সম্মোহিত মুসলমান
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
হজরত মোহাম্মদ যে একজন মহাপুরুষ, অর্থাৎ সত্য তিনি শুধু কথায় প্রচার করেননি তা তাঁর সমগ্র জীবনের ভিতরে এক আশ্চর্য-দৃঢ়রূপ লাভ করেছিল, সে সম্বন্ধে তর্ক বিচার করবার কাল বোধ হয় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখনো যারা তার মাহাত্মের পানে সন্ধিগ্ধ চিত্তে তাকান, কেননা, তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, অথবা শেষ বয়সে বহু বিবাহ করেছিলেন, বলা যেতে পারে, কিছু সরল প্রকৃতি নিয়ে তাঁরা জীবনের জটিলতাবর্তে ঘুরপাক খেয়ে মরছেন। হয়তো তাদের সংস্কার আছে, মহাপুরুষের যে জীবন, শিশুর মতো সারল্যই তাতে প্রতিভাত হওয়া স্বাভাবিক ও শোভন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যাবে, তাদের এ সংস্কার শুধু এক মধুর খেয়াল–সত্যে, এর প্রতিষ্ঠা নয়। মহাপুরুষের জীবনে কেমন এক ঋজুতা আমরা প্রত্যক্ষ করি সত্য, আসলে কিন্তু সেটি ঋজুতার ভঙ্গিমা মাত্র। বহুভঙ্গিমতা বা মানব-মনের জটিলতা মহাপুরুষের জীবনে নিরাকৃত হয়ে যায় না; সে সমস্ত শুধু এক পরমাশ্চর্য অধিকারে একমুখিত্ত লাভ করে।
কিন্তু মহাপুরুষ মোহাম্মদের অভক্ত যে তাঁর জীবনের এই জটিলতায় বিড়ম্বিত হয়েছেন সে আর কতটুকু দুঃখের বিষয়। তার চাইতে অনেক বেশী শোচনীয় ব্যাপার তাঁর অনুবর্তী ভক্তদের ভিতরেই ঘটেছে, তাঁরাও তাঁর এই বিচিত্র অথচ ভগবনুখী জীবনে বিড়ম্বিত হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মহাসাধনাকে বিড়ম্বিত করেছেন। তাঁরা তার পানে যে দৃষ্টিতে চেয়েছেন ও যে দৃষ্টিতে চাইবার জন্য অপরকে আহ্বান করেছেন, তাতে এই সহজ অথচ অতি বড় সত্য আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে, জগতের অনন্তকোটি মানুষের মতো হজরত মোহাম্মদও একজন মানুষ; মানুষের ইতিহাসের এক বিশেষ স্তরে শক্তিমাহাত্মে তিনি সুপ্রকট, কিন্তু তার শক্তিমাহাত্ম্য লাভই সে-ইতিহাসের চরম কথা নয়, তার চাইতে গভীরতর কথা এই, –জগৎসংসারের যিনি চির জাগ্রত নিয়ামক অনন্ত কাল ধরে তিনি এমনিভাবে শক্তিমান আর সাধারণ এই দুই শ্রেণীর চক্রের সমবায়ে সংসার রথকে চিরচলন্ত রেখেছেন। বাস্তবিক, মহাপুরুষ যে সর্বজ্ঞ নন, মানুষের সর্বময় প্রভু নন, মানুষের জীবন সম্রামে তিনি একজন বড় বন্ধু মাত্র অবশ্য যেমন বন্ধু সমুদ্রচারী পোতের জন্য আলোকস্তম্ভ; তাঁর কথাও চিন্তার ধারা চিরকালের জন্য মানুষের পথকে নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছে একথা বিশ্বাস করলে মানুষরূপে তার সাধনাকে যে চরম অপমানে অপমানিত করা হয়, কেননা, সমস্ত সাধনার যা লক্ষ্য সেই আল্লাহর উপলব্ধি মানুষের দৃষ্টিপথ থেকে রুদ্ধ হয়ে যায় যে আল্লাহ চিরজাগ্রত, চিরবিচিত্র, বিশ্বজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেশে দেশে যুগে যুগে মানরে অন্তহীন শুভ চেষ্টায় যাঁর মহিমা প্রকটিত; হজরত মোহাম্মদের অনুবর্তীর। সেই প্রাণপ্রদ সদস্মর্তব্য কথা অদ্ভুতভাবেই মন থেকে দূর করে দিয়েছেন; হয়ত তারই ফলে অন্যান্য ছোটখাট প্রতিমার সামনে নতজানু হওয়ার দায় থেকে কিছু নিষ্কৃতি পেলেও “প্রেরিতত্ব” রূপ এক প্রকাণ্ড প্রতিমার সামনে নতদৃষ্টি হয়ে তারা যে জীবন পাত করছেন আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা সাংসারিকতা সবদিক থেকেই তা শোচনীয়রূপে দুঃস্থ ও বিভ্রান্ত।
অথচ হজরত মোহাম্মদ সাধনার এই বিড়ম্বনা ভোগ কত বিস্ময়কর ব্যাপার। মানুষের সাষ্টাঙ্গ প্রণামকে পর্যন্ত এই মহাপুরুষ গ্রহণ করেননি। আর তাঁর আবিষ্কৃত যে বজ্রসার তৌহীদ (একশ্বরতত্ত্ব), তাঁর অবলম্বিত যে আশ্চর্য অনাড়ম্বর সাংসারিক জীবন, আগ্নেয় সাম্যবাদ, আল্লাহর পানে সে-সমস্তের যে প্রচণ্ড আকর্ষণ, কিসের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে। কিন্তু তার মাহাত্ম যত বড়ই হোক, একথা অস্বীকার করবার কিছুমাত্র উপায় নেই যে, সেই আল্লাহর উপলব্ধি, অন্য কথায়, সমস্ত জগতের সঙ্গে প্রেম ও কল্যাণের যোগের উপলব্ধি, আজ তার অনুবর্তীদের দৃষ্টির সামনে নেই। জীবনের অর্থই যেন আধুনিক মুসলমান বোঝে না। বুদ্ধি, বিচার, আত্মা, আনন্দ, এ সমস্তের গভীরতার যে আস্বাদ তা থেকে তাকে বঞ্চিত ভিন্ন আর কিছু বলা যায় না। জগতের পানে সে তাকায় শুধু সন্দিগ্ধ আর অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে এর কোলে যেন সে সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, একে যেন সে চেনে না। কেমন এক অস্বস্তিকর অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সারা জীবন সে ভীত ত্রস্ত হয়ে চলেছে।
মুসলমানের, বিশেষ করে আধুনিক মুসলমানের, এই অবস্থা লক্ষ্য করেই বলতে চাই– সে সম্মোহিত। সে শুধু পৌত্তলিক নয়’ সে এখন যে অবস্থায় উপনীত তাকে পৌত্তলিকতার চরম দশা বলা যেতে পারে; তার মানবসুলভ সমস্ত বিচার বুদ্ধি, সমস্ত মানস উৎকর্ষ, আশ্চর্যভাবে স্তম্ভিত! বর্তমান তার জন্য কুয়াসাচ্ছন্ন দিগদেশবিহীন, অতীত ভবিষ্যৎ তার নেই। সময় সময় দেখা যায় বটে সে তার অতীতকালের বীরদের, রাজাদের, ত্যাগীদের মনীষীদের কথা বলছে। কিন্তু এ শেখানো বুলি আওড়ানোর চাইতে এক তিলও বেশী-কিছু নয়। জীবনকে সত্যভাবে উপলব্ধি করবার দুর্নিবার প্রয়াসের মুখেই যে উচ্ছিত হয় যুগে যুগে মানুষের বীরত্ব, ত্যাগ, শাস্ত্রজ্ঞান, মনীষা, তার প্রাচীন ইতিহাসে এর যোগ্য প্রমাণের অভাব নেই। হজরত ওমর ও ইবনে জুবেরের মতো বীর-কর্মীদের, সাদী-ওমরখাইয়ামের মতো মনীষীদের, গাজ্জালী-রুমির মতো সাধকদের, জীবনের অন্তস্থল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এ কথা দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবনরহস্যের সেই গহনে উঁকি দেবে, এই সম্মোহিতের কাছ থেকে তা আশা করা দুরাশা! এ সমস্তই যে তার কাছে শুধু নাম-পঠন-অযোগ্য অক্ষরের মতো কালের পটে কতকগুলো আঁচড়। তার জন্য একমাত্র সত্য শাস্ত্রবচন। অথবা তাও ঠিক না; শাস্ত্রবচনের পিছনে যে সত্য ও শ্রেয়ঃ অন্বেষী মানবচিত্তের স্পন্দনের অপূর্ব রয়েছে শাস্ত্রবচনের মাহাত্ম-উপলব্ধির সেই দ্বার তার জন্য যে রুদ্ধ। প্রকৃত সম্মোহিতের মতো তার জন্য একমাত্র সত্য প্রভুর হুকুম–স্থলবুদ্ধি শাস্ত্রব্যবসায়ী প্রভুর হুকুম। সেই প্রভুর হুকুমে কখনো কখনো ভবিষ্যতের অসংলগ্ন স্বপ্ন সে দেখে কখনো ‘প্যান ইসলাম এর স্বপ্ন, কখনো এই তের শত বৎসরের সমস্ত ইতিহাস, সমস্ত বর্তমান পরিবেষ্টন, যেন যাদুমন্ত্রে উড়িয়ে দিয়ে সেই তেরশত বৎসরের আগেকার শরীয়ত’ এর হুবহু প্রবর্তনার স্বপ্ন। কত নিদারুণ তার জীবনের পক্ষে এই প্রভুর হুকুম তার প্রমাণ এইখানে যে, এর সামনে তার সমস্ত বুদ্ধি বিচার স্নেহ প্রেম শুভেচ্ছা, সমস্ত স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব, আশ্চর্যভাবে অন্তর্হিত হয়ে যায়, সে যে চিরদাস, চিরঅসহায়, অত্যন্ত অপূর্ণাঙ্গ মানুষ, এই পরম বেদনাদায়ক সত্য ভিন্ন আর কিছুই তার ভিতরে দেখবার থাকে না।
কিন্তু এই সম্মোহন আজ যত প্রবল চেহারা নিয়েই দাঁড়াক, অনুসন্ধান করলে বুঝতে পারা যাবে, এ নূতনই নয়, পুরাতনও বটে। মনে হয়, এ সমোহনের। এক বড় কারণ হজরত মোহাম্মদের মহাজীবনই। সে জীবন তপস্যায়, প্রেমে, কর্মে বিচিত্র, ও বিরাট; নানা দুঃখ দহনের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসার ফলে প্রখর ঔল্য; তার উপর তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য মানুষের হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো চিরকালই পৌত্তলিক; কিন্তু হজরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্বের এই প্রাখর্যের জন্যই হয়ত মুসলমান ইতিহাসের অনেক শক্তিধর পুরুষও তার সম্মোহনের নাগপাশ এড়িয়ে যেতে পারেন নি। হজরত ওমর ও ইমাম গাজ্জালির কথা বলতে চাই। হজরত ওমরের ভিতরে দেখা যায়, তিনি তার প্রকাণ্ড পৌরুষকে যেন আর সব দিকে লৌহ-আবেষ্টনে বন্ধ করে শুধু হজরত মোহাম্মদের অনুবতির্তার পানে উনুখ রেখেছিলেন; সত্য আর হজরত মোহাম্মদের সাধনা এক ও অভিন্ন এই-ই যেন তার মনোভাব। তাঁর নিজের জীবন সাধনার জন্য এই একান্ত অনুবতির্তার প্রয়োজন সব চাইতে বেশী ছিল কিনা সে জিজ্ঞাসা অনাবশ্যক, কেননা, মুসলমান জগতের সামনে মাত্র একজন বিশিষ্ট সাধক তিনি নন, তার চাইতে সাধারণত তার সমাদর এইজন্য যে, সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য তিনি এক অতি বা আদর্শ। ইমাম গাজ্জালিও তেমনিভাবে দেখা যায় দর্শনচর্চার বিরুদ্ধে এই অদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করেছেন–সাপুড়ে তাঁর অল্প বয়স্ক পুত্রের সামনে সাপ খেলায় না, তার ভয় এই, সে তার বাপের অনুকরণ করতে গিয়ে বিপদ ঘটাবে; সর্বসাধারণের জন্য দর্শনচর্চাও এমনিভাবে বিপজ্জনক।[Confessions of Al Ghazzali নামক পুস্তক দ্রঃ] –সর্বসাধারণের জন্য শাস্ত্রানুগত্যেও যে বিপদ কিছুমাত্র কম নয়, তাতে তাদের সত্যানুসন্ধিৎসায় গ্লানি পৌঁছিবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশী, নিজে দার্শনিক আর সাধক হয়েও সে দিকে যে তিনি দৃষ্টি রাখেন নি তার স্বপক্ষে এই সামান্য কথা বলা যেতে পারে যে, তাঁর যুগে এ প্রতিবাদের হয়ত প্রয়োজন হয়েছিল,–বৃথাতর্কের প্রবণতা ঘুচিয়ে দিয়ে সত্যান্বেষীকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন হজরত মোহাম্মদের মহাদৃষ্টান্তের। তবু গোটা দর্শন চর্চার বিরুদ্ধে তার যে প্রতিবাদ তাকে অত্যন্ত দোষাবহ বলা ভিন্ন উপায় নেই। যুক্তি বিচার যতই অপূর্ণাঙ্গ হোক, জীবনপথে বাস্তবিকই এ যে মানুষের এক অতি বড় সহায়। এর সাহায্যের অভাব ঘটলে পূর্বানুবর্তিতা পাষাণভাবের মতনই মানুষের জীবনের উপরে চেপে বসে, দেখতে দেখতে তার সমস্ত চিন্তা ও কর্ম প্রবাহ শুষ্ক ও শীর্ণ হয়ে আসে।–কর্মে আত্মপ্রকাশ মানুষের প্রকৃতি চায়, এই-ই তার জন্য কল্যাণকর আর এই কর্মচেষ্টার জীবনে পূর্বানুবর্তিতা যে মানুষের পরম কাক্ষিত কে না তা জানে। তবু মানব-প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও বহুধা সার্থকতার কথা মন থেকে দূর করে দিয়ে কর্মের আয়োজন যেখানে মানুষ করে সেখানে সে যে মরণের আয়োজনই করে চিন্তাশীলেরা একথা আজ বিশ্বাস করেন।
ইসলামের ইতিহাস বহুল পরিমাণে এক ব্যর্থতার ইতিহাস। হজরত মোহাম্মদের সংযমের সাধনা তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই আরবের আদিম উছুলের ও পারস্যের বিলাস-মত্ততার আবর্তে পড়ে বিপর্যয় ভোগ করেছিল। সে- বিপর্যয় সামলে নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বিকাশ লাভ করবার অবসর খুব কমই তার ঘটেছে। হয়ত সেই জন্যও কিছু বাড়াবাড়ির ছবি মুসলমান-ইতিহাসের প্রায় সব পর্যায়েই আমাদের চোখে পড়ে কখনো চরম উচ্ছলতার বাড়াবাড়ি, কখনো অন্ধ অনুবর্তিতার বাড়াবাড়ি। তবু হজরত মোহাম্মদের সাধনার পথে উদার বিচার-বুদ্ধি নিয়ে সহজ ছন্দে বেড়ে উঠলে মানুষের জীবনে যে কি অলৌকিক মহিমা প্রকাশ পায়, সৌভাগ্যবশত তার দৃষ্টান্তও মুস নয়। মুসলমান সমাজ নূতন করে তাদের মাহাত্মের কাহিনী পাঠ করবে যেন তারই অপেক্ষায় বিশ্বজগতে সৌরভ ছড়িয়ে অথচ নিজেদের ঘরে কতকটা অবহেলিত হয়ে নীরব মহিমায় তারা বিরাজ করেছেন। বিশ্ববরেণ্য শেখ সাদী এই পুণ্যশ্লোক মুসলমানদের অন্যতম। তাঁর যে সমস্ত আনাড়ম্বর অথচ প্রাণও বিশ্বাস-সঞ্চারী বাণী হজরত মোহাম্মদের তৌহীদ ও বিশ্ব-কল্যাণের সাধনাই ভব বিহ্বল হয়ে নয়, অন্ধ অনুবর্তিতার পথেও নয়,–সবল মনুষ্য প্রকৃতি ও উদার বিচার-বুদ্ধির পথে। মনীষী তিনি, সত্যদ্রষ্টা তিনি, মানুষকে তিনি দেখেছেন জাতি ধর্মের, আচার-আড়ম্বের সমস্ত আবরণ ভেদ করে, সেই মুক্ত অবিচলিত দৃষ্টিতেই তিনি চেয়েছে হজরত মোহাম্মদের পানে; দেখেছেন, মানুষের বিচিত্র আশা আকাভার, বেদনা-সম্ভাবনার, কি আশ্চর্য ফুতি ও সামঞ্জস্য-সাধন সে-জীবনে ঘটেছে, সেই জন্য তা কি সুন্দর, কি উজ্জল কি বরোধী দৃঢ়তা তার অঙ্গে অঙ্গে সুখে দুঃখে, সম্পদে বিপদে তা মানুষের কত অবলম্বনযোগ্য। আর যদি জ্ঞানে ও মনুষ্যত্বে বিকশিত হয়ে জগতের কাজে লাগবার আকাক্ষা মুসলমানের অন্তরে জাগে তখন এই মহামনীষী সাদী হবেন তাদের একজন শ্রেষ্ঠ উপদেষ্টা। বুদ্ধি বিচার প্রভৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্বল বিসর্জন দিয়ে নতজানু হয়ে মহাপুরুষের পায়ে গড় হওয়া যে তারও প্রতি সত্যকার শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, তার প্রতি সত্যকার শ্রদ্ধা নিবেদন হচ্ছে, প্রকাণ্ড এই জগতের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর সাধনাকে সমস্ত প্রাণ ও মস্তিস্ক দিয়ে গ্রহণ করায়, এই সেই, অধিকারে, প্রয়োজন হলে, তাকে অতিক্রম করায়, সেই তত্ত্বের সন্ধান যাদের কাছ থেকে নব মুসলিমের লাভ হবে এই শ্রেষ্ঠ মুসলমান সাদী হবেন তাদের অন্যতম। [সাদীর একটি অতি প্রসিদ্ধ বাণী এই “তরিকত বজুজ খেদমতে খলক নিমত তসবিহ ও সাজ্জাদও দলক নি; “সৃষ্টির সে ভিন্ন ধর্ম আর কিছু নয়। তসবি জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নেই।– বোধ হয় এই বাণীটিই রাজা রামমোহন রায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছিল : নগেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কত রামমোহনের জননী ৫২৪ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য]
জগতের জন্য ইসলামের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় নি। বরং ইসলামের যে একান্ত ঈশ্বরপরায়ণতা, সাম্য ও মৈত্রীর বীর্যন্ত সাধনা, জগতের জন্য আজো সেই সমন্তেরই দারুণতম প্রয়োজন। কিন্তু এই কল্যাণময় ইসলামকে বহন করে জগতের আর্তক্লিষ্ট নরনারীর সেবায় পৌঁছে দেবে কে? নিশ্চয়ই সেটি সেই কৃপার পাত্রের দ্বারা সম্ভবপর নয় যে, “আলেম” বলে নিজের পরিচয় দেয়, কিন্তু হৃদয়ের দ্বার যার সাংঘাতিকভাবে বন্ধ: শত শত বৎসরের পুরাতন বিধিনিষেধের তুচ্ছ তালিকা থেকে চোখ উঠিয়ে আল্লাহর এই জীবন্ত সৃষ্টির অন্তহীন সুখ দুঃখ ব্যথার উত্তরাধিকার বংশসূত্রে নির্ণীত হয় না, গতানুগতিক শিষ্যত্ব-সূত্রেও নির্ণীত হয় না, হয় সাধনা-সূত্রেই। সাধক যে, নিজের রসনা দিয়ে সত্যের অমৃতস্বাদ গ্রহণ করবার আকাক্ষা যার চিত্তে জাগে, তারই চোখে কেবল পূর্ববর্তীর সাধনার দ্বার উদঘাটিত হয়, আর যে বেদনায় ও শ্রদ্ধায় সেই সাধনাকে বহন করে নব নব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করে তাকে সার্থকতা দান করতে হয়, সেই পরম সৌভাগ্য অধিকারও তার জন্মে। সেই সাধনার দ্বারা শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনের কথা বিস্মৃত হয়ে মুসলমান হজরত মোহাম্মদের বিরাট তপস্যাকে বহন করতে গিয়েছিল শুধু অন্ধ অনুবর্তিতার লাঠিতে ভর দিয়ে! সে যে পিষ্ট পর্যদস্ত হবে, তার মস্তিষ্ক অবসাদগ্রস্ত হবে, এ তার অপরিহার্য পরিণাম। সেই তপস্যাহীন, সুতরাং অর্ধবিকশিত মানুষ, মুসলমানই জগতের দুঃখ ব্যাধিতে ইসলামের সেবা পৌঁছে দিতে হাত বাড়াতে পারবে, এ মোহ যে আজো আমাদের চিন্তা ও কর্মের নেতাদের অন্তরে প্রবল, একটা গৌরবময়-অতীতের-অধিকারী সম্প্রদায়ের পক্ষে এর বড়ো লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে? আল্লাহর এ জগৎ বিরাট, অনাদ্যন্ত হর্ষে ক্ষোভে, ব্যথায় আনন্দে, এ বিচিত্র, এই বিরাট বাস্তবতার সঙ্গে যে যোগযুক্ত নয় জীবনে শ্রেয়োলাভের আসল দরজা তাঁর জন্য বন্ধ, নূতন করে এই সত্য আমাদের চিত্তে প্রেরণা সঞ্চার করুক; আমাদের দেহকোষাণু সমূহ অক্সিজেন সংস্পর্শে প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ ও পুণর্গঠিত হয়, এমনি করেই দেহ সবল ও কার্যক্ষম থাকে, আমাদের চিত্তকেও তেমনিভাবে নব নব জ্ঞান ও প্রেরণার দহনে নিরন্তর দগ্ধ ও সঞ্জীবিত করতে হয়, নইলে জড়তার আক্রমণ প্রতিরোধে অসমর্থ হয়ে তা সম্পূর্ণ অকর্মণ্য ও জীবনের পক্ষে অভিশাপের মতো হয়ে দাঁড়ায়, নতুন করে এ জ্ঞানের দহনে আমাদের সমস্ত জড়তা ভস্মীভূত হয়ে যাক; আর আমাদের চিত্ত বল সঞ্চার করুক এই নব বিশ্বাস যে, মানুষের চলার জন্য বাস্তবিকই কোনো বাঁধানো রাজপথ নেই,–জগৎ যেমন এক স্থানে বসে নেই মানুষও তেমনি তার পরিবর্তনশীল পরিবেষ্টনকে নিয়ে একস্থানে স্থির হয়ে নেই আর এই পরিবর্তনশীল পরিবেষ্টনের ভিতর দিয়ে পথ করে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন অন্ধ অনুবর্তিতার নয়, . সদাজাগ্রতচিতোর। হয়ত তাহলে আমাদের চোখের সমোহন ঘুচে যাবে। তখন জগতের সঙ্গে আমাদের অপরিচয়ের পর্যায়ের অবসান হবে। তখন হয়ত সহজ দৃষ্টিতেই আমরা দেখতে পাব, বিপুলা এ পৃথিবীর কত বিচিত্র প্রয়োজনে কত ধর্ম, কত নীতি, কত সভ্যতা কোন সভ্যতা কোন অনাদি কাল থেকে তার কোলে জন্মলাভ করে আসছে, আর এই অনন্ত জন্মপ্রবাহে ইসলামের অর্থ কি, তার নব নব সম্ভাবনা ও সার্থকতা কোন পথে। তখন প্রীতিতে আর শ্রদ্ধায়ই আমরা অবলোকন করতে পারব, আমাদের প্রিয় হজরত মোহাম্মদের সাধনার সঙ্গে যে সমস্ত মহাপুরুষের সাধনার হুবহু মিল নেই তারাও কেমন করে সত্যের চির-অমল চির আনন্দপ্রদ জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার যে গৌরব ও অমোঘ কার্যকারিতা, তখন জগৎ ও ইসলামের জন্য সেই শ্রেষ্ঠ সার্থকতার সন্ধানে আমাদের চিত্ত উন্মুখ হবে।
মুক্ত বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে ইসলামের কিছুমাত্র বিরোধ নেই। বরং ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, ইসলামের যে প্রাণভূত তৌহীদের সাধনা, মুক্ত বিচার-বুদ্ধির সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর আল্লাহকে যে জানতে চায়, তার চিত্তে ভিন্ন বিচার, কাণ্ডজ্ঞান অপরের প্রতি স্নেহ ও শ্রদ্ধা প্রভৃতি মুক্তির লক্ষণ আর কোথায় যোগ্যভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া, ইসলামের তৌহীদের সাধনা জগতে কল্যাণ ও মুক্তির সহায়তা করে এসেছে, ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে। তৌহীদের বিশ্বাসী দার্শনিক ইবনে রোশদের (Averoes) লেখা দ্বাদশ শতাব্দীতে ইয়োপীয় চিত্তে শাস্ত্রের অভ্রান্ততায় সন্দেহ জন্মেছিল, প্রাচীন শাস্ত্রের বন্ধন থেকে বুদ্ধির এই মুক্তির স্থান ইয়োরোপীয় রেনেসাসে অনেকখানি; মধ্যযুগের ঘোর তামসিকতার ভিতরে নানক, কবীর প্রভৃতি ভক্ত সত্যকার আধ্যাত্মিকতার দীপ ভারতে পুনঃ প্রজ্জলিত করেছিলেন, তাদের সামনেও শিখারূপে জ্বলেছিল ইসলামের তৌহীদ ও সাম্যবাদ; আর বাঙালি মুসলমানের জন্য সব চাইতে বড় সুসংবাদ এই যে, ভারতের নবজাগরণের যিনি আদি নেতা সেই মহাত্মা রাজা রামমোহনের উপরে ইসলাম আশ্চর্যভাবে প্রভাবশালী হয়েছিল। বাংলার চন্ডীমন্ডপের অবরুদ্ধতা ও নিরুদ্বেগের ভিতরে তিনি যে প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন সকল কাণ্ডজ্ঞান, চিন্তা ও কর্মের বিশ্বধারা, সে সমন্তের যোগ্য প্রেরণা চিত্তবিকাশের মহামুহূর্তে তার লাভ হয়েছিল হজরত মোহাম্মদের সাধনা থেকে, তার প্রচলিত তৌহীদ, সাম্য, নরনারী নির্বিশেষে সবারই জীবনের মর্যাদাবোধ, আধুনিক যুগের এই মহাপুরুষের কল্যাণ ও মুক্তির পথে অমূল্য পাথেয়রই কার্য করেছিল।
কিন্তু, “চেরাগকে নিচে আন্ধেরা!” সেই ইসলামের অনুবর্তী বলে আজ যারা নিজেদের পরিচয় দেয়, সমস্ত রকমের মুক্তির সঙ্গে তারা অপরিচিত। কেন এমন হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমাদের নূতন কোনো কথা বলবার নেই। সত্য ও সত্যসাধকের মহৈশ্বর্যময় প্রকাশের সামনে মুসলমান চকিত সম্মোহিত হয়েছে, জগতের সমস্ত সাধনাকে জীবন গঠনের উপাদানরূপে ব্যবহার করা যে মানুষের চিরন্তন অধিকার, সে কথা সে শোচনীয়রূপে বিস্মৃত হয়েছে বার বার এই কথাটাই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে; একটা বড় সম্প্রদায় হিসাবে এই ই মুসলমানের চরম দুর্ভাগ্য যে, তার যে সমস্ত পরমাত্মীয় পূর্ণাঙ্গ মনুষ্য-প্রকৃতি নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও গভীর আত্মবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদের দীপ্তিতে অন্ধ হয়ে সম্মোহিত হয়ে আস্ফালন করেছেন তাঁদের প্রচণ্ডতা, তাকে আকৃষ্ট করেছে, বেশী, আর আজ পর্যন্ত সেই আকর্ষণই তার পক্ষে প্রবলতম!
তবে, শুধু নৈরাশ্যে একান্ত মিয়মান না হলেও আধুনিক মুসলিম সাধকদের চলে। একটা বড় সত্যসাধনার পূর্ণ পরিস্ফুটনের জন্য তের শত বৎসর খুব দীর্ঘকাল নয়। বিপুল ভবিষ্যৎ তাদের সামনে। সেই ভবিষ্যতে ভীত সম্মোহিত মুসলমানের পরিবর্তে মুক্তদৃষ্টি ভুমার প্রেমিক মুসলমানকে জগৎ পাবে, তা করে বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের চিরসংগ্রামে এক দৃঢ় মেরুদণ্ড-সমন্বিত অকুতোভয় সৈনিক জগতের লাভ হবে, ইসলামও এক অপূর্ব সার্থকতার শ্রীতে মণ্ডিত হবে– এই আশায় ও বিশ্বাসে তারা তাদের অতীত ও বর্তমানের সমস্ত ব্যর্থতা ও লজ্জা বহন করতে পারেন।
জৈষ্ঠ, ১৩৩৩