সম্ভাবনাকে জাগতে দিন
বাংলাদেশের ছয়টি কিশোর বিশ্বমঞ্চ থেকে গৌরব এনেছে। আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে, ছয়টি রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। খবরটা অনেক আনন্দের। অসম্ভব গৌরবের। তাদের অভিনন্দন! আমি কিশোরগুলোর ছবি দেখে দেখে, দুর। থেকে এক অহংবোধে ডুবে আছি। যাদের বয়স এখনো ১৬ হয়নি, যারা এখনো মায়ের ঘড়ির কাঁটায় চলে, তারা কী ভয়ংকর। প্রতিযোগিতা করে পদক ছিনিয়ে আনে। একুশ শতকের মেধার যুদ্ধে ওরাই হবে আমাদের দুর্গ।
এই মুখগুলো দেখে আমি ওদের পারিপার্শ্বিক অবস্থান নিয়ে ভাবি। আমি নিশ্চিত, যে কিশোরগুলো বিজ্ঞানে পৃথিবী জয় করার যোগ্যতা রাখে, তাদের পরিবার তাদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যই প্রতিনিয়ত চাপ দেয়। অনেকেই তাদের একজন। গবেষক বা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য উৎসাহ দেয় না। আমাদের দেশের কিশোরেরা খুব সামান্য সুযোগ পায়। ইউরোপ আমেরিকার স্কুলের ছেলে-মেয়েরা দেশ ও পরিবার থেকে যে। পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ও সাপোর্ট পায়, তার অর্ধেকও আমাদের কিশোর-তরুণেরা পায় না। তবুও অসংখ্য ছেলেমেয়ে গবেষণা করার স্বপ্ন দেখে। ওরা উদ্ভাবন ও সৃষ্টি করতে চায়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মাঝেও যদি পারিপার্শ্বিক সাপোর্টটুকু বেশি বেশি থাকত তাহলে আমাদের এসব বিজয়ের খবর অনেক বেড়ে যেত। পরিবারের মেন্টাল সাপোর্ট মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টা বহুগুণে বাড়ায়। অন্য যে কিছুর চেয়ে এটা ঢের গুরুত্বপূর্ণ।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ি তখন। বাসা নানান। জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর করে ফেললাম। রসায়নের পরীক্ষা করে ক্ষার (alkali) তৈরি করা হলো। সেটা পরীক্ষার জন্য লিটমাস পেপার না থাকায় বাড়ির আঙিনার জবা ফুল ব্যবহার করলাম। কামারের কাছ থেকে প্রাণী ব্যবচ্ছেদের জন্য ট্রে তৈরি করলাম। কতগুলো কাঁচের জার কিনে আনলাম। ফরমালিন দিয়ে বিরল উদ্ভিদ সংরক্ষণ শুরু করলাম। এসব দেখতে দেখতে আম্মার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর, কাঁচের জারগুলো হয়ে গেল তার মসলা রাখার পাত্র। তিনি ভাবলেন, পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব করলে ভালো রেজাল্ট করতে পারব না। আর রেজাল্ট ভালো না। করলে ডাক্তার হওয়া যাবে না। আর যদি ডাক্তারই হতে না পারি, তাহলে আমার জীবনে আর কোনো আলোই থাকবে না। বিজ্ঞানের প্রতি যে সহজাত (Innate) ভালোবাসা জন্মেছিল, সেটা তখন কমে গিয়েছিল। ডাক্তার না হলে, এই জীবনে আর কোনো সার্থকতা নেই–সমাজের দশজনের মতো এটাই ছিল আম্মার একমাত্র ভাবনা।
হে অভিভাবকগণ, আমাদের জন্য আপনাদের ত্যাগের সীমা নেই। আমাদের মঙ্গলের জন্য আপনাদের প্রচেষ্টার শেষ নেই। আপনাদের শ্রম অতুলনীয়, অপরিশোধ্য। কিন্তু আপনারাও মানুষ। তাই আপনারাও ভুল করেন। আপনাদের কিছু অসর্তকতা, অসচেতনতার কারণে শতসহস্র ছেলেমেয়ের সুপ্ত সম্ভাবনা জাগার সুযোগ পায় না। তাদের স্বপ্নের জগৎ ক্ষুদ্র হয়ে। যায়। ডাক্তার হওয়া মন্দ কিছু নয়। ইঞ্জিনিয়ার খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছাড়াও জীবনে বহু কিছু করা যায়। জগন্ময় খ্যাতি আনা যায়। বড় হওয়া যায়। আপনারা। এমআইটি, প্রিন্সটন, হাভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, কেমব্রিজ, স্ক্রিপস রিসার্চ সেন্টার–এমন সব প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে থাকবেন। এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে শতগুণ কঠিন। আর এই কঠিন কাজটি অর্জনের স্বপ্ন দেখাতে হবে ওদের। এই কঠিন কাজটি না করতে পারলে আমরা গবেষক তৈরি করতে পারব না। আর গবেষণা না হলে রাষ্ট্র পিছিয়ে যাবে। আমরা সৃষ্টিশীল স্বনির্ভর কোনো জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারব না।
কখনো কি ভেবেছেন, আপনার যে ছেলেমেয়েটিকে স্রেফ একজন ডাক্তার বানাবেন, সে হয়তো তার চেয়ে অনেক বড় কি হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সে সম্ভাবনাকে বের করে আনার চেষ্টাও। করতে হয়। কোনো সম্ভাবনার ক্ষয় হলে, শুধু একটি পরিবার নয়। সমাজ-সভ্যতাও বঞ্চিত হয়।