সম্পর্ক
দুধের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে অনিলা সামনের চেয়ারটায় বসল। শৈলেশ বলল, “আজ আবার কে এসেছিল? তোমার কোন ফ্রেণ্ড?”
কথাটার অর্থ বুঝতে অনিলার দেরি হল না; তাকিয়ে তাকিয়ে খাবার ধরন দেখল শৈলেশের। ডিমের তরকারি মুখে দিয়েই রেখে দিয়েছে শৈলেশ: চারটে মাত্র পাতলা রুটি, অতি কষ্টে যেন দুটো খেয়েছে। শীত পড়ায় ক’দিন থেকে বাঁধাকপির পাতা, আর গাজর-বিট, টমাটো এইসব সবজি দিয়ে সুপ না স্টু খাবার বাতিক হয়েছে। নিয়মিত দু’বেলা অনিলাকে বেঁধে দিতে হয়, সেই স্টু-এর বাটিটাও ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি, ভাজাভুজি কিছু মুখে দিয়েছে!
অনিলা প্রায় নিঃসন্দেহ হল, বাতিকগ্রস্ত মানুষ হলেও কোথাও কারও পাল্লায় পড়ে কিছু খেয়েছে, এখন মুখে রুচছে না, অগত্যা একটা অছিলা করার চেষ্টা।
জবাবে অনিলা বলল, “আমার কে এসেছিল তা নিয়ে তোমার কি!…তোমার যা বলার বল!”
শৈলেশ অক্লেশে বলল, “ডিমে ভয়ঙ্কর নুন, পুড়ে গেছে।”
“তোমার ওই স্টু না কি ছাই ওটায় বুঝি খুব ঝাল হয়েছে?”
“ওটা অখাদ্য, টেস্টলেস।”
“রুটি?”
শৈলেশ আর রুটির খুঁত বর্ণনা করল না, বলল, “তোমার কোনো জিনিসে মন নেই। রান্না করতে বসে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্প জুড়লে এই রকমই হয়।”
অনিলা অনেকক্ষণ যাবৎই অসন্তুষ্ট, এবারে বিরক্ত হল। রাগের গলায় বলল, “তুমি কাকে কি শেখাও? আমি কচি খুকি নাকি?”
“তোমায় কে শেখাবে।” শৈলেশ অনেকটা যেন উপহাসের স্বরে বলল, বলে জলের গ্লাস মুখে তুলল।
অনিলা আরও রাগল। বলল, “তোমার মুখে এখন কিছুই রুচবে না।”
শৈলেশ কথাটা গায়ে মাখল না, দুধের কাপ টেনে নিল। তারপর নিতান্ত যেন পরিহাস করছে, বলল, “কে এসেছিল আজ?”
“কেউ না। আমার আর কে কবে আসে!”
“কেন, সেদিন যে কোন্ বন্ধু এল!”
“বন্ধু নয়, প্রতিবেশী। দয়া করে এসেছিল।”
শৈলেশ দুধের কাপ মুখে তুলল। বেশ গরম।
অনিলা অল্পক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল, শেষে তার কালো নরুনপাড় থানধুতির আড়াল থেকে বাঁ হাত বের করল। হাতের মুঠোয় একটা পোস্টকার্ড। আলোয় সেই চিঠি সামান্য মেলে ধরে শৈলেশের দিকে ঠেলে এগিয়ে দিল।
শৈলেশ বুঝল না, বলল, “কি?”
“চোখ আছে, দেখ। সুখবর পাবে?”
পোস্টকার্ড তুলে নিয়ে শৈলেশ তার নাম ঠিকানা দেখল। অপরিচিত হস্তাক্ষর। চিঠির আধখানাও পড়া হয়নি, তার মুখে কেমন একটা বিব্রত ও আড়ষ্ট ভাব ফুটে উঠল। মুখ তুলে পলকের জন্যে দেখল অনিলাকে, অনিলা স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মুখ নামিয়ে বাকী চিঠিটা অতি দ্রুত পড়ে নিয়ে শৈলেশ কেমন সঙ্কুচিত, লজ্জিত ও অস্থির হয়ে বলল, “বা এ তো বেশ রসিকতা!…কে এই রসিকতা করল!”
“তুমিই জান।” অনিলা শুকনো গলায় ছোট করে জবাব দিল।
“আমি কিছু জানি না।” শৈলেশ খুব জোর গলায় প্রতিবাদ করল। তারপর যেন তার কিছু মনে পড়ে গেল, বলল, “এ নিশ্চয় শিবদাস কিংবা মজুমদারের কাণ্ড। সেদিন হাসি-ঠাট্টা হচ্ছিল, ওরাই কেউ করছে।… ননসেন্স। ছি ছি, ভদ্রলোক কি ভাববেন।”
“ভাববার কি আছে! তিনি তো খুশিই হবেন।” অনিলা পালটা জবাব দিল।
শৈলেশ দু’পলক অনিলার মুখ দেখল। অনিলার এই বাঁকা পরিহাস তার পছন্দ হল না; ভাল লাগল না, বলল, “কে খুশি হবে না হবে তাতে আমার কিছু আসে যায় না।” বলে সামান্য থেমে, যেন তৃতীয়জন কাউকে শোনাচ্ছে, বলল, “আমার আর কাজ নেই, কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ের চিঠি লিখব! পঁয়তাল্লিশ বছরে বিয়ে! ছেলেমানুষি করার বয়েস আমার নেই।”
“বয়েস না থাক, সাধ তো হতে পারে।” অনিলা যেন ঠোঁট জুড়ে হাসল।
শৈলেশ প্রথমে কিছু বলল না, তারপর বলল, “তা পারে”, বলে গম্ভীর হয়ে গেল। দুধের কাপের ওপর চোখ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল, নিঃশ্বাস ফেলল তারপর বলল, “সাধ মেটাবার ইচ্ছে থাকলে আরও আগে মেটাতে পারতাম।”
অনিলা আর কিছু বলল না।
কিছু সময় পরে শৈলেশের শোবার ঘরে হাতের ক’টা খুচরো কাজ সারতে এল অনিলা। জলের গ্লাস রাখল; সকালে মাঝে মাঝে ফ্রুট সল্ট খায় শৈলেশ, গরম জলের ফ্লাস্ক; কাচের গ্লাস, চামচ গুছিয়ে রেখে দিতে হয়। অনিলা একে একে সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে শৈলেশকে দেখছিল।
সাবেকী ইজিচেয়ারে শুয়ে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে শৈলেশ, বাঁ হাতের আঙুলে সিগারেট। বইটা কিসের অনিলা বলে দিতে পারে, সস্তার ইংরেজী গোয়েন্দা বই!
অনিলার মনে হল শৈলেশ বেশ কিছুটা ক্ষুণ্ণ; বই পড়ছে বলে মনে হয় না, পাতা ওল্টাচ্ছে কিংবা অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে। উত্তরের জানলাটা বন্ধ করে দিল অনিলা। বিছানার মোটা চাদরটা উঠিয়ে পাট করে পায়ের কাছে রাখল। হাত দিয়ে সাদা চাদরের ভাঁজ ভেঙে দিল, ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে রাখল। পায়ের দিকে পাতলা কম্বল, আর ক’দিন পরেই লেপ চাইবে; কম্বলটা খুলে রাখল অনিলা।
“তা তুমি একটা বিয়ে করই না; এখনও বেলা বয়ে যায়নি।” অনিলা ঠাট্টা করে বলল, বলে বিছানার একপাশে বসল।
শৈলেশ কথার জবাব দিল না।
সামান্য অপেক্ষা করে আবার বলল অনিলা, “কি, কথা বলছ না যে।”
হাতের বই মুড়ে শৈলেশ জবাব দিলে, “বাজে কথায় কী লাভ!” ও হাই ওঠানোর মতন মুখ হাঁ করল, হাত উঠিয়ে আলস্য ভাঙল। অর্থাৎ যেন অনিলাকে বোঝাতে চাইল তার ঘুম পেয়েছে, সে ঘুমুবে, এবার তুমি যাও।
অনিলা উঠল না; হাসল, চাপা হাসি। বলল, “রাগ করেছ?”
“না; কিসের রাগ!” শৈলেশ সিগারেটের শেষ টুকরোটুকু ঠোঁটে ঠেকিয়ে শান্ত গলায় জবাব দিল।
“তোমার এই রাগের মানে হয় না।…চিঠিটা ডাকে এসেছে, আমি তোমায় দিয়েছি। তোমার অফিসের বন্ধুরা কে কী ঠাট্টা রসিকতা করেছে আমার কি তা জানবার কথা।” অনিলা নরম করে বলল।
“চিঠির জন্যে আমি তোমায় কিছু বলিনি।”
“বেশ বলনি।…এখন আমি যা বলছি তাই শোন। এখনও তোমার বিয়ের বয়েস পেরিয়ে যায়নি। সত্যি, একটা বিয়ে করে ফেল।”
শৈলেশ কোনো কথা বলল না, সিগারেটের টুকরো ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শুতে যাবার আগে সে এলার্ম ঘড়িতে দম দেয়, বরাবরের অভ্যেস। টেবিল থেকে ঘড়ি তুলে নিয়ে দম দিতে লাগল।
অনিলা কয়েক দণ্ড বিছানার ওপর হাসিমুখেই বসে থাকল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হালকা গলায় বলল, “যা বললাম ভেবে দেখ—”
শীত তেমন কিছু না—নভেম্বরের মাঝামাঝি; তবু এই শীতের শুরুতে কেমন করে ঠাণ্ডা লেগেছিল। কাল সারাদিন গায়ে হাতে ব্যথা এবং মাঝে-মধ্যেই হাঁচি হয়েছে। আজ সামান্য সর্দি ভাব। হয়ত তাই চোখ জ্বালা করছিল, মুখ বিস্বাদ। অন্ধকারে শৈলেশ অন্যমনস্কভাবে নিজের কপাল দেখল, না—গরম লাগছে না। পায়ের ওপরকার কম্বলটা কোমর পর্যন্ত টেনে নিল শৈলেশ!
অনিলা বাস্তবিক কি ভাবল, কিছু মনে করছে কিনা— শৈলেশ বুঝতে পারল না। কেমন বলল, তুমি একটা বিয়েই কর না, বেলা বয়ে যায়নি। কথা শিখেছে খুব, কিছু বলতেই মুখে আটকায় না আজকাল, অক্লেশে বলল— বয়েস না থাক, সাধ তো হতে পারে!
শৈলেশ অন্য সময় এতটা ক্ষুব্ধ হত কি হত না বলা যায় না, কিন্তু আজ হয়েছে। অনিলার উচিত ছিল কিছু বলার আগে কথাটা ভাবা। বিয়ের সাধ হলে— অনেক আগে না হোক— দু’ চার বছর আগে সে বিয়ে করতে পারত। তখন বয়স চল্লিশের নীচে এবং অবস্থাও সামান্য বদলে এসেছে। একটা বিয়ে করা তখন একেবারে অসম্ভব ছিল না। চাই কি, চাকরি-করা কোনো মেয়েকেও বিয়ে করা যেত।
মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারে না। তোমায় আমি ওপর থেকে যতটুকু দেখছি, তোমায়-আমায় যতটা কথা হল, সামাজিক কি পারিবারিক আদান-প্রদান—তার ওপরই তোমায় দেখছি, কিংবা আরও একটু বেশি হয়ত।
এই অনিলা আজ আট-ন’ বছর তার সংসারে। মনে করলে হাসি পায়, দুঃখও হয়। এল যখন তখন আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে; রোগা, নির্বোধ, চরম দুঃস্থ। মনোরঞ্জনকে নাকি মুগ্ধ করেছিল। আর মনোরঞ্জন, যার কোনো চালচুলো ছিল না, দায়দায়িত্ব ছিল না, নিতান্ত হাউই বাজি, আগুন লাগতেই সব কাজে হুস করে জ্বলে উঠে ছিটকে পড়ত এবং অচিরে ছাই হয়ে যেত— সেই মনোরঞ্জন কাঁথি থেকে মেয়েটাকে ঘাড়ে করে নিয়ে হাজির। বলল, আমার বউ রে, শৈল। বিয়ে করে ফেললাম।
শৈলেশ বিমূঢ় হয়েছিল। এ কে? রংটা ফরসা যদিও, তবু গায়ে মাংস নেই যেন, শরীরে বাড় নেই গড়ন পুরো ওঠেনি; লম্বা পাতলা মুখ, নাকটা টিয়াপাখির মতন, বড় বড় দুই নির্বোধ চোখ। পরনে একটা ঘোর লাল শাড়ি, সিঁথিতে চওড়া সিঁন্দুর। পায়ে বুঝি মনোরঞ্জনেরই চটি।
আড়ালে শৈলেশ বলল, “ওকে কেউ ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে তোর? নাকি নিজেই চেপে বসেছে?”
মনোরঞ্জন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না রে, আমিই চামর্ড হয়ে গেলাম। মনের জোর যা— তুই বুঝবি না, সাপের মুখের সামনে পা বাড়িয়ে দিতে পারে।”
“ওকে নিয়ে থাকবি কোথায়?”
“এখন তোর কাছে তো থাক, পরে একটা হিললে করব…”
মনোরঞ্জন ওই রকমই। সম্পর্কে ভাই, মাসতুতো। বয়সও সমান সমান, বন্ধু তো বটেই; কিন্তু এই বিয়ের বোঝা সে যেভাবে শৈলেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিল, তাতে শৈলেশ খুশি হতে পারল না।
মা বললে, “ঘরের বউ, রাস্তায় গিয়ে থাকবে নাকি ওই বাউন্ডুলের সঙ্গে।”
অনিলা তখন থেকেই এ বাড়িতে পাকাপাকি ঠাঁই পেয়েছে। মনোরঞ্জন অথবা মা কেউই তলিয়ে বোঝেনি শৈলেশের যৎসামান্য চাকরিতে এই বোঝা বয়ে যাওয়া কত কষ্টকর। হয়ত এতটাই কষ্টের হত না, যদি না শৈলেশ আরও ক’টা দায়দায়িত্ব বইত। দিদির সংসারে কিছু সাহায্য ছিল, দেশে জ্যাঠামশাইকে পঁচিশ ত্রিশটা করে টাকা মাসে মাসে পাঠিয়ে পিতৃ-ঋণ শোধ করতে হত। একবার ঝোঁকের বশে শৈলেশ জ্যাঠামশাইকে লিখেছিল, বাবার ধার আমি শোধ করব, এ-বিষয়ে আপনি মাকে কিছু লিখবেন না। জ্যাঠামশাই খুশি হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, যোগ্য পুত্রের মতনই কথা তোমার। আজকাল ক’জন আর পিতৃ-সত্য পালন করে।
সংসারের সে-সময়কার চেহারাটা ভাবলে শিউরে উঠতে হত। আঠাশ টাকার চাকরিতে অন্ন, বস্ত্র, ঋণশোধ, অসুখবিসুখ, তারপরও কত কি! রোজগারের জন্যে তখন শৈলেশ ছেলেও পড়াত কখনও, কখনও ইন্সিওরেন্সের দালালি করত।
জীবনে কয়েকটা জিনিস শৈলেশ খুব গোঁড়ামির সঙ্গে পালন করত। তার একটা ছিল সম্ভ্রমবোধ, অন্যটা দায়িত্ব। আত্মসম্মান, শোভনতা, ভদ্রতা ইত্যাদির জন্যে সে কখনও চাকরিতে খোশামোদ করেনি, দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের বাড়িতে ধরনা দেয়নি; শোভনতা ও ভদ্রতা বিষয়ে সে এত সচেতন ছিল যে, ছেঁড়া লুঙ্গি পরে বাজারে যেত না, বন্ধুদের পয়সায় চা-সিগারেট খেত না। দারিদ্র্যের নোংরামি সে ঘৃণা করত, দরিদ্রের জীবনে তার আপত্তি ছিল না। এ-সব সত্ত্বেও শৈলেশের সবচেয়ে বেশি গোঁড়ামি ছিল দায়িত্ব সম্পর্কে। বলা যায়, দায়িত্ব-বিষয়ে তার এক ধরনের মানসিক উদ্বেগ ছিল।
সংসারে নানান দায়িত্বের সঙ্গে মনোরঞ্জনের দায়িত্বও কিছু ছিল, হুট করে বিয়ে করে এনে মনোরঞ্জন সেই দায়িত্ব স্থায়ীভাবে ঘাড়ে তুলে দিল। বিয়ের মাস পাঁচ-ছ পরে মনোরঞ্জন কলকাতার রাস্তায় মশাল জ্বেলে মিছিল বের করেছিল, সেই মশালের আগুনে একটা বাচ্চা পুড়ল, মনোরঞ্জনও পুড়ল। হাসপাতালে একটানা তিন মাস। বিকৃত, বীভৎস চেহারা নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে মরে গেল। একপক্ষে ভালই হয়েছে, বেঁচে থাকলে অক্ষম ও অবজ্ঞাত হয়ে থাকত, হয়ত অনিলাও সেই দগ্ধ ও কুরূপ স্বামীকে সহ্য করতে পারত না।
মনোরঞ্জন একটু নাটুকে ছিল। হাসপাতালে দেখা করতে গেলে বলত, “শৈল, আমি বরাবরই জানতাম ঝট করে একদিন মরে যাব।…সেই ছেলেটার জন্যে আমার ঘুম হয় না, কতদিন ধরে ঘুমোতে পারি না। আমি এখনও বেঁচে আছি কেন! ভগবানের এ বড় অন্যায়।”
হাসপাতালে অনিলার যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মনোরঞ্জনই বারণ করত। দু’চারবার অবশ্য অনিলা গিয়েছে। গিয়েছে কাঠের মতন, ফিরেছে কাঠ হয়ে। তাকে একদিনও কাঁদতে দেখেনি শৈলেশ, একমাত্র শবদাহের দিন ছাড়া।
অনিলার ব্যাপারে মনোরঞ্জন বলেছিল, “কোনো আশ্রমটাশ্রমে দিয়ে দিস পরে। তুই আর কত টানবি, শৈল। আমি দুঃখ করব না, তুই ওকে মেয়েদের কোথাও একটা ঢুকিয়ে দিস।”
অনিলাকে অবশ্য কোথাও পাঠানো হয়নি; শৈলেশের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। মাও কোনদিনই এতে রাজী হত না।
এর বছর দুই পরে মা পড়ল। রোগটা প্রথম এক বছর ঠিক মতন ধরা পড়ল না, তারপর যখন ধরা পড়ল তখন থেকেই শৈলেশ বুঝল মার যাবার দিন এসে গেছে। যথারীতি মা চলে গেল।
সংসার কেমন ফাঁকা হয়ে এল তারপর, মনোরঞ্জন নেই, মা নেই, দিদিরা কাশীতে চলে গেছে, আর সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। একমাত্র বাবার ঋণ তখনও শুধতে হচ্ছে। এ-সময় শৈলেশের কিছু উন্নতিও হয়েছে। বিয়ে করার বাসনা হলে তখনই করতে পারত সে। একবার অফিসের চক্রবর্তীদা সে চেষ্টাও করেছিলেন, তাঁরই এক বন্ধুর মেয়ে, ওই অফিসেই সবে চাকরিতে ঢুকেছে, তার সঙ্গে শৈলেশের বিয়ের কথা উঠিয়েছিলেন, ধরাধরি করেছিলেন খুব, শৈলেশের বন্ধুরাও বলেছিল, ‘তোর আপত্তিটা কি! দেখতে-শুনতে মোটামুটি ভাল মেয়েটা, দু’পয়সা বাড়িতেও আনবে। রাজি হয়ে যা!…’ শৈলেশ মাথা নেড়েছে, ‘না রে, এখন আর ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ, চল্লিশ বছর হতে চলল প্রায়, এখন টোপর পরতে পারব না।’
বলতে কি, তখন অনায়াসে শৈলেশ বিয়ে করতে পারত। বউকে খাওয়ানো পরানো তার অসাধ্য ছিল না। কিন্তু করেনি।
তারপর আরও তিন-চার বছর কাটল। শৈলেশ এখন চাকরিতে অনেকটা এগিয়েছে, উন্নতি মন্দ হল না। বাবার ঋণ শোধ হয়েছে। দায় দায়িত্ব বস্তুত আর কিছু নেই, এক অনিলা বাদে। অবশ্য আজকের অনিলা আর সেদিনের অনিলা এক নয়। সেই গ্রাম্য, নির্বোধ অশিক্ষিত অনিলা আজ সবদিক থেকেই পালটে গেছে। তার শরীর আর শীর্ণ রুগ্ণ নয়; স্বাস্থ্য স্বাভাবিক; তাকে আর নির্বোধ বলা যাবে না, সংসারে সে অনেক শিখেছে লেখাপড়াও মোটামুটি শৈলেশ তাকে শিখিয়েছে। মাঝে মাঝে শৈলেশ যে ঠাট্টা করে বলে, একটা কাঠামো নিয়ে এসেছিলে, প্রতিমা তৈরি হয় দেখেছ, সেই রকম। আমার কাঁধে বসে দিব্যি তো হৃষ্টপুষ্ট হলে মাথায় ঘিলু হল, এবার সরে পড়, বাপু— তা কিছু মিথ্যে নয়।
সবই বদলেছে অনিলার, শুধু সেই অসম্ভব ধারাল নাক আর চোখের মণির রং বদলায়নি; আর বদলায়নি মাথার চুল। বরং মাথার চুল আরও বেড়েছে। বিশ্বাস করা মুশকিল, আজকালকার দিনের মেয়েদের মাথায় এমন চুল থাকতে পারে। অনিলা মাথার চুল খুললে সেই কালো, ঘন, দীর্ঘ চুলের গোছা তার হাঁটু ছড়িয়ে নেমে আসে। অথচ অনিলা মানানসই লম্বা, মেয়েরা যতটা মাথায় লম্বা হলে মানায়।
রাস্তায় কিংবা কোথাও কোনো মেয়ের মাথার মস্ত খোঁপা, কিংবা দীর্ঘ বিনুনি দেখলে শৈলেশের অনিলার কথা মনে পড়ে এবং সে প্রায় নিঃসন্দেহ হয়, অনিলার তুলনায় এই কেশগুচ্ছ নিকৃষ্ট। অনিলার মাথার ওই আশ্চর্য সুন্দর চুলের ওপর কেমন একটা আকর্ষণ ও মোহ আছে যেন শৈলেশের।
এই অনিলাকে এখন এই সংসারেরই আধখানা বলে মনে করে শৈলেশ। বস্তুত মেয়েটি যে কে, এবং তার সঙ্গে প্রকৃতই আত্মীয়তার কি সম্পর্ক অনিলা তার গলগ্রহ কি না— এ-সব চিন্তা বহুকাল আগেই শৈলেশের মন থেকে মুছে গেছে। সে কখনও আর ভাবে না, অনিলা তার কেউ নয়, তার সংসারের কেউ নয়; বরং যে ধারণার বশে মানুষ মা, বোন, ভাই, স্ত্রী ও সন্তানকে নিজের বলে গ্রহণ করে, শৈলেশ অনিলাকে সেইভাবে গ্রহণ করেছে। বলা বাহুল্য, মা বেঁচে থাকলে যে অধিকার তাঁর থাকত এমন কি শৈলেশ বিয়ে করলে যে পারিবারিক অধিকার তার স্ত্রী পেত—অনিলা এই সংসারের সেই অধিকার ভোগ করছে।
আজ এখন বিছানায় শুয়ে এলোমেলোভাবে পুরনো কথা ভাবতে গিয়ে শৈলেশ যেন আর উৎসাহ পেল না, এবং যেভাবে যে পুরনো কোনো বই কদাচিৎ পড়ার জন্যে খুলে বসে, সামান্য পাতা চোখ বুলিয়ে আলস্যভরে আর পড়তে পারে না, বই মুড়ে রাখে, অনেকটা যেন সেইভাবেই পুরনো কথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আজকের ঘটনাই তাকে অনেকক্ষণ থেকে বিরক্ত করছে।
অনিলার কাছে তখন মিথ্যে কথা বলা হল। আসলে সত্যিই শিবদাস কি মজুমদার কেউই রসিকতা করে পাত্রীপক্ষকে চিঠি লেখেনি। এটা ঠিক, ওই কাগজের পাত্র চাই বিজ্ঞাপনটা ঠাট্টা-তামাশা করেই শিবু এবং মজুমদার দেখছিল, দেখতে দেখতে তার একটা বিজ্ঞাপন লাল পেনসিলে টিক মেরে শৈলেশকে দিল। বলল, “ওহে শৈলেশ— এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়ে দাও। ত্রিশ বছরের মেয়ের জন্যে পাত্র চাইছে। বয়স্ক পাত্র— একমাত্র বউ বেঁচে থাকলেই আপত্তি, নচেৎ ছেলেপুলে থাক, কায়স্থ হোক কি ব্রাহ্মণ হোক বৈদ্য হোক আপত্তি নেই। পাত্রী প্রবাসী বাঙালী।…তোমার সুটেবুল্।”
এরকম হাসি-ঠাট্টা ওরা করে শৈলেশকে নিয়ে। এবারেও করেছিল। কিন্তু কোনো কোনো সময় যেন মাত্রা হারিয়ে কিছু করে ফেলে মানুষ, শিবুরা তাই করেছিল। শৈলেশ যে প্রায় বৃদ্ধ হতে চলেছে এবং এখন বিয়ে করলে ওই রকম প্রবীণা কাউকে বিয়ে করতে হবে— তাতে তারা দ্বিমত নয়। বরং বলা যায়, শৈলেশের বিয়ের দিন চলে গেছে বলেই এখন আর বিয়ে হবে না, সপুত্র সকন্যা কোনো বিধবার ভরণপোষণের ভার নেওয়াই হতে পারে।
“এই পাত্রীটি কিন্তু বিধবা নয়।” শৈলেশ বলল।
“ও কথা কি বিজ্ঞাপনে লেখে।…নেগোসিয়েসান কর, দেখবে ক্রমশ রহস্য উদঘাটিত হবে।” মজুমদার জবাব দিল।
“প্রবাসে তার আরও কত কি আছে— কি বল, মজুমদার!” শিবু বলল, “থাকাই সম্ভব।”
শৈলেশ তখন আর কিছু বলেনি। কিন্তু তারপর বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে যখন ট্রাম ধরতে গিয়ে আর ট্রাম ধরল না, আসন্ন শীতের মৃত বৈকালের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে লাগল, হাঁটতে হাঁটতে ভিড় গাড়ি-ঘোড়া, কোলাহল রাক্ষুসে বাড়িগুলো পেরিয়ে ফাঁকায় এসে দাঁড়াল, তারপর মাঠে, শেষে আউটরাম ঘাটে— তখন বিকেল মৃত। আকাশও শূন্য ধূসর হয়ে গেছে, গঙ্গার জল কালো, জাহাজগুলো প্রায়ন্ধকারে দাঁড়িয়ে, নদীর জলের অদ্ভুত এক শব্দ হচ্ছে— যেন এই শব্দ সময় প্রবাহকে ভয়ংকরভাবে অনুভব করিয়ে দিচ্ছে। শৈলেশ বসল। তার মাথার ওপর অজস্র পাখি গাছ থেকে গাছে উড়ে রাত্রের আশ্রয় করে নিল, স্টিমারের ভোঁ বাজল কোনো অন্ধকার সীমানা থেকে শীতের বাতাস এবং গঙ্গার জলীয় ঠাণ্ডায় শৈলেশ অকস্মাৎ অনুভব করল, সে আশা এবং আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির জগৎ পেরিয়ে চলে এসেছে। নিজেকে বৃদ্ধ ও বঞ্চিত মনে হল, দুঃখ হল। না, দুঃখ নয়, অদ্ভুত এক বেদনা তাকে অধিকার করল। মনে হল, যেন সে এমন একটি সীমানা ছাড়িয়ে এসেছে যে, সীমানার পর স্বভাবতই সে আর কিছু কামনা করতে পারে না। জরাগ্রস্ত বৃক্ষের মতন প্রাণসম্পদহীন লতার মতন এখন তার মরে আসার কথা।
শৈলেশ সম্ভবত নিজেকে ঠিক এখনই পরিত্যক্ত বলে ভেবে নিতে পারল না। এবং বস্তুতই সে জীবনের স্বাভাবিক দাবিদার হবার সামর্থ্য রাখে কি রাখে না, অথবা সে আকাঙ্ক্ষা করলে যৌবনের সামগ্রী পেতে পারে কি পারে না— যেন তারই এক পরীক্ষায় নামল।
পরের দিন নিতান্ত কৌতূহলবশত, খানিকটা বা হঠকারিতা করে, কিংবা শিবু এবং মজুমদারের ওপর ক্ষুব্ধ ও ক্ষুণ্ণ হয়ে এবং সেই মানসিক হতাশাবশে একটা চিঠি গোপনে বিজ্ঞাপনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিল।
ঢিল ছোঁড়া হয়ে যাবার পর অবশ্য নিজের ছেলেমানুষিতে নিজে লজ্জিত হয়েছে শৈলেশ। কথাটা গোপনে রেখেছে। দিন দুই-চার অস্বস্তির সঙ্গে কাটিয়ে ও-বিষয়টা প্রায় ভুলেই যাচ্ছিল। সত্যি, তার আর মনেও ছিল না ঠিক; অথচ, অথচ আজ হুট করে একটা জবাব এসে গেল।
চিঠিটা খামে এলেও কথা ছিল। পপাস্টকার্ডে কি করে ভদ্রলোকে বিয়ে থার কথা লেখে শৈলেশ ভেবে পেল না। ভদ্রলোকের ওপর রাগ হল। অত্যন্ত কৃপণ এবং জ্ঞানহীন ভদ্রলোক।…নিজের ওপরেও অসন্তুষ্ট হল শৈলেশ, সে কেন বাড়ির ঠিকানা দিল? কোন বুদ্ধিতে?
এ-পাড়ায় আসার পর শৈলেশ কেমন প্রত্যেকটি চিঠিতে পুরো ঠিকানা লেখার অভ্যেস করে ফেলেছে। সেই অভ্যেসেরই পরিণাম।
যাই হোক, শৈলেশ ভাবল, যা হবার হয়ে গেছে। অনিলা হয়ত কিছু মনে করলেও করে থাকতে পারে, উপায় নেই। সে এই চিঠির জবাব দেবে না।
ঘুমোবার আগে শৈলেশ অবশ্য এ সান্ত্বনাও পেল যে, এখনও সে বিয়ের বাজারে অচল হয়ে যায়নি।
দিন পনের পরে আবার।
সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরতে অনিলা কিছু বলেনি। পোশাক-আশাক ছেড়ে শোবার ঘরে বসে শৈলেশ এডগার ওয়ালেস পড়ছে, অনিলা চা এনে দিল।
শৈলেশ বলল, “তোমার আজ খুব সুমতি যে! ভেবেছিলাম, এখন আর চা করবে না!”
চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে অনিলা বলল, “তোমার সেই বারিদবরণবাবু এসেছিলেন।”
“কে বারিদবরণ?”
“নামটাই ভুলে গেলে!…অত ঢাকাটুকির কি আছে! বিয়ে করবে কর— আমি কি মেয়ে ভাগিয়ে দিচ্ছি।”
নামটা ততক্ষণে মনে পড়ে গিয়েছিল শৈলেশের। অনিলার কথার ধরনটা তার পছন্দ হল না। “ও সেই চিঠির ভদ্রলোক।…তাঁর আসার কি ছিল?”
“আসবে না!…খোঁজখবর করতে এসেছিল।”
“আমি তাকে কোনো চিঠি দিইনি।”
“কি করে জানব!”
“শৈলেশ দু’মুহুর্ত অনিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অনিলার মুখে তেমন তিক্ততা; বিদ্রূপ, না ঘৃণা! সত্যিই শৈলেশ কোনো চিঠি দেয়নি। অথচ অনিলার মুখ দেখে মনে হল, অনিলা তাকে বিশ্বাস করেনি। ‘বিশ্বাস’ কথাটাই মনে ছুরির ফলার মতন গাঁথল শৈলেশের। অনিলা তার কথা বিশ্বাস করল না!
শৈলেশের মুখ-কান গরম হয়ে নিঃশ্বাস দ্রুত হল। চোখ জ্বালা করছিল।
শৈলেশ বলল, “ঠিক আছে, আবার যখন আসবে দেখা হবে।”
“আমি রবিবার সকালে আসতে বলেছি!”
শৈলেশ বিমূঢ় হল, স্তম্ভিত হল। অনিলার স্পর্ধার সীমা যেন অতি বেশি রকম অতিক্রম করে গেছে। “তুমি তাকে কেন আমার বাড়িতে আসতে বললে?” শৈলেশ কর্কশভাবে ধমকে উঠল।
“ভদ্রলোক রোজ রোজ ঘুরে যাবেন, তাই।” অনিলা নির্লজ্জের মতন জবাব দিল।
কে ঘুরে যাবেন, কে যাবেন না— সেটা আমি বুঝব, তুমি নও। তুমি কে? আমার ব্যাপারে তোমার মাতব্বরি করার কি আছে?”
অনিলা তাকিয়ে তাকিয়ে বলল, “মাতব্বরি করিনি, তুমি যা চাও তার ব্যবস্থা করেছি।”
শৈলেশ স্বভাবতই ধৈর্য হারাল। “তুমি কি মনে কর, তুমি ব্যবস্থা না করলে আমার কিছু হবে না! আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারব।”
“তবে তাই কর।”
“হ্যাঁ, করব।”
অনিলা আচমকা তীক্ষ্ণ গলায় শুধাল, “এতকাল করনি কেন?”
শৈলেশ কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এ প্রশ্নের জবাব সে জানে অথবা জানে না—বোঝা গেল না। রাগের মাথায় চিৎকার করে বলল, “আমার ইচ্ছে, আমার খুশি। …তোমারই বা এত লাগছে কোথায়! এতদিন ধরে যা ইচ্ছে করে গেছ, রাজত্ব করেছ বসে বসে, এখন তোমার ভয় হচ্ছে, সেটা হাতছাড়া হবে!…”
শৈলেশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, অনিলা বাধা দিয়ে বলল, “করতে না দিলেই পারতে!…যাক্গে, আমার কোনো রাজাও নেই, রাজত্ব নেই। তুমি অনায়াসে বিয়ে করে আনতে পার।” অনিলার দুই চোখের দৃষ্টি ধকধক করছিল, গলার স্বর কাঁপছিল। অনিলা আর কিছু বলল না, চলে গেল।
তারপর সমস্ত সন্ধেটাই আবহাওয়া গুমট ও স্তব্ধ হয়ে থাকল। শৈলেশ কোনো প্রয়োজনেই আর অনিলাকে ডাকল না; অনিলাও সামনাসামনি এল না। শৈলেশের রাতের খাওয়া অত্যন্ত নিঃশব্দে সমাধা হল। রাত বাড়ছিল বাড়ির বাতিগুলো নিবে এল একে একে, অন্ধকার হল সর্বত্র, শীতের কনকনে ভাবটা গায়ে লাগল শৈলেশের।
বিছানায় শুয়ে শৈলেশ চোখ বুজে পড়ে থাকল। অনিলা তার অধিকারের এক ফোঁটাও ছাড়তে রাজি না। এতদিন সে এ-বাড়ির এবং শৈলেশের সর্বেসর্বা হয়ে থেকেছে, সে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও আধিপত্য ভোগ করেছে যাতে তার কোথাও কোনো দাবি নেই, তা ভোগ-দখল করে বসে থাকতে থাকতে এখন সে একটা স্বত্বলাভ করেছে। লোভীর মতন, শঠের মতন এখন সে সেই স্বত্ব হারাতে চায় না। সেই অধিকার তার হাত থেকে চলে যাবে এই চিন্তায় অনিলা নোংরা কুৎসিত ও বেপরোয়া হয়ে গেছে, নির্লজ্জ হয়েছে।
অনিলাকে এখন শৈলেশ মনে মনে ঘৃণা করছিল।
পরের দিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে শৈলেশ অনিলাকে আর বাড়িতে দেখতে পেল না। তার কোথাও যাওয়ার কথা নয়, যায়ও কদাচিৎ, ভবানীপুরে নির্মলা আশ্রমে যায়। যেতে হলে বলে যায় শৈলেশকে। এ ছাড়া পুরনো পাড়ার সুষমাদির কাছে কখনও-সখনও।
অনিলা কোথায় গেছে শৈলেশ বুঝতে না পারায় বিরক্ত হল, ঝিকে একবার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলেও শেষ পর্যন্ত কিছু জানতে চাইল না। যথারীতি চা খেল, কাগজ দেখল, দাড়ি কামাল। শীতের বেলা, দেখতে দেখতে ন’টা বাজল। স্নান সারল শৈলেশ। ঝি রান্না শেষ করেছে, অনিলা ফেরেনি। ভাত খেয়ে পোশাক পালটাতে পালটাতে একবার মনে হল অনিলা ফিরেছে, পরে বুঝল ঝি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাশের বাড়ির কারও সঙ্গে কথা বলছে।
অফিসে বেরুবার সময় নিজের ঘরটা তালা বন্ধ করে দিল শৈলেশ। ঝিয়ের জিম্মায় বাড়িঘর খোলা থাকল বলে তার দুর্ভাবনা হল না, তার রাগ হল এই ভেবে যে, অনিলা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে। সে কি এই বাড়ি ত্যাগ করে গিয়ে শৈলেশকে জব্দ করতে চাইছে? করুক না। অনিলাকে আশ্রয় দেবার মতন কত যে লোক আছে কলকাতায় শৈলেশ জানে! দুটো মিষ্টি কথা একবেলা কি দু বেলা বলবে, তারপর?
শৈলেশ যখন ট্রামে তখন শুনল: সকালে টালিগঞ্জের ব্রিজের কাছে একটি মেয়ে কাটা পড়েছে, খুব ভোরে। শোনামাত্র তার বুকের মধ্যে কেমন একটা আতঙ্ক লাফিয়ে উঠল। কেউ জানে না কতবড় মেয়ে, কেউ বলল বউ, কেউ বলল বয়স্কা মেয়ে।…অনিলা কিন্তু গাড়িটাড়ি চড়ায় তেমন অভ্যস্ত নয়, বাড়ি থেকে একা খুবই কম বেরোয়! পথঘাট সে খুব একটা চেনে এমন মনে হয় না।
অফিসে পৌঁছে শৈলেশের কিছুতেই মন বসছিল না। এতক্ষণ সে রীতিমত এক উদ্বেগে অসহায়তা বোধ করতে লাগল। কোথায় গেল অনিলা? কার কাছে গেল? রাগ করে পথে নামা কঠিন নয়, কিন্তু এই শহরের পথ হাঁটা মুশকিল; এমন কি অনিলার মত আঠাশ উনত্রিশ বছরের যুবতীর পক্ষে জীবনের পথ হাঁটাও মুশকিল।
শিবু বা মজুমদারকে কথাটা বলে পরামর্শ চাইলে হত। কিন্তু সেটা আরও কেলেঙ্কারীর হবে। মানুষের চোখ বড় সন্দেহপরায়ণ।
অনিলা কি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে এসে আত্মহত্যা করল! আত্মহত্যায় শৈলেশের বড় ভয়। জিনিসটা নাটকীয় বটে, তবে কেলেঙ্কারীর একশেষ। অনিলা আত্মহত্যা করবে না। করলে— শৈলেশ ভাবল, তার কপালে থানা পুলিশ লোকনিন্দা অপবাদ সন্দেহ— আরও কত কি! ভাবতে গা শিউরে ওঠে, বুকের মধ্যে মস্ত একটা বোঝা যেন চেপে বসে।
রাগ আর হচ্ছে না, এখন অনিলাকে তার ঘৃণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে— এই মেয়েটি তার জীবনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। অনিলা ইতর, অনিলা নৃশংস।
দুপুর গড়াবার আগেই শৈলেশ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে সে অধীর হয়ে উঠেছে। কি হবে? কোথায় গেল অনিলা? কেন সে এ রকম ছেলেমানুষি করল?
প্রথমে পুরনো পাড়ায়, সুষমাদির পাড়ায়। না, সেখানে যায়নি অনিলা।
শৈলেশ ফিরল। উদ্বেগের ভার এখন তার সমস্ত মনে! আতঙ্ক এবং অসহায়তা ক্রমশই তাকে দুর্বল ও নির্জীব করছিল। কোথায় পাওয়া যাবে অনিলাকে। তাকে কি পাওয়া সম্ভব আর? থানা পুলিশ করবে শৈলেশ? হাসপাতালে খবর নেবে?
ট্যাক্সি করে সেই নির্মলা আশ্রমে। না, অনিলা আসেনি।
শীতের দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন। প্রায় বিকেল। শৈলেশ পথ হারানো বাচ্চা ছেলের মতন চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ যেন কেঁদে ফেলার উপক্রম করল! না, কাঁদল না— অথচ সে অনুভব করল, তার চারপাশ শূন্য হয়ে গেছে। সে বস্তুত হারিয়ে গেছে, কিংবা হারিয়ে ফেলেছে কিছু।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিল শৈলেশ, কোথায় যাবে আর? গঙ্গার দিকে যাবে? কি হবে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে। কলকাতা শহরে গঙ্গা কি মাপজোকা!
রিকশা পেয়ে শৈলেশ চেপে বসল। বলল, টালিগঞ্জ চল।
যেতে যেতে শৈলেশ একসময় অনুভব করল, সে যেন অনিলার মৃত্যুসংবাদ কোথাও পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরছে এবার বাড়ি ফিরে অনিলার সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। আশ্চর্য! সমস্ত মন কেমন ফাঁকা, সব শূন্য বলে মনে হয়; শীতের ধুলো, নিরুত্তেজ রৌদ্র, একটি ট্রাম গেল কি এল, বাসের হর্ন— সমস্তই যেন তাকে অনিলার মৃত্যুসংবাদ দিচ্ছে, কানে কানে। কেন এরকম মনে হয়। অনিলা তার কে? আত্মীয় নয় অনাত্মীয়। সে-মনোরঞ্জনের স্ত্রী, তার স্ত্রী নয়!
অথচ শৈলেশ সহসা অনুভব করল অনিলার সঙ্গে তার সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা, বসবাস এবং জীবনযাপনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত নৈকট্য ছিল, স্ত্রী নয় অনিলা— কিন্তু মানুষের একটা সম্পর্ক বাদ দিলে অন্য যে হৃদয়সম্পর্ক এবং অবলম্বনের সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে থাকে, অনিলার সঙ্গে তার সেই রকম কোনো সম্পর্ক ছিল। শৈলেশ শোভনতা, সভ্যতা ও দায়িত্বকে অতিশয় মূল্য দিয়েছে, যদি না দিত তবে—
তবে কি? …না, কিছু না! মনোরঞ্জন যে-বিশ্বাসে অনিলাকে তার সংসারে এনে দিয়ে বলেছিল, “এখন তোর কাছে থাক—”, সেই বিশ্বাসও একটা দায়িত্ব বই কি! শৈলেশ যথাসাধ্য তা পালন করেছে। হয়ত আজীবন করত।
অদ্ভুত এক হাহাকার এবং পরিপূর্ণ বেদনা নিয়ে শৈলেশ বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামল!
সদর খোলা। বাড়ির কোথাও রোদ নেই, ছায়া নেমে সিঁড়ি ঠাণ্ডা হয়ে আছে! কলে জল পড়ছে। দুটি চড়ুই উড়ে গেল। সাড়াশব্দ নেই কোথাও। ফাঁকা যেন, খাঁ খাঁ করছে। ঝি বুঝি ঘর মুছছে। শৈলেশ সিঁড়িতে পা দিল। মা মারা যাবার পর ঠিক এই রকম বিকেলে সে বাড়ি ঢুকেছিল।
অবর্ণনীয় এক স্তব্ধতা ও শোক অনুভব করল শৈলেশ। হয়ত অনিলাও চলে গেল। তার কোথায় লেগেছিল, শৈলেশ এখন বুঝি অনুভব করতে পারছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে আসতে শৈলেশ কেঁদে উঠেছিল প্রায়, হঠাৎ মুখ ফেরাতে অনিলার ঘর তার চোখে পড়ল। দাঁড়াল শৈলেশ, অপলকে সেই ঘর দেখল, দরজা খোলা, পরদা দুলছে।
অবশ ও কম্পিত পায়ে শৈলেশ শেষ সিঁড়ি উঠল। কোনো শব্দ নেই, কাউকে দেখা যায় না। পায়ে পায়ে অনিলার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল; কান পাতল। কিছু বোঝা যায় না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শৈলেশ দাঁড়িয়ে থাকল, পরদা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিতে তার সাহস হচ্ছিল না।
অনেকক্ষণ পরে ঘরের মধ্যে সামান্য শব্দ পাওয়া গেল।
শৈলেশ পরদা সরাল না, কিন্তু সে সমস্ত দিনের ভয়ঙ্কর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা, অসহায়তা ও বেদনা থেকে যেন মুক্তি পেল।
এই স্বস্তিটুকু অনুভব করে শৈলেশ শান্তি পেল এবং দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।