সম্পূর্ণ অকারণে – প্রবীরগোপাল রায়

সম্পূর্ণ অকারণে – প্রবীরগোপাল রায়

ব্যারিস্টার এডোয়ার্ড টুডু ছোটনাগপুরের একটি কেন্দ্র থেকে ভারতের লোকসভার সদস্য।

তাঁর রাঁচির বাড়িতে সেদিন তখন সকাল দশটা। তাঁর স্ত্রী নির্মলা শয়নকক্ষের একটি আলমারিতে চাবি ঘুরিয়ে ড্রয়ার খুলল, স্বামীর রিভলবারটি বেরুল। তাতে গুলি পুরে নল রগের ওপর চেপে ধরে সে ঘোড়া টিপল।

আওয়াজ কানে গেল সেক্রেটারি অমিয় সাহার। সে অদূরের ঘর থেকে ছুটে এল কি ব্যাপার দেখতে। দেখল, নির্মলার নিস্পন্দ শরীর মেঝেয় পড়ে। রক্তে কার্পেটের খানিকটা ভিজে গেছে।

সেই ঘরেই টেলিফোন। অমিয় প্রথমে পারিবারিক চিকিৎসক মিস্টার বোসকে, তারপর পুলিশকে ফোন করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে মিস্টার টুডুকে খবর দিতে গেল। তিনি তখন তাঁর বৈঠকখানায় কয়েকজন আদিবাসীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। অমিয় গিয়ে বলল, ‘খুব জরুরী ব্যাপার, আপনি যদি একটু ভেতরে আসেন।’

কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই ডাক্তার ও পুলিশ পৌঁছল। মিস্টার টুডু মৃতদেহের অদূরে একটি চেয়ারে বিস্ফারিত চোখে বসেছিলেন। মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছিলেন। পুলিশকে বললেন, ‘নির্মলা আত্মহত্যা করে নি। করবার কোনই কারণ ছিল না। কেউ তাকে খুন করেছে। না, খুনের মোটিভ আপাতত স্পষ্ট নয়। হয়তো কোন হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকের কাজ।’

সত্যই, আত্মহত্যা অচিন্ত্যনীয়। টুডুরা ছিলেন অতি সুখী দম্পতি। দুর্ঘটনার সময়ে নির্মলার গর্ভে পাঁচ মাসের বাচ্ছা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাগ্রহে সন্তানের জন্য দিন গুণছিলেন। ঘটনার আড়াই ঘন্টা আগে টুডুরা একত্রে প্রাতরাশ সেরেছেন। তখনও নির্মলা সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক। দুজনে প্ল্যান করেছিলেন। বিকেলে ওরা মোটরে হাওয়া খেতে বেরুবেন।

প্রাতরাশের পরও নির্মলাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখেহে অন্তত চারজন। সাড়ে নয়টায় অমিয়। দশটায় বাড়ির একজন বেয়ারা জগদেও এবং সে যাকে সঙ্গে করে কর্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল―এক ফার্নিচার কোম্পানীর ট্র্যাভেলিং সেলসম্যান। দশটা কুড়িতে একান্ত পরিচারিকা আশা।

নির্মলাকে শেষ জীবিত দেখেছিল আশাই। কর্ত্রীর জন্য গরম দুধের গ্লাস নিয়ে সে গিয়েছিল। নির্মল তাকে ক্যাটালগ দেখিয়ে বলেছিল যে ফার্নিচার কোম্পানীর কাছ থেকে দুটি বড় মাপের গার্ডেন-চেয়ার সে পছন্দ করেছে। বিকেলে যে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী মোটরে হাওয়া খেতে বেরুবে সে কথাও বলেছিল। ও প্রফুল্ল মুখে দুধে চুমুক দিচ্ছে, সেই দেখে আশা চলে এসেছিল।

অমিয়কে পুলিশ খুঁটিয়ে জেরা করল। মৃতদেহ তারই আবিষ্কার। বৈঠকখানায় ভিড় থাকে বলে সে টুডুদের শয়নকক্ষের অদূরে একটি ঘরে বসে কাজ করে। সেই ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে টুডুদের ঘরে যেতে হয়। অমিয় স্পষ্ট বলল, দশটা কুড়ি মিনিট থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে সে কোনরকম সন্দেহজনক আওয়াজ বা চিৎকার শোনে নি, কাউকে বারান্দা দিয়ে যেতে-আসতেও দেখে নি। পুলিশ অমিয়র টেসটিমোনিয়ালস দেখল। মিস্টার টুডুকে শুধোল যে ওরঁ এবং নির্মলার মধ্যে অপ্রকাশ্য ও অনুচিত কোনরকম সম্পর্ক ছিল বলে তাঁর সন্দেহ আছে কিনা। না, সন্দেহের কিছু নেই।

অচিন্ত্যনীয়, তথাপি সকল তথ্য সঙ্কেত করছিল আত্মহত্যারই দিকে। সে চাবি-লাগানো আলমারির ড্রয়ার থেকে রিভলবার বার করে তাতে গুলি পুরে ফায়ার করেছে। ট্রিগারে তার আঙুলের ছাপ। ডাক্তার অভিমত দিলেন, ক্ষত স্বকৃত। মৃতদেহের অবস্থান দেখেও বোঝা যায় এটি মার্ডার কেস নয়। সর্বোপরি একটি চিরকুট। তাতে বাঙলায় লেখা—‘ওগো, আমায় ক্ষমা কর।’ নির্মলা ছিল বাঙালী কন্যা।

সম্পূর্ণ অকারণে আত্মহত্যা। কেউ অনুমানেও কোন ব্যাখ্যা দিতে পারল না। পুলিশ ফাইলে অনুসন্ধানের এই ফল লিপিবদ্ধ করা হল―আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার সময়ে মৃতার প্রকৃতিস্থতা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

শোকের প্রথম আঘাতে মিস্টার টুডু ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যস্ত ব্যারিস্টার, আদিবাসীদের নেতা এবং দায়িত্বশীল এম. পি। দু-চার দিন কাটল এবং ক্রমশ তাঁর জীবনে পুরোন রুটিন ফিরে এল। তাঁর মনে কি হচ্ছিল কে জানে। তবে কাল তো সর্বসস্তাপহর। প্রত্যাশিত যে তিনি তাঁর শোক কিছুকাল পরে ভুলবেন।

শান্তি ছিল না অমিয়র মনে। মাত্র গত বছর মিস্টার টুডু এম. পি. হয়েছেন। হবার পর তিনি একজন সর্বক্ষণের সেক্রেটারির প্রয়োজন বোধ করলেন। পদপ্রার্থীদের মধ্য থেকে অমিয়কেই নেওয়া হল। নির্মলার ইচ্ছায়। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সর্বক্ষণের সেক্রেটারির কিছু কিছু কাজ সেই করছিল। অমিয়কে তার পছন্দ হয়েছিল, তার কারণ হয়তো―প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের মধ্যে অমিয়ই ছিল একমাত্র বাঙালী। নিয়োগ সন্তোষজনকই হয়েছিল। এদিকে অমিয়র সৌভাগ্যগণ যে নির্মলা তার প্রতি ঠিক কর্ত্রীসুলভ নয়, বরং সস্নেহ ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারই করত।

দুর্ঘটনার দিন সাড়ে ন’টার সময়ে অমিয় মেল-ব্যাগ থেকে নির্মলার নামাঙ্কিত একটি পুরু এনভেলাপ নিয়ে ওকে দিতে গিয়েছিল। ওটির প্রেরক কলকাতার কোন ইংরাজী দৈনিক। বক্স-নম্বরে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, প্রাপ্ত জবাবগুলি রি-ডাইরেকটেড হয়েছে। অমিয়র হাত থেকে এনভেলাপ নিয়ে মুচকি হেসে নির্মলা শুধিয়েছিল, কি বিজ্ঞাপন দিয়েছি জান?’

‘না।’

‘আমার একজন কমপ্যানিয়ন নার্সের প্রয়োজন। আমার সঙ্গে দিল্লীতে যাবে। পরের মাসে লোকসভার অধিবেশন বসছে।’

’ভালই তো।’

‘পুরো ভাল নয়। আমরা তখন আশাকে ছাড়িয়ে দেব।’

আশা অশিক্ষিত, কিন্তু বুদ্ধিমতী ও যৌবনবতী। বাঙালী অমিয় তার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলে। এই নিয়ে নির্মলা মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে।

‘আপনারা যা ভাল বুঝবেন, করবেন।’

নির্মলা হাসতে লাগল। অমিয় বিদায় নিয়ে চলে এল।

নির্মলার সেই মূর্তি চিন্তা করে অবশেষে অমিয়র দৃঢ় বিশ্বাস হল সেদিন সেই দশ মিনিটের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিল যা অভাবিত ও ক্রূর, কালো ও তীক্ষ্ণ। সঙ্কল্প করল সেই কারণটিকে সে খুঁজে বার করবে। সঙ্কল্পের কথা মিঃ টুডুর কাছে ব্যক্ত করার আগেই একটি ঘটনা ঘটল।

সে নোটিশ পেল যে এই মাস শেষ হলে তার চাকরিও শেষ। বরখাস্তের কারণ অনুল্লেখিত। কিন্তু অমিয় কারণটি অনুমান করতে পারল। মিঃ টুডুর মনে মাঝে মাঝে এই সন্দেহ উঁকি দেয় যে হয়তো তাঁর স্ত্রীর আত্মহত্যার সঙ্গে অমিয় কোনভাবে জড়িত। তাঁর সে-সন্দেহের ছায়া অমিয় লক্ষ্য করেছে ওর প্রতি তাঁর আচরণে।

নোটিশটি হাতে নিয়ে তখনি অমিয় মিঃ টুডুর সঙ্গে দেখা করল। সে জানত, প্রমাণাভাবে এখন নিজের নির্দোষিতা ঘোষণা করা মিথ্যা বাক্যব্যয়। সে বলল, ‘আপনার নোটিশ শিরোধার্য। কিন্তু আমার ইচ্ছে, মিসেস টুডুর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করি। তাতে আপনার অনুমতি, শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা চাই।’

‘পুলিশকে পূর্ণ সহযোগিতাই দিয়েছিলুম আমি।’

‘দিয়েছিলেন। অনুসন্ধান-কার্যে আমার যোগ্যতা পুলিশের চেয়ে যে বেশি তার কোন প্রমাণ নেই। তথাপি…’

‘প্রশ্ন তোমার যোগ্যতার নয়। প্রশ্ন—অনুসন্ধানের দ্বারা কি আবিষ্কার করবে তুমি?’

‘এখনও জানি না। তবে, সম্পূর্ণ অকারণ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত আমি মানতে পারছি না।’

‘তোমার থিয়োরিটা শুনি।’

‘কেউ সূক্ষ্ম কৌশলে আত্মহত্যার দিকে তাঁকে ঠেলেছিল। কিংবা তিনি নিজেই দৈবক্রমে এমন কিছু দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন বা এমন কিছু তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল যে জন্যে দুঃখে, হতাশায়, অনুতাপে তিনি আত্মহত্যা করলেন।’

মিঃ টুডু কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। শেষে বললেন, ‘আমিও অনেকটা সেই রকমই ভেবেছিলুম। কিন্তু আরো একটু ভেবেছিলুম আমি। তোমাকে স্পষ্ট বলছি। সে তোমাকে সরল মনে স্নেহ করত। তুমি কোনভাবে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কর নি তো?’

‘আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন।’ আবেগে অমিয়র গলা কেঁপে গেল।

তোমাকে সন্দেহ করার পর অনেক ভেবে বুঝলুম কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। তখন তোমার নামে নোটিশটি লিখলুম এবং স্থির করলুম অতঃপর এই কথাই জানব যে নির্মলার আত্মহত্যা সম্পূর্ণ অকারণে।’

‘অনুসন্ধানের জন্য আমি আপনার কাছে অনুমতি ভিক্ষা করছি।’

‘বেশ, কর অনুসন্ধান। আমি সর্বান্তঃকরণে সহযোগিতা করব। কিন্তু তুমি ব্যর্থ হলেও বিন্দুমাত্র দুঃখিত হব না।’

পুলিশী অনুসন্ধানের সময়ে কিছু কিছু তথ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অমিয় সেগুলির বিষয়ে মি: টুডুর মুখে শুনল। যেমন, জানলা টপকে বা অ্যাটাচড বাথরুম দিয়ে কেউ টুডুদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে নি। যেমন, সেদিন সকালে নির্মলা কারো টেলিফোন পায় নি বা কাউকে টেলিফোন করে নি। যেমন, ডাকে সে কোন আতঙ্ককর চিঠি পায় নি (প্রাপ্ত চিঠিগুলির সব কটিই তো বিজ্ঞাপনের জবাব) ইত্যাদি।

টুডুদের শয়নকক্ষের তিনটি জানলার মধ্যে একটি বাইরের, মানে বাগানের দিকে খোলে। সেই জানলার পর্দা সরিয়ে অমিয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল। ওই পথে কারো ইশারা বা চিঠি এসেছিল কি? আত্মহত্যার প্রেরণা দেয় এমন কিছু দেখেছিল কি নির্মলা? এসব জিজ্ঞাসা শুধু নিরঙ্কুশ কল্পনাকে প্রশ্রয় দেবে, তাই অমিয় ওই পথে অধিক চিন্তা করল না।

নির্মলা ডায়েরি লিখত না। একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট-বুক ছিল, অমিয় তার ইদানীন্তন এনট্রিগুলি পড়ে দেখল। নির্মলার চিঠিপত্রের ফাইল ও ব্যক্তিগত খরচের খাতা দেখল। সন্দেহজনক কিছু কোথাও নেই। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সরল জীবন ছিল নির্মলার। কোনরকম অপ্রকাশ্য ও অনুচিত আকর্ষণ ছিল না তার।

তারপর অমিয় মাথা ঘামাল টুডুদের যুগল জীবন নিয়ে। না, ওঁদের তিন বছরের দাম্পত্যে কখনো কোন ভুল বোঝাবুঝির বা একের বিরুদ্ধে অন্যের অভিযোগের কারণ ঘটেনি। দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল। মিঃ টুডুর প্রথমা স্ত্রী ছিল ইংরাজ, সে মারা যাবার দু’ বছর পর উনি নির্মলাকে বিয়ে করেন। তাঁর বয়স তখন চল্লিশ, নির্মলার আটাশ। দেরাদুনে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সে তখন শিক্ষয়িত্রী। আত্মীয়স্বজন বলতে শুধু এক বিধবা পিসীমা। তাঁর সঙ্গেই থাকত। এক ছুটিতে মিঃ টুডু দেরাদুন-মুসৌরিতে বেড়াতে গেছিলেন। সেখানেই স্কুলের এক্সকার্সন পার্টিতে তিনি নির্মলাকে দেখেন। প্রায় প্রথম দর্শনেই প্রেম। মিঃ টুডু দুটির সীমা বাড়ালেন, নির্মলার সঙ্গে এনগেজমেন্ট ঘোষণা করে তবে তিনি রাঁচি ফিরেছিলেন।

যে প্রশ্ন দিন দুয়েক আগে অমিয়কে মিঃ টুডু করেছিলেন, সেই একই প্রশ্ন এবার অমিয় ওঁকে করল। একটু অন্য ভাষায়—‘আপনাদের সংক্ষিপ্ত কোর্টশিপে আপনি হয়তো আপনার জীবনের সব কথা ওঁকে বলতে পারেন নি। সেই রকম কোন কথা হয়তো সম্প্রতি জানতে পেরে উনি আহত হয়েছিলেন।’

‘সংক্ষিপ্ত কোর্টশিপ? অবশ্যই। কিন্তু ছোকরা, সে-সময়টা আমরা ফুলবাগানে দৌড়-ঝাঁপ করে এবং পরস্পরের কানে রোমান্টিক সংলাপ আউড়ে কাটাই নি। উই ডিকাসড আওয়ার লাইভস। আমার জীবনের উত্থান-সংঘর্ষ, পতন-ভ্রান্তি ও জটিলতা ব্যস্ততার কথা মোটামুটি তাকে তখনই জানিয়েছিলুম। সবই নয় এবং সবিস্তারে নয়। কিন্তু বিয়ের পর নির্মলা আমার সব পুরোন চিঠি, দলিল ও এলবাম দেখেছে। এখন হঠাৎ নতুন কিছু আবিষ্কার করে ও ক্ষিপ্ত হবে তার সম্ভাবনা ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমার অতীতে কিংবা বর্তমানে সত্যই এমন কোন স্ক্যান্ডাল নেই যা জানতে পেরে ও আত্মহত্যা করবে। তুমি শোন, আমার কোন আচরণে বা বাক্যে আহত হয়ে সে আত্মহত্যা করে নি।’

‘ধৃষ্টতা মার্জনীয়, আমার শেষ প্রশ্ন—তাঁর জীবনের কোন অজানিত পূর্ব তথ্য কি আপনি সম্প্রতি জানতে পেরেছিলেন বা জানবেন এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল যে জন্য তিনি…’

অমিয়কে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাথা এবং হাত নেড়ে মিঃ টুডু বললেন,‘না, না।’

অমিয় আশাকে জেরা করল। নতুন কোন তথ্যই পাওয়া গেল না। পুলিশকে সে আগেই জানিয়েছে যে সেদিন সকালে কর্ত্রীর মধ্যে কোনরকম ভাববৈলক্ষণ্য সে দেখে নি—অন্যমনস্কতা বা দুশ্চিন্তা। কোনরকম ব্যস্ততা লক্ষ্য করেছিল কি―আশার হাতের দুধটুকু শেষ করতে বা তাকে ঘর থেকে তাড়াতে? মোটেই না। তাঁর কোন কথায় কি মনে হয়েছিল যে তিনি কিছুর বা কারো প্রতীক্ষা করছেন? না তো।

অমিয় ট্রাভেলিং সেলসম্যানটির সঙ্গেও দেখা করল। ফার্নিচার কোম্পানীর হেড অফিস রাঁচিতেই। ছোকরার নাম উইলিয়াম ব্যানার্জি। প্রথম দর্শনেই চোখ যায় তার একমাথা সোনালী চুল ও নীল চোখের দিকে। চিবুক-নাকের গড়ন সুন্দর। হয়তো য়ুরোপীয়। ছেলেটির মুখের ভাব কিন্তু লোভী ও রুক্ষ। হয়তো ভাল শিক্ষা পায় নি, সঙ্গ খারাপ এবং আবাল্য জীবিকার জন্য ঘুরছে। ছেলেটি বাংলা জানে না। অমিয়র প্রশ্নের জবাবে বলল তার বয়স ষোল। তারপর অমিয় কাজের কথায় এল। মিসেস টুডুকে সে ওই একবারই দেখেছে―তাও মিনিট পাঁচেকের জন্য। আগে থেকে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না। ঘরে ঢুকে তাঁকে অভিবাদন করে সে নিজের আগমনের উদ্দেশ্য জানিয়ে কোম্পানীর ক্যাটালগ এগিয়ে দিয়েছিল। উনি তাকে বসতে বলেছিলেন। ও বসলে কিছুক্ষণ ওকে দেখে বলেছিলেন, ভারি সুপুরুষ সে। শুধিয়েছিলেন, সে পড়াশোনা করে কিনা এবং সেলসম্যানশিপ তার পার্টটাইম জব কিনা। সে বলেছিল, না, ফুলটাইম। ও যে খ্রীস্টান অনাথালয়ে মানুষ, তাও বলেছিল। উনি বলেছিলেন, ‘আহা!’ তারপর ক্যাটালগ দেখে তিনি নিজের পছন্দ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সম্ভবত সেদিনই বিকেলে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী কোম্পানীর শো-রুমে গিয়ে জিনিস দেখে ফাইনাল অর্ডার দিয়ে আসবেন। ও পুনরাভিবাদন করে চলে এসেছিল।

তারপর অমিয় ডাঃ বোসের সঙ্গে দেখা করল। ওর কয়েকটি প্রশ্ন ছিল। সেগুলির একটি ; ‘বলুন, এমন কি হতে পারে না, কোন জটিল শারীরিক পীড়ায় মিসেস টুডু বা অজ্ঞাত সন্তানের অচির ও অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল? হয়তো সন্দেহ হবার পর তিনি শহরের অন্য ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন?’

‘অসম্ভব। শুধু ডাক্তার হিসেবে বলছি না। ওর কোনরকম সন্দেহ হলে, আমি বন্ধুস্থানীয়, আমাকে সে বলত। গোপন করার প্রবণতা তার স্বভাবে ছিল না।’

‘আকস্মিক বুদ্ধিবিকারের থিয়োরি সম্বন্ধে আপনার মতামত বলুন।’

‘ও নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। বই পড়েছি এবং মনস্তত্ত্ববিদ ও উন্মাদ রোগ বিশেষজ্ঞ―রাঁচিতে তাঁদের অভাব নেই―দু-একজনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রেগন্যান্সির সময়ে কারো কারো সাময়িক বুদ্ধিবিকার ঘটে, কিন্তু এমন বিনা ওয়ার্নিংয়ে ঘটে না, মুহূর্তে এমন প্রলয়ঙ্কর রূপ ধরে না। এত কথার প্রয়োজন কি, তার শেষ চিরকুটটিই তো প্রমাণ করে যে তার বুদ্ধিভ্রংশ হয় নি।’

অমিয় নীরবে শুনছিল।

ডাঃ বোস শুধোলেন,‘তোমার কোন থিয়োরি আছে নাকি!’

‘বাইরের কোন কারণ আছে তাঁর আত্মহত্যার পেছনে।’

‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই কারণটি ঘটিয়েছিল?’

‘আমার অনুসন্ধান শেষ হয়নি।’

এবার ডাঃ বোস উত্তেজিত স্বরে বললে, অসম্ভব। নির্মলাকে চিনত এমন কারো পক্ষে অত নিষ্ঠুরতা সম্ভব নয়।’

অমিয় নীরব রইল।

‘তাহলে একটি সিদ্ধান্তই অনিবার্য—প্রবল ও ভীষণ কোন হতাশা বা অনুতাপ। প্রিয় স্বামীর সন্তান তার গর্ভে―এটা ছিল তার কাছে একটি পবিত্র দায়িত্ব ও পরম গৌরব। তা সত্ত্বেও সেই হতাশা বা অনুতাপ হয়তো নিজের ওপর, নিজের স্বামী-সন্তানের ওপর, সমগ্র বিশ্ব-সংসারের ওপর দুর্দান্ত কোন রাগ ও ঘৃণা তাকে আত্মঘাতিনী হতে বাধ্য করল।’

অমিয় চুপ।

‘মিস্টার টুডু সব দিক চিন্তা করেই তোমায় অনুসন্ধানের অনুমতি দিয়েছেন তো?’

‘তাই তো মনে হয়।’

‘আমার পরামর্শ―অনুসন্ধানে কাজ নেই।’

‘আমার নিজের গভীরতম শ্রদ্ধা স্বর্গীয়া মিসেস টুডুর প্রতি। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে ‘আমার অনুসন্ধানের ফল–যদি কোন ফল পাই―প্রকাশ করতে আমি বাধ্য নই। আমি স্বেচ্ছানিযুক্ত।’

এইবার অমিয় নির্মলার বিয়ের আগের জীবন নিয়ে অনুসন্ধান আরম্ভ করল। তথ্য অতি অল্প। এবং জটিলতা কিছুই নেই। মিঃ টুডু আগেই অমিয়কে বলেছিলেন যে নির্মলার নিস্পাপ সুন্দর মুখ, মধুর ব্যবহার, উদার মতামত, এসবেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। শিশুদের সে প্রিয় ছিল এবং তাদের মাঝখানে তাকে স্বর্গোদ্যানে দেবী বলে মনে হত। ওর সহকর্মিনীদেরও ওর প্রতি মনোভাব ছিল অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও প্রীতির। মিঃ টুডু নিশ্চিত যে নির্মলা ওঁর যশ বা অর্থে আকৃষ্ট হয় নি। মানবিক গুণেই হয়েছিল। পরিচয়ের প্রথম দিকে সে কিংবা তার পিসীমা দুজনের কেউই ভদ্রতার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখান নি। মিঃ টুডুর আগ্রহ না থাকলে আত্মীয়তা হত না।

এখন অমিয় শুনতে চাইল নির্মলার পরিবার, বাল্য ও শিক্ষার ইতিহাস। মিঃ টুডু যতটুকু জানেন বললেন। সে খুব ছেলেবেলাতেই মা ও বাবাকে হারিয়েছিল। তারপর বছর পাঁচেক বয়স থেকে পিসী মিসেস শোভা সেনের কাছে মানুষ। প্রথমে বেনারসে, তারপর বছর ষোল বয়স থেকে দেরাদুনে। মিঃ সেন কবিরাজী করতেন। দেরাদুনে ছোট একটি বাড়ি করেছিলেন। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। সেনেরা নিঃসন্তান। নির্মলার অনুরোধে মিঃ টুডু মিসেস সেনকে মাসোহারা দেন। পিসীকে নির্মলা ভক্তি করত। তাঁর কথা বিবেচনা করেই হোক, বা অন্য কি কারণে, মিঃ টুডু জানেন না সে কেন অত বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিল। কিন্তু সে জন্যে তাকে একটুও অসুখী বলে মনে হত না। সে যে এত সুন্দর, সে বিষয়েও যেন সে সচেতন ছিল না। বিয়ের পর নির্মলা পিসীকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল। তিনি রাজী হন নি। অমিয় অনুমান করল―এক আপত্তি তো জামাইবাড়ি, দ্বিতীয়ত আদিবাসী খ্রীস্টানের বাড়ি বলে। টুডুরা দিল্লীতে থাকলে মাঝে মাঝে মোটরে দেরাদুন যেতেন। নির্মলা যেখানেই থাকুক বা যত ব্যস্তই হোক, প্রতি সপ্তাহে পিসীকে চিঠি লিখত। আত্মহত্যার দু-দিন আগে সে তার শেষ চিঠিটি লিখেছিল। তিনি সে চিঠি জামাইকে ফেরত পাঠিয়েছেন। অমিয় পড়ে দেখল, অত্যন্ত সুখী গৃহিণীর সাধারণ চিঠি। মিসেস সেন স্পষ্টই লিখেছেন যে নির্মলার আত্মহত্যার কোন কারণই তিনি ভাবতে পারছেন না। তার বিবাহিত জীবনে কোন অভাব, দুশ্চিন্তা বা অভিযোগ ছিল বলে তিনি কখনো আভাস পান নি।

অমিয় মিসেস সেনকে একবার কিছুক্ষণের জন্য দেখেছে। কোন কাজে সে দিল্লী থেকে দেরাদুন গিয়েছিল। নির্মলা তখন তার হাত দিয়ে পিসীর জন্য কিছু উপহার এবং একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। সাক্ষাতের সেই অল্প সময়ের মধ্যেই কিন্তু অমিয় ওঁর সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করেছিল।

মিসেস সেন লেখাপড়া জানেন, নার্সিংয়ে কিছু ট্রেনিংও আছে। বুদ্ধিমতী, আলাপে পটু এবং ব্যবহারে নিখুঁত। কিন্তু যে মেয়েকে তিনি তাঁর পাঁচ বছর বয়স থেকে নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছেন, তার প্রতি তাঁর স্নেহে যেন কিছু কৃত্রিমতা আছে। মিঃ টুডুর প্রতি তিনি কি প্রসন্ন নন? নিজের চেষ্টায় তিনি কোনকালে নির্মলার জন্য পাত্র সংগ্রহ করতে পারলেও এত ভাল পাত্র পেতেন কোথায়! শোকসংবাদ পেয়ে শুধু পত্রে সান্ত্বনা দেবার পরিবর্তে তাঁর উচিত ছিল না কি এখানে ছুটে আসা? তিনি তো অথর্ব নন।

অমিয় স্থির করল মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু আগে থেকে কোন সংবাদ পাঠাল না। মাস শেষ হতে সে মিঃ টুডুর চাকরি ছেড়ে দিল। উনি বাধা দিলেন না। যদিও অমিয়র প্রতি তাঁর মনোভাব আবার প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। ওকে তিনি সুপারলেটিভস্‌-এ পূর্ণ একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন এবং নগদ মাইনের অতিরিক্ত দু-হাজার টাকার একটি চেক। অমিয় এখন বেকার, তাই চেকটি নিল। সেই রাত্রেই সে দেরাদুনে রওনা হল।

অমিয় মিসেস সেনের সামনে তাঁকে নমস্কার করে দাঁড়াতে তিনি ওকে চিনতে পারলেন।

‘তুমি দিল্লী থেকে আসছ?

‘আজ্ঞে না। সোজা রাঁচি থেকে।’

‘কেন?’

‘বলছি। আশঙ্কা করি, আমার আলোচনা আপনার পক্ষে খুব প্রীতিকর হবে না।’

‘সে কি আমার মাসোহারা বন্ধ করে দিতে চায়?’

শুনে অমিয়র খুব খারাপ লাগল।

‘আজ্ঞে না, তাঁর ইচ্ছে তাঁর স্ত্রীর আত্মহত্যার কারণ নিয়ে অনুসন্ধান হোক। আমি সেই অনুসন্ধানের জন্যে এসেছি।’

‘আমি তো ওকে লিখেছি যে আত্মহত্যার কি কারণ হতে পারে আমার মাথায় আসছে না।’

‘মিসেস টুডুর অতীত নিয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন।’

অমিয় স্পষ্ট দেখল, ওঁর মুখে পরপর সন্দেহ, ভয় ও বিরুদ্ধতা ছায়াপাত করল। শেষ পর্যন্ত তিনি সে-মুখকে যথাসম্ভব ভাবলেশহীন করে অমিয়র বক্তব্য শোনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

‘ওঁর প্রাগবিবাহ জীবনে কখনো কোন বড় রকম নৈরাশ্যের ঘটনা ঘটেছিল কি?’

‘মানে?’

‘এই ধরুন, ব্যর্থপ্রেম বা কোন বিয়ের সম্বন্ধ শেষ মুহূর্তে ভেঙে যাওয়া।’

‘না।’

‘কিন্তু একটু বেশি বয়স পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন।’

‘হ্যাঁ। তার কারণ—আমাদের পয়সা ছিল না এবং সে নিজে কোন পুরুষকে ভুলিয়ে বিয়ে করবে, তাকে আমি সে শিক্ষা দিই নি।’

‘ওঁর মধ্যে আগে কখনো পাগলামির বা আত্মহত্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করেন নি?’

‘না।’

‘ওঁর সঙ্গে রক্ত-সম্পর্কে নিকট কারো মধ্যে সে-প্রবণতার ইতিহাস আছে কি?’

‘না।’ কিছু চিন্তা না করেই জবাব দিলেন। মিথ্যা বললেন? অমিয়র জেরার হাত থেকে যথাসম্ভব শিগগিরই বাঁচতে চাইছেন?

‘ওঁর মা কিভাবে মারা যান?’

‘ওঁর মা…’ উনি এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করছিলেন, অমিয় আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল।

‘প্লীজ, সত্যি কথা বলবেন।’

‘দাদা আমায় বলেন নি।’

‘তিনি নিজে কিভাবে মারা যান?’

‘বিদেশে মারা যান। আমি বিস্তারিত খবর পাই নি।’

‘বিদেশে? তাহলে নির্মলা কিভাবে আপনার তত্ত্বাবধানে এলেন একটু বুঝিয়ে বলুন তো।’

এবার মিসেস সেন রাগ দেখালেন, ‘তুমি কি জানতে চাও বল তো? ওর আত্মহত্যার সঙ্গে ওর বাবা-মার মৃত্যুর কি যোগ?’

‘যোগ আছে কিনা সেটা আমার মনিব মিস্টার টুডু বুঝবেন।’

মিঃ টুডুর উল্লেখে কাজ হল। মিসেস সেন বিরস মুখে শুধালেন, ‘তুমি যেন কি জানতে চাইছিলে?’

‘দরকার নেই। আপনার দাদার নাম ও শেষ ঠিকানা বলুন। আমি যা জ্ঞাতব্য সেখান থেকেই জানব।’

মিসেস সেন বুঝলেন মিথ্যা কথা বলে বেশিক্ষণ পার পাবেন না। বলে ফেললেন, ‘আমি জানি না।’

‘কি জানেন না?’

‘ওর বাবার ঠিকানা।’

‘মানে?’

‘তাঁর সঙ্গে আমার কোন আত্মীয়তা বা পূর্ব-পরিচয় ছিল না।’

অমিয় আকাশ থেকে পড়ল।

‘প্লীজ, একটু বুঝিয়ে বলুন।’

‘নাম হরিদাস মুখুজ্যে। দশ বছর আগে তিনি মারা গেছেন।’

‘তাঁর মেয়ে আপনার কাছে এল কি করে?’

‘তিনি খবরের কাগজে বক্স নম্বরে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে, তাঁর অসুস্থ মেয়েটির দায়িত্ব নিতে হবে। সে জন্য তিনি মোটা টাকা দিতে রাজী। আমরা তখন কাশীতে। আমি বিজ্ঞাপনের জবাব দিলুম। তারপর একদিন হরিদাসবাবু স্বয়ং হাজির। তিনি আমাদের বিষয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তাঁর প্রধান বক্তব্য ছিল যে মেয়েকে তিনি কখনো নিয়ে যেতে পারবেন না। তার সঙ্গে চিঠিপত্রে বা অন্য কোনভাবেও সম্পর্ক রাখবেন না। নির্মলাকে আমি নিজের মেয়ে বলে বা যা-খুশি বলে পরিচয় দিতে পারি। কথাবার্তা এই পর্যন্ত। তিনদিন পরে তিনি মেয়েকে নিয়ে এলেন। আমরা যা টাকায় রাজী হয়েছিলুম তিনি তা নগদ এনেছিলেন। টাকার অঙ্ক এবং আমরা যে তাঁর মেয়ের ভার নিচ্ছি এই কথা আমি একটি কাগজে লিখে সই করে দিলুম। কিন্তু কোন সাক্ষী রইল না। তিনি মেয়েকে রেখে চলে গেলেন।’

অমিয় কিছুক্ষণ ভাবল। মিসেস সেন নিশ্চয়ই সত্য বলছেন, কিন্তু নির্মলার আত্মহত্যার রহস্যের ওপর এ আবার এক নতুন রহস্য। দুটো রহস্যের মধ্যে কোন যোগ আছে নাকি?

‘মেয়ে যে হরিদাসবাবুরই তার কোন প্রমাণ আপনি পান নি?’

‘না।’

‘কেমন মানুষ ছিলেন তিনি?’

‘তাঁকে দেখে বড়লোক ও বদমায়েস বলে মনে হয় নি। কর্মচারী বা লোভী দালালও তিনি নন। আমরা স্বামী-স্ত্রী বিশ্বাস করেছিলুম যে নির্মলা ওঁর নিজেরই মেয়ে।’

‘মেয়েকে কেন তিনি ত্যাগ করলেন তার কোন কারণ তিনি আপনাদের বলেন নি?’

‘বলেছিলেন যে পুরোন সব সম্পর্ক মুছে ফেলে তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন, মনে হয় মিথ্যা বলেছিলেন। তাঁর হাবেভাবে সাহেবিয়ানা কিছু ছিল না। বাঙালী সাধারণ গৃহস্থের মত। তাঁর তখন বয়সও হয়েছিল—আন্দাজ বছর পঁয়তাল্লিশ। আরো একটি কথা—তাঁর মৃত্যু-সংবাদ বিদেশ থেকে আসে নি। এসেছিল চব্বিশ পরগণার কোন গ্রাম থেকে।’

‘কে পাঠিয়েছিল সে-সংবাদ?’

‘তোমায় চিঠিটা দেখাই।’

মিসেস সেন উঠে তাঁর চাবিবন্ধ ট্র্যাঙ্ক খুলে হাতড়ে একটি খাম বার করে সেটি অমিয়র হাতে দিলেন। ভেতরের চিঠিতে পত্র-প্রেরক নিজের নাম-ঠিকানা দেন নি। শুধু লিখেছেন—‘সংক্ষিপ্ত রোগভোগের পর হরিদাস মুখুজ্জে পরশু মারা গেছেন। তাঁর মেয়েকে কিছু বলার দরকার নেই। তার কল্যাণ হোক।’ তলায় তারিখ। পুনশ্চ দিয়ে লেখা—‘উনি স্থাবর বা অস্থাবর কোন সম্পত্তিই রেখে যান নি।’

অমিয় লক্ষ্য করল খামের ওপর ঠিকানা দেরাদুনের। মানে, হরিদাসবাবু কারো মারফত বা নিজেই লুকিয়ে মেয়ের খবর নিতেন। সেনেদের ঠিকানা পরিবর্তনের খবর জানতেন।

অমিয় বলল, ‘খামসুদ্ধ চিঠিটা আমি নিলুম।’

‘নেবে? আচ্ছা, নাও। নির্মলা যখন নেই ওসব আর কার কাজে লাগবে।’

অমিয় ভাবছিল, হরিদাসবাবু যে কেন মেয়েকে হস্তান্তরিত করেছিলেন সে-রহস্যের ওপর আলোকপাত হল না।

‘তাঁকে কি স্নেহ-মমতাশূন্য পিতা বলে মনে হয়েছিল?’

‘না। মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় তিনি কান্নাকাটি করেন নি বটে, কিন্তু তার কারণ বোধ হয় এই যে তাঁর চোখের জল সব শুকিয়ে গিয়েছিল। মেয়ের জন্য পরিশ্রমে ও দুর্ভাবনায় তাঁকে মলিন ও ক্লান্ত লাগছিল।’

‘নির্মলার অসুখটা কি ছিল?’

‘মাথার অসুখ। না, পাগলামি নয়। স্মৃতিলোপ। হরিদাসবাবু বুঝিয়েছিলেন যে কিছুকাল আগে এক ভীষণ ট্রেন দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে তার অমন হয়েছে। দুর্ঘটনা এবং তার আগেকার কোন কথা তার মনে নেই। স্মৃতিলোপের পর নিজের বাবার সঙ্গে দেখা হতে সে তাঁকে পর্যন্ত চিনতে পারে নি।’

অদ্ভুত ব্যাপার বটে! কিন্তু অমিয় যতদূর অবাক হতে পারে ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। বলল, ‘পাঁচ বছরের মেয়ের স্মৃতির ঘরে জমাই বা কতটুকু?’

‘এই দেখ, আমি এতক্ষণ বলতে ভুলে গেছি। নির্মলাকে আমি যখন আশ্রয় দিই তখন তার বয়স ছিল পাঁচ নয়, পনের। বড় জোর ষোল।’

‘প্রায় কৈশোরোত্তীর্ণা। অমিয়র মুখ থেকে স্বতঃই ছিটকে বেরুল।

‘হ্যাঁ। কিন্তু স্মৃতিভ্রষ্টা। শিশুর মত নিষ্পাপ, সরল ও অসহায়। আমাদের বাড়ি যখন এল আমি ওকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলুম, আমার কাছে থাকতে তার ভাল লাগবে কি না। সে মুখে কোন জবাব দিল না। শুধু আমার একটি হাত জড়িয়ে ধরে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল আর. আমার মুখের দিকে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে তাকাল।’ বলতে বলতে মিসেস সেনের গলা বুজে এল।

একটু বিরতি দিয়ে অমিয় শুধাল, ‘তারপর কোনদিন আপনি কোন কথায় আভাস পান নি যে তাঁর শৈশব-স্মৃতি ফিরে আসছে কি না?’

‘না।’

‘তাঁকে নিয়ে আপনি কখনো কোন অসুবিধায় পড়েন নি?’

‘না। সে আমাদের অভাবের সংসারে লক্ষ্মীর মত এসেছিল। ওকে নিয়ে আমরা কাশী থেকে দেরাদুনে এসে নতুন জীবন আরম্ভ করলুম। হরিদাসবাবুর দেওয়া টাকায় এই বাড়ি তৈরি করলুম। ওঁর কবিরাজী-প্র্যাকটিসও আস্তে আস্তে জমল। নির্মলা দুর্ঘটনার আগে নাইন-টেনের কিংবা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী ছিল বোধ হয়। কয়েক মাসের মধ্যে পড়ালেখা যা শিখেছিল সব ওর মনে পড়ল। শুধু হিন্দী জানত না।’

‘আপনি হরিদাসবাবু বা তাঁর মেয়ের বিষয়ে আর কিছু তথ্য আমাকে দিতে পারেন না?’

মিসেস সেন কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘একটি কথা। আমার মনে হয় ট্রেন-দুর্ঘটনার গল্পটা বানানো। নির্মলার কখনো ট্রেন সম্পর্কে ভয় লক্ষ্য করি নি। দ্বিতীয়ত ও আমার কাছে আসার পূর্ববর্তী কয়েক মাসের মধ্যে ভারতবর্ষে কোন বড় ট্রেন-দুর্ঘটনা ঘটে নি।’

আরো কিছুক্ষণ সাধারণ কথাবার্তার পর অমিয় বিদায় নিল। রাত্রে ট্রেনে ওর চোখে ঘুম এল না। ঘুরে ফিরে ওর মনে যে প্রশ্নটি জাগছিল—হরিদাসবাবু কেন মেয়েকে হস্তান্তরিত করেছিলেন? ভেবে ঠিক করল যে নির্মলার স্মৃতিলোপের কারণটি জানতে পারলেই হরিদাসবাবুর অদ্ভুত আচরণের অর্থ পাওয়া যাবে। সে যখন দেরাদুন এক্সপ্রেস থেকে হাওড়ায় নামল ততক্ষণে ওর মনে আরো একটি সন্দেহ দানা বেঁধেছে—নির্মলা আত্মহত্যার পূর্বে হয়তো ওর লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পেয়েছিল। সেটাই আত্মহত্যার কারণ। কোন ধ্বংস বা কারো পাপের স্মৃতি কি সে দীর্ঘকাল ভুলে ছিল?

কলকাতায় পৌঁছে অমিয়র প্রথম কাজ হল, খোঁজ নেওয়া যে মিসেস সেনের কাছ থেকে সংগৃহীত খামে যে-পোস্টাপিসের ছাপ সেটি কোথায়। প্রথমে পোস্টাল ডায়রেক্টরি দেখে এবং তারপর আলিপুর পোস্টাপিসে ফোন করে খোঁজ পাওয়া গেল। কলকাতা থেকে বাসে ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে এগিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে অমিয় গন্তব্যস্থলে পৌঁছল। রাস্তার বাঁ দিকে গ্রাম, ডান দিকে অনেকখানি জায়গা ঘিরে বিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, মন্দির, দাতব্য-চিকিৎসালয় ইত্যাদি। পরিচালনায় একটি হিন্দু মিশন। শোনা গেল যে পোস্টাপিসটিও মিশনের সীমানার মধ্যে।

তখন সকাল প্রায় দশটা। অমিয় পোস্টাপিসের সামনে পৌঁছল। দরিদ্র ও নিরীহ, বছর পঞ্চাশ বয়সের পোস্টমাস্টার কর্মব্যস্ত। অমিয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর পোস্টমাস্টার যখন পোস্টাপিসে তালা লাগিয়ে দ্রুত বাড়িমুখো হলেন, সে তাঁর দিকে এগোল।

‘নমস্কার। আপনাকে পাঁচ মিনিট বিরক্ত করব।’

উনি বিপন্ন মুখে বললেন, ‘সাড়ে দশটায় আমার স্কুল যে!’ মানে, তিনি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারও।

‘আপনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিই। আপনার আপত্তি নেই তো? চলুন।’

পোস্টমাস্টার এগোলেন। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের কথা হল।

‘স্বর্গীয় হরিদাস মুখুজ্যের বিষয়ে আমি জানতে চাই।’

‘বলেন কি? তিনি বেঁচে থাকতে কেউ তাঁর খোঁজ নিতে আসত না, চিঠি লিখত না, আজ হঠাৎ আপনার উদয়?’

‘তিনি আমার পিতার বাল্যবন্ধু। আমি ডায়মন্ডহারবারে কাজে যাচ্ছি। বাবা ওঁর বিষয়ে খোঁজ নিতে বললেন। বাস থেকে নেমে প্রথমে যাঁকে ওঁর নাম বললুম তিনি জানালেন, হরিদাসবাবু দশ বছর আগে মারা গেছেন। তারপর আপনাকে ধরেছি।’

‘ওহো, তা কি জানতে চান আপনি?’

‘তাঁর ঠিকানা।’

‘গ্রামে বামুনপাড়ায় ওঁর বাড়ি ছিল। মেয়ের চিকিৎসার খরচের জন্যে সে-বাড়ি জলের দরে বিক্রি করে দিলেন। তারপর থেকেই এই মিশনেরই একটা ঘরে থাকতেন আর হাইস্কুলে মাস্টারি করতেন।’

‘এখন তাঁর পরিবারের কে আছেন?’

‘কেউ নেই। থাকবার মধ্যে তো ছিল তাঁর মা-মরা এক মেয়ে ছবি। আজ থেকে পনের-ষোল বছর আগে সে মারা যাবার পর তিনি শোকে-দুঃখে আধ-পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তখন এবং তারপর তাঁর মৃত্যুর সময়ে বা সে-মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর কোন আত্মীয় বন্ধুর টিকি দেখা যায় নি। আপনি আর কি জানতে চান?’

‘তাঁর মেয়ের চিকিৎসা ও মৃত্যু গ্রামে হয় নি নিশ্চয়।’

‘না। রাঁচিতে।’

‘রাঁচি!’ অমিয় লাফিয়ে উঠেছে। ‘মাথার অসুখ নাকি?’

‘কানাঘুষো ছিল টি. বি. বলে।’

মানে, ট্রেন দুর্ঘটনা আর টি. বি. রোগ, দুটো গল্পই হয়তো বানানো। কিন্তু রাঁচির উল্লেখ বড় বিস্ময়কর। এই গ্রাম, রাঁচি, কাশী, দেরাদুন, তারপর আবার রাঁচি—এই বৃত্তের কি কোন তাৎপর্য আছে?’

অমিয় শুধাল, ‘হরিদাসবাবু ছবিকে নিয়ে রাঁচিতেই গেছলেন আপনার ঠিক মনে আছে?’

‘লোকে তাই বলে ভাই। মিশনের স্বরূপ মহারাজ এককালে রাঁচিতে ছিলেন। ওখানকার টি. বি. হাসপাতালে এখানকার অনেক রুগী ওঁর সুপারিশে গিয়ে ভর্তি হয়েছে।’

কিংবদন্তীর ওপর কিংবদন্তী। তার আড়ালে স্মৃতিলুপ্ত এক কিশোরীকে নিয়ে তার বাবার নিষ্ঠুর নাটক।

অমিয় সাগ্রহে শুধাল, ‘আচ্ছা, স্বরূপ মহারাজের দেখা পাওয়া যায় না?’

পোস্টমাস্টার আঙুল তুলে একদিক দেখালেন, ‘ওই দিকে যান। উনি রুগী দেখছেন।’

হঠাৎ অমিয়র মাথায় একটি বুদ্ধি জোগাল। সে পকেট থেকে খামটি বার করল।

‘দেখুন তো, হাতের লেখাটা বোধ হয় স্বরূপ মহারাজেরই?’

ভাল করে দেখে পোস্টমাস্টার বললেন, ‘হ্যাঁ। মিসেস শোভা সেন কি আপনার মায়ের নাম?’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। আচ্ছা, আপনার কাছ থেকে অনেক দরকারী কথা জানা গেল। আপনার স্কুলে দেরি না হয়ে যায়। নমস্কার।’

অমিয় এবার মিশনের ডিসপেনসারির দিকে যাবে বলে পা বাড়াল। পোস্টমাস্টার একটু বিস্ময় ও সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ডিসপেনসারির বারান্দায় চেয়ারে বসে স্বরূপ মহারাজ রোগী দেখছিলেন। সামনে একটি ছোট টেবিল এবং অদূরে রোগীদের বসবার জন্য একটি বেঞ্চ। অমিয় বারান্দায় না উঠে একটু দূরে একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে রইল। মহারাজ একবার ওর দিকে তাকালেন, অমিয় চোখের ইঙ্গিতে জানাল যে ওঁর সঙ্গেই ওর দরকার বটে এবং সে অপেক্ষা করবে। রোগীরা একে একে বিদায় হল। কম্পাউন্ডার ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে চলে গেল। মহারাজ টেবিলে ওপর থেকে একটি মোটা বাঁধান খাতা নিয়ে তাতে কি লিখতে লাগলেন। অমিয় তখন বারান্দায় উঠে ওঁকে নমস্কার করল।

উনি প্রতি-নমস্কার করলেন। ওঁর লেখার কাজ শেষ হয়েছিল। খাতা বন্ধ করলেন।

‘বলুন।’

অমিয় পকেট থেকে চিঠি সমেত খামটি বার করে এগিয়ে দিল। উনি চিঠিটি বার করে পড়ে সেটিকে আবার খামে ভরে খামটি অমিয়কে ফেরত দিলেন।

‘হ্যাঁ, কি জানতে চান বলুন।’

‘আমার আশা, হরিদাসবাবু ও তাঁর মেয়ের রহস্য আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার হবে।’

‘তিনি তাঁর মৃত্যুশয্যায় ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন আমি যেন তাঁর মৃত্যু-সংবাদটি দেরাদুনের মিসেস সেনকে জানাই। ঠিকানা দিয়েছিলেন। আমি আর কিছু জানি না।’

অমিয় বুঝল সন্ন্যাসী প্রশান্ত মুখে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলবেন, তবু সত্য প্রকাশ করবেন না।

‘হরিদাসবাবু যখন চিঠিটি ডিকটেট করছেন, আপনি প্রথম জানলেন যে মিস মুখার্জি বেঁচে?’

‘হ্যাঁ।’

‘মিথ্যা মৃতু-সংবাদ তিনি কেন রটনা করেছিলেন সে-বিষয়ে তিনি আপনার কাছে কোনরকম ব্যাখ্যা দেন নি?’

‘না। তিনি তখন তাঁর সত্য মৃত্যু-শয্যায়।’

ব্যঙ্গটিকে গায়ে মাখল না অমিয়।

‘তারপর এই আজ পর্যন্ত আপনি মিস মুখার্জির বিষয়ে কারো কাছ থেকে বা কোন সূত্র থেকে কিছু জানেন নি?’

‘না। শুনুন মিস্টার, আপনি প্রথমেই ভুল করছেন। হরিদাসবাবুর সঙ্গে আমার কোনরকম ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল না। ছবিকে আমি একদিন—সেই একদিনই—ডাক্তার হিসেবে পরীক্ষা করেছিলুম। তার কয়েক মাস পরে তিনি আশ্রমে এসে থাকতে লাগলেন। অনেক মাস্টারই থাকেন। আমি খবর রাখি না। লোক মুখে যেন শুনেছিলুম ছবি মারা গেছে। ওঁকে ডেকে সান্ত্বনা দেওয়া বা কিছু জিজ্ঞাসা করা আমার দ্বারা সম্ভব হয় নি। উনিও কোনদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে কিছু শুনিয়ে যান নি। তারপর একদিন তাঁর মৃত্যুশয্যা-পার্শ্বে আমার ডাক পড়েছিল। ডাক্তার হিসেবে। আপনি আমার কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হলেন কি?’

অমিয় সন্তুষ্ট হয় নি। কিন্তু হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না সে।

‘আপনি কোন অধিকারে আমাকে জেরা করছেন, জানতে পারি কি?’

‘আপনাকে বলতুমই। এতক্ষণ বলার সুযোগ করে নিই নি বলে ক্ষমা করবেন। মিস মুখার্জি পরবর্তী জীবনে ছোটনাগপুরের এম, পি, মিস্টার এডোয়ার্ড টুডুর স্ত্রী। গত মাসের বারোই তিনি তাঁর রাঁচির বাড়িতে কোন অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমি টুডুদের সেক্রেটারি ছিলুম। বর্তমানে মিসেস টুডুর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করছি।’

‘তারপর?’

‘মিস মুখার্জি তাঁর পনের-ষোল বছর বয়সে স্মৃতিভ্রষ্টা হন। কেন এবং কি পরিস্থিতিতে জানা যাচ্ছে না। অসম্ভব নয় যে তাঁর স্মৃতিভ্রংশ, তাঁর পিতা কর্তৃক তাঁকে ত্যাগ এবং এত বৎসর পরে তাঁর আত্মহত্যা এ-সবের মধ্যে একটা যোগ আছে।’

‘অসম্ভব নয় বটে, কিন্তু সে-যোগ আবিষ্কৃত হলে কার কি লাভ হবে বুঝতে পারছি না।’

‘আপনাকে স্পষ্ট বলি, দুর্ঘটনার পর মিস্টার টুডু আমার বিশ্বস্ততায় সন্দেহ করেছিলেন। আমিও নানারকম সন্দেহ করছিলুম। তারপর উনি যখন আমায় বরখাস্তের নোটিস দিলেন, আমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি যে আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বার করবই। লাভ এই পর্যন্ত, ক্ষতি কারো দেখছি না।’

স্বরূপ মহারাজ কিছুক্ষণ অমিয়র কথাগুলি নিয়ে চিন্তা করলেন। তাঁর মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব বোঝা যাচ্ছিল না।

শেষে বললেন, ‘দুঃখিত, আপনার গোয়েন্দাগিরিতে সাহায্য করবে এমন কোন তথ্য আমি আপনাকে দিতে পারছি না।’

‘রটনা যে মিস মুখার্জির টি, বি, হয়েছিল। আপনি কি ওঁকে পরীক্ষা করেছিলেন?’

‘একদিন মাত্র। যতদূর স্মরণ হয়, দেখেশুনে আমি হরিদাসবাবুকে বলেছিলুম কলকাতা থেকে ওর রক্ত কফ পরীক্ষা করিয়ে এবং বুকের ছবি তুলিয়ে আনতে। তিনি আমার পরামর্শ গ্রাহ্য অথবা অগ্রাহ্য করেছিলেন কিনা আমি বলতে পারি না। সকন্যা বা একা তিনি আমার কাছে আর আসেন নি।’

অর্থাৎ চতুর স্বরূপ মহারাজ রটনাটির সত্যতা সম্বন্ধে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। অমিয় নিশ্চিত হল ছবির টি. বি. হয় নি।

‘অধিকন্তু রটনা যে হরিদাসবাবু চেঞ্জের জন্য মেয়েকে রাঁচিতে নিয়ে গেছিলেন। সে বিষয়ে আপনি নিশ্চয় কিছু জানেন?’

‘হাউ ইজ দ্যাট? আমি কেন জানতে যাব?’

‘তাও তো বটে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুটি রটনার সত্যতা যে-কোন মুহূর্তে যাচাই করা যেত। আপনি এবং হরিদাসবাবু দুজনেই আশ্রমবাসিন্দা ছিলেন। তবু রটনা সত্যের মর্যাদা পায় নি।’

‘আশ্চর্যের বিষয় নয়। আমি পরচর্চা করি না, পূজাপাঠ ও রোগী-দেখা নিয়ে থাকি। হরিদাসবাবু কোনদিনই দিলখোলা ও আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন না। মেয়ের মৃত্যু-সংবাদ রটনা করার পর তো প্রায় মানব-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। তিক্ত ও রুক্ষ। তাঁর মেয়ের রোগ ও মৃত্যু নিয়ে কে তাঁকে জেরা করতে যাবে।’

এ-কথার পর অমিয় ওঁকে নমস্কার করে উঠল। এবার চলল গ্রামের মধ্যে।

অমিয় গ্রামে রইল প্রায় দুই ঘন্টা। যখন বেরুল তখন তার জেদ অনেক বেড়ে গেছে—রহস্যের সূত্র অনুসন্ধানের জন্য। অন্যদিকে মন বেদনায় টনটন করছে পিতা-পুত্রীর ট্র্যাজেডির কথা ভেবে। ছবি—নিস্পাপ, সুন্দর, মধুর ব্যবহারে গ্রামের সকলের প্রিয় কিশোরী। হরিদাসবাবু মেয়েকে শাসনে রাখতেন ঠিক কথা, কিন্তু তিনি তাকে ভালবাসতেন। তার কোন অভাব রাখেন নি, নিজেই সাহায্য করতেন তার স্কুলের পড়া তৈরিতে। তাহলে কেন তিনি তাঁর সর্বস্ব বিক্রয় করে সেই অর্থপণ সমেত মেয়েকে কাশীতে ভাসিয়ে দিয়ে এলেন। কোন নিদারুণ আতঙ্কে? কোন পাপের প্রতি ঘৃণায়? কার প্রতি অভিমানে? পশ্চিম থেকে ফিরে গিয়ে সংক্ষেপে বলেছিলেন, ছবি মারা গেছে। তারপর আরো বছর পাঁচ-ছয় বেঁচেছিলেন। সেই ক’বছরে কেউ কোনদিন তাঁকে হাসতে দেখে নি, একদিনও যোগ দেন নি কোন সামাজিক উৎসব কি মেলামেশায়। আশ্রম ও স্কুলের সব নিয়ম যন্ত্রের মত পালন করতেন। কি গ্লানিকর শুধু নিজের প্রাণধারণের জন্য চাকরি করা। আচ্ছা, তাঁর ভেতরটাও কি মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল? নাকি, কন্যার স্মরণে বিরলে অশ্রু বিসর্জন করতেন? পূজাপাঠ ইত্যাদির যে-অভ্যাস ছিল মেয়েকে হারাবার পর তা গিয়েছিল। ধর্মগ্রন্থ তাঁকে সান্ত্বনা দিত না। কিন্তু কি মানে এই ট্র্যাজেডির? অমিয় ঘন্টা দুয়েক আলোচনা করেও আলোকের কোন রেখা দেখতে পায় নি। ওর অনুসন্ধানে একটি অসুবিধা ছিল। গ্রামের মানুষ রহস্যের কোন আভাস পায় নি। একটি মাত্র মেয়েকে হারিয়ে উনি তো একটু কেমন কেমন হয়ে যাবেনই।

অমিয় সব কথা বলতে পারে নি। পোস্টমাস্টার মশাইয়ের কাছে সে নিজের যে-পরিচয় দিয়েছিল, সেই পরিচয়ই দিয়েছিল গ্রামবাসীদের কাছে। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে সে পৌঁছল হরিদাসবাবুর প্রতিবেশী বিমলবাবুর বাড়ি। অতি সজ্জন ব্যক্তি। স্কুলে হরিদাসবাবুর সহকর্মী ছিলেন, সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। সাহিত্য-চর্চা করেন। তাঁর বারংবার অনুরোধে অমিয়কে তাঁর বাড়িতেই মধ্যাহ্ন-ভোজন সারতে হল। বিমলবাবু ও অমিয় যতক্ষণ গল্প করল বিমলবাবুর স্ত্রী আশেপাশেই ছিলেন। খুঁটিনাটিতে কিছু ভুল হলে স্বামীকে সংশোধন করছিলেন।

বিমলবাবু সখেদে বললেন যে হরিদাসবাবুর সঙ্গে তাঁর গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক ছিল। দুজনের পাশাপাশি বাড়ি, কর্মস্থল একই এবং ওঁরা সমবয়সী। অমিলের মধ্যে বিমলবাবুর ধর্মে অনাগ্রহ এবং সাহিত্যে রুচি, হরিদাসবাবুর ঠিক উল্টো। আর একটি ব্যাপার—কিশোরী কন্যাকে কিভাবে মানুষ করা যায় সে-বিষয়ে দুই ভদ্রলোকের মতে গরমিল ছিল। বিমলবাবুর মেয়ে সুধা ছবির সহপাঠিনী ছিল। দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সুধা সব রকম বই-ই পড়ত, সঙ্গী পেলে ডায়মন্ডহারবারে সিনেমা দেখতে যেত।

তবে বিমলবাবু হরিদাসবাবুর কোনরকম নিন্দা করতেই পারেন না। তিনি নির্লোভ ব্যক্তি ছিলেন, গৃহ-শিক্ষকতা করে রোজগার বাড়ান নি। তাঁর যৌবনে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল, দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নি এবং নারীঘটিত কোন দুর্নামও কখনো তাঁর ছিল না। আশ্রমের মহারাজদের তিনি খোশামোদ করতেন না এবং গ্রামের পরনিন্দা-পরচর্চায় যোগ দিতেন না।

অমিয় ছবির অসুখের বিষয়ে জানতে চাইল। সে শুনেছে হরিদাসবাবু মেয়ের চিকিৎসার জন্য রাঁচি গিয়েছিলেন। মাথার অসুখ নাকি?

বিমলবাবু বললেন, তিনি শুনেছেন ছবির টি.বি. হয়েছিল। অমন স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, তার টি. বি. হওয়া আশ্চর্যের বিষয় বটে, বিমলবাবু ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই স্বীকার করলেন। তবে উঠতি বয়সের মেয়ে, বাবার শাসনে তার স্বাধীনতা ছিল না, মনের অসুখ থেকে শরীরের অসুখ হওয়া বিচিত্র কি? না, বিমলবাবুরা প্রতিবেশী হলেও ছবির রোগভোগ সম্বন্ধে ডেফিনিট কিছু জানেন না, হয়তো তাঁদের মেয়ে সুধা জানে।

তখন অক্টোবর মাস, পূজা আসতে আর দেরি নেই, বিমলবাবু একদিন হঠাৎ সুধার কাছে শুনলেন হরিদাসবাবু মেয়েকে নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য রাঁচি চলে গেছেন। সুধা বলেছিল সে বিশেষ কিছু জানে না। কয়েকদিন ধরেই ছবি নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা বলছিল, তারপর একদিন সে স্কুলে এল না। সুধা বিকেলে তাকে দেখতে গিয়েছিল। হরিদাসবাবু উপস্থিত ছিলেন। তিনি সুধাকে বারান্দার এককোণে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে ছবির অসুখটা ছোঁয়াচে, সে যেন বান্ধবীকে দেখতে আর না আসে। ছবি নিজেও সুধাকে তার অসুখটা কি সে সম্বন্ধে কিছু বলে নি। শুধু বলেছিল, সেদিনই সকালে স্বরূপ মহারাজ ওকে পরীক্ষা করেছেন।

তারপর?

সুধার সঙ্গে ছবির দেখা হয়েছিল আর মাত্র একদিন। ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে জলখাবার খাচ্ছিল, খবর পেল যে ছবির বাইরে যাচ্ছে। দৌড়ে গেল সে। হরিদাসবাবু রিক্সা ডেকে এনেছিলেন। ছবি একটা পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে তাতে বসেছিল। উনি কোন লাগেজ আনতেই বোধ হয় বাড়ির ভেতরে গেছিলেন। ছবি সুধাকে বলেছিল, ‘বাবা আমাকে জানায় নি, কিন্তু আমি জানতে পেরেছি—আমরা রাঁচি যাচ্ছি।’ তখনই হরিদাসবাবু বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এসে রিক্সায় বসলেন। রিক্সা চলতে আরম্ভ করল। রিক্সা খানিকদূর এগিয়েছে তখন ছবি পেছনে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে সুধাকে বলেছিল, ‘আমি ফিরে আসব।’ তারপর?

দিন পাঁচেক বাদে হরিদাসবাবু ফিরে এলেন। একা। মুখ গম্ভীর। দেখা হতে বিমলবাবু শুধোলেন, ‘মেয়েকে কোথায় রেখে এলেন?’

‘পশ্চিমের একটা হাসপাতালে।’

‘রাঁচিতে নাকি?’

হরিদাসবাবু চমকে উঠেছিলেন, কিন্তু মুখে প্রতিবাদ করেছিলেন, ‘না তো!’

‘অসুখটা কি?’

‘কে জানে, ডাক্তাররা স্পষ্ট করে কিছু বলতে চায় না।’

এরপর উনি প্রতি মাসেই দু-দিনের জন্য মেয়েকে দেখতে যেতেন। ফিরে এলে বিমলবাবু বা অন্য কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করলে জবাব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতেন। অসুখটা কি এবং কোথায় সে আছে—এ দুটি প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর কেউ কখনো ওঁর কাছে পায় নি। অসুখটা ভাল হচ্ছে কিনা, এ প্রশ্নের উত্তর দিতেন ভাসা-ভাসা।

মার্চ মাসে উনি ওইভাবে মেয়েকে দেখতে রওনা হয়ে যাবার পর খবর রাষ্ট্র হল যে নিজের বাড়ি-জমি ইত্যাদি গ্রামের সব স্থাবর সম্পত্তি উনি সামান্য দরে বিক্রি করে গেছেন। এবার উনি ফিরলেন দেরি করে। বোধ হয় আট-দশ দিন পরে। কিন্তু গ্রামে ঢুকলেন না। জীবনে আর কখনোই ঢোকেন নি। স্কুলে যোগদান করলেন। সেদিনই খবরটা ছড়াল যে ছবি আর নেই। হরিদাসবাবু প্রথম ক’দিন টীচার্স রুমে আসছিলেন না। এক ক্লাশ থেকে আরেক ক্লাশে যাওয়ার মুখে বিমলবাবু যখন ওঁর মুখোমুখি হলেন তিনি আন্তরিক ভাবে তাঁর সমবেদনা জানালেন। মুখ নিচু করে নীরবে হরিদাসবাবু শুনলেন। তারপর ক্লাশে চলে গেলেন।

এই জায়গায় শোকে বিমলবাবুর কণ্ঠ রুদ্ধ হল। ছবির স্মৃতিতে কিংবা তার বাপেরই দুঃখে।

অমিয় একটি প্রশ্ন করল, ‘ছবির মা’র বা নিকট আত্মীয়দের অন্য কারো কখনো পাগলামি বা স্মৃতিলোপের কথা শুনেছেন? বা আত্মহত্যার কোন ঘটনা?’

‘না তো! একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? বিমলবাবু খুব অবাক।

‘না, এমনি।’

উঠবার আগে অমিয় কৌশলে জেনে নিল সুধার শ্বশুরবাড়িটা কোথায়। ভাগ্যক্রমে বেশি দূরে নয়, ডায়মন্ডহারবার থেকে মাত্র মাইল দুয়েক দূরে।

বিমলবাবুর সঙ্গে আলোচনার সময়ে অমিয়র মনে পড়েছিল যে মিসেস শোভা সেন তাকে বলেছেন যে হরিদাসবাবু এক মার্চ মাসেই তাঁর মেয়েকে রেখে গেছিলেন।

দুপুর দেড়টা। সুধার শ্বশুরবাড়ির গ্রামখানি কি নির্জন, গাছপালায় ঢাকা। রিক্সা থেকে নেমে পুরোন ও বড় বাড়িখানার সামনে দাঁড়িয়ে অমিয় মৃদুস্বরে ‘শুনছেন, শুনছেন করে কয়েকবার ডেকে এবং চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। অবশ্য বৈঠকখানার দরজা খোলা। যাক, শেষ পর্যন্ত পরিচারিকা শ্রেণীর একজন মন্থর পায়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। অমিয় নিজের অভিপ্রায় জানিয়ে পরিচয় দিল সে সুধার বাপের বাড়ি থেকে আসছে। স্ত্রীলোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে আবার বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

অমিয়কে প্রায় পনের মিনিট অপেক্ষা করতে হল। বৈঠকখানাটি বিরাট। অমিয় তার এমন একটি কোণে বসল, যেখানে বসে আলাপ করলে তা বাড়ির ভেতর বাইরের কারো কর্ণগোচর হবে না।

সুধা দেখা দিল। বিলম্বের কারণ বোঝা গেল। হয়তো প্রথমে আড়াল থেকে অমিয়কে দেখে গেছিল। এখন চুল আঁচড়ে, মুখে স্নো-পাউডার মেখে, ভাল শাড়ি-জামা পরে এবং পায়ে চটি গলিয়ে এসেছে।

নির্মলার সহপাঠিনী, অতএব বয়সের হিসাবে তরুণীই। যদিও দেখায় আরো পাঁচ-সাত বছরের বড়। সাত-আট বছর বয়সের একটি মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল অমিয়।

‘আমি অমিয় সাহা। পরিচয় দিলে চিনবেন না। নিজের কাজে বিমলবাবুর সঙ্গে এইমাত্র দেখা করে আসছি। অনেক উপকার হয়েছে, ফাউ হিসেবে পেয়েছি ওঁদের আতিথেয়তা। আশা করছি, আপনার কাছেও কিছু কাজ হবে।’

‘বলুন।’

‘আপনি আগে বসুন। আমাদের কথা চট করে ফুরোবে না। এটি আপনার মেয়ে বুঝি? এ কিন্তু আমাদের কথায় কোন রস পাবে না।’

সুধা ইঙ্গিত বুঝল। মেয়েকে ‘যাও, এখন ঘুমোও গিয়ে’ বলে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। তারপর অমিয় যে চেয়ারটি দেখিয়েছিল সেখানে বসল।

‘আমাদের আলোচনার কথা আপনি কারো কাছে প্রকাশ করবেন না। কিছুতেই না। আপনার বাবার কাছে আমি নিজের সত্য পরিচয় ও প্রকৃত উদ্দেশ্য জানাই নি।’

সুধার মুখে উদ্বেগের ছায়াপাত করল।

‘কে আপনি? এত ভণিতা করছেন কেন?’

‘বিনা ভণিতাতেই শোনাই বম্বশেলের মত একটি খবর ; ষোল বছর আগে হরিদাসবাবু ছবির মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ রটনা করেছিলেন।’

‘সত্যি?’

সম্মতিতে অমিয় ঘাড় নাড়ল।

‘কি হয়েছিল? কোথায় আছে সে এখন? আপনি তার কে?’

অমিয় সংক্ষেপে সব বলল। স্তব্ধ হয়ে বসে শুনলে সুধা। তারপর অমিয় পকেট থেকে বার করে নির্মলার কয়েকটি ফটোগ্রাফ এবং রাঁচির ইংরেজী সাপ্তাহিকে প্রকাশিত আত্মহত্যার বিস্তৃত বিবরণের কাটিং ওর হাতে দিল।

‘হ্যাঁ, সে-ই—সে-ই তো, ওমা!’ বলতে বলতে সুধা ছবিগুলো দেখল। তার চোখ বারবার অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসছিল। তারপর সে সাপ্তাহিকের কাটিং সবটা পড়ল।

‘আহা, কেন যে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আত্মহত্যা করল! আপনি কিছু জানেন?’

‘না, সেটা জানতেই আমি ছুটোছুটি করছি। এখন আপনার সাহায্যপ্রার্থী।’

সুধা হঠাৎ শুধোল, আপনি তাকে ভালবাসতেন?’

‘তা জেনে পৃথিবীতে কারো লাভ নেই। আমার ভালবাসা বা অ-ভালবাসার সঙ্গে নির্মলার আত্মহত্যার সুদূরতম সম্পর্ক নেই।’

‘আমি ছবিকে চিনতুম। স্মৃতিলোপের পর সে প্রায় নতুন মানুষ—নির্মলা। নির্মলার আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে আমি আপনাকে কি সাহায্য করব?’

‘আপনি আমাকে ছবির কথাই বলবেন। যতদূর বুঝেছি, সব জটিলতার শুরু যোল বছর আগে ছবির কোন অদ্ভুত অসুখে। রটনা—তার টি. বি. হয়েছিল। কিন্তু তাই কি? আপনি তার তথাকথিত অসুখের লক্ষণগুলো স্মরণ করুন তো।’

‘আমি ডাক্তার নই। আমি কি করে বলব? আপনি স্বরূপ মহারাজকে জিজ্ঞেস করুন গিয়ে। উনি বড় ডাক্তার। অন্তত একদিন ছবিকে ভাল করে পরীক্ষা করেছিলেন।’

‘জিজ্ঞেস করেছি। তিনি কনফার্ম করেন নি।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার।’ বলে সুধা কিছুক্ষণ ভেবে শেষে বলল, ‘হয়তো টি. বি. তার হয় নি। কিন্তু কিছু একটা হয়েছিল। ছবিও তা অস্বীকার করে নি। শুধু রোগের নামটা আমাকে বলতে চায় নি বা জানত না।’

‘আপনি এখন আন্দাজ করুন।’

‘কোন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন গিয়ে—কোন্ রোগে পাঁচ-ছ’ মাস ভুগলে—এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা চলছিল—মানুষের স্মৃতিলোপ হতে পারে।’

‘এমন রোগ অসম্ভব।’

আবার কিছুক্ষণ ভেবে সুধা বলল, ‘স্কুলে একদিন আমার সামনেই ছবি বমি করল। বলেছিল অরুচিতে ভুগছে। ইদানীং সন্ধ্যা হলেই ক্লান্তিতে তার ঘুম পেত। এই সব লক্ষণ, বাপ-মেয়ে ও স্বরূপ মহারাজের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা এবং ছবিকে কয়েক মাসের জন্য দূরে পাঠিয়ে দেওয়া, এই সমস্ত দিক চিন্তা করে আমার মনে একটা বিশ্রী সন্দেহ জেগে উঠছে, কিন্তু সে সন্দেহও যে আবার অসম্ভব।’

‘অসম্ভব কেন?’

‘সে তখন মাত্র পনের বছরের। আর, ওই বয়সের যে কোন মেয়ের চেয়ে সে ছিল ইনোসেন্ট। ভুলিয়ে, কেউ তার সর্বনাশ করেছিল—তাও অসম্ভব। হরিদাসবাবুর কড়া শাসনে তার স্বাধীনতা ছিল না। স্কুলে, বিকেলে, সে যেদিন বেড়াতে বেরোত, আমি ছিলুম তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি কিছু জানলুম না—তাও কি হয়?’

সুধা স্মৃতিতে ষোল বছর আগেকার দিনগুলোর সমস্ত খুঁটিনাটি ওলোট-পালোট করে নিজের সন্দেহের পক্ষে ও বিপক্ষে প্রমাণ খুঁজছিল। অমিয় ওর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছিল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুধার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

সে বলল, উত্তেজনায় তার কণ্ঠস্বর কম্পিত এবং একটু উচ্চ, ‘নিশ্চয়ই হয়। ভেবে দেখুন, সেকি প্রকাণ্ড অঘটন, যাকে ভুলতে ছবির স্মৃতিতে ব্ল্যাকআউট হয়েছিল এবং হরিদাসবাবু ভীষণ অক্ষমতায় সর্বস্ব খুইয়েও মেয়েকে পর করে দিলেন।’

সুধা কপালে করাঘাত করে বলল, ‘এইবার আমি বুঝতে পেরেছি। রিক্সায় বসে ছবি আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল যে সাহেব-ব্রহ্মচারী যদি ওর খোঁজে আসে, আমি যেন তাকে বলি ছবি রাঁচিতে।’

‘সাহেব-ব্রহ্মচারী কে?’

সুধা বলে গেল এবং অমিয় রুদ্ধশ্বাসে শুনল। প্রতি বছর মে মাসে আশ্রমে ঘটা করে উৎসব হয়—পূজা-পাঠ, দরিদ্রভোজন, ছোটখাটো মেলা, ধর্মসভা এই সব আর কি। সেদিন আশেপাশের জেলাগুলোর একই সংঘভুক্ত আশ্রমগুলো থেকে ব্রহ্মচারী ও মহারাজেরা আসেন। সে-বছর কলকাতার দলের সঙ্গে এসেছিল সাহেব-ব্রহ্মচারী। সোনালী চুল, নীল চোখ, সুন্দর কপাল নাক চিবুক, বলিষ্ঠ চেহারা। বয়স হবে একুশ-বাইশ। ইংরাজী জানে না, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছে। ধর্মসভায় সংস্কৃততেই বক্তৃতা দিল। অদ্ভুত উচ্চারণের দোষে সংস্কৃতজ্ঞরাও বিশেষ কিছু বুঝল না। তারপর সে ঘুরে ঘুরে মেলা দেখছিল। স্কুলের ছাত্রীরা একটা স্টল করেছিল, সেইখানে ছাত্রীরা তাকে ধরল কিছু কিনতে হবে। সে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন, আমি অতি দরিদ্র।’ তখন একজন ছাত্রী দেখিয়ে দিল প্লেটে নানা রকম আচার—খুব সস্তা জিনিস, একটুখানি কিনলেই চলে এবং খেতে খুব ভাল। সাহেব-ব্রহ্মচারী দু-আনা খরচ করতে রাজী। ওকে দেওয়া হল মশলাভর্তি একটা বড় সবুজ লঙ্কা। খেয়ে সে নাজেহাল। ছবিই তখন ছুটে গিয়ে একগ্লাস জল এনে ওকে দিয়েছিল। এ গেল সকালবেলাকার কথা।

আড়াইটের সময়ে ছবি আর সুধা চলে গেছিল ডায়মন্ডহারবারে। অভিভাবকেরা সেদিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ব্যস্ত, পালাবার জন্য উপযুক্ত দিন। সুধার প্ল্যান ছিল সিনেমার ম্যাটিনী শো দেখে, রেস্টুরেন্টে চপ-কাটলেট খেয়ে ফিরবে। কিন্তু সিনেমার কাছে ছবি এসে বেঁকে বসল। আশ্রম-হোস্টেলের এবং ওদের গ্রামের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর ভিড় সেখানে। তাদের কেউ যদি হরিদাসবাবুকে ছবির নামে লাগায়? সে একলা বাড়ি ফিরতেও রাজী নয়। সুধা কি আর করে, দুজনে চলল গঙ্গার ধারে বেড়াতে। বেড়াতে বেড়াতে ছবি হঠাৎ বলে উঠল, ‘বন থেকে বেরোল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।’ সুধা শুধোল, ‘আনারস? কোথায় দেখলি?’ ছবি দেখাল। আনারস নয়। গঙ্গার তীরে সেদিকটা নির্জন। উঁচু পাড়ের তলার ছায়ায় জলের অদূরে বসে সাহেব-ব্রহ্মচারী। খালি গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছে আর জলের সঙ্গীত শুনছে। সুধাই ছবিকে টেনে নিয়ে গেল তার কাছে।

‘সাহেব, একে চিনতে পার?’

সে আন্দাজে প্রশ্নের মানে বুঝল, ছবির দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসল। বলল, ‘উপবেশন করুন, আমরা কথোপকথন করি।’ সাহেব-ব্রহ্মচারী শুনিয়েছিল গঙ্গার গল্প। সে হিমালয়ে তার প্রায় উৎস পর্যন্ত গিয়ে দেখে এসেছে, দেখেছে তার ধারা অনুসরণ করে আর্য ঋষিদের স্মৃতি-বিজড়িত অনেক তীর্থ। সুধা সাহেবের বিষয়ে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করেছিল। এত বছর বাদে জবাবগুলো আর তার মনে নেই।

এক সময় ব্রহ্মচারী বলল, সে এইবার স্নান করে আশ্রমে ফিরবে। ওরাও জলে নামবে নাকি? ওরা অসম্মতিতে মাথা নাড়ল। ব্রহ্মচারী কৌপীন পরে জলে ঝাঁপ দিল। কিছুক্ষণ পরে আরম্ভ হল দুই সখীর উদ্দেশে ওর আহ্বান : ‘মহিলাগণ, আপনারা আসুন। মাভৈঃ!’ জলে নামলে কিরকম ভাল লাগবে, সেটা সে চোখ-মুখের নানা ভঙ্গি করে দেখাচ্ছিল। দুই সখী চারদিকে দেখল। বৈকালিক ভ্রমণকারীরা তখনো কেউ ওদিকে এসে পৌঁছয় নি। সাড়া দিল প্রথম সুধাই। শায়া-জামা খুলে রেখে শুধু শাড়ি পরে গিয়ে জলে নামল। তারপর ছবিও গেল। জল থেকে উঠে ওরা শায়া-জামা পরে কিছুক্ষণ শাড়ি শুকোল। তারপর?

ওরা গিয়ে বাসে উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-বাসে সুধার আর যাওয়া হয়নি। বাসস্ট্যান্ডের সামনে মিষ্টির দোকানে এক পিসতুতো দাদাকে দেখে ‘তোরা যা’ বলে সে নেমে গেল। না, সখীর সঙ্গে যুবকের ঘনিষ্ঠতা করার সুযোগ দান তার উদ্দেশ্য ছিল না।

যাই হোক, পরের দিন সকালে ছবির সঙ্গে দেখা হতে সে বলেছিল, একই বাস-স্টপেজে নেমে সাহেব-ব্রহ্মচারী গিয়েছিল আশ্রমের দিকে, সে গিয়েছিল বাড়ির দিকে। এত বৎসরে সুধা কখনো ছবির সে বক্তব্যে সন্দেহ করবার কারণ দেখে নি। কিন্তু এখন সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পারছে।

বুঝতে পারছে অমিয়ও। ওর আগের অনুমান যথার্থ—এই গ্রাম, রাঁচি, কাশী, দেরাদুন ও আবার রাঁচিকে নিয়ে একটি পূর্ণ বৃত্ত আছে। সেই জন্যেই নির্মলার আত্মহত্যার আগে সাহেব-ব্রহ্মচারীর প্রতিরূপ উইলিয়াম ব্যানার্জির আবির্ভাব।

‘অদ্ভুত যোগাযোগ, জানেন,’ সুধা অমিয়কে বলল, ‘গত মাসে আত্মহত্যার সময়ে ওর পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা ছিল, আর সেই অক্টোবরেও ওর অবস্থা প্রায় সেই রকমই ছিল। আমার মনে পড়ছে, সন্ধ্যার আলোয় রিক্সায় বসা গায়ে চাদর জড়ানো ওর সেই মূর্তি। ওর ক্লিষ্ট করুণ ও সুন্দর মুখ।’

সুধার মনে পড়ল ওর ইদানীংকার কিছু হাবভাব—সদ্য প্রেমে-পড়া কিশোরীর মত। রোমান্টিক গল্প শোনায় আগ্রহ। এবং সেই কৌতূহল—সুধাকে ওর মা হাইজিন সম্পর্কে একটি সচিত্র বই পড়তে দিয়েছিলেন ; ও আবার বইটা ছবিকে পড়তে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে আগ্রহ দেখায় নি। তারপর বর্ষাকালে একদিন একলা ঘরে ছবি সেই বইটি পেড়ে নিবিষ্ট মনে দেখছিল।

‘কিন্তু যেটা আমার কিছুতেই মনে পড়ল না—কোনদিন ওর কোন কথায় কিছুমাত্র অনুতাপ বা ভয়ের আভাস। এখন বুঝছি যে ওর ভাবখানা ছিল সাহেব-ব্রহ্মচারী একদিন ফিরে আসবে, যদি নাও আসে তো তার দানকে সে ধৈর্যের সঙ্গে এবং আদর করে বইবে। আচ্ছা, রাঁচিতে যাবার পর কি ঘটেছিল?’

‘ফেব্রুয়ারি বা মার্চে এক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার ফল ওর স্মৃতিলোপ।’

‘তখন তো ওর বাচ্চা জন্মে গেছে।’

‘সম্ভবত।’

‘কি হল সে বাচ্চার?’

‘তা আর কোনদিন জানা যাবে না।’ অমিয় মিথ্যা কথা বলল।

‘আপনি কি সাহেব-ব্রহ্মচারীর খোঁজ করবেন?’

‘নিশ্চয়ই না।’

‘মানে আপনার অনুসন্ধান এখানেই শেষ?’

‘হ্যাঁ। আমি বুঝতে পেরেছি নির্মলার আত্মহত্যার কারণ। ষোল বছর পরে তিনি নিজের লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পেয়েছিলেন।’

‘তারপর?’

‘তারপর তাঁর মনে কি ঝড় উঠেছিল, কি করে জানব বলুন।’

‘কিন্তু কি কারণে লুপ্ত স্মৃতি ফিরে এল?’

‘তাও আর জানা যাবে না।’

তিনটি ব্যাপার সম্ভবত অমিয় ভেবে দেখল। উইলিয়ামকে দেখে নির্মলার মনে পড়েছিল সাহেব-ব্রহ্মচারীকে। অথবা নিজের কামিন পুত্রকে। নাকি উইলিয়াম নির্মলারই ছেলে?’

রাঁচিতে পৌঁছে অমিয় একটা হোটেলে উঠল। তারপর গেল ফার্নিচার কোম্পানীতে উইলিয়ামের মনিবের কাছে। ওর ভাগ্যক্রমে ছোকরা তখন অনুপস্থিত। অমিয়র জিজ্ঞাস্য—তার প্রতিপালক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা। ঠিকানা এক খ্রীস্টান অনাথ বিদ্যালয়ের। একবার স্বরূপ মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের খুব শিক্ষা হয়েছে অমিয়র, সে তাই বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কারো সঙ্গে দেখা না করে, দেখা করল একজন কেরানীর সঙ্গে। কুড়ি টাকা ঘুষ দিয়ে এই খবরটি পাওয়া গেল যে, রেজিস্টারে উইলিয়ামের পিতা-মাতার নামের ঘর শূন্য, তবে ফাদারদের একটি গোপনীয় ফাইলে এই তথ্য লিপিবদ্ধ যে ও এসেছে এক খ্রীস্টান মিশন থেকে। মিশনটি রাঁচি শহরেরই এক প্রান্তে।

অমিয় তখনই ছুটল সেই মিশনের অফিসে। এক কল্পিত নার্স ডোরার সন্ধানে। ষোল-সতের বছর ধরে সে ওই পেশায় এবং একই মিশনে। মিশনের নামটা অবশ্য অমিয় ভুলে গেছে। তবে ডোরার চেহারার বর্ণনা দিল। সে যে ভারি বুদ্ধিমতী ও স্নেহশীলা তাও বলল। অফিসের লোকেরা শেষ পর্যন্ত বলল যে ওই বর্ণনার সঙ্গে একজনের মেলে বটে, তবে তার নাম ডোরা নয়। কোথায় তাকে পাওয়া যাবে তার সন্ধান দিল।

পরের দিন সকালবেলা। বিরাট মিশন কম্পাউন্ডে একপাশে প্রসূতি-সদন, শিশুসদনের মাঠে এক পাকাচুল পরিচারিকার পাহারায় কতগুলো বাচ্চা খেলা করছিল। অমিয়কে দেখা গেল, সেই মাঠের এককোণে এক গাছের ছায়ায় উদাস মুখে বসে থাকতে। তার কোট-প্যান্টের সব ক’টি পকেট লজেন্স-চকোলেটে ভর্তি। সে সেগুলোকে বাচ্চাদের মধ্যে বিলোতে চায়। দেখতে পেয়ে বুড়ী তেড়ে এল। সে ছেলেধরা নয় তো? কি মতলব তার? বিনানুমতিতে মিশনের এলাকায় সে ঢুকল কি করে?

অমিয় বোঝাল। গত বছর ঠিক এমনি দিনে জার্মানীতে তার বউ বাচ্চা হবার সময়ে মারা গেছে, বাচ্চাটিও বেশি দিন বাঁচে নি। বুড়ী আপত্তি করলে অমিয় জানালে সে এখনি ফাদারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসছে। বুড়ী অবুঝ নয় এবং তার মনটি ভারি নরম। অমিয়র দুঃখের গল্প তাকে স্পর্শ করল। তার আর কোন আপত্তি রইল না। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, অমিয় আর বুড়ী দুজনে সেই গাছতলায় গল্প জুড়েছে।

বুড়ী আদিবাসী খ্রীস্টান। দুজনের গল্প হচ্ছিল ইংরাজীতে। অমিয় বলল যে তার বউ মা হয়েছিল মাত্র পনের বছর বয়সে। গৌরী ও স্বাস্থ্যবতী কিশোরী। অমিয় অবশ্য কালোই। ফর্সা, নীল চোখ ও সোনালী চুল ছেলে হয়েছিল তার। হয়তো শীতের দেশ বলেই, নয়তো তার কোন বিদেশী বন্ধু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তা করুক, অমিয় নিজের স্বর্গীয়া স্ত্রীকে ক্ষমা করেছে। আচ্ছা, স্ত্রীর বয়স অত অল্প ছিল বলেই কি সে মারা গেল?

বুড়ী অমিয়র অজ্ঞতায় হাসল। গত বিশ বছরে সে পনের বছরের মেয়েকে মা হতে অনেক দেখেছে। হ্যাঁ, তাদের মধ্যে দু-চারজন বাঙালী ভদ্রকন্যাও ছিল। বলতে বলতে বুড়ীর মনে পড়ল ষোল বছর আগের একটি কেস।

রুদ্ধশ্বাসে অমিয় সেই গল্প শুনল। বুড়ীর স্মৃতিশক্তি খুব ভাল। সে যে খুঁটিয়ে সব মনে রেখেছে, তার আরো কারণ আছে। ছবি মিশনে ছিল প্রায় ছ’ মাস। সে শিশু নয় যে শিশুসদনে থাকবে এবং প্রসূতিসদনে ডেলিভারির অত আগে থেকে কাউকে রাখা নিয়মও নয়। বুড়ী যেন কানাঘুষা শুনেছিল যে এই মিশনের এক বন্ধু-ডাক্তার, যিনি এখন বাংলাদেশে হিন্দু মিশনে রয়েছেন, তাঁর চিঠির জোরেই নিয়মভঙ্গ হয়েছিল। ছবি থাকত এই বুড়ী এবং মিশনের অন্য নার্স ও ঝি’দের সঙ্গে তাদের কোয়াটারে। স্বেচ্ছায় এবং হাসি মুখে সে শিশুসদনের নানা কাজ করত। শিশুরা তার অতি প্রিয় ছিল। তার বাবা যেদিন প্রথম তাকে নিয়ে এলেন, তার কপালে সিঁদুর ছিল। কিন্তু সে অবিবাহিতা মাতাই ছিল বোধ হয়। তার বাবা ফাদারদের কি বুঝিয়েছিলেন, বুড়ী জানে না। বাবা তাকে রেখে চলে যাবার পর সে আর সিঁদুর পরে নি। পরের মাসে বাবা যখন দেখা করতে এলেন, তখনো না। পিতাপুত্রীর একটি সাক্ষাৎকারে বুড়ী উপস্থিত ছিল। দুজনের মধ্যে সামান্য দু-একটি কথার বিনিময়েই সাক্ষাৎকার শেষ হয়েছিল।

মিশনের ফাদারেরা করুণাময়, প্রসূতিসদনে মাঝে মাঝেই অবিবাহিতা গর্ভবতীরা ভর্তি হয়। শিশুসদনে অনেক পিতৃপরিচয়হীন শিশু রয়েছে। মোট কথা এখানকার আবহাওয়ায় নেই জারজ সন্তান ও তাদের মায়েদের প্রতি সমালোচনা বা ঘৃণা এবং তাদের সম্বন্ধে অনাবশ্যক কৌতুহল। কিন্তু বুড়ি দীর্ঘ বিশ বছরে আর দ্বিতীয় মুখ দেখে নি যে মুখ ছবির মুখের মত পবিত্র, সুন্দর ও নিঃসঙ্কোচ। শুধু একা বুড়ীরই নয়, আরো অনেকেরই ছবিকে দেখে মাতা মেরীর সঙ্গে তুলনা মনে আসত।

আর কি সুন্দর বাচ্চা হয়েছিল ছবির! নীল চোখ এবং সোনালী চুল ছেলে, ছবি তাকে আদর করতে করতে একটি ছোট্ট বাংলা ছড়া বলত। সোনার টুপি পরা পাখিকে নিয়ে ছড়া।

অমিয় শুধোল, ‘বন থেকে বেরোল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে—এই ছড়া কি?’ হবেও বা, বুড়ীর ঠিক মনে নেই।

ছবি আর তার বাচ্চার কি হল? সে বড় করুণ পরিণাম। বলতে বলতে, বুড়ীর চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। একদিন সকালে ছবি তার ছেলেকে নিয়ে হাসি মুখে বিদায় নিল।

তিন-চারদিন পর ছবির বাবা কাঁদতে কাঁদতে এসে ফাদারদের পায়ে পড়লেন। ফাদারদের সঙ্গে তাঁর কি আলোচনা হয়েছিল বুড়ী জানে না। তবে পরে যা বোঝা গেল—ফাদারেরা রাজী হয়েছিলেন ছবির ছেলেকে ওঁদের চেনা কোন অনাথালয়ে স্থান দিতে। ছবি সে প্রস্তাবে রাজী কিনা, হয় সে-খোঁজ তাঁরা নেন নি, নয়তো মিথ্যা শুনেছিলেন যে সে রাজী। ভদ্রলোক মেয়েকে এবং বাচ্চাকে নিয়ে রাঁচিতেই একটি ভাড়া করা ঘরে গিয়ে উঠলেন। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে চুরি করলেন। বাচ্চাকে যথাস্থানে দিয়ে বাবা যখন ফিরে এলেন, মেয়ে দৌড়ে এল। ‘আমার ছেলে কোথায়? বাবা তখন মেয়েকে বোঝাতে লাগলেন—কখনো মিষ্টি কথায় যুক্তি দিয়ে, কখনো শাসনের ভঙ্গিতে। খানিক দূর শুনে ছবি উঠে গিয়ে ঘরে খিল দিল। বাবা দরজার বাইরে বসে শুনতে লাগলেন মেয়ের বুকফাটা কান্না। কিছুক্ষণ পরে সব চুপ। তারপর যখন আরো কিছুক্ষণ কাটল, বাবার মনে বিশ্রী সন্দেহ জাগল। দরজায় ধাক্কা দিলেন, খুলল না। তখন লোক জুটিয়ে এনে দরজা ভাঙলেন। ছবি মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ডাক্তার এল, চিকিৎসার ফলে জ্ঞান ফিরল, কিন্তু হায় ছবির স্মৃতি লুপ্ত হয়েছে। সে নিজের বাচ্চার কথা ভুলে গেছে, বাবাকেও চিনতে পারছে না।

দু-একদিন বাদে বাবা—হয়তো ফাদারদেরই পরামর্শে—ছবিকে মিশনে নিয়ে এলেন। আকৃতি-প্রকৃতিতে সে কিছুই বদলায় নি, শুধু স্মৃতি লুপ্ত। যাদের সঙ্গে তার সবচেয়ে বেশি মেলামেশা ছিল, তাদের সঙ্গে নব-পরিচিতার মত আলাপ করল, যে ঘরে সে থাকত সেই ঘরে গেল, যে খাটে ছেলেকে নিয়ে শুতো সেই খাটে বসল, যে বাচ্চার সঙ্গে ক’ মাসে তার সবচেয়ে বেশি ভাব হয়েছিল, তাকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেলো; কিন্তু কিছুই—কিছুই মনে পড়ল না তার। বুড়ী ঠিক জানে না, তার নিজের বাচ্চাকে তার কোলে আবার দেওয়া হয়েছিল কিনা। সম্ভবত দেওয়া হয়নি। কোন লাভ হত না। তবে একটা কথা, বুড়ী সে সময়ে শুনেছিল যে ছবির লুপ্ত স্মৃতি যদি কোনদিন ফিরে আসে—সাধারণত ফিরে আসেই, তবে হয়তো খুব বড় আঘাতের প্রয়োজন হয়—সেদিন ছবির পক্ষে বড় ভয়ঙ্কর।

নিজের ছেলেকে চিনতে পারার পর ছবি আত্মহত্যা করেছিল। ঠিক কোন লজ্জা বা অনুতাপে, তা জানা অসম্ভব। উইলিয়ামের লোভী ও রুক্ষ মুখ, তার দীন ও রুচিহীন পরিচ্ছদ এবং তার চালিয়াৎ ভাব সবই মনে পড়ল অমিয়র। হয়তো প্রথম ও প্রিয় সন্তানের দুর্গতির জন্যে নিজেকেই দায়ী করেছিল ছবি, তাই সে আত্মহত্যা করল। হয়তো তার মনে হয়েছিল, সে পাপিষ্ঠা এবং মিঃ টুডুকে ঠকিয়েছে সে। যাই হোক, অনুসন্ধানের আর একটু বাকী। অমিয় জানতে চায় ঠিক কোন আঘাতে ছবি লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পেল।

উইলিয়ামের কর্মস্থলে আজ আবার গেল সে। কিন্তু দেখা হল না, কোম্পানীর জন্য অর্ডার সংগ্রহ করতে সে রাঁচির বাইরে গেছে। কি ভেবে অমিয় গেল আশার সঙ্গে দেখা করতে। মিঃ টুডুর রেকমেণ্ডেশানে সে এখন রাঁচিতেই একটি অবস্থাপন্ন বাঙালী পরিবারের কাজ করছে।

অমিয় জিজ্ঞাসা করল, ‘ফার্নিচার কোম্পানীর ছোকরা সেলসম্যানকে নিয়ে নির্মলার সঙ্গে আপনার কি কি কথা হয়েছিল মনে আছে?’

‘আমি যখন চলে আসছি, উনি বলেছিলেন যে ছেলেটিকে দেখলে মায়া হয়। ব্যস, আর কোন কথা হয় নি।’

‘আপনি কোন জবাব দেন নি?’

‘না।’

‘ওঁর মন্তব্যটি শুনলেন এবং নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন?’

‘ঠিক নিঃশব্দে নয়। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে একটি বাংলা ছড়া আউড়েছিলেন—সেলসম্যান ছোকরাটির সোনালী চুল মনে পড়াতে—‘বন থেকে বেরোল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।’

‘আবৃত্তি শেষ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলেন, পেছন ফিরে নির্মলার মুখের ভাব লক্ষ্য করার সুযোগ হয়নি। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

অমিয়র অনুসন্ধান শেষ। যে ছড়া একদিন ছবি আবৃত্তি করেছিল সাহেব-ব্রহ্মচারীকে দেখে, যে ছড়া সে আদর করে নিজের ছেলেকে শোনাত, আশার মুখে সেই ছড়া শুনে তার স্মৃতির দরজা হঠাৎ খুলে গিয়েছিল।

উইলিয়ামের সঙ্গে সাক্ষাতেরও আর প্রয়োজন নেই। সে গেল মিঃ টুডুর সঙ্গে দেখা করতে। বৈঠকখানা ঘরে উনি একলাই ছিলেন। কতকগুলো কি সব কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন। অমিয়কে দেখে খুশি হলেন।

‘এস, এই এত বেলায় কোন ট্রেন থেকে নেমে আসছ?’

‘আমি গতকালই পৌঁছেছি। তারপর একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলুম।’

‘ব্যস্ত। তোমার গোয়েন্দাগিরি এখনো শেষ হয় নি?’

‘হয়েছে।’

সাগ্রহে মিঃ টুডু শুধোলেন, কিছু জানতে পারলে?

‘জানবার মত কিছুই যে নেই তাই জেনেছি। মিসেস টুডুর আত্মহত্যা সম্পূর্ণ অকারণে।’

আরামের নিশ্বাস ফেলে উনি বললেন, ‘যাক।

‘আমি এবার চলি।’

‘যাবে। আমার একটা পরিকল্পনার কথা শুনে যাও। এই বাড়িটাতে আমি নির্মলার নামে বাচ্চাদের জন্যে একটা স্কুল করব।’

উত্তম পরিকল্পনা।’

‘এই বাড়িতে আমার দুই স্ত্রী মারা গেছে। দুজনেই সন্তানহীনা। এখন এখানে শিশুদের মেলা বসলে হয়তো ওদের আত্মা তৃপ্তি পাবে। কি বল?’

নিশ্চয়ই।’

‘তোমার কোন পরামর্শ আছে?’

একটু ভেবে অমিয় জবাব দিল, ‘সেই সঙ্গে আপনি যদি অনাথাশ্রমে পালিতদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্যে প্রতি বছর দু-একটা করে বৃত্তি দেন, খুব ভাল হয়।’

‘আমি ভেবে দেখব। কিন্তু শুধোই, এমন অদ্ভুত পরিকল্পনার কথা তোমার মাথায় কেন এল?’

‘এমনিই। সম্পূর্ণ অকারণে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *