতে; পরে বাঙলা অনুবাদ দেয়া হয়েছে কখনো, কখনো হয় নি।
কোনো কোনো রাষ্ট্রপতি বাঙলা প্রচলনের ব্যাপারটিকে নিয়েছেন ব্যক্তিগত ব্যাপার হিশেবে, এবং কঠোর আবেগস্পন্দিত ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন; আবার কেউ দায়িত্ব ন্যাস্ত করেছেন কমিটির কাঁধে। আমাদের জীবনের অন্যান্য এলাকা যেমন বিশৃঙ্খল ও অপরিকল্পিত বা অপপরিকল্পিত, বাঙলা প্রচলনের ব্যাপারটিও তেমনি। কতো দিনের মধ্যে রাষ্ট্র ও জীবনের সব এলাকায় বাঙলা প্রচলিত হবে, সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি। রাষ্ট্রপতিরা যখন নির্দেশ দিয়েছেন, তখন তাঁরা ‘অবিলম্বে’ বাঙলা প্রচলনের কথা বলেছেন, কিন্তু সচিবেরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তাঁরা সরল ইংরেজিতে বলেছেন, ‘দ্যায়ার ইজ নো নিউ টু ফিক্স এ টার্গেট ডেট ফর দি ইভেনচুয়াল সুইচওভার টু বেঙ্গলি।’ সচিবদের কাছে বিষয়টা যুক্তাক্ষর, পরিভাষা, মুদ্রাক্ষরযন্ত্র, মুদ্রাক্ষরিক ও সাধু-চলতির সমস্যা। অর্থাৎ তাঁরা গভীর আন্তরিকভাবে বিষয়টি অনুধাবন করতে ইচ্ছুক নন; এবং তাঁদের ক্রিয়াকলাপ নির্দেশ করে যে বাঙলা প্রচলন ব্যাহত করাই তাঁদের গোপন উদ্দেশ্য। ১৯৮১-র শেষ দিকে বাঙলা প্রচলনের জন্যে দুটি উদ্যোগ নেয়া হয়- বাঙলা প্রচলনের জন্যে গঠন করা হয় একটি আধা-’সেল’ (এর অন্য দায়িত্ব রয়েছে); এবং মুদ্রাক্ষরিক তৈরির জন্যে সৃষ্টি করা হয় ‘স্টাফ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ (প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি নাম স্রষ্টাদের মানসপ্রবণতা নির্দেশ করে) নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
বাঙলা ভাষা বাঙলাদেশের সরকারগুলোর কাছে একটি সমস্যা, এবং এমন সমস্যা যা কোনো অসাবধান মুহূর্তে বিপজ্জনকভাবে বিস্ফোরিত হ’তে পারে। প্রতিটি সরকারই এ-কথা জানে, তাই সরকারগুলো কিছুটা কাজে কিছুটা বুলিতে সন্তুষ্ট রাখতে চায় বাঙলা ভাষাপন্থীদের, অর্থাৎ বৃহৎ জনমণ্ডলিকে। একাত্তর-উত্তর এক দশকে দেখা গেছে যে-সরকার যতো প্ৰগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী, সে-সরকার ততো বেশি চেষ্টা করেছে বাঙলা প্রচলনের; আর প্রগতিবিমুখ সরকার বাঙলা ভাষা থেকে স’রে গেছে, যদিও বাধ্য হ’য়েই বেশি দূরে যেতে পারে নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সর্বস্তরে বাঙলা প্রচলনের উদ্যম দেখা গিয়েছিলো; কিন্তু পঁচাত্তরের পরে বাঙলা প্রচলনের উদ্যম-উদ্যোগ হ্রাস পায়; এমনকি বাঙলাবিরোধী ক্রিয়াকলাপ দেখা দেয়। একটি ছোটো উদাহরণ দেয়া যাক। বাঙলাদেশের সংবিধানের ৪৮-অনুচ্ছেদে লেখা আছে— ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন।’ অর্থাৎ বাঙলাদেশের প্রধান কর্মকর্তার অভিধা ‘রাষ্ট্রপতি’, ‘প্রেসিডেন্ট’ নয়। কিন্তু পঁচাত্তরের পর ‘রাষ্ট্রপতি’ অভিধাটি লোপ পায়, যদিও সংবিধানে এখনো তাই আছে; এবং ‘প্রেসিডেন্ট’ অভিধাটি সর্বত্র ব্যবহৃত হ’তে থাকে।
কিন্তু কোনো সরকারই বাঙলা ভাষার বিরোধিতা করে নি গত এক দশকে; বরং প্রতিটি সরকারই বাঙলা প্রচলনের জন্যে অজস্র নির্দেশ প্রচার করেছে। কতগুলো নির্দেশ প্রচারিত হয়েছে গত দশকে, তা কেউ জানে না, কোনো মন্ত্রণালয় জানে না; এমনকি কোনো মন্ত্রণালয়েরই স্পষ্ট ধারণা নেই বাঙলা প্রচলনের নির্দেশ প্রচারের অধিকার কোন মন্ত্রণালয়ের। যতো নির্দেশ প্রচারিত হয়েছে, তার সবগুলো এখন খুঁজেও পাওয়া যায় না। প্রচারিত নির্দেশগুলোর একগুচ্ছ এমন :
[ক] ১২-৩-১৯৭৫ তারিখে রাষ্ট্রপতির সচিবালয় থেকে প্রচারিত হয় এ-নির্দেশটি : ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিসআদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙ্গালী কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।
এ আদেশ জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারী অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোন অন্যথা হলে উক্ত বিধি লংঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।… কোন বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার সাথে সাথে ইংরেজি অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষায় একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন।…এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকরী হবে।’ (শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি, ১২-৩-১৯৭৫)
[খ] ২৩-১০-১৯৭৫ তারিখে বঙ্গভবনের রাষ্ট্রপতিভবন থেকে প্রচারিত হয় এ-নির্দেশটি : ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা। পূর্বেই আদেশ দেওয়া হইয়াছে যে সরকারী নথিপত্র এবং চিঠিপত্র বাংলায় লেখা হইবে। এই আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাইতেছে যে সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধাসরকারী দফতরসমূহে এখন পর্যন্ত ইংরেজিতে নথি এবং চিঠিপত্র লেখা হইতেছে। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের এই প্রবণতা একান্তই অনভিপ্রেত। অতএব, পুনরায় এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে যে সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধাসরকারী দফতরে বাংলায় নথি ও চিঠিপত্র লেখা হইবে।…এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকরী হবে।’ (খন্দকার মোশতাক আহমদ, রাষ্ট্রপতি)
[গ] ১২-১-১৯৭৯ তারিখে ‘গভর্নমেন্ট অফ দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’-এর ‘ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েট, ক্যাবিনেট ডিভিশন’ থেকে একটি দীর্ঘ ইংরেজি নির্দেশ জারি হয়। নির্দেশটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং এমন (আমি বাঙলা বর্ণে লিখছি) : ‘এক্সট্রাক্ট ফ্রম দি মিনিটস অ্যান্ড ডিসিশন্স অফ দি মিটিং অফ দি কাউন্সিল অফ মিনিস্টারস হেল্ড অন ডিসেম্বর ২৮, ১৯৭৮। অ্যাজেণ্ডা : ৫- ওয়াইডার ইউজ অফ বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ অ্যাট অল লেভেলস ইন অফিসেস অ্যাণ্ড কোর্টস।— ইন মার্চ, ১৯৭৫ দি দেন অন’বল প্রেসিডেন্ট হ্যাড অরডারড দ্যাট বেঙ্গলি শ্যুড বি ইনট্রোডিউসড ইন অল অফিসেস অফ গভর্নমেন্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট অ্যাণ্ড অটনমাস বডিজ। ও অ্যাণ্ড এম উইং অফ দি এসটাবলিশমেন্ট ডিভিশন হ্যাড টেকেন সারটেন কংক্রিট স্টেপস, অ্যাণ্ড ইজ অ্যানগেজড ইন ডেভেলপিং মেজরস টু ফেসিলিটেট ওয়াইডার এপ্লিকেশন অফ বেঙ্গলি ইন দি অফিসেস। এ নাম্বার অফ প্র্যাকটিক্যল অ্যান্ড সাইকোলজিক্যল অবস্ট্যাকলস এপিয়ার টু বি ডিলেইং দি ইমপ্লিমেনটেশন অব দি গভর্নমেন্ট ডাইরেকটিভ। (এ) দি বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ ইজ অ্যান ইনটেল পার্ট অফ আওয়ার ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ওয়াজ এ কি এলিমেন্ট ইন আওয়ার স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেনডেন্স। দি ফেইলুর টু ইউস অ্যান্ড অ্যাপ্লাই দি ল্যাংগুয়েজ অ্যাট অল লেভেলস অফ ন্যাশনাল লাইফ ইজ এ স্যাড কমেনটারি অন আওয়ার ডিক্লেয়ার্ড ইন্টেনশন্স অ্যান্ড সিন্সিয়ারিটি। অল ওয়ার্কস কন্সারনিং দি ক্যাবিনেট অ্যান্ড দি মিনিস্ট্রিজ মে বি কনডাকটেড ইন বেঙ্গলি ফ্রম নাও অনওয়ার্ডস। রিপোর্ট অন কম্যান্ড ওভার দি মাদার টাং শুড বি মেইড এ পার্ট অফ দি এ-সি-আর অফ ইচ অফিসার। (বি)…এ রেসপন্সিবল কমিটি মে বি ফর্মড টু অ্যানশিউর প্রিপ্যারেশন অফ টেকস্ট বুক্স ইন সিম্পল অ্যান্ড লুসিড বেঙ্গলি। (সি)…দি পি-এস-সি মে কনডাক্ট দি অ্যাকজামিনেশন্স ইন বেঙ্গলি হুইচ উইল ইনফুলুয়েন্স দি ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড দি অফিসেস টু অ্যাডপ্ট ওয়াইডার ইউজ অফ বেঙ্গলি।…দি ল্যাংগুয়েজ মাস্ট রিড ইটসেলফ অফ দি গ্রিপ অফ দি ‘পান্ডিটস’ অ্যান্ড মাস্ট রিচ ফর দি পিপল। (ডি)…দ্যায়ার ইজ নো নিড টু ফিক্স এ টারগেট ডেট ফর দি ইভেনচুয়াল সুইচওভার টু বেঙ্গলি।’
[ঘ] ২৪-১-১৯৭৯ তারিখে ‘মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়, সংস্থাপন বিভাগ, শাখা এডি-২’ ‘অফিসআদালতের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষাব্যবহার প্রসংগে’ বহু ধারাবিশিষ্ট এক নির্দেশ প্রচার করে। ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা যথাসম্ভব শীঘ্র চালু করার লক্ষ্যে মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকে’ মুদ্রাক্ষরিক, সাঁটলিপিকার, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা ক’রে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। এ-বৈঠকে গৃহীত দুটি সিদ্ধান্ত এমন : ‘(ঙ) বিদেশে রাষ্ট্রদূত অথবা ডেলিগেশনের প্রধান/নেতা আপন বক্তব্য বাংলায় বলার সম্ভাব্য সকল সুযোগ গ্রহণ করবেন এবং দোভাষীর ব্যবস্থা করবেন। (চ) বাংলা ভাষার মর্যাদার খাতিরে ইংরেজী ভাষার ওপর তাকে প্রতি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে।’ (উপসচিব, (প্রশাসন), সংস্থাপন বিভাগ)
[ঙ] মন্ত্রীপরিষদ সচিবালয়ের সংস্থাপন বিভাগের যুগ্মসচিব ও বাঙলা ভাষা বাস্তবায়ন সেলের কর্মকর্তা কর্তৃক ২৪-১-১৯৭৯ তারিখে স্বাক্ষরিত এক স্মারকলিপিতে প্রচার করা হয় নিম্নসিদ্ধান্তসমূহ : ‘(১) অফিসআদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার সংক্রান্ত ‘সচিব কমিটি’র ৩১-৩-১৯৭৯ তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে অফিসআদালতে সমস্ত কাজ বাংলা সাধু ভাষায় সম্পন্ন করিতে হইবে। (২) উক্ত সচিব কমিটির ২৭-১১-৭৯ তারিখের বৈঠকে বিষয়টি পুনরায় আলোচিত হয় এবং অফিস আদালতের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমতা রক্ষার জন্য সাধু ভাষার ব্যবহারই উপযুক্ত বলিয়া মত প্রকাশ হয়। (৩) সচিব কমিটির উপরোক্ত সিদ্ধান্তক্রমে অফিসআদালতের যাবতীয় কাজকর্ম বাংলা সাধু ভাষায় সম্পন্ন করিবার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা যাইতেছে।’
[চ] ২৪-৪-১৯৮১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের এক বৈঠকে বাঙলা প্রচলন সম্পর্কে কতিপয় পদক্ষেপ অনুমোদিত হয়। ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীর একাংশ এমন : ‘বিষয় : অফিসআদালতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার। সিদ্ধান্ত (২৪) : ২১-২-৮২এর মধ্যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য নিম্নে উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ অনুমোদন করা হয় : (১) বাংলা একাডেমী যে পরিভাষা পুস্তক প্রণয়ন করেছে, তাছাড়া আরও যথোপযুক্ত বাংলা পরিভাষা পুস্তক প্রণয়ন। (২) ব্যাপকভাবে মুদ্রাক্ষরিক ও সাঁটমুদ্রাক্ষরিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। (৩) প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাংলা মুদ্রাক্ষরিকযন্ত্র সংগ্রহ। (৪) আইনকানুন, বিধি, নির্দেশাদি, প্রশিক্ষণগ্রন্থসমূহ অনতিবিলম্বে বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা, যাতে কোর্টে এবং সামরিকবাহিনীর কার্যালয়সমূহেও বাংলা ভাষা প্রচলন সহজতর হতে পারে। (৫) মন্ত্রীমহোদয় এবং সচিবগণ বাংলা ভাষায় লিখিত না হলে নিষ্পত্তির জন্য কোন নথি গ্রহণ করবেন না। (বিচারপতি আবদুস সাত্তার, উপ-রাষ্ট্রপতি, ৭মে ১৯৮১)। ওপরের সিদ্ধান্তসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ’ জানিয়ে সংস্থাপন বিভাগের ও অ্যান্ড এম উইং-অন্তর্গত ‘ভেটিং ও বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন সেল’ একটি স্মারকলিপি প্রচার করে ৩-৬-১৯৮১ তারিখে।
[ছ] ‘অফিসআদালতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত সচিব কমিটি’র একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২-৮-৮১ তারিখে, যাতে চোদ্দটি দীর্ঘ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ-সভায় নরনারীর নামের আগে ‘জনাব-বেগম’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
[জ] ৬-১১-১৯৮১ তারিখে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ‘অফিস কাজকর্মে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের জরুরী নির্দেশাবলী’ নামে একটি নির্দেশ প্রচারিত হয়। এটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ : ‘অফিসআদালতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য সুস্পষ্টভাবে সরকারী নির্দেশ রহিয়াছে। সে মোতাবেক যদিও এই মন্ত্রণালয়ে কাজকর্মে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইতেছে, তবুও ইহার আওতাধীন কোন কোন পরিদপ্তর/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহে এখনো ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাইতেছে। ইহা নিঃসন্দেহে জাতীর আদর্শের পরিপন্থি। এই প্রবণতা পরিহার করিয়া অফিস কাজকর্মে অবিলম্বে বাংলায় সকল কার্য সম্পাদনের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অত্র মন্ত্রণালয়ে ও ইহার আওতাধীন পরিদপ্তর/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহকে পুনরায় অনুরোধ করা যাইতেছে। এখন হইতে সকল কাজকর্মে পুরোপুরিভাবে বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন ও মানিয়া চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করা যাইতেছে : (১) অফিস কাজকর্মে ব্যবহারের জন্য যদিও সাধু ভাষার প্রচলনই মূল লক্ষ্য, তবুও প্রথম পর্যায়ে চলতি ভাষার ব্যবহার দূষণীয় বলিয়া গণ্য হইবে না। (২) বিশেষ প্রকৃতির কাজকর্মের কারণে যেসব ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষা ব্যবহৃত হইতেছে, সেই সব ক্ষেত্রে অচিরেই বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যবস্থা করতে হইবে।…(৫) মন্ত্রীমহোদয়, সচিব এবং অত্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদপ্তর/সংস্থাসমূহের সংশ্লিষ্ট প্রধানগণ বাংলা ভাষায় লিখিত না হইলে নিষ্পত্তির জন্য কোন নথি গ্রহণ করিবেন না।…(৭) ১৯৮২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাংলা মুদ্রাক্ষরিকযন্ত্র সংগ্রহ করার ব্যবস্থা গ্ৰহণ করিতে হইবে। প্রয়োজনবোধে ইংরেজী মুদ্রাক্ষরযন্ত্রগুলিকে বাংলায় রূপান্তরকরণের ব্যাপারে বাংলা একাডেমীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাইবে। ইহা ব্যতীত বাংলাদেশ ষ্টেশনারি অফিসে বহুসংখ্যক বাংলা মুদ্রাক্ষরিকযন্ত্র মজুত রহিয়াছে।…সংগত কারণ ব্যতিরেকে বাংলা ভাষা ব্যবহার সংক্রান্ত উপরোক্ত নির্দেশাবলী লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে।
[ঝ] বাঙলা প্রচলনের উদ্দেশ্যে সরকারি উদ্যোগের, অর্থাৎ ‘সচিব কমিটি’র শেষ সভা বসে ১৮-১-১৯৮২ তারিখে। ওই সভার সিদ্ধান্তরাশি এখনো নথিতেই গুপ্তভাবে আছে।
অনেকটা আক্ষরিকার্থেই অজস্র সরকারি সিদ্ধান্ত-নির্দেশের কয়েকটি ওপরে উদাহরণ হিশেবে দেয়া হলো। এগুলো নির্দেশ করে যে বাঙলা প্ৰচলন সম্পর্কে নিরন্তর চিন্তাভাবনা করেছে আমাদের সরকারসমূহ, যদিও তাদের চিন্তা বিশেষ বাস্তবায়িত হয় নি। নির্দেশগুলোর ভুল বানান, বিকৃত বাক্য, সাধু-চলতির মিশ্রণ, ইংরেজির প্রতাপ সহ্য করা যেতো যদি নির্দেশগুলোর প্রয়োগ ঘটতো বাস্তবে। নির্দেশগুলো আমাদের আমলাশ্রেণীর নিপুণ, নিরন্তর, নিরর্থক নথিক্রিয়ার নমুনামাত্র। সরকারি কাজে এখন কী পরিমাণ বাঙলা ব্যবহৃত হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই; তবে শতকরা দশভাগের বেশি কাজ সম্ভবত বাঙলায় হয় না। আমাদের আমলাগণ বাঙলা প্রচলনের উপায় খুঁজতে গিয়েও মাঝেমাঝেই নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। যেমন : ১২-১-১৯৭৯ তারিখের ইংরেজিতে গৃহীত সিদ্ধান্তে ‘পান্ডিটস বনাম পিপল’-এর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির ইঙ্গিত রয়েছে; এবং ‘দ্যায়ার ইজ নো নিউ টু ফিক্স এ টারগেট ডেট ফর দি ইভেনচুয়াল সুইচওভার টু বেঙ্গলি’ সিদ্ধান্তটি বাঙলা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পণ করেছে মহাকালের হাতে। ৩১-৩-১৯৭৯ তারিখের এক সিদ্ধান্ত বাঙলা ভাষার দু-রীতির, সাধু ও চলতির, মধ্যে বাঁধিয়েছে কলহ। এখন যদিও চলতি রীতিই গ্রহণ করা উচিত, তবুও সচিব কমিটি গ্রহণ করতে চেয়েছে সাধুরীতি, এবং জন্ম দিয়েছে নতুন সমস্যা। তবে সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি হচ্ছে যে বাঙলা প্রচলন সম্পর্কে কোনো সরকারই কোনো সুস্পষ্ট-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে নি। তাই গত এক দশকের সমস্ত সরকারি বাঙলা বাস্তবায়ন উদ্যোগ-প্রচেষ্টায়ই আধা-আন্তরিক। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোর আধা-আন্তরিকতা পরবর্তী বছরগুলোতে শূন্য-আন্তরিকতায় পর্যবসিত হয়।