সম্পাদক লেখক পাঠক
শ্ৰীযুত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
মহাশয়,
সচরাচর আমি পাঠকদের জন্যই আপনার কাগজে লিখে থাকি (এবং আপনার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি যে প্রতি সংখ্যায়ই কিছু লেখা দেব)। আপনার পড়ার জন্য নয়। কারণ আমি নিন্দুকের মুখে শুনেছি, সম্পাদকেরা এত ঝামেলার ভিতর পত্রিকা প্রকাশ করেন যে, তার পর প্রবন্ধগুলো পড়ার মতো মুখে আর তাদের লালা থাকে না। কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যা নয়। কারণ যেদিন আমি
তিন্তিড়ী পলাণ্ডু লঙ্কা লয়ে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
প্রপঞ্চ ফোঁড়ন লয়ে।
রন্ধনকর্ম সমাধান করি, সেদিন আমারও ক্ষিদে সম্পূর্ণ লোপ পায়। কাজেই আপনার বিরুদ্ধে যে প্রিমা ফাশি কে একেবারেই নেই, সেকথা বলতে পারবেন না। অন্তত আমার লেখা যে আপনি একেবারেই পড়েন না, সে-বিষয়ে আমি সুনিশ্চয়– কারণ পড়া থাকলে দ্বিতীয়বারের জন্য লেখা চাইতেন না। ন্যাড়া একাধিকবার যেতে পারে বেলতলা- নিমতলা কিন্তু যায় একবারই।
ইতোমধ্যে আমি কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি। অথচ দোষটা পড়েছে নিশ্চয়ই আপনার ঘাড়ে। বাঙলাতে বলে,
খেলেন দই রমাকান্ত
বিকারের বেলা গোবদ্দন!
অর্থাৎ জবান খেলাপ করলুম আমি, বিকারটা হল আপনার!
অয়, অয় জানতি পারো না–আকছারই হয়। তার কারণটাও সরল। যে-দোষ আপনি করেছেন, তার গালমন্দ আপনিই খাবেন, এ তো হক কথা, এ তো আপনার ন্যায্য প্রাপ্য। তাই তাতে আপনার ক্ষোভ থাকাটা অশোভন, কিন্তু সংসারটা তো ন্যায়ের ওপর চলে না, সে কথা তো আপনি বিলক্ষণ জানেন– তাই মাঝে মাঝে অন্যায় অপবাদ সইতে হয়। আপনারই কাগজে দেখলুম, এক পাঠক আপনাদের টাইট দিয়েছেন, রাবিশ লেখা ছাপেন কেন? উত্তরদাতা বেচারি মুখ শুকনো করে (আমি হরফগুলোর মারফতেই তাঁর চেহারাটি স্পষ্টই দেখতে পেলুম) বলছেন, নাচার, নাচার স্যার! নামকরা লেখক। অনুরোধ জানিয়েছিলুম, একটি লেখা দিতে– অজানা জনকে তো আর অনুরোধ করতে পারিনে, বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে পুকুরে তো আর ডুব মারতে পারিনে তার পর এসে উপস্থিত এই খাজা মাল। না ছাপিয়ে করি কী?
বিলকুল সচ্চি বাত (আপনার কাগজে হিন্দি-উর্দু শব্দের বগহার দিতে আমার বাধে না, কারণ আপনার পাঠক সম্প্রদায় পাইকিরি দরে হিন্দি ফিলিম দেখে দেখে দিব্যি হিন্দি বুঝতে পারেন)! কারণ ফ্রান্স-জর্মনিতেও বলে, বরঞ্চ রদ্দি মাল খেয়ে পেটের অসুখ করব, তবু শা– হোটেলওলাকে ফেরত দেব না, পয়সা যখন দিতেই হবে– পাছে অন্য খদ্দেরকে বিক্রি করে ডবল পয়সা কামায়! অতএব আমার মতে ছাপিয়ে দেওয়াটাই সুবুদ্ধিমানের কর্ম।
এ হেন অবস্থায় একটা মাস যে মিস্ গেছে, সেটা কি খুব খারাপ হল? বুঝলেন না? তা হলে একটি সত্যি ঘটনা বলি :
ফিল্মকাশের পূর্ণচন্দ্ৰ শ্ৰীযুত দেবকী বসু আমার বন্ধু। দিল্লিতে যখন তার রদীপের হিন্দি কার্বন কপি দেখানো হয়, তখন দিল্লির ফিল্ম সম্প্রদায় তাঁকে সেখানে নিমন্ত্রণ করে অভ্যর্থনা জানায়। স্বাগতিক ভাষণটি বলবার অনুরোধ আমাকেই করা হয়েছিল। কেন, তা জানিনে। এ তো ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো নয়। দেবকীবাবু যদি চটকদার রাবিশ ফিল্ম বানাতেন, তবে আমি ডাক পেলে আশ্চর্য হতুম না। তখন বুঝলুম, মুক্তো তুলতে ডুবুরি অর্থাৎ জউরি, যে সত্যই মুক্তোর মূল্য জানে, সে জলে নামে না– নামে মুক্তো বাবদে আনাড়ি ডুবুরি। কারণ আমি ফিল্ম দেখতে যাইনে– এরকম একটা বদনাম তরুণদের মধ্যে আমার আছে। বৃদ্ধেরা অবশ্য খুশি হয়ে বলবেন, বা, বা, বেড়ে ছেলে, খাসা ছেলে। আমি কিন্তু বৃদ্ধের প্রশংসার চেয়ে তরুণের নিন্দাই কামনা করি। সংস্কৃতেও বলে, বৃদ্ধার আলিঙ্গনের চেয়ে তরুণীর পদাঘাত শ্রেয়।
যাক সেকথা। সেই সূত্রে দেবকীবাবুর পুত্র দিলীপের সঙ্গেও পরিচয় হয়। তদ্দণ্ডেই সে আমার ন্যাওটা হয়ে যায়। খাসা ছেলে। ফিল্ম দেখেও বেড়ে ছেলে– তরুণ বৃদ্ধ এক সুরেই বলবেন।
সে ডাক্তারি প্র্যাকটিসে নামার কয়েক বৎসর পর আমি তখন ঘরের ছেলে কলকাতায় ফিরে এসেছি– দেবকীবাবু আমাকে একদিন শুধোলেন, দিলীপ কীরকম ডাক্তার!
মিত্রপুত্রের প্রশংসা করতে সবাই আনন্দ পায়; একগাল হেসে বললুম, চৌকশ, তালেবর।
মানে?
অতি সরল। এই দেখুন না, মাস ছয় আগে আমার হল দারুণ আর্ত-রাইটিস– আরব ছেড়ে ডাকলুম ডাকসাইটে অমুক ডাক্তারকে। তিনি ওষুধ দেওয়ার পর আমার এমনই অবস্থা যে আরব স্মাৰ্তরব কোনও রবই আর ছাড়তে পারিনে। তখন এলেন আরেক বাঘা ডাক্তার। তিনি নাকি মরাকে জ্যান্ত করতে পারেন। আমার বেলা হল উল্টো; জ্যান্তকে মরা করতে লাগলেন। যাই যাই। সেই যে,
এক দুই তিন,
নাড়ি বড় ক্ষীণ।
চার পাঁচ ছয়,
কী হয় না হয়।
সাত আট নয়,
মরিবে নিশ্চয়।
দশ এগারো বারো,
খাট যোগাড় করো।
আঠারো উনিশ কুড়ি
বল হরি হরি।
কী আর করি? মরি তো মরি, মরব না হয় দিলীপেরই হাতে। আর যা হোক হোক, আমাকে মানে। ভোঁতা নিডল দিয়ে শেষ ইনজেকশনটা দেবে না।
আমি থামলুম, দেবকীবাবু রুদ্ধশ্বাসে, শঙ্কিত কণ্ঠে শুধোলেন, তার পর কী হল? আপনি বেঁচে উঠেছিলেন কি?
আমি বললুম, দিলীপ বাড়িতে ছিল না, তাই আসতে পারল না। আমি সেরে উঠলুম।
তবেই দেখুন, সে ভালো ডাক্তার কি না।
সম্পাদক মশাই, আপনাদেরও কি সেই অবস্থা নয়? ডাকসাইটে অমুক লেখকের লেখা ছাপালেন। কাগজ নাবলো নিচে। বাঁচাতে গিয়ে ডেকে পাঠালেন আরেক বাঘা লেখককে। আপনাদের অবস্থা হল আরও খারাপ! তখন আমি দিলীপ– কাঁচা লেখক– চাইলেন আমার লেখা। আমি বরদায়। লেখা পাঠাতে পারলুম না। হুশ করে আপনার কাগজের মান উঁচু হয়ে গেল। বিশ্বাস না হয়, আপনার সেলস ডিপার্টমেন্টে খবর নিন– যে সংখ্যায় আমার লেখা ছিল না সেটি ইন্ডো-পাকিস্তান ক্রিকেট টিকিটের মতো বিক্রি হয়নি, ডাকে বিস্তরে বিস্তরে খোয়া যায়নি, হয়তো-বা আপনার অজানতে কালোবাজারও হয়েছে। বলতে কি, ওই সংখ্যাটি আমারও বড় ভালো লেগেছে। বিশেষ করে রঞ্জনের লেখাটি এবং ভোম্বে থেকে ভৌমিকের প্রশ্নবাণ। বস্তুত, আমি আজ ঠিক করেছিলুম এ সংখ্যাটি নিয়েই আলোচনা করব কিন্তু উপস্থিত মাত্র দু একটি মন্তব্য করে সে আলোচনা মুলতুবি রাখি।
যেমন মনে করুন, রঞ্জন লিখেছেন, বম্বের চিত্রনির্মাতা ঠিকই ধরেছেন যে অধিকাংশ দর্শক আড়াই ঘণ্টার জন্যে (যখন ছবি ওই সময়ে শেষ হয়) আপন আসন্ন পরিবেশ থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। সত্যই কি তাই? তবে আমার প্রশ্ন, বৃদ্ধের আসন্ন পরিবেশ মৃত্যুর। এবং মৃত্যুভয় সবচেয়ে বড় ভয়। তবে বৃদ্ধেরা সিনেমা দেখতে যায় না কেন? আবার দেখুন, লড়াই যখন চলতে থাকে তখন ছুটি-ফেরা জোয়ান সেপাই জোর সিনেমা যায়। চল্লিশ এবং পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়েই এদেশের পরিবেশ সর্বাপেক্ষা নিরানন্দময়। ছেলেদের পড়াবার পয়সা নেই, মেয়েরা বড় হয়েছে অথচ বর জুটছে না, চাকরিতে আর যে একটা মহৎ পদোন্নতি হবে সে সম্ভাবনাও আর নেই– তবু ওই বয়সের লোক সিনেমায় যায় কম। অথচ তার কলেজি ছেলে– যার ঘাড়ে এখনও সংসারের চাপ পড়েনি, খেলাধুলো সে করতে পারে, রকবাজিও তোফা জিনিস, তার আসন্ন পরিবেশ প্রৌঢ় বা বৃদ্ধের তুলনায় অনেক কম ভয়াবহ সেই-বা ড্যাং ড্যাং করে সিনেমায় যায় কেন? না, আমার মন সাড়া দিচ্ছে না।
মঞ্জু বসু আমাদের ভৌমিক সায়েবকে শুধিয়েছেন, বারাঙ্গনা বীরাঙ্গনাতে রূপান্তরিতের একটি উদাহরণ দিন। ভৌমিক ঠিক উত্তরই দিয়েছেন– বাজিরাও প্রেমিকা মস্তানা বেগম।
আমি উল্টোটার বিস্তর উদাহরণ দিতে পারি। বীরাঙ্গনা কী করে বারাঙ্গনা হয়। যে কোনও খবরের কাগজে যে-কোনও দিন দেখতে পাবেন। আমি তো প্রথম দিনে হকচকিয়ে উঠেছিলুম। এক বিখ্যাত বাঙলা দৈনিকের প্রথম পাতার এক কোণে দেখি, একটি সৌম্যদর্শন মহিলার ফোটোগ্রাফ এবং নিচে লেখা বারাঙ্গনা– অমুক। এদের কি মাথা খারাপ না এরা পাগল যে বারাঙ্গনার ছবি কাগজের পয়লা পাতায় ঘটা করে ছাপায়। তলায়। আবার পরিচয় মহিলাটি বঁটি হাতে একা একটা ডাকাতকে ঘায়েল করে প্রাণ হারান। তখন আমার কানে জল গেল। বাঙলা হরফের উপরে ও নিচের দিকের অংশ প্রায়ই ভেঙে যায়। দীর্ঘইকারের উপরের লুপটি ভেঙে যাওয়াতে বী বদলে হয়ে গিয়েছে বা। এটা একদিনের নয়। উপরের লুপ (বঞ্চিত শব্দে উপরের হুক ভেঙে গেলে অবস্থা আরও মারাত্মক), নিচের হ্রস্বউকার গণ্ডায় গণ্ডায় নিত্যি নিত্যি ভাঙে। আমরা অভ্যাসবশে পড়ে যাই বলে লক্ষ করিনে। যদি ঠিক যেরকম ছাপাটি হয়েছে– ভাঙাচোরার পর সেরকমটি পড়েন তবে দেখবেন বিস্তর বীরাঙ্গনা বারাঙ্গনা হচ্ছেন, এবং আরও অনেক সরেস উদাহরণ পাবেন সেগুলো স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ছাপলে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারতুম না। আপনাকে বলে রাখি, এখনও পারিনে– তবে সেটা পাওনাদারের ভয়ে।
অরুণ গুহ শুধিয়েছেন, এমন একটি আশ্চর্য জিনিসের নাম বলুন যা আজ আছে কিন্তু ত্রিশ বৎসর আগে ছিল না। ভৌমিক উত্তর দিয়েছিলেন, শচীন ভৌমিক। সরেস উত্তর। তার পর অরুণ গুহ ফের শুধিয়েছেন, এমন একটি জিনিসের নাম বলুন যা না থাকলে বিশ্বের কোনও ক্ষতি হত না।- ভৌমিক উত্তর দিয়েছিলেন, অরুণ গুহ। আমি শচীন ভৌমিক হলে লিখতুম, শচীন ভৌমিক–এবারেও। কারণটা বুঝিয়ে বলি।
রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকী চলেছে, সেই সুবাদ নিয়েই বলছি–
বিলাতের বিখ্যাত স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন একবার পৃথিবীর সেরা সেরা গুণীজ্ঞানীদের, প্রশ্ন শোধান,
১. আপনার সবচেয়ে প্রিয় পাপমতি কী (হোয়াট ইজ ইয়োর বেস্ট ফেভরিট আইস??
২. আপনার সবচেয়ে প্রিয় পুণ্যমতি কী (হোয়াট ইজ ইয়োর মোস্ট ফেভারিট ভার্চু?)? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন–
১. ইনকনসিসটেনসি (অর্থাৎ কোনও জিনিসে অবিচল থাকতে পারিনি– অর্থাৎ মত বদলাই)।
২. ইনকনসিসটেনসি (অর্থাৎ কোনও জিনিসে অবিচল থাকতে পারিনে– অর্থাৎ মত বদলাই)।
একবার চিন্তা করেই দেখবেন, ইকসিটেসি জিনিসটা পাপ বটে, পুণ্যও বটে।
যখন আমি স্বার্থের বশে কিংবা শত্রুভয়ে কাপুরুষের মতো আপন সত্য মত বদলাই (কুলোকে বলে এ ব্যামোটা রাজনৈতিকদের ভিতরই বেশি টার্নকোট এর নাম) তখন আমার ইকসিসটেনসি পাপ। আবার যখন বুঝতে পারি আমার পূর্বমত ভুল ছিল, তখন লোক-লজ্জাকে ড্যাম-কেয়ার করে, এমনকি প্রয়োজন হলে স্বার্থত্যাগ করেও যখন মত বদলাই তখন আমার ইনকনসিসটেনসি সাতিশয় পুণ্যকর্ম।
ঠিক সেইরকম ভৌমিক সায়েব যখন বলেন তিনি ত্রিশ বৎসরের আশ্চর্য জিনিস, আমরা সানন্দে সায় দিই। কারণ তিনি সুন্দর সুন্দর এবং চোখা চোখা মৌলিক এবং চিন্তাশীল উত্তর দিতে পারেন। কখনও আনন্দিত হয়ে বলি বাঃ, কখনও মার খেয়ে বলি আঃ।
আর তিনি না থাকলেও কোনও ক্ষতি হত না। ইংরেজিতে বলে, যা তোমার অজানা সে তোমাকে বেদনা দিতে পারে না। কিংবা বলব, আমরা জানিলাম না, আমরা কী হারাইতেছি।
একটু চিন্তা করে দেখুন, কথাটা শুধু ভৌমিক সাহেব না, টলস্টয়, কালিদাস, আপনি আমি সকলের বেলায়ই খাটে কি না।
***
রবীন্দ্রনাথ ও ইনকনসিসটেসির সুবাদে আমাদের দুটি নিবেদন আছে।
গেল মাসে মিস গেছে তার জন্যই আমি সম্পূর্ণ দায়ী নই। বড় লেখক হলে আমি অনায়াসে বলতে পারতুম, মশাই, ইন্সপিরেশ আসেনি-আমি কি দর্জি না ছুতোর অর্ডার মাফিক মাল দেব? তা নয়। আমি সাধারণ লেখক। আমি আজ পর্যন্ত কখনও ইন্সপায়ার্ড হয়ে লিখিনি। আমি লিখি পেটের ধান্দায়। পূর্বেই বলেছি, চতুর্দিকে আমার পাওনাদার। কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যতবার ফুরিয়ে গিয়েছে ততবারেই হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে, তবু না বলে উপায় নেই, আপনি হয়তো লক্ষ করেননি, আমি চাকরিতে থাকাকালীন কোনও প্রকারের সাহিত্যসৃষ্টি করিনে– চাকরিতে থাকাকালীন আমার কোনও বই বেরোয়নি। তখন তো পকেট গরম, লিখতে যাবে কোন মূর্খ। অতএব ইনসুপিরেশনের দোহাই কাড়লে অধর্ম হবে।
আমি গিয়েছিলুম বরদা। সেখানে আমি মধ্য যৌবনে আট বছর কাজ করি। ১৯৪৪-এ বরদা ছাড়ি। সেখানে রবি শতবার্ষিকী উদ্বোধন করতে আমাকে আহ্বান জানানো হয়, পুরনো চেনা লোক বলে, অন্য কোনও কারণে নয়। না গেলে নেমকহারামি হত। ট্রেনে লেখা যেত না? না। আপনি যদি গবেষণামূলক উচ্চাঙ্গ উন্নাসিক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ চাইতেন সে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় ট্রেনে-বাসে, ভেটিবুলে-তরুমূলে যেখানে-সেখানে বসে না বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও লিখে দিতে পারি। কিন্তু একটুখানি রসের ভিয়েন দিতে গেলেই চিত্তির। তার জন্য ইন্সপিরেশ না হোক, অবকাশটি চাই। সাধে কি আর জি. কে, চেস্টারসন বলেছিলেন, টাইমস্ কাগজের গুরুগম্ভীর সম্পাদকীয় কলাম আমি দিনের পর দিন আধ ঘণ্টার ভিতর লিখে দিতে পারি, কিন্তু ওই যে ট্রাম-বাসের কাগজ টিট বিটস–তার পয়লা পাতার বিশটি রসিকতার চুটকিলা গল্প একসঙ্গে আমি কখনও রচনা করে উঠতে পারব না। অথচ কে না জানে, চেস্টারসন ছিলেন সে যুগের প্রধান সুরসিক লেখক। আর আমি? থাকগে।
দ্বিতীয়ত, ওই ইনকনসিসটেনসির কথা। ওটায় বাড়াবাড়ি করলে লোক ভাববে পাগল। গল্পটা তাই নিয়ে।
ট্রেনে ফেরার মুখে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে শোনা। এটা উনি কোনও ছাপা বই থেকে পড়ে বলেছেন কি না হলপ করতে পারব না। তবে এইটুকু বলতে পারি সেই থেকে যাকে বলেছি, তিনি উত্তরে বলেছেন, এটা তিনি আগে কখনও শোনেননি। আজ দোল-পূর্ণিমার চন্দ্রগ্রহণ ছিল– তার সঙ্গেও এর কিঞ্চিৎ যোগ (অর্থাৎ এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ) রয়েছে।
ক্লাস-টিচার বললেন, গত শতাব্দীর সূর্যগ্রহণ থেকে চন্দ্রগ্রহণ সংখ্যা বিয়োগ করে, তোমার কলারের সাইজের সঙ্গে এ বাড়ির থামের সংখ্যা যোগ দিয়ে, পদীপিসির নামকে ক্ষান্তমাসির নাম দিয়ে ভাগ করে বল দেখিনি আমার বয়স কত?
ছেলেরা তো অবাক! এ কখনও হয়!
একটি চালাক ছোকরা হাত তুলে বললে, আমি পারি, স্যর।
টিচার বললেন, বল।
চুয়াল্লিশ।
টিচার ভারি খুশি হয়ে বললেন, ঠিক বলেছিস। কিন্তু স্টেপগুলো বাতলা তো, কী করে তুই সঠিক রেজাল্টে পৌঁছলি।
ছেলেটি তিন গাল হেসে বললে, মাত্র তিনটি স্টেপ, স্যর। অতি সোজা :
আমাদের বাড়িতে একটা আধ-পাগলা আছে;
তার বয়স বাইশ;
অতএব আপনার বয়স চুয়াল্লিশ ॥
.