সম্ভাবনা
প্রগতিশীল মানুষের মতো আমাদের আর একটি চরিত্র ধীরে-ধীরে বিকশিত হচ্ছে, সেটি হল প্রতিযোগিতাশীল। বেঁচে থাকাটা আর আগের মতো সহজসাধ্য নেই। খেলুম-দেলুম আর গদাই লস্করি চালে যা হয় একটা কিছু করলুম—সেই অনায়াস-স্বাচ্ছন্দ্যের যুগ চলে গেছে। পৃথিবীতে এক একটা যুগ এসেছে, চলে গেছে, যেমন ডার্ক এজ, প্যাপাল এজ, মিডল এজ, রেনেসাঁস, পোস্ট রেনেসাঁস, এজ অফ রিভাইভ্যাল, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এজ, অ্যাটমিক এজ, সেই রকম আমাদের এ দেশে এখন চলেছে, ধস্তাধস্তির যুগ—এজ অফ ধস্তাধস্তি—এক ধরনের কুরুক্ষেত্র। সকলেরই মুখে ছোট একটি শব্দ, ‘এই যা: হল না।’ কি হল না, ছেলের প্রপার এডুকেশানের ব্যবস্থা হল না, মেয়ের ভালো বিয়ের ব্যবস্থা হল না, নিজের প্রাোমোশান হল না, একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হল না। এ সবই হল, বড়-বড় ‘হল না’ ছোট আছে অসংখ্য। যেমন, কেরোসিন তেল আনা হল না, গ্যাসের জন্য ধন্না দেওয়া হল না, রেশনে হঠাৎ ভালো চাল এসেছিল, তোলা হল না, লোডশেডিংয়ের আগে জল তোলা হল না। তার মানে এই যুগের আর এক নাম—’এজ অফ হল না।’
আর একটি শব্দ, ‘যা: বেজে গেল।’ হয় নটা বাজল, না হয় বারোটা বাজল। অধিকাংশ মানুষই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। একটি বাজা সাংঘাতিক বাজা, সেটি হল নটা। সারা দেশ সাইরেনের কণ্ঠে আর্তনাদ করছে, অল ক্লিয়ার, যে যেখানে যে অবস্থায় আছ, আবাস্থল ছেড়ে, ছুটে বেরিয়ে এস। লেট হয়ে গেল, লেট হয়ে গেল। কোনওরকমে তালগোল পাকিয়ে জীবিকার আসনে গিয়ে বসে পড়। হাজিরা ফার্স্ট, কাজ? তখন একটু ব্যঙ্গের হাসি’, ‘যে ভালো করেছ কালী/আর ভালোতে কাজ নাই। এবারে ভালোয়-ভালোয় বিদায় দে মা/আলোয় আলোয় চলে যাই।’ কাজের ঠেলায় সারা দেশ স্তব্ধ!
সাইরেন নটায় ককিয়ে উঠলে কি হবে, জাতির ঘড়িতে বারোটা বেজে বসে আছে। যা: বারোটা বেজে বসে আছে। যা: বারোটা বেজে গেল, এ কথা এখন মুখে মুখে। বিদ্যুতের বারোটা, রাস্তাঘাটের বারোটা, সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বারোটা, ট্রান্সপোর্টের বারোটা, পানীয় জলের বারোটা, জনস্বাস্থ্যের বারোটা, চতুর্দিকে বারোটা বাজার ধুম পড়ে গেছে।
পাশাপাশি আর একটি যুগও চলছে, লাশ ফেলার যুগ। বিদেশ থেকে অনেক কিছুর মতো এটিও আমাদের সাম্প্রতিক আমদানি। এমন মুড়িমুড়কির মতো কথায় কথায় লাশ ফেলার রেওয়াজ কোনও কালে দেখা যায়নি।
বাঘ সাধারণত মানুষ খায় না। দুর্বল বাঘ কোনওক্রমে একবার মানুষ খেতে শিখলে ম্যানইটার হয়ে যায়। আমাদের চারিত্রিক দুর্বলতা যত বাড়ছে, ততই আমরা আত্মঘাতী, নরঘাতী হয়ে উঠছি। যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি, সদাচারের পথ ছেড়ে আমরা ধীরে-ধীরে দ্বিপদ জন্তু হয়ে উঠছি। যতদিন যাবে ততই এই জন্তুর বিকাশ সম্পূর্ণতার চেহারা নেবে।
তখন কি হবে? আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাব? না, তা হবে না। আমাদের সব কিছুর বিবর্তন হবে। আকার আকৃতিও হয়তো পাল্টে যাবে। গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা পেড়ে খাবার চেষ্টায় জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গেল। শীতের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টায় শীতপ্রধান দেশের প্রাণীদের গায়ে লোম বেরল। উট পেয়ে গেল গলায় জল ধরে রাখার গলকম্বল। কালে আমাদেরও তাই হবে। হয়তো কপালের দুপাশে দুটো শিং গজাবে। মনের আকৃতি পাল্টে যাবে। সারমেয়-স্বভাব প্রবল হবে। দলবহির্ভূত কারুর সঙ্গে দেখা হলেই আস্ফালন, তর্জন-গর্জন, খেয়োখেয়ি। তখন আমাদেরও ‘র্যাবিজ’ হবে। কামড় খেয়েই ছুটতে হবে পাস্তুরে। গায়ে টিকস হবে। হাতের সমস্ত নখ সরু-সরু হয়ে, আগা বেঁকে হুকের মতো হবে। ক্যানাইন টিথ বড় হয়ে যাবে। মানুষের বাচ্চাকেও বেড়াল বাচ্চার মতো আগলে রাখতে হবে, নয় তো হুলোয় মেরে দিয়ে যাবে।
জনপদ বলে কিছু থাকবে না। কমিউন্যাল ভায়োলেন্সে, পলিটিক্যাল ভেনডেটায় সব মাঠময়দান হয়ে যাবে। কুকুরের মতো নাচতে-নাচতে ভীত মানুষ যখন যেখানে সুবিধে সেখানেই আশ্রয় নেবে। চতুস্পদের জগতে কিছু প্রাণী যেমন হিংস্র, কিছু আবার নিরীহ। দ্বিপদের জগতেও সেই শ্রেণিবিন্যাস অবশ্যই থাকবে। এখনও তাই আছে। একদল বাঁচবে গরুর মতো। তারা হবে দোহনের বস্তু, নিপীড়নের বস্তু। একদল হবে ভারবাহী গর্দভ। একদল হবে ভীরু খরগোস। একদল হবে ধূর্ত শৃগাল। একদল হবে ফেউ। বাঘের পেছনে-পেছনে ঘুরবে।
ধর্ম ঈশ্বর-বিশ্বাস ছাড়াও আরও কিছু। ধর্ম হল জীব-ধর্ম, স্বভাবের প্রকাশ। মানুষ আর পশুর মধ্যে দেহগত সীমারেখা ছাড়াও, আর একটি সীমারেখা ছিল, সেটি হল বোধ বা বোধি। মানুষকে বলা হয় ‘থিঙ্কিং অ্যানিম্যাল’। এ যুগ হল ‘অ্যাকসান’ আর ‘রিঅ্যাকসানে’র। মগজহীন, বোধ-বুদ্ধিহীন ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া।
আগামী শতাব্দীর শুরুতে কি হবে, বলা কঠিন। সুখই তখন হয় তো অসুখ হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ ওষুধ খেয়ে বিমর্ষ হবে, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে। ওষুধ খেয়ে যন্ত্রণা চাইবে। নিজেকেই নিজে আহত করে তৃপ্তি খুঁজবে। এমন হতে পারে মনুষ্য-বিজ্ঞানের চিকিৎসায় আর রোগ সারবে না, পশুবিজ্ঞানের পথ ধরতে হবে। সব হাসপাতাল আর স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়ে যাবে, ‘ভেটেনারি হসপিটাল’। মানব সন্তানকে ‘ট্রিপল-অ্যান্টিজেনে’র বদলে দিতে হবে, ‘অ্যান্টি র্যাবিজ!’ বলা যায় না কি হবে! Hanskoning এই উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করি : A barricade is more photogenic than a gas station. May be we have marched backward without knowing it ever since 1776.