সয়তানি বুদ্ধি

সয়তানি বুদ্ধি 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

মাঘ মাসের একদিবস দিবা দশটার সময় খানমহম্মদ নামক এক ব্যক্তি থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী তাঁহার আফিসে বসিয়া নিয়মিত কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিতেছিলেন। খানমহম্মদ তাঁহার সম্মুখে গমন করিয়া যোড় হস্তে দণ্ডায়মান হইল। 

তাহাকে দেখিয়া কৰ্ম্মচারী কহিলেন “তুমি কে, কোথা হইতে আসিয়াছ ও তোমার প্রয়োজনই বা কি?” 

খান। হুজুর, আমার নাম খানমহম্মদ, উজীরপুরে আমার বাসস্থান। আমি বিশেষরূপ বিপদস্ত হইয়া আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। 

কৰ্ম্ম। তুমি কি বিপদগ্রস্ত হইয়াছ? 

খান। আমাদিগের গ্রামের জমীদার পাওনা খাজনার নিমিত্ত আমার পিতাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিলেন, সেই পৰ্য্যন্ত আর তাঁহাকে পাইতেছি না। তাঁহার অনেক অনুসন্ধান করিয়াছি কিন্তু কোনরূপেই তাঁহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

কৰ্ম্ম। তোমার পিতার নাম কি? 

খান। তাঁহার নাম পীরমহম্মদ। 

কৰ্ম্ম। তাহার বয়ঃক্রম কত?

খান। প্রায় ৭০/৭৫ বৎসর হইবে।

কৰ্ম্ম। তোমাদের জমীদার কে? 

খান। আবুল ফজল খাঁ। 

কৰ্ম্ম। প্রজামাত্রকেই জমীদার খাজনার নিমিত্ত ডাকিয়া লইয়া গিয়া থাকেন, হয় খাজনা দিয়া, না হয় কড়ার করিয়া, তাহারা জমীদার বাড়ী হইতে চলিয়া আসে কিন্তু তোমার পিতা ফিরিয়া আসিল না কেন? 

খান। কেন যে তিনি ফিরিয়া আসিলেন না, তাহাই আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

কৰ্ম্ম। তোমার পিতাকে জমীদার আজ কয়দিবস হইল লইয়া গিয়াছিলেন? 

খান। আজ চারি দিবস হইল। 

কৰ্ম্ম। কোন্ সময় ও কোথা হইতে তাহাকে লইয়া যান? 

খান। সন্ধ্যার অল্পমাত্র পূর্ব্বে আমাদিগের বাড়ী হইতে জমীদারের কয়েকজন লোক আসিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া লইয়া যায়। সেই পর্যন্ত আমি আমার পিতাকে আর দেখিতে পাই নাই। 

কৰ্ম্ম। তাহা হইলে চারি দিবস পর্য্যন্ত তোমার পিতা বাড়ীতে ফিরিয়া আইসে নাই। এই চারি দিবস তুমি তাহার অনুসন্ধান করিয়াছ? 

খান। অনুসন্ধান করিয়াছি কিন্তু কোন স্থানে তাঁহাকে পাই নাই। 

কৰ্ম্ম। জমীদার বাড়ীতে তাহার অনুসন্ধান করিয়াছিলে? তাঁহারা কি বলেন? 

খান। আমি জমীদার বাড়ীতে তিন-চারিবার গিয়াছি, তাঁহারা কহেন আমার পিতাকে তাঁহারা ডাকাইয়া আনেন নাই বা তিনি সেই স্থানে গমনও করেন নাই। 

কৰ্ম্ম। তাহা হইলে তোমার পিতা কোথায় গমন করিল? 

খান। আমার বোধ হয়, হয় জমীদার সাহেব তাঁহাকে নিজের বাড়ীর ভিতর কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন, না হয় তাঁহাকে হত্যা করিয়াছেন, যাহা হউক আপনার নিকট আমার এই প্রার্থনা যে আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক ইহার অনুসন্ধান করিয়া যাহাতে আমি আমার বৃদ্ধ পিতাকে প্রাপ্ত হই তাহার উপায় করুন, ও জমীদার সাহেব যদি কোনরূপ অপরাধ করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাঁহাকে তাহার উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করুন। 

কৰ্ম্ম। যখন তুমি জমীদারের উপর নালিস করিতেছ তখন আমাকে ইহার অনুসন্ধান করিতেই হইবে, কিন্তু তোমার পিতার উপর জমীদার সাহেবের এমন কি আক্রোশ আছে যে, তিনি তোমার পিতাকে কয়েদ করিয়া রাখিবেন বা তাহাকে হত্যা করিবেন। পাওনা খাজনার জন্য জমীদার কখনও কি তাঁহার প্রজাকে হত্যা করিয়া থাকেন? সে যাহা হউক তুমি এখন গমন কর, আমি এখনই তোমার গ্রামে গমন করিতেছি। 

এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী ওই সংবাদের প্রয়োজনীয় বিষয় তাঁহার ডায়েরিভুক্ত করিয়া লইয়া, উপযুক্ত পরিমিত লোকজন সঙ্গে লইয়া সেই স্থানে গমন করিলেন। 

উজীরপুর গ্রাম থানা হইতে তিন ক্রোশের অধিক ছিল না। কর্ম্মচারী অশ্বারোহণে সেই স্থানে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই গিয়া উপস্থিত হইলেন, খানমহম্মদও তাঁহারই সহিত গ্রামে প্রত্যাগমন করিল সে কর্মচারীকে আপনার বাড়ীতে লইয়া গিয়া বসিবার আসন প্রদান করিল, কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপবেশন করিলেন। 

ইহার পূর্ব্বে কর্ম্মচারী আরও কয়েকবার সেই গ্রামে গমন করিয়াছিলেন, সুতরাং ওই গ্রামের অবস্থা তিনি কিয়ৎ পরিমাণে অবগতও ছিলেন। ওই গ্রামে দুই চারি ঘর দরিদ্র হিন্দুর বাসস্থান ছিল, তদ্ব্যতীত সমস্তই মুসলমান। প্রকৃতপক্ষে বলিতে গেলে ওই গ্রামকে একেবারে মুসলমানের গ্রাম বলা যাইতে পারে। প্রায় পাঁচ শত ঘর মুসলমান ওই গ্রামে বাস করিত। গ্রামের জমীদারও মুসলমান। তিনিই গ্রামের মধ্যে বড়লোক ছিলেন। অধিকাংশ প্রজাই ওই জমীদারের জমীতে চাষ আবাদ করিয়া আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। উহাদিগের মধ্যে যাহারা একটু লেখাপড়া শিখিয়াছিল তাহাদিগের আর চাষ আবাদ ভাল লাগিত না, তাহারা স্থানান্তরে চাকরী করিয়া আপনার উদরান্নের সংস্থান ও পরিবার প্রতিপালন করিত। উহাদিগের মধ্যে ভালরূপ লেখা পড়া কেহই জানিত না, অতি সামান্যরূপ লেখা পড়া শিখিলে ওই শ্রেণী লোকের যেরূপ অবস্থা প্রায়ই ঘটিয়া থাকে, ইহাদিগের অবস্থাও তাহাই হইয়াছিল। কিরূপে অপর লোককে প্রতারিত করিবে, কিরূপে পরের জমী নিজের বলিয়া দখল করিবে, কিরূপে সামান্য কারণে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ বাধাইয়া দিবে, কিরূপে অপরের মধ্যে আদালতে মোকদ্দমা বাধাইয়া দিয়া নিজে কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন পূৰ্ব্বক মোকদ্দমার যোগাড় করা উপলক্ষে কিছু কিছু উপার্জ্জন করিবে, এইরূপ নানা বিষয় লইয়া তাহারা সময় অতিবাহিত করিত। কিন্তু সুখের বিষয় এই যে, ওইরূপ অল্পশিক্ষিত লোকের অধিকাংশই প্রায় বার মাস বাড়ীতে থাকিত না, ভিন্ন ভিন্ন স্থানেই থাকিত, তবে সময় সময় দুই এক মাস বাড়ীতে থাকিয়া গ্রামের অবস্থা অতিশয় শোচনীয় করিয়া তুলিত। গ্রামের অশিক্ষিত লোক উহাদিগের কথার উপর অনেকটা বিশ্বাস করিয়া নিজের সর্ব্বনাশ সাধনে প্রবৃত্ত হইত ও ক্রমে ঋণ জালে জড়িত হইয়া পড়িত। 

ওই গ্রামের পূর্ব্ব জমীদার অতিশয় বহুদর্শী, প্রবীণ লোক ছিলেন, তিনি সকলের সহিত মিলিত হইয়া ও সকলকে হাতে রাখিয়া চলিতেন, ও সদা সর্বদা বিনা কষ্টে নিজের কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইতেন। 

বর্তমান জমীদার আবুল ফজল তাঁহারই পুত্র, তিনি বাল্যকাল হইতে কলিকাতায় থাকিয়া লেখা পড়া শিখিয়াছিলেন ও শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের সহিত সর্ব্বদা মিশামিশি করিতেন বলিয়া, তিনি তাঁহার পিতার ন্যায় সেই সকল চাষি প্রজার সহিত উত্তমরূপ মিশিতে পারিতেন না। 

তাঁহার পিতার মৃত্যু হইলে তাঁহাকে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া গ্রামে আসিয়া থাকিতে হয়। তিনি বড় জমীদার ছিলেন না, জমীদারীর মধ্যে কেবল তাঁহার নিজের গ্রামখানই ছিল, সুতরাং গ্রামে থাকিয়া আদায় তহসিলের দিকে দৃষ্টি না রাখিলে কোনরূপেই চলিত না বলিয়াই তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর হইতেই তাঁহাকে সদাসর্বদা নিজ বাড়ীতেই অবস্থিতি করিতে হইত। 

গ্রামে যে সকল চাষি প্রজার বাস ছিল, তাহাদিগের মধ্যে অনেকের লোকদেখান চাষ আবাদ ছিল, কিন্তু তাহাদিগের প্রধান ব্যবসা ছিল ডাকাইতি করা। আবুল ফজলের পিতা তাহা জানিতেন, কিন্তু তিনি কখনও তাহাদিগকে ধরাইয়া দিবার কোনরূপ চেষ্টা করেন নাই। 

আবুল ফজল তাঁহার জমীদারীর ভার গ্রহণ করিয়া বাড়ীতে অবস্থিতি করিবার কালীন এই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারেন। সেই সময় একটি ডাকাইতির অনুসন্ধানে, পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ সেই গ্রামে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারই বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনিও পুলিস কর্মচারিগণকে বিশেষরূপে সাহায্য করিয়া, ওই গ্রামের ডাকাইতগণকে বাঁচাইবার পরিবর্তে অনেককে ধরাইয়া দেন, ও সেই ডাকাইতি মোকদ্দমায় তাহাদিগের সকলেরই দীর্ঘকালের জন্য জেল হইয়া যায়। 

খানমহম্মদের দুইটি ভ্রাতাও ওই ডাকাইতি মোকদ্দমায় ধৃত হইয়া কারারুদ্ধ হয়। সেই সময় হইতে গ্রামের অধিকাংশ মুসলমান প্রজাই সেই জমীদারের বিপক্ষাচরণ করিতে প্রবৃত্ত হয় ও তাঁহাকে নানারূপে কষ্ট দিতে আরম্ভ করে। সহজে কেহ খাজনা দেয় না। খাজনা আদায় করিতে হইলেই নালিস করিতে হয়। অনেকে জমী বেদখল করিয়া লইবার চেষ্টা করে, তাহার জন্যও আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়। সেই অল্পশিক্ষিত ব্যক্তিগণের মধ্যেও কেহ কেহ ওই সকল প্রকার পক্ষ অবলম্বন করিয়া সেই জমীদারের নামে নানারূপ মিথ্যা ফৌজদারি মোকদ্দমা উপস্থিত করে। ইহার কোন কোন মোকদ্দমায় তিনি জয়লাভ করেন ও কোন কোন মোকদ্দমায় তিনি পরাজিত হন। এইরূপ প্রজাগণকে লইয়া নানারূপ অশান্তির সহিত তিনি দিন যাপন করিতে থাকেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপবেশন করিবার পর ক্রমে ক্রমে সেই পাড়ার অনেকে আসিয়া সেই স্থানে উপবেশন করিল। ইহারা যে অনুসন্ধানকারী পুলিসকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে আগমন করিল তাহা নহে, নিজের নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির মানসে সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এই ব্যক্তিগণের সহিত প্রায়ই সেই জমীদারের সৎব্যবহার ছিল না। ইহাদিগের অনেকের নামেই জমীদারকে বাকী খাজনার নালিস করিয়া, তাহাদিগের বিষয় প্রভৃতি বিক্রয় করিয়া লইতে হইয়াছে। কাহারও নিকট হইতে বা চাষের জমী ছাড়াইয়া লইতে হইয়াছে। 

ইহারা জমীদারকে কোনরূপে বিপদগ্রস্ত করিবার মানসেই সেই স্থানে আগমন করিয়াছে, আবশ্যক হইলে জমীদারের বিপক্ষে কোন কথা বলিতেও পরাঙ্মুখ নহে 

কর্ম্মচারী যে পাড়ায় অনুসন্ধানের নিমিত্ত আগমন করিয়াছিলেন, সেই পাড়ায় জমীদারের বাসস্থান ছিল না, তাঁহার বাসস্থান গ্রামের অপর প্রান্তে, সুতরাং প্রথমে তিনি কিছুমাত্র অবগত হইতে পারেন নাই যে, তাঁহার বিপক্ষে এক ভয়ানক গুরুতর অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে, ও তাহারই অনুসন্ধানের নিমিত্ত পুলিস-কর্মচারীর সেই গ্রামে আগমন হইয়াছে। 

কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপবেশন করিয়া সেই পাড়ার অনেক লোকের জবানবন্দী গ্রহণ করিলেন। ওই সমস্ত লোকের নিকট হইতে তিনি যে সকল বিষয় অবগত হইলেন তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

তাহারা কর্ম্মচারীকে বলিল খানমহম্মদের পিতা পীরমহম্মদ একজন অতিশয় বৃদ্ধ প্রজা, বহুদিবস হইতে ওই স্থানে বাস করিয়া আসিতেছিল। তাহার সহিত জমীদারের ব্যবহার ভাল ছিল না, কারণ অর্থের সংস্থান করিতে না পারায়, সে নিয়মিতরূপ খাজনা দিতে পারিত না বলিয়া জমীদার তাহার উপর বিশেষ অসন্তুষ্ট থাকিতেন। জমীদারের বিশ্বাস ছিল পীরমহম্মদ ইচ্ছা করিয়া তাঁহার খাজনা বাকী রাখিয়া থাকে, ও বাকী খাজনার নালিস করিলে নানারূপ মিথ্যা কথা বলিয়া ওই মোকদ্দমার জবাব দেয়। এখনও পীরমহম্মদের নিকট তাঁহার অনেক খাজনা বাকী আছে। 

ওই সমস্ত লোকের মধ্যে কেহ কেহ কহিল, চারি পাঁচ দিবস হইতে, সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে জমীদারের একজন গোমস্তা, একজন সরকার, ও দুইজন পাইক পীরমহম্মদের বাড়ীতে আগমন করিয়া কহে জমীদার বিশেষ কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে পীরমহম্মদকে ডাকিতেছেন এখনই তাহাকে তাহাদিগের সঙ্গে গমন করিতে হইবে। তাহাদিগের কথা শুনিয়া পীরমহম্মদ তাহাদিগের সহিত গমন করিতে অসম্মত হয়, কিন্তু যে সকল ব্যক্তি তাহাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত সেই স্থানে আগমন করিয়াছিল, তাহারা কিছুতেই উহার কথা না শুনিয়া কহে, যদি নিতান্তই সে তাহাদিগের সহিত স্বইচ্ছায় গমন না করে, তাহা হইলে তাহারা তাহাদিগের মনিবের আদেশ প্রতিপালন করিবে, অর্থাৎ তাহারা তাহাকে ধরিয়া লইয়া যাইবে। ইহাতেও পীরমহম্মদ তাহাদিগের সহিত গমন করিতে সম্মত না হওয়ায় তাহারা জোর করিয়া পীরমহম্মদকে ধরিয়া লইয়া যায়। 

কেহ বলিল যখন জমীদারের লোক পীরমহম্মদকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া যাইতেছিল সেই সময় রাস্তায় সে তাহা দেখিতে পায়, বৃদ্ধ লোককে ওরূপ করিয়া ধরিয়া লইয়া যাইতে দেখিয়া সে উহাদিগকে নিষেধ করে ও পীরমহম্মদকে ছাড়িয়া দিতে কহে, কিন্তু তাহার কথায় জমীদারের কর্ম্মচারিগণ সম্মত হয় না। অধিকন্তু তাহাকে গালি দিয়া পীরমহম্মদকে লইয়া জমীদারের বাড়ীর দিকে প্রস্থান করে। কেহ বলিল সন্ধ্যার পর সে জমীদারের বাড়ীর নিকট দিয়া গমন করিতেছিল, সেই সময় সে জমীদার বাড়ীর ভিতর হইতে পীরমহম্মদের চীৎকারধ্বনি শুনিতে পায়, তাহার বোধ হয় যে কোন ব্যক্তি পীরমহম্মদকে প্রহার করিতেছিল। সে সেই জমীদার বাড়ীর ভিতর গমন করিবার চেষ্টা করে কিন্তু জমীদারের লোক তাহাকে প্রবেশ করিতে দেয় না। 

এইরূপ নানা লোকের নিকট হইতে নানা কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না, একবার মনে করিলেন সকলেই মিথ্যা কথা বলিয়া সেই জমীদারকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে। আবার ভাবিলেন পাড়ার সমস্ত লোকেই যে মিথ্যা কথা কহিবে তাহাই বা কি করিয়া বলা যাইতে পারে? সত্য হউক মিথ্যা হউক যখন একটা কথা উঠিতেছে, ও পাড়ার সমস্ত লোক সেই কথার সমর্থন করিতেছে, অথচ চারি পাঁচ দিবস হইতে পীরমহম্মদকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, তখন উহাদিগের কথায় অবিশ্বাস করিয়া কিরূপেই বা স্থির ভাবে বসিয়া থাকিতে পারা যায়। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, যে সকল লোক জমীদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছিল ও যে খানমহম্মদ এই মোকদ্দমা রুজু করিয়াছে, তাহাদিগের সকলকে সঙ্গে লইয়া কৰ্ম্মচারী সেই জমীদার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

জমীদার আবুল ফজল সেই সময় তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সেই কৰ্ম্মচারীকে তাঁহার বাড়ীতে আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা পূর্ব্বক আপন বাড়ীতে লইয়া গেলেন, ও বসিবার আসন প্রদান করিলেন। তাঁহার সহিত অপর যে সকল ব্যক্তি গমন করিয়াছিল, তাহাদিগকেও সেই স্থানে বসিতে কহিলেন। সকলে সেই স্থানে উপবেশন করিলে কৰ্ম্মচারী আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি পীরমহম্মদকে চিনেন?” 

আবু। চিনি বৈকি সে আমার প্রজা। 

কৰ্ম্ম। সে এখন কোথায়? 

আবু। তাহা আমি বলিতে পারি না। 

কৰ্ম্ম। আজ চারি পাঁচ দিবস হইল আপনি তাহাকে আপনার বাড়ীতে ডাকাইয়া আনিয়াছিলেন? 

আবু। মিথ্যা কথা, আমি তাহাকে এক বৎসরের মধ্যে আমার বাড়ীতে ডাকাইয়া আনি নাই বা সেও আমার বাড়ীতে আসে নাই। সে আমার প্রজা সত্য, কিন্তু কখনও সে আমার বাড়ীতে আসিয়া খাজনা দিয়া যায় না। হয় তাহার নামে ডিক্রী করিয়া তাহার নিকট হইতে খাজনা আদায় করিতে হয়, না হয় সে নিজে গিয়া খাজনা আদালতে জমা দিয়া আসে। 

কৰ্ম্ম। তাহার পুত্র ও পাড়ার এই সমস্ত লোকে বলিতেছে যে আপনি চারিজন লোক পাঠাইয়া দিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিয়াছেন। 

আবু। মিথ্যা কথা। 

কৰ্ম্ম। আপনার বাড়ীর ভিতরও তাহার ক্রন্দন ধ্বনি কেহ কেহ শুনিয়াছে। 

আবু। সমস্তই মিথ্যা কথা। 

কৰ্ম্ম। সত্য মিথ্যা আমি জানি না, যাহারা যাহারা আপনার বিপক্ষে বলিতেছে আমি তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া আপনার বাড়ীতে আনিয়াছি, উহারা আপনার সম্মুখেই বসিয়া আছে; ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই আপনি জানিতে পারিবেন যে, উহারা পীরমহম্মদকে আপনার বাড়ীতে ধরিয়া আনিতে দেখিয়াছে কি না ও আপনার বাড়ীর ভিতর তাহার ক্রন্দন ধ্বনি শুনিয়াছে কি না? 

আবু। আমার বিপক্ষে ইহারা সব বলিতে পারে। ইহারা আদালতে গিয়া আমার ও আমার কর্মচারিগণের বিপক্ষে যে কত মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছে তাহার সংখ্যা নাই। এরূপ অবস্থায় ইহারা যে আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিয়া আমাকে বিপদগ্রস্ত করিবার চেষ্টা করিবে, তাহার আর বিচিত্র কি? 

কৰ্ম্ম। এতগুলি লোক যদি আপনার বিপক্ষে মিথ্যা কথা কহে তাহা হইলে আমি কি করিতে পরি? 

আবু। আপনি সব করিতে পারেন, আপনি যখন অনুসন্ধানে আসিয়াছেন তখন সত্য মিথ্যা আপনার নিকট কিছুই গোপন থাকিবে না, আপনি অনুসন্ধানে আমার দোষ প্রাপ্ত হন তবে আমাকে উপযুক্ত রূপ দণ্ড প্রদান করুন। 

আবুল ফজলের এই কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী সেই সমস্ত লোককে কহিলেন “তোমাদিগের জমীদার তোমাদিগের সম্মুখে যাহা বলিলেন তাহা তোমরা শুনিলে। তোমাদিগের জমীদার অশিক্ষিত লোক নহেন, তিনি যে এইরূপ একটি নিতান্ত অন্যায় কার্য্য করিয়া বসিবেন তাহাই বা বলি কি প্রকারে?” 

যে সকল ব্যক্তি, কর্ম্মচারীর সহিত সেই স্থানে আসিয়াছিলেন তাহার মধ্যে পূর্ব্বকথিত অর্দ্ধশিক্ষিত একজন লোক ছিল। সে কর্মচারীর কথার উত্তরে কহিল “যে ব্যক্তি অধিক লেখা পড়া শিখে তাহাদিগের বুদ্ধির তেজ অত্যন্ত প্রখর হয়। কিরূপ উপায়ে কোন কার্য্য সমাপন করিলে সহজে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারা যায় তাঁহারা তাহা উত্তমরূপ বোঝেন, সুতরাং আমাদিগের জমীদার দ্বারা যে এই কার্য্য সম্পন্ন হইতে পারে না তাহা আমরা বলিতে পারি না।” 

কৰ্ম্ম। ভাল, যে যে ব্যাক্তি পীরমহম্মদকে ধরিয়া আনিয়াছিল তাহারা এখন এখানে আছে? একজন প্রজা গাত্রোত্থান করিয়া কহিল “তাহাদিগের দুইজন এখন এখানে উপস্থিত আছে।” এই বলিয়া আবুল ফজলের দুইজন কর্মচারীকে তাহারা দেখাইয়া দিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

আবুল ফজলের বাসস্থান প্রায় পঁচিশ বিঘা জমীর উপর। রাস্তা হইতে তাঁহার বাড়ীতে প্রবেশ করিতে হইলে প্রথমেই খানিকটা খোলা জমী। তাহার পর দুই দিকে দুইখানি করিয়া চারিখানি খড়ের ঘর। অতিথি অভ্যাগতের নিমিত্ত ওই ঘরগুলি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। উহার একখানি হিন্দু অতিথির থাকিবার ও আর একখানি রন্ধনের নিমিত্ত ব্যবহৃত হয়, কোন মুসলমানকে ওই দুইখানি ঘরে কখনই স্থান প্রদান করা হয় না। অপর দুইখানি ঘরের একখানি সম্ভ্রান্তশালী ও অপরখানি অপরাপর মুসলমানদিগের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। তাহাদিগের রন্ধন করিবার নিমিত্ত স্বতন্ত্র ঘরের কোনরূপ প্রয়োজন হয় না। ইহাদিগের রন্ধনাদি আবুল ফজলের রন্ধনশালায় তাঁহার রন্ধনের সহিত একত্রিত হইয়া থাকে। এই দুই শ্রেণী ঘরের সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ হস্ত পরিসর রাস্তা, ওই ঘর শ্রেণীর পরই একদিকে তাঁহার গোয়ালবাড়ী, অপর দিকে ধান্যাদি রাখিবার গোলাবাড়ী, তাহার পর একদিকে তাঁহার কাছারি ঘর, ও অপর দিকে প্রজাদিগের বিশ্রাম করিবার ঘর এবং কর্ম্মচারী ও পরিচারকদিগের থাকিবার স্থান। ইহার পরেই অন্দর। অন্দরের ভিতর ৮/১০ খানি ঘর আছে, রন্ধন ও শয়ন ইত্যাদি এই সকল ঘরেই হইয়া থাকে। এই মহলটি প্রাচীর পরিবেষ্টিত। এই সমস্ত ঘর ব্যতীত ওই প্রাচীরের বাহিরেও একখানি রান্না ঘর আছে। কাছারি বাড়ীর পশ্চাতে বৃহৎ সানবাঁধান পুষ্করিণী। প্রাচীরের ভিতরেও একটি অপেক্ষাকৃত ছোট পুষ্করিণী আছে। স্ত্রীলোকগণ উহার জলই ব্যবহার করিয়া থাকেন। ইহার পরই ওই বাড়ীর সংলগ্ন একটি বাগান। উহা সকল প্রকার বৃক্ষ দ্বারা সমাচ্ছন্ন ও বহুদূর বিস্তীর্ণ। বিশেষ কোন কাৰ্য্য ব্যতীত প্রায় কেহই সেই বাগানের ভিতর গমন করে না। 

এই সমস্ত লইয়া আবুল ফজলের বসত বাড়ী। অন্দর বাড়ী ব্যতীত এই ২৫ বিঘা জমীর চতুর্দিকে মনসা বৃক্ষদ্বারা সামান্যরূপ বেড়া দেওয়া ভিন্ন ভাল রূপ ঘেরা নহে। যাহার যেদিক দিয়া ইচ্ছা মনে করিলে, সে সেইদিক দিয়া যাতায়াত করিতে পারে, কিন্তু সেই সকল স্থান দিয়া প্রায় কেহই যাতায়াত করে না, সকলেই সদরের রাস্তা দিয়া গমনাগমন করিয়া থাকে। 

কর্ম্মচারী অনুসন্ধান উপলক্ষে লোকজন সমভিব্যহারে সেইদিক দিয়া গমন করিয়াই আবুল ফজলের কাছারি ঘরে গিয়া উপবেশন করিয়াছিলেন। 

আবুল ফজলের সকল কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী তাঁহাকে কহিলেন, যখন তাঁহার উপর এই ভয়ানক অভিযোগ উপস্থিত হইয়াছে, তখন তাহার বাড়ীটি একবার উত্তমরূপে দেখিয়া লওয়া তাঁহার কর্তব্য। 

আবু। আপনি রাজ কর্মচারী, আপনার কর্তব্য কর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণ করা আমাদিগের ক্ষমতাতীত ও কৰ্ত্তব্য নহে। আপনি আপনার ইচ্ছামত কার্য্য অনায়াসেই করিতে পারেন, কিন্তু এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি? 

কৰ্ম্ম। কেন পারিবেন না, আপনার যাহা ইচ্ছা অনায়াসেই তাহা আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

আবু। আমার বাড়ীর খানাতল্লাসি করিয়া যদি আপনি পীরমহম্মদকে প্রাপ্ত হন বা আমি যে তাহাকে এই স্থানে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছি, তাহার কোনরূপ নিদর্শন প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে আমাকে নিশ্চয়ই রাজদ্বারে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে তাহা আমি উত্তমরূপ অবগত আছি; কিন্তু আপনার অনুসন্ধানে পরিশেষে যদি সাব্যস্ত হয় যে আমাদিগের কোনরূপ অপরাধ নাই, তাহা হইলে আমার এই বিষম অবমাননার জন্য দায়ী কে হইবে? 

কৰ্ম্ম। তাহার জন্য দায়ী হইবে খানমহম্মদ, ও যে সকল ব্যক্তি আপনার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। 

আবু। যাহা হউক সে পরের কথা, আপনি এখন আপনার ইচ্ছামত কার্য্য করিতে পারেন। কিন্তু আমার নিবেদন এই যে, যখন আপনি আমার অন্দর মহলে প্রবেশ করিবেন, সেই সময় আপনার প্রয়োজনীয় লোক ব্যতীত অপর কোন লোক যেন আপনার সহিত আমার অন্দর মহলে প্রবেশ না করে। 

কৰ্ম্ম। কেবল খানাতল্লাসির সাক্ষী, খানমহম্মদ ও পুলিস-কৰ্ম্মচারী ব্যতীত অপর কেহই আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে না। 

ইহা বলিয়া কৰ্ম্মচারী সেই পাড়ার তিন চারিজন লোককে ডাকাইয়া, গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহাকে উঠিতে দেখিয়া সেই স্থানে যে সকল লোক উপস্থিত ছিল সকলেই উঠিল। তিনি বাহিরের স্থান ও গৃহ সকল প্রথমেই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার সহিত যে সকল লোক পীরমহম্মদের পাড়া হইতে আগমন করিয়াছিল তাহারাও সেই বাহির বাড়ীর ও বাগানের চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। 

কর্ম্মচারী যখন গোয়াল বাড়ী ও গোলা বাড়ী দেখিতে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় একজন মুসলমান, একটি মুসলমান কনেষ্টবলকে একটু দূরে লইয়া গিয়া তাহাকে কি কহিল ও তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কর্ম্মচারী ইহা দেখিলেন কিন্তু সেই সময় কাহাকেও কিছু বলিলেন না। প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেই কনেষ্টবল সেই স্থানে প্রত্যাগমন করিল ও কর্মচারীকে কহিল “আমি আপনাকে একটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি আপনি একটু দূরে আসুন।” 

কনেষ্টবলের কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী তাহার সহিত একটু দূরে গমন করিলেন; সেই স্থানে কনষ্টবল কৰ্ম্মচারীকে চুপে চুপে কি বলিল। কর্মচারী ধীর ভাবে সমস্ত কথা শুনিয়া সেই কনেষ্টবলকে কহিলেন “তুমি আবুল ফজলকে একবার আমার নিকট ডাকিয়া আন।” 

কনেষ্টবল কর্ম্মচারীর আদেশ পালন করিল, আবুল ফজল সেই স্থানে আগমন করিলে, কর্ম্মচারী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনার পরিবারবর্গ ও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কাহারও মৃত্যু হইলে আপনারা তাহাদিগকে কোথায় গোর দিয়া থাকেন?” 

আবু। কবর স্থানে! 

কৰ্ম্ম। কোন্ কবর স্থানে? 

আবু। যে কবর স্থানে গ্রামের সমস্ত লোকের গোর হয়। 

কৰ্ম্ম। সে কবর স্থান কোথায়? 

আবু। এই গ্রামের এক প্রান্তভাগে। 

কৰ্ম্ম। আমি জানি অনেক ভদ্র মুসলমানের নিজের কবর স্থান থাকে। তাঁহাদিগের পরিবারবর্গের মধ্যে কাহার বা কোন আত্মীয় স্বজনের মৃত্যু হইলে, তাঁহারা সেই স্থানেই উহাদিগের গোর দিয়া থাকেন। এইরূপ স্থান প্রায়ই তাঁহাদিগের নিজের জমীতে, নিজের বাড়ীতে বা নিজের বাগানেই স্থির করিয়া রাখা হয়। 

আবু। না মহাশয়, আমাদিগের সেরূপ কোন নির্দিষ্ট স্থান নাই। 

কৰ্ম্ম। আপনাদিগের বাগানে কখনও কোন গোর হইয়া থাকে? 

আবু। না। 

কৰ্ম্ম। আমি শুনিলাম আপনার বাগানের মধ্যে এক স্থানের জমী নূতন খনন করা হইয়াছে। 

আবু। আমি তাহা অবগত নহি। আমি যতদূর অবগত আছি তাহাতে বাগানের ভিতর দুই এক মাসের মধ্যে কোন স্থান খোদিত হয় নাই। 

কৰ্ম্ম। কোনরূপ বৃক্ষাদি লাগাইবার নিমিত্ত কোন স্থান ত প্রস্তুত করা হয় নাই? 

আবু। আমি আপনাকে এইমাত্র বলিলাম, গত দুই মাসের মধ্যে আমার বাগানের ভিতর কোন কার্য্যই হয় নাই।

কৰ্ম্ম। এই সমস্ত সামান্য সামান্য বিষয়ের সমস্ত কথা আপনার কর্ণ গোচর না হইলেও হইতে পারে, সে যাহা হউক আপনি আপনার কর্ম্মচারিগণকে ও পরিচারকদিগকে একবার এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন দেখি, তাহারাই বা কি বলে? 

কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া আবুল ফজল তাঁহার কর্ম্মচারী ও পরিচারকগণের মধ্যে যাহারা সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সকলকেই সেই কর্ম্মচারীর সম্মুখে ডাকাইলেন, ও প্রত্যেককেই ওই সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু কেহই বলিল না যে সেই বাগানের কোন স্থানের মৃত্তিকা সম্প্রতি কোনরূপে খোদিত হইয়াছে। তখন আবুল ফজল কৰ্ম্মচারীকে কহিলেন “মহাশয়, বাগানের কোন স্থানে কিরূপ খোদিত হইয়াছে তাহা দেখিলেই সবিশেষ বুঝিতে পারা যাইবে, চলুন সেই স্থানে যাইয়া অগ্রে দেখা যাউক।” 

আবুল ফজলের কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী কহিলেন “আমিও মনে মনে তাহাই স্থির করিয়াছি।” এই বলিয়া তিনি সেই কনেষ্টবলকে ডাকিলেন ও তাহাকে কহিলেন “যে ব্যক্তি এই সংবাদ তোমাকে প্রথমে প্রদান করিয়াছে তাহাকে একবার আমার সম্মুখে ডাকিয়া আন দেখি।” কনেষ্টবল তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিল। কিন্তু কৰ্ম্মচারী সেই সময় তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই বাগান অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। আবুল ফজল ও অপরাপর যে সকল ব্যক্তি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল সকলেই তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। সেই কনেষ্টবল ও যে ব্যক্তি ওই কনেষ্টবলকে সংবাদ প্রদান করিয়াছিল, তাহারা সকলের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। ক্রমে সকলে আবুল ফজলের বাড়ীর সংলগ্ন সেই বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, উহারা সকলকে সেই বাগানের এক প্রান্তভাগে লইয়া গেল, ও একটি নব খোদিত স্থান তাঁহাদিগের দেখাইয়া দিল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

ওই ব্যক্তি ওই স্থান সৰ্ব্ব সমক্ষে দেখাইয়া দিলে কর্মচারী আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই স্থানটি নতুন খোদিত বলিয়া বোধ হইতেছে না?” 

আবু। সেইরূপইত বোধ হইতেছে। 

কৰ্ম্ম। এই স্থান কে খনন করিল? 

আবু। তাহা ত বলিতে পারি না, দুই এক মাসের মধ্যে বাগানের ভিতর কোন স্থান খনন করিবার আমাদিগের কিছুমাত্র প্রয়োজন হয় নাই। 

কৰ্ম্ম। সে যাহা হউক এখন দেখা যাউক উহার মধ্যে কি আছে। 

এই বলিয়া সেই স্থানে যে সকল ব্যক্তি সেই সময় উপস্থিত ছিল তাহাদিগের মধ্যে কয়েকজনকে তিনি ওই স্থান পুনরায় খোদিত করিয়া দেখিতে কহিলেন। আবুল ফজল তাঁহার বাড়ী হইতে একখানি কোদালী আনাইয়া দিলেন। ওই কোদালী দ্বারা ওই স্থান বিশেষ সতর্কতার সহিত খোদিত করিবামাত্র, প্রায় অর্দ্ধ হস্ত মৃত্তিকার নিম্নে একটি মৃতদেহের কিয়দংশ দেখিতে পাওয়া গেল। মৃতদেহ দেখিতে পাইবার পরই কর্ম্মচারী আরও বিশেষরূপ সতর্কতার সহিত ওই স্থানের মৃত্তিকা স্থানান্তরিত করিতে লাগিলেন। ক্রমে মৃতদেহের সমস্ত অংশ বাহির হইয়া পড়িলে ওই মৃতদেহটি তিনি ওই স্থান হইতে উঠাইয়া উহার নিকটবর্ত্তী এক স্থানে রাখিয়া দিলেন। 

উহা একটি বৃদ্ধের মৃতদেহ, কিন্তু উহা দেখিয়া কিছুতেই চিনিতে পারা যায় না যে উহা কাহার, কারণ ওই দেহটির উপর এরূপ ভাবে অস্ত্রাঘাত করা হইয়াছে, যে তাহার কোন স্থান একেবারে অক্ষত নাই, সমস্তই যেন মাংসপিণ্ড রূপে পরিগণিত হইয়াছে। বিশেষ মুখের অবস্থা আরও ভয়ানক, উহার নাক, কান, মুখ, চোখ যে কোথায় গিয়াছে তাহার কিছুমাত্র ঠিকানা নাই। এইরূপ অবস্থায় ওই মৃতদেহ দেখিয়াও খানমহম্মদ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল “এই আমার পিতার মৃতদেহ, দেখুন মহাশয় জমীদার সাহেব আমার পিতাকে হত্যা করিয়া এই স্থানে পুঁতিয়া রাখিয়াছেন।”

কৰ্ম্ম। এ যে তোমার পিতার মৃতদেহ তাহা তুমি কি প্রকারে বলিতেছ? কারণ এরূপ অবস্থায় মৃতদেহ দেখিয়া কেহই বলিতে পারে না যে, উহা কাহার মৃতদেহ। এই মৃতদেহ যেরূপ ভাবে বিকৃত ভাব ধারণ করিয়াছে, তাহাতে কাহার সাধ্য যে, সে উহা দেখিয়া বলিতে পারে যে উহা কাহার মৃতদেহ, এরূপ অবস্থায় তুমি কিরূপে বলিতে পার যে ইহা তোমার পিতার মৃতদেহ। 

খান। যেরূপ বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হইক না কেন আপনার পিতার মৃতদেহ কে না চিনিতে পারে? তৎব্যতীত উহার পরিধানে যে বস্ত্র দেখিতেছেন, যখন জমীদারের লোক ইহাকে ধরিয়া লইয়া যান, সেই সময় ইহার পরিধানে এই বস্ত্রই ছিল, আমি এই বস্ত্র দেখিয়া উত্তমরূপে চিনিতে পারিতেছি যে, উহা আমার পিতার বস্ত্র। সুতরাং ইহা যে আমার পিতার মৃতদেহ সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। 

খানমহম্মদের কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী সেই সময় তাহাকে অপর কোন কথা না বলিয়া মনে মনে এই ভাবিলেন, এই মৃতদেহ পীরমহম্মদের হউক বা না হউক, ইহা কাহার মৃতদেহ? ও কিরূপেই বা এই মৃতদেহ এই স্থানে প্রোথিত হইল? খানমহম্মদ ও তাহার পাড়ার লোক যাহা বলিতেছে তাহাই বা এরূপ অবস্থায় একেবারে অবিশ্বাস করি কি প্রকারে? পীরমহম্মদকে পাওয়া যাইতেছে না, আবুল ফজলের লোকেরা তাহাকে ধরিয়া আনিয়াছে তাহারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে, এদিকে তাহারই বাগানের ভিতর একটি বৃদ্ধের মৃতদেহ, কোন প্রখর অস্ত্রের শতাধিক আঘাতের সহিত পাওয়া যাইতেছে, কিরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ এই স্থানে আসিল, ও কেই বা ইহা লইয়া আসিয়া এই স্থানে প্রোথিত করিয়া রাখিল, আবুল ফজল বা তাঁহার কোন লোক, তাহার কোন কথা বলিতে পারিল না। এরূপ অবস্থায় যে পর্য্যন্ত খানমহম্মদের অভিযোগের বিরুদ্ধে অপর কোনরূপ সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া না যায় সেই পৰ্য্যন্ত খানমহম্মদ ও তাহার সাক্ষীগণের কথাই বিশ্বাস করিতে হইবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কৰ্ম্মচারী আবুল ফজল ও তাঁহার দুইজন কর্ম্মচারীকে গ্রেপ্তার করিলেন, এই দুইজন কর্মচারীকে ইতিপূর্ব্বে খানমহম্মদ ও তাহার সাক্ষীগণ দেখাইয়া দিয়াছিল। 

উহাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়া কৰ্ম্মচারী সেই বাগানের নিকটবর্ত্তী স্থানে যে সকল লোকজন বাস করে তাহাদিগের নিকট অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই স্থানের অনেক লোককে তিনি অনেক জিজ্ঞাসা করিলেন কিন্তু কেহই তাহাকে বিশেষ কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারিল না। তিনি নিতান্ত নিরাশ হইয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার কালীন খানমহম্মদের পাড়ার এক ব্যক্তি, সেই বাগানের নিকটবাসী দুইজন লোককে আনিয়া সেই কর্মচারীর সম্মুখে উপস্থিত করিল। উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া কৰ্ম্মচারী জানিতে পারিলেন তিন দিবস হইল সন্ধ্যার পর তাহারা ওই স্থান দিয়া গমন করিতেছিল, সেই সময় তাহারা দেখিতে পায় আবুল ফজল সেই স্থানে দাঁড়াইয়া আছে, ও তাঁহার চারিজন কর্মচারী তাঁহার সন্নিকটে এক স্থানের মৃত্তিকা কোদালী দিয়া কাটিতেছে। অসময়ে সেই স্থান খনন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের মনে সন্দেহের উদয় হয়, তাহারা ওই স্থান খনন করিবার কারণ আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি তাহাদিগকে এই কহেন যে, কলিকাতা হইতে একটি ভাল আমের কলম আসিবে, তাহাই ওই স্থানে পুঁতিবার জন্য তিনি একটি স্থান প্রস্তুত করিয়া রাখিতেছেন। আবুল ফজলের এই কথায় উহারা বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে, কিন্তু এখন তাহারা দেখিতেছে যে, আঁবের কলমের পরিবর্ত্তে পীরমহম্মদকে সেই স্থানে প্রোথিত করা হইয়াছে। 

উহাদিগের এই কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী আবুল ফজলকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি মহাশয়, ইহারা যাহা বলিতেছে তাহা কি সত্য নহে?” 

আবু। না মহাশয়, ইহাদিগের সমস্ত কথাই মিথ্যা, ইহাদিগের বাসস্থান আমাদিগের পাড়ায় সত্য, কিন্তু ইহারা উভয়েই পীরমহম্মদের কুটুম্ব, ও ইহারা ইহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া আমাকে নানারূপ কষ্ট দিয়া আসিতেছে। আমাকে বিপদে ফেলিবার জন্য উহারা যে আমার বিপক্ষে এইরূপ মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিবে তাহার আর বিচিত্র কি? 

কৰ্ম্ম। সকলেই যদি আপনার বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহা হইলে ওই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলেই আপনাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে। 

আবু। বিনা দোষে যদি আমাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হয়, তাহা হইলে আর উপায় কি? ঈশ্বর অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন তাহা হইলেই হইবে, তাহার কিছুতেই খণ্ডন হইতে পারে না। 

কৰ্ম্ম। সে যাহা হউক, তোমার অপর আর দুইজন কর্মচারী, যাহাদিগের নাম সাক্ষীগণ করিতেছে তাহারা কোথায়?

আবু। তাহারা এখানে নাই। 

কৰ্ম্ম। কোথায়? 

আবু। আজ আদালতে কয়েকটি বাকী খাজনার মোকদ্দমার দিন আছে, ওই মোকদ্দমার জন্য তাহারা আদালতে গমন করিয়াছে। 

কৰ্ম্ম। আদালত হইতে তাহারা কখন ফিরিয়া আসিবে? 

আবু। আজ যদি মোকদ্দমা হইয়া যায়, তাহা হইলে কল্যই তাহারা এখানে আসিয়া উপস্থিত হইবে। আর যদি মোকদ্দমা না হয়, তাহা হইলে দুই-এক দিবস বিলম্ব হইলেও হইতে পারে। 

কৰ্ম্ম। তাহাদিগের নাম কি? 

আবু। একজনের নাম ওহারেন বক্স আর একজনের নাম সেরু মিঞা। 

কৰ্ম্ম। তাহাদিগের বাসস্থান কি এই গ্রামে? 

আবু। তাহারা এ গ্রামে বাস করে না। এখান হইতে প্রায় দশ ক্রোশ ব্যবধানে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে তাহাদিগের বাসস্থান। কিন্তু তাহারা কদাচিৎ গ্রামে গমন করিয়া থাকে, তাহারা আহার করে আমার বাড়ীতে ও এই স্থানেই শয়ন করিয়া থাকে। 

আবুল ফজলের কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী মনে মনে ভাবিলেন, যখন এত গোলযোগ হইয়া পড়িয়াছে, তখন তাহাদিগকে যে সহজে পাওয়া যাইবে তাহা মনে হয় না। কিন্তু তাহাদিকে এখন গ্রেপ্তার করিবার বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে। যদি এই মৃতদেহ পীরমহম্মদের হয়, তাহা হইলে উহাদিগ দ্বারাই যে এই সকল কাৰ্য্য ঘটিয়াছে, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া কৰ্ম্মচারী উহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত নানারূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু কোন স্থানেই আর তাহাদিগকে প্রাপ্ত হইলেন না। 

ওই মৃতদেহ সম্বন্ধে সেই সময় অপর যে সকল অনুসন্ধানের প্রয়োজন ছিল তাহার সমস্ত শেষ করিয়া, কৰ্ম্মচারী ওই মৃতদেহ ডাক্তারের পরীক্ষার্থে সদরে পাঠাইয়া দিলেন। 

আবুল ফজল ও তাঁহার যে দুইজন কর্মচারী ধৃত হইয়াছিল, তাহারা পুলিসের জিম্বায় রহিল। অপর যে দুইজনকে পাওয়া গিয়াছিল না, তাহাদিগের অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যে কর্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনি বহু পুরাতন কর্ম্মচারী না হইলেও, একজন অতিশয় দক্ষ কর্ম্মচারী ছিলেন। তাঁহার নিজের হিতাহিত জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়া তিনি সমস্ত মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেন; মিথ্যাকে সত্য করিয়া, সত্যকে মিথ্যা করিয়া তিনি কখনও কোন পক্ষ সমর্থন করিতেন না। অন্যায়রূপে অর্থ উপার্জ্জনের দিকে তাঁহার একেবারেই লক্ষ্য ছিল না, এই নিমিত্ত সময় সময় তিনি তাঁহার নিম্নপদস্থ বা উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারীর অপ্রিয় পাত্র হইয়া উঠিতেন, কিন্তু তিনি সে দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া নিজের অভিপ্রায়মত কাৰ্য্য করিতেন। যে সকল বিষয়ে তাঁহার কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইত, অপরের নিকট তাহার পরামর্শ গ্রহণ করিতে তিনি কখনও কুণ্ঠিত বা লজ্জিত হইতেন না। 

কর্ম্মচারী এই মোকদ্দমার বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু ইহার প্রকৃত ঘটনা কি, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না, বা ওই মৃতদেহ পীরমহম্মদের কি অপর কাহার, তাহাও তিনি নির্ণয় করিতে পারিলেন না। তিনি নিজের মনকে এ বিষয়ে কোনদিকে স্থির করিতে না পারিয়া তাঁহার কাগজপত্র লইয়া, তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট গমন করিলেন। তাঁহাকে মোকদ্দমার সমস্ত অবস্থা কহিলেন, ডায়েরি প্রভৃতি সমস্ত কাগজপত্র যাহা তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন তাহা তিনি তাঁহাকে দেখাইলেন ও কহিলেন “আমি এই মোকদ্দমার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, যে অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা দেখিয়া কোন ব্যক্তি, উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা কখনই বলিতে পারে না, কিন্তু খানমহম্মদ ও তাহার সাক্ষীগণ উহা অনায়াসেই সনাক্ত করিতেছে, এতদ্ব্যতীত উহার পরিধানে যে বস্ত্র আছে তাহাতে এমন কোন চিহ্ন নাই যে তাহা দেখিয়া ওই বস্ত্র সনাক্ত করা যাইতে পারে, কিন্তু খানমহম্মদ ও তাহার সাক্ষীগণ ওই বস্ত্র পীরমহম্মদের বস্ত্র বলিয়া সনাক্ত করিতেছে। এরূপ সনাক্তের উপর কিছুতেই নির্ভর করা যাইতে পারে না, অথচ আবুল ফজলের বাগানের ভিতর ওই মৃতদেহ যে কিরূপে আসিল, তাহার কোন কথা তিনি বলিতে পারেন না। যে সকল লোক আবুল ফজলের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, তাহাদিগের কাহারও সহিত আবুলফজলের সৎভাব নাই, অথচ অতগুলি লোকের কথা কিরূপেই বা একেবারে অগ্রাহ্য করা যাইতে পারে।” কর্মচারীর কথা শুনিয়া তাঁহার প্রধান কর্মচারী তাঁহাকে এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলেন যে, কোন সাক্ষী কোনরূপ অতিরঞ্জিত না হয়, অথচ কোন সাক্ষীর কথাও যেন কোনরূপে গোপন করা না হয়। ওই সমস্ত সাক্ষীর কথার উপর নির্ভর করিয়া মোকদ্দমার অবস্থা যেরূপ দাঁড়ায়, সেইরূপ অবস্থাতেই বিচারার্থে ওই মোকদ্দমা প্রেরণ কর, ইহাতে বিচারক যেরূপ ভাল বিবেচনা করিবেন সেইরূপ করিবেন। 

প্রধান কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী তাহাতেই সম্মত হইলেন, ও যে সকল সাক্ষী প্রাপ্ত হইলেন, তাহাদিগের কথার উপর নির্ভর করিয়া তিনি ওই মোকদ্দমা বিচারার্থে প্রেরণ করিলেন। বলা বাহুল্য আবুল ফজল ও তাঁহার যে দুইজন কর্ম্মচারী ধৃত হইয়াছিলেন, তাহাদিগের উপর যে কেবল এই মোকদ্দমা দায়ের হইল তাহা নহে, ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞার উপরও এই মোকদ্দমা দায়ের হইল। 

আবুল ফজল ও তাঁহার দুইজন কর্মচারীর উপর মোকদ্দমা চলিতে লাগিল, কিন্তু ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞাকে আর পাওয়া গেল না, তাহাদিগকে ধৃত করিবার নিমিত্ত পুলিস-কৰ্ম্মচারিগণ বিশেষরূপ চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন ফলই ফলিল না। 

ওহায়েদ বক্স ও সেরু মিঞা আদালত হইতে প্রত্যাগমন কালীন এই সমস্ত অবস্থা শুনিতে পায় ও জানিতে পারে যে তাহাদের মনিব ও অপর দুইজন কর্ম্মচারী পুলিস কর্তৃক ধৃত হইয়াছে, ও তাহাদিগকেও ধরিবার নিমিত্ত পুলিস বিধিমতে চেষ্টা করিতেছে। এই সংবাদ শুনিয়া তাহারা আর মনিব বাড়ীতে প্রত্যাগমন করে না বা আপনার গ্রামেও গমন করে না। নিকটবর্তী একখানি গ্রামে তাহাদিগের কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে তাহারা দুই চারি দিবস লুকাইয়া থাকিয়া, পুলিস ও তাহাদিগের শত্রুপক্ষীয় লোকগণ কতদূর কি করিতেছে, তাহার সংবাদ সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হয়, পরিশেষে যখন জানিতে পারে যে তাহাদিগের মনিবকে তাঁহার কর্ম্মচারিদ্বয়ের সহিত হাজতে আবদ্ধ করা হইয়াছে ও বিচারার্থে তাহাদিগকে আদালতে প্রেরণ করা হইয়াছে, তখন তাহারা সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্বক অপর আর এক স্থানে গুপ্ত ভাবে অবস্থিতি করিয়া ওই মোকদ্দমার যোগাড় করিতে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যোগাড় করিয়া ওই মোকদ্দমার কিছুই করিয়া উঠিতে পারে না। মোকদ্দমার আবুল ফজলের অনেক অর্থ ব্যয় হইয়া যায় কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগের অব্যাহতি হয় না। নিম্ন বিচারালয় হইতে তাহাদিগের মোকদ্দমা পরিশেষে উচ্চ আদালতে প্রেরিত হয়, সেই স্থান হইতে উহারা সকলেই দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ হয় এবং ওহায়েদ বক্স ও সেরু মিঞার নামে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির হয়। 

এই সমস্ত অবগত হইয়া ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞা বুঝিতে পারে যে তাহারা ধৃত হইলে কোনরূপে তাহারা নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারিবে না, তাহাদিগকেও দীর্ঘকালের জন্য জেলে গমন করিতে হইবে। ইহা ভাবিয়া তাহারা যেস্থানে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থান করিতেছিল সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে, ক্রমে দেশান্তরে গমন করে। তাহাদিগের এখন প্রধান উদ্দেশ্য এই হইল যে, যেদিকে কোনরূপে তাহাদের পুলিসের হস্তে ধৃত হইবার সম্ভাবনা, সেই দিকে তাহারা কিছুতেই গমন করিবে না। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তাহারা নানা স্থানে ও নানা গ্রামে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করে। যাহাতে কোন লোক তাহাদিগের উপর কোনরূপে সন্দেহ করিতে না পারে এই ভাবিয়া তাহারা ফকির পরিচয়ে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করিয়া আপন আপন জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে আরম্ভ করে। যে জেলায় তাহাদিগের বাসস্থান সেই জেলা পরিত্যাগ করিয়া দূরবর্তী জেলার মধ্যে গমন করিয়া, আজ এ গ্রামে কাল ও গ্রামে, এইরূপে নানা গ্রামে অবস্থিতি করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে প্ৰবৃত্ত হয়। 

এইরূপে নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে করিতে তাহারা ক্রমে লক্ষ্ণৌ সহরে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে একটি ঘর ভাড়া করিয়া অবস্থিতি করিতে লাগিল। তাহারা ফকিরী বেশ ধারণ করিয়াছিল ও ভিক্ষা করিয়া দৈনিক অন্নের সংস্থান করিতেছিল সুতরাং তাহাদিগকে দেখিয়া কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় না, তাহারা নির্ভয়ে সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া দিন অতিবাহিত করিতে থাকে। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

এইরূপে দুই তিন মাস অতিবাহিত হইবার পর এক দিবস ভিক্ষা করিতে যখন তাহারা বাহির হইয়াছিল, সেই সময় তাহারা শুনিতে পায় ওই স্থানের একজন ধনী মুসলমান সহরের সমস্ত ফকিরদিগকে উত্তমরূপে আহার করাইবার বন্দোবস্ত করিতেছেন ও পর দিবস দুই প্রহরের সময় ফকিরগণকে পরিতোষের সহিত আহার করাইয়া প্রত্যেককে এক একখানি বস্ত্র প্রদান করিবেন। এই সংবাদ অবগত হইয়া পর দিবস সময়মত তাহারা সেই স্থানে গমন করিতে মনঃস্থ করিল। 

পরদিবস দিবা ১১ টার সময় তাহারা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল, দেখিল নানা স্থান হইতে নানারূপ ফকিরের সেই স্থানে আমদানি হইয়াছে, সকলেই গিয়া একস্থানে উপবেশন করিতেছে, তাহারাও ক্রমে সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিল। 

সেই স্থানে অনেক ফকির আসিবে ও বিশেষরূপ জনতা হইবে, যাহাতে কোনরূপ গোলযোগ না হয় ও অনায়াসে কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া যায়, তাহার নিমিত্ত স্থানীয় পুলিসের কয়েকজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন। ওহায়েদ বক্স ও সেরু মিঞা সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই আর একজন আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহাদিগের মধ্যে একজনকে দেখিয়া ওহায়েদ বক্স সেরুকে চুপে চুপে কহিল “ওই লোকটিকে বেস ভাল করিয়া একবার দেখ দেখি।” 

সেরু। উহাকে ঠিক পীরমহম্মদের ন্যায় বোধ হইতেছে। লোকে বলে এক আকৃতির দুই ব্যক্তি কখন হইতে পারে না, কিন্তু ইহার আকৃতির সহিত পীরমহম্মদের আকৃতির কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। 

ওহা। এ পীরমহম্মদ নয় ত? 

সেরু। পীরমহম্মদ হইবে কি প্রকারে যে একবার মরিয়া গিয়াছে সে আবার বাঁচিয়া উঠিবে কি প্রকারে?

ওহা। সে যে মরিয়া গিয়াছে, তাহারই বা প্রমাণ কি? আমরা তাহাকে ধরিয়াও আনি নাই, বা মারিয়াও পুঁতিয়া রাখি নাই। তবে যে ব্যক্তির মৃতদেহ আমাদিগের মনিবের বাগানের ভিতর পাওয়া গিয়াছে তাহা যে পীরমহম্মদের মৃতদেহ তাহাই বা বলি কি প্রকারে। আমার বেশ বোধ হইতেছে পীরমহম্মদ মরে নাই, আর এই সেই পীরমহম্মদ আমাদিগের ন্যায় ফকিরের বেশে নানাদেশ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। যাহা হউক ইহাকে ভাল করিয়া দেখা আবশ্যক, চল আমরাও উহার নিকটে গিয়া উপবেশন করি। উহার নিকটে গিয়া দেখিলেই আমরা উহাকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিব। 

ওহায়েদের কথা শুনিয়া সেরুমিঞা তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইল ও যেস্থানে ওই ব্যক্তি বসিয়া ছিল তাহার নিকট গিয়া উপবেশন করিল, উহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া তাহাদিগের মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। পীরমহম্মদও তাহাদিগের দিকে নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। পীরমহম্মদকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিবার পর ওহায়েদ বক্স সেরু মিঞাকে চুপে চুপে কি কহিল। ওহায়েদ বক্সের কথা শুনিয়া সেরুমিঞা সেই স্থান হইতে উঠিয়া যে স্থানে কয়েকজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী বসিয়া ছিলেন সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল, ও তাহাদিগের একজনকে সম্বোধন করিয়া কহিল “মহাশয় আমি আপনাকে কিছু বলিতে ইচ্ছা করি।” 

কৰ্ম্ম। কি বলিতে চাই? 

সেরু। আপনি কি পুলিস-কৰ্ম্মচারী?. 

কৰ্ম্ম। হাঁ। 

সেরু। আমরা ভয়ানক বিপদগ্রস্ত, সেই বিপদ হইতে এখন আপনি আমাদিগকে উদ্ধার করুন। 

কৰ্ম্ম। কি বিপদগ্রস্ত হইয়াছ? 

সেরু। এক ব্যক্তিকে হত্যা করা অপরাধে আমাদিগের মনিব ও তাঁহার দুইজন কর্ম্মচারী দীর্ঘকালের জন্য জেলে গিয়াছেন ও আমার ও অপর একজনের নামে ওই খুনি মোকদ্দমার নিমিত্ত ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। আমরা এখন ওই খুনি মোকদ্দমার ফেরারী আসামী। 

কৰ্ম্ম। তুমি বলিতেছ আমরা, তুমি আর কে? 

সেরু। হায়েদ বক্স নামক আর এক ব্যক্তি। 

কৰ্ম্ম। তিনি কোথায়? 

সেরু। তিনিও এই স্থানে আছেন। 

কৰ্ম্ম। এখন তোমরা কি চাহ? তোমরা গ্রেপ্তার হইতে চাহ? 

সেরু। আমরা গ্রেপ্তার হইতে চাহি, ও অপর আর একজনকে গ্রেপ্তার করাইতে চাহি। 

কৰ্ম্ম। আর কাহাকে? 

সেরু। যে ব্যক্তিকে হত্যা করিয়াছি বলিয়া আমরা অভিযুক্ত সেই ব্যক্তিকে। 

কৰ্ম্ম। তুমি এই বলিতে চাও যে যে ব্যক্তিকে হত্যা করা অপরাধে তোমরা অভিযুক্ত সেই ব্যক্তি হত হয় নাই, তাহাকেও তোমরা ধরাইয়া দিতে চাহ? 

সেরু। হাঁ মহাশয়। 

কৰ্ম্ম। ভাল কথা, চল তাহাদিগকে দেখাইয়া দেও। 

এই বলিয়া কৰ্ম্মচারী সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া সেরু মিঞার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন, যে স্থানে ওহায়েদ বক্স ও পীরমহম্মদ বসিয়া ছিল সেই স্থানে গমন করিয়া সেরুমিঞা উভয়কেই দেখাইয়া দিয়া কহিল, ইহার নাম ওহায়েদ বক্স ইহার নামেও হত্যা মোকদ্দমার ওয়ারেন্ট আছে, ইনিও আমার ন্যায় একজন ফেরারী আসামী। আর ইহার নাম পীরমহম্মদ। ইহাকেই হত্যা করার অভিযোগে, আমরা ফেরার হইয়াছি। সেরুমিঞার এই কথা শুনিয়া কর্ম্মচারী ওহায়েদ বক্সকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, সেরুমিঞা তাঁহাকে যাহা বলিয়াছিল ওহায়েদ বক্সও তাঁহাকে ঠিক তাহাই কহিল। তখন তিনি পীরমহম্মদকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম কি? পীরমহম্মদ কি তোমার নাম?” 

পীর। না মহাশয় আমার নাম পীরমহম্মদ নহে। 

কৰ্ম্ম। তোমার নাম কি? 

পীর। আমার নাম আহম্মদ বক্স। 

সেরু। মিথ্যা কথা। 

ওহা। ইহার নাম পীরমহম্মদ, ইহার পুত্রের নাম খানমহম্মদ, ইহার বাড়ী উজীরপুর গ্রামে, ইহার নিমিত্তই ইহার জমীদার আবুল ফজল ও তাঁহার দুইজন কর্ম্মচারীর জেল হইয়াছে, ইহার নিমিত্তই আমরা এই ফকির বেশ ধারণ করিয়া ছদ্মবেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করিয়া কত কষ্টই প্রাপ্ত হইতেছি। যে এরূপ মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইতে পারে, সে কি কখন সত্য কথা বলিবে, আপনি আমাদিগের সহিত উহাকে কয়েদ অবস্থায় আমাদিগের দেশে লইয়া চলুন তাহা হইলেই জানিতে পারিবেন যে আমরা মিথ্যা কথা কহিতেছি কি এই ব্যক্তি মিথ্যা কথা কহিতেছে? 

কর্মচারী উহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তিনজনকেই কয়েদী রূপে থানায় পাঠাইয়া দিলেন। ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞা হাসিতে হাসিতে প্রহরীর সমভিব্যাহারে থানায় গমন করিতে লাগিল। সেই স্থানে গিয়া তিনজনেই সেই পুলিস-কর্মচারীর দ্বিতীয় আদেশ পৰ্য্যন্ত হাজত-গৃহে আবদ্ধ হইল, ও তাহাদিগের উপর দস্তুরমত পাহারা রহিল। 

নিজের কার্য্য সমাপন করিয়া সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারী থানায় আসিয়া ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞাকে আপনার সম্মুখে ডাকাইলেন ও তাহাদিগের জবানবন্দী লিখিয়া লইলেন। তাহারা কহিল, পীরমহম্মদের সহিত গ্রামের জমীদার আবুল ফজলের অনেক দিবস হইতে মনের গোলমাল চলিতেছিল, সে তাহার জমীদারকে নানারূপে কষ্ট দিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করে নাই। কিন্তু কোনরূপেই জমীদারকে পরাজিত করিতে পারে না, উভয়ের মধ্যে যতগুলি মামলা মোকদ্দমার হইয়াছিল তাহার প্রায় সমস্ত মোকদ্দমা জমীদার জয়লাভ করেন। 

এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইলে হঠাৎ এক দিবস পীরমহম্মদ তাহার ঘর হইতে নিরুদ্দেশ হয় কিন্তু তাহার পুত্র খানমহম্মদ থানায় গিয়া জমীদার, তাঁহার দুইজন কর্মচারী এবং আমাদিগের নামে এক মিথ্যা মোকদ্দমা এই মৰ্ম্মে রুজু করে যে, আমরা বাকী খাজনার নিমিত্ত তাহাকে জমীদার বাড়ীতে ধরিয়া লইয়া যাই, ও তাহাকে জমীদার বাড়ীর ভিতর মারপিট করিয়া মারিয়া ফেলি ও তাহার মৃতদেহ জমীদার বাড়ীর সংলগ্ন জমীদারের বাগানের ভিতর পুঁতিয়া রাখি। পুলিস ইহার অনুসন্ধান করেন। অনুসন্ধানের সময় পীরমহম্মদের যত আত্মীয় ওই মর্ম্মে সাক্ষ্য প্রদান করে। পরিশেষে জমীদার সাহেবের বাড়ীর সংলগ্ন সেই বাগানের মধ্যে একটি মৃতদেহ প্রোথিত অবস্থায় বাহির হইয়া পড়ে। ওই মৃতদেহ এরূপ অবস্থায় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল যে উহা দেখিয়া কাহারই বলিবার উপায় ছিল না যে উহা কাহার মৃতদেহ। তথাপি খানমহম্মদ ও তাহার সাক্ষীগণ ওই মৃতদেহ পীরমহম্মদের মৃতদেহ বলিয়া সনাক্ত করে। জমীদার সাহেব ও তাঁহার দুইজন কর্ম্মচারী সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা পুলিস কর্তৃক সেই সময় ধৃত হন ও বিচারে তাহারা দীর্ঘকালের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হন। আমরা সেই সময় সেই গ্রামে ছিলাম না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গ্রামান্তরে গমন করিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার কালীন এই সমস্ত অবস্থা শুনিতে পাই, ও ভয়ে আর আমরা জমীদার বাড়ীতে গমন করি না, ও কোন রূপেই পুলিসকে ধরা দেই না। পুলিস আমাদিগকে ধরিতে না পারিয়া আমাদিগের নামে গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দেয়, আমরাও ফকিরি বেশ অবলম্বন করিয়া এ পর্যন্ত নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া নিতান্ত কষ্টের সহিত দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছি। মিথ্যা মোকদ্দমায় আমাদিগকে স্ত্রী পুত্রের মায়া দূর করিতে হইয়াছে, দেশের উপর মমতা পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। পীরমহম্মদ নিরুদ্দেশ হইয়া যে কোথায় গিয়াছে তাহা আমরা এ পর্যন্ত কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিয়াছিলাম না, সে মরিয়া গিয়াছে কি বাঁচিয়া আছে তাহাও আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিয়াছিলাম না। আজ হঠাৎ তাহাকে দেখিতে পাইয়া আমরা যে কিরূপ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছি তাহা আপনাকে কি বলিব, প্রথমতঃ আমরা মনে করিয়াছিলাম আমাদিগের দেখিবার ভুল হইয়াছে পীরমহম্মদ মরিয়া গিয়াছে, আর যদি মরিয়াই না গিয়া থাকে তাহা হইলেই বা এই দূর দেশে আসিবে কেন? আমরা প্রাণের ভয়ে লুকাইয়া বেড়াইতেছি, সে লুকাইয়া বেড়াইবে কিসের ভয়ে, আবুল ফজলের জেল হওয়ায় তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে, এইরূপ ভাবিয়া আমরা উহার নিকটে গমন করিলাম ও ভাল করিয়া উহাকে দেখিয়া আমাদিগের মনের সন্দেহ মিটাইলাম। আমাদিগকে দেখিলে পাছে সে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে এই ভাবিয়া আমরা একজন তাহার নিকট রহিলাম আর একজন আপনার নিকট আসিয়া আপনাকে এই সংবাদ প্রদান করিলাম, তাহার পর আপনি ইহাকেও গ্রেপ্তার করিয়া আমাদিগের যে কি উপকার করিয়াছেন তাহা আপনি নিজেই অবগত আছেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

পুলিস-কৰ্ম্মচারী ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞার কথা শুনিয়া পীরমহম্মদকে ডাকিলেন ও তাহাকে ওই সকল কথা জিজ্ঞাসা করায় সে সমস্ত অস্বীকার করিল, তিনি তাহার কথায় কোনরূপ পীড়াপীড়ি না করিয়া, তাহাকেও হাজতে রাখিয়া দিলেন ও সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিয়া, যেস্থানের এই ঘটনা সেই স্থানের পুলিস- কর্ম্মচারীর নিকট পত্র লিখিলেন। পত্র পাইবামাত্র সেই স্থানের পুলিস কর্ম্মচারী এক টেলিগ্রাফ করিলেন, ওই টেলিগ্রাফ পাইয়া সেই পুলিস-কৰ্ম্মচারী জানিতে পারিলেন যে, ওহায়েদ ও সেরুমিঞা যাহা বলিয়াছে তাহা সত্য। ওই টেলিগ্রাফে সেই স্থানের পুলিস তিনজনকেই বন্দী করিয়া সেই স্থানে পাঠাইয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ের পুলিস-কৰ্ম্মচারী ওই টেলিগ্রাফের আদেশ প্রতিপালন করিলেন, চারিজন প্রহরীর জিম্বায় ওই তিনজনকেই পাঠাইয়া দিলেন। 

যে জেলায় মোকদ্দমা, নিয়মিত সময়ে উহারা সেই জেলায় আসিয়া উপস্থিত হইল, জেলার কর্মচারী তাহাদিগকে স্থানীয় পুলিস-কর্মচারীর নিকট লইয়া যাইবার আদেশ প্রদান করিলেন। 

যে থানার অধীনে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল প্রহরিগণ তাহাদিগকে লইয়া সেই থানায় উপস্থিত হইল। যে সময় তাহারাই গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, সেই সময় সেই থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। এই কৰ্ম্মচারী প্রথমেই মূল মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, তিনি পীরমহম্মদকে দেখিয়া যে কতদূর বিস্মিত হইলেন তাহা বলা যায় না, তিনি সেই সময় আর কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া ওই তিনজনকে হাজতে বদ্ধ করিয়া দিয়া, যে প্রহরিগণ উহাদিগকে আনিয়াছিল তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন। 

সময় মত কর্ম্মচারী উহাদিগকে লইয়া উজীরপুর গ্রামে গমন করিলেন সেই স্থানে পীরমহম্মদকে দেখিবামাত্র সকলেই চিনিতে পারিল। যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে বলিয়া সকলে বিশ্বাস করিয়াছিল, এখন তাহাকে জীবিত অবস্থায় সেই স্থানে দেখিতে পাইয়া সকলেই অতিশয় বিস্মিত হইল। কেহ কেহ পীরমহম্মদকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, কিন্তু পীরমহম্মদ তাহাদিগের কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। 

খানমহম্মদ ও যে সকল ব্যক্তি সেই বাগানের মধ্যে প্রাপ্ত মৃতদেহকে পীরমহম্মদের মৃতদেহ বলিয়া সনাক্ত করিয়াছিল, ও যাহাদিগের সাক্ষার উপর নির্ভর করিয়া বিচারক তিন তিনজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাদিগের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। 

ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞাকে দেখিয়া সকলেই চিনিতে পারিল, জমীদারের পক্ষীয় লোকজন তাহাদিগকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, এতদিবস পর্য্যন্ত তাহারা কিরূপ অবস্থায় কোথায় ছিল, কিরূপে ও কোথায় তাহারা পীরমহম্মদকে দেখিতে পায়, ও কিরূপে তাহাকে তাহারা পুলিসের হস্তে অর্পণ করে, এইরূপ নানা প্রকার প্রশ্ন তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, তাহারাও কর্ম্মচারীর অনুমতি মতে তাহাদিগকে ওই সকল কথার সংক্ষেপে উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। 

পীরমহম্মদ ধৃত হওয়ায় গ্রামের মধ্যে একটা মহা গোলোযোগ পড়িয়া গেল, গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই তাহাকে দেখিবার নিমিত্ত দলে দলে সেই স্থানে আগমন করিতে লাগিল। 

কর্ম্মচারী দেখিলেন গ্রামের মধ্যে যেরূপ গোলযোগ হইয়াছে, তাহাতে সেই সময় সেই স্থানে কোনরূপ অনুসন্ধান করা একেবারেই অসাধ্য। কাজেই অনন্যোপায় হইয়া কৰ্ম্মচারী উহাদিগকে লইয়া আবুল ফজলের বাড়ীতে গমন করিলেন, সেই স্থানে ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞাকে বাহিরে রাখিয়া কেবলমাত্র পীরমহম্মদকে সঙ্গে করিয়া তিনি আবুল ফজলের একখানি বাহিরের ঘরের মধ্যে গিয়া উপবেশন করিলেন। সেই ঘরের সম্মুখে দুইজন প্রহরীকে রাখিয়া দিলেন, তাহাদের উপর এই আদেশ রহিল কোন ব্যক্তি যেন এই ঘরের ভিতর প্রবেশ না করে, বা কোন ব্যক্তি যেন এই ঘরের নিকটে না আসে। 

প্রহরিগণ সেই ঘরের সম্মুখে থাকিয়া কর্মচারীর আদেশ প্রতিপালন করিতে লাগিল। যে সকল ব্যক্তি পীরমহম্মদকে দেখিবার মানসে সেই ঘরের দিকে গমন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, প্রহরিগণ তাহাদিগকে সেই স্থানে যাইতে নিবৃত্ত করিতে লাগিল, ও তাহাদিগকে এইরূপে বুঝাইয়া দিতে লাগিল যে, কর্ম্মচারী এখন তাহার জবানবন্দী গ্রহণ করিতেছেন, তাঁহার কার্য্য শেষ হইয়া গেলেই পীরমহম্মদকে আমরা বাহিরে লইয়া আসিব, সেই সময় তোমরা অনায়াসেই উহাকে দেখিতে পাইবে ও ইচ্ছা করিলে উহাকে জিজ্ঞাসাবাদও করিতে পারিবে। প্রহরিগণের কথায় বিশ্বাস করিয়া উহারা দূরে গিয়া উপবেশন করিতে লাগিল ও পীরমহম্মদ কখন বাহির হইয়া আসিবে তাহারই প্রতীক্ষায় সেই স্থানে বসিয়া সময় অতিবাহিত করিতে লাগিল, কেহ বা ওহায়েদ বক্স ও সেরু মিঞার নিকট গমন করিয়া তাহাদিগকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। সেই সময় গ্রামের ও অপর গ্রামের এত লোক আসিয়া, উহাদিগকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া এত কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল যে, তাহারা কাহার কথায় কি উত্তর প্রদান করিবে তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

কর্ম্মচারী পীরমহম্মদকে সেই ঘরের ভিতর লইয়া গিয়া উপবেশন করিলেন ও পীরমহম্মদকেও সেই স্থানে উপবেশন করিতে কহিলেন। পীরমহম্মদ সেই স্থানে উপবেশন করিলে কর্ম্মচারী তাহাকে কহিলেন, “দেখ পীরমহম্মদ, তোমাকে এ পর্যন্ত যখন জিজ্ঞাসা করিয়াছি তখনই তুমি বলিয়াছ তোমার নাম পীরমহম্মদ নহে। কিন্তু এখন তোমার গ্রামের সমস্ত লোক, তোমার পুত্র, তোমার আত্মীয় স্বজন সকলেই তোমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিয়াছে, ও তোমাকে এই অবস্থায় জীবিত দেখিয়া একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইয়াছে, এখন আর তুমি মিথ্যা কথা বলিও না। তোমার জন্য তিনজন লোকের জেল হইয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু এখন আর তাহাদিগকে কারাগারে থাকিতে হইবে না, দুই চারি দিবসের মধ্যে তাহারা অব্যাহতি পাইবে। তাহাদিগের পরিবর্তে তোমাকে, তোমার পুত্র খানমহম্মদকে, ও তোমার আত্মীয় স্বজন যাহারা ওই মোকদ্দমায় সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাহাদিগকেই জেলে যাইতে হইবে ইহা নিশ্চয় জানিও, কিন্তু এখন যদি তুমি সমস্ত অবস্থা আমাকে খুলিয়া বল তাহা হইলে আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিতে পারি যে আমা দ্বারা তোমাদিগের কোনরূপ উপকার হইতে পারে কি না? তুমি এখনও আমার কথা শুন, সমস্ত অবস্থা এখনও আমাকে বল।” 

পীর। আপনি আমার নিকট কি অবগত হইতে চাহেন? 

কৰ্ম্ম। আমি অবগত হইতে চাহি, আবুল ফজলের উপর তোমার এমন কি মর্মান্তিক রাগ ছিল যে, তুমি তাহাকে জব্দ করিবার মানসে চির দিবসের নিমিত্ত দেশত্যাগী হইয়াছিলে, আর তাঁহার কর্ম্মচারিগণই বা তোমার নিকট এমন কি অপরাধ করিয়াছিল, যাহাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ষড়যন্ত্র করিয়া তাহাদিগের দুইজনকে দীর্ঘকালের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরণ করিয়াছ। এই সমস্ত বিষয় আমি আনুপূর্ব্বিক তোমার নিকট অবগত হইতে চাহি। আরও অবগত হইতে চাহি, কাহার পরামর্শ মত তোমরা এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলে, যে মৃতদেহ আবুল ফজলের বাগানের ভিতর পাওয়া যায় সে কাহার মৃতদেহ, কিরূপ উপায়ে ওই মৃতদেহ সংগ্রহ হয়, কিরূপ উপায়ে উহার সর্ব্বশরীরে ওরূপ ভাবে জখম করা হয়, ও কিরূপ ভাবেই বা উহা ওই বাগানের ভিতর প্রোথিত করা হয়। স্থূল কথায় এই ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথা আমি আনুপূর্ব্বিক জানিতে চাহি। 

পীর। যখন আমি ধরা পড়িয়াছি তখন আর আমি কোন কথা গোপন করিব না, সমস্তই আপনার নিকট প্রকাশ করিব, ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা ঘটিবার ঘটুক। আর ঘটিবেই বা কি? আমার বয়স হইয়াছে সংসারের সমস্ত কার্য্য আমার শেষ হইয়া গিয়াছে। মৃত্যু আমার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইয়াছে, এখন আর আমার কিছুতেই ভাবনা নাই, রাজদণ্ডে ভয় নাই, লোক নিন্দার দিকেও আর আমার কিছুমাত্র লক্ষ্য নাই। আমি সমস্তই এখন আপনাকে বলিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন: 

আমি বহুকাল হইতে এই গ্রামে বাস করিতেছি, আবুল ফজলের পিতামহের সময় হইতে আমার এই গ্রামে বাসস্থান। তিনি আমাদিগকে কখনও কোনরূপে কষ্ট দেন নাই, সহোদর ভ্রাতার ন্যায় তিনি আমাকে ভালবাসিতেন। তাঁহার সময় এই গ্রামে অতি সুখে আমি বাস করিয়াছিলাম। তাঁহার পরলোক গমনের পর আবুল ফজলের পিতা আমাদিগের জমীদার হন। তিনি আমাকে মান্য করিয়া চলিতেন, তিনি জমীদার আর আমি তাঁহার প্রজা, সে ভাব তিনি কখনই দেখাইতেন না, অধিকন্তু আমি তাঁহার পিতার বন্ধু ছিলাম বলিয়া, আমায় জিজ্ঞাসা না করিয়া তিনি কখন কোন কাৰ্য্য করিতেন না। তিনি জমীদার আমি প্রজা ছিলাম সত্য কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন পড়িলেও কখনও তিনি আমাকে তাঁহার বাড়ীতে ডাকাইয়া লইয়া যাইতেন না, নিজেই আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইতেন, ও তাঁহার কার্য শেষ করিয়া চলিয়া যাইতেন। তাঁহার ব্যবহারে কেবল যে আমিই সন্তুষ্ট ছিলাম তাহা নহে, গ্রামের সমস্ত প্রজাই তাঁহার উপর বিশেষরূপ সন্তুষ্ট ছিলেন, ও সকলেই তাঁহাকে মান্য করিয়া চলিতেন। তিনিও যে যেমন ব্যক্তি, তাহার উপর সেইরূপ ব্যবহার করিতেন। তাঁহার সময় কোন প্রজার নিকট কখনও কোনরূপ খাজনা বাকী পড়িত না, বিনা তাগাদায় প্রজাগণ তাঁহাকে খাজনা দিয়া আসিত। তাঁহার মৃত্যুর পর আবুল ফজল আমাদিগের জমীদার হইলেন। 

আবুল ফজল বাল্যকাল হইতেই কলিকাতায় থাকিয়া ইংরাজী লেখা পড়া করিতেন, প্রজাদিগের সহিত মিশামিশি তাঁহার বাল্যকাল হইতেই ছিল না। প্রজাগণ চাষ আবাদ করিয়াই জীবন ধারণ করিয়া থাকে, আর তিনি ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত সুতরাং প্রজাগণের সহিত তাঁহার মেশামিশি করা দূরে থাকুক, তিনি উহাদিগকে ঘৃণা করিতেন, উহাদিগের সহিত কখনও একত্র আহার করিতেন না, এমন কি উহাদিগের সহিত কখনও এক বিছানায় পর্য্যন্ত বসিতেন না, এইরূপ নানা কারণে প্রজাগণ ক্রমে তাঁহার উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইতে আরম্ভ হইল, ও খাজনা দেওয়া একবারে বন্ধ করিয়া দিতে লাগিল, বিনা নালিসে প্রায় তিনি কাহারও নিকট খাজনা আদায় করিতে পারিতেন না, এইরূপ নানা কারণে তিনি ও প্রজাদিগের উপর ক্রমে অসন্তুষ্ট হইয়া পড়িতে লাগিলেন। 

যে সময় প্রজাদিগের সহিত তাঁহার গোলযোগ চলিতেছিল সেই সময় একটি ডাকাইতি মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত থানার দারোগা এই গ্রামে আগমন করিয়া তাঁহারই বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আবুল ফজল তাঁহাকে সম্পূর্ণ রূপ সাহায্য করিয়া গ্রামের কতকগুলি প্রজাকে ধরাইয়া দেন। কোথায় তিনি তাঁহার নিজের প্রজাদিগকে সাহায্য করিয়া, যাহাতে তাহারা কোনরূপে বিপদে পতিত না হয় তাহা করিবেন, কিন্তু তাহার পরিবর্তে তিনি পুলিসকে সাহায্য করিয়া তাঁহার নিজের কতকগুলি প্রজাকে ধরাইয়া দেন ও যাহাতে তাহাদিগের উপর ডাকাইতি মোকদ্দমা উত্তমরূপে প্রমাণ হয়, তাহার যোগাড় করিয়া দেন। তাঁহার নিমিত্তই তাঁহার অনেকগুলি প্রজা সেই সময় জেলে গমন করে। আমার দুইটি পুত্রকেও তিনি ওই সময় ধরাইয়া দেন, ও তাহাদিগের দীর্ঘকালের নিমিত্ত জেল হইয়া যায়। 

ইহার পূর্ব্ব হইতে আমার সহিত আবুল ফজলের মিল ছিল না, কিন্তু এই সময় হইতে উভয়ের মধ্যে কথাবার্ত্তা পৰ্য্যন্তও বন্ধ হইয়া যায়। যাহাদিগের উপার্জ্জনের উপর নির্ভর করিয়া আমরা দিন পাত করিয়া আসিতেছিলাম, তাহাদিগের জেল হওয়ায় আমাদিগের বিশেষ কষ্ট হয়। আমার পূর্ব্ব সঞ্চিত যে কিছু অর্থ ছিল, আমার পুত্রদ্বয়ের মোকদ্দমায় তাহা সমস্তই ব্যয় হইয়া যায়। সেই সময় হইতে জমীদারের খাজনা বাকী পড়িতে আরম্ভ হয়। জমীদারও প্রত্যেক কিস্তির বাকী খাজনার নিমিত্ত আমার নামে নালিস করিতে আরম্ভ করেন, তিনি আর আমার নিকট খাজনা চাহিতেন না, সময় অতীত হইবামাত্র আমার নামে নালিস করিয়া খাজনা, তাহার সুদ ও খরচার ডিক্রী করিয়া আমাকে একেবারে ফেরার করিতে আরম্ভ করেন, আমিও লোকের পরামর্শ শুনিয়া প্রত্যেক মোকদ্দমায় জবাব দিতে আরম্ভ করি ও জমীদারের নামে দুই একটি দেওয়ানি ও ফৌজদারী মোকদ্দমা রুজু করিয়া দি। জমীদারের পয়সা আছে, আর আমার পয়সার অভাব সুতরাং জমীদারের নিকট আমাকেই পরাস্ত হইতে হয়। 

এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইবার পর কিরূপে আবুল ফজলকে বিশেষরূপে জব্দ করিতে পারা যায় সেই সম্বন্ধে পরামর্শ করিতে আরম্ভ করিলাম। আমাদিগের পাড়ায় একটি লোক আছে, সে লেখা পড়া জানে কিন্তু প্রায়ই গ্রামে থাকে না, তাহার নিজের কার্য্য উপলক্ষে সে প্রায়ই সহরে থাকে ও সময় সময় বাড়ীতে আসে। সে মামলা মোকদ্দমা খুব ভাল রূপ বুঝিয়া থাকে, কাহাকে কিরূপে জব্দ করিতে হয় তাহার উপায় সে যেমন জানে, সেরূপ আর কেহ জানে বলিয়া আমার বোধ হয় না। 

সেই ব্যক্তি তাহার আবশ্যকমত বাড়ী আসিলে, আমি আমার দুঃখের কথা তাহাকে বলি, আমার কথা শুনিয়া সে কহে আবুল ফজল যদিও তাহার জমীদার, তথাপি তাহার মত প্রজাকে এক দিবসের জন্যও তিনি খাতির করেন নাই, বা কোন দিন তাহাকে দুইটি মিষ্ট কথাও বলেন নাই। নিতান্ত অশিক্ষিত ও চাষি প্রজার সহিত তিনি যেরূপ ভাবে ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহার সহিতও তিনি সেইরূপ ভাবে ব্যবহার করিতেন বলিয়া তাহারও জমীদারের উপর বিশেষ রাগ ছিল। আমার কথা শুনিয়া সেই ব্যক্তি কহিল, “এরূপ জমীদারকে ভাল রূপেই জব্দ করিয়া দেওয়া কৰ্ত্তব্য।” আমি কহিলাম “কিরূপ উপায়ে তাঁহাকে ভালরূপ শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে তাহার একটি উপায় আমাকে বলিয়া দেও, দেখি সেই উপায় অবলম্বন করিয়া আমি উহাকে জব্দ করিতে পারি কি না?”

আমার কথার উত্তরে সে কহিল “আচ্ছা আমি দুই এক দিবস ভাবিয়া দেখি কোনরূপ উপায় বাহির করিতে পারি কি না?” 

ইহার পর দুই তিন দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এক দিবস সন্ধ্যার পর সে আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল, আমি বাড়িতেই ছিলাম, সে আসিলে আমি খাতির করিয়া তাহাকে বসাইলাম। সেই স্থানে উপবেশন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরে আমাকে কহিল “আমি একটি উপায় স্থির করিয়াছি, যদি আপনারা আমার উদ্ভাবিত উপায় অবলম্বন করিতে পারেন তাহা হইলে চিরদিবসের নিমিত্ত জমীদারের হইতে কেবল যে আপনি বা আপনার পুত্রগণ নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারিবেন তাহা নহে, প্রজামাত্রেই তাঁহার হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারিবে কিন্তু ইহাতে গ্রামের এক ব্যক্তিকে কিছুদিবসের নিমিত্ত স্বার্থত্যাগ করিতে হইবে। 

উত্তরে আমি কহিলাম ‘তুমি কি উপায় স্থির করিয়াছ তাহা না শুনিলে আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, ও কিরূপ স্বার্থত্যাগ করিতে হইবে তাহাও জানিতে পারিতেছি না, সমস্ত কথা শুনিলে তখন বুঝিতে পারিব, তোমার পরামর্শমত কার্য্য আমাদিগ দ্বারা হইতে পারিবে কি না? 

এই সময় কৰ্ম্মচারী পীরমহম্মদের কথায় বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “ওই ব্যক্তির নাম কি? ও সে থাকে কোথায়?”

পীর। উহার নাম মনছুর আলি, উহার বাসস্থান আমাদিগের পাড়ায়, এখন সে বাড়ীতে আছে কি না তাহা আমি বলিতে পারি না। 

কৰ্ম্ম। তাহার পর কি হইল? 

পীর। মনছুর আলি কি উপায় স্থির করিয়াছে তাহা আমাকে বলিতে কহিলাম। সেই সময় সেই স্থানে অপর আর কেহই উপস্থিত ছিল না, সে একবার এদিক ওদিক দেখিয়া মনে মনে যে উপায় স্থির করিয়াছিল তাহা আমাকে চুপে চুপে কহিল। তাহার কথা শুনিয়া আমার মনে ভয় হইল, আমি তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে না পারিয়া কহিলাম “তোমার এ কথার উত্তরে আমি বলিতে পারি না যে এরূপ কার্য্য আমাদিগ দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারিবে। আমি খানমহম্মদকে ডাকিয়া আনিতেছি তাহাকে তুমি সমস্ত অবস্থা বল, খানমহম্মদ যদি তোমার প্রস্তাবে সম্মত হয় তাহা হইলে ও কাৰ্য্য হইতে পারিবে, নতুবা কেবল আমা দ্বারা এ কার্য্য কোনরূপেই সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই।” এই বলিয়া আমি খানমহম্মদকে ডাকিয়া আনিলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ 

খানমহম্মদ সেই স্থানে আগমন করিলে আমি তাহাকে কহিলাম “মনছুর আলি জমীদারকে জব্দ করিবার নিমিত্ত যে উপায় স্থির করিয়াছে তাহা ভাল করিয়া শুন, ও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ ওই কার্য্য আমাদিগ দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে কি না?” 

খান। আপনি কি উপায় স্থির করিয়াছেন? 

মন। আমি এই স্থির করিয়াছি এক ব্যক্তি যদি দুই চারি মাসের জন্য কোনরূপ লুকাইয়া থাকিতে পারে তাহা হইলে জমীদারকে উত্তমরূপে জব্দ করিতে পারা যায়। 

খান। কিরূপে জব্দ করিতে পারা যায়? 

মন। যে ব্যক্তি লুকাইয়া থাকিবে সেইরূপ বয়সের একটি মৃতদেহ কবর স্থান হইতে উঠাইয়া তাহার উপর কতকগুলি অস্ত্রাঘাত করিয়া, জমীদারের বাগানে উহা পুঁতিয়া রাখিতে হইবে। যে লুকাইয়া থাকিবে তাহার কোন আত্মীয় থানায় গিয়া এই মৰ্ম্মে এজাহার দিবে যে, জমীদারের লোক বাকী খাজনার নিমিত্তে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে ও সেই পর্যন্ত সে আর প্রত্যাগমন করে নাই, খুব সম্ভাবনা জমীদার তাহাকে হয় কয়েদ করিয়া রাখিয়াছে, না হয় তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে। থানায় এইরূপ সংবাদ দিলে পুলিস-কর্ম্মচারী ইহার অনুসন্ধানে আগমন করিবেন ও ক্রমে কোনরূপে ওই মৃতদেহ-প্রোথিত স্থানের সংবাদ কর্ম্মচারীর কর্ণ গোচর করিতে পারিলেই, ওই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িবে। সেই মৃতদেহ তখন সেই লুক্কায়িত ব্যক্তির মৃতদেহ বলিয়া সনাক্ত করিলে ও জমীদার ও তাঁহার কর্ম্মচারিগণের উপর একটু সাক্ষ্য গোছাইয়া দিলেই, উহারা ফাঁসি কাষ্টে ঝুলিবে। তাহার পর সেই লুক্কায়িত ব্যক্তিকে যদি পাওয়া যায় তাহা হইলে না হয় কিছুদিবসের নিমিত্ত তাহার জেল হইবে কিন্তু জমীদার ত আর কবর হইতে উঠিয়া আসিতে পারিবে না। 

মনছুর আলির কথা শুনিয়া খানমহম্মদ কহিল “ তোমার প্রস্তাব খুব ভাল। কিন্তু ভালরূপ সাক্ষী সাবুদের বন্দোবস্ত না করিয়া এরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিত নহে।” এই বলিয়া খানমহম্মদ তাহার কয়েকজন আত্মীয়কে সেই স্থানে ডাকিয়া আনিল। মনছুর আলি যে উপায় স্থির করিয়াছিল, তাহা সে সকলকে বলিল উহাদিগের সকলেরই জমীদারের উপর আক্রোশ ছিল, সকলেই মনছুর আলির প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ওই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল। কবর স্থান হইতে মৃতদেহ উঠাইবার ভার উহারা গ্রহণ করিল, জমীদারের বাগানের ভিতর রাত্রিকালে ওই মৃতদেহ পুঁতিয়া রাখিতেও তাহারা সম্মত হইল কিন্তু উহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তি গোপনে থাকিতে স্বীকার করিল না, তখন কাজেই সে ভার আমার উপর পড়িল। আমার বয়স হইয়াছে মৃত্যুর সময় নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিয়াছে, সুতরাং আমি ভাবিলাম মরিবার পূর্ব্বে একজন সাধারণের শত্রুকে নিপাত করিয়া যাওয়া কৰ্ত্তব্য, এই ভাবিয়া সে ভার আমি গ্রহণ করিলাম। 

জমীদারের লোকে আমাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, জমীদারের বাড়ীর ভিতর আমাকে মারপিট করিয়াছে, জমীদার নিজে উপস্থিত থাকিয়া তাঁহার লোকজন দ্বারা আমার মৃতদেহ তাঁহার বাগানের ভিতর পুঁতিয়াছেন, প্রভৃতি বিষয়ের কে কোন্ সাক্ষ্য দিতে হইবে তাহার সমস্তই স্থির হইয়া গেল। আরও স্থির হইল, যে দিবস একটি বৃদ্ধ লোকের মৃতদেহ পাওয়া যাইবে, সেইদিবস হইতেই আমি গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কোন দূর দেশে গমন করিব ও সেই স্থানে ফকির বেশে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবন ধারণ করিব। এইরূপে দুই চারি বৎসর অতিবাহিত করিবার পর যদি আমি বাঁচিয়া থাকি ও যদি ইচ্ছা হয় তখন দেশে প্রত্যাগমন করিব। 

এইরূপ পরামর্শ স্থির হইবার পর হইতেই কবর স্থানের উপর বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখা হইল যে পর্য্যন্ত একটি বৃদ্ধের মৃতদেহ কবর স্থানে না আসিল, সেই পর্যন্ত আমাদিগের মন্ত্রণা কার্য্যে পরিণত হইল না। 

এইরূপে কয়েক দিবস অতিবাহিত হইবার পর এক দিবস সংবাদ পাওয়া গেল যে প্রায় আমারই ন্যায় একটি বৃদ্ধের মৃতদেহ কবর স্থানে আনীত হইয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া যাহারা এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল তাহারা সকলেই প্রস্তুত হইল। যাহারা ওই মৃতদেহ কবর স্থানে আনিয়াছিল তাহারা তাহাদিগের ধর্মের নিয়ম অনুসারে ওই মৃতদেহ সেই কবর স্থানে প্রোথিত করিয়া প্রস্থান করিল। 

রাত্রি দশটার পর ষড়যন্ত্রকারিগণের কেহ কেহ অন্ধকারের সাহায্যে সেই কবর স্থানে প্রবেশ করিয়া ওই মৃতদেহ উঠাইয়া, তাহার উপর এরূপ ভাবে অস্ত্রাঘাত করিল যে যাহাতে ওই মৃতদেহ কাহার, তাহা কেহ চিনিতে না পারে। কেহ কেহ জমীদারের বাগানের ভিতরে সেই অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ওই মৃতহে পুঁতিয়া রাখিবার উপযোগী এক স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে লাগিল। তাহার পর ওই স্থানে ওই মৃতদেহ প্রোথিত হইল। 

এইরূপে সমস্ত কার্য্য সমাপ্ত হইয়া গেলে সেই রাত্রিতেই আমি গ্রাম পরিত্যাগ করিলাম। ভাবিয়াছিলাম আমি আর এই গ্রামে দুই চারি বৎসরের মধ্যে প্রত্যাগমন করিব না কিন্তু যাহা ভাবিয়াছিলাম ঘটনা চক্রে তাহা ঘটিল না। আমাকে পুনরায় এই স্থানে আসিয়া শত্রু-মিত্ৰ সৰ্ব্বসমক্ষে উপস্থিত হইতে হইল। 

এই বলিয়া পীরমহম্মদ চুপ করিল। কর্ম্মচারীও সমস্ত অবস্থা অবগত হইলেন। এই ষড়যন্ত্রে যে সমস্ত ব্যক্তি লিপ্ত ছিল তাহারা সকলেই ধৃত হইল ও বিচারে সকলকেই কিছুদিবসের জন্য কারারুদ্ধ হইতে হইল। 

আবুল ফজল ও তাঁহার যে দুইজন কর্ম্মচারী বিনা দোষে জেলে গিয়াছিলেন তাহাদিগকে জেল হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। 

ওহায়েদ বক্স ও সেরুমিঞাও অব্যাহতি পাইল। 

ইহার পর প্রজাদিগকে লইয়া আবুল ফজলকে আর কোনরূপ কষ্ট ভোগ করিতে হয় নাই। 

সমাপ্ত 

[ আশ্বিন, ১৩১৮ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *