সম্মানের মূল্য – সুমথনাথ ঘোষ

সম্মানের মূল্য – সুমথনাথ ঘোষ

চিতোর! প্রতাপের সাধের চিতোর! রাজপুতদের গৌরবের চিতোর আবার অমরসিংহের হাতে এল৷ যার সাধনায়, যার কল্পনায়, যার স্বপ্নে রানা প্রতাপসিংহ দিনরাত ডুবে থাকতেন; যে চিতোরের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সকল ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়ে শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যে ও অন্ধকার পর্বতগুহায় কত দিন, কত রাত্রি, অনাহারে, অনিদ্রায় কাটিয়ে দিয়েছেন; প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দুর্দান্ত শীত, অবিশ্রান্ত বর্ষাকে উপেক্ষা করে, পদদলিত করে যে জন্মভূমির পবিত্র ধুলাকণা একদিন শত্রুর স্পর্শ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, সেই চিতোরের সিংহাসনে প্রতাপেরই উপযুক্ত পুত্র অমরসিংহ যখন বসলেন, তখন রাজপুতদের আনন্দের আর সীমা রইল না৷

কিন্তু এ আনন্দ বেশি দিন উপভোগ করতে হল না৷ অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা জানতে পারলেন সম্রাট জাহাঙ্গির বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে চিতোর আক্রমণ করতে আসছেন৷

রানা অমর সিংহ পূর্বপুরুষের যুদ্ধপ্রথা অনুসরণ না করে সৈন্যসামন্ত জোগাড় করতে লাগলেন এবং সম্মুখসমরে তাঁকে বাধা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন৷ মোগলদের আসতে বিলম্ব দেখে তিনি মনে করলেন ততক্ষণ কয়েকটা স্থান মোগলদের গ্রাস থেকে ছিনিয়ে আনা যাক৷

যুদ্ধের আয়োজন সব ঠিক; এমন সময়ে নিজেদের মধ্যে এক গোলমাল বাধল৷ কে সেনাদের পুরোভাগ রক্ষা করবে অর্থাৎ সৈন্যপরিচালনা করবে? এটা হল সকলের চেয়ে বড়ো সম্মানের পদ৷ যারা শ্রেষ্ঠ বীর, মানে-মর্যাদায় যারা সকলের বড়ো, চিরকাল তারাই এই যশের অধিকারী হয়ে এসেছে৷ এবার এই নিয়ে রাজপুতদের মধ্যে একটা ঘোরতর অশান্তির সৃষ্টি হল৷

চন্দাবৎগণ অর্থাৎ মহারানা চণ্ডের বংশধরগণের মধ্যে যাঁরা জ্যেষ্ঠ, বরাবর তাঁরাই এই সম্মান পেয়ে এসেছেন৷ শক্তাবৎ হল রানা প্রতাপসিংহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শক্তসিংহের বংশধরগণ; এরা কিন্তু এবার খেপে গেল, বললে, ‘আমরা এই সম্মান চাই৷’ বলার আর কোনো হেতু ছিল না, শুধু এরা প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করেছিল বলেই দম্ভের সঙ্গে এই দাবি জানালে৷

মহামুশকিল! এখন কী হয়? দুই দলই সমান পরাক্রমশালী৷ রানার ডান হাত বাঁ-হাত বললেই হয়-কাকে চটাবেন? ভেবে অস্থির হলেন৷

একদলকে সম্মানিত করতে গেলেই আর একদল যাবে খেপে৷ শেষে কি গৃহবিবাদে নিজেদের শক্তি নিজেরা ক্ষয় করবে? সামনে আসন্ন যুদ্ধ৷ রানা অমরসিংহ মন্ত্রীদের সঙ্গে অনেক জল্পনা-কল্পনা করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না৷

রাজপুত হল ব্যাঘ্রের জাত৷ ক্ষমতার দম্ভ, বীর্যের দর্প তাদের শিরায় উপশিরায় চঞ্চল হয়ে উঠল৷ যায় যাক প্রাণ; সম্মান আগে, বীরত্বের জয়মাল্য আগে গলায় চাই৷ এই ভেবে দুই দলই তলোয়ার খুলে একেবারে রানার সামনে হাজির হল৷ যে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হবে সেই পাবে এই সম্মান৷

এমন সময় রানার মাথায় এক মতলব এল, তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘যে দল আগে অন্তলার দুর্গে প্রবেশ করতে পারবে সেই পাবে ‘হিরোল’ রক্ষার ভার৷’ হিরোল বলে সেনাদলের পুরোভাগকে৷

রাজধানী থেকে ন-ক্রোশ দূরে একটা পাহাড়ের ওপর এই দুর্গ; চারিদিক কঠিন পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা৷ মাঝে মাঝে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গোলাকার রক্ষীনিবাস, তারই ওপর থেকে সৈন্যরা পাহারা দেয়৷ আর এই দেওয়ালের পাদদেশ বিধৌত করে চলে গেছে একটি খরস্রোতা নদী৷

অন্তলার মধস্থলে দুর্গরক্ষকের অট্টালিকা, সেও অতি কঠিন পাথরের প্রাচীরে ঘেরা৷ অন্তলায় প্রবেশ করবার মাত্র একটি পথ, মাত্র একটি দরজা৷

ভোর হতে-না-হতেই তারা ছুটল আপন আপন সৈন্যদল নিয়ে দিক-বিদিক প্রকম্পিত করতে করতে৷ এতদিন যে ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে উভয়ে উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিল, আজ যশোলিপ্সা-প্রণোদিত হয়ে তার প্রকৃত পরিচয় দেবার জন্য দু-জনে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল৷

অন্তলার দুর্গ মোগলদের অধিকৃত৷ যে বীর এদের হটিয়ে দিয়ে দুর্গ জয় করতে পারবে সেই পাবে বিজয়মাল্য, আজ তারই হাতে সমস্ত মেবারের সৈন্যদলের সম্মুখ-ভার৷

প্রচণ্ড উৎসাহ ও প্রবল জিগীষা মেবারের প্রধানতম দুই সামন্তদলকে টেনে নিয়ে গেল কঠিন অগ্নিপরীক্ষায়৷ চারণেরা মঙ্গলগীত গেয়ে তাঁদের অভিনন্দন করলেন, রাজপুত রমণীরা সেই সঙ্গে নিজেদের কোকিলকন্ঠ মিলিয়ে তাঁদের দ্বিগুণ উৎসাহিত করলেন৷

সকাল হল; সূর্যদেব আকাশের গায়ে দেখা দিলেন৷ গাছের মাথায়, পাহাড়ের পাদদেশে আলো ছড়িয়ে পড়ল, শক্তাবৎগণ অন্তলা দুর্গের দ্বারে উপস্থিত হয়ে শত্রুদের অতর্কিতভাবে আক্রমণ করলে৷ কিন্তু মোগলেরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাঁচিলের মাথায় এসে দাঁড়াল৷ উভয় দলে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হল৷

এদিকে ভারি বিপদ হল৷ চন্দাবৎগণ পথ ভুলে এক জলাভূমির মধ্যে গিয়ে পড়েছিল৷ দুর্গম স্থান, পথ খুঁজে না পেয়ে ইতস্তত ভ্রমণ করছে, এমন সময় এক মেষপালকের সঙ্গে তাদের দেখা৷ সেই শেষে পথ দেখিয়ে তাদের অন্তলা দুর্গের কাছে নিয়ে এল৷

চন্দাবৎগণ বুদ্ধি করে কতকগুলো কাঠের সিঁড়ি সঙ্গে এনেছিল৷ তারই সাহায্যে দুর্গের পাঁচিলে অতি অনায়াসে তারা উঠতে লাগল; কিন্তু মোগলেরা উপর থেকে লোহার বল ও বড়ো বড়ো পাথর ফেলতে লাগল তাদের ওঠার পথে এবং তারই আঘাতে চন্দ্রাবৎ সর্দার আহত হয়ে নীচে পড়ে গেলেন৷ ভগবান তাঁর ভাগ্যে হিরোল রক্ষার ভার লেখেননি!

এমনি করে উভয় দলের প্রচণ্ড শক্তি ব্যাহত হয়ে বার বার ফিরে আসতে লাগল৷

চন্দাবৎ ও শক্তাবৎগণ মুহূর্তের জন্য নিরস্ত হয়ে আবার ভীমবলে আক্রমণ চালাল৷ শত্রুদের পরাস্ত করতেই হবে৷

শক্তাবৎ-সর্দার একটি প্রকাণ্ড হাতির পিঠে চড়ে এসেছিলেন, তিনি উপায়ান্তর না দেখে রুদ্ধ দুর্গদ্বারের দিকে হাতীকে চালিয়ে দিলেন; দারুণ চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করতে করতে রণমাতঙ্গ সেইদিকে ছুটে গেল৷ কিন্তু সেই দুর্গদ্বারে অসংখ্য তীক্ষ্ণ লোহার ফলা লাগানো থাকাতে হাতির সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল৷ বার বার সে গিয়ে ফিরে আসতে লাগল৷ দুর্গদ্বারে হাজার হাজার বর্শার শাণিত ফলক রৌদ্রে ঝলমল করে উঠল, হাতি কিছুতেই তাতে মাথা ঠেকিয়ে ঠেলতে পারলে না৷ সে দ্বার আর উন্মুক্ত হল না৷ ক্রমে শত শত শক্তাবৎ বীর শত্রুহস্তে প্রাণ হারাল, কিন্তু শক্তাবৎ-সর্দার কিছুতেই নিরুৎসাহ হলেন না৷

অকস্মাৎ আকাশ-বাতাস কম্পিত করে চন্দাবৎগণের পক্ষ থেকে জয়ধ্বনি উঠল৷ শক্তাবৎ সর্দারের বুক কেঁপে উঠল-ওই বুঝি চন্দাবৎরা জিতল৷

আর কোনো উপায় না দেখতে পেয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ হস্তীপৃষ্ঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে সেই বল্লমের ফলাগুলিতে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন৷ আর চিৎকার করে মাহুতকে বললেন, ‘শীঘ্র হাতিকে আমার দেহের ওপর দিয়ে চালিয়ে দাও, নইলে তোমার মাথা এখনই তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলব৷’

মাহুত একটু ইতস্তত করতে লাগল, কিন্তু তিনি আবার বললেন, ‘এখনই আমার আদেশ পালন করো, তা না হলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিতে জেনো৷’

মাহুত আর মনিবের আদেশ পালন না করে থাকতে পারলে না৷ ডাঙ্গশ দিয়ে হাতির মাথায় এমন জোরে আঘাত করলে যে, সে ভীষণ চিৎকার করতে করতে সেই রুদ্ধ দ্বারের ওপর গিয়ে পড়ল৷ তার চাপে শক্তাবৎ-সর্দারের দেহ দুর্গদ্বারের সঙ্গে পিষে গেল আর সেই লৌহফলকগুলো তাঁর দেহ বিদীর্ণ করে অপর দিকে বেরিয়ে পড়ল৷ মড়মড় করে দুর্গের দ্বার ভেঙে পড়ল, শক্তাবৎ-সর্দারের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে৷

কিন্তু সৈন্যরা তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ করল না; সর্দারের মৃতদেহ যে ধুলায় পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে তাঁকে পদদলিত করে ঝড়ের বেগে দুর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল৷ এরূপ অদ্ভুত আত্মত্যাগ করেও কিন্তু শক্তাবৎ-সর্দার সেদিন সম্মান লাভ করতে পারলেন না৷ তাঁর সৈন্যগণ দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করবার আগেই চন্দাবৎ-সর্দারের মৃতদেহ নিয়ে ওপক্ষের সৈন্যরা পাঁচিলের ওপর দিয়ে ভেতরে ফেলে দিয়েছিল৷ চন্দাবৎগণের যে জয়ধ্বনি শুনে শক্তাবৎ-সর্দার প্রাণ বিসর্জন দিলেন, এ আর কিছু নয় তারই বিজয়োল্লাস৷

মোগলদের গোলার আঘাতে চন্দাবৎ-সর্দারের মৃতদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তখন অপর একজন সর্দার চন্দাবৎগণের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন৷ তার নাম বান্দাঠাকুর বা পাগলসর্দার৷ যে সকল বীর কঠোর বিপদ আলিঙ্গন করতে কুন্ঠিত হয় না, আবশ্যক হলে প্রচণ্ড ব্যাঘ্রের সঙ্গে লড়াই করে, যাদের হৃদয়ে মায়া-মমতার লেশমাত্র নেই-বান্দাঠাকুর তাদেরই অন্যতম; তিনি যেমন বীর তেমনি তেজস্বী ও নির্ভীক; চন্দাবৎ-সর্দারের মৃতদেহ যখন মাটিতে লুন্ঠিত হতে লাগল তখন বান্দাঠাকুর একখানি উত্তরীয়ে সেই সব জড়িয়ে নিজের স্কন্ধে ভালো করে বেঁধে নিলেন এবং মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পাঁচিলের ওপর উঠতে লাগলেন ও শেষে সর্দারের মৃতদেহ অন্তলার দুর্গশিরে নিক্ষেপ করলেন৷

‘হিরোল, হিরোল!’ বলে চন্দাবৎগণ চেঁচিয়ে উঠল৷ মুহূর্তের মধ্যে তাদের মিলিত জয়ধ্বনি অন্তলা দুর্গের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল৷ চন্দাবৎগণ হিরোল পেলেন৷

শক্তাবৎ-সর্দার লজ্জায় অধোবদন হয়ে দেশে ফিরে গেলেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *