সম্রাট শাহজহানের দৈনন্দিন জীবন

সম্রাট শাহজহানের দৈনন্দিন জীবন

সমসাময়িক ইতিহাস হইতে মুঘল বাদশাহ্গণের দৈনন্দিন জীবনযাপন সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। আগ্রার প্রিয় প্রাসাদে শাহান কিরূপে দিন কাটাইতেন তাহা নিম্নে লিপিবদ্ধ করিতেছি।

সম্রাটের দৈনন্দিন সময়-বিভাগ ও কার্য্য সকাল

৪টা-শয্যাত্যাগ, নামাজ, পাঠ।

সকাল ৬-৪৫ মি:-দর্শনদান, হাতীর লড়াই দেখা, অশ্বারোহী সৈন্যের কুচ।

সকাল ৭-৪০ মি:- দেওয়ান-ই-আমে প্রকাশ্য দরবার।

সকাল ৯-৪০ মি:- দেওয়ান-ই-খাসে বাছা বাছা লোকের দরবার।

সকাল ১১-৪০ মি:-শাহবুরুজে গোপন পরামর্শ।

১২টা-হারেমে গমন, মধ্যাহ্নভোজন, দিবানিদ্রা, স্ত্রীলোকদের বখসিস দান।

বিকাল ৪টা-সাধারণকে দর্শন দান, বিকালের নামাজ।

বিকাল ৬-৩০ মি:- দেওয়ান-ই-আমে সান্ধ্যসম্মিলন।

রাত্রি ৭টা-শাহবুরুজে গুপ্ত বৈঠক।

রাত্রি ৮-৪০ মি:-হারেমে গমন, নৃত্যগীত। রাত্রি ১০টা-পাঠ শ্রবণ।

রাত্রি ১০-৩০ মি:-৪টা-নিদ্ৰা।

সকালের নামাজ

সূর্যোদয়ের দু’ঘণ্টা পূর্ব্বে সম্রাট শয্যাত্যাগ করিতেন। হাত-মুখ ধোয়ার পর কিছুক্ষণ উপাসনায় কাটাইতেন। তারপর তিনি মক্কার দিকে মুখ করিয়া কোর-আন্ আবৃত্তি করিয়া ভগবদ্ চিন্তায় রত হইতেন। সূর্যোদয়ের অল্পক্ষণ পূর্ব্বে প্রাসাদ সংলগ্ন মজিদে মুসলমানদের প্রথা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক দিনের প্রথম ‘ফজর’ নামাজ পড়িতেন। উপাসনার পর রাজকার্য্যে যোগ দিতেন।

দর্শন

দিবসে তাঁর প্রথম কাজ ছিল দর্শন দান। আগ্রা দুর্গের পূর্ব্বদিকের প্রাচীরে যমুনার উপর একটি জানালা বাহির হইয়াছিল। এই জানালার নাম ছিল ঝারোখা-ই-দর্শন। প্রত্যহ সকালে যমুনার তীরে বহুলোক সমবেত হইত। সূর্যোদয়ের প্রায় ৪৮ মি: পরে সম্রাট ঝারোখায় দর্শন দিতেন এবং সমবেত জনসঙ্ঘ সম্রাটকে সেলাম দিত; সম্রাটও প্রতিনমস্কার করিতেন। এইখানে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় কাটিত। এই সময়টা শুধু দর্শনদানেই অতিবাহিত হইত না। এই সময় রাজকার্য্য এবং আমোদ-আহ্লাদও হইত। লোকজন যে মাঠে সমবেত হইত তাহা দুর্গ-প্রাচীরের বাহিরে ছিল, সেইজন্য সকলেই সেখানে আসিতে পারিত। এখানে অত্যাচারিত ও দুঃখীজন সরাসরি সম্রাটের কাছে বিচার প্রার্থনা করিতে পারিত। তাহা না হইলে আইন আদালত ও পাহারাওয়ালাদের খোসামোদ না করিলে সম্রাটের কাছে দরখাস্ত পেশ করা সম্ভবপর ছিল না। এইরূপে সম্রাট স্বয়ং জনসাধারণের অভাব-অভিযোগ জানিতে পারিতেন। সময়ে সময়ে ঝারোখা হইতে নীচে দড়ি ঝুলাইয়া দেওয়া হইত; তাহাতে দরখাস্ত বাঁধিয়া দিলে সম্রাটের অনুচররা তাহা টানিয়া তুলিয়া তাঁহার হাতে দিত। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সে সময় এক সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ ছিল তাহাদের নাম ছিল দর্শনিয়া; তাহারা দিনের প্রথমে ম্রাটকে দর্শন না করিয়া কোনও কাজ আরম্ভ করা পাপ মনে করিত।

দর্শন সম্পন্ন হইলে লোকজন সরিয়া যাইত। তারপর সেই মাঠেই হাতীর লড়াই হইত। এই হাতীর লড়াই শুধু সম্রাটের অনুজ্ঞা ছাড়া অপরের এমন কি শাহজাদাদের অনুজ্ঞায়ও হইতে পারিত না। হাতীর লড়াই দর্শন শাহানের খুব প্রিয় ছিল। এই হাতীর লড়াইএর মাঠেই সম্রাটকে নবধৃত ও মত্ত যুদ্ধের হাতী দেখান হইত। নবধৃত হাতীদিগকে দুর্গাভ্যন্তরে লইয়া যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। কি করিয়া অশ্বারোহী সৈন্যকে আক্রমণ করিতে হয় এখানে হাতাঁকে তাহাও শেখান হইত এবং এইরূপে ঘোড়াদেরও ভয় ভাঙ্গান হইত। এইখানেই রাজকীয় অশ্বারোহী সৈন্য ও ওমরাহগণের অধীনস্থ পল্টনদের কুচকাওয়াজ হইত। এই স্থান লড়াই এর পক্ষে বিশেষ নিরাপদ ছিল।

দেওয়ান-ই-আম

ইহার পর দেওয়ান-ই-আমে দরবার বসিত। ঠিক এই স্থানেই আকবর ও জাহাঙ্গীর বাদশাগণও দরবার করিতেন, কিন্তু আকবর ও জাহাঙ্গীরের দরবার সামিয়ানার তলায় বসিত। ১৬২৮ খ্রিঃ শাহান এইখানে একটি কাঠের ঘর তৈরী করান। এই ঘরটি গিল্টী করা ছিল। ১৩৩৮ খ্রি: বর্তমান দেওয়ান-ই-আম নির্ম্মিত হয়। দেওয়ান-ই-আম লাল পাথরের, শাদা চুনকাম করা। ৪০টি খামের উপর ছাদ, তিন দিক খোলা। বন্ধদিকের মাঝখানের দেওয়ালের তাকে শাদা মার্বেল পাথরের আচ্ছাদিত উচ্চ সিংহাসন। তাহাতে নানারূপ ফুল ফল পাতা খোদিত আছে। এই সিংহাসনে সম্রাট বসিতেন

প্রধান দরবার

সম্রাটের সিংহাসনের বামে ও ডাহিনে শাহজাদারা বসিতেন। ইহারাও রাজ আজ্ঞা না পাইলে বসিতে পারিতেন না। দরবারে আমীর ওমরাহগণ, রাজকর্মচারীগণ উপস্থিত জনসাধারণ নিজেদের পদমর্যাদানুযায়ী একে একে দরবারগৃহের খোলা দিকে পিঠ করিয়া সম্রাটের দিকে মুখ করিয়া থাকিতেন। সম্রাটের শরীর-রক্ষীগণ ঐ উচ্চ তাকের নিকট দুইটি খামের কাছে দেওয়ালের দিকে পেছন করিয়া সম্রাটের ডাহিনে বাঁয়ে দাঁড়াইত। সম্রাটের বাঁ দিকে দেওয়ালের দিকে পিঠ করিয়া রাজকীয় পতাকাবাহীগণ সোনার পতাকা, ‘তুঘ’ ও ‘কুর’ (Standards) হস্তে দাঁড়াইয়া থাকিত!

এইরূপে ২০১ ফিট লম্বা ও ৬৮ ফিট চওড়া দরবার-গৃহ লোকে ভরিয়া যাইত; ইহাতেও সকল লোকের স্থান সংকুলান হইত না অবশিষ্ট দু’হাজারের নীচের মনসবদারগণ, তীরন্দাজ রক্ষীগণ। ওমরাহগণের রক্ষীগণ প্রভৃতির জন্য বাহিরের খোলা প্রাঙ্গণে মখমলের সামিয়ানা টাঙ্গাইয়া কাঠের রেলিং দিয়া ঘিরিয়া দেওয়া হইত। প্রধান দরবার-গৃহের খোলা তিন দিক রূপার রেলিং দিয়া ঘেরা থাকিত। এই রূপার রেলিংএর তিনদিকে তিনটি মাত্র ছোট ছোট প্রবেশপথ ছিল। দরবার-গৃহের সদর দরজায় এবং রূপার ও কাঠের রেলিংএর প্রবেশ-পথে মূল্যবান জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিহিত বিশ্বাসী আশাসোটাধারী ও অস্ত্রধারী প্রহরী থাকিত। ইহারা অপরিচিত লোককে ভিতরে ঢুকিতে দিত না।

সমবেত জনসঙ্ঘ প্রস্তুত হইয়া আশায় প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকিত। ৭-৪০ মি: সময় সম্রাট পশ্চাতের দরজা দিয়া সেই তাকে আসিয়া বসিতেন। তখন সভার কার্য্য আরম্ভ হইত।

প্রথমেই প্রধান বখ্শী, মনসবদারগণের দরখাস্ত সম্রাট-সকাশে পেশ করিতেন। সম্রাট শীঘ্র এই সব দরখাস্তের হুকুম দিতেন। তারপর যে সকল রাজকর্মচারী দূর হইতে আসিতেন তাঁহারা ম্রাটের সহিত দেখা করিতেন। পরে নূতন নিযুক্ত কর্ম্মচারীগণ স্ব স্ব বিভাগের প্রধানগণের দ্বারা সম্রাটের সম্মুখে উপনীত হইতেন। উপস্থিত ব্যক্তিদিগকে কিছু বখশিশ দিবার জন্য এই সকল প্রধানগণ সম্রাটকে অনুরোধ করিতেন। যাঁহারা বখশিশ পাইতেন তাঁহারা সেলাম করিয়া বিদায় লইতেন-খিলাৎ জহরৎ কিম্বা অস্ত্রশস্ত্র অথবা ঘোড়াও এই সঙ্গে দেওয়া হইত।

তারপর সম্রাটের খাস মহলের ও গার্হস্থ্য বিভাগের কর্মচারীরা আসিত। মীর-ই-সামান ও দেওয়ান্-ই-বেয়ুতাৎ এই খাস বিভাগের সম্বন্ধে হুকুম লইয়া কর্মচারীদের জানাইতেন।

তারপর সম্রাটের অতি বিশ্বস্ত কর্মচারীরা, শাহজাদা, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, ফৌজদার, দেওয়ান, বখ্শী প্রভৃতি প্রেরিত পত্র কিম্বা পেশকেশ সম্রাট সকাশে নিবেদন করিতেন।

শাহ্তাদাগণের ও প্রধান প্রধান কর্মচারীগণের চিঠি-পত্রাদি সম্রাট স্বয়ং পড়িতেন কিংবা সম্রাটের সম্মুখে পড়া হইত। অন্যান্য পত্রাদির চুম্বক সম্রাটকে জানান হইত। এ কাজ হইয়া গেলে প্রধান ‘সদর’ প্রাদেশিক ‘সদর’দের চিঠির প্রয়োজনীর অংশে সম্রাটে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেন। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তিদের, শেখ সৈয়দ, ফকিরগণের সাহায্য ভিক্ষা পেশ করিয়া হুকুম লইতেন। দানধ্যানের কাৰ্য্য শেষ হইলে ইতি পূর্ব্বে মনসবদারদের ও জায়গীরদারগণদের সম্বন্ধে যেসব হুকুম দেওয়া হইয়াছিল তাহা পুনরায় সম্রাটের নিকট দৃঢ়ীকরণ মানসে দ্বিতীয়বার উপস্থিত করা হইত। এই কার্য্যের জন্য একজন বিশেষ কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহার পদের নাম ছিল আরজু-ই-মরোর দারোঘা।

ইহার পর ঘোড়া ও হাতীর আস্তাবলের হিসাব ঐ ঐ বিভাগের কর্মচারীরা দাখিল করিতেন। ঐ প্রথা সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত হয়। দানাপানি চুরি করিলে তাহাকে শাস্তি দেওয়া হইত। কোন হাতী কিংবা ঘোড়া রুগ্ন শীর্ণ দেখাইলে তাহার দানাপানির সংক্ষিপ্ত বিবরণ লওয়া হইত ও ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে তিরস্কার ও জরিমানা করা হইত। ইহার পর সম্রাটের সম্মুখে আমীরগণের অধীনস্থ নূতন সৈন্যগণকে যোদ্ধাবেশে কুচ্ করিতে হইত সাধারণত দরবারে ঘণ্টা দুই সময় কাটিত। তবে কাজকর্ম্মের কম বেশী অনুসারে সময়ের কম বেশীও হইত।

দেওয়ান-ই-খাস

১০টার কিছু পূর্ব্বে সম্রাট দেওয়ান-ই-খাসে যাইতেন। (সকলে বলিত সম্রাট গোসলখানায় গিয়াছেন, কারণ আকবরের গোসলখানা দেওয়ান-ই-খাসের অতি নিকটেই ছিল।) এইখানে সম্রাট নিজহাতে বিশেষ দরকারী চিঠিপত্রাদি লিখিতে- ন। উজীর অথবা ভারপ্রাপ্ত উচ্চ কর্মচারীরাও কিছু কিছু চিঠি পত্রাদি পড়িয়া সম্রাটকে শুনাইত। তাহার উত্তরে সম্রাটের মৌখিক হুকুম অনুযায়ী তাহারা ফর্মান লিখিত। এই সকল ফরমান সম্রাট নিজে দেখিয়া পরিবর্তন ও কাটাকাটি করিতে- ন। এই কাটাকুটী ফর্মান পরিষ্কার করিয়া লেখা হইলে হারেমে প্রেরিত হইত। সেখানে ফর্মানে সম্রাটের শীলমোহর দেওয়া হইত। এই শীলমোহর সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের জিম্মায় থাকিত। এই শীলটি ছিল ছোট্ট গোলাকার–শুধু সম্রাটের নাম তাহাতে অঙ্কিত ছিল।

এইবার প্রধানগণ খাসমহল, সৈনিক কর্ম্মচারীদিগকে প্রদত্ত জায়গীর প্রভৃতি সম্বন্ধে হুকুম লইতেন। সরকারী দান বিভাগের কর্তা এবার দুঃস্থদের আবেদন পেশ করিতেন। প্রায়ই নগদ টাকা দান করা হইত। কেহ কেহ জমি ও দৈনিক সাহায্যও পাইত। সম্রাটের জন্মদিনে প্রতি বৎসর সম্রাট ‘ওজন’ হইতেন। এই ‘তুলার’ দরুণ সোনারূপা জহরৎ এবং আমীর-ওমরাহগণ সম্রাটের মঙ্গল প্রার্থনায় যে তাসাদ্দক্ (দান) দিত তদ্বারা একটি দান তহবিল সৃষ্টি করা হইয়াছিল।

ইহার পর নিপুণ শিল্পী প্রভৃতিদের কাজ পর্যবেক্ষণ করা হইত। প্রস্তাবিত রাজপ্রাসাদের নকশা দেখিয়া প্রয়োজন বোধ করিলে সম্রাট কোথাও কোথাও পরিবর্তন ও কোথাও বা সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির আদেশ দিতেন। যে নকশা মঞ্জুর হইত তাহাতে প্রধান মন্ত্রী আসফ খাঁ শিল্পীদের জন্য সম্রাটের আদেশ বিশদভাবে লিখিয়া দিতেন কোথায় কি করিতে হইবে। সম্রাট শাজাহানের ইহা এক প্রধান কাজ ছিল। পূর্ত বিভাগের কর্তা তাঁহার দলবলসহ স্বয়ং খাস দরবারে উপস্থিত থাকিয়া সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করিতেন।

এইসব কাজ শেষ হইলে সম্রাট মাঝে মাঝে তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য যে সকল পশুপক্ষীকে শিকার শিক্ষা দেওয়া হইত তাহা পরিদর্শন করিতেন। এবং খাসমহলের প্রাঙ্গণে সম্রাটের সম্মুখে নূতন তেজস্বী ঘোড়াদের বিচক্ষণ সওয়াররা শিক্ষা দিত।

শাহ্-বুরুজ

দেওয়ান-ই-খাসের কাজ শেষ হইতে প্রায় দু’ঘণ্টা লাগিত। ইহার পর সম্রাট শাহ্-বুরুজে আসিতেন। অতি গোপনীয় পরামর্শ ও কাজ এইখানে সম্পন্ন হইত। শাহ্তাদাগণ ও একজন বিশ্বাসী কর্মচারী ছাড়া অপর কেহ বিনা অনুমতিতে এখানে প্রবেশ করিতে পাইত না। এমন কি খানসামাগণকে পর্য্যন্ত ঘরের বাহিরে অপেক্ষা করিতে হইত, না ডাকিলে তাহারাও ঘরে ঢুকিতে পাইত না।

এখানে প্রধান উজীরের সঙ্গে এমন সব রাজকীয় গুপ্ত কথার পরামর্শ হইত যাহা বাহিরের লোক জানিতে পারিলে ক্ষতির কারণ হইবে। যে সকল গোপনীয় চিঠিপত্রাদি লিখিত হইবে তাহার একটি চুম্বক এখানে তৈরী হইত। আম ও খাস দরবারে খাসমহাল, সৈন্য-সংক্রান্ত ব্যয় প্রভৃতির যে সকল বিষয় সম্রাট-সকাশে জানান হইয়াছিল তাহার মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনীয়গুলি উজীর তখন সম্রাটকে আবার নিবেদন করিয়া হুকুম লইতেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা এই কাজে ব্যয় হইত। কাজের কম বেশীর উপর সময়ের কম বেশী নির্ভর করিত।

দ্বিপ্রহরে হারেমে

এইরূপে দুপুর হইয়া যাইত। সম্রাট তখন হারেমে প্রবেশ করিতেন। ‘জুহর্’ নামাজ শেষ করিয়া, খাওয়া-দাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক তিনি দিবানিদ্ৰা উপভোগ করিতেন। মুঘল সম্রাটদের অনেকেরই পক্ষে হারেম ছিল বিশ্রাম ও প্রমোদালয়, কিন্তু সম্রাট শাহজাহান সেখানেও কাজ করিতেন। হারেমে বহু ভিক্ষুক সমবেত হইত। বিধবা, পিতৃমাতৃহীনা, বর্তমানে হীনাবস্থা বড় ঘরের মেয়েরা, পণ্ডিত, ফকীর ও ধার্মিক ব্যক্তিদের কন্যারা সম্রাটের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া আসিত। সম্রাজ্ঞীর কাছে নারী নাজীর সিত্তী উন্নিসা এদের দরখাস্ত পেশ করিতেন। সম্রাজ্ঞী আবার তাহা সম্রাটের কাছে জানাইতেন। সম্রাট কাহাকেও জমি, কাহাকেও পেন্‌সেন, কাহাকেও একেবারে কিছু দান, কাহাকেও পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়নাগাঁটি বা কাহাকেও বিবাহের জন্য যৌতুকাদি দান করিতেন। প্রত্যহ এই কাজের জন্য বহু অর্থ ব্যয়িত হইত।

বৈকালিক দর্শন

৩টার পর সম্রাট ‘আসর’ নামাজ শেষ করিয়া মাঝে মাঝে আমদরবারে উপস্থিত হইতেন। উপস্থিত লোকজন সম্রাটকে প্রণাম জানাইত। এখানে খুব সামান্য কাজই হইত। প্রাসাদরক্ষী চৌকীদারগণকে সম্রাটের সম্মুখে সারিবন্দীভাবে দাঁড় করান হইত ও তাহারা অস্ত্র ধরিয়া সম্রাটকে সেলাম করিত। তারপর সম্রাট দরবারস্থ লোকদের সঙ্গে করিয়া দেওয়ান-ই-খাসে সান্ধ্য উপাসনায় যোগ দিতেন।

দেওয়ান-ই-খাসে সান্ধ্যসম্মিলন

দেওয়ান-ই-খাস সুগন্ধি মোমবাতি দ্বারা আলোকিত হইত। দীপাধারগুলি মণিমুক্তাখচিত ছিল। সম্রাট ও তাঁহার নির্বাচিত বিশেষ প্রিয়পাত্ররা এখানে সমবেত হইতেন। রাজকার্য্য সমাপনান্তে তাঁহারা আমোদপ্রমোদে মত্ত হইতেন। এই আমোদপ্রমোদ উচ্চশ্রেণীর ছিল। সম্রাট কণ্ঠ ও যন্ত্র-সঙ্গীত শুনিতেন এবং সময়ে সময়ে নিজেও তাহাতে যোগ দিতেন। সম্রাট শাহজাহান উর্দু সঙ্গীতে এক পারদর্শী ছিলেন যে, এইখানে অনেক ধার্ম্মিক সূফীর মন তাঁহার সঙ্গীত শুনিয়া পৃথিবী হইতে স্বর্গ রাজ্যে ভ্রমণ করিতে এবং ভাবাবেশে অনেকে সমাধিস্থ হইয়া পড়িতেন।

গুপ্ত বৈঠক

‘ইষা’ নামাজের পর সম্রাট পুনরায় শাহবুরুজে গমন করিতেন। সরকারী যে সকল গোপনীয় কাজ তখনও বাকী থাকিত তাহা প্রধান উজীর ও বখ্শীদের ডাকিয়া সম্পন্ন করিতেন। পরের দিনের জন্য কোন কাজই ফেলিয়া রাখিতেন না।

হারেমে নৃত্যগীত ও পাঠ

রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় সম্রাট হারেমে প্রবেশ করিতেন। এখানে নারী-কণ্ঠের সঙ্গীত শ্রবণ করিয়া দু’তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হইত। ইহার পর তিনি শয়ন করিতেন। সম্রাটের শয়ন-কক্ষ হইতে পর্দা দ্বারা পৃথক করা আর একটি ঘর ছিল। এই ঘরে সুকণ্ঠ পাঠক বসিত। সম্রাট শয়ন করিলে পাঠক ভাল ভাল উপদেশপূর্ণ বই পাঠ করিতেন; তাহা শুনিতে শুনিতে সম্রাট ঘুমাইয়া পড়িতেন। এ পাঠ্য পুস্তকে ভ্রমণকাহিনী ধার্মিকদের জীবনী, পূর্ব্বতন সম্রাটদের জীবনী প্রভৃতি ছিল। তৈমুরলঙ্গের জীবনী ও বাবরের আত্ম-জীবনী ছিল বিশেষ প্রিয় পাঠ্য। ১০টায় সম্রাট ঘুমাইয়া পড়িতেন। প্রায় ছ’ঘণ্টা তিনি ঘুমাইতেন।

বুধবারে বিচার

ইহাই ছিল প্রাত্যহিক কার্য্য। শুক্রবার জুম্মাবার বলিয়া ছুটি থাকিত। বুধবার দিন বিশেষভাবে বিচারের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। দেওয়ান-ই-আমে কোন দরবার বসিত না। সম্রাট দর্শন দরওয়াজা হইতে প্রায় ৮টার সময় একেবারে দেওয়ান-ই-খাসে উপস্থিত হইতেন ও বিচারের সিংহাসনে বসিতেন। ধাৰ্ম্মিক, বুদ্ধিমান ও বহুদর্শী লোকদের কাজী ও আদিলের পদ দেওয়া হইলেও সম্রাট স্বয়ং ছিলেন ন্যায় বিচারের উৎস এবং শেষ আপীলের কর্তা। বুধবার দিন আসন-সম্পর্কিত কর্মচারীরা, ফতওয়ার জ্ঞানী ব্যক্তি, ধর্মপরায়ণ সূক্ষ্মদর্শী পণ্ডিতরা ও যেসকল ওমরাহরা সদাসর্ব্বদা সম্রাটের পার্শ্বচররূপে থাকিতেন, তাঁহারা ব্যতীত অপর কাহারও দরবারে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। আইন- কর্ম্মচারীরা একে একে ফরিয়াদীদিগকে সম্রাটের সম্মুখে উপস্থিত করিতেন ও তাহাদের নালিশ নিবেদন করিতেন। সম্রাট অতি ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিয়া সত্য নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক উলেমাদের নিকট এই সম্বন্ধে শাস্ত্রে কি বিধান আছে জানিয়া লইয়া রায় দিতেন। বহু দূর দূর দেশ হইতেও লোক দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নিকট হইতে ন্যায়-বিচার-লাভার্থ সমবেত হইত। ইহাদের নালিশ সম্বন্ধে বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিবার জন্য তত্রত্য প্রাদেশিক শাসনকৰ্ত্তাকে সম্রাট আদেশ করিতেন ও সম্ভব হইলে সেইখানেই ন্যায়বিচার করিতে বলিতেন নচেৎ তাহাদিগকে পুনরায় সম্রাট সকাশে পাঠাইতে লিখিতেন।

দিল্লী ও আগ্রার প্রাত্যহিক জীবন এইরূপই ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে ইহার ব্যতিক্রমও ঘটিত। বৈকালে সময় সময় যমুনার বাদশাহী নৌকার বাচখেলা হইত; কখনও বা বাদশাহ শিকারে যাইতেন; কখনও বা বিভিন্ন প্রদেশে সমস্ত দরবারীদের সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইতেন। মুঘল বাদশাহরা অনলস কৰ্ম্মী ছিলেন। তখন রাজাসন পুষ্পাকীর্ণ ছিল না। রাজার অনেক কর্তব্য-কৰ্ম্ম ছিল এবং সেই সকল কর্ম্মে বাদশাহরা উদাসীন ছিলেন না। সম্রাট শাহজাহান বিপুল পরিশ্রম করিতেন। তাঁর সময়ে দেশের লোক সুখ শান্তিতে ছিল। লণ্ডনের, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর পুরাতন হস্তলিখিত একখানা ফার্সী পুথিঁতে সম্রাট শাহজাহানের দৈনিক কার্য্যাবলীর ফর্দ্দ দিয়া নিম্নলিখিত শ্লোকটি লেখক সম্রাটকে উদ্দেশ্য করিয়া লিখিয়াছেন:-

খাল্‌ক্ শবুক্ দিল জে গীরাণ বারিয়শ
ফিতনা গীরাণ খাব জে বিদারীয়শ।

অর্থাৎ, হে সম্রাট তোমার প্রকৃতিপুঞ্জ ফুর্তিতে আছে কারণ তুমি তাদের ভারি বোঝা নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছ; তোমার সাম্রাজ্যে অত্যাচার বিচার ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, যেহেতু তুমি নিজের চক্ষু হইতে ঘুমকে নিৰ্ব্বাসিত করিয়াছ।

[প্রভাতী, পৌষ ১৩৩০। ভারতীয়, ৪৭শ বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, ফাল্গুন, ১৩৩০ এ পূনঃমুদ্রিত।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *